আমার হৃদয়ে সে পর্ব -০৪

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৪

বাবার ওহেন ব্যবহারে আমি প্রায় স্তব্ধ এবং বাকরুদ্ধ!কষ্টটা বুকে একটু বেশিই দানার মতন বিঁধছে।কষ্ট হবে না কেন বলুন?বাবা তার নিজের মেয়েকে বিশ্বাস না করে বিশ্বাস করলেন একটা পরের ছেলেকে?বিশ্বাস যদি এতই হয় এরআগে অন্তত মেয়ের ত দোষগুণ একবার তার জাস্টিফাই করা উচিত ছিল!তিনি তা না ভেবে উল্টো আমাকেই দোষ দিলেন!চোখজোড়া ভিঁজে এলো আমার! আর যে সহ্য করতে পারছি না!কী করবো আমি?বা কী করা উচিত আমার এখন?ভাবনার মাঝে ওপাশের রুম ,অর্থাৎ বাবার রুম থেকে চিল্লাপাল্লার আওয়াজ শুনতে পাই।অবচেতন মস্তিষ্কটা ক্ষীণ করে ফেলি।বাবা উঁচু গলায় বলছেন,

“অভিকে আমি ছোট্টকাল থেকে চিনি।ওর স্বভাব-আচার-ব্যবহার আমি সব দেখেছি।ও কখনো ওরকম করতেই পারে না।তোমার মেয়ে ন্যাঁকা কান্না করছে সব!সব ন্যাঁকা কান্না!”
“তবে আমার মনে হয় তোমাকে অভির সাথে এই ব্যাপারে একবার কথা বলা উচিত!”
“কী কথা বলবো?কী কথা?কোনোকিছু হলে ত অভি আমাকে নিজেই সে কল করে বলতো।অভি তা বলে নি।ও যে এসব করছে তল্লাসি করে দেখো অভি হয়তো এসবের কিছুই জানে না।ও আমাদের কাছে এসে সুযোগ খুঁজছে মাত্র।মিথ্যে বাহানা ধরছে কীভাবে ভার্সিটিরওই বদমাশটার ছেলেটার আবার হাত ধরতে পারবে।”
“তারপরও কথা বলে দেখলে ভালো হত না…?”

বাবার আর কোনো কথা শুনতে পাইনি।মা হয়তো বাবার কাছে যেয়ে আমার ব্যাপারে কিছু বলেছেন তাই বাবা এতটা রেগে গেছেন!রেগে যাওয়াটা বাবার জন্যে স্বাভাবিক। কারণ বাবার চোখে ত অভি নামটাই হলো “একখানি হিরের টুকরো।”আমি এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়াই।কিছুই আর ভাল্লাগছে না।কোনো কিছুই না।

“পারিসা,দরজা খোল!”

তাকিয়ে মা দরজায় করাঘাত করছেন।আমি দরজা খুলার উদগ্রীব না করে উল্টো দৃষ্টিটা আগের মতন করে নিই।কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আর।

“কি হলো পারিসা?দরজাটা খুলবি ত?”

এবার চোখমুখ খিঁচে আনি।বড় অসহ্যকর মুখে বলি,

“দরজা খুলবো কেন?”
“দরকার আছে!”
“কি দরকার?”
“আগে দরজাটা খুলবি ত?”

নিরস মুখ নিয়ে দরজা খুলে দিই।মা খাবার প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে।প্লেটটা আমার দিকে এগিয়ে,

“খাবারগুলো খেয়ে নে।”

কিছু বললাম না।মুখটা অন্যদিক করে ফেললাম।মাও আর বাড়াবাড়ি করলেন না।আমাকে পাশ কেঁটে ভেতরে ঢুকে প্লেটটা টেবিলের উপর রেখে আবার চলে যান।মাকে চলে যাবার মুহূর্তে আমার খুব আঁটকাতে ইচ্ছে হয়।আটকিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকপ্রাণ উজাড় করে বলতে”মা,তোমরা আমাকে কেনো অবিশ্বাস করো?কেন বারবার বিয়ের হবার আগের দিনগুলোর মতন আজ আবার বলো ভার্সিটির ওই ছেলেটির সাথে আমার সম্পর্ক আছে!তোমাদের মেয়ে একটা বখাটের সাথে সম্পর্ক রাখবে এই তোমাদের মনে হলো?কেন মা তোমরা তোমাদের মেয়েকে চেনো না!?”বলতে পারলাম না।তারপর আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার দরজা বন্ধ করে বিছানার দিকে যাই।গুঁটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ি।খানিক্ষণ বাদেই ঘুম চলে আসে আমার।মাঝরাতে হঠাৎ আবার ঘুম ভেঙ্গে যায়!ঘুম ভাঙ্গার কারণ আমি খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখি!স্বপ্নটা অভিকে নিয়েই!দেখি অভি স্বপ্নেও আমার গাঁয়ে হাত তুলেছে।আর রাগ রাগ গলায় বলছে,”তোমার সাথে আমি আর সংসার করতে পারবো না।চলে যাও এই বাসা থেকে!তোমাকে আমি ডিভোর্স দিব!”

ফুঁপরে কেঁদে উঠি আমি।কান্নাটা দুই মিনিটের মতন থাকে।তরপর মুখ চেপে কান্নার বেগ কমাই। নিজেকে বহু কষ্টে সংযত করে বালিশের কিনার হাতড়ে ফোনটা হাতে নিই।স্ক্রিনে তাকিয়ে সময় ৩ টা বেঁজে পঁচিশ মিনিট।খুব রাত।ঘুমাতে আবার চেষ্টা করি।কিন্তু চোখে আর ঘুম ধরা দেয়নি।সে ওই দুঃস্বপ্নের সাথে হারিয়ে যাই।পুরো রাতটা আমার নির্ঘুমেই কেঁটেছে।সকালে চারদিকে ফর্সা আলো পড়তেই আমি শোয়া থেকে উঠে বসি।মাথাটা খুব ভার ভার লাগছে।রাতে ভালোমতন ঘুম হয়নি তাই হয়তো মাথা ভারের কারণ।তাই তা নিয়ে বেশি আর মাথা না ঘামিয়ে সোঁজা বেলকনির দিকে হেঁটে যাই।সেখানে খানিক্ষন বসে থাকি।বসে থাকার কিছুক্ষণ পরই পূর্বাকাশে সূর্যি মামা উঁকি দেয়।তার সোনালী রোদে গাছের পাতা,ডাল,দালানকোঠা,মাঠঘাট সব ঝলমল করে উঠে।সেদিকে গভীর মনোযাগ নিয়ে তাকিয়ে থাকি।তাকিয়ে থাকার মাঝেই কেনজানি মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।সাথে মাথা ভারটা কেঁটে যায়।প্রকৃতির আসলেই অসীম শক্তি যে অল্পক্ষণেই তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে মনখারাপের মানুষ গুলোর মনকেও ভালো করে দিতে পারে।এমন সময় আবারো দরজায় মার করাঘাত।

“পারিসা?পারিসা?”

গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।

“তোমার বাবা তোমার সাথে কথা বলতে চায়।যাও গিয়ে কথা বলে আসো।তোমার বাবা আবার অফিসে চলে যাবেন।”

মার কথা বাধ্য মেয়ের মতন মেনে বাবার রুমে যাই।দেখি বাবা পত্রিকা পড়ছেন।পত্রিকার দিকে দৃষ্টি রেখেই বলেন,

“চেয়ারে বসো।কথা আছে তোমার সাথে।”

আমি চেয়ারে বসলাম।এবার উনি পত্রিাকাটা বন্ধ করে চশমা টা খুলে পাশে রাখলেন।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“দেখো তুমি একজন মেয়ে!মেয়ে মানুষদের প্রধান গুণ কি জানো?”

একথার পিঠে সরাসরি বাবার চোখের দিকে তাকালাম।চোখের ভাবান্তরে বুঝালাম, “জানি না।” বাবা বললেন,

“মানিয়ে নেওয়া!বিয়ের পর মেয়েদের প্রধান হয়ে ওঠে তার স্বামী এবং সংসার!সে যদি বিয়ের পর তাতে না মানিয়ে নিতে পারে তাহলে সে কোনো সাংসারিক জীবনটা সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারে না।দেখো বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা নয়।বিয়েটা একটা বন্ধন।বন্ধনটা যদি ভেঙ্গে যায় তাহলে সেটার সাফার মেয়েটি পরে নিজেই ভোগ করে।মানলাম তুমি বিয়ের আগে সব করেছে,দশটা বিশটা ছেলের সাথে প্রেম করেছো অন্তত বিয়ের পরতো একটু ভালো হবার চেষ্টা করো!?কারণ তোমাকে ভাবতে হবে বিয়ের পর ওসব অন্যায়!পাপ!”

বাবার কথাগুলো শুনে কেনজানি মনের অজান্তে খুব হাসি পেয়ে গেল।হাসিটা আবার ঠোঁটের কোণে চাপিয়ে নিয়ে চট করে এবার বলে উঠলাম,

“বাবা আমি আমার এই চব্বিশ বছর জীবনে প্রেমের প্র টুকু বুঝি নি!আর সংসার এবং স্বামী?সে ত বিয়ের পর থেকেই মানিয়ে আসার চেষ্টা করেছি!কিন্তু লাভ জিরো তে জিরো!”
“মিথ্যে কথা বলতেছো তুমি!”
“আমি কেনো মিথ্যে বলবো বাবা?আমি কি কোনোদিন আপনার সাথে মিথ্যে বলেছি,বাবা? ”
“হ্যাঁ বলেছো।তুমি ভার্সিটি পড়াকালীন ওই হ্যাংলা ছেলেটার সাথে প্রেম করেও আমাকে মিথ্যে বলেছো।এবং এখনো মিথ্যে বলতেছো!”
“বাবা আমি কখনোই মিথ্যে বলি নি এবং এখনো বলছি না! এসব শুধুই আপনার সন্দেহ ছাড়া আর কিছুই না বাবা। আর আপনি অভিকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে সবথেকে বড় ভুল করছেন!অভিকে আমি চিনি বাবা।কারণ ওর সাথে আমার সাংসারিক জীবনের আঁটমাস চলছে।”
“তুমি ওকে আঁটমাস ধরে চিনো।আর আমি ওকে ছোট্টকাল থেকে চিনি !”
“কাউকে দূর থেকে চেনা এবং কাউকে খুব কাছ থেকে চেনার মাঝে আকাশসম তফাৎ ।দূর থেকে কাউকে ভালো দেখালেও দেখা যায় ভেতরটা তার তিক্ততা!”
“তুমি আসতে পারো এবার!”

বলে বাবা আবার পত্রিকা হাতে নেন।বুঝলাম বাবা আর আমার কথা বলতে ইচ্ছুক নয়।আমি চুপ হয়ে যাই।আর নিশ্চুপ মুখে কয়েক সেকেন্ডস বসে থেকে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকি।বসা থাকার সময়টা একটু বেশিই মনে হতে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যাই।পেছন ঘুরতে নিলে বাবা পেছন থেকে বাবা বলে উঠেন,

“অভির সাথে আমি কথা বলবো।দেখবো কার ভুল কার ভুল নয়! যদি তোমার ভুল দেখি তাহলে তোমার সাথে আমার বোঝাপড়া আছে!কঠিনভাবে বোঝাপড়া আছে!”

বাবার কথার জবাব দিলাম না।নিশ্চুপ মুখেই চলে এলাম।তবে বাবার এটা দেখে কিছুটা ভাল্লাগলো বাবা এবার আর অভিদের বাসায় ফিরে যেতে আমাকে কিছু বললেন না।আমি মনে মনে সে ভয়টাই করেছিলাম।যাইহোক ভয়টা এখন কিছুটা কমেছে।

৭.
সন্ধে আটটার নাগাদ অভি আমাদের বাসায় আসে।অভিকে বাবাই আসতে বলেছেন তাই অভি এসেছে।এখন অভি ডাইনিং এ আমার মা-বাবার সাথে বসে আছে।আমি কানদুটো ক্ষীণ করে দরজার সাথে লেপ্টে আছি।উদ্দেশ্য আমার মা-বাবা এবং অভির সাথে কি কথা হচ্ছে তা শুনতে।

“অভি, তোমাকে এখানে ডাকার কারণ নিশ্চয়ই তুমি এতক্ষণে অবগত হয়েছো,রাইট?”
“জ্বী!”
“তাহলে বলো ত তোমাদের দুজনের মাঝে কি এমন হয়েছিলো যে আমার মেয়ে তোমাদের বাসা থেকে চলে এসেছে?এবং এসে বলছে তোমার সাথে আর সংসার করবে না?কেনো করতে চায় না সে?আমাকে কি কারণটা বলবে?”

কয়েক সেকেন্ডস অভির থেকে নিরবতা শুনতে পাই।তারপর সে হাঁক ছেড়ে বলে উঠে,

“সে যদি চায় আমার সাথে সংসার করবে না।তাহলে কারো ইচ্ছের উপর হস্তক্ষেপ করার আমার অধিকার নেই!”

অভি এ কেমন কথা বললো ?আমার ইচ্ছাতেই ডিভোর্স?আমার ইচ্ছের উপর তার হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই!?কিন্তু এসবটারই একমাত্র কারণ যে সে তার জবাব কে দেবে?কে দেবে?না চাইতেও এবার জোরে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠি।আর্তনাদের বেগ এতটাই তীব্র ছিল দেয়াল টপকে বেগটা ওপাশে গিয়ে ছিটকে পড়লো!

চলবে…..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here