আমার হৃদয়ে সে পর্ব -০৫

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৫

কান্নার বেগ শুনার পর ওপাশে নিরবতা বয়ে যায়।তবে নিরবতাটা বেশিক্ষণ থাকেনি।নিরবতার গুমোট ভাঙ্গে মার কন্ঠস্বরে।অত্যন্ত শান্ত স্বরে মা বলেন,

“অভি?সংসার জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে হালকাপাতলা ঝাঁমেলা হয়ই। দুজনে যদি চায় ঝামেলাটা আবার মিটমাটও করা যায়।স্ত্রী রেগেছে স্বামীর উপর আবার স্বামীও রেগে উঠেছে স্ত্রীর উপর এরকম দুজন দুই মেরুর হলে সংসার করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।অন্তত একজন উগ্র হলে আরেকজনকে শান্ত থাকা উচিত।ঝামেলা টা এতে বাড়ে না।দ্যাখো?তোমাদের বিয়ে হয়েছে মাত্র আঁটমাস!আঁটমাস তেমন বেশি সময় নয়।এই সময়ে দুজন দুজনকে বুঝে ওঠা আসলেই সময়সাপেক্ষীয় ব্যাপার।তাই তারজন্যে একটু সময় প্রয়োজন।তোমরা চাইলে আরেকটু সময় নাও।এভাবে হুটহাট রেগে বসে কোনো ডিসিশন নেওয়া আমার দৃষ্টিতে উচিত না।ভুলত্রুটি দুজনের মাঝেই থাকে।সেই ভুলত্রুটি টুকু নিজেদের মাঝে বোঝাপড়া করা উচিত অন্তত।”

অভি চুপ থাকে।বাবা পাশ থেকে বলেন,
“তোমার শাশুড়ী মা ঠিক বলেছেন অভি।”
“আচ্ছা,আমি পারিসাকে কি এখানে ডাকবো?তোমরা দুজন কথা বলে দেখো।”

অভি এবার বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ে!শ্বাসটার মাঝে প্রচন্ড ক্ষীপ্রতা জুড়ে আছে তা আমি গভীর অনুভূতি দিয়ে অনুভব করতে পেরেছি।অভি বলে উঠে,

“ডাকতে হবে না আমিই ওর সাথে গিয়ে কথা বলছি।”

বলে অভি সম্ভবত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।আমি তরহর করে চোখের পানি মুছে দরজার থেকে ছিটকে অন্যপাশে এসে দাঁড়াই।অভি ভেতরে ঢোকে।আমার দিকে খানিক্ষন ক্ষিণ চোখে তাকিয়ে থেকে বলে,

“তোমার সাথে আমার কিছু কথা বলার ছিল!”

আমি এবার অভির মুখশ্রীতে তাকাই।বলি,
“বলেন?”
“তুমি ডিভোর্স চেয়েছিলে না?আমি ডিভোর্স দিতে রাজি আছি।”

আমার চোখজোড়া ক্রমান্বয়ে তীক্ষ্ণ হয়ে আসে।অভি বলে,

“এতদিন তোমার সাথে আমার যা হলো,যা ঘটলো এসবের কারণ আজ তোমাকে আমি সরাসরি বলে দিচ্ছি।তোমার রিয়াজ নামের কোনো ছেলের সাথে রিলেশন ছিল,তাই না?”
“কি!”
“শুধু রিলেশন বললেও ভুল হবে।আরো গভীর রিলেশন ছিল!
“কী বলছেন এসব আপনি…!”
“আগে আমি কথা বলা শেষ করি…!তুমি ওর সাথে শারিরীক সম্পর্ক করে তারপর আমার সাথে বিয়ের পীড়িতে বসলে!তো বিয়ের পীড়িতে বসার আগে আমার দিকটা একবারও ভাবা উচিত ছিল না যে যার সাথে বিয়েটা করছি তার জীবনটা এভাবে শেষ করে দেওয়াটা কি ঠিক?আমিতো তোমার মতন এরকম কাউকে চাই নি!বিয়ের রাতে বাসর ঘরে ঢোকার আগে আমার মাথাটাই পুরো নষ্ট করে দিলে রিয়াজ!আমার কপালটা এতটাই খারাপ যে আমি একটা ভার্জিন মেয়ে পাই নি!”

ভীষণ আত্মসম্মানে লাগলো আমার।তাও মিথ্যে কিছু নিয়ে!এবার আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না।বললাম,

” আপনি না বুঝে না শুনে আমার নামে সব মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন অভি!রিয়াজের সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না।”
“আমি জানতাম তুমি সব মিথ্যে বলবে।তুমি এসব করেও হেরে যাবে।এইজন্যে তোমার সাথে আজ পর্যন্ত আমি এই বিষয় নিয়ে কথা তুলি নি!আমি জানতাম তুমি কখনোই সত্যটা আমাকে বলবে না!”

অভি এ কারণে আমাকে এতটা মাস তার স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে!জাস্ট এটুকু কারণে?অবাক!চরম রকমের অবাক।মাথাটা শূন্য হয়ে আসে আমার!বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠে!সাথে গলাটাও।এবার বুঝি আমি জোরে কেঁদে উঠবো!এমন সময় অভি তার ফোনটা আমার দিকে তাঁক করে।বলে,

“লুক!”

ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাঁকালাম।রিয়াজ ভাইয়ার পাশে বসা আমি।সে আমাকে নিয়ে সেলফি তুলেছে।অভি বললো,
“এটা তোমাদের ঘুরতে যাওয়া অবস্থায় তোলা,রাইট?”

আমার সারা শরীর কেঁপে উঠে।ঘুরতে যাওয়াটা ত জাস্ট একটু রিকুয়েষ্ট ছিল রিয়াজ ভাইয়ার।
“এটা আসলে উনার অনেক রিকুয়েষ্টের পর।”
“তাহলে একসাথে ঘুরতে যাওয়াটাও অন্যকিছু ছিলো?”

চুপসে যাই।সেটা আসলে কীভাবে যেন হয়ে যায়।আমি তখন রিয়াজ ভাইয়ার প্রতি একটু আবেগে পড়ি।আবেগটা অবশ্যি জোঁকের বসেই ছিল।এছাড়া আর কিছুই না।

“কি হলো বলো?”
“আসলে..?”
” বলতে পারবে না তাই তো?জানি বলতে পারবে না।
আমার কোনো আফসোস ছিল না!আমার আফসোস শুধু একটাই যে তুমি একটা ভদ্র ঘরের মেয়ে হয়ে কীভাবে পারলে ওই ভার্সিটির আস্ত বড় একটা সিনিয়র গুন্ডার প্রেমে পড়তে।তাও যেই ছেলে ডেইলি আঁটটা দশটা মেয়ের সাথে রুমডেটও করে।আর তুমিও
শেষপর্যন্ত সেসব মেয়েদের মতন..ছিঃ!আই হাস্ট হেইট দিস।আমার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ।তোমার মা বললেন তোমার সাথে ভুলগুলো মিটমাট করতে।আমি জানি না কীভাবে মিটমাট করা উচিত।সম্ভবত আর কখনো মিটমাট হবেও না!”

বলে অভি দম ছাড়ে ।খুব শব্দ করে দম ছাড়ে।অভির মুখ দিয়েও আমার মতন এখন আর কথা আসছে না।সে এদিকওদিক তাকায়।তারপর নিজেকে বহু কষ্টে সংযত করে বলে,

“আসছি!”

বলে অভি তরতর করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।অভি চলে যাওয়া মাত্রই আমার বাবা রুমে ঢুকলো।বাবার পেছন পেছন মাও!বাবা এসেই আমার গালে খুব জোরে দুটা চড় বসিয়ে দিলো!ঝাঁঝ গলায় বলে উঠলো,

“হলো ত আমার সন্দেহ সত্যি?হলো?বিয়ের আগে এতসব আমার লজ্জায় মাথা হেইট হয়ে আসছে!ছিঃ! আমার মানসম্মান আর রাখলো না!আমার বন্ধুর কাছে,অভির কাছে,অভির মার কাছে!ওকে বলো এখান থেকে চলে যেতে পারুল।যেদিকে চোখ যায় সেদিকে বলো চলে যেতে!ওর মুখ দেখতে চাই না আমি!”

আমি বরাবরের মতন এবারও চুপচাপ।বাবাকে জবাব দিতে পারি নি!বলতে পারি নি বাবা অভির সবকথা ঠিক নয়।রিয়াজ ভাইয়া অভিকে যা বললো সব বেশিভাগই বানোয়াট কথা!বাবা চলে গেলো।মা আর গেলো না।মা ঠায় সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো।মা বললো,

“অভি যা বললো সব কি ঠিক?”

আমি এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি।মাকে খুব জোরে জড়িয়ে ধরে বলি,

“মা আমি ওরকম কিছুই করি নি।মা তোমাকে একদিন বললাম না?রিয়াজ নামের একটা ছেলে আমাকে খুব ডিস্টার্ব করে?তার সাথে সম্পর্ক করিনি বিধায় সে আমার সংসারে এরকম আগুন লাগালো। সে ইচ্ছে করে ই এরকম করলো মা।আমি ওই রকম বখাটের সাথে কেন সম্পর্ক করবো,বলো?”

“টেনশন করিস না।আমি দেখি কি হয়!তবে ওই যে ছবি এবং তোর ঘুরতে যাওয়া?”

আমি এবার মার বুক থেকে মাথা তুলে চোখের পানি মুছে বলি,

“মা তাহলে শুনো এবার?কি থেকে কি হলো?”

ফ্ল্যাশব্যাক…

সেদিন ছিল আমাদের তৃতীয় বর্ষের লাস্ট সেমিস্টার পরিক্ষা।আমি এবং মমি এক্সাম দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হলাম।মমি আমাকে বিদেয় দিয়ে রিক্সায় চড়ে চলে গেল।আর আমি রিক্সার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকলাম।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এমন সময়,

“এক্সকিউজ মি,আপু?”

আমি পাশে ফিরে তাকালাম।দেখলাম একটা চিকন,লম্বা ছেলে এসে আমাকেই সম্বোধন করছে।আমি ছেলেটিকে বললাম,

“কিছু বলবেন?”

ছেলেটি আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এই এডমিট কার্ডটা কি আপনার?”

আমি চট করে এডমিট কার্ডের দিকে তাকালাম।এডমিট কার্ডের উপর আমার ছবি এবং নাম।আমি বললাম,

“হ্যাঁ আমার।আমার এডমিট কার্ড কি তাহলে পড়ে গেছে?”
বলে আমার ফাইল হাতরালাম।ফাইলে কোনো এডমিট কার্ড পাইনি।তাহলে এটাই আমার।বললাম,

“কোথায় পেয়েছেন এডমিটটা?”
“এডমিটটা আমি সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের সামনে পড়ে থাকতে দেখলাম।ছবি দেখে আপনাকে চিনতে পারলাম না।পরে কয়েকজনকে দেখালাম।তাদের মধ্যে একজন আপনাকে চেনতে পারলো।সে বললো আপনি এদিলে চলে এলেন।আমিও এদিকে আসলাম।দেখাহয়ে গেলো আপনার সাথে।যাক এডমিটটা দিতে পারলাম।”
“আসলে আমিও বুঝতে পারি নি আমার এডমিটটা কখন পড়েছে।থ্যাংকু ইউ সো মাচ আপনাকে!এতবড় বিপদ থেকে বাঁচালেন।এডমিটটা যদি হারিয়ে যেত তাহলে আমার আর এক্সাম ই দেওয়া হতো না।অনেক থ্যাংকস!”
“থ্যাংকস দেওয়া লাগবে না।মানুষ মানুষদের জন্যে ত কিছু করতেই পারে, তাই না?”
“নাম কি আপনার?”
“জ্বী আমার নাম রিয়াজ।আপনার?”
“আমার নাম পারিসা। ”
“শুধুই পারিসা?”
“জ্বী!”
“কিউট নেইম।”
“থ্যাংকস।”
“কিসে পড়েন আপনি?”
“জ্বী আমি এবার তৃতীয় বর্ষের লাস্ট সেমিস্টার এক্সাম দিচ্ছি।আপনি?”
“ওহ তাহলে ত তুমি আমার জুনিয়র!আমি চতুর্থ বর্ষে এবার।সমাজবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্ট!”
“আচ্ছা ভাইয়া!”

চলবে..
(পরের ফ্যাশব্যাকটুকু নেক্সট পর্বে পেয়ে যাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here