আলো আঁধার, পর্ব:৬+৭

#আলো_আধাঁর
লিখা- জেসিয়া জান্নাত রিম

৬.
মামনি কে দিয়ার কাছের কেউ?
দিয়ার মা। মেজো বাবার প্রথম স্ত্রী।
বুঝতে পেরেছি। উনি কিভাবে মারা গিয়েছিল?
প্রশ্নটা শুনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হিয়া। এই মামনি তো ওর ভিষণ কাছের মানুষ। নিজের মার থেকে তো বেশি মামনির কাছেই থাকত ও। একে একে সব স্মৃতি ভেসে উঠলো হিয়ার মনে। সাথে সাথে মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো ওর। চোখের পানি মুছে নিজেকে শক্ত করলো হিয়া। তারপর বলল,
মামনি আত্মহত্যা করেছিল।
আত্মহত্যা? কিন্তু কেন?
কারণ টা শুধুমাত্র মামনিই জানতো। আমরা জানতে পারিনি।
সেদিন এক্স্যাকলি কি ঘটেছিল বলতে পারবে ভাবি?
সেদিন আমাদের অফ ডে ছিল। আমার টিউটর আসায় আমি পড়ছিলাম। বাবারা অফিসে আর মায়েরা যে যার রুমে ছিল। পড়া শেষে যখন আমি মামনির রুমে যাই তখন মামনির দরজা ভেতর থেকে লক ছিল। আগে কখনো এই সময় মামনির দরজা লক দেখিনি। আমি কয়েক বার দরজায় নক করলাম। মামনি কে ডাকলাম ও। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সারা শব্দ পেলাম না। আমি আরও কয়েকবার জোর গলায় ডাক দিলাম। মামনির ঘুম খুবই পাতলা ছিল। ঘুমালে এটুকু শব্দে উঠে পরার কথা। কিন্তু তার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বাবারা সব বাইরে তখন। আমি মাকে ডেকে নিয়ে এলাম। মাও ডাকাডাকি করল কিছুক্ষণ। কিন্তু মামনি তাও দরজা না খোলায় শেষে সার্ভেন্ট দের ডেকে এনে দরজা ভাঙতে হল। আমার এখনো মনে আছে রুমের মধ্যে ঢুকে মামনির ঝুলন্ত নিথর দেহটা দেখে আমি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছিলাম। মুখ দিয়ে কোন কথা সরছিল না। এমন বিভৎস দৃশ্য তাও আবার নিজের কোনো মানুষের ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। আমাদের বাসার রুম গুলো দেখেছো তো। বারান্দা‌ আর রুম কাঁচের ডোর দিয়ে সেপারেট করা। সেইসময় ও এমনি ছিলো। আর বারান্দায় কাঁচের অপর পাশে দিয়া দাঁড়িয়েছিল। ঐ ঘটনার পর ও অনেকদিন কোনো কথাই বলেনি। আমি সবসময় ওকে নিজের সাথে ই রাখতাম। মাকে নিজের চোখের সামনে আত্মহত্যা করতে দেখলে কোন সন্তানেরই স্বাভাবিক থাকার কথা না।
পুলিশে খবর দাওনি?
হুম। পুলিশ কিছুদিন ইনভেস্টিগেশন করে ছিল। মামনির বাপের বাড়ির লোকজন ও সেভাবে ইন্টারফিয়ার না করায় দ্রুতই ইনভেস্টিগেশন শেষ করে দিয়েছিল। তাঁরাও কোনো কিছু বের করতে পারেনি।
কোনো ভাবে এটা খুন নয়তো?
নাহ। ঘটনার একমাত্র আই উইটনেস ছিল দিয়া। ও কারো সাথে কথা না বললে ও আমার কথায় সামন্য রেসপন্স করতে শুরু করেছিল। ওর কাছ থেকেই জানা যায় মামনি আত্মহত্যা ই করেছিল। তাছাড়া পোস্টমর্টেম ও করা হয়েছিল। তাতেও একই তথ্য বেরিয়ে এসেছিল।
দিয়ার বয়স কত ছিল তখন?
দশ বছর। দিয়ার ভাই দিশান তো আরও ছোট ছয়সাত মাস।
উম… দিয়া একটু স্বাভাবিক হয়েছিল কতদিন পর?
ঠিক স্বাভাবিক নয় তবে পরিবর্তন হয়েছিল মামনির মৃত্যুর তিনমাস পর।
কোনো বিশেষ কারণে নাকি…
সেদিন মেজোবাবা মেজো মাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল। দিয়াকে মেজো বাবা এসে যখন বলল আজ থেকে এটাই তোমার মা। তখন ও চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। তিনমাস পর ওর মুখ থেকে কোন আওয়াজ বের হলো। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা ছিল অস্বাভাবিক। মেজো মাকে আমরা ভালোভাবেই চিনতাম। ইনফ্যাক্ট দিয়া ওনাকে খুব পছন্দ ও করত। কিন্তু সেদিনের পর থেকে ও মেজো মাকে দেখলেই চেঁচামেচি শুরু করে দিত।
হুম। তুমি বললে ওনাকে আগে থেকে চিনতে…. মানে কিভাবে কত আগে থেকে?
মেজো মা সম্পর্কে আমার দাদীর ভাগ্নি ছিল। উনার প্রথম হাসবেন্ড মারা যাওয়ার পর উনি এবাড়িতে আসেন। কারণ আমরা ছাড়া ওনার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না।উনি বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে তাই আমাদের ও ভিষণ প্রিয় হয়ে উঠেছিল সে সময়।
ওহ উনি আসার কতদিন পর দিয়ার মা মারা যায়?
ছয়মাস। আর মামনি মারা যাওয়ার পর দিশানের সমস্ত দ্বায়িত্ব মেজো মাই নিয়েছিলেন। মেজোবাবাও মামনির মৃত্যুতে ভিষন ভেঙে পড়েছিল। তারপর পরিবারের বড়রা মেজবাবাকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে দুজনের বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু দিয়াকে আর স্বাভাবিক করা যায়নি। ও সবসময় নিজের রুমের মধ্যেই থাকত। পুরো বাড়িতে শুধু আমার সাথেই ও একটু কথা বলতো। মামনির পর ওকে খাওয়ানো গোসল করানো থেকে শুরু করে ওর সমস্ত দায়িত্ব আমিই নিয়েছিলাম। রাতে সবসময় ও আমার সাথে ঘুমাতে চাইতো না। মাঝে মাঝে একা ঘুমাতো। আর সেদিন সারারাত ও ঘুমাতোই না। চুপচাপ বিছানায় বসে থাকত। ওর অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারছিলাম সবাই। ভেবেছিলাম সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। একবছর পর থেকে ওর পড়াশোনা শুরু করানো হলো। স্কুলে যেতনা শুধু পরিক্ষাটা দিত। পড়ালেখায় একদমই মন ছিল না ওর। কোন মতে টেনেটুনে পাশ। ও বরাবরই ভালো ছাত্রী। সবসময় টপ ফাইভে থাকতে। অথচ সেই ছাত্রী কোনমতে পাশ। পি এস সির সময় তিনমাস আমি ওকে পড়ালাম। দিনরাত জেগে ওর পিছনে পরে থাকলাম। আমার এত কষ্ট দেখেই বোধহয় ও চেষ্টা করেছিল। সেবার রেসাল্ট হলো ২.০০। এরপর এভাবেই ওর পিছনে লেগে থাকলাম। জে এস সি তে আরেকটু ভালো করলো ২.৯০। আমি হাল ছাড়লাম না। ওকে পড়াশোনার মাঝে বাঁধতে চাইলাম। কিন্তু ওর ভালো লাগতো না। একবার তো বলেই বসলো “এসব পড়াশুনা আমার ভালো লাগে না আমি মায়ের কাছে যাব।” সেদিন ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদে ছিলাম। ও কিন্তু একটুও কাঁদেনি। সেদিন কেন মামনি মারা যাওয়ার দিন থেকেই ওর কান্না চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই সময় যাচ্ছিল আমাদের। যতই দিন যাচ্ছিল ও ততই চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিল।
বলেই একটু থামল হিয়া। এর পরের ঘটনা টা যে কটতা ভয়াবহ ছিল সেটা একবার মনে করে নিল। সমস্ত ঘটনা শুনে দিয়ার প্রতি এদের মনোভাব কি হবে। রাজিব ওদের সম্পর্কে কি ভাববে? ওর শশুর বাড়ির সামনে ওর বাপের বাড়ির সেই সম্মানের কি হবে যে সম্মান বাঁচাতে ওর বাবা সহ পুরো পরিবার খুব কৌশলে এসব ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছিল?
ভাবী তুমি বলে যাও লুকিয়ো না কিছু।
রিয়াদের কথায় ধ্যান ভাঙল হিয়ার। না লুকাবে না কিছুই যে যা ভাবুক। সত্য তো লুকানোর জিনিস না। তাছাড়া এর সাথে দিয়ার ভালো মন্দ জড়িত। চোখ বন্ধ করে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আগের মতই বলতে শুরু করল হিয়া,
তখন ও নিউ টেনে উঠেছে সবে। আগের মতই দিন গুলো যাচ্ছিল ওর। কিন্তু একদম হুট করেই ওর মাঝে একটা পরিবর্তন খেয়াল করলাম। যে দিয়ার মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোর জন্য আমরা বাড়ি শুদ্ধ লোক মরিয়া হয়ে ছিলাম সেই দিয়া একা রুমে হাসছে। অবাক হয়েছিলাম আবার খুশিও। কিন্তু আমি রুমে ঢোকার সাথে সাথে ই ওর হাসি গায়েব। জানতে চাইলে বলেছিল “কই বড়াপু আমি তো হাঁসি নি।” ওর কথায় টেনশনে পড়ে গেলাম। তবে কি আমার বোনটা দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে। তারপরের ঘটনাগুলো তো আরো ভয়াবহ ছিল। দিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। মাঝে মাঝে সাজে। পড়ালেখায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। সময় মত খাওয়া দাওয়া, গোসল করে। বিশেষ করে নিজের যত্ন নিচ্ছে। নিজেকে কিভাবে সুন্দর দেখানো যায় সেই চেষ্টা করছে। পরিবর্তন টা চোখে পরলেও কিছু বুঝতে পারছিলাম না। একদিন আমাকে এসে বলল “আমার একটা ফোন লাগবে বড়াপু।” এই এত বছর পর দিয়া কিছু মুখ ফুটে চাইলো মানা করার তো প্রশ্নই আসে না। বাবাকে বলে ফোন আনিয়ে দিলাম ওকে। কিন্তু এই সমস্ত পরিবর্তনের উৎস কি? এই রহস্য ভেদ করতে রিতিমত হিমসিম খাচ্ছিলাম আমি। নিজে না জেনে অন্য কাউকে এসব বলা ঠিক হবে না ভেবে দিয়াকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম। দিয়া এবারও এড়িয়ে গেল সবকিছু। পরদিন সকালে ওকে দেখলাম বেশ সাজুগুজু করছে। আমি কলেজে যাওয়া বাদ দিয়ে ওর রুমে লুকিয়ে ওকে লক্ষ্য করতে শুরু করলাম। এ সময়টা সবাই খুব বেশি ব্যস্ত থাকে। আর দিয়া নিজের রুম থেকে কখনোই বের হয়না। ওর রুমে আমি ছাড়া কেউ মোটেও না। খেয়াল করলাম ও রুমের দরজা বন্ধ
করে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।
চলবে…….

#আলো_আধাঁর
লিখা- জেসিয়া জান্নাত রিম

৭.
দিয়ার এতসব পরিবর্তনের কারণ ছিল ইমরান। বাবাদের পি এস হিসেবে নতুন চাকরিতে এসেছিল ছেলেটা। প্রায়ই আমাদের বাসায় জাতায়াত করত। সবসময় সকালের দিকে যে সময়টা সবাই ব্যস্ত থাকত। ইমরান বাড়ির মধ্যে কখনোই আসতো না। বাগানে হাটাহাটি করতো। আর দিয়ার রুমের বারান্দা থেকে বাগানের পুরোটা দেখা তো যেতই সাথে নিচতলা হওয়ায় সহজেই রেলিং টপকে আসা যাওয়াও করা যেত। সেদিন লুকিয়ে আমি দিয়া আর ইমরানকে কথা বলতে দেখলাম। ওদের কথপোকথন বলে দিচ্ছিল ওদের পরিচয়ের বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। আর সম্পর্কটাও বেশ গভীরে চলে গেছে। সেই মূহূর্তে আমার কি করা উচিত ছিল আমি বলতে পারবো না। তবে দিয়ার মুখের হাসি ওর চোখ মুখের উজ্জলতা বলে দিচ্ছিল ও বহুবছর পর একটু সুখ খুঁজে পেয়েছে। যখন দেখলাম কথা বলার সময় ও ইমরানের শার্টের কোন ধরে রেখেছে তখন বুঝতে পারলাম ওর মধ্যে দিয়া নির্ভরতাটুকুও পেয়ে গেছে। বিশ্বাস করো তখন উচিত অনুচিত কোনোকিছুই মাথায় আসেনি আমার। চোখের সামনে শুধু দিয়ার হাসি মাখা মুখটাই দেখছিলাম। তাই বিষয়টা যেমন চলছিল তেমন চলতে দিলাম। কয়েক দিন পর দিয়ার মাঝের পরিবর্তন টা সবার চোখেই কম বেশি পড়তে শুরু করল। তবে এর মাঝেও মেজো মাকে দিয়া সহ্য করতে পারলো না। আমি সাহস করে সবাইকে সবটা বলে দিলাম। বাবা প্রথমে ইমরানের উপর কিছুটা রেগে গেলেও সবাই মিলে দিয়ার পরিবর্তন এবং ওর ভালো সম্পর্কে বোঝানোর পর বাবা বিষয়টা মেনে নিলেন। ইমরান কে বাড়িতে ডাকা হলো। প্রথমে ওর সাথে আলাদা কথা বলা হলো। প্রফেশনালরা ছাড়াও যে কোনো মানুষ এতো ভালো আর নিখুঁত অভিনয় করতে পারে সেটা ইমরান কে না দেখলে আমরা বুঝতেই পারতাম না। তখন মনে হতো ও দিয়াকে সত্যিই ভালোবাসে। যাইহোক ওর সাথে আলাদা কথা বলার পর আমরা এতটুকু নিশ্চিত হয়েছিলাম ইমরান ছেলেটা ভালো আর ও দিয়াকে সত্যিই ভালোবাসে। ইমরানের বাবা মা ছিল না। তাই আমাদের কাছ থেকে ভালোই সিম্প্যাথি পেয়েছিল ও। সবদিক বিচার বিবেচনার পর ওদের বিয়ের সিদ্ধান্তই নেওয়া হলো।
বিয়ে হয়েছিল ওদের?
ভয়ার্ত কন্ঠে বলে বসল রিয়াদ। সবাই তখন দিয়ার গল্পে মগ্ন থাকায় হয়তো ওর এই কন্ঠ ধরতে পারলো না। পূর্ব সুর ধরেই হিয়া বলল,
তখন শুধু আংটি পরানো হয়েছিল। যেহেতু দিয়ার বয়স কম ছিল তাছাড়া আমার বিয়ের আগে দিয়ার বিয়ে হলে উল্টাপাল্টা কথা হতো এ বাড়ির সম্মানে বিশেষ ইফেক্ট পরত তাই বিয়েটা কয়েক বছরের জন্য স্থগিত রাখা হলো। আর ইমরান ও বিয়ের জন্য তখন প্রস্তুত ছিল না। লাভের মধ্যে ইমরানের এ বাড়িতে যাতায়াত বেড়ে গেল। আর দিয়া ও বাইরের জগতের সাথে পরিচিত হতে থাকলো। মামনি মারা যাওয়ার পর দিয়ার জীবনের বেস্ট তিনটা বছর ছিল ইমরানের সাথে কাটানো ঐ তিনটা বছর।। আমার দিয়া এস এস সি তে পুরো ৪.৫৫ পেয়ে পাস করল। আর এইচএসসি পরীক্ষার সময় নিজে থেকে ছয়মাস সময় নিয়ে সারাদিন রাত পড়ে জি পি এ ৫ নিয়ে এল। ওর রেসাল্ট শুনে আমরা কি পরিমান খুশি হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না। বাবা খুশি হয়ে ইমরান কে আমাদের নতুন খোলা কোম্পানির সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। ইমরানের কাজের চাপ ও বেড়ে গেল। এখন ওকেও বড় বড় বিজনেস মিটিং এটেন্ড করতে হচ্ছে। দিয়ার সাথে ইমরানের সপ্তাহে একবার দেখা হতো তখন। এভাবেই সময় গুলো যাচ্ছিল। ইমরানের মধ্যে যে তখন থেকেই পরিবর্তন সেটা আমরা না বুঝলেও দিয়া ঠিকই বুঝতে পারছিলো। কিন্তু বোকাটা আমাদের কিছুই বলেনি। ভালোবাসাটা টিকিয়ে রাখতে মেয়েটা একা একা ওর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছে। আমরা টের পেলাম যখন সবকিছু হাতের বাইরে চলে গেছে তখন। সেদিন দিয়া হুট করেই বাসায় ফিরে ওর রুমের দরজা আটকে দিল। প্রথমে ভাবলাম বাইরে থেকে এসেছে বোধহয় ড্রেস চেঞ্জ করবে। কিন্তু ঘন্টা খানেক পর ও যখন ও দরজা খুলল না তখন আমি গিয়ে ওকে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করলাম। কিন্তু ও কোনো জবাব দিলো না। হঠাৎ করে আমার মামনির মৃত্যুর দিনটা মনে পড়ে গেল। দ্রুত সবাইকে ডাকলাম। মামনির ঘটনার পর থেকে সব রুমের এক্সট্রা চাবি মায়ের কাছে রাখা ছিল। দিয়ার রুমের চাবি এনে দরজা খোলা হলো। দিয়ার নিথর দেহটা তখন নিচে পরে ছিল। ডান হাতের কব্জি থেকে রক্ত পরছে। বা হাতে ব্লেড। এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল ও আর নেই। মামনির মত ও ও চলে গেছে। হিমেল গিয়ে ওর নাকের সামনে হাত রাখল। নিঃশ্বাস তখন ও পড়ছিল। ও এসে আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল ” বড়াপু দিয়াকে ওঠা জলদি ওকে হসপিটালে নিয়ে যাই।” আর এক মূহুর্ত দেরি না করে ওকে হসপিটালে নেওয়া হলো। অনেক স্ট্রাগল করে ওকে বাঁচানো তো গিয়েছিল কিন্তু……..
এটুকু বলতে গিয়ে হিয়া থেমে গেল। বাবার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলবে কিনা ইশারায় তা জানতে চাইলো। দিদার চৌধুরী মেয়েকে ভরসা দিয়ে বললেন,
তুই বলে যা।
বাবার অনুমতি পেয়ে হিয়া আবার ও বলতে শুরু করল,
ডাক্তার এসে যখন বললেন দিয়া প্রেগন্যান্ট আমারা বড় একটা ধাক্কা খেলাম। কিভাবে সম্ভব? ইমরানেকে এ বিষয়ে তখন ও জানানো হয়নি। কারণ ওর ফোন অফ ছিল। ইমরানকে আমরা নিজেদের ফ্যামিলি মেম্বার হিসেবে ট্রিট করেছি। বিয়ের কথা বললে যে ইমরান সবসময় বলত দিয়ার বয়স কম ও এখনো বিয়ের ব্যাপারটা বোঝেনা। সেই ইমরান কি করে দিয়ার সাথে এমনটা করতে পারে? ইমরানকে বারবার ফোন করেও যখন পাওয়া গেল না তখন বাধ্য হয়েই বাবা মেজো বাবা ইমরানের বাসায় গেলো। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে সোজা ডাক্তারকে বাবা একটা কথাই বলে ছিল ” বাচ্চাটা এবোর্ট করে ফেলো।”
কথাটা বলতে গিয়ে হিয়ার গলা কেঁপে উঠলো। দু হাত দিয়ে মুখ ডেকে অনেকটা বিলাপ করার মত করে বলল,
আমার দিয়া জ্ঞান ফেরার পর কিছুদিন বিশ্বাস ই করতে চাইনি বাচ্চাটা আর নেই। বার বার পেটে হাত দিয়ে বলত আমার বাবু ঘুমাচ্ছে তাইনা বড়াপু। দেখিস বাবুকে দেখলেই ও আবার ফিরে আসবে আমার কাছে।
এর বেশি কিছু আর রিয়াদের কানে গেলো না। কে যেন ওর কানে জ্বলন্ত আগুন ঢেলে দিয়েছে বলে মনে হলো ওর। এতটা ও আশা করেনি। ঘর ভর্তি লোকজন উপেক্ষা করে নিরবে বেরিয়ে গেল ও। এখন এক মূহুর্তের জন্য ও এখানে থাকতে চায় না। দিদার চৌধুরীর মুখটা হঠাৎ কালো আঁধারে ছেয়ে গেছে। উনিও কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেলেন।

রিয়াদ রাস্তা ধরে নিজের মতো হাটছে। ওর এখনো বিশ্বাস হতে চাইছে না। দিয়ার জীবনে এত কিছু ঘটে গেছে। ঐ লোকটা আর দিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক এতটা গভীরে চলে গিয়েছিল কিভাবে? দিয়া কি এতটাই অবুঝ ছিল? আর ওর পরিবার তারাই বা কিভাবে ওদের কে এভাবে মেলামেশার সুযোগ দিলেন। রিয়াদের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। কিন্তু ঠিক কার উপর ও বুঝতে পারছে না। দিয়া, ঐ ছেলেটা, দিয়ার পরিবার নাকি ওর নিজের ওপর? দিয়াকে দেখার পর থেকে ওর মনের মধ্যে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল প্রফেশনের কারণ সেটা সহজেই ধরতে পেরেছিল। তাই দিয়াকে নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। তাইতো ওর সম্পর্কে জানার জন্য এতটা উৎসুক ছিল ও। ভেবেছিল দিয়ার সমস্যার সমাধানের বাহানায় ওর কাছাকাছি থাকা যাবে আর দিয়ার মনেও নিজের জন্য জায়গা বানাবে। কিন্তু দিয়া তো অলরেডি অন্য কাউকে….
ভাবতে ভাবতেই পাশের দেয়ালে হাত দিয়ে সজোরে আঘাত করে বসল রিয়াদ। তখনই ওর ফোনে একটা কল এল। প্রথমবার ও ধরলো না। দ্বিতীয় বার রিং হতেই ফোন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে হাতে নিতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম দেখে সিদ্ধান্ত বদলে ফোন রিসিভ করল ও।
চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here