আমার হৃদয়ে সে পর্ব -১৩+১৪

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-১৩

খালামণি কাছে এসে আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরেন।আরেক হাতে গালে আলতো ছুঁয়ে বলেন,
“একদম কাঁদবি না।তোকে কাঁদতে মানায় না।তোকে শুধু হাসিতে মানায়।সফলতা তোরই যোগ্য।”

খালামণির কথায় ফিক করে হাসি চলে আসে।কান্নাহাসি মিশ্রিত মুখে খালামণির বাম হাত চেপে ধরি। বলি,
“সেজন্যে কাদি নি।কাদি তোমাদের আতিথেয়তায়।তোমরা আমাকে অনেক বুঝ!আমার ফ্যামিলি আমাকে বুঝে না।আচ্ছা তোমরা এত ভালো কেন,হ্যাঁ?!”
“এভাবে বলতেছিস কেন?তুই ত আমাদেরই মেয়ে।বোনের মেয়ে মানেই ত আমার মেয়ে তাই না?”

হেসে দিই।খালামণিও সহিত হেসে উঠে আমার গালের উপর চিকচিক করা চোখের পানি মুছে দেম।তারপর সযত্নে আমাকে বুকের দিকে টেনে নেন।আমি খালামণির বুকের উপর আলতো মাথা রাখি।তীক্ষ্ণ কানে স্পষ্ট কানে বাঁজে হার্টবিটের ধ্বনি।দ্রুতগতিতে হার্টবিট হচ্ছে।প্রতিটি বিটে বিটে খালামণির কষ্টের কথার বাণ খুলছে। খালামণির বরাবরই মেয়ে সন্তান খুব পছন্দের।
।ফাহিম গর্ভে আসার পর খালামণির শখ ছিল প্রথম সন্তান মেয়ে হতে।হলো না।ছেলে হয়।ফাহিমের বয়স দেড় পেরুতে আন্টি আবারো মেয়ে সন্তানের আক্রোশে সন্তান নেন।আন্টির স্বপ্নটা পূরণও হয়ে যায়।কোল ভরে ফুটফুটে একটা মেয়ে সন্তান আসে।তবে ভাগ্য বলে যে একটা কথা আছে তা আন্টির কপালে হয়তো সহায় হয়নি।মেয়ে সন্তানের বয়স ছয় মাসে পড়তে সে প্রচন্ড নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়।সর্দি,কাশিতে মেয়েটির সারা দেহ অবশ হয়ে যায়।আন্টি তাকে বাঁচাতে অনেক হাসপাতালে ছুটোছুটি করে।কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। তাকে বাঁচাতে পারে নি। মরে যায়।সেদিন খালামণি খুব কষ্ট পায়।বিষন্নতায় কেঁটে যায় কয়েকটা মাস । তারপর আন্টি আবারো নিজেকে ধাতস্থ করে।আবারো বুকে বাসা বাঁধে কন্যা সন্তানের আশায়।পরে আর আন্টির গর্ভে কোনো সন্তান আসে নি।সমস্যাটির জন্যে খালামণি ডাক্তারের কাছে ছুটে যায়।ডাক্তার বলে,জরায়ুর মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাই আর কোনো সন্তান ধারণের ক্ষমতা নেই খালামণির।কোনো সন্তানই না।কেঁদে দেয় আন্টি।ভীষণ রকমের কেঁদে দেয়।তারপর আমাকে জড়িয়ে আরো কাঁদেন।আমি তখন কিশোরী ছিলাম।কিশোরী মনেই বলি,খালামণি তোমার মেয়ে নেই বিধায় কি হয়েছে?আমি ই ত তোমার মেয়ে!”খালামণি প্রচন্ড খুশি হয়ে যান। আদরে সারা মুখে চুমু বসিয়ে দেন।
সেই ভালোবাসাটা হয়তো আজও আমার প্রতি খালামণির রয়ে গেল।

১৭.
দুপুরের দিকে এম ডি আমাকে কল করে।বলে আর্জেন্ট তাদের অফিসে যেতে।অভি স্যার ডেকেছে।আমি যাই।যাওয়ার পরে শুনি তাদের অভি স্যার নাকি অন্য কোম্পানির সাথে চুক্তিতে বসেছেন।এখন তার মিটিং হচ্ছে। মিটিং শেষ হতে আরো দেড় ঘন্টার মতন সময় লাগবে।তাই এই দেড় ঘন্টা ওয়েটিং রুমে বসতে।ওয়েটিং রুমে বসতে যেয়ে খুব বিরক্ত লাগে এম ডির উপর।এম ডি কল করে আসতে এত তাগাদা দিলো।আর এখন এসে দেখি তাদের মিটিং চলছে।আমাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে।মন চায় এম ডির মাথাটা ফাঁটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে দিই।অপেক্ষা করতে থাকি।আধা ঘন্টা পার না হতে ধৈর্য্য আর ধরে রাখতে পারি নি।টগবগিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিয়নকে ডাকি।বলি,

“আপনার স্যারকে বলুন তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ করতে।আমি আর অপেক্ষা করে থাকতে পারবো না।”

আমার কথায় ক্রোধ দেখে পিয়ন কেঁপে উঠে।নত মাথায় বলে,
“জ্বী,ম্যাম।এখুনি গিয়ে বলতেছি।”

বলে চলে যায়।তবে পিয়নকে দেখে বড্ড অবাক হয়ে যাই।অনেক কোম্পানিতে গেলে দেখি পিয়ন গুলা ত্যাড়া টাইপের হয়।সহজে কথা শুনতে চায় না।আর অভির কোম্পানির পিয়ন দেখি খুবই সাদাসিধা আর বোকা টাইপ।কথাটা বলা মাত্রই কী সুন্দর মেনে নিল।মালিক চালাক টাইপ।আর তার পিয়ন বোকা টাইপ।বড্ড হাস্যকর!তার খানিকক্ষণ পর পিয়নের বদৌলতে এম ডি ফিরে আসে।মুখে নিরস ভাব এনে।বলে,

“সরি ম্যাম,আসলে হঠাৎ করে আমাদের একটা কোম্পানির সাথে অন্য আরেকটা কোম্পানির চুক্তি হয়ে যায়।তাই বাধ্য হয়ে বসতে হয়।আপনি একটু কষ্ট করে আর অপেক্ষা করুন।খানিক্ষণ বাদেই মিটিং শেষ হয়ে যাবে ম্যাম।”
এম ডির কথায় রাগ-ক্রোধ ভেতরে চাপি।তারপর স্বাভাবিকতায় বলি,
“জ্বী,আচ্ছা।”

ত্রিশ মিনিট বাদে অভির অফিসে ডাক আসে।যাই।তার কোনোরকম অনুরোধ ছাড়া চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়ি।বিষয়টা একটু অভদ্রতা ই দেখালো।অভিও ব্তা দেখলো।তবে কিছু বললো না।বলবে ই বা কেন?তাদের
অফিসে কাজ করতে এসেছি এটাই ঢের।নাহলে এ’কদিনে তাদের এবারের সর্বোচ্চ অর্জন কী বিনে কারণে পেত?ভাবনার মাঝে,

“আই’ম সরি ফর লেট।হঠাৎ মিটিং এ বসতে হবে বুঝতে পারি নি।”
অভির কথার পিঠে বাম পাশের ভ্রু টা কুঁচকে ফেলি।তবে কোনো জবাব দিই নি।অভি এবার নড়েচড়ে বসে।বলে,

“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!”

আমি চোখের দৃষ্টি প্রশ্নসূশক করে ফেলি।মানে -“থ্যাংকস কেন!”অভি কুটিল হাসে।বলে,

“গত বছরগুলো থেকে আমাদের কোম্পানি এবার সর্বোচ্চ অর্জন করতে পেরছে।আর তা আপনার কারণেই।থ্যাংকু ইউ সো মাচ।ভাবলাম আপনার এত বড় এ্যাচিভে আমাদের কোম্পানি থেকে একটা পার্টি দেওয়া হবে।পার্টির বিশেষ অতিথি থাকবেন আপনি।”

এবার ঠোঁটজোড়া স্থবির থাকলো না।বললাম,

“তার প্রয়োজন নেই।থ্যাংকস।”
“কিন্তু কেন?”
“নাথিং।”

অভি এবার ছোট্ট করে গলায় একটা খ্যাঁক শব্দ তুললো।ওদিক এদিক তাকিয়ে নিজেকে যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক করে নিল।বললো,

“দেখুন,এটা আমাদের কোম্পানির নিয়ম।প্রতিবছর আমরা কোম্পানি থেকে কাউকে এক্সিবিশন করতে পার্টি দিই।”
“মিস্টার অভি?আমার তার প্রয়োজন নেই।আপনি অন্যকাউকে নিয়ে এক্সিবিশন করুন।আমার যতটুকু কাজ তা করে দিলাম।যতটুকু পাওনা পেলাম।আর অতিরিক্ত পাওনা আমার পছন্দ না।আশা করি বুঝতে পেরেছেন!”

অভি কয়েক সেকেন্ডস চুপ থাকে।তারপর দৃঢ় গতিতে একটা শ্বাস ছাড়ে।বলে,
“এজ ইউর উইশ!”
“তাহলে উঠলাম।”

অভি নিশ্চুপ চাহনিতে আমার দিকে তাকায়।চোখমুখ দেখে বুঝলাম আমার কথাগুলোতে সে সন্তুষ্ট নই।
আমি জোরপূর্বক হেসে উঠলাম।উঠে দাঁড়ালাম।বললাম,
“বায়।”

১৮.
বাসায় আসার পর অনেকক্ষণ ধরে নিশ্চুপতায় বসে থাকলাম।কেনজানি ভালো লাগছে না।বুকের ভেতরটা বারবার ধড়ফড় করে উঠছে।অভিকে ইগনোর করে যতটা গুড ফিল হচ্ছে ততটাই খারাপ লাগছে ওর সামনে বসতে।ওর মুখাকৃতির দিকে তাকালে বার বার হৃদয়ে “ঘৃণা” নামক শব্দটা নড়ে উঠে।বিশ্বাস করুন?যতবার ওর সামনে গিয়ে বসেছি ততবার ভেতরটা রাগে-ঘৃণায় দুমড়েমুচড়ে গিয়েছে।হয়তো তা প্রকায় পায় নি।বা প্রকাশ পেতে দিই নি।এখন কি করবো আমি?ওর বন্ধন এখনো আবদ্ধ হয়ে আছি।স্বামী নাকি ও আমার!কিন্তু স্বামীও ওকে ভাবতে পারছি না।দূরে ঠেলতেও পারছি না।ভেতরের কোনো এক অদৃশ্য দেয়াল দুই জায়গার সমান্তরালে দাঁড় করিয়ে রাখছে।খালামণির কাছে যাই।খালামণি কিচেনে রান্নাবান্না করছেন।চট করে বলে উঠি,

“খালামণি?অভিকে কি করবো আমি?ডিভোর্স দিতে ইচ্ছে হয়!”
“কিছু হয়েছে নাকি অফিসে?”খালামণি তেলের মধ্যে পেঁয়াজ কুচি,রসুন কুঁচি দিতে দিতে বলেন।বললাম,
” নাহ কি হবে।কিছুই হয়নি।তবে ওকে জাস্ট আমার অসহ্য লাগছে।”

খালামণি আমার এ’কথার পিঠে হেসে দেন।কাছে আসেন।কাঁধে হাত রাখেন।মিইয়ে স্বরে বলেন,
“লাগবেই ত।এটা স্বাভাবিক! ”

চুপ হয়ে থাকি।খালামণি বলেন,
“ওর ভুল বোঝা মিথ্যা অপবাদগুলো মেনে নিতে পারিস নি তাই এরকম লাগছে তোর।”
“তো তুমি কি বলতে চাচ্ছো ওসব ভুলে যেয়ে পরে আবার ওর সাথে সংসার করবো?”
“তা বলছি না।”
“তাহলে?”
“সময় হলে তুই নিজেই ডিসিশন নিবি কি করবি কি করবি না।তোর যথেষ্ট ম্যাচিউরড বয়স এখন।ভালো-মন্দ তুই ই বুঝবি।তোকে কারো থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে না।এখন এই মুহূর্তে তুই যে বললি ডিভোর্সের কথা?এটা তোর মনের ডিসিশন না।বা ধর ডিভোর্স দিবি না এটাও তোর মনের কথা না। এই দুটোই তোর ঘোরমাখা কথা।।কারণ তুই এখন অস্থিরতার মাঝে আসিস।যার কারণে এখন যেকোনো ডিসিশনই রিজনেবল না।আস্তে ধীরে অস্থিরতাটা কাঁটুক তারপর নিজেই বুঝতে কোনটা করলে ঠিক হবে,কোনটা করলে বেঠিক হবে ।”

চুপ থাকলাম।খালামণি মন্দ বলেননি।আমাকে হ্যাঁ,মাথা ঠান্ডা করতে হবে।যা করবো ঠান্ডা মাথায়।ভেবে রুমে এলাম।এসে দেখি ফোন বাঁজছে।স্ক্রিনে তাঁকিয়ে দেখি একটা আননউন নাম্বার।রিসিভ করি,

“হ্যালো কে?”

ওপাশ থেকে ভেসে আসে,
“আমি অভি।আপনাকে কালকে আমাদের অফিসে যে করেই হোক একটু আসতে হবে।আর আপনি যদি না বলেন তারপরও আসতে হবে।আসার কারণ ফোনে বলছি না।আসলে সব বলবো।যে করেই হোক আসবেন!”

আমি মুহূর্তের জন্যে দমে যাই।অভির বলা কথাতে যথেষ্ট ক্ষীপ্রতা এবং তাগাদা!
#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-১৪

ফোনটা রাখার পর আমার ভেতরে চাপা একটা রাগ ফুঁসে উঠে।সে আমাকে কল দিয়ে তাগাদা করবে তার অফিসে যেতে বলবে আর আমি হন্তদন্ত ছুট লাগাবো!আসলে অভি এখনো আমাকে ভাবে টা কি?আমি তার হাতের পুতুল?আগে যা বলতো,যা শুনাতো তা বাধ্য মেয়ের মতন মেনে নিয়েছি বলো এখনো তা মেনে নিব?! নো!এই পারিসা এখন আর সেই পারিসা না!আপনি বোধহয় বুঝতে এখনো ভুল করতেছেন অভি!পরদিন অভির অফিসে সত্যিই আর যাই নি।না যাওয়াতে ভাবলাম কল করবে আবার।করেনি।

২০.
এখন সন্ধে। ড্রয়িং পেপারসগুলো পুরো বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।সেই ড্রয়িং পেপারসের একটাতে আমি একে একে রংতুলি করে যাচ্ছি।আজ হুট করে ইচ্ছে হয়েছিল একটু প্রাকটিকাল ড্রয়িং করতে।ল্যাপটপে ত এ’কটা দিন করেছি এতে খুব তেঁতো হয়ে গেছি।কাগজে করলে একটা প্রাণবন্ততা বলে ব্যাপার আছে। যা অল্যামিনিয়াম পর্দায় ফিল হয় না।ড্রয়িং করতে অনেকটাই করে ফেলেছি।জাস্ট কপি কালারটা লাগালেই ওকে।

“পারিসা?দরজাটা খোল তো একটু?”

খালামণি শব্দ শুনে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দিই।খালামণি ভেতরে আসেন।এসেই খালামণি চোখমুখ কেমন উদ্বিগ্নতা উদ্বিগ্নতা দেখাচ্ছে।বললাম,

“খালামণি কিছু বলবে?”
“পারিসা,অভি এসেছে!”

“পারিসা অভি এসেছে”-তিনটা শব্দ আমার কান বরাবর মস্তিষ্কে ঠুকতেই আমার চমকে যাওয়া অবস্থা।বেসামাল চমকে যাওয়া অবস্থা!চোখমুখ তীব্র কুঁচকে আসে।আকাসময় বিস্ময় নিয়ে বললাম,

” মানে?কখন এসেছে?!”
“মাত্র!”
“কেন এসেছে কারণ জিজ্ঞেস করেছো?”
“করেছি।ওতকিছু বলে নি।বললো আমাদের দেখতে এসেছে।অনেক দিন দেখে নি তাই।তবে ওর হাবভাবে ওরকম কিছু স্পষ্ট হলো না।আমার যতটা মনে হচ্ছে ও তোর সাথেই দেখা করতে এসেছে!”
“কিন্তু খালামণি..!”
“দ্হয়তো কোনো কারণ আছে দেখা করার।কারণ কারণ ছাড়া ওর এখানে আসার প্রশ্নই আসে না।আচ্ছা শোন?তুই থাক রুমে।আমি ওর সাথে কথা বলে দেখি!”

বলে খালামণি দ্রুতপদে বেরিয়ে যান।আমার মাথাটা এখন ঝিমঝিম করতেছে।কপালের চওড়া রগটা দপদপ করছে বারংবার!টাল সামলাতে পারলাম না।বিছানার উপর ছিটকে বসে পড়লাম!এটা কী?ও এখানে কেন?কি চাই ওর?কী চাই?ভাবনার মাঝে খালামণি আবার আমার রুমে আসেন,

“পারিসা?অভি সত্যিই তোর সাথে দেখা করতে এসেছে।আজ নাকি তোর তার অফিসে যাওয়ার কথা ছিল।তুই যাস নি।তাই এসেছে।কি নাকি ইম্পর্ট্যান্ট প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলবে।”
“আমিতো বুঝতেছি না ওর সাথে আমার কিসের ইম্পর্ট্যান্ট প্রজেক্ট নিয়ে কথা আবার?সবতো গতকালকেই মিটমাট করে এসেছি!”
“সেটাই ত বুঝতে পারছি না।তারপরও দেখ কথা বলে।কথা বললে ত আর সমস্যা না।”

দাঁড়িয়ে থাকলাম সং হয়ে।আমার কোনো রকম ভাবান্তর না দেখে খালামণি এগিয়ে আসেন।পিঠে আলতো হাত রেখে বলেন,

“ও আপাতত আমাদের গেস্ট!ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করা ঠিক হবে না।ওর অফিসে ও তোর সাথে যতটুকু সৌজন্যতা দেখিয়েছে তুইও দেখাবি।ব্যাস্ এটুকুই!মানে যোগ-বিয়োগে ফুঁসিয়ে এই আর কি।রাগ-ক্রোধ সব তো মনেই।”

তাকালাম খালামণির দিকে।খালামণির কোনো কথাই অযৌক্তিক নয়।কথাতে লজিক থাকেই।তাছাড়া তার সাথে ত আমি অফিসেই দুই,তিনবারের মতন কথা বলেছি।এখন বললে সমস্যা কি?খালামণিকে বললাম,
“ঠিক আছে।”

তারপর খালামণির পেছনে পেছন হেঁটে গেলাম।খালামণি আমার সামনে থেকে ক্রস কেঁটে কিচেনে ঢুকলেন।আমি সোঁজা অভির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।রসহীন গলায় বলে উঠলাম,

“কেন ডাকলেন আমাকে?”

এতক্ষণ পর ও আমার উপস্থিতি বুঝলো।মাথা তুলে তাকালো।তাকানোর স্থায়িত্ব একটু বেশিই গড়ালো।আমি নড়ে উঠলাম,

“কেন ডেকেছেন,বলুন?”

কথাটি বলামাত্রই কোনো কথা নেই,বার্তা নেই অভি সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সোঁজা আমার ডানহাতটা চাপড়ে ধরলো!ওর আকস্মিক এমন কান্ডে আমার চোখজোড়া তীব্র বড় হয়ে যায়।কিচেন থেকে খালামণিও ব্যাপারটা খেয়াল করে বেশ অবাক হলেন।বললাম,
“মানে কী?হাত ধরলেন কেন!”

অভি এবার ভাবলেশহীন ভাবে হাঁটু গুঁজে নিচে বসে পড়লো!
“আই’ম সরি,পারিসা!”

অত্যন্ত কাতর জড়ানো ওর কন্ঠস্বর।আমি চোখজোড়া আরো বড় করে ফেললাম।বললো,
“তোমার ভার্সিটির ওই সিনিয়র ছেলেটার সাথে তোমাকে ভুল বুঝে ফেললাম।কুলাঙ্গারটা তোমাকে নিয়ে যে এতটা খারাপ কিছু বলছে আর আমি তা সাথে সাথে বিশ্বাস করে ফেলেছি এখন নিজের কাছে নিজেকেই ঘৃণা লাগছে!খুব জঘন্যভাবে ঘৃণা লাগছে!
আমি কেন সেদিন তোমাকে না জিজ্ঞেস করে ওর কথাই বিশ্বাস করে নিলাম!এটুকু বিবেল কি আমার ছিল না?
এতটা বিবেকহীন কবে হলাম আমি?!কবে!”

বলতে বলতে অভি যেন আরো ভেঙ্গে পড়লো।আমি হাতটা জোরে ঝাঁকিয় সরিয়ে আনলাম।অভি অপ্রস্তুতনায় ওপড়লো।বললাম,
“অতঃপর আপনি কার থেকে সিউর হলেন যে রিয়াজের সাথে আমার কোনোরকম এফেয়ার ছিল না?”
“রিয়াজের থেকে!ও আজ আমার অফিসে আমার সাথে ও দেখা করতে এসেছে।এসেই বললো সব!”
“বর্তমানে আমার অবস্থান দেখেই কি এসব বানিয়ে বললেন? রিয়াজ জাস্ট একটা এক্সকিউজ মাত্র!?”

অভি চোখ কড়া করে ফেললো।আমি হেসে উঠলাম।তারপর হাসি থামিয়ে বললাম,
“সম্পর্ক সৃষ্টি হয় একে-অপরের বিশ্বাস এবং ভরসার উপর। সেই সম্পর্কটা শুরু হবার আগেই যদি একে-অপরের মাঝে অবিশ্বাস শব্দটা জড়িয়ে যায় তাহলে সম্পর্কা খুবই তিক্ত হয়ে যায়।তবে এদের যুগলবন্দী অপর মানুষটা কিন্তু চেষ্টা করে সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখতে।ধৈর্য্য নিয়ে মাসের পর মাস,বছরের পর বছর চায় সম্পর্কটা ঠিক করতে।এতদসত্ত্বেও যদি সে ব্যর্থ হয় তাহলে সে মানুষটা খুব তেতো হয়ে যায়।মানুষ ভাবে যে সবসময় মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সাময়িকের জন্যে ক্ষুণ্ণ হলেও পরে তার মাঝে কোনো আড়ষ্টতা থাকে না।সে ঠিক আগের মতন হয়ে যায়।আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি সেরকমই একজন!তাহলে ভুল মিস্টার অভি!কারণ যে অন্যের কথা বিশ্বাস করে বাসর রাতে সদ্য স্ত্রীকে এক পলক না অবিশ্বাস করে ফেলে!সে পরে আর বিশ্বাস করবে কি না তার গেরান্টি নেই!যারা খুব সহজে অবিশ্বাস করে খুব সহজে তা আবার শুধলাতে আসে এদের মাঝে ব্যক্তিত্বের ভাবটা খুবই কম থাকে ।এসব এদের জাস্ট সময়ের আক্রোশতা।আক্রোশতা টা কেঁটে গেলে অন্য আরেকটা বিষয়েও ভুল বুঝে বসবে।আবার অবিশ্বাস করবে।এদের বিশ্বাস নেই।আপনি ক্ষমা করবেন আমাকে।আর হ্যাঁ,এই সময়টার জন্যেই অপেক্ষা করেছিলাম জাস্ট!দেখলাম মেসেজ দিয়ে আমার থেকে সবগুলো ব্যাপার ক্লিয়ার করে দেওয়ার পরও আমাকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝিটা থাকে কি না?কিন্তু না।এখন দেখলাম থেকেই গেলো।ওই যে রিয়াজ এসে বললো, আবার সেই রিয়াজের কথাতেই বিশ্বাস হলো।দারণ আপনি,মিস্টার অভি?ভীষণ রকম দারণ!”

“আমি জানি।হ্যাঁ,আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি।বিশ্বাস করো আমি এসব ইচ্ছে করে করিনি।এসব কেনজানি হয়ে গেলো নিজেও জানি না।আর হঠাৎ করে বাসর রাতে ঢোকার আগে ওমন কথা কে ই নিতে পারে,বলো?তারসাথে তোমার এবং তার একসাথে পিক ছিল।তা দেখে ত রাগটা আরো বেড়ে গেলো!আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম।উন্মদা মনে কি করলাম..আই’ম ভেরী আপসেট!”
“তো এখন আপসেট করছেন তা আমাকে বলছেন কেন?আপসেট হলে আমি কি করতে পারি?”

আমার মুখে রুক্ষতা।চোখের কিণার কাণারে রাগের দগ্ধতা!মুখে কোথাও কোনো দুঃখের চিহ্ন টুকু নেই।অভি গভীর মনোযোগ নিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।এরমাঝে খালামণি আসেন।টি-টেবিলের উপর ট্রে রাখেন।অভি ট্রে-এর তাকায়।তারপর খালামণির দিকে।বলে,

“আমি কিছুই খাবো না,আন্টি!চলে যাচ্ছি!”

বলে চলে গেলো।অত্যন্ত ব্যথিত মনে চলে গেল হয়তো।হ্যাঁ,এদের এরকম নাটকের ব্যথা মন অল্প কিছুদিন থাকবে। পরে আবার আপনাআপনি ঠিক হয়ে যাবে।খালামণি বলেন,

“এখন না বলে পরেও বলতে পারতিস এসব কথা।মেহমান মানুষ আসছে। আগে খেতো।”

আমি সরাসরি খালামণির মুখের দিকে তাকাই।খালামণি চোখ নামিয়ে নেন।আমি খালামণিকে আর কিছু বললাম না।রুমে চলে এলাম।দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করলাম।ওড়নাটা রুমের একদিকে ছিটকে ফেলে বিছানায় বেসামাল বসে দুইহাত দিয়ে পুরো মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠলাম।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here