ইতি মাধবীলতা পর্ব -০৩

#ইতি_মাধবীলতা
#পর্ব_৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

তখন মাত্র পুজো শেষ করে গীতা পাঠ করছে মাধবী। জমিদার গিন্নি, রেখা দেবী ঠিক তখন সে ঘরে প্রবেশ করলেন।

— তোমার স্পর্ধা দেখে আমি ক্রমশ অবাক হচ্ছি, মাধবী!

মাধবী শুনলো সে কথা। তবে, নিজের পাঠে ব্যাঘাত ঘটবে বিধায় উত্তর করলো না কোনো। ধীর গতিতে পবিত্র গীতা পাঠ করতে লাগলো। সম্পূর্ণ পড়া শেষ করে তবেই তাতে চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।। রেখা দেবী চোখের তীক্ষ্মতা ধনুকের ন্যায় মাধবীর পানে আটকে। মাধবী সেই চাওনিতে বেপরোয়া, নম্র কণ্ঠে বললো সে,
— কি স্পর্ধা দেখাচ্ছি আমি?

রেখা দেবী কণ্ঠ প্রখর করে বললেন,
— এ বাড়িতে তোমায় এ বাড়ির পূঁজো ঘরে যাওয়ার অনুমতি কে দিলো? এত বড় স্পর্ধা দেখাতে তোমার কি একবারও বুক কাঁপলো না?

মাধবী দায়সারা ভাবে উত্তর করলো,
— আমি এ বাড়িতে পূঁজো করে যদি স্পর্ধা দেখিয়ে থাকি, তবে আমায় এ বাড়ি হতে বিতাড়িত করে দিন। এতে আমার দিল অনেক খুশি হবে! পারবেন বিতাড়িত করতে আমায়?

থমকে গেলেন রেখা দেবী। দু ভ্রুতে সূক্ষ্ম এক ভাঁজ পড়লো। মাধবীর কথার প্যাঁচ বুঝতে তার একটুও বিলম্ব হলো না। তিনি জানেন, মাধবীকে এ বাড়ি হতে বিতাড়িত করলে তার বড় পুত্র জমিদার বাড়িতে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে। নিলাংসুর রাগে এ বাড়ির প্রতিটা সদস্য সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে রয়। রেখা দেবী দমে গেলেন। মাধবীর পানে প্রখর দৃষ্টিপাত করে সে ঘর প্রস্থান করলেন তিনি। মাধবী কুটিল হাসলো সেদিকে চেয়ে।
_________________________
জমিদার বাড়ির সমস্ত পুরুষ আজ বাড়ি ফিরেছে। বাড়ীর বড় পুত্র এতবড় অনিষ্ট ঘটিয়েছে, তাতে সবার হাতের অন্ন পড়ে গেছে। জমিদার সমরেশ ভট্ট বসার ঘরে বসে আছেন। বদনখানা গম্ভীর করে হুক্কা টানছেন ক্রমাগত। এই মুহূর্তে জমিদার বাড়ীর সবাই একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে আছে। যেকোন মুহূর্তে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র ঘটে যেতে পারে, মনে মনে সবাই সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছে।

নিলাংসু মাত্রই বাড়ি ফিরলো। আজ গ্রামে এক রাজনৈতিক নেতা এসেছেন। নিলাংসু তার সাথেই দেখা করতে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে ঘরের এমন ঝড়ের আবাশ তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারলো না। সে সমরেশ ভট্টের দিকে একপল চেয়ে নিজের কক্ষে চলে গেলো।

মাধবী তখন কক্ষে ক্রমাগত পায়চারি করছে। তার সমগ্র মস্তিষ্ক জুড়ে একটাই ভাবনা, এ নরক থেকে কিভাবে পালাবে সে?

— কেমন আছো, মাধবীলতা?
আচমকা কর্নকুহুরে কথাটা প্রবেশ করতেই মাধবী ভয়ে ছিটকে সরে গেলো। বুকে কতোবার ফুঁ দিয়ে তাকালো সামনে। নিলাংসু খুব হাসছে। সারাটাদিন পর নিলাংসুকে দেখে মাধবীর রক্ত পুনরায় ছলকে উঠলো। তীক্ষ্ম চোখে পরখ করতে লাগলো নিলাংসুর আপাদমস্তক। নিলাংসু হাসি থামালো। ঠোঁটে হাসির চিন্হ বজায় রেখে বললো,
— তুমি ভয়ও পাও, মাধবীলতা? কিন্তু, আমি তো জানতাম তুমি এক আস্ত বাঘিনী। যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না! শুধু ভালোবাসা যায়!

মাধবীর রাগ হলো খুব। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে চাইলো নিলাংসুর দেহখানা। নিলাংসু কেমন করে যেন বুঝে গেলো সে ভাবনা। সে মাধবীর দিকে অগ্রসর হলো। মাধবী সরে যেতে চাইলো। কিন্তু, নিলাংসু বাঁধ সাধলো। নিজের সাথে চেপে ধরলো মাধবীর দেহখানা। মাধবীর কানের কাছে ঠোঁট এনে বললো,
— আমায় খুন করবে না, মাধবীলতা?

মাধবী দুহাত নিলাংসুর হাতের বাঁধনে আবদ্ধ। তবুও, এ নারী দমে গেলো না। মাধবী হাতের ধারালো নখ দিয়ে নিলাংসুর হাতে আঁচড় কাটলো কতবার। অথচ, নিলাংসু স্থিরচিত্ত হয়ে চেয়ে রয়েছে মাধবীর পানে। মাধবী কণ্ঠে রুক্ষতা এনে নিলাংসুর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
— এক জঘন্যতম মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হ, পাপিষ্ঠ!

নিলাংসু আবারও হাসলো। যেনো জীবনের প্রথম এক অতীব হাস্যকর কথা শুনলো সে। অতঃপর, সে বললো,
— তোমার স্পর্শে আজ নাহয় আরও একবার মৃত্যু হোক আমার, মাধবীলতা!
_______________________
নিলাংসু তখন গায়ের কাপড় ছাড়ছিল। মাধবী বারান্দায় বসে রইলো ঠায়। কান্না রোধ করার অবিরাম প্রচেষ্টা তার। গলার অংশটা মনে হচ্ছে, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। নিজের এত বড় সর্বনাশের কথা ভাবতেই সারা গা’তে কাঁপন সৃষ্টি হচ্ছে। আজ সম্পূর্ণ একটা দিন কেটে গেল। বাপ, মা, দাদার সাথে যোগাযোগ হয়না। বিয়ের বিষয়টা ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ গ্রামে ছড়িয়ে গেছে নিশ্চয়ই। বাপ,মাকি এই বিয়ে নিয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে আছেন? মাধবী ভাববার অবকাশ পেলো না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ও।

— মাধবীলতা?
পাশ থেকে নিলাংসুর ডাক শুনেও জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলো না মাধবী। সে তখনও স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আকাশেরর বক্ষে থাকা কলঙ্কিনী চন্দ্রের পানে।
— বাবা ডাকছেন, আমাদের বিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে। কিন্তু খবরদার, বাবার সামনে নিজের এই তেজ দেখাবে না। নাহলে কিন্তু…
— নাহলে? কি করবেন? মেরে ফেলবেন? তো মেরেই ফেলুন না। আমি কাউকে ভয় পাইনা। এমনকি মরন’কেও না। এই নরক থেকে আমার নিকট মরণই সৈ।

নিলাংসু মুচকি হাসলো। ঠোঁটের কোনে বক্র হাসি টেনে বললো,
— আমার শাস্তি কখনো মৃত্যু হয়না, মাধবীলতা। আমার শাস্তি কখনো প্রকাশ পায়না। কেউ দেখতে পায় না আমার শাস্তির ধরন। এ শাস্তি শুধুমাত্র অনুভব করা যায়। তবে, চিন্তা নেই। আমি তোমায় আমার সর্বনিম্ন শাস্তির সাথেও পরিচয় করাবো না। তুমি শাস্তির নও, ভালোবাসার যোগ্য!

মাধবী দু নয়ন আগুন হলো। উত্তপ্ত লাভা ছলকে উঠলো তার সেই মায়াবী নজরে। নারীর নজরের এ হিংস্রতা বধ করতে পারলো না নিলাংসুকে। সে মৃদু হেসে উঠে চলে এলো বারান্দা থেকে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here