আমার হৃদয়ে সে পর্ব -০৬

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৬(বোনাস পর্ব)

তারপর থেকে উনার সাথে ক্যাম্পাসে এলে আমার প্রায়ই দেখা হত।দেখা হলেই উনি আমাকে দেখে হেসে দিতেন।আমিও তাতে তাল মিলিয়ে হেসে দিতাম।তবে তেমন বেশি কথা বলতাম।মানে উনি আমাকে হালকা চেনেন এবং আমি উনাকে চিনি এরকম সম্পর্ক আর কি। তারপর একদিন আমার ভার্সিটি ছুটি হলে আমি রিক্সার জন্যে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াই।অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন কোনো রিক্সা চোখে পড়ে নি তখন খুব বিরক্ত লেগে যায়।এমনিতেই আজ অনেকগুলো ক্লাস হয়েছে তারউপর আবার বাসায় পৌঁছাতে লেট হচ্ছে।ভাবনার মাঝে এমন সময় রিয়াজ ভাইয়া উনার বাইক নিয়ে আমার সামনে থামেন।বলেন,

“কি পারিসা?রিক্সা পাচ্ছা না?”

আমি সাবলীলভাবেই জবাব দিই,
“জ্বী,ভাইয়া।”
উনি তখন উনার বামহাতে থাকা ঘড়িটার দিকপ তাকান।তাকিয়ে খুব চিন্তিত গলায় বলেন,

“এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে!একটা কাজ করো তুমি আমার বাইকে চড়ো আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব।”
“নাহ ভাইয়া তার প্রয়োজন নেই।আমি নিজেই যেতে পারবো।”
“রিক্সা ত পাচ্ছ না।যাবে কীভাবে?”
“আরেকটু দাঁড়াও পেয়ে যাবে।”
“তোমার ইচ্ছে।”

বলে উনি উনার বাইকটা একপাশে ব্রেক করে রাখেন।তা দেখে আমি বললাম,

“ভাইয়া আপনি যাবেন না?”
“যাবো।আগে তুমি রিক্সা পাও।যদি রিক্সা না পাও তাহলে ত..! ”

বাকিটা বললেন না আর।অবশ্যি আমি বুঝে ফেললাম রিক্সা না পেলে উনি তখন আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন।আমার খুব হাসি পেয়ে যায়।হাসিটা উনি আমার দেখে পেলেন।উনিও হেসে দেন।উনার কথাই হলো। পরবর্তীতে দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরও রিক্সা পাই নি।তারপর বাধ্য হয়ে উনার রিক্সায় উঠি।উঠামাত্রই উনি আমাকে একটা কথা বলেন,

“আজকের পরিবেশ টা খুব সুন্দর,না?”

আমি চারপাশে তাকিয়ে বলি,
“জ্বী।”
“আজকে ঘুরতেও হেব্বি হবে।”
“ওহ।তো ঘুরতে যাবেন আজকে?”
“যেতাম।কিন্তু ঘুরার মতন তেমন কাউকে পাই নি ত তাই ঘুরতে পারছি না।”
“আপনার বন্ধুবান্ধব নাই?”
“আছে।তবে সবাই সবার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বিজি।গার্লফ্রেন্ড নিয়েই ওদের ঘুরতে ঘুরতে সময় যায়। বন্ধুদের নিয়ে আর কখন।”
বলে হাসার চেষ্টা করেন।আমি হাসলাম।তারপর উনি বলেন,

“তোমার ঘুরতে কেমন লাগে?”
“বেশ ভালো।”
“কাদের সাথে বেশি ঘুরতে পছন্দ করো?”
“বান্ধবীদের সাথে।”
“বয়ফ্রেন্ড নেই তোমার?”

তখন উনার কথায় আমি খুব লজ্জা পেয়ে যাই।আমি যে লজ্জা পেয়েছি উনি বুঝে পেলেন।
“আরেহ লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।বলো?বলো?”
“নাহ!”
“গ্রেটস!বফ না থাকাই ভালো।এসব থাকা মানেই প্যারা।রাইট?”
আমি মাথা নাড়ি।তারপর উনি লম্বা একটা হাঁক ছেড়ে বলেন,

“আমার একটা রিকুয়েষ্ট রাখবে?”
“জ্বী?”
“ভাবলাম বালুনদীতে যাবো।কিন্তু যাওয়ার মতন সাথে তেমন কেউ আমার নেই।যদি তুমি যেতে আই মিন ভাই হিসেবে?”
“নাহ ভাইয়া,নাহ।আমি আসলে কারো সাথে ঘুরতে যাই না।”
“কিছু হবে না।কাছেই বালুনদী।বেশিক্ষণ লাগবে না যেতে।কয়েক মিনিটস থাকবো তারপর আমরা আবার চলে আসবো।”
“ভাইয়া আসলে আমার বাসায় শুনলে সমস্যা আছে।”
“আরে কিছু হবে না।ওটা আমিই ম্যানেজ করবো।ওকে?”
“ভাইয়া থামুন,থামুন।”
“বাসার সামনে ত এখনে আসি নি।”
“নাহ ভাইয়া।আরে কাছে গেলে প্রবলেম আছে।কারণ ওদিকে সব পরিচিত মানুষ।”
“আচ্ছা বুঝলাম, বুঝলাম।আমাকে তোমার সাথে দেখলে মাইন্ড করবে তাইতো?মাইন্ড করলে সোঁজা বলবা আমার বয়ফ্রেন্ড না।আমার সিনিয়র ভাই।”

আমি নিচের দিকে তাকিয়ে উপরের ঠোঁট কামড়ে ধরি।লজ্জা পেয়েছি ভীষণ।
“আচ্ছা আসি পারিসা।মজা করলাম কিছু মনে করো না।জানি এখনকার মানুষ খুব মাইন্ডফুলী।”

তারপর তিনি চলে যান।আমি বাসায় আসার পর অনেকক্ষণ ভাবতে থাকি উনার আবদারটা একসেপ্ট করবো নাকি রিজেক্ট করবো।তবে মনটা বার বার বাড়াবাড়ি করছে একসেপ্ট করতে।মনটা বড্ড বেহালা!কোনোকিছু মানে না।কেন মানে না জানি না।তবে বারবার এটাই মনে হলো উনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো।উনি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন এবং খুব মিশুকও।মাইন্ড টাইন্ড উনার মাঝে নাই।পরদিন ভার্সিটিতে যাওয়ামাত্রই উনি কোথাও থেকে আবার আমার পাশে এসে দাঁড়ান।বলেন,

“কি ডিসিশন নিয়েছো, পারিসা?”

আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যাই।কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,

“আসলে ভাইয়া..!”
“নো আসলে আসলে..।উত্তর ইয়েস/নো।”

খানিক্ষণ চুপ করে থাকি।সেই সময়ের জন্যে কেনজানি ভীষণ আবেগে পড়ে যাই।সামনের পিছনের কোনেকিছু আর ভাবি নি।চট করে বলে ফেলি,

“ইয়েস।”

উনি রাশভারী হাসি দেন।তারপর দিনই আমরা বালুনদীতে যাই।চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখি।প্রচন্ড বাতাস।বালুপানির খেই খেই ঢেউ।দারুন একটা পরিবেশ।উনি এমন সময় এসে বলেন,

“পারিসা,চলো?আমরা ওই জায়গাটায় গিয়ে বসি।”

বসলাম।তারপর উনি উনার ফোনটা বের করে বলেন,

“এমন সুন্দর একটা জায়গায় আসলাম।যদি সেলফি না তুলি কেমন দেখায় বলো ত?একটু ক্যামেরার দিকে তাকাও?একটা সেলফি তোলা হোক আমাদের?”

আমি এবারও অবুঝের মতন তাতে সায় দিলাম।অনেকগুলো সেলফি তুললো আমার।তারপর সাদামন নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।বরাবরের মতন পরের দিন ভার্সিটিতে গেলাম।যাওয়া মাত্রই আমার ফ্রেন্ড মমি আমার ডান হাতটা টান মেরে আমাকে একপাশে এনে দাঁড় করিয়ে বলে,

“কী দেখতেছি এসব?”
“ক-কি!”
“কি?”
“তুই কাল ভার্সিটির সবগুলো ক্লাস না করে কোথায় গিয়েছিলি?”

আমি মমিকে সত্যটা বলতে পারলাম না।মমি কীভাবে যেন সত্যটা বের করে নিল,

“ওই রিয়াজ নামের ওই ভাইটার সাথে ঘুরতে গিয়েছিলি,না?”
“তুই কীভাবে জানিস?”
“দেখেছি আমি।তখন আমি ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং দাঁড়িয়ে দেখেছিোম।ঘুরতে গিয়েছিস ভালে কথা!যার সাথে গিয়েছিস উনাকে তুই ভালো করে চিনিস?”
“ক-কে উনি?”
“হায়রে বলদ!এটা আমি গতকাল দেখেই বুঝতে পেরেছি তুই উনাকে চিনিস না তাই উনার সাথে হাঁটাচল করতেছিস।নাহলে কখনোই করতিস না!”
“উ-উনি ক-কে?”
“আব্রাহাম রিজভী রিয়াজ নামটা ত শুনেছিস,না?”
“হ্যাঁ!”
“উনিই সেই আব্রাহাম রিজভী রিয়াজ ভাইয়া!”

মমির কথা শুনামাত্রই আমি মুখে হাত দিয়ে মাটিতে ধপাস করে বসে পড়লাম।হতাশ জনিত কন্ঠে বলে উঠলাম,

“মমি গো, এটা আমি কি করলাম!উনার নাম অনেকের কাছে শুনেছিলাম উনি নাকি খুব বখাটে টাইপের!মেয়েদের নাকি র্যাগিং দেন!”
“হ্যাঁ!”
“এখন?এখন কি হবে?আমি যদি উনাকে আগে দেখতাম।আমি উনার নাম শুনেছি কতবার কিন্তু উনাকে কখনো দেখি নি!”

বলে আবারো ব্যথাতুর শব্দ করে উঠলাম।মমি বলে,
“এই তোদের মতন অতিরিক্ত ভদ্রতা বজায় রাখার চেষ্টা করার মেয়ে গুলাই সবথেকে বেশি ফাঁদে পড়ে!”
“তো তুই কি বলতে চাচ্ছিস অভদ্র হয়ে থাকতে?”
“অভদ্র নারে ভাই।ভদ্র তবে গরজিয়াস ওরকম টাইপ।মানে চারপাশে চোখ-কান খোলা রাখার কথা বলেছি,শুধু বাসা এবং ক্লাসরুম না!”
“হয়েছে। ভুল ত করেই ফেললাম।এখন সমাধান কি ওটা বল!”
“সমাধান আর কি!সরাসরি বলে দিবি ছেলেদের সাথে কথা বললে আমার বাবা আমাকে ভার্সিটি আসা বন্ধ করে দিবে।তাই দয়া করে প্লিজ ভাইয়া আমার কথাটুকু অন্তত ভেবে আমার থেকে দূরত্বতা বজায় রাখার চেষ্টা করবেন।নাহলে আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে!আর যদি মিষ্টি করে বলার পরও ব্যাটা না মানে তাহলে সরাসরি ইগনোর।ক্লিয়ার?”
“হুম।”

মমির কথামতো রিয়াজ ভাইয়াকে ভালোমতন বলার পরও৷ লাভ তেমন হয়নি।উনি উল্টো আমার সাথে আরো বেশি কথা বলার চেষ্টা করতে থাকেন।ভার্সিটিতে গেলে আমার পথ আগলানোর চেষ্টা করেন।ক্যান্টিনে বসলে আমার সামনে এসে বসেন।বাসায় গেলে আমার পেছনে পেছনে ছুটেন।একদিন তো বাবা উনাকে আমাদের বাসার সামনে দেখে ফেললেন।উনাকে দেখার পর সেই থেকে বাবার মনে উনাকে নিয়ে আমার উপর সন্দেহের দানা বাঁধতে থাকে।আমি আর পারলাম না চুপ থাকতে।এবার সরাসরি উনাকে বারণ করে দিলাম।

“দেখুন,আপনি এভাবে আমার পেছন পেছন আসতে পারেন না!রাস্তার লোকে কি বলে?ভার্সিটির স্টুডেন্টরা কি বলে?ইভেন আমার বাবাও আপনাকে দেখে ফেলেছে!আপনি জানেন আপনি এভাবে আমার পেছনে আসেন আমি কতটা রিস্কিতে আছি!?”
“দ্যাখো,কে কি ভাবে,কি বলে আমি ওসন ভাবি না।তুমি আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ?আমি সেদিনের ঘুরার পর থেকে তোমাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি!”
“আমাকে ভালোবাসেন নাকি আমার শরীরকে!”
“মানে?”
“আপনি কি ভেবেছেন আপনাকে আমি চিনি না?আপনাকে খুব ভালো করেই চিনি!আপনি যেমন গুন্ডা,তেমন বখাটে।কোনো মেয়ে আপনার সাথে প্রেম করবে না!”
“আমার সাথে প্রেম করবে না? ”
“নাহ!”
“সত্যিই করবে না?”
“আপনি কি জোর করছেন?”
“ওকে।ভালো থেকো!”

বলে চলে গেলেন উনি।বাসায় আসার পর আমি খুব ভয়ে পেয়ে যাই!কারণ উনার সাথে আমি যে সেলফি তুলেছি সেগুলো যদি ফেসবুকে ছেড়ে দেয়?তাহলে আমার সব শেষ!উফস,এসব আমি কি করলাম?কিছু বলার আগে কেনো ছবিগুলোর কথা একবারও ভাবলাম না!এখন?ভাবতে ভাবতে পুরোটা রাত আফসোস করি!সে রাতে আর ঘুম হয়নি।দিনে আমি হন্তদন্ত হয়ে উনার নাম্বারে কল দিই।বাট নাম্বার অফ পাই।সেই থেকে আর কোনোদিন নাম্বারটা অন পাইনি।ভার্সিটিতেও উনাকে দেখি নি।আর ভার্সিটিতে না থাকারই কথা।যখন উনার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় তখন উনার গ্রাজুয়েশন ফাইনাল এক্সাম চলে!

বর্তমান…..

“সেদিনের সেই ভয়টা আজ সত্যিই হয়ে গেল মা।”

বলে মার দিকে ভেঁজা চোখে তাকাই।মার মুখটাও ভীষণ রকম মলীন হয়ে যায়!আমার পিঠ চাপড়ে বলেন,

“টেনশন নিবি না পারিসা।আমি তোর বাবাস সাথে কথা বলে দেখি!”

একটা তাচ্ছিল্যকর হাসি দিয়ে বললাম,
“বাবাকে আর কি বলবে,মা?বাবা আমাকে আগেও বিশ্বাস করেনি এবং এখনো করবে না।বাদ দাও।”
“মানুষ ত না বুঝে অনেক কিছুই বলে মা।তোর বাবা বুঝতে পারে নি তাই হয়তো…।”

মাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে দিলাম না।হাত দিয়ে থামিয়ে দিলাম।মা চুপ হয়ে যান।আমিও চুপ থাকি কিছুক্ষণ।নিশ্চুপতার গুমোট ভেঙ্গে মা পরক্ষণে বলে উঠেন,
“তো এখন কি করবি?অভিকে গিয়ে সব বিস্তারিত বলবি?”
“বলতে ত অবশ্যই হবে।আমি চাই না কারো চোখে দুশ্চরিত্রা এবং খারাপ হয়ে থাকতে।”

মা আমার এ’কথা শুনামাত্রই মার চোখজোড়া চকচক করে উঠে।অধীর কন্ঠে বলেন,

“হ্যাঁ রে মা হ্যাঁ।এটাই করিস।আমি চাই তোদের ভুল বুঝাবুঝিটা নিজেদের মাঝে সংশোধন করে সুন্দর মতন আবার সংসারটা শুরু কর।”
“এতকিছুর হবার পরও তুমি বলছো অভির ঘরে আমি যেতে?”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here