অস্তিত্বে_তুমি পর্ব ২০

#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_২০
#সুলতানা_পারভীন

-জিশান? কার কথা বলছেন? কে রাজকন্যা কে রাজপুত্র আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না জিহান। আর জিশানই বা আপনাকে বাবা বলে ডাকছে কেন? প্লিজ ক্লিয়ার করে বলবেন আমাকে?

জিহানের বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে মাথার মধ্যে তালগোল পাকাতে শুরু করেছে নীলার। এতো কমপ্লিকেটেড কথাবার্তা শোনার ফাঁকে রান্না করায় কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না মেয়েটা। আাপতত তাই কাজ ফেলে জিহানের কথা শোনায় মন দেয়ার চেষ্টা করলো। অন্তত তাতে যদি কিছু হলেও বুঝতে পারে আসলে জিহান কি বলতে চাইছে। এদিকে জিহানও নীলার হতভম্ব মুখটার দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে আবার বলা শুরু করলো।

-গল্পের সেই রাজকন্যার ছোটো ভাইটা হলাম আমি নীলা। সেই রূপকথার গল্পের মতো সুন্দর, সুখী পরিবারের গল্পটার মতো আমার পরিবারটা সেদিনের একটা ঘটনায় পুরো তছনছ হয়ে গেছে নীলা।
চোখের সামনে আমার বোনকে ভেঙ্গে পড়তে দেখেছি। সবার অপবাদের আঙুল যখন ওর বাচ্চাটার দিকে উঠেছে তখনও নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল সেই অপমানের মোকাবেলা করার। ও তো কোনো পাপ করে নি, কোনো অন্যায় করে নি। ভালোবেসেছিল। সবাই যতই খারাপ কথা বলুক না কেন ওর সন্তানটা তো পাপের ফসল ছিল না। ওদের ভালোবাসার ফসল ছিল, দুই পরিবারের বৈধ উত্তরাধিকারী ছিল সেই অনাগত শিশুটা। অথচ একজন মানুষের, মানুষ কি বলছি, ওই অমানুষের ধোঁকায় একনিমিষেই ওদের সন্তানটাকেও সমাজের নজরে অবৈধ বানিয়ে দিয়েছিল সেদিন। তবু আমার বোনটা হাল ছাড়ে নি জানো? ওই অমানুষটাকেই বিশ্বাস করে অপেক্ষা করছিল তার ফিরে আসার। সমাজের হাজারটা লোকের হাজার কুকথা মুখ বুজে সহ্য করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল আমার বোনটা।

জিহানের কথাগুলো শুনতে শুনতে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল নীলার। কেন জানে না মনে হচ্ছে এই ঘটনার সাথে নীলার নিজের কেউ জড়িত আছে। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব?

-জানতে চাইবে না নীল সেই বিশ্বাসঘাতক, অমানুষটা কে ছিল?

-কে?

-তুমি তখন অনেক ছোটো ছিলে নীলা। সবটা বোঝার মতো বয়স হয়েছিল হয়তো, বাট ততটুকুই দেখেছো যতটা তোমার চোখের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই কে ভুল, কে ঠিক সেটাও অন্য কারো সিদ্ধান্তটাই তোমার নিজের ভেবে ভুল করেছ। আচ্ছা বলো তো নীল? তোমার বাবা আর ভাইয়ের সাথে আমার বিজনেস রাইভেলের বাইরেও যে আলাদা একটা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে জানো সেটা? কেন তোমার না চাইতেই সবকিছু সামনে এনে দেয়া বাবা, ভাইয়া তোমার হাজার কান্নার পরও তোমাকে আমার হাতে তুলে দিতে চায় নি জানো?

-আমি সত্যিই জানি না। বাবা, ভাইয়া সবাই ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে যতবার জানতে চেয়েছি ততবারই। ভাবিমা তো বলতে চায়,বাট ভাইয়ার কারণে বলতে পারে নি। তারপরও তো ওই ঘটনার পর বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়ার পর ভাবিমার কাছে একটা নাম শুনলাম। কায়রা। ভাইয়া কি রেগে গেছিল নামটা শুনে। আর আজ আপনার মুখেও নামটা শুনলাম আবার। এই নামটা কেন জানি পরিচিত মনে হয় আমার খুব। কে এই কায়রা বলুন না প্লিজ?

নীলার প্রশ্নটা শুনে জিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দরজার দিকে মুখ করে বলা শুরু করলো আবার।

-একটু আগে তোমাকে যার গল্প শোনালাম, সেই রাজকন্যার মতো মেয়েটাই ছিল কায়রা। ছোট্টো জিহানের বেস্টফ্রেন্ড, বাবা মায়ের চোখের মণি, সদ্য কৈশোরে পা রাখা এক কিশোরের সমস্ত বদমাইশির সঙ্গী। আমার ছোট্ট জিশানকে দেখলে না? ওর মা। আর——-।

-আর?

-আর? প্রায় সাতটা বছর আগে তোমার ভাই বিয়ের স্টেজ থেকে যাকে বিয়ে না করে নিহার ভাবিকে বিয়ে করেছিল, সেই মেয়েটাই ছিল কায়রা। তুমি তখন অনেকটাই ছোটো ছিলে নীল। তোমার মনে নেই হয়তো। কিন্তু কায়রা একদম আগের মতোই আছে। ভুল বললাম, বাইরে থেকে দেখে আগের মতোই একই আছে বলে ভুল হবে তোমারও। কিন্তু ভিতরটা পুরো মরে গেছে মেয়েটার। লাশের মতো বেঁচে আছে, অনেক চেষ্টা করেছিল সবটা ভুলে, সবার কটু কথাকে উপেক্ষা করে শুধু নিজের সন্তানটাকে নিয়ে বাঁচতে। কিন্তু এই ভদ্রলোকের মুখোশধারী সমাজের লোকগুলো ওর সেই সাহসটুকুও কেড়ে নিয়েছিল। তাই হয়তো আমার বোনটা বেঁচে থাকার শেস ভরসাটাও হারিয়ে ফেলেছিল। তাই নিজের সন্তানটাকে নিয়েই এই নষ্ট লোকে ভরা পৃথিবীটা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চেয়েছিল।

জিহান দরজার দিকে মুখ করে কথাগুলো বলছিল। ছেলেটার চোখের কোণা বেয়ে টপটপ করে ঝড়ছিল বলে ঝাপসা চোখে নীলার রিএকশনটা দেখতেই পায় নি জিহান। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে নীলার থতমত খাওয়া পাংশু মুখটা দেখলো জিহান। নীলার হাতটা ধরে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নিজেই রান্নার বাকি কাজে মন দিলো জিহান। নীলা জিহানের পড়নের টিশার্টটা খামচে ধরতেই জিহান কাজ করতে করতেই নীলার দিকে ফিরে তাকালো। নীলা কি বলবে বুঝতে না পেরে জিহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। জিহান আবার রান্নায় মনোযোগ দিচ্ছে দেখে নীলা আবার জিহানকে আঁকড়ে ধরে নিজের দিকে টানলো আরেকবার।

-মানে? কি বলছেন বলুন তো জিহান? নিজের সন্তানকে নিয়ে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চেয়েছিল মানে? তাহলে জিশান? আর লাশের মতো বেঁচে আছে মানে? কায়রা আপু কোথায় এখন? কি হয়েছে উনার? আর বারবার কেন বলছেন ভাইয়া ধোঁকা দিয়েছে? ওই দিন কি ঘটেছিল কায়রা আপুর আর আপনার ফ্যামেলির সাথে বলবেন প্লিজ?

-হাহ। ওইদিনের ঘটনাটা আমার আমৃত্যু মনে থাকবে জানো নীল? কায়রা আপু আবরার ভাইয়াকে বাসায় পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ভাইয়ার সাথে কত ঘুরেছি, কত আড্ডা দিয়েছি, আজও মনে আছে আমার। তোমাদের বাবা এই বিয়েতে কিছুতেই রাজি ছিল না। যা হোক, আবরার ভাইয়ার জেদের কারণেই সেদিন কায়রা চুপচাপ কাউকে না জানিয়ে বিয়েটা করতেও রাজি হয়ে যায়। অথচ জানো? দুটো বছর পর দুটো পরিবার রাজি হওয়ার পর কি ঘটেছিল জানো নীল? বিয়ের আসরে কায়রা হঠাৎ করেই যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন আমরা কায়রাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটছিলাম, আর তোমার পরিবার? কায়রা হসপিটালে এডমিট জানা স্বত্বেও তোমার বাবা কি করলো? জোর করে তোমার ভাইয়াকে বাধ্য করলো নিহার ভাবিকে বিয়ে করতে। আর তোমার ভাই? মিস্টার আবরার খন্দকার। একটা সিদ্ধান্তে দুটো মেয়ের জীবনের সাথে সাথে একটা নতুন আশার যে কিরণ দেখা গিয়েছিল সেটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

-মানে? কিন্তু সেদিন——। কায়রা আপু এখন জিহান?

-আছে। আছে বেঁচে আছে। অবশ্য এটাকে বাঁচা বলে না মরাও বলে না। একদিন তোমাকে নিয়ে যাবো কায়রার কাছে।

-কিসব বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। কায়রা আপুর কাছে নিয়ে যাবেন তো বুঝলাম, কিন্তু কোথায় সেটা? আর কবে নিয়ে যাবেন? আর জিশান——।

-জিশানের জন্মের পর ওকে সামলানোর মতো কেউ ছিল না। মাত্র ভার্সিটিতে এডমিট নিয়েছি। বাবা মা, নিজের পরিবার হারিয়ে মামা মামির দয়ায় শুধু বেঁচে ছিলাম নামমাত্র। এর মধ্যে ছোট্টো জিশানকে সামলানোর জন্য কি করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এতো ছোট্টো একটা বাচ্চা মাকে ছাড়া বেঁচে থাকার লড়াই করছে, অথচ ওর জন্য আমার কিছুই করার ছিল না। শেষে সবার কথায় জিশানকে একটা ফুলটাইম নার্সিং হোমে দিয়ে দিই। অনেকটা ফুল ডে ডে-কেয়ার হোমের মতো। তারপর কয়েকটা বছর কেটে যাওয়ার পর একটা বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেয়া হলো জিশানকে। দেখতে দেখতে আরো কতগুলো বছর কেটে গেছে। বোর্ডিং স্কুলে জিশান ওর বয়সী বাচ্চাদের কাছ থেকে বাবা মায়ের পরিচয় নিয়ে কথা না শুনলেও ওদের বাবা মাকে দেখে কেঁদে দুনিয়া ভাসাতো। মন খারাপ হলেই মায়ের বেডের পাশে বসে ‘মা, মা’ করে কাঁদতে পারলেও বাবা বলে ডাকার কেউ ছিল না জিশানের। তাই আমিই ওকে বলে দিয়ে আমাকেই পাপা বলে ডাকতে। তাতে অন্তত ছেলেটার একটু হলেও ভালো লাগবে।

-জিশানকে বোর্ডিং স্কুলে? কেন?

-ওকে সামলানোর মতো কেউ ছিল না তাই। মামা বিজনেস নিয়ে বিজি, মামী সংসার সামলাতে ব্যস্ত, মুগ্ধা আর আমি বাচ্চা সামলাবো কি বলো? নিজেদেরকেই সামলাতে আরো তিনজন লাগে অবস্থা। তাই কি আর করা।

-এর পর থেকে জিশান কোথাও যাবে না জিহান। ও আমাদের সাথেই থাকবে।

-সিরিয়াসলি নীল? আর ইউ সিরিয়াস?

নীলার জিহানের কথাটার উত্তর দেয়া হয়ে উঠলো না। এর আগেই ছোট্টো ছোট্টো দুটো হাত নীলাকে পিছন থেকে জাপটে ধরেছে। আর একটা ছোট্টো শব্দ মধুর সুরের মতো নীলার কানে এসে বাজলো।

-মামনি।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here