আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব -১৪

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(14)

বধূ বেশে নূর বসে আছে নিজের রুমে। চারিদিকে মানুষের হৈ হট্টগোল বিরক্তিকর লাগছে তার কাছে আ*ত্ম*হ*ত্যা যদি হা*রা*ম না হতো তাহলে সেটাই বেছে নিত নূর নিজেকে একটু একটু করে শে*ষ হয়ে যাওয়ার পথে ঠেলে দেওয়ার থেকে ভালো অন্তত সেটা হতো।

বিয়ে বাড়ির সবার মধ্যে খুশি খুশি আমেজ। হবে নাই বা কেন বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। মধ্যবিত্ত হলেও একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোন কমতি রাখেননি নূরের বাবা। উচ্চবিত্ত পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে বেশ ধার দেনা পোহাতে হচ্ছে তাকে, তারপরও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে সব করে যাচ্ছেন তিনি। চোখে মুখে ফুটে ওঠা খুশির ঝিলিক দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে খুব মূল্যবান কিছু পেতে চলেছেন তিনি। নূর কিভাবেই বা পারতো এই মানুষটার খুশি শেষ করে দিতে। কিভাবে পারত বলতে তার অসীম ভালবাসার কথা।

বিয়ের বেনারসি সাথে ভারী ভারী গয়না, ব্রাইডাল মেকাপ সবমিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর লাগছে নূরকে। নূরকে দেখে প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে নুর। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু হারাতে চলেছে সে একেবারের মতো। হারাতে চলেছে তার আদিত্যকে, তাদের সম্পর্ককে সারা জীবনের মতো। অনেক দূরে চলে যেতে চলেছে আদিত্য থেকে, যেখান থেকে চাইলেও আর কখনো ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না।

“আমাকে মাফ কোরো আদিত্য। তোমাকে বলা প্রত্যেকটা কথা তোমার থেকে বেশি আমাকে ক্ষ*ত বি*ক্ষ*ত করেছে। কখনো তোমাকে বলতে পারব না কতটা ভালোবাসি তোমাকে। কখনো বোঝাতে পারবো না আমার পরিস্থিতির কথা। কি দোষ করেছিলাম আমি বলতে পারো? জীবন আমাকে এমন জায়গায় কেন দাঁড় করালো? তুই ঠিকই বলেছিস অরু, তোর নূর এমন না। এই নূরকে তোরা চিনিস না। ভালোবাসায় বিলীন হয়ে যাওয়া নূর আজ অর্থের জন্য আদিত্যকে ভুলে যাবে কিভাবে ভাবলি। আমি যে অপা*রগ। জীবনের ঊনিশ বছরের ভালোবাসার কাছে দু’বছরের ভালোবাসা ভারি পড়ে গেছে। আমি পারবোনা আব্বুর মৃ*ত দেহ দেখতে, পারবোনা আব্বুর লা*শে*র উপর থেকে গিয়ে আদিত্যর সাথে সংসার করতে। আমি পারলাম নাহ নিজের কথা রাখতে আদিত্য”

“বিয়ের দিন বিয়ের কনে অজ্ঞান।”

লোকমুখে কথাটা পুরো বিয়ে বাড়িতে ছড়িয়ে গেছে। বেডের মাঝ বরাবর নুরকে শুইয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দেন নুরের আব্বু। মেয়ের হঠাৎ করে এমন অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে অনেকটাই ভয় পেয়ে যান তিনি, না জানি পাত্রপক্ষ কিভাবে নেয় ব্যাপারটা। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে পাত্রের মা নিজে এসে নূরের পাশে বসেন এবং তাদের আশ্বস্ত করেন। জ্ঞান ফিরতেই মাথায় বিশ্বস্ত এক হাত দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে নূর। পাশে যে একজন অ*গ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছে সেটা বেশ অনুধাবন করতে পারছে নূর।

বেশ বি*ধ্ব*স্ত অবস্থাতেই সম্পন্ন হয় নূরের বিয়ে। পাশে থাকা যুবকটা এখন থেকে তার স্বামী, অথচ সেই মানুষটির নামটাই সে এখনো জানেনা। সেদিনের আদিত্যকে বলা কথাগুলো মনে পড়তেই ভীষণ হাসি পায় নূরের। যে মানুষটার সাথে কখনো দেখাই হয়নি, যার নামটা পর্যন্ত জানার আগ্রহ বোধ করেনি, তাকে তার ভালো লেগে গেছে বলেছিল আদিত্যকে। কবুল বলার মুহূর্তে ভীষণভাবে পাশে চাচ্ছিল তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী অরুণিকাকে। কিন্তু যে সম্পর্ক সে নিজে হাতে ছি*ন্ন করে এসেছে তাকে এই মুহূর্তে;আশা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।

_________________

আজ প্রথম অরুণিকা এই বাড়ির কিচেনে এসেছে। অরুনিকা আনিকা আহসানকে দেখে মুচকি হাসি উপহার দেয়।

“কি ব্যাপার অরুনিকা,সকাল সকাল কিচেনে কিছু লাগবে তোমার? চা খাবে? আমাকে বল আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”

“না না আন্টি আসলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। আপনি একা একা সব কাজ করেন, আমাকে তো কিছুই করতে দেন না। প্লিজ আমি আপনাকে হেল্প করি আজ। প্লিজ মানা করবেন না কিন্তু।”

“কে আন্টি? কোথায় আন্টি? কেউ এসেছে নাকি? আমাকে কিছু বলছো? আমি তো এখানে কোন আন্টিকে দেখতে পাচ্ছি না।” আনিকা আহসানের এমন মশকরা দেখে ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায় অরুণিকা। এমন পরিস্থিতিতে কি বলবে কিছু ভেবে না পায় না।

“এই মেয়ে শোনো এখানে কোন আন্টি থাকে না বুঝেছ? আম্মু বলে ডাকবে এবার থেকে মনে থাকবে?”

“জ্বী আন্টি। এই না সরি আম্মু।”

আনিকা আহসান পিছন ঘুরে তাকাতেই বেশ বড়সড় শক খান। পুরো নতুন বউ এর মত লাগছে অরুনিকাকে। এই প্রথম অরুণিকাকে শাড়ি পড়তে দেখে ভীষণ খুশি হন তিনি। মনে মনে কিছু একটা ভেবে অরুনিকাকে বলেন,

“মাশাআল্লাহ! আমার আম্মুটাকে আজকে অনেক সুন্দর লাগছে।”

“এক কাজ করো আজ তুমি মিষ্টি জাতীয় কিছু রান্না করো। এই বাড়ীতে তোমার প্রথম আজ কিচেনে আসা তাই নিয়ম অনুযায়ী মিষ্টি কিছু রান্না করো।”

“আম্মু একটা রিকুয়েস্ট, প্লিজ আজকে সব রান্নাটা আমি করি! আপনার মত খুব ভালো না পারলেও মোটামুটি খাওয়ার মত রান্না করতে পারি আমি। প্লিজ আম্মু আজকে আমাকে রান্না করতে দিন।”

অরুনিকার ভালোবাসা মিশ্রিত অনুরোধ আর কিউট ফেস দেখে আর না করতে পারলেন না আনিকা আহসান। কোথায় কি রাখা আছে অরুণিকাকে বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন কিচেন থেকে। সাথে এটাও বলে এলেন দরকার হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে ডাকে তাকে।

বাড়ির সবার জন্য নাস্তায় পরোটা, ভাজি, অমলেট আর আধাভাণের জন্য স্যান্ডউইচ আর পায়েস বানানোর প্রস্তুতি নিয়ে কাজে লেগে পড়লো অরুণিকা। একদিকে ময়দা মেখে রাখলো পরোটার জন্য আর ভাজির জন্য আলু কেটে নিলো। গরমের জন্য চুলটা হাতখোপা করে শরীর আঁচল কোমরে গুঁজে একমনে কাজ করে যাচ্ছে সে। কাজের মধ্যে এতটাই ব্যাস্ত হয়ে গেছে যে আদাভানের সকালের কফির কথা একদমই ভুলে বসেছে। বেশ সময় ধরে অপেক্ষা করার পর অরুনিকাকে কফি নিয়ে রূমে আসতে না দেখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে আদাভান এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে।

কিচেনে ঢুকে এক মোহময়ী নারীকে আবিষ্কার করে আদাভান। যতটা বিরক্তিভাব নিয়ে কিচেনে এসেছিলো তা মুহুর্তেই গায়েব হয়ে যায়। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অরুনিকার দিকে। চোখ সরিয়ে নিতে চেয়েও পর পর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে আবারো তাকায় অরুনিকার দিকে। ঘাম আর ভেজা চুলের পানিতে পিঠের কিছুটা অংশ ভিজে আছে, শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে কাজ করার ফলে পেটের বেশ কিছুটা অংশ দৃশ্যমান, ফর্সা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে এক অদ্ভুত মোহময়ী রূপ সৃষ্টি করেছে।

ডিম নেওয়ার জন্য পিছন ঘুরতেই আদাভানের মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে লজ্জায় পড়ে যায় অরুনিকা। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে পড়ে আরোও মিয়য়ে যায় সে। দজ্জাল বউয়ের এমন লজ্জায় মিয়য়ে যাওয়া রূপ দেখে ভীষণ হাসি পায় আদাভানের। তবে কেনো জানো এই রূপের থেকে অরুনিকার ঝগড়ুটে, প্রতিবাদী রূপটা তার কাছে বেশিই ভালো লাগে। অরুনিকাকে সহজ করতে বলে,

“আমার কফিটা দিয়ে গেলেনা আজ তাই কিচেনে এলাম কফি নিতে। ব্যাস্ত থাকলে থাক লাগবেনা।”

“আরে না না। আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি।”

কফি বানিয়ে পিছনে ফিরতে যাবে তখনই কারোর শক্ত বুকের সাথে ধাক্কা খায় অরুনিকা। আদাভানও বেশ হকচকিয়ে যায় ব্যাপারটাতে। আবেগের বশে কখন যে অরুনিকার এতটা কাছাকাছি চলে গেছে নিজেও খেয়াল করেনি। অস্বস্তি কাটাতে কফির মগটা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে আসে কিচেন থেকে।

খাবার টেবিলে সবাই অরুনিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পায়েশটা নাকি বেশ ভালো হয়েছে। আনিকা আহসান নিজের রুম থেকে একটা বক্স এনে দিলেন অরুনিকার হাতে। অরুনিকা প্রশ্নবিদ্ধ তার দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, এটা নাকি নিয়ম বাড়ির বউ প্রথম কিছু রান্না করলে তাকে উপহার দেওয়া।

“আম্মু পরোটার প্লেটটা এদিকে দাও তো একটু।”

আদাভানের কথা শুনে সবাই অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেনো সে খুব বড় ভুল কিছু বলে ফেলেছে।

“ভাইয়া তোর শরীর ঠিক আছে তো? তুই খাবি পরোটা? আম্মু তুমি ভাইয়াকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেও। নিশ্চই শরীর খারাপ করেছে।”

“এই তুই এতো বকিস কেনো? কেনো আমি কি পরোটা খেয়ে পারিনা নাকি? তোরা তো খাচ্ছিস আমি খেলে কি দোষ?”

“ভাইয়া তুই মজা করছিস তাইনা? তুই খাবি পরোটা এটাও বিশ্বাস করতে হবে? পরোটা তুই আজ পর্যন্ত ছুঁয়েও দেখিসনি। আম্মু এতো জোর করেও তোকে লুচি, পরোটা খাওয়াতে পারেনি। তোর একি কথা সকাল সকাল এইসব অয়লি ফুড ভালো না।”

“তো তুই কি চাস বান্দরনী, তোর ওই অয়লির চক্করে আমি আমার বউয়ের প্রথম রান্না মিস করি? এতদিন বউ ছিলোনা এখন সুন্দরী বউ আছে বুঝলি!”

চলবে?
#Fiza_Siddique

গল্পটা কি আর ভালো লাগছেনা?🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here