ইতিপূর্বে পর্ব ৯ ও শেষ

#ইতিপূর্বে [০৯] (শেষ পর্ব)

বেশ কিছুক্ষন সময় পেড়িয়ে যাওয়ার পর ইতি হুট করে ধাক্কার ন্যায় পূর্বের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।পুর্ব এবার আহত দৃষ্টিতে তাকায় ইতির দিকে।তবে ইতি সেই চাহনির দিকে তাকায় না, কারণ সেই দিকে তাকালেই সে আবারো দুর্বল হয়ে পরবে,যার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।তাকে যে শক্ত থাকতে হবে,নইলে চলবে না।
পূর্ব ও এবার নিজের দূর্বলতা কাটিয়ে শক্ত গলায় বলে,
পূর্ব: আমি তোমায় দেখতে চাই ইতি।কি তোমার আসল পরিচয়?

ইতি:যদি বলি দেখাবোনা।তুমি জানতে পারবেনা আমার পরিচয়।
পূর্বের এবার মাথায় রাগ চড়ে বসে।ইতির হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।

ইতি:খবরদার পূর্ব।ভালো হচ্ছেনা কিন্তু..

পূর্ব কোনো কথাই শুনলো না,কিছু সময় ছোটাছুটির পর অবিশেষে ইতির মাস্ক খুলতে সক্ষম হয়।আর সঙ্গে সঙ্গেই যেনো বুক থেকে একটা বড় পাথর সরে যায়।
সেই সুনয়নার চোখের সঙ্গে নিলাঞ্জনার চোখে অনেকটা মিল খুজে পেয়েছিলো পূর্ব।আর নিলাঞ্জনার গলার ভয়েস এর সঙ্গে ইতির ভয়েস এর বেশ মিল রয়েছে।কিন্তু তাদের চোখ সম্পূর্ন ভিন্ন।সেই কারণেই পূর্ব ইতিকে দেখার জন্য এতো আগ্রহ দেখাচ্ছিলো।কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়,কারণ এটা নিলাঞ্জনা নয়।তবে এক অন্য মায়াবী চেহারা।যার মায়াতে জড়িয়ে যায় পূর্ব,এক দৃষ্টিতে ফাকিয়ে থাকে ইতির পানে।

ইতি:হয়েছে?দেখেছো আমায়?নাও হ্যাপি?

পূর্ব: তোমার আসল পরিচয় কি ইতি?কে তুমি?

ইতি:আমি তুরফা ইতি,এটাই আমার পরিচয়

পূর্ব:আমার সঙ্গে হেয়ালি করোনা ইতি।তোমার মধ্যে কিছুতো একটা রহস্য আছে যা তুমি গোপন করে রেখেছো।সত্যিটা আর লুকিয়ে রেখোনা ইতি।প্লিজ বলো আমায় হু আর ইউ?

ইতি:আচ্ছা?এতো আগ্রহ…তাহলে বলো তো পূর্ব, মনে আছে কি সেই পুড়োনো রিতির কথা? (শেষ কথাটা বলতে গিয়ে চোখ ছলছল করে ওঠে)

“রিতি” নামটা শোনা মাত্রই পূর্ব দু পা পিছিয়ে যায়। কাপা কাপা গলায় বলে,

পূর্ব: র র রিতি!

ইতি:পিছিয়ে যাচ্ছো কেনো পূর্ব?মনে নেই বুঝি? সেই রঞ্জনা রিতির কথা?

পূর্ব:ত তুমি রিতির ক কে হও?

ইতি:হা হা হা..আমি?চেনেন না আপনি আমায়? তবে শুনুন, রিতি আমার আইডিয়াল,রিতি আমার টিচার,রিতি আমার উৎসাহদাতা,রিতি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড,রিতি ইজ হাফ অফ মি। ফর এভার, রিতি আমার বোন,আমার আপন বড় বোন,তার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক।বুঝেছো পূর্ব?

পুর্ব কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।এতোদিনে ইতির প্রতিটা কাজ দেখে রিতির কথা মাথায় আসতো তার তবে সেটাকে কখনো পাত্তা দেয়নি। কিন্তু আজ? যা কখনো কল্পনাও করেনি।

ইতি:কেনো পূর্ব?আমার এসব অন্যরকম কাজ দেখে তো তোমার বুঝে যাওয়ার কথা।বুঝতে পারোনি বুঝি?আমিও না!তুমি কি করেই বা বুঝবে?তোমার তো আপু কেই মনে থাকার কথা না..যাকে নিজের প্রয়োজন শেষে ছুড়ে ফেলে দিতে দু বার ভাবলেনা তাকে আর মনে থাকবে কেনো?

পূর্ব: ইতি..কি বলছো তুমি এসব?আ আমি ছুড়ে ফেলে দিয়েছি মানে?

ইতি:ওহ হো,বুঝতে পারছোনা বুঝি?তাই তো, বুঝতে পারবেও না।তবে শুনে রাখো পূর্ব, আমার আপু দুর্বল ছিলো না,আমার আপু প্রতিবাদি ছিলো।আজ আমি যতটা স্ট্রং,তার মূলে কিন্তু আপু ই।সবসময় আপুর থেকে শুনেছি নিজের সেফটি নিজের কাছে,কঠিন থেকে কঠিনতম মুহূর্তেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে শিখেছি আপুর থেকে। আমার আপু তো এতো সহজে দুর্বল হয়ে পড়ার মেয়ে নয়,ওকে দুর্বল হতে বাধ্য করেছো তুমি।বলোনা কি দোষ করেছিলো আপু? ভালোই তো বেসেছিলো,তার জন্য তাকে এতোটা কষ্ট কেনো পেতে হলো বলো?কেনো রাতের আধারে কেঁদে বালিশ ভেজাতে হলো তাকে?উত্তর দাও আমায়,আমি নিড এন্সার…

পূর্ব অবাক হয়ে তাকায় ইতির দিকে।এই কথার মানে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

পূর্ব:ইতি তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।রিতি আ..

ইতি:আমার কোথাও ভুল হচ্ছেনা পূর্ব।ভুল করেছিলে তুমি,আর সেই ভুলের মাশুল আমার আপুকে দিতে হয়েছে।কি ভেবেছিলাম জানো?তোমার নিজের হাতে শেষ করে দেবো।কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস?যেই মামুষটিকে পাচ পাচটে বছর ধরে নিজের সর্বোচ্চ ঘৃণার মানুষের স্থানে বসিয়েছিলাম,নিজের অজান্তেই তার মায়ায় জড়িয়ে গেলাম। আপুর মতো সেই একই ভুল আমিও করলাম।তবে ভাগ্য ভালো তোমার আসল রূপটা জানতে পেরে গেছি।

পূর্ব: ইতি তুমি কার আসল রূপের কথা বলছো।তুমি সবটা জানোনা..

ইতি:আমিতো জানতেও চাই না পূর্ব..যা জেনেছি তাই আমার জন্য ইনাফ।তবে এখন আমি চাইলেও তোমাকে মারতে পারবো না,কারণ টা কিছুক্ষণ আগে তুমি নিজেই বললে।

পূর্ব:নিশ্চুপ

ইতি:তোমার মতো মানুষেরা না ভালোবাসার মর্ম বোঝে না,তোমরা সম্পর্কের মর্ম বোঝো না।আর আমি চাইলেও তোমায় বোঝাতে পারবো না।তবে একটা কথা জেনে রাখো পুর্ব,ইতিপূর্ব না কখনো এক ছিলো আর না কখনো এক হবে।তুমি আমায় আর দেখতে পাবেনা,চাইলেও খুজে পাবেনা আমায়।তবে হ্যা,তোমার কর্মের ফল এ জন্মে না পেলেও পরকালে পাবে।ভালো থেকো..

কথাটা বলে পূর্বকে কিছু বলার সু্যগ বা দিয়ে বাইক এ উঠে বসে।প্রিয়াঙ্কা ও নিজের চোখের জল মুছে ওর পিছনে বসে পড়ে।
মুহূর্তের মাখেই বাইক স্টার্ট দিয়ে একবার পূর্বের দিকে তাকায় ইতি।পূর্ব মাথা তুলে ইতিকে বাইক এ বসতে দেখেই ছুটে যায় সেদিনে।কিন্তু তার আগেই চলে যায় ইতি।পূর্ব নিজের সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়ে যায় তার পিছনে,একসময় পাথরে পা বেজে পরে যায় জনশূন্য রাস্তায়।চিৎকার করে বলে ওঠে,

–যেওনা ইতি,একবার শোনো আমার কথাটা। তুমি যা জানো তা সত্য নয়,আমি খারাপ মানুষ নই ইতি। একটাবার দাড়াও প্লিজ….

কোনো লাভ হলোনা।চলে গেলো ইতি,হয়তো সারাজীবন এর জন্য এক ভুল ধারণা মনে গেঁথে নিলো সে।
রাস্তার মাঝে বসে নিজের চুল টেনে ধরে আকাশেষ দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলো পুর্ব,হয়তো তার এই কষ্টে আকাশ ও শোকাহত।মুহূর্তের মাঝেই আকাশ ছেয়ে গেলো মেঘে,ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নেমে এলো ধরণি তে। এ বর্ষন হয়তো কারোর নিকট সুখের কিংবা কারোর নিকট বিষাদের।

কিছুদুর যেতেই বাইক থামালো ইতি।বাইক থেকে নেমে।রাস্তায় বসে কাদিতে লাগলো,বৃষ্টির পানির সঙ্গে তার অশ্রুও মিকে যেতে লাগলো।প্রিয়াঙ্কা নেমে এসে কাধে স্পর্ষ করতেই জাপটে ধরলো তাকে।প্রিয়াঙ্কা সবটা বুঝতে না পারলেও এতটুকু বুঝেছে এখন ইতুর মনে ঠিক কি চলছে…
আর এই বর্ষনেই হয়তো ইতিপূর্ব একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো,কিংবা কাছে আসার রাস্তা তৈরি হলো..
ঘন্টাখানেক বৃষ্টিতে ভেজার পর পূর্ব উঠে দাঁড়ায়,টলতে টলতে নিজের বাইক এর সামনে যায়।বাইক এ চেপে চলে যায় বারে,একের পর এক ওয়াইন এর বোতল শেষ করে চলেছে সে।এক পর্যায় আর পেরে ওঠেনা।গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে।

নিলাঞ্জনা বাড়ি থেকে কিছুটা বাহিরে আসতেই দেখতে পায় আরাধ্যের গাড়ি।গাড়ির সামনে গিয়ে জানালা দিয়ে ভিতরে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় সে।কোনোরকম গাড়ির দড়জা খুলে ভিতরে ঢুকতেই নাকে বিদঘুটে গন্ধ আসে,এক হাতে মুখ চেপে ধরে সে।অন্যহাতে আরাধ্যের গায়ে হাত দিতেই আতকে ওঠে,কারণ গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।ভিজে জামাকাপড় গায়ে থেকেই শুকিয়ে খানিকটা কুঁচকে গেছে।নিলাঞ্জনা কোনো মতে অরন্যের সাহায্য নিয়ে ওকে ভিতরে নিয়ে যায়।সারারাত ওর পাশেই বিসে থাকে।অনেক কষ্টে জলপট্টি দিয়ে জ্বর নামিয়েছেমতবে জ্বরের ঘোড়েও আরাধ্য বারবার “ইতি যেওনা”কথাটি উচ্চারণ করছিলো।তার দিকে নিলাঞ্জনা তেমন খেয়াল দেয় নি।…

ভোর হতেই ঘুম ভেঙে যায় নিলাঞ্জনার,কিন্তু বিছানার দিকে তাকিয়ে আরাধ্য কে না দেখতে পেয়ে অবাক হয়।পরবর্তিতে জানতে পারে সে নাকি ভোরবেলাতেই চলে গেছে।কিছুটা অবাক হলেও এ বিষয়ে কথা বারায় না সে।লেগে পরে নিজের দৈনন্দিন কাজে….

কেটে গেছে দু দুটো বছর..অনেকের কাছে হয়তো সময়টা চোখের পলক এই শেষ হয়ে গেছে মনে হবে আবার অনেকের কাছে মনে হবে সময়টা যেনো যুগ যুগ পর শেষ হলো।ঠিক তেমনি অবস্থা আরাধ্য ওরফে পূর্বের।
বারান্দায় একটা চেয়ারে বলে কফি খাচ্ছে সে।দুটো বছর পার হয়ে গেলো তবুও ভুলতে পারেনি সে ইতিকে।সেদিনের পর পাগলের মতো খুজেছে ইতিকে এবং এখনো খোজে।কিন্তু তার এতো চেষ্টা প্রতিবার ই বিফলে যায়।দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পূর্ব।কফিটা পাশের টি টেবিল এ রেখে চোখ বন্ধ করে বলে,
–কোনো এক বর্ষনের রাতে তোমার সেই প্রতিবাদি আখির মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি,এ যেনো এক অদ্ভুত মায়া,যেনো নেশার দ্রব্যের চেয়েও প্রখর।তবে কেনো এই নেশা ধরালে যখন ছেড়েই চলে যাবে?
আমার কোনো দোষ ছিলো না ইতি,তোমার ভাবনাতে ভুল ছিলো।হয়তো আজো আমায় এক প্রতারক ভেবেই ঘৃণা করো তুমি।তবে আমি?
হাহ,আজো এক চিলতে আশা নিয়ে খুজে বেড়াই তোমায়।হয়তোবা আমার এই আশা পূরণ হওয়ার নয়।
হয়তো অসমাপ্ত ই থেকে যাবে ইতিপূর্বের গল্পকথা🥀

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here