আমার হৃদমাঝারে তুমি প্রিয় পর্ব ১২

#আমার_হৃদমাঝারে_তুমি_প্রিয়
#পর্বঃ১২
#Sohana_Akther
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম মা আমার পাশে মাথা রেখে শুয়ে আছে । ওঠে বসতে নিলে হাতে কিসের যেনো টান খাওয়াতে মৃদু চিৎকার দিলাম। আমার চিৎকার শুনে মা ধরফরিয়ে ওঠে বসলো।
হাতে তাকিয়ে দেখি স্যালাইন দেওয়া হয়েছে আমাকে আর হাত টান দেয়ার ফলে সুইয়ে টান লেগে রক্ত বের হয়ে গেছে ।

আমার জ্ঞান ফেরার খবর বাবাকে দেয়ার জন্য মা বাবাকে অস্থির হয়ে ডাকা শুরু করলেন । মায়ের ডাক শুনে বাবা হুড়মুড়িয়ে বাহির থেকে কেবিনের ভিতরে আসলেন ।

” নিরা বাবা দেখো আমাদের নিরার জ্ঞান ফিরেছে ” ।

” মামনি তুমি তো আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে , হঠাৎ কি হয়ে গেল তোমার ” । তোমার মায়ের অবস্থা দেখো কেদে কেটে কি অবস্থা করেছে নিজের ” ।

তাদের কথার মাঝেই ডাক্তার কেবিনে আসলেন তার পিছনে আরো একজন মাথা নিচু করে কেবিনে ঢুকলো , লোকটি মাথা উঁচু করতেই আমার চোখ একদম স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে । সে আর কেউ না নিহান! চোখজোড়া তার আগুনের ফুলকির মতো লাল হয়ে আছে , চুলগুলো উস্কসুস্কো , মুখটাও কেমন মলিন হয়ে আছে মনে হয় এই অল্প কয়েক সময়ের মধ্যে তার বয়স যেনো বেড়ে গেছে অনেক ।

ডাক্তার এসে আমাকে চেকাপ করে বললো ভয়ের কিছু নেই অত্যাধিক ভয়ের কারণে জ্ঞান হারিয়েছি আর এক দুই ঘন্টার পর বাড়িতে যেতে পারবো । ডাক্তার যাওয়ার সাথে সাথে নিহান ও চলে গেল আমার সাথে একবার কথা বলার ও চেষ্টা করেনি । তাদের যাওয়ার পর বাবা আমাকে বললো নিহানই নাকি তাদের ফোন করে হাসপাতালে আসতে বলেছে আর বলেছে আমি একটি এক্সিডেন্টের ঘটনা নিজ চোখে দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছি ।

ওহহ তার মানে কলেজে ঘটে যাওয়া আসল ঘটনা বাবাকে বলেনি নিহান । যাক না বলে ভালোই করেছে নাহলে বাবা ভয়ে আমার কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিতো । বাবা আমাকে বিশ্রাম করতে বলে মাকে নিয়ে বাহিরে চলে গেল আমার ডিসচার্জ পেপার রেডি করার জন্য ।

শুয়ে শুয়ে নিহানের কথা ভাবতে লাগলাম , বারবার তার ঐ হিংস্র চেহারা চোখে ভেসে ওঠছে । আজ যদি নিহান ঠিক সময়ে না পৌঁছাতো না জানি কি হতো আমার সাথে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে । কিন্তু আজকের এই ঘটনার পর কেনো যেনো নিহানকে ভয় লাগতে শুরু করলো ।

সন্ধ্যার পর আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো ।
শরীর এখানো অনেকটা দূর্বল, ডাক্তার কয়েক দিনের বেড রেস্ট দিয়েছে । এই কয়েক দিন আর কলেজে যাওয়া হবে না আমার । রাতে মা এসে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে আমায় । আজ অনেক দিন পর এই অসুস্থতার বাহানায় মায়ের হাতে খাওয়া হলো । খাওয়ার সময় এসব ভাবতে ভাবতে চোখে পানি এসে পরলো ।

” কি ব্যাপার কাঁদছিস কেনো তুই কি হয়েছে তোর খারাপ লাগছে না তো ” ?

” না মা আজ অনেক দিন পর তোমার হাতে ভাত খেলাম তাই খুশিতে চোখ ভরে এলো ” ।

” বোকা মেয়ে এই জন্য কাঁদতে হয় বুঝি ” ।

খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে মা আমাকে আমার ঔষুধ খাইয়ে দিয়ে রুম থেকে চলে গেল । বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না । খাট থেকে ওঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার বই নিয়ে পড়তে লাগলাম ।

অনন্ত প্রেম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী,
প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে,
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে,
মিলনমধুর লাজে—
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

কবিতা পড়তে পড়তে চোখটা একটু লেগেই আসছিলো ঠিক তখনি মোবাইলটা বেজে ওঠলো। হাতে নিয়ে দেখি আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে, সাধারণত অচেনা নাম্বার রিসিভ করি না কিন্তু আজ নিজের অজান্তেই রিসিভ করে ফেলেছি । হয়তো আমার অবচেতন মন চাইছে কলটা রিসিভ করতে । কল রিসিভ করার সাথেসাথে অপর পাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠ ভেসে আসলো ,

” হ্যালো নিরা আমি নিহানের ফ্রেন্ড আকাশ বলছি ” । এতটুকু শুনে আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম এত রাতে আকাশ ভাইয়া আমায় কেনো ফোন করেছে আর আমার নাম্বারইবা পেলো কিভাবে । আমার ভাবনা বেশিদুর অগ্রসর হতে দিলেন না তিনি । আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি বলে ওঠলেন ,

” নিহানকে একমাত্র তুমিই আটকাতে পারো নিরা! সে আমাদের কারো কথা গায়ে মাখছে না , এভাবে চললে তো আর কিছু সময় পর তাদেরকে মেরেই ফেলবে নিহান ” ।

একনাগাড়ে কথা বলে থামলেন আকাশ ভাইয়া । আমি তার কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলাম না ।

” কাদের কথা বলছেন আপনি নিহান কাদের মেরে ফেলবে আর আমিই বা কিভাবে তাকে আটকাতে পারি ” ?

” কলেজে আজ যারা তোমার সাথে অসভ্যতামি করেছে তাদের কথা বলছি । নিহান তাদেরকে নিজের গোডাওনে এনে সেই সন্ধ্যা থেকে মারছে অনেক । এভাবে চললে তো নির্ঘাত মরেই যাবে ওরা , এখন তুমিই আটকাতে পারো ” বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা নিহানের কানে দিয়ে বললো নিরা লাইনে ।

এইদিকে তার এসবের কথা শুনে ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে । একটু সময় নিয়ে তাকে বললাম ,

” প্লিজ ছেড়ে দিন ওদের, আমার কথাটা একটু শুনুন ” বলেই কলটা কেটে দিলাম । উফফ বুক ধুকপুক করছে আমার ভয়ে । এখন তো আমার প্রতি নিহানের এই পজেসিভনেস দেখে তাকে আমার ভয় লাগতে শুরু করলো । কথায় আছে অতিরিক্ত কিছুই ভালো না , ঠিক তেমনি প্রয়োজন ছাড়া অতিরিক্ত রাগ ও ভালো না ।

মোবাইল হাতে থাকা অবস্থায় আবার বেজে ওঠলো তাকিয়ে দেখি সেই অচেনা নাম্বার থেকে কল । আশ্চর্যের বিষয় হলো মীরার বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত এই নাম্বার থেকে কল আসেনি আজ আবার কল !

কল রিসিভ করে কানে দিয়ে রাখলাম, অপর পাশ থেকে শুধু কারো জোরে জোরে শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনতে পারছি তাছাড়া আর কিছু না । কয়েক মিনিট নিরবতা পালন করার পর কল কেটে দিল । খুব অস্থিরতা কাজ করছে মনে , মনে হচ্ছে কিছু একটা নেই । কোনো কিছুর শূন্যতায় বুকটা খা খা করছে ।

কোনো রকম রাতটা পার করলাম । সকাল দশটার দিকে রিয়া ও প্রিয়া হাজির আমার বাসায়। এসেই নিহানের কথা বলা শুরু করে দিয়েছে । ওরা নাকি আজ কলেজে যেতে গতকালের ঘটে যাওয়া ঘটনা শুনতে পেলো ।
পুরো ভার্সিটি জুড়ে নাকি আমাকে আর নিহানকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে । আজ পর্যন্ত কেউই নিহানকে এভাবে এগ্রেসিভ ব্যবহার করতে দেখেনি । ভার্সিটির অনেক বখাটেদের শায়েস্তা করছে কিন্তু এমন ব্যবহার করেনি কখনো । ঐ ছেলেগুলো নাকি হাসপাতালে ভর্তি, নিহান নিজেই তাদের ভর্তি করেছে । নিহানের রাজনৈতিক ক্ষমতার কারনে কারোর সাহস হয়নি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ।

চারদিন ঘরবন্দি হওয়ারপর আজ ভার্সিটিতে পা দিলাম । গেইটের ভিতরে ঢুকার সাথে সাথে চারদিকে ফিসফিসিয়ে কথা বলার আওয়াজ শুনছি । এতদিন ভার্সিটিতে আসিনি কিন্তু আজ আসার সাথে সাথেই গুনগুন শুরু হয়ে গেল । ওসবে কান না দিয়ে সামনে পা বাড়ালাম ঠিক তখনি আচমকা নিহান ও তার দলবল আমার সামনে হাজির হলো । ওকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলাম । আমার এই ভয়ার্ত চেহারা দেখে নিহান ভ্রু কুঁচকে তাকলো আমার দিকে আর বললো …

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here