আলো আঁধার, পর্ব:১

১.

পুরো বাড়িতে কোলাহল আর মিউজিকের শব্দের কারণে ফোনে কথা বলতে না পেরে ছাদে চলে এল রিয়াদ। আজ ওর ভাই রাজিবের বিয়ে। ওর ইমপটেন্ট কল আসায় বিয়ে ছেড়ে ছাদে আসতে হয়েছে ওর। এখানে বেশ নিরিবিলি নিচের শব্দ কম আসছে। এক কোণায় দাড়িয়ে কথা শেষ করে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ফিরতেই সিগারেটের বোটকা গন্ধ নাকে এসে লাগলো ওর। বিয়ে বাড়িতে সবাইকে লুকিয়ে নিশ্চয়ই কেউ সিগারেট খাচ্ছে। পাত্তা না দিয়ে চলে যেতে চাইলেও কৌতুহল দমাতে না পেরে পা টিপে ছাদের অন্য প্রান্তে গিয়ে দাড়ালো রিয়াদ। যা দেখলো তাতে অজান্তেই মুখ হা হয়ে গেল ওর। পায়ের কছে ছোটখাটো একটা সিগারেটের স্তুপ নিয়ে রেলিংয়ের উপর পা ঝুলিয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছে একটা মেয়ে। অবশ্য মেয়ে বললে ভুল হবে একটা পরি বললে বোধহয় বেশি মানানসই হবে। এর আগে সাদা চামড়ার মহিলাদের সিগারেট কেন মদ ও খেতে দেখেছে ও। কিন্তু কোনো বাঙালি মেয়েকে প্রথমবার এ অবস্থায় দেখে অবাকই হলো সে। আরেকবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করে নিল মেয়েটাকে। অসম্ভব সুন্দরী একটা মেয়ে। লাল ফর্সা চেহারার সাথে বড় কালো একজোড়া চোখ। যদিও চোখের নিচে কালি পরেছে। সিগারেট খাওয়ার পরেও ঠোটঁ দুটি গোলাপিই আছে। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল পিঠের উপর ছাড়ানো। যদিও বেশি লম্বা নয়। তবুও পারফেক্টলি মানিয়েছে মেয়েটির সাথে। আরেকটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো মেয়েটির চোখে পানি চিকচিক করছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মেয়েটিকে যে এতক্ষন যাবত ও দেখছে সেটা মেয়েটি এখনো খেয়াল করেনি। রিয়াদ আরো কয়েক কদম এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। ওর পাশে গিয়ে দাড়ালো। একবার ফিরে তাকিয়ে ওকে দেখে নিল মেয়েটি কিন্তু আবার মুখ ফিরিয়ে সিগারেট টানায় মনোযোগ দিল। পাশেই বড় অবহেলায় তিন প্যাকেট সিগারেট আর একটা লাইটার পরে রয়েছে। আর সিগারেটের ছোট্ট স্তুপটার পাশে আরো কয়েকটি খালি প্যাকেট দেখতে পেল ও। ও নিজেও সিগারেট খায় তবে দিনে একটার বেশি খেলেই যেখানে ওর গা গুলিয়ে ওঠে সেখানে এই মেয়েটি এতগুলো সিগারেট খেয়ে ফেলেছে দেখে ওর চোখ বের হওয়ার যোগাড় হলো। মেয়েটা সিগারেটে একটার পর একটা টান দিয়েই যাচ্ছে। হঠাৎ রিয়াদের মেয়েটার হাতের দিকে চোখ পড়লো। কয়েকটা কাটার দাগ। কেউ অনেক রাগ নিয়ে ব্লেড দিয়ে কেটেছে বলে মনে হচ্ছে। মেয়েটাই কি? মেয়েটার চেহারা যেমন ওকে মুগ্ধ করেছে তার চেয়ে বেশি মেয়েটার বিহেভিয়ার আর হাতের এই দাগ মেয়েটার সম্পর্কে জানার জন্য ওকে কৌতুহলি করে তুলেছে। এর আগে মোট চারবার এ বাড়িতে এসেছে ও। ওর ভাবীর প্রায় সব আত্মীয়র সাথেই পরিচিত হয়েছে ও কিন্তু একবারও এই মেয়েটাকে দেখেনি। কে এই মেয়েটি? এ বাড়ির কেউ নাকি……এমন সময় সিড়িতে কারো আসার শব্দ পেয়ে সরে অন্য পাশে পানির ট্যাংকের পিছনে একটু আড়াল করে দাড়ালো রিয়াদ। এখান থেকে মেয়েটাকে স্পষ্ট দেখা গেলেও ওকে কেউ দেখতে পাবেনা। ছাদের গেট দিয়ে ওর নতুন ভাবীকে আসতে দেখে ও একটু অবাকই হলো। ওর ভাবী সোজা মেয়েটার কাছে চলে গেল। হাত ধরে মেয়েটাকে রেলিং থেকে নামিয়ে পাশে থাকা দোলনায় বসালো। মেয়েটা হাত থেকে সিগারেটের টুকরোটা সাথে সাথে ফেলে দিল কিন্তু তার মুখে কোনো অপরাধবোধ নেই। মেয়েটা সরাসরি রিয়াদের ভাবীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ওর ভাবীর গায়ে বিয়ের শাড়ি গহনা থাকাতেও যেন কারোই কোনো সমস্যা হচ্ছেনা। এমন সময় আরেকজন ছাদে আসল হাতে প্লেট আর একটা পানির বোতল। সে একটা চেয়ারের উপর প্লেট আর বোতল রেখে আবার নিচে নেমে গেল। এবার ওর ভাবী মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
দিয়া উঠে বোস তো দেখি নিশ্চয়ই কিছু খাওয়া হয়নি তোর।
তুইও আমায় ছেড়ে চলে যাবি বড়াপু।
এই প্রথম মেয়েটির কন্ঠ শুনতে পেল রিয়াদ। মেয়েটার নাম তাহলে দিয়া। আর ভাবীকে আপু বলছে তারমানে ভাবীর বোন। কিন্তু ভাবীর সব বোনের সাথেই তো কথা বলেছে ও। ফাজলামিও করেছে কিন্তু একে তো একবারও দেখেনি। সেসব চিন্তা আপাতত মাথা থেকে সরিয়ে আবারও মেয়েটার দিকে মনোযোগ দিল রিয়াদ মেয়েটা উঠে বসেছে। ওর ভাবী মেয়েটাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা খাচ্ছে আর কাদঁছে। ওর ভাবীর চোখও শুকনো নেই। হঠাৎ মেয়েটি বলল,
আর তুই আমাকে খাইয়ে দিবিনা তাই না বড়াপু?
কে বলেছে দেবোনা। আমি তো একেবারে চলে যাচ্ছি না। মাঝে মাঝেই তো তোর দুলাভাই কে নিয়ে এ বাড়িতে আসবো।
কিন্তু আমি তো আর আসবো না এ বাড়িতে।
কেন?
তোমার শশুরবাড়ির কেউ এমন কি দুলাভাইকে ও আমার সম্পর্কে কেউ কিছু জানায়নি তার কারণ আমি জানি না ভেবেছ আর তাছাড়া আমিও চাইনা তারা জানুক। এ বাড়ির সম্মানের জন্য নয় কিন্তু শুধু তোমার জন্য বড়াপু। আজকের পর থেকে এ বাড়ির সাথে আর কোনো সম্পর্কই রাখবোনা আমি।
খুবই ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বললো দিয়া। হিয়া কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
কেন এগুলো বলছিস দিয়া তুই দেরি করে আসলি আবার এসেই সারাক্ষন নিজের ঘরে ঢুকে বসে ছিলি এ কারণেই তোর সাথে কারো পরিচয় করাতে পারিনি। আর তাছাড়া আসবি না মানে কি এটা কি তোর বাড়ি না?
যে বাড়িতে আমার আপন বলে কেউ নেই সে বাড়ি আমার না।
কে বলেছে আপন কেউ নেই? সবাই তোকে খুব ভালোবাসে। আর আমিও তো চিরদিনের জন্য যাচ্ছি না। আমার তো এটা ভেবেই দম বন্ধ লাগছে তোকে ছাড়া আমি থাকবো কিভাবে?
পারবি থাকতে বড়াপু তোর এখন একটা সংসার হবে। সংসারের চাপে ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক আমাকে তোর ভুলতেই হবে দেখেনিস।
দিয়ার কথায় চুপ করে গেল হিয়া। দিয়া ভুল কিছু বলেনি। ওর শশুরবাড়ির লোকেরা কেমন ও জানেনা। তারউপর ও বাড়ির বড় বউ হবে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই মা চাচিমাদের মুখ থেকে এই নিয়ে একগাদা উপদেশ শুনে ফেলেছে ও। তাই বিয়ের পর যে ওর কি অবস্থা হবে সেটা একমাত্র আল্লাহই জানেন। তবে বাড়ির বড়মেয়ে হিসেবে সবাইকে আগলে রাখার গুনটা বেশভালো ভাবেই আছে হিয়ার। আর এখানে হিয়ার করারও কিছু ছিলনা। বাবা এসে বলল তোর বিয়ে ব্যাস কবে কার সাথে এখন কেন? প্রশ্ন গুলো মনের মধ্যে চাপা দিয়ে শুধু মাথা উপর নিচ করে চলে এসেছিল হিয়া। এবাড়িতে বাবার মুখের উপর কথা বলার মতো সাহস কারো নেই শুধুমাত্র দিয়া ব্যাতিক্রম। অবশ্য ও কথা কোথায় বলে সবসময় পালিয়ে বেড়ায়। ভয় পায় খুব। কিন্তু কেন যেন দিদার চৌধুরীও ওকে এড়িয়ে চলতে চায়। ওর কিছুতে বাধাঁও দেয় না। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আবারও দিয়াকে খাওয়ানোতে মনোযোগ দিল হিয়া। ওর এই বোনটার মনে অনেক অভিমান জমা হয়ে আছে। যেগুলো দুর করা ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি বা সাহস হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয় এমন কিছু যদি পেত যা দিয়ে ওর এই বোনটার সমস্ত দুঃখ এক নিমিষেই দূর করতে পারতো। যদি একটা রাজপুত্র….আর ভাবতে পারলোনা একবার তো পস্তাতে হয়েছে আবারও সেইম প্রসঙ্গ এনে নিজের বোনটাকে হারাতে চায়না ও তাই মনের ইচ্ছা মনেই মাটিচাপা দিয়ে বর্তমান কাজে মনোযোগ দিল ও। দিয়াও কোনো কথা বলছে না চুপচাপ বোনের হাতে খেয়ে যাচ্ছে। হয়তো এরপর ওর বড়াপুর ওকে খাওয়ানোর সময় হবেনা। এখন ওর মনে হচ্ছে চিৎকার দিয়ে কাদেঁ। কিন্তু তা ঠিক হবেনা। খাওয়া শেষে দুবোনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নিরবতা ভেঙে হিয়া বলল,
তুই কি এমনই থাকবি?
হয়তো।
আমার জন্য কি নিজেকে একটু হলেও চেন্জ করতে পারবি না?
তুমি কিন্তু ওয়াদা ভঙ্গ করছ বড়াপু।
কিন্তু এতে তোর ভবিষ্যৎ…….
উফ্ কতবার বলব আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই এ নিয়ে আর আমাকে কিছু বলবে না তাহলে আমি আমার ওয়াদা ভেঙে ফেলবো।
ঠিকআছে। কিন্তু আমি এখানে যখন আসবো শুধু তখন এ বাড়িতে আসিস প্লিজ।
আচ্ছা আসবো।
আর আজ আমার সাথে ও বাড়িতে যাবি তুই?
না।
আর কথা বাড়ালো না হিয়া। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল শুধু।
রিয়াদ ওদের কথায় কিছুই তেমন বুঝতে পারলো না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে মেয়েটা প্রচন্ড ডিপ্রেসড্। এই মেয়েটার কেইসটা যে করেই হোক জানতে হবে। নিজের মনেই ভাবলো রিয়াদ। তারপর আরো কিছু জানার উদ্দেশ্যে ওদের দিকে মনোযোগ দিল। কিন্তু আর কিছুই জানা গেল না। একটু আগে যিনি খাবার রেখে গিয়েছিলেন তিনি এসে তার ভাবীকে বলল,
বড়আফা এক্ষনই নিচে চলো তোমারে খুজবো সবাই।
দিয়া চল আমার সাথে।
কিন্তু বড়বাবা রাগ করবে তো।
করবে না আমি বোঝাবো তুই না গেলে আমিও যাবোনা।
তুমি এতো জেদি কেন বলোতো?
তোর বোন তো তাই। এখন চল।
বলেই দিয়ার হাত ধরে নিচে নিয়ে গেল হিয়া। রিয়াদও কিছুক্ষন পর নেমে এলো। যা জানার ভাবীর কাছ থেকেই জানবে ও। এখন বিয়েটা মিটে যাক।

চলবে………

#আলো_আধাঁর
লেখা- জেসিয়া জান্নাত রিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here