আমার হৃদমাঝারে তুমি প্রিয় পর্ব ১৭

#আমার_হৃদমাঝারে_তুমি_প্রিয়
#পর্বঃ১৭
#Sohana_Akther
দীর্ঘদিনের অপেক্ষার প্রহর শেষ হওয়ার দিন আজ। আজ আবার আমাদের বিয়ে পড়ানো হবে। আমাদের বিয়ে নিয়ে যাদের মন খারাপ ছিল আজ তাদের মহা আনন্দের পালা । আর মীরার কথা তো নাই বলি , বেচারি যেনো হাতে চাদঁ পেয়েছে এমন অবস্থা । আমাদের বিয়েতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়তো মীরাই হয়েছে ।

সর্বপ্রথম বিয়ের কথা শুনে সে কি রাগ তার !! আমার সাথে কথাই বলবে না নাকি , তাকে না বলে ,তাকে ছাড়া আমি বিয়ে কিভাবে করলাম।
রাগে , অভিমানে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল । অনেক কষ্টে মীরাকে বুঝালাম যে কি পরিস্থিতিতে আমাদের বিয়ে । যেখানে আমি নিজেই জানতাম না আমার বিয়ের কথা আর তাকে কি বলবো ।

সম্পূর্ণ বাড়িতে পুরো জমজমাট অবস্থা, সমস্ত বাড়িজুড়ে লাল নীল মরিচ বাতির লাইটিং , ঘরের প্রতিটি কোনে ফুল দিয়ে সাজানো ।
রিয়া ও প্রিয়া কালকেই এসে পরেছে । রিয়া, প্রিয়া ও মীরা এই তিনজন সর্বক্ষণ আমার সাথে থাকছে , একদম ফেবিকল গ্লু এর মতো লেগে আছে । বড়দের ভাষ্যমতে বিয়ের কনেকে নাকি একা থাকতে নেই তাই তাদের ডিউটি পরছে আমার সাথে থাকতে ।

কিছুক্ষণ পর পর মা ঘুরে দেখে যাচ্ছে আমাকে , যখনি আসে তখনি কান্না শুরু করে দেয় । মাকে দেখলেই যেনো আমারও কান্না গুলো গলায় দলা পাকিয়ে আসে । কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারি না , সকাল থেকে মা মেরের কয়েক দফা কান্নার রোল পরে গেছে ।

কি অদ্ভুত নীতি এই দুনিয়ার! সকল রীতিনীতি যেনো আমাদের মেয়েদের জন্যই তৈরী করা হয়েছে । যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করে , যে মা বাবা কষ্ট করে লালন পালন করেছে , যে মা বাবা সকল প্রকার বিপদ থেকে আগলিয়ে রেখেছে…আজ বিয়ে নামক এক নতুন সম্পর্কের জন্য সবকিছু ছেড়ে এক নতুন জীবনে পা দিতে হয় । একদিকে নিহানের সাথে নতুন জীবন শুরু করার আনন্দ অপরদিকে মা বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট এই যেনো এক অসহনীয় যন্ত্রণা ।

সন্ধ্যার নাগাদ পুরো বাড়িতে হৈচৈ মেছে গেছে বর এসেছে বর এসেছে বলে । আমার তিন বডিগার্ড আমাকে রেখে বর দেখতে ছলে গেল ।
এইদিকে নার্ভাসনেসে আমার হাত পা কাঁপা শুরু করে দিয়েছে । আর কয়েক ঘন্টার পর আমি এক নতুন বাড়িতে পা দিবো । ঐখানে ফুফা ফুফি থাকলেও ঐবাড়ির বাকি মানুষরা আমার জন্য নতুন ।

বরবেশে নিহানকে কেমন লাগছে তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহ আমার কিন্তু কিছুতেই দেখা সম্ভব না, এই তিন ফাজিল মেয়েগুলো যে কখন বের হয়েছে আর আসার নামই নিচ্ছে না । এমনিতো আজ সারাদিন আমার পিছু ছাড়েনি কিন্তু এখন যখন আমার প্রয়োজন তখন সামনের থেকে উধাও , কি পরিমাণ রাগ লাগছে তা বলার বাহিরে । হঠাৎ রিয়া ও প্রিয়া দৌড়ে এসে বললো,

” এই নিরা জিজুকে দেখতে না আজ সেই লাগছে আমারই ইচ্ছে করছে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যেয়ে বিয়ে করে ফেলি ”

” চুপ ফাজিল, অন্যের বরকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে দাড়া আঙ্কেল আন্টিকে বলতে হবে মেয়ের বিয়ে করার শখ জেগেছে “।

“আরেহ না না , আমি তো এমনি বলেছি এতো জলদি আমি বন্দি হতে চাইনা । আমার তো এখন দুনিয়া দেখার বাকি তারপর বিয়ে করবো ” ।

বিয়ে পরানোর সময় আমাকে হলে নিয়ে যেয়ে নিহানের পাশে বসানো হয়েছে । বড়োরা সবাই সামনে তাই নিহানকে কেমন লাগছে তা চোখ ওঠিয়ে দেখতে পারছি না । কিন্তু ঠিকি নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে ছিল যখন আমাকে তার পাশে এনে বসানো হয়েছে । আমার কানে ফিসফিস করে বললো,

” আজ তোমাকে একদম হুর পরীদের মতো লাগছে, ইসসস ইচ্ছে করছে একদম গিলে খেয়ে ফেলি ” ।

লজ্জায় কিছু বলতে পারেনি তাকে , মাথা নিচু করে মিটমিট করে হেসে যাচ্ছি । কাজী সাহেব যখন নিহান কবুল বলতে বললো তখন সে একবারেই তিনবার বিসমিল্লাহ কবুল , কবুল ,কবুল বলে ফেলেছে । তার কান্ড দেখে তার বন্ধুরা সবাই ক্ষেপানো শুরু করে দিয়েছে ।
যখন কাজী সাহেব আমাকে বললেন কবুল বলতে তখন যেনো আমার গলায় কিছু আটকে আছে তেমন অবস্থা । কিছুতেই নিজের কান্না বন্ধ করতে পারছি না আমি, কবুল তো এর আগেও একবার বলেছি কিন্তু আমার কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে বলতে । হয়তো এর আগে জানতাম আমি আমার আপনজনদের সাথে থাকবো কিন্তু আজ এই কবুল বলার পর সম্পূর্ণ ভাবে অন্যের হয়ে যাবো , আপনজনদের ছেড়ে থাকতে হবে ।
কাজী সাহেব বারবার বলছে বলো মা কবুল , অনেক কষ্টে মুখ ফুটে কবুল বললাম । পরপর তিনবার কবুল বলার পর সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে ওঠলো ।

বিদায়ের সময় নিজেকে আর আটকাতে পারলাম না, বাবা মাকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম । বাবা অনেক শক্ত থাকলেও মা ও কাঁদতে শুরু করল অনেক । কেদে কেটেই বারবার আমাকে বলছে শ্বশুর বাড়ির সকলের মন জুগিয়ে চলি । বাবা আমার হাত নিহানের হাতে দিয়ে বললেন ,

” আমার একমাত্র আদরের মেয়ে নিরা , তাকে তুমি দেখে রেখো বাবা । বাচ্চামি স্বভাব তার মধ্যে এখনো আছে, ওর বাচ্চামিপনাতে কখনো কষ্ট পেয়ো না ” ।

” আপনি চিন্তা করবেন না বাবা । আপনার মেয়ে নিরা এখন আমার স্ত্রী, তাকে আমি সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবো । আর তার বাচ্চামির জন্যই তাকে এতোটা ভালোবাসি তা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করবেন না ” ।

বাবা আর ফারান ভাইয়া আমাকে গাড়িতে তুলে বসিয়ে দিল । নিহান বারবার আমার হাত ধরে স
শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে । কয়েক মিনিট পরেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল তার গন্তব্যের দিকে । শুরু হয়ে গেল আমার নতুন জীবনের যাত্রা । পিছনে রয়ে গেল পুরনো জীবনের সকল মানুষ ।

গাড়ি এসে থামলো নিহানদের বিশাল বাড়ির সামনে । চারপাশে লাইটিং এর আলোতে পুরো বাড়ি চিকচিক করছে । আমাদের পিছনের গাড়িতেই মীরা , ফারান ভাইয়া, ভাবি , ফুফা ও ফুফি সকলে চলে আসলেন । নিহান গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা খুলে আমাকে নামানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিল । তার হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে আসলাম । আমার পাশে মীরা এসে দাড়ালো । ঘরের ভিতরে যাওয়ার জন্য যখন দরজার সামনে এসে দাড়ালাম তখন মীরা নিহানকে বললো আমাকে কোলে তুলে ভিতরে নিয়ে যেতে । মীরার কথায় নিহানের মা বললো ,

” নিহান আমাদের বাড়ির এই রীতি তো তুই জানিস যে নতুন বউকে তার বর কোলো তুলে বাড়িতে প্রবেশ করে তোকেও তা করতে হবে ”

নিহান তো এক কথায় রাজি , এই কথা বলার সাথে সাথেই আমাকে কোলে তুলে নিলো । সবার সামনে কিভাবে সে কোলে তুলে নিলো , লজ্জায় একদম গুটিসুটি মেরে তার বুকে মুখ লুকালাম । আমাকে নিয়ে যেয়ে নিচে বসার ঘরে বসানো হয়েছে । নিহানদের ডুপ্লেক্স বাড়ি , বাড়ির ভিতরটা অনেক সুন্দর । আমাকে আর নিহানকে একসাথে বসিয়ে সবাই একে একে মিষ্টি মুখ করানো শুরু করেছে । এতো মিষ্টি খেতে খেতে বমি আসবে এমন অবস্থা, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবো না নতুন বউ বলে কথা । কিছুক্ষণ পর নিহানকে তার বন্ধুরা এসে সাথে করে নিয়ে গেল, তারা নাকি নিহানের জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে । মীরা, তিথি ভাবি ও নিহানের মেয়ে কাজিনরা আমাকে ভাবি ভাবি বলে মজা করা শুরু করে দিয়েছে ।

এদিকে সকল নিয়ম রীতি পুরণ হওয়ারপর আমাকে নিহানের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো । মস্ত বড়ো একটি রুম , রুমের ঠিক মাঝখানে খাট । পুরো খাট বেলী ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে শুধু খাটই নয় সম্পূর্ণ রুমটিও বেলী ফুলের ধারা সাজানো হয়েছে । এই বেলী ফুল দিয়ে সাজানো কার আইডিয়া কার হতে পারে । যারই হোক সাজানো আমার বেশ ভালো লেগেছে । আমাকে খাটে বসিয়ে এক এক করে সবাই চলে গেল । যাওয়ার আগে বলে গেল ,

” তুমি অপেক্ষা করো আমি নিহানকে রুমে পাঠাচ্ছি ” ।

সেই যে বলে গেল এখন রাত বারোটা বাজে কিন্তু নিহানের আসার খবর নেই । এদিকে এসব ভারি লেহেংঙা পরেও অস্বস্তি লাগছে, কখন থেকে এগুলো পরে আছি মনে হচ্ছে এগুলোর ভারেই আমি জ্ঞান হারাবো । হঠাৎ খুট করে দরজা খোলার শব্দ শুনে ঠিক হয়ে বসলাম, নিহানই এসেছে হয়তো । রুমে এসেই সর্বপ্রথম আমাকে বললো ….

চলবে ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here