অবহেলার শেষে পর্ব ৫

#__অবহেলার__শেষে__ (৫ম পর্ব)
#__লেখক_সালাহ্উদ্দিন_তারিক

যাকে এতো বছর ধরে ভালোবাসি। যার মায়ায় আমি স্বামী সংসার ছেড়ে চলে এসেছি। যার জন্য আমার স্বামীর মনে কষ্ট দিয়েছি৷ আমার অসুস্থ শাশুড়ীকে মন কষ্ট নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করতে হয়েছে। সে কিনা আজকে বলল, “আমি কেবল তোমার টাকা গুলোর জন্যই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম,এখন তুমি নাকি টাকাই খরচ করতে পারবে না।আমি অতো টাকা কোথাও পাবোও না, আর বিয়েও করতে পারব না। আর বাড়িতে আমি একজন অবিবাহিত ছেলে হয়ে যদি একটা ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ের কথা বলি তবে আমার বাবা আমাকে ত্যাজ্য পুত্র ও করতে পারেন। আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না৷ আর ভালো ও বাসি না।আমাকে আর ২য় বার কল দিবে না।”

আমি কার জন্য এতো কিছু করলাম। কার জন্য? কার জন্য সব কিছু ছেড়ে চলে আসলাম! আমার আর কিছুই ভালো লাগতো না।

আমার বাড়িতে প্রতিনিয়ত আমার স্বামীকে নানান কথা বলতে থাকে। আগে সহ্য হলেও পরে আর আমার ওই কথা গুলো সহ্য হয়না৷ উনি কেন এতো কথা শুনবেন? ওনার তো কোন দোষ ছিল না। ওনার মাঝেতো কোন কিছুরই কমতি ছিল না৷ আমিই তো ভালোবাসা গুলোকে দুরে ঠেলে দিয়েছি। কেন করলাম আমি এই সব, কেন?একটা বার এর জন্য আমি ওনার কথা ভাবলাম না! আমি এতোটাই সার্থপর হয়ে গেলাম! উনি কি কখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারবেন? আর কি কোন সুযোগ আছে আমার ওনার কাছে থেকে ক্ষমা নেয়ার?

এমন হাজারটা প্রশ্ন আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করতে থাকে। বিবেকের ছুঁড়ে দেওয়া প্রতিটা গভীর প্রশ্ন আমার হৃদয়টাকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে৷ আমার মন চায় যদি একটি বারের জন্য হলেও উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে পারলাম। চোখের পানিতে ওনার বুকটা ভিজিয়ে দিতে পারতাম। হয়তোবা উনিও আমাকে জড়িয়ে বলতে, “আর কাদতে হবে না,ভালোবাসি তোকে,খুব ভালোবাসি কথা দে আর কখনো ছেড়ে যাবিনা।”

আমি তখন ওনার বুকে মুখ লুকিয়ে বলতাম, “এ জীবন যত দিন আছে কখনো আর ছেড়ে যাবোনা।শুধু একটি বার আপনার বুকে ঠাঁই দিবেন আমায়?”

কিন্তু?
এই কথা গুলোকে কেবল কল্পনায় জায়গা দেয়া যায়৷ বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। আমি কী কখনো ওনার সামনে দাঁড়াতে পারব? ওনার চোখে চোখ রাখতে পারব?ওনার বুকে মাথা রাখতে পারব? শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরতে পারব?
জানিনা কখনো সম্ভব কিনা। আমি পারব না আমি হয়তো পারব না। তবে আজ কেন জানি মনে হচ্ছিল হ্যাঁ আমিও ওনাকে খুব করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম৷ ঐ পুরোনো সিম কার্ড। সেই ৩ বছরের মায়া আমাকে শেষ করে দিয়েছে আমার ভালোবাসাকে শেষ করে দিয়েছে।

এসব ভাবতে ছিলাম ঠান্ডা ফ্লোরে বসে।কাঁদতে ও শরীরের অনেক শক্তি ব্যায় হয়।তাই খুব ক্লান্ত লাগছিল। একটু ঘুমালে মনে হয় ভালো হতো। এই ভেবে ফ্লোর থেকে উঠে বিছানার কাছে যেতেই ঝুনঝুন শব্দ আমার কানে বাজতে থাকে। হ্যাঁ ই
ঐ দিন আসার সময়ে পায়েল গুলো রেখে আসিনি। উনিও আমাকে বারন করে নি। হয়তোবা ভালোবাসতেন বলেই কিছু বলেনি। নতুবা আমার সাথে আর কথা বলার কোন রুচি হয়নি। তাই আমার ও আর রাগের সময় খেয়াল হয়নি।

বিছানায় বসে এক নজরে তাকিয়েছিলাম পায়েল গুলোর দিকে। রেডিমেড জিনিস নয়। অর্ডার দিকে বানানো৷ একটা পায়েল খুলে প্রতিটা অংশ ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখছিলাম৷ খোদাই করে খুব সুন্দর করে লিখাছিল। “A”..
আবার একটু দুরেই লেখা ” I”..একটু উচু করে আঁকা ❤.. তারপরই লেখা “U”..
এই ছোট ছোট সংক্ষিপ্ত লেখা গুলোর মানে সবাই বুঝে। আমি ও সেদিন বুঝেছিলাম। পায়েলটা বুকে জড়িয়ে অনেক কান্না করি। এতো ভালোবাসা জমাছিল আমার জন্য। আর আমি একটুও অর্জন করতে পারলাম না। পায়েলেই কি কেবল এটা লিখা ছিল! না প্রতিটা জিনিসেই এভাবে লেখা ছিল! আর আমি সেগুলোকে আমার গলায়,আমার হাতে এক জায়গায় ও স্থান দিতে পারলাম না।শুধু মাত্র পায়েই স্থান দিতে পারলাম। আমি নির্বোধ সব চেয়ে বড় নির্বোধ। বৈধ ভালোবাসা গুলোকে দুরে ঠেলে দিয়ে একটা অবৈধ মায়ায় জড়িয়ে ছিলাম৷ অন্ধকার হয়ে আসে আমার পৃথিবীটা।

অনেকে হয়তোবা ঐ সময়ে আত্মহত্যা করেও ফেলত৷ কিন্তু আমি করিনি। আমার যে সেই হারানো ভালোবাসা পেতেই হবে। এ পৃথিবীতে যদি না-ও পাই। পরের জগতে হয়তোবা পাবো। আর যদি আত্মহত্যা করি তবে তো আর কোন জগতেই আমি সেই ভালোবাসা পাব না। সেই চিন্তায়ই বেঁচে ছিলাম। (এই গল্প পুরোটা পড়তে চাইলে গল্পের শেষে লেখা কথা গুলো অবশ্যই পড়বেন)

প্রতিদিন ভাবতে থাকি ওনাকে একটু ফোন দেই অন্তত। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। আমি পারি না ফোন দিতে। এভাবে প্রায় ১০ দিন কেটে যায়। মনে হয় আরো বেশি ও হতে পারে। একদিন রাতে খেতে বসেছি তখন একটা মেসেজ আসে। আমি খাওয়া শেষ করে আর সেটা দেখতে মন থাকেনা। পরে রাতে ঘুমানোর আগে ফোন হাতে নিলে মেসেজ টা দেখি। মেসেজ টা আমার স্বামীর নাম্বার থেকে এসেছে।

আমি তাড়াতাড়ি সেটা পড়তে উঠে বসি। অনেক বড় একটা মেসেজ, কি রেখে কি পড়বো আমি বুঝতে পারিনা। অবশেষে শুরু থেকে খুব মন দিয়ে পড়তে শুরু করি।
উনি লিখেছেন, “কেমন আছো? আশাকরি খুব ভালো আছো।আমি কেমন আছি তা বল্লেও চলবে৷ আজ আম্মু মৃত্যুর ৪০ দিন হলো৷ যদিও এই দিন হিসেবে বিশেষ কোন কিছু নেই৷ তবুও আমি এই দিনটা একটা বিশেষ দিন ধরে নিয়েছিলাম। ইসলামী শরিয়তে ৪০ খুব প্রশংসনীয়, তাই আরকি৷ আমি ঠিক করে রেখেছিলাম আম্মুর মৃত্যুর ৪০ দিন পর্যত্ন তোমাকে সময় দিব।কিন্তু তুমি! এই দিন গুলোর মাঝে একটা বারের জন্যও যোগাযোগ করনি। কি দোষ করেছিলাম।না হয় রাগের মাথায় একটা থাপ্পড়ই দিয়েছিলাম৷ কই এতো দিন তো কিছু বলিনি৷ তোমার এতো অনিয়মের পরেও কিছু বলিনি৷ কিন্তু যেদিন শুনি যে আমার আম্মু সব জেনে গেছে। ঐদিন থেকে আমার রাগ চলে আসে৷ তবুও তোমাকে এই কয়দিনের সময় দিয়েছিলাম। খুব ভালোবাসতাম তোমাকে। খুব খুব। তাই সহজেই ভুলতে পারিনি৷ তুমি নিজে যদি ডিভোর্স টা দিতে তবে তোমার বাড়িতে অনেক সমস্যা হতো তাই বাধ্য হয়ে আমিই ডিভোর্স দেই। আজ প্রায় ২২ দিন হয়ে গেছে তুমি চলে গেছ। একটা বারের জন্য মনে হলোনা যে আমি একা একা কিভাবে চলি! কে রান্না করে দেয়৷ কিভাবে সময় মতো অফিসে যাই৷ আমি কি ঠিক মতো অফিসে যেতে পারি,ঠিক সময় মতো খেতে পারি, সময় মতো ঘুম থেকে উঠতে পারি! একটা বারের জন্যও জানতে মন চাইলোনা? আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি তারও খোঁজ নাও নি। ঐদিন আমার অফিসে এসে সবার সামনে তোমার বাবা আমাকে প্রায় ৩০ মিনিট নানান কথা বলেছে৷ কতোটা অপমান করেছে সবার সামনে৷ একটা বারও আমি উনার দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারিনি৷ একবার ও বলিনি যে আমি কিছুই করিনি আপনার মেয়ের জন্যই এই সব হয়েছে। বললে হয়তো তুমি অনেক কথা শুনতে। লোকে তোমাকে খারাপ ভাবতো, তুমি অনেক বকা খেতে। তাই ঐদিন তোমার নামে কোন অভিযোগ করতে পারিনি। কেন জানো! বড্ড ভালোবাসতাম যে তোমাকে। অফিসের কলিগ রা আমায় বাজে ছেলে ভেবেছে ঐদিন। কিন্তু আমি একবার ও তাদের ভুল শুধরে দেইনি। কারন একটাই বড্ড ভালোবাসতাম তোমাকে। কিন্তু তুমি একটু ভালোবাসনি আমাকে৷ একটু ও না। তাই প্রতিটি মুহুর্তে কষ্টে কষ্টে তোমাকে ভুলতে শিখেছি। একাকী বাঁচতে শিখেছি। হ্যাঁ এখন থেকে আর ভালোবাসি না তোমাকে। না একটু ভালোবাসি না। সব ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে। এখন তোমার জন্য আমার মনে কেবল ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই। ক্ষমা করে দিও তোমার জীবনের অনেকটা সময় আমার কারনে নষ্ট হয়ে গেছে। আর একটা কথা আজ থেকে আর কোন সম্পর্কে নেই তোমার সাথে। তাই আর আমার খোঁজ নেয়ার ও প্রয়োজন নেই৷ আর কোন ফোন দেয়ার ও প্রয়োজন নেই । ভালো থাকবেন!”

মেসেজ টা পড়ার পর আমার কেমন লাগছিল তা আমি নিজেও বলতে পারব না। আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম ঐদিন। অতো কান্না আমি জীবনেও করিনি। আমার ঘরটা থেকে আব্বুর ঘর দুরে, ভাইয়ার ঘর থেকেও দুরে। আর রুমের দরজা ও লাগানো তাই কেউ শুনতে পায়নি আমার কান্না। সারাটা রাত ঘুমাতে পারিনি। কান্নায় কান্নায় কাটে পুরো রাত। শেষ রাতে ক্লান্ত হয়ে একটু ঘুমাই।

সকাল বেলা ঘুম থেকে দেরীতে উঠি। তখন রান্না প্রায় শেষ তবুও ভাবীকে সাহায্য করার জন্য যাই৷ ভাবী আমার দিকে তাকিয়েই বলতে থাকে, “অবন্তী তোমার চোখ এমন লাল কেন,ঘুমাও নি ঠিক মতো”?
আমি বলি, ” হুম ভাবী ঘুম হয়নি বেশী”।
ভাবী বলে, “তোমাকে বলছি না কান্নাকাটি করবে না৷যে কিনা ২ মাসের বউকেই ডিভোর্স দিয়ে দেয়৷ তাও মা মরার ১৫ দিনের মাঝেই ঐ রকম বাজে লোকের জন্য কান্নার কোন মানে হয়না৷ আমরা আছি না কোন টেনশন করবা না।”
আমি বলি, “ভাবী প্লিজ ওনাকে কিছু বলবেন না।”

ভাবী রাগে ফুলতে ফুলতে বলে, “এহ দরদ উতলায়া পরতাছে এই সব হারামির জন্য কিসের দরদ এতো। ”

আমি শুধু বলি, “ভাবী প্লিজ এখন কিছু বলো না, রাতে তোমার সাথে কথা আছে। সবাই ঘুমালে তারপর আমার রুমে এসো।”

ভাবী বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে। যাও এখন গিয়ে ভালো করে হাত মুখ ধোও চোখ যেন লাল না থাকে”।

আমি এসে হাত মুখ ধুয়ে নিই ভালো করে। যেন আব্বু আম্মু লাল চোখ না দেখে।
রাতে খাওয়ার পরে সবাই যখন ঘুমিয়ে যায়। তখন ভাবী আমার রুমে আসে। আমি ভাবীকে আস্তে আস্তে সব বলি।
কথা শেষ হতেই ভাবী জ্বলজ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর হঠাৎই জোরে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেয় আমার গালে। আমি হতভম্ব হয়ে গালে হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

(চলবে…..) (

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here