এক্সিডেন্টলি প্রেম পর্ব ২৩

#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#পার্ট-২৩♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥

পিচঢালা রাস্তার পাশে রক্তাক্ত শার্টে মোড়ানো নিশান্ত খুব সাবধানেই নিজের বাহুডোরে বাচ্চাটিকে আগলে রেখে শুয়ে আছে আধভেজা ঘাসের চাদরের ওপর। এতোক্ষণে আশেপাশের মানুষেরা ঘটনার আকস্মিকতায় তাড়াহুড়ো করে যে যার স্থান ত্যাগ করে ছুটে আসতে শুরু করে দিয়েছে “এক্সিডেন্ট স্পটে!”
বাচ্চারা এতোক্ষণ খেলায় মত্ত থাকাকালীন টের না পেলেও আশেপাশের হৈচৈ শুনে মনোযোগ সরিয়ে রাস্তার ধারে তাকালো। চোখের সামনে নিজের ভাইকে রক্তে ভেজা শরীর নিয়ে আহত অবস্থায় আবিষ্কার করে হাত থেকে পড়ে গেল চকলেটের ঠোঙ্গা! নিজের ভাইয়ের এমন করুন পরিস্থিতি বড় হোক বা ছোট, কোনো বোনের পক্ষেই মেনে নেওয়াটা সহজ নয়। দুষ্কর প্রায়! নূহাও তার ব্যাতিক্রম নয়! যার দরুন নূহা ছোট্ট ছোট্ট পায়েই ঘাসের ওপর ধাপ ফেলে ছুট লাগালো। কান্না জড়িত কন্ঠে আর্তনাদ জুড়ে দিলো মুহূর্তেই,

—– “ভাইয়ায়ায়ায়ায়ায়া……!”

নূহার গলায় “ভাইয়া” বলে করা চিৎকার অন্বিতার কানের পর্দায় আঘাত হানতেই হাত ছেড়ে ভয়ার্ত চোখে সামনে তাকালো অন্বিতা। ততক্ষণে স্পটে ভীড় জমে গিয়েছে অনেকটাই। দূর থেকে বাচ্চাটিকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ রেখে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠা নিশান্তের প্রতিচ্ছবি গোলকরন্ধ্রের মাঝে ফুটে উঠতেই এক লাফে উঠে দাঁড়ালো অন্বিতা। হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগল তার। কাঁপাকাঁপা পায়েই শরীরে বিদ্যমান বাকি শক্তিটুকুর ওপর ভিত্তি করে এক ছুটে স্পটে পৌঁছল সে।

নিশান্ত বাচ্চাটিকে ছেড়ে দিয়ে উঠতে চেষ্টা করতেই চাপা আর্তনাদে লুটিয়ে পড়লো। ভার ছেড়ে দেওয়ায় মাথায় আঘাত লাগার পূর্বেই ধরে ফেললো কেউ। একই মুহুর্তে দৌড়ে পৌঁছাল নূহা। ভাইয়ের হাত ধরেই কান্না জুড়ে দিলো সে। অন্বিতার কোলে মাথা রেখেই মৃদু হাসলো নিশান্ত। অন্বিতার চোখে এই প্রথমবারের মতো জল দেখছে সে। যে মেয়েটা হাজারো প্রতিকূলতায় দিব্যি ঠোঁটে হাসি রেখে পরিস্থিতির সামাল দেয় আজ তারই এক বুক ভরা কষ্টের পাহাড় জমে গোলকরন্ধ্র কর্তৃক বয়ে চলেছে লবনাক্ত জল! নিশান্তের ইচ্ছে হলো খুব করে অন্বিতার গালে হাত রেখে বলতে যে,

—- “কাঁদবেন না প্লিজ মিস. অন্বিতা, আপনার ঠোঁটে যে হাসিটাই মানায়। কান্না? সে তো আপনার চোখে বড্ড বেশিই বেমানান!”

তবে বলা হয়ে উঠলো না তার। চোখের সামনে সবকিছু আবছা হয়ে এলো মুহুর্তেই, অন্বিতার ঝাপসা মুখটাকে স্পর্শ করে চিন্তামুক্ত থাকতে বলাও হলো না। তখন বাচ্চাটিকে বাঁচাতে যেয়ে নির্ঘাত মৃত্যুর হাতে না পড়লেও হামাগুড়ি দিয়ে পড়ার কারণে মাথায় চোট লেগেছিলো বেশ। সাথে পিঠে, পাঁজরে আঘাত লেগে কেটে গেছে বিশ্রীভাবে, যার দরুন তার পরনের সাদা শার্টটা আর সাদা রঙের বাহারে নেই মোটেই। রক্তের চাদরে সাদা রং কেটে লালবর্ণ ধারণ করেছে তার পরনের পোষাক। মাথার পেছন পাশে ক্ষতস্থান থেকেও ব্লিডিং হচ্ছে ভীষণ! তবু নিশান্তের ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি। নিজের জীবন দিয়ে হলেও অবেলায় ঝড়ে যাওয়া থেকে প্রানবন্ত শিশুটির প্রাণ তো রক্ষা করতে পারলো। মায়ের কোলের শিশু কোলে ফেরাতে তো সক্ষম হলো!

_______________________

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এসেছে প্রায়। পশ্চিমাকাশের ডুবি ডুবি রক্তলাল সূর্যটা তারই আগাম সংকেত দিয়ে চলেছে অবলীলায়। সেই সাথেই থেকে থেকে কানে ভেসে আসছে বাড়ি ফেরা পাখিদের ডাক! এই পড়ন্ত বিকেলে বিষন্ন মন নিয়ে হসপিটালের এক কোণার সিটে নূহাকে বুকে আগলে গুটিসুটি মেরে বসে আছে অন্বিতা। তাদের ঠিক সামনেই পায়চারি করে চলেছেন রফিক আহমেদ এবং আমজাদ হোসেন। ছেলের শোকে কান্নায় ভেঙে পড়ে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন আফসানা বেগম! আইসিইউ-র এই নিস্তব্ধ পরিবেশেই হঠাৎ দরজার শব্দে পলক ফেলে তাকাল সবাই।

দুজন নার্সের সাথে ভীষণ কর্কশভাবেই কথা বলতে বলতে আইসিইউ থেকে বের হলে ডক্টর শেফাউল আলম। তাকে দেখতেই একবুক ভরা বেদনাকে আশায় রূপ দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এগোলেন আমজাদ হোসেন, রফিক আহমেদ এবং আফসানা বেগম। অন্বিতা উদগ্রীব চোখে মুখ তুলে তাকালো। নূহাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপাকাঁপা পায়ে ধাপ ফেলে এগোতেই কানে এলো ডক্টরের সাথে বাকিদের সংলাপ বিনিময়,

—- ডক্টর, কেমন আছে আমার ছেলে? ওর গুরুতর কিছু হয়নি তো?

—- ডক্টর প্লিজ বলুন, চুপ করে থাকবেন না। আমার একমাত্র ছেলের কিছু হলে আমি বাঁচব না।

ডক্টর দু-হাত মেলে রফিক আহমেদ এবং আফসানা বেগমকে থামালেন। কপালে ভাঁজ ফেলে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,

—- আহা আপনারা শান্ত হন! আমায় কথা বলার সুযোগ তো দিন! আপনাদের ছেলে এখন বিপদ মুক্ত। চিন্তা করবেন না। তবে অনেক বড় ক্ষতি হতে পারতো যদি না অন্বিতা সঠিক সময় আপনাদের ছেলেকে হসপিটালে নিয়ে আসতো।

ড. শেফাউল আলমের কথায় একটু হলেও চিন্তামুক্ত হলেন সবাই। অন্বিতা আপন মনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এতোক্ষণ ধরে এক মনে আল্লাহ কে ডাকা তবে স্বার্থক হলো ভেবে আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করলো সে। নূহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,

—- দেখেছো নূহা বেবি, ভাইয়ুর কিচ্ছু হয় নি। তোমার ভাইয়া একদম ঠিক আছে! আর কান্না নয় কেমন?

নূহা অন্বিতার গলা জড়িয়ে ধরে মুখ লুকাল। ক্ষীণ গলায় বললো,

—- ভাইয়ু কে বলবানা আমি কান্না করছি ওকে? নয়তো পরে হেসে হেসে আমার মজা নেবে পঁচ্চাটা!

অন্বিতা হাসলো। নূহার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,

—- আচ্ছা বাবা ঠিক আছে বলবোনা! এবার হ্যাপি?

নূহা চোখ মুছে মিষ্টি হেসে মাথা দোলাল। আফসানা বেগম ও রফিক আহমেদ কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে অন্বিতার পানে তাকালো। চোখ সরিয়ে ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে আবারও প্রশ্ন ছুড়ল,

—- আচ্ছা আপনি কি অন্বিতাকে আগে থেকেই চিনতেন? ওর নাম জানলেন কি করে?

ড. শেফাউল আলম হেসে সম্মতি জানালেন। নার্সদের কাজ বুঝিয়ে যেতে ইশারা করে বললেন,

—- ওকে কেই বা না চিনে! মেয়েটা মানুষের জন্য যা করে তা বলা বাহুল্য! এই পর্যন্ত যেসব ভিক্টিমদের ফ্যামিলি মেম্বার কেউ সাথে ছিলো না, সাথে ছিলো এই মেয়েটি। কম করে হলেও ১০/১২ জনকে এডমিট করিয়েছিল হসপিটালে। অনেকের তো বিল মিটিয়েও দিয়েছে নিজের পকেট খালি করে। সেই সূত্রেই অন্বিতার সাথে আলাপ হয় আমার। ওর মতো মেয়ে সচারাচর কোথাও পাওয়া যায় না। সাধারণের মাঝেই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তার!
আচ্ছা আপনারা বরং একটু অপেক্ষা করুন! পেশেন্টকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আর যদি এখনই দেখা করতে চান তবে এক এক করে ঢুকবেন। পেশেন্টের ঘুমে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে খেয়াল রাখবেন।

এটুকু বলেই রফিক আহমেদের কাঁধে হাত রেখে আস্বস্ত করে পাশের কেবিনে ঢুকলেন ডক্টর আলম। আফসানা বেগম অন্বিতার মাথায় হাত বুলালেন। মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে ছেলেকে দেখবার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন দরজা ঠেলে।

একে একে সবার অচেতন নিশান্তকে দেখা হয়ে এলে এবার এলো অন্বিতার পালা। অন্বিতাকে অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আঁচলে চোখ মুছে বাহু ধরে ঝাঁকালেন আফসানা বেগম। অন্বিতা আইসিইউ-র বাহিরে দাঁড়িয়ে কপালে ঘাম মুছছিল। আফসানা বেগমের হাতের স্পর্শে চমকে ফিরে তাকালো সে। আফসানা বেগম মৃদু হেসে বললেন,

—- তুমি কি ভেতরে যাবে অন্বিতা মা?

অন্বিতা ঠোঁট কামড়ে ধরে এদিক-ওদিক তাকালো। কেনো যেনো নূহার মুখ থেকে সেই “ইটিশপিটিশ” শব্দটি নিসৃত হবার পর থেকেই আফসানা বেগম ও রফিক আহমেদের সামনে পড়লেই লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠছে তার। অন্বিতার মনে মনে ভয় হতে লাগলো, “নিশান্তের প্রতি এতোটা উইকনেস দেখে যদি উনাদের সন্দেহটা বিশ্বাসে পরিণত হয়ে যায়” ভেবেই দোটানায় পড়ে রইলো তার অসহায় নিপিড়ীত ছটফটে হৃদয়টা। আফসানা বেগম হয়তো অন্বিতার অস্বস্তিটা বুঝলেন। অভয় দেওয়ার তাগিদে কাঁধে হাত রেখে বললেন,

—- যাও মা, একটু দেখা নাহয় করেই এসো! ছেলেটার মুখটা বড্ড শুকিয়ে গেছে জানো? মা হয়ে ছেলের এই করুন পরিস্থিতি মেনে নেওয়া যে সম্ভব হচ্ছে না আমার পক্ষে। তবু আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া, যে তিনি তোমার মাধ্যমে আমার ছেলেটাকে সঠিক সকয়ে হসপিটালে পাঠালেন!

বলেই মলিনতা ভরা হাসি হেসে পাশ কাটিয়ে নূহার পাশে গিয়ে বসে পড়লেন। আফসানা বেগমকে দেখেই ঠোঁট উল্টালো নূহা। পেট চেপে ধরে মুখে কাঁদো কাঁদো ভাব এনে বললো,

—- আম্মুউউউ, পেট এমন গুড়গুড় করছে কেন?

আফসানা বেগম মেয়ের বোকা বোকা কথায় হেসে ফেললেন। নূহাকে কোলে বসিয়ে বললেন,

—- পেটে এখন ইঁদুর দৌড়োচ্ছে যে বাবুটার! চলো ইঁদুরগুলোকে শান্ত করবার ব্যবস্থা করি!

বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। মেয়ের হাত ছোট্ট ডান হাতটা ধরে চললেন ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে। অন্বিতা স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো মা-মেয়ের ভালোবাসাময় কিছু নিদর্শনের পানে। অজান্তেই নিজ মনে হাসলো সে। মায়ের কথা মনে পড়তেই বুক ভারী হয়ে এলো তার। তবে জল গড়িয়ে পড়লো না চোখ বেয়ে, শুধু বুক চিরে বেড়িয়ে এলো এক তীব্র উত্তপ্ত দীর্ঘশ্বাস!

সাদা চাদরে মোড়ানো বেডশিটের ওপর নিশান্তের নিথর দেহটা চোখে পড়তেই বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠল অন্বিতার। নিশান্তের মাথার অর্ধেকটা ব্যান্ডেজেই মোড়ানো। ব্যান্ডেজের ওপর থেকে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো এলোমেলো ভীষণ! মুখটা শুকিয়ে চুপসে গিয়েছে তার। এতোগুলা মানুষকে চিন্তায় ফেলে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে ঘুমন্ত নিশান্ত! অন্বিতার বড্ড অভিমান হলো! চেয়ার টেনে নিঃশব্দে নিশান্তের পাশে বসতে বসতে আনমনেই বলে উঠলো,

—- আপনি ভীষণ স্বার্থপর নিশান্ত! আমাদের কাঁদিয়ে কি নিশ্চিন্তেই না ঘুমোচ্ছেন আপনি! একটুও কি মায়া হচ্ছে না আমার ওপর? আপনার মা-বাবা, বোনের ওপর?

অন্বিতা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল। নিশান্তের মুখপানে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আলতো করে হাত রাখলো তার হাতের ওপর। কি হচ্ছে কেনো হচ্ছে তা জানা নেই তার! শুধু এটুকুই উপলব্ধি কর‍তে পারছে যে, মন নামক অনিয়ন্ত্রিত মেশিনটি অজান্তেই দূর্বল হয়ে পড়ছে দিনকে দিন! নিশান্তের প্রতি অদ্ভুত এক অনুভূতি এসে জমছে মনের কোণায়। না চাইতেও তাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে অবুঝ মনটা। নিশান্তের ভাবনায় ডুবে শতশত জাল বুনে চলেছে আনমনেই সেই হৃদয়! আচ্ছা আদৌ কি কোনো কানেকশন আছে তাদের মাঝে? কেনো এতোটা মায়া কাজ করে অন্বিতার? কেনো নিশান্তকে দেখে মনে হয়, সে তার বড্ড চেনা। যার সাথে কোনো কারণ ছাড়াই পাড় করে দেওয়া যায় যুগের পর যুগ, মাসের পর মাস!

________________

রাত ৯ টা বেজে ১২ কি ১৩ মিনিট,

রিভান-সানির মুখে বিষন্নতার তীব্রতর ছাপ! দম বন্ধকর পরিস্থিতিতে পিষ্ট তাদের অসহায় বিনম্র প্রাণ! আজ সন্ধ্যে বেলায়ই দুই বন্ধু হেলেদুলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিশান্তের বাসায় এসে দেখা করে তাদের জটপাকানো প্রশ্নের উত্তর খোঁজার! যেই ভাবা সেই কাজ ধার্য্য ধরেই রাত ৯ টা নাগাদ নিশান্তদের বাড়িতে পৌঁছোয় সানি-রিভান। তবে তাদের আশা নিরাশায় পরিণত করে আফসানা বেগম নিজের ছেলের সাথে ঘটে যাওয়া নির্মম দূর্বিষহ ঘটনা আওড়াতেই ধক করে উঠে দুজনের বুক! একে ওপরের দিকে গ্লানি ভরা চাহনিতে চেয়ে নিশান্তের ঘরের দিকে পা বাড়ায় তারা। হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে কিছু একটা ভাবছিল নিশান্ত। সানি-রিভানকে পেঁচার মতো মুখ বানিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,

—- এই এখন তোদের আসার সময় হলো? আরে মরে গেলে তো এতোক্ষণে মাটি দেওয়াও সারা হয়ে যেতো। ছাগল কোথাকার!

সানি-রিভান হতাশার চরম সীমায় পৌঁছে ঠোঁট উল্টালো। মুখ কালো করে নিশান্তের পাশে এসে টুপ করে বসে রিভান বললো,

—- দোস্ত তুই তো জানিস আমদের দুজনের একজনের কাছেও এই মুহুর্তে ফোন নাই! থাকলে কি আর খবর পাইতাম না বল?

রিভানের কথার রেশ টেনেই সানি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,

—- মামা তুই বিশ্বাস কর, আইজ যদি ওই কাইল্লা ডাকাইত্তগুলাক পাইতাম! ওমার প্যান্ট খুইল্লা ডুগডুগি বাজাইয়া মুতাইতাম! শালাগো জন্যে ঠিক সময়ে এতো বড় অঘটনের খবরডা পর্যন্ত পাইলাম না!

নিশান্ত মৃদু হাসল। ব্যাথায় জীর্ণ শরীরটায় জোড় খাটিয়ে সামান্য উঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসে বললো,

—- হইছে হইছে আর ডাকাতের দোষ দিতে লাগবে না। ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়! আচ্ছা সেসব কথা ছাড় আমি ঠিক আছি, এখন কিসের জন্য এই রাতে হুলোবেড়ালের মতো এসেছিস সেটা বল!

নিশান্তের প্রতিউত্তরে কিছু মনের পড়ার ভাব নিয়ে দুজনেই একসাথে লাফিয়ে উঠলো হঠাৎ! নিশান্ত গা বাঁচাতে ছিটকে সরে এলো। ঝাঁঝালো গলায় বললো,

—- তোরা মানুষ? একে তো বিপদের সময় পাশে ছিলি না আর এখন যখন বিপদ কেটে একটু সুস্থ আছি তাতেও তোদের বাঁদরামি! আরেকটু হলেই তো আহত থেকে নিহত করে ফেলছিলি “ডাটাগিলার পাঠা”!

সানি-রিভান নিজেদের বোকামির জন্য একে-অপরের মাথায় আস্তে করে চাটি বসিয়ে দিলো। রিভান মুখে সিরিয়াসনেস ফুটিয়ে বললো,

—- আসলে আমরা আসছিলাম তোর ওই ডুপ্লিকেট আয়ানার রহস্যভেদের কৌশল জানতে আরকি! মাগার এসে তো আন্টির থেকে এগ্লা শুনে সব ভুইলা গেছিলাম।

রিভানের কথায় নড়েচড়ে বসলো নিশান্ত। মাথাটা আগের মতো বালিশে হেলান দিয়ে রেখে বলল,

—- প্রথমত ওই মেয়েটা যে আয়ানা সেজে আমায় বোকা বানাবার চেষ্টায় নিয়জিত ছিলো তাকে সন্দেহ করবার উৎকৃষ্ট উদাহরণ কি ছিল জানিস? তার ফার্স্ট বলা কথাটাই!

—- ইউ মিন ওয় যে তোকে ডেকে কেমন আছিস আস্ক করলো সেটা?

—- ইয়াহ! দ্যটস হার ফার্স্ট মিসটেইক!

সানি-রিভান দুজনেই বিস্মিত চোখে একে অপরের দিকে তাকাল। সানি আহাম্মক সেজে বলল,

—- লে ভাই, এটা তো একটা নরমান কুয়েশ্চন! এটাতে আবার সন্দেহের কি দেখলি তুই?

নিশান্ত সরু চোখে তাকালো। চোখেমুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে বললো,

—- আহা, কোয়েশ্চনটা ফ্যাক্ট নয়, ফ্যাক্ট হচ্ছে মেয়েটার আমার নাম ধরে করা ডাকটা! তারও একটা গুরুতর কারণ আছে বৈ কি! আমি মেয়েটার পেট থেকে কথা বের করবার জন্য অনেক কিছুই আস্ক করেছিলাম তার পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েটা আমায় যা যা বললো তাতে স্পষ্ট ছোটবেলার তেমন কোনো ঘটনা সে ভুলে নি। সেই হিসেবে আমায় ছোটতে কি বলে ডাকতো তা ভুলে যাওয়াতো কাম্য নয় নিশ্চয়, রাইট?

সানি-রিভান একসাথে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। সানি প্রশ্নোক্ত চোখে চেয়ে বললো,

—- কি বলে ডাকতো তোরে মাইয়াডা?

নিশান্ত মৃদু হাসলো, দু-হাত ভাঁজ করে বসে বললো,

—– “রাই ভাইয়া!”

রিভানের মতো সানিও চোখ বড়বড় করে মুখ হা করলো। রিভান ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

—– রাই ভাইয়া? এ কেমন নাম!

নিশান্ত একরাশ বিরক্তি নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রিভানের কনফিউশান দূর করতে বললো,

—– আমার পুরো নাম তোদের অজানা নয়! রাইয়ান নামটা উচ্চারণ করতে বড্ড পরিশ্রম বলে মনে হতো দেখেই শর্টকাট মেরে রাই ভাইয়া বলেই ডাকতো আয়ু! আর শুধু সেটাই মেইন পয়েন্ট না। মেয়েটার কথাবার্তায় একটা লুকোচুরি ভাব ছিলো, ওর বাবা বিদেশে থাকলেও মাসে মাসে টাকা পাঠাতেন তা আমার জানা ছিলো বাট মেয়েটা সিমপ্যাথি পাবার জন্যে বলেছে যে তার বাবা তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয় না। তাছাড়া ওর যদি সব মনে থাকতো তবে এতোদিন লুকিয়ে থাকার কোনো মানে ছিলো না। আচ্ছা সেটাও মানলাম তাতেও কিন্তু পুরোপুরি মিথ্যে প্রমাণিত হয়নি সে, বাট সবথেকে বড় ধরাটা কখন খেলো জানিস?

—– কখন?

—– যখন সে আমায় তার গলার লকেটটা দেখাল। আমি কিন্তু ইচ্ছে করেই ইন্টারনেটে ইনফরমেশন দিয়েছিলাম যে আয়ুর গলায় আমার নামের ফার্স্ট লেটারের একটা লকেট ছিলো, ইনফ্যাক্ট সেই চেইনটার ছবিও দিয়েছিলাম। তবে ইচ্ছে করেই প্রতারণার ভয়ে লেটারটার ছবি দেইনি, আর তারা ধরাটা খেলো এখানেই। আমার কথামতো সেই ইনফরমেশনটাকেই বাস্তবে রূপ দিতে যেয়ে মেয়েটার গলায় ঝুলানো সেইম চেইনের “N” লেটারের একটা লকেট! বাট আয়ুকে আমি দিয়েছিলাম “R” লেটারের লকেট, আর এতোদিনে যদি সেটা হারিয়ে না গিয়েও সাথে থাকতো তবে নির্ঘাত পুরোনো হবার ছাপ পড়তো। হয় রং উঠে যেতো কিংবা মরিচা পড়ত। যেটাই হোক না কেনো। কোনো না কোনো পরিবর্তন দেখা যেতোই এটা কনফার্ম!

নিশান্তের প্রতিটি কথাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো সানি-রিভান! তার বুদ্ধিমত্তা দেখে না চাইতেও অবাক হতে বাধ্য হলো তারা। দুজনেই দু-হাতে বার কয়েক তালি বাজিয়ে রিভান বললো,

—- সাব্বাশ ব্যাটা! তোর দ্বারাই পসিবল এসব। কেম্নে পাড়িস বলতো এতোটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি নিয়ে ঘুমোতে? তোর জায়গায় আমি হইলে তো এতো না ঘাইট্টা সোজা বাড়ি নিয়ে আসতাম ওরে!

নিশান্ত অসুস্থ শরীরের ভাব জমাল। শার্টের কলার ধরে সোজা করতে করতে বললো,

—- এইজন্যেই তুই রিভান, নিশান্ত নস!
.
.
.
চলবে………………….💕

(আজ সময় পেলাম বিধায় তাড়াতাড়ি দিলাম। রাতে #নীবিড়_অনন্যার_প্রেমালাপন পেলেও পেতে পারেন!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here