আলো আঁধার, পর্ব:৪+৫

#আলো_আধাঁর
লিখা- জেসিয়া জান্নাত রিম

৪.
গেস্ট দের অভ্যর্থনার জন্য গেইটে দাঁড়িয়ে আছে রিয়াদ। একটু পর ভাবীর বাড়ির সবাই চলে আসবে। কিন্তু ও তো শুধু দিয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কি জাদু করেছে মেয়েটা ওকে। থেকে থেকে ওর মুখ টাই কেন সামনে আসছে ওর।একি হলো রিয়াদের। মেয়েটিকে ভাবলেই বুকের বাঁ পাশে এক অন‌্য রকম যন্ত্রণা হচ্ছে।যে যন্ত্রণা সহ্য করতে ওর নূন্যতম কষ্ট হয়না বরং ভালো লাগে।
ভালো আছেন ভাইয়া?
একটা মেয়েলি কন্ঠ ওর ভাবনায় ছেদ ফেলতেই ফিরে তাকাল রিয়াদ। না চিনতে পেরে বলল,
তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না?
সেকি কালই তো পরিচয় হলো আর আজ ভুলে গেলেন এত বাজে স্মৃতি নিয়ে ডাক্তারি পাশ করলেন কিভাবে?
মেয়েটার কথায় আসেপাশের সবাই হেসে উঠল। রিয়াদ মনে করার চেষ্টা করতেই চোখের সামনে আবার দিয়ার মুখটা ভেসে উঠল। আবারও মেয়েটি বলল,
আরে আমি রিয়া।হিয়া আপুর ছোট চাচার মেয়ে।
এবার মনে পড়ল রিয়াদের। কি করবে ও দিয়া ছাড়া মাথায় অন্য কিছুই তো আসছে না। রিয়াকে ও কি বলবে” তোমার বোন দিয়া ছাড়া আমার মাথায় অন্য কিছুই নেই”। কিন্তু সেটা না বলে ভদ্রতা সূচক একটি হাঁসি দিয়ে ও বলল,
আমি তোমার সাথে একটু মজা করলাম তা বাকিরা কই ?
এইতো সবাই।
আসেপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিল ও কিন্তু ওর চোখ যাকে খুঁজছে তাকে দেখতে পেলনা। তাহলে কি আসেনি সে? রিয়াদের চিন্তিত মুখ দেখে রিয়া বলল,
আবার কি ভাবছেন ভাইয়া আপুর কাছে নিয়ে যাবেন না আমাদের?
হ্যা, ওহ আচ্ছা চলো।
বলেই ওদের নিয়ে ভাবীর কাছে এল রিয়াদ। হিয়া পরিবারের লোকজন দের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করার পর রিয়ার কাছে দিয়ার খোঁজ করলো। রিয়াদ ও উত্তরের আশায় রিয়ার দিকে তাকালো। রিয়া জানালো দিয়া আসেনি। রিয়াদের মন মূহূর্তে খারাপ হয়ে গেল। পুরো সময়ে সেটা আর ভালো হলোনা। বৌভাত শেষ করে ওদের ঐ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল। পুরো সময়টা রিয়াদ দিয়ার ভাবনায় ই ডুবে রইল। ওদের বাড়িতে পৌছে ও রিয়াদের নজর শুধু দিয়াকেই খুঁজল। হিয়া ও দিয়ার কথা জানতে চাইলে সবাই বলল সকালে দেখা করতে দিয়া ঘুমে। শুনে রিয়াদ মনে মনে বলল, তোমাকে দেখার জন্য এখন সকাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে সিগারেট সুন্দরী। ঠিকাছে সকালেই সবকিছুর হিসাব হবে। আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে তুমি শান্তিতে ঘুমাচ্ছ। আমার সবকিছু তে শুধু তুমি আর তুমি। কেন ? এই প্রশ্নের জবাব তো তোমাকে ই দিতে হবে।”

ভোরের দিকে চৌধুরী ভবনে ঢুকল দিয়া। বাড়িতে না ঢুকে সোজা ছাদে চলে এলো সে। প্রথমে ভেবেছিলো আসবেনা। কিন্তু হিয়া কষ্ট পাবে ভেবে ভোর হতে না হতেই আবার চলে এল। ওর বড়াপুই তো ওর একমাত্র আপনজন। ও সব সহ্য করতে পারে কিন্তু ওর জন্য ওর বড়াপু কষ্ট পাবে সেটা ও কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। সব মানুষের কাছ থেকে যেখানে ও শুধু ধোঁকা আর কষ্ট পেয়ে এসেছে সেখানে শুধু হিয়াই একমাত্র যার কারণে ও এই পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নেওয়ার সাহস করছে। তাই বড়াপুর সুখের জন্য ও সবকিছু করতে পারবে সবকিছু।
‘এই যে সিগারেট সুন্দরী?
হঠাৎ অপরিচিত কন্ঠের ডাকে ওর চিন্তাধারায় বিঘ্ন ঘটলো। পিছন ফিরে তাকাতেই সেদিন ছাদের সেই লোকটিকে দেখে চমকে উঠলো ও। কে ইনি? কি সম্পর্ক তাদের এই লোকটির সাথে? নিজের স্মৃতি শক্তি কে যথাসাধ্য কাজে লাগিয়ে ও এ রহস্যের সমাধান করতে পারলনা দিয়া। তাই চুপ করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করল ও লোকটিকে। হাইট ছয় ফিটের মত, মাথা ভর্তি চুল, ফর্সা গোলগাল মুখ, জোর ভ্রুর নিচে বড় বড় দুটি চোখ, ফ্রেন্স কাট দাড়িতে অসম্ভব সুদর্শন এক পুরুষ। ও ওর এই ছোট্ট জীবনে এমন কাউকে কোনদিন দেখেনি। অবশ্য দেখবেই বা কি করে এক মিথ্যা ভালোবাসার কালো রুমালে ওর চোখ দুটো বাঁধা ছিল যা শত চেষ্টার পর চোখ থেকে নামাতে পারলেও মন থেকে এখনো তা সরাতে পারেনি। আর ও ও চায়নি আর কাউকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে। তাই ওর সামনে থাকা এই সুদর্শন পুরুষ টির থেকে বাধ্য হয়ে চোখ দুটো সরিয়ে নিলো ও।
দিয়ার থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছেনা রিয়াদ ও। আজকে ওকে অন্য রকম সুন্দর লাগছে। পরিটাকে কি ও বলবে যে ওর চিন্তায় কাল সারারাত জেগে ছিল ও। খুব বলতে ইচ্ছে করছে ওর। ইচ্ছে করছে পরিটাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলে বলতে, তুমি তো বেশ ঘুমিয়েছো আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে, এর শাস্তি হিসেবে আমার বুকে ই বন্দী থাকো সারাজীবন। কিন্তু সেসব কিছুই না বলে একভাবে ও দিয়াকে দেখতে থাকলো। এভাবে অপরিচিত কিন্তু সুদর্শন এক পুরুষ কে ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না দিয়া। কন্ঠে যথাসাধ্য বিরক্তি ফুটিয়ে ও বলল,
কি সমস্যা আপনার এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
প্রিয় মানুষের কন্ঠে সম্বিৎ ফিরে পেল রিয়াদ। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
কি করব বলুন কোনোদিন তো সিগারেট সুন্দরী দেখিনি। তাই এখন মন ভরে দেখে নিচ্ছি।
রিয়াদের কথায় একটু লজ্জা পেল দিয়া। এনাকে কি ভাবে বোঝাবে ও সেদিন ই প্রথম সিগারেট খেয়েছিল তাও কোনোমতে দুটো। বাকিগুলো শুধু শুধু পুড়িয়ে ছিল। কিভাবে বলবে ওই বিশ্রি জিনিস টা খাওয়ার থেকে পোড়াতে বেশি ভালো লাগে ওর। মানুষটাকি আদৌ বিশ্বাস করবে ওকে। এসব কি ভাবছে ও। এনার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কি এসে যায় ওর। কিছুই না। তাহলে? নিজেকে সামলাও দিয়া একবার শিক্ষা হয়নি তোমার আবার এসব কি……..
কি হলো কথা বলছেন না যে?
রিয়াদের কথায় খুবই শীতল কন্ঠে দিয়া বলল,
কে আপনি? এ বাড়িতে কি করছেন?
রিয়াদ ভাবলো বলবে, আমি তোমাতে পাগল এক তুচ্ছ মানব। তোমার জন্য ই তো এ পৃথিবীর বুকে এতদিন নিঃশ্বাস নিয়েছি।’
ও আমার দেওর দিয়া।
হিয়ার কন্ঠে দুজনেই সেদিকে তাকালো। হিয়াকে দেখে দৌড়ে ওকে জড়িয়ে ধরল দিয়া। কিছুক্ষণ দিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে ওকে নিয়ে রিয়াদের দিকে এগিয়ে এল হিয়া। তারপর বলল,
ও দিয়া আমার সবথেকে আদরের ছোট বোন।
ইতিমধ্যেই দিয়া বোনের শাড়ির আঁচলের এককোণা ধরে ফেলেছে সেটা লক্ষ্য করল রিয়াদ। মেয়েটার সবকিছু ওকে খুবই কৌতুহলী করে তুলছে। তাই কিছু জানার উদ্দেশ্যে ও হিয়াকে বলল,
তোমার এই বোন টার সাথে আগে কেন পরিচয় করালেনা ভাবী?
ও আসলে নিজেকে খুব একটা বাইরে আনতে বা সবার সাথে মিশতে চায় না।
ওহ। কিন্তু…….
তুমি নিচে যাও চা দেওয়া হয়েছে।
রিয়াদ আর কিছু বলার আগেই বলল হিয়া। রিয়াদ ও কথা ঘুরিয়ে বলল,
ভাইয়া কি উঠেছে ভাবী?
না উনি তো এখনো ঘুমাচ্ছে।
সেকি তুমি তো দেখি একেবারে ওল্ড ইজ গোল্ড এ বিশ্বাসী।
মানে?
আরে আজকাল কেউ নিজের বরকে আপনি করে বলে?
কেবল তো বিয়ে হলো কিছুদিন যাক। এত দ্রুত অধিকার খাটানো কি ঠিক হবে।
আরে ভাবী আমার ভাইয়া কে তো তুমি জানোই না। একেবারে গুড বয়। আমার ঠিক উল্টো। সহজ সরল। তাই এখনই ভালো করে আকড়ে ধরো। দেখা গেল তুমি সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছে আর আমার ভাইয়া উল্টো পাল্টা কিছু ভেবে বসে আছে।
ঠিক বুঝলাম না?
তাহলে একটা ঘটনা বলি শোনো। ভাইয়ার ২১ তম বার্থডে। ভাইয়া দেশে আসছে দুদিন আগে। একমাস থাকার প্লান। আমারা সবাই প্লান করলাম বার্থডে তে সারপ্রাইজ দেব বলে। সবাই এমন ভান করলাম যেন মনেই নেই ওর বার্থডে। সারাদিন নানান রকম চেষ্টায় ও যখন কোনো পাত্তা পেল না। ফোন টোন অফ করে তিনি উধাও। প্রায় সাতদিন তার কোনো খোঁজ নাই। অবশেষে ভাইয়ার এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে জানা গেল তিনি বিদেশে ফিরে গেছেন। শেষমেশ সবাই মিলে সেখানে গিয়ে একসপ্তাহ পর ভাইয়ার বার্থডে সেলিব্রেট করে তারপর ফিরি। তারপর থেকে আর কোনোদিন ভাইয়াকে আমরা সারপ্রাইজ দেইনি। ঘটনা থেকে কি বুঝলা?
তোমার ভাই অনেক অভিমানী।
তা ঠিক তবে সেই অভিমান ভাঙতে বেশি খাটতেও হয়না। আরেকটা ব্যাপার কি জানো ভাইয়াকে আমি কখনোই কারো উপর রাগতে দেখিনি। প্রচন্ড দায়িত্ব শীল এই দায়িত্বশীলতার কারনে নিজের ইচ্ছে কেও অনেক সময় পাশ কাটাতে দেখেছি তাকে। খুব মুখচোরা স্বভাবের। কাউকে টেনশন দিবে না বলে নিজের সমস্যা গুলো নিজের মাঝেই রাখে সবসময়। আর ভাইয়ার যাকে একবার ভালো লাগে তাকে কলিজা কেটে ও খাওয়াতে পারে।এ কারণে ই বলছি প্রথম থেকেই শক্ত করে ধরে রাখো।
ঠিকাছে খেয়াল রাখবো তবে আমার কিন্তু আরো তথ্য চাই।
অবশ্যই দিব। উইথ মাই প্লেজার। আরে কথা বলতে বলতে তো সিগা….. মানে দিয়ার সাথে ঠিকঠাক আলাপই হলো না। তা বেয়াইন সাহেবা কি করো তুমি মানে পড়াশোনা?
ইয়ে রিয়াদ আলাপ করার অনেক সময় আছে। তুমি তাড়াতাড়ি নিচে যাও তোমার চা ঠান্ডা হয়ে গেল।
রিয়াদ বুঝল হিয়া দিয়ার সম্পর্কে কিছু জানাতে চাইছে না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ছাদ থেকে বেরিয়ে এসে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। রিয়াদ চলে গেছে ভেবে হিয়া দিয়ার দিকে মনোযোগ দিলো। দিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
এত ক্লান্ত লাগছে কেন ঘুমাসনি সারারাত?
নাহ।
ওই বাজে জিনিস টা খেয়েছিস নাকি?
নাহ। জানিস বড়াপু মানুষ দুঃখ ভোলার জন্য সিগারেট খায় কিন্তু এই জিনিস টা খেলে দুঃখ কমে না বরং পোড়ানো তে বেশি ভালো লাগে। মনে হয় তার কলিজা পোড়াচ্ছি। খুব শান্তি লাগে তখন খুব শান্তি…..
বলেই কেঁদে ফেললো দিয়া।ফোফাতে ফোফাতে বলল,
আমার এ জীবন আর ভালো লাগে না বড়াপু আমি মুক্তি চাই। ও কেন এল আমার জীবনে? কেন?
চোখ শুকনো নেই হিয়ার ও। বোনকে শান্তনা দেওয়ার ভাষাও নেই ওর। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় ওর। দিয়াকে তখন বাঁচিয়ে রাখাটা কি ভুল ছিল। না না একি ভাবছে ও, দিয়া যখন বেঁচে আছে তখন ওর জন্য নিশ্চিত ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি নিজের চোখের পানি মুছে দিয়াকে সামলে নিলো হিয়া। বোনের উষ্ণতায় কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে এল দিয়া। চোখ মুছে বলল,
তুই কেমন আছিস বড়াপু?
ও বাড়ির সবাই খুব ভালো। রিয়াদ কে তো দেখলিই। তোর বয়েসী একটা ননদ আছে আমার। বড় আপু ও খুবই ভালো।
আর দুলাভাই?
উনিও ভালো।
আর কিছু জিজ্ঞাসা করলনা দিয়া। বোনের ঠোঁটে ফুটে ওঠা লাজুক হাসি টাই বলে দিচ্ছে সে কতটা সুখি।

দিয়াকে নিয়ে নীচে নেমে এল হিয়া। সবাই দিয়ার দিকে এগিয়ে এলে সে সবাইকে উপেক্ষা করে রুমে চলে গেল। হিয়ার মেজো মা হিয়াকে বললেন,
ওকে আনতে গিয়েছিলি তুই?
নাতো ও তো ছাদেই ছিল। কেন বলোতো?
কি আর বলবো মা। আমার মেয়েটা কবে যে ঠিক হবে। কি হবে ওর ভবিষ্যতে?
চিন্তা করোনা মেজো মা সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
সেই আশাতেই তো আছি।
বলেই একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। তারপর হিয়ার হাতে একটা ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
যা জামাইকে ওঠা টেবিলে নাস্তা দিচ্ছি।
আচ্ছা।
বলেই নিজের ঘরে এলো হিয়া। ট্রেটা সাইড টেবিলে নামিয়ে রেখে বিছানায় বসল ও। কাল রাতে রাজিব ঘুমের মধ্যে ওকে জড়িয়ে ধরে ছিল।তারপর আর ঘুমাতে পারেনি ও। সারারাত হৃৎপিণ্ড বিমানের গতিতে ধুকধুক করেছে।ও তো ভেবেছিল এত শব্দে রাজিব না উঠে যায়। ভোরের আলো ফুটতেই ও কোনোমতে উঠে ছাদে চলে গিয়েছিল। এখন রাজিবের সামনে আসতেই বুকের ধুকপুকানি আবারও বেড়ে গেল তার। কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে রাজিবকে বারকয়েক ডেকে উঠল ও। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হলো না। আচ্ছা ও তো রাজিব কে ছুঁতে ই পারে। এতটুকু অধিকার তো ওর আছে। ভেবেই হাত বাড়িয়ে ওকে একটু ধাক্কা দিলো। এভাবে বারকয়েক ধাক্কা দিয়ে হাত সরাতে যেতেই টান অনুভব করল হিয়া। পরক্ষনে নিজেকে রাজিবের বুকে আবিষ্কার করল ও। সাথে সাথে ই দম বন্ধ হয়ে আসলো ওর। শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। হিয়ার কাঁপুনি দেখে রাজিব ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
আমার ছোঁয়া কি আপনার ভালো লাগছে না লজ্জা বতী?
হিয়া নিজের সমস্ত ভার রাজিবের উপর ছেড়ে দিল। কিন্তু লজ্জায় কিছু বলতে পারলো না। পরক্ষনে ই ওর রিয়াদের একটু আগে বলা কথা মনে পড়লো। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
ভুল ভাববেন না আসলে…….
বুঝেছি লাজুকলতার লজ্জা এখনও ভাঙেনি।
বলেই হিয়াকে ছেড়ে উঠে পরল ও। হিয়া এখনও কাঁপছে। ওকে স্বাভাবিক করতেই রাজিব বলল,
আচ্ছা আপনার বাচ্চা কেমন লাগে?
এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল হিয়া। কোনোমতে বলল,
হঠাৎ এ প্রশ্ন?
আরে আমি আপনার বাচ্চার কথা বলছি না এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই। আমি এমনিতেই জানতে চাইলাম।
নিজেকে আস্ত গবেট মনে হচ্ছে হিয়ার ইস্ কি মনে করছে না জানি মানুষটা।
আমি কিন্তু উত্তর পেলাম না।
বাচ্চা দের পছন্দ করে না এমন মানুষ আছে নাকি পৃথিবীতে?
না ধরুন অবৈধ বাচ্চা দের কিন্তু কেউই তেমন পছন্দ করে না।
আমার অত বাছ বিচার নেই। সব বাচ্চারাই নিষ্পাপ। দোষ থাকলে বাবা মায়ের থাকে বাচ্চা তো কোনো দোষ করে নাই।
হুম।
তা হঠাৎ এই প্রশ্ন?
এমনিতেই।
ওহ। আপনার চা ঠান্ডা হয়ে গেল তো।
ওহ দিন। আপনার চা কই।
আমি পরে খাবো।
পরে কেন আমার থেকে খান?
এমা না না।
কি হবে খেলে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক টাই সেয়ারিং এর। এই নিন ধরুন।
বলেই চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল ও হিয়ার দিকে। মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে কাপটা নিল হিয়া। কাপের অর্ধেক চা টা খেয়ে বাকিটা রাজিবের দিকে বাড়িয়ে দিল। ওদের দুজনের মুখেই তৃপ্তির এক উজ্জ্বল আভাস। এখন করুনাময় এদের নতুন জীবনের এই সুখ স্থায়ী করলেই হয়।
চলবে………

#আলো_আধাঁর
লিখা- জেসিয়া জান্নাত রিম

৫.
সবার সাথে সকালের নাস্তা শেষে নিজের ঘরে বসে পেপার পড়ছিলেন দিদার চৌধুরী। হঠাৎ ই দিয়ার চিৎকারে পড়ায় বিঘ্ন ঘটলো তার। এসময় দিয়া কেন চিৎকার করছে? বাড়িতে মেহমান সেটা ও কি খেয়াল নেই মেয়েটার। ব্যাপারটা দেখার জন্য রুম ছেড়ে বেরোলেন তিনি। দিয়ার রুম থেকে আসছে চিৎকার টা। ইতিমধ্যেই সবাই রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। দিয়া একনাগাড়ে চিৎকার করে বলেই যাচ্ছে,
ঐ মহিলাকে আমার সামনে থেকে যেতে বল বড়াপু।
হিয়া ওকে সামলানোর চেষ্টা করছে। মেঝেতে ভাঙ্গা প্লেট আর খাবার পরে আছে। দিদার চৌধুরীকে এগিয়ে আসতে দেখে চুপ হয়ে গেল দিয়া। দ্রুত হিয়ার পিছে লুকিয়ে পরল সে। দিদার চৌধুরী ঘটনা কিছুটা আঁচ করতে পেরে মেজো ভাইয়ের বউ শিলার দিকে তাকালেন।
আমি শুধু…..
শিলার মুখ আতংকে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কোনো মতে ঢোক গিলে এই দুটো শব্দ ই বলতে পারলেন। দিদার চৌধুরী হাত উঠিয়ে শিলাকে ইশারায় চলে যেতে বললেন। এরপর চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিলেন। চিৎকার চেঁচামেচিতে প্রায় সবাই সেখানে উপস্থিত। কিছু হয়নি এমনভাবে উনি রাজিবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
আরে বাবা তুমি তো আমাদের বাগানটাই দেখনি বোধহয়। হিয়া নিজ হাতে বাগানের প্রত্যেকটি গাছ লাগিয়েছে। যাও ভাইকে নিয়ে দেখে এসো।
এরপর হিয়াকে বললেন,
যাও তো মা জামাইকে বাগান দেখাও। আমি দিয়ার সাথে কথা বলি।
বাবার কথায় করুন চোখে তাকালো হিয়া দিদার চৌধুরীর দিকে। মেয়েকে চোখের ইশারায় আসস্ত করে আবারো যেতে ইশারা করলেন তিনি। হিয়া দের সাথে বেড়িয়ে গেল বাকিরাও। দিদার চৌধুরী এবার দিয়ার দিকে মনোযোগ দিলেন। এককোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। সেদিকে গিয়ে দিয়ার হাত ধরে বিছানায় বসালেন তিনি। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে কিছুটা শান্ত করলেন তিনি। তারপর নরম সুরে বললেন,
কি সমস্যা তোমার মা বড়বাবাকে বলবেনা?
দিদার চৌধুরীর এমন আচরণে অবাক হয়ে গেল দিয়া। দীর্ঘ নয় বছরে‌ দিদার চৌধুরীর সাথে বলতে গেলে তেমন কথাই হয়নি তার। কথা হবে কি দেখাই তো হয়েছে বড়জোর কয়েক বার। অবশ্য হিয়া ছাড়া অন্য কারো সাথেই বেশি কথা বলেনা ও। আর দিদার চৌধুরীকে ভয় পাওয়ায় তাকে সবসময় এড়িয়ে চলত দিয়া। আর দিদার চৌধুরী ও কখনো আগ বাড়িয়ে তাকে কিছু বলেনি কোনোদিন। দিয়াকে চুপ থাকতে দেখে আবারও তিনি বললেন ,
মাকে নিয়ে কি সমস্যা সেতো……
ওই মহিলা আমার মা না কিছুতেই না।
ওনার কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার করে উঠলো দিয়া। তিনি দিয়াকে শান্ত করতে বললেন,
ঠিকাছে কেউ না। কিন্তু তুমি চিৎকার বন্ধ করো। শান্ত হও। বলো আমাকে কি চাই তোমার।
এবার কোনরকম দ্বিধা না করে বেশ ঠান্ডা গলায় দিয়া বলল,
আমি যখন বাড়িতে থাকবো ওই মহিলা যেন আমার সামনে না আসে।
ঠিক আছে আসবেনা। কিন্তু তোমাকে এখন থেকে বাড়িতে থাকতে হবে।
কিন্তু বড়বাবা……..
কোনো কিন্তু না তোমার একমাত্র সমস্যা তো শিলা তাহলে ঠিক আছে। সে তোমার সামনে আসবেনা। কিন্তু তুমি আর হোস্টেলে ফিরে যেতে পারবেনা। আর তোমাকে এখন থেকে স্বাভাবিক ও হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পড়ালেখায় আবার মন দাও। তোমার মা প্রয়োজন সব এখন থেকে বড়বাবাকে বলবে। কি শুনবে না আমার কথা?
আমার এখানে থাকতে ভালো লাগে না বড়বাবা। কেমন যেন সব অসহ্য লাগে। এখানে থাকলে পুরোনো কথাগুলো আরও বেশি করে মনে পড়ে। আর এখনতো বড়াপুও নেই…….
আমরা তো আছি। আমি তোমার বড়মা, বাবা, ছোট বাবা, ছোট মা, ভাইবোনেরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসি আমরা।
দিদার চৌধুরীর কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো দিয়া। হঠাৎ পুরোনো কিছু স্মৃতি ওর মানসপটে ভেসে উঠতেই চিৎকার করে উঠল ও,
না কেউ নেই আমার কেউ না। কেউ ভালোবাসে না আমায়। তোমরা সবাই খারাপ সবাই পঁচা। চলে যাও তুমি লাগবেনা কাউকে। মা.য়া..আ…..
চিৎকারের সাথে সাথে রুমের সবকিছু ফেলতে শুরু করে দিল দিয়া। মা মা বলে চিৎকার দিয়ে একসময় দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল দিদার চৌধুরী। দিয়াকে পরে যেতে দেখে তার হুস ফিরল। তিনি সবাইকে ডাকার উদ্দেশ্যে তখনই রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।

বাবার কথায় দিয়ার রুম থেকে বেরিয়ে বাগানে সবাইকে নিয়ে গেলেও মন তার দিয়ার কথাই ভাবছিল। তাই সবাইকে উপেক্ষা করে নিরবে কাঁদছিল হিয়া। রিয়াদ দিয়ার ঘটনা জানতে কৌতুহলী হলেও ভাবিকে কাঁদতে দেখে কিছুই বলতে পারলো না। অন্যদিকে রাজিব, ঘটনার আকস্মিকতায় ও হতভম্ব। বিয়ের আগে পর্যন্ত ও এবাড়ির কাউকেই ভালো করে চিনতো না। বৌভাতের দিন নিজ থেকে সবার সাথে মিশেছে ও। তবে দিয়াকে ও আজই দেখেছে। বিয়ের দিন ও তেমন ভাবে কিছু খেয়াল করে নি। তাই কি বলা উচিত না উচিত কিছুই না বুঝে হিয়ার শান্ত হওয়ার অপেক্ষায় ওর পাশে গিয়ে বসল। নিজের হাত দিয়ে ওর এক হাত চেপে ধরে ওকে আশ্বস্ত করল রাজিব। এমন সময় রিয়া এসে হিয়ার হাত ধরে টেনে বলল,
তাড়াতাড়ি চলো মেজোপু আবারও জ্ঞান হারিয়েছে।
চটজলদি উঠে দাঁড়ালো হিয়া। হন্তদন্ত হয়ে ভেতরের দিকে এক প্রকার দৌড়ে গেল হিয়া। বাকিরাও নিরবে অনুসরণ করল ওকে। হিয়া এসে দিয়ার পাশে বসে ওর মাথায় হাত রাখল। রিয়াদ কে দেখে এগিয়ে এলেন দিদার চৌধুরী। রিয়াদের হাত ধরে বললেন,
তুমি তো ডাক্তার একটু দেখো ওকে।
দিদার চৌধুরীর অনুমতি পেয়ে দিয়ার বেডের পাশে গিয়ে বসল রিয়াদ। বেড সাইড টেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে পানি ছিটিয়ে দিয়ার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করল রিয়াদ। তাতে বিশেষ লাভ না হওয়ায় চিন্তায় ভ্রু জোড়া কুচকে গেল ওর। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
দুতিনজন বাদে বাকিরা রুম থেকে গেলে ভালো হয় আর বাড়িতে পেশার মাপা মেশিন, স্থেতস্কোপ, থার্মোমিটার এসব কি আছে থাকলে এনে দিন একটু।
রিয়া দৌড়ে দিদার চৌধুরীর ঘরে গেল জিনিসগুলো আনতে। বাকিরা রুমের বাইরে চলে গেল। হিয়া সরে রিয়াদ কে জায়গা করে দিল। রিয়াদ প্রথমে দিয়ার নাকের কাছে হাত নিয়ে শ্বাস পরিক্ষা করল। তারপর হাতের কব্জিতে হাত দিয়ে পালস্ চেক করল। ততক্ষণে রিয়া বাকি জিনিস দিয়ে গেছে। সেগুলো দিয়ে সমস্ত পরিক্ষা শেষে হিয়ার দিকে তাকিয়ে রিয়াদ বলল,
আগে কখনো হয়েছে এমন।
হুম। তিনচারবার। অনেক রেগে গিয়ে চিৎকার করলে ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
আচ্ছা।
বলেই কোথাও একটা ফোন করল রিয়াদ। তারপর আবারো বলল,
কোনো ডাক্তার দেখাও নি?
হুম। হক আংকেল দেখেছিল ওকে।ডক্টর মাজহারুল হক।
মাজহার চাচ্চু নাকি? গত মাসে অস্ট্রেলিয়া চলে গেলেন তিনি??
হ্যা। তুমি চেনো?
হুম। কি বলেছিলেন তিনি?
বাবার সাথে কথা বলতে হবে এ ব্যাপারে। তবে তিনি একজন সাইকাট্রিস্ট রেফার করেছিলেন। দিয়া নাকি মেন্টালি স্টেবল না।
আরো কিছু জানতে চাচ্ছিল রিয়াদ। কিন্তু কলিং বেল বেজে উঠায় সেদিকে ছুটে গেল ও। রাজিব এসে হিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
রিয়াদ যেতেই হিয়ার হাত ধরে ওকে কিছুটা সান্তনা দিলো ও।

ড্রয়িং রুমে সবাই চুপচাপ বসে ছিল। রিয়াদ রাজিব হিয়াসহ সেখানে প্রবেশ করল। ওদের দেখে দিদার চৌধুরী বলল,
কি অবস্থা দিয়ার?
একটি ইনজেকশন দিয়েছি জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে তবে ব্রেনে চাপ দেওয়া যাবে না। ওর আসল সমস্যা আসলে কি? ব্লাড প্রেশার হাই, হার্টবিট পালস খুব ধীরে চলছিল। তাই আপাতত ইনজেকশন টা দিয়েছি। কিন্তু ওর মেডিকেল হিস্ট্রি না জেনে তো অন্য কিছুই করতে পারবনা।
বলব তোমাকে সব । মাজহার তোমার কথাই বলেছিল আমাকে।
কিন্তু মাজহার চাচ্চু তো আমাকে কিছু বলেনি এ ব্যাপারে।
আমিই মানা করেছিলাম। ভেবেছিলাম হিয়ার বিয়ের ঝামেলাটা গেলে তোমার সাথে কথা বলব। তোমার বাবার সাথেও আমার কথা হয়েছে। তিনিও আমাকে এব্যাপারে সমর্থন করেছেন। আজকের এই ঘটনা না ঘটলে হয়তো তোমার বাবাই কিছুদিন পর তোমাকে সব বলতেন।
কিছু দিন হলে ব্যাপার গুলো আরও বিগড়ে যেতে। এমনিতেই আজ সময় মত ইনজেকশন টা না দিলে ভয়াবহ কিছু হয়ে যেতে পারত।
আসলে দিয়া মেন্টালি স্টেবল না। ওর সাথে কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটার কারনে আজ ওর এই অবস্থা। আসলে কিভাবে কি বলব, কোথা থেকে শুরু করব…..
আমার কাছ থেকে কিছুই লুকাবেন না। অন্যান্য রোগের চিকিৎসা রোগটি অনেক কিছু না বললেও ধরা যায় কিন্তু মানসিক রোগ গুলোর ক্ষেত্রে ছোট থেকে ছোট ডিটেইলস্ ও গুরুত্বপূর্ণ। সবথেকে ভালো হয় দিয়ার সম্পর্কে যে সব কিছুই জানে মানে দিয়ার সবথেকে ক্লোজ যে তার সাথে কথা বলতে পারলে।
তাহলে হিয়ার কাছ থেকেই তুমি যা জানার যেনে নাও। একমাত্র ওর সাথেই দিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল।
ভাবি তাহলে তুমিই বল।
বলেই হিয়ার মুখোমুখি বসল রিয়াদ। দিয়া সম্পর্কে ওর সব জানতে হবে। এত ফুটফুটে একটি মেয়ে… ভেবেই একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল ও। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনে মনে সমস্ত কথা গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল হিয়া,
আসলে সমস্যা টা শুরু হয় মামনি যেদিন মারা যায় সেদিন থেকে। অন্তত আমার তাই মনে হয়।
চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here