আমার হৃদয়ে সে পর্ব -০৭

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৭

আমার কথা শুনে মার চোখজোড়া চকচক করে উঠে।অধীর কন্ঠে বলে উঠেন,

“হ্যাঁ রে মা, হ্যাঁ।এটাই করিস।আমি চাই তোদের ভুল বোঝাবুঝিটা নিজেদের মাঝে সংশোধন করে সুন্দর মতন আবার সংসারটা শুরু কর।”
“এতকিছু হবার পরও তুমি এখনো বলছো আমি অভির ঘরে যেতে?”

মা আমার এ’কথার পিঠে চুপ হয়ে যান।আমিও আর কিছু বলি নি।তারপর হাতের মুঠোয় বদ্ধ থাকা ফোনটার দিকে একফোঁড় তাকিয়ে রুমে ফিরতে ব্যস্ততুর হয়ে যাই।মার সামনে থেকে পেছন ঘুরতে আবার মা বলে উঠেন,
“তাহলে এখন কি করবি ভেবেছিস?”

আমি মার দিকে খুব প্রশস্তভাবে না তাকিয়ে খানিকটা ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দিই,

“দেখি কি করা যায়।”
বলে একটা গাঢ় শ্বাস ছেড়ে আমার রুমে চলে আসি।ফোনটা বিছানার দিকে ছুঁড়ে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াই।গ্রিল ধরে বাইরে তাকাই।আকাশে থালার মতন বড় চাঁদ ওঠেছে।তার জোৎস্নায় চারপাশে কেমন চকচক করছে।দূরে অদূরে তার তারসাথে তাল মিলিয়ে জোনাকীদেরও দেখা যাচ্ছে।তারা নিজেরা নিজেরা খেলা করছে।তবে তাদের ওতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।তাকিয়ে থাকলাম খানিক্ষন সেদিকে।খুবই সজীব এবং প্রাণবন্ত লাগছে চারপাশ।এত সজীবতা এবং প্রাণবন্ততার মাঝেও আমার ভেতরটায় একজোড়া কালো মেঘ দখল করে আছে।চোখ বুঁজলেই অভির এবং বাবার তিক্ত মুখগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে।কতগুলো অপবাদ পেলাম অভির।সাথে বাবারও তালে তাল মেশানো বুলি!একটা মেয়ে তার বাবার থেকে কীভাবে এসব ডিজার্ভ করে?পরের ছেলে বলতেই পারে তাই বলে সাথে বাবাও?এভাবে অপবাদ আর কতো?.. আবারো গলাতে কান্নার দলা বেঁধে যায়।চোখ থেকে ঝরঝরে অশ্রু সারা গালে উপচে পড়ে। আঁচলটা টেনে দুই হাত দিয়ে কিছুক্ষণ মুখ চেপে কান্নার বাঁধ থামাই।তারপর আবারো নিজেকে বহু কষ্টে সংযত করে চোখের অশ্রু মুছে জানলা থেকে বিছানায় গিয়ে বসি।বিছানার উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে খালামণির নাম্বারে কল দিই।খালামণির বাসা উত্তরায়।কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হয়,

“হ্যাঁ,পারিসা?কেমন আছিস?”
“ভালো খালামণি।খালামণি তোমার বাসায় কি থাকার জায়গা হবে?”
“হ-হঠাৎ এমন কথা যে!?এই কিছু হয়েছে নাকি বাসায় আবার?”
“নাহ কিছু হয়নি।কি হবে আর।আচ্ছা আগে বলো জায়গা আছে বাসায়?”
“থাপড়ামু!এভাবে বলতেছিস কেনো!?আমার পুরো বাসা খালি!আয় তাড়াতাড়ি।”
“ধন্যবাদ,খালামণি।”

বলে কলটা কাঁটি।হাসি চলে এলো খালামণির শেষ কথাগুলো শুনে।আসলে আমার একজনই খালামণি।খালামণি মার বয়সে ছোট্ট।আই মিন আমার ছোট্ট খালামণি।খালামণির মেয়ে নেই।একটাই ছেলে।সবে ক্লাস ফোরে পড়ে। মেয়ে নেই বিধায় খালামণি আমাকে একদম উনার মেয়ের মতনই ভাবে।আবার মতন যে বলছি তাও না।বলতে গেলে আমিই যেন উনার মেয়ে এতটাই স্নেহ করেন আমাকে।এখন ডিসিশন খালামণির বাসায় যাবো।থাকবোও।দেখি ওখান থেকে কোনো একটা জবের ট্রাই করতে পারি কি না।এমন মিথ্যে অপবাদে এই ঘরটা বড্ড অসহ্য লাগছে।দূরে চলে যাবো এখান থেকে!আর কারো দৃষ্টিগোচর আসবো না!

৮.
পরদিন সকাল আঁটটায় জামাকাপড়গুলো কাবার্ড থেকে বের করি তরহর করে।সবগুলো জামা গুছিয়ে ট্রলিতে ঢুকাতে থাকি।এমন সময় মা আসেন রুমে।আমাকে ট্রলিতে জামাকাপড় ঢুকাতে দেখে চিন্তিত কন্ঠস্বরে বলেন,

“জামাকাপড় গুছাচ্ছিস যে,পারিসা?”

মার কথার জবাব দিই নি।নিজ মনে ট্রলিতেই জামাকাপড় ফুঁড়তেছি।আমার জবাব না পেয়ে মা আবার বলেন,

“কিছু বলছিস না কেন?কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

এরমাঝে জামাকাপড় সবগুলো মোটামুটি গোছগাছ শেষ হয়ে যায়।এবার মাথা তুলে মার কথার জবাব দিই,

“খালামণির বাসায় যাচ্ছি।আর হ্যাঁ,একথা বাবাকে বলবে না।আর আমি যদি খালামনির বাসায় যেয়ে যদি জাহান্নামেও যাই তাও বলবে না।”
“এটা কেমন কথা বললি,পারিসা?বাবাকে কেউ এভাবে বলে?”
“বাবা ও কি তার মেয়েকে কিছু বলার আগে ইতস্ততা বোধ করে?!নাকি পর লোকের সাথে কথার তাল না মেলালে পয়সা পায় না!”
“পারিসা?বাবারা একটু ভুলবাল করেই।সেটা তেমন কিছু না!আর তোর বাবা কি এখন অভির সাথে ঝগড়া করবে?আর পরের ছেলের সাথে ঝগড়া করলেই ত সমস্যা। সংসারে ঝামেলা হবে!একজন বাবা তা চায় না।বাবাদের চাওয়া কীভাবে পরের ছেলেকে শান্ত এবং দৃঢ় স্থির রেখে মেয়ের সংসারটাকে টিকিয়ে রাখতে।কারণ উনার নিজের মেয়ের সংসার।মেয়ের কিছু হলে তো বাবারই চিন্তা। আর চিন্তাও করছে তোর বাবা এখন।বিশ্বাস না হলে গিয়ে দেখ কতটা চিন্তায় আছে।খাবার টুকু পর্যন্ত খাচ্ছে না!আমি সেই সাতটার দিকে টেবিলে খাবার দিয়ে এসেছি।খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে তারপরও খেতে ভাবান্তর আসছে না।ওদিক দিয়ে অফিসেরও লেট হয়ে যাচ্ছে।”

আমি মার কথা বলার দিকে তাঁকিয়ে আছি।কতটা ব্যাকুল ভঙ্গিতে মা কথাগুলো বলতেছেন।আসলে মা এরকমই।একটু স্বামী ভক্তি টাইপ আর কি।ছোট্টবেলা থেকেই মার এহেন আচরণ দেখে আসছি।একবার হলো কী আমার নানু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।অসুস্থতায় নানু ত একদম মৃত্যুশয্যা ব্যক্তিদের মতন হয়ে যান।নানু খালি বারবার পানি চায়।নানুর এহেন দেখে খালামণির সে কি কান্না এবং মামাদেরও!পুরো বাড়ি যেন কান্নাতে ভরে যায়।আশপাশের সব মানুষ কান্নার আওয়াজ শুনে বাড়ির আনাচেকানাচে জড়ো হয়।আর এদিক দিয়ে আমার মা তার সোনায় সোহাগা স্বামীকে সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে ব্যাকুল।কারণ,বাবার এগোরটার দিকে ওষুধ আছে।সেই ওষুধটা খেয়েছে কিনা তা জিজ্ঞেস করতে!কোথাও তুফান হোক,ভূমিকম্প হোক যদি বাবার হালকা পাতলা হেরফের হয় তা ওই তুফান এবং ভূমিকম্প থেকেও মার বাবার প্রতি তাগোদ বেশি।
মার অভ্যসেটাকে আমার ফুপী নাম দিয়েছে স্বামী পাগল।” অবশ্যি মার এই অভ্যসেটা মা কার থেকে পেয়েছে তাও জানি না।আমার দেখামতে আমার নানাদের এবং দাদাদের বংশের কারো এরকম অভ্যেস নাই।আর মার এই অভ্যসেটা এখন আমার জন্যে অনেক কাল।এতটা দুঃখ সময় আমার!তারপরও আমার কষ্টগুলো থেকে তার স্বামীর বলা কথাগুলো খুব বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।খাবারটা ইম্পর্ট্যান্ট। আমার কষ্টগুলো ইম্পর্ট্যান্ট না।কিছুক্ষণ আগে বলা বিয়ের আগে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটাও না।খুবই আফসোসের কথা।এই কারণে আমার কপালটা এতটা আটপৌরে!মা আবার জবাব না পেয়ে বলেন,

“দ্যাখ মা,সব মাটি দিয়ে দে।তোর বাবা কি বললো অভি কি বললো সব মাটি দিয়ে দে।মানুষ রাগের বশে কতকিছুই বলে তাই না?রাগ কমে গেলে দেখবি সব ঠিকঠাক!”

এবার মাকে না বলে আর পারলাম না,

“অতিরিক্ত স্বামী ভক্তি যারা তারা কখনো স্বামীদের অত্যাচার বুঝে না।মা একটু স্বাধীনচেতা হতে শিখো।নিজে নিজে অনুধাবন করে বুঝতে শিখো।অন্যের উপর জীবন চলে না।অভি যেসব কথাবার্তা বললো ওসবে কি একটুও আত্মসম্মানের প্রশ্ন আসে না?ও আমার কতটা আত্মসম্মানে আঘাত করেছে বুঝতে পেরেছো?বুঝো নি।বুঝলে এভাবে আমাকে কখনোই বলতে না।আসলে পরের ছেলে কি দোষ দেবো? তোমরা আমার নিজের মা-বাবা হয়ে নিজেরাই আমাকে বুঝতে পারলে না।”
“পারিসা?আমি কি তোকে সেরকম কিছু বলেছি?আমি কি বলেছি তুই সব করেছিস?আরেহ আমিতো জানি তুই কিছুই করিস নি!আমি বলতে চাইলাম তোর বাবা বয়স্ক তার হিসেবে সে হয়তো ঠিক ভেবে বলেছে।আবার একেবারেও যে ঠিক তাও না। এখন রাগের মাথা।আস্তে আস্তে রাগ কমলে তখন অন্যকিছু ভাববে।প্লিজ মা বুঝার চেষ্টা কর।বাবাকে সময় দে একটু।বাবাস সাথে এবং অভির সাথে এভাবে রাগ করে কোথাও যাস না।”
“গুণীদের একটা কথা জানো কী মা জানো?সবকিছু বিসর্জন দিতে পারো,তবে তোমার আত্মসম্মানটা না।আমার কাছে আমার আত্মসম্মানটা অনেক বেশিই দামী।আর আরেকটা কথা আমি খালামণির বাসা গেলে আমাকে কলটল দিবা না।আসি।”

বলে ট্রলির হাতল ধরে মাকে পাশ কেঁটে সুড়সুড় করে চলে আসি।রিক্সা করে খালামণির বাসায় পৌঁছাই।খালামণি আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে যান।বুকে জড়িয়প নিয়ে বলেন,

“অনেক খুশি হয়েছিস এসেছিস।আগের বিয়ে সেই যে বেড়িয়ে গেলি।আর আজ এলি।তা অভিকে সাথে নিয়ে আসলি না কেন?”
“কে অভি!!”
“মানে কী?”
“প্লিজ খালামণি আমাকে অভির কথা আর বলো না!”

বলার মাঝেই আমার চোখজোড়া পানিতে ঝাপসা হয়ে আসে।তা খালামণি ধরে ফেলেন।গাল চাপড়ে করুণ স্বরে বলেন,

“এই পারিসা কিছু হয়েছে নাকি তোর?”

আমি কোনোকিছু না বলে খালামণিকে এবার জড়িয়ে ধরে অস্ফুট স্বরে কেঁদে উঠি।আমার কান্না দেখে খালামণি হতভম্ব।বলেন,

“আরেহ এভাবে ছোট্ট বাচ্চাদের মতন কাদছিস কেনো?কি হয়েছে তোর?কী হয়েছে?বল আমাকে?”

আমি তারপরও কান্না থামাতে পারছি না।কান্নার বেগ যেন আরো বেড়ে যাচ্ছে।তা দেখে খালামণি হতাশ হয়ে যান।হতাশ ভাবটা নিজের মাঝে স্বাভাবিক করে এবার আমাকে আলতো করে ছাড়ান।তারপর দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে সোফায় এনে বসান।মুখের, মাথার এলোমেলো চুলগুলো মাথায় আবার পরিপাটি করে দিয়ে নরম কন্ঠে এবার বলেন,

“হয়েছে টা কী,পারু?বল খালামণিকে?”

বলতে পারি নি।মুখ দিয়ে কোনো কথা ই আসছে না।তারপর খালামণি আবার একে একে তিন তিনবার জিজ্ঞেস করেন।আমি চতুর্থ বারের সময় জবাব তুলি।জবাব দিতে কষ্ট হয়েছে প্রচন্ড!তারপরও বারকয়েক হাঁক ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে পুরো ব্যাপারটা খালামণিকে বলি।খালামণি আমার কথা শুনে চোখজোড়া কপালের দিকে তুলে ফেলেন।আমার বলা শেষ হওয়া মাত্রই খালামণি বলে উঠেন,

“অভি এতটা খারাপ!?কত ভদ্র ভেবেছিলাম ছেলেটাকে!আর তোর বাবাও না কি,ছিঃ!নিজের মেয়েকে কেউ এতটা অবিশ্বাস করে?শোন?কোনো টেনশন নিবি না!ওদের এতটা জঘন্য কথা,হীনমন্যতা কথা,অপবাদের কথা নিজেকে একদম দুর্বল ভাববি না।জাস্ট, ট্রাই টু স্ট্রং ইউরসেলফস!সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“সব ঠিক হয়ে যাবে খালামণি মানলাম।তবে অভির সংসার আমি করবো না এটাই সত্যি।”

“পৃথিবীর সব মানুষ ভুল করে।সেই ভুলে মানুষগুলো তার প্রায়শ্চিত্তও আবার ভোগ করে।দেখিস অভিও পাবে।পাওয়ার পর সে তার ভুল বুঝে ফেলবে।ইভেন তোর কাছে ক্ষমাও চাইতে আসবে।আর এরকমই পৃথিবীর সব।পৃথিবীর নিয়ম এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলছে।”

বলে খালামণি মুখে হাসি টেনে আমার দিকে তাকান।এ’কথার পিঠে আমার মাঝে আর কোনো ভাবান্তর পাননি।তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন,

“তুই রুমে যা।ফ্রেশ হ।আমি দেখি কি রান্না করা যায়।”

আমি খালামণির কথায় সায় দিয়ে রুমে চলে এলাম।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here