এক্সেডেন্টলি প্রেম পর্ব ১

—- চোর……এই কেউ আছেন ওই চোরটাকে ধরুন, আমার ব্যাগ চুরি করে নিয়ে পাল্লাছে….!
এই চোর, দাড়া ব্যাটা আজ তোর ওপর ঠাডা পড়বে যদি আমার ব্যাগ ফের‍ত না দিস! ওই চোরের বাচ্চা থাম…….

কথাগুলো এক নাগাড়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে বলতে এক হাতে শাড়ির কুচিগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে গলির ভেতর দিয়ে দৌড়োচ্ছে অন্বিতা। উদ্দেশ্য তার ব্যাগ চুরি করে পালিয়ে যাওয়া চোরটা কে ধরে ইচ্ছেমতো ধোলাই দিয়ে ব্যাগটা ফেরত নেওয়া।

কিছুক্ষণ আগেই সে তার গান শেখানোর সমিতি থেকে বাসায় ফেরার জন্য গলির মোড়ে রিক্সার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলো। এমন সময় হাতের বাধন আলগা থাকায় চোখের পলকে একটা চোর তার ব্যাগ চুরি করে গলির ভেতরে ছুট লাগায়। গলিতে সচরাচর তেমন কোনো মানুষ থাকে না, বিধায় চোরটা সুযোগ বুঝে সেদিকেই দৌড়ে পালিয়েছে। তবে অন্বিতাও কম নয়, তাকে ধরবার জন্য জীবন বাজি রেখে একনাগাড়ে ছুটেই চলেছে।

অন্বিতার মনে হচ্ছে আজ শাড়ি পরাটা বোধহয় বড্ড বেশি ভুল হয়ে গিয়েছে। শাড়ি না পড়লে দৌড়োতে বেশ সুবিধে হতো। চোখের পলকে চোরটা কে ধরে রাম কেলানি দিয়ে ব্যাগটা ফেরত নেওয়া যেতো। কিন্তু এই শাড়ির চক্করে পড়ে তার দৌড়ানোর বেগ বাড়ার বদলে ক্রমশ কমেই আসছে। বেশি বেগে দৌড়োতে গেলেই মনে হচ্ছে এই বুঝি শাড়ি খুলে যায় যায় অবস্থা। সাথে শাড়িতে পা পেচিয়ে উল্টে পড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে বেশ। সব মিলিয়ে প্রচন্ড রকমের মাথা গরম হয়ে আসছে অন্বিতার।

চোরের থেকে আর মাত্র ৩-৪ হাত দূরে ঠিক সেই মুহুর্তেই গলির মোড়ে বাঁক নিয়ে একটি বাইক আসতে নিলেই চোরটা সুযোগ বুঝে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও রক্ষে হলো না অন্বিতার। বাইক চালক প্রথমে চোরটা কে দেখে ব্যালেন্স সামলে সাইড কেটে নিলেও অন্বিতা কে দেখে ব্রেক কষার মুহুর্তেই ঘটে গেলো সর্বনাশ। গলির এক পাশে ছিটকে পড়লো অন্বিতা।
বাইকের আঘাতে কোনো মেয়েকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে বাইক ফেলে দিয়ে, হেলমেট খুকে এক ছুটে এগিয়ে গেলো ছেলেটি তার কাছে। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে কোনো সাহায্য ছাড়াই চটজলদি উঠে পড়লো অন্বিতা। নিজের ছিলে যাওয়া হাতের কুনুই ধরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে কি না দেখে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। না, রক্তপাত সেরকম হচ্ছে না, ছিলে গিয়ে রক্ত জমেছে মাত্র। হাটুতেও বেশ আঘাত লেগেছে তবে আপাতত সেদিকে কোনো ধ্যান নেই অন্বিতার। ছেলেটা অন্বিতাকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলো,

—- সরি সরি সরি, আপনি ঠিক আছেন মিস.? আপনার তো চোট লেগেছে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে…!

ছেলেটির কথায় নিজের আঘাতপ্রাপ্ত হাতটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চোখ তুলে তাকালো অন্বিতা। বেশ লম্বা-চওড়া গড়নের, গায়ের রং ধবধবে ফর্সা, ব্রাউন সিল্কি চুলগুলোর মতো চোখে মনি, ভ্রু দুটোই ব্রাউন কালারের। থুতনিতে হাল্কা হাল্কা দাড়ি তার ওপরে ঢেউ খেলানো গোলাপি বর্ণের ঠোঁট। সাথে গায়ে জড়ানো ফোল্ড করে রাখা অফ-হোয়াইট শার্ট! মন ছুয়ে যাওয়া সেই অনিন্দিত চেহারায় চিন্তার ছাপ, ভ্রু যুগল কুঁচকে চোখে মুখে ভয়ের রেশ ফুটে উঠেছে তার। তবে এই সুদর্শন ছেলেটিকে দেখে আর ৫ টা মেয়ের মতো মুগ্ধ হবার বদলে চোখেমুখে আমর্ষ ফুটে উঠলো অন্বিতার। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঝাঁঝালো গলায় সে ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

—- শালা বিদেশি গরু, ধলা চিকা, মাথামোটা বান্দর! ধাক্কা মেরে আবার ঠিক আছি কি না জিগাইতাছোস? গাধার তিন নম্বর বাচ্চা, তোর জন্য চোরটা আমার ব্যাগ চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেলো আর আমি ধরতে পারলাম না। এখন কি করবো আমি হ্যা? ওখানে আমার সবথেকে দামী জিনিস ছিল…..!

অন্বিতার কথায় হকচকিয়ে উঠলো ছেলেটি। তার মানে একটু আগে যার সাথে এক্সিডেন্ট হতে হতে হলো না সে ছিলো একটা চোর আর যার সাথে হলো সে চোরের পেছনে ছোটা ভিক্টিম! কিন্তু তাতে অনুশোচনা হবার বদলে কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফুটে উঠলো তার। এতো বিশ্রী ভাষায় গালি তাকে জীবনে প্রথম বার কেউ দিয়েছে তাও মানা যেতো যদি দোষটা তারই হতো। কিন্তু এখানে মামলাটা পুরোটাই উল্টো, বাইক সাবধানে চালানোর সময় হুট করে তার সামনে কেউ চলে এলে এতে তো দোষ তার নয়। বরং এর থেকেও বেশি কিছু হয়ে যেতে পারতো, যদি না সে সময় মতো ব্রেক কষতে পারতো। সেই হিসেবে কোনো দোষ না করেও এতো বিশ্রী বিশ্রী গালিগালাজ তাকে হজম করতে হবে, এতো মানা যায় না। এতো অন্যায়! রীতিমতো ঘোর অন্যায়। যার দরুন বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে কর্কশ গলায় সে বললো,

—- দেখুন ভদ্র ভাষায় কথা বলুন।
আমি কোনো বিদেশি নই, আর না এই এক্সিডেন্টে আমার কোনো হাত রয়েছে। তবুও যেহেতু আমার বাইকের সাথেই দূর্ভাগ্যবশত আপনার ধাক্কা লেগেছে সেহেতু দায়ভার টা খানিকটা আমারও। আমার সাথে চলুন ড্রেসিং করিয়ে দিচ্ছি সামনের ক্লিনিক থেকে।

ছেলেটির কথার পরিপ্রেক্ষিতে, নিজের শাড়ি থেকে ধুলো ঝাঁড়া থামিয়ে দিলো অন্বিতা। রাগটা আগের থেকেও বেড়ে গেলো বোধহয় তার। দাঁতে দাঁত চেপে রাগান্বিত কন্ঠে সে বললো,

—- আরে রাখুন তো আপনার ড্রেসিং! দয়া দেখাচ্ছেন আমায়? চাইনা আপনার দয়া, আমার যা যাওয়ার তা তো চলেই গিয়েছে। আমার ব্যাগটা যে চুরি হয়ে গেলো তা কি আর ফেরাতে পারবেন?

অন্বিতার কথায় কপালের ভাঁজটা আরো খানিকটা তীব্রতর হলো ছেলেটির। ঘাড় ঘুরিয়ে উল্টো দিকে ফিরে গলির মোড় থেকে সোজা রাস্তায় চোখ বুলিয়ে নিলো সে। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত চোরের টিকিটিরও হদিস না মেলায় হতাশাগ্রস্ত কন্ঠে সে বললো,

—- দেখুন যা হবার তা হয়ে গিয়েছে, সেটা আর ফেরানো যাবে না। আর আপনি এতোটা রিয়াক্টই বা করছেন কেনো? কি এমন ছিলো ব্যাগ টায়? কত টাকা ছিলো? ওকে দেন আপনি যেহেতু বলছেন আমার জন্যই ব্যাগটা ফেরত পেলেন না তবে আমি চেষ্টা করবো তার কিছু অর্থ হলেও ফেরত দেওয়ার।

বলেই প্যান্টের পকেট থেকে তার ওয়ালেট বের করে নিজের এটিএম কার্ডটা খুঁজতে লেগে পড়লো ছেলেটি। এবার অন্বিতার মেজাজটা এতোটাই বিগড়ে গেলো যেন পারলে এক্ষুনি ছেলেটাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ছেলেটির মাথায় বারি দেওয়ার মতো কিছু একটা খুঁজার চেষ্টা করে অবশেষে ব্যর্থ হয়ে বলে উঠলো,

—- আপনার সাহস তো কম নয়, টাকা দেখাচ্ছেন আমায়! হ্যাঁ? টাকার সাথে তুলনা করছেন আমার সবথেকে প্রিয় জিনিসটাকে? আপনি জানেন তার মূল্য টাকার থেকেও বেশি?
না জেনেই টাকা দেখাচ্ছেন? আচ্ছা আপনার মাথার ঠিক কয়টা নাট ঢিলে রয়েছে বলতে পারেন?

অন্বিতার জবাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো ছেলেটি। কার্ডটা পূণরায় ওয়ালেটে রেখে শার্টের পকেট থেকে নিজের পাতলা ফ্রেমের চশমাটা চোখে লাগিয়ে সে বললো,

—- টাকার চেয়েও দামী মানে? কি এমন আছে ওতে? ওয়েট ওয়েট, এই আপনি দিনে-দুপুরে ব্যাগে করে গোল্ড ওর ডায়মন্ড নিয়ে ঘুরেন নাকি?

—- শাট আপ! আমার ব্যাগে গ্রানির বানানো স্পেশাল আমসত্ত্ব ছিলো, আমার জন্যই বানিয়েছিলো গ্রানি। আজই আমায় দিলো আর আজই চুরি হয়ে গেলো। আপনি বুঝবেন এর কষ্ট? যত্তসব ফাউল পোলাপান!

অন্বিতার কথায় এবার হতভম্ব হয়ে গেলো ছেলেটি, বিস্ময়ে চিৎকার করে সে বললো,

—- হোয়াট? সিরিয়াসলি! আমসত্ত্ব! ওহ মাই গড, প্লিজ সেইভ মি। আমি তো ভেবে বসেছিলাম কি না কি অমূল্য রত্ন ব্যাগে করে ঘুরে বেড়ান আপনি! উফফফ… আই জাস্ট কান্ট বিলিভ দিস!

কথাগুলো বলার মাঝেই কপালে হাত দিয়ে হাসতে লাগলো ছেলেটি, তার হাসির ঝংকারে মুগ্ধতায় ভরা আকর্ষণ অন্বিতাকে টানছিলো খুব করে। তবে সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে রেগেমেগে হাটু চেপে ধরেই স্থান ত্যাগ করলো অন্বিতা। সে বুঝলো এই মাথা মোটাকে বুঝিয়ে সময় অপচয় ছাড়া আর কোনো লাভই হবে না। এমনিতেই তাড়া রয়েছে, বাসার তার বাবা আর ছোট ভাইটা অপেক্ষা করছে তাই মনে মনে হাজারটা গালি গালাজ করতে করতে রওনা দিলো সে তাদের নতুন বাড়িটির উদ্দেশ্যে। অবশ্য সেটা নিজেদের বাড়ি নয়। ভাড়া বাড়ি! আজই সেখানে সিফট করেছে তারা। এই এলাকায় আজই তার প্রথম আগমন। তবে একটা দিক থেকে বেশ সুবিধে হয়েছে। আর তা হলো, অন্বিতার গান শেখানোর সমিতি থেকে তাদের নতুন বাসার দূরত্ব বেশ কম। এদিক থেকে সোজা রাস্তা ধরে একটু বাঁক নিয়ে ১০ মিনিট হাটলেই পৌঁছে যাওয়া যায় সহজেই।

অন্বিতা যেতেই হুশ হলো ছেলেটির। হাসি থামিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই বেশ খানিকটা দূরে অন্বিতার শাড়ির হাল্কা নীল আঁচলটা হাওয়ায় উড়তে দেখায় সে বুঝলো মেয়েটি রাগ করে আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পায়েই হাটা ধরেছে। তার যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আনমনেই সে বলে উঠলো,

—- হাও স্ট্রেইঞ্জ!

তার ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে কেউ ছাড়া গলায় ডেকে উঠলো,

—- নিশান্ত…..! ওই এদিকে তাকা……নিশান্ত….

নিজের নাম কানে পৌঁছাতেই ভ্রু কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকালো সে। সানি দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো,

—- তুই এখানে কি করোস? আর ওই মাইয়াটা কে ছিলো রে?

নিশান্ত সানির মাথায় হাল্কা করে টোকা মেরে দিয়ে বললো,

—- লাইব্রেরি যাচ্ছিলাম, আর মেয়েটা মেইবি কোনো পাগল টাগল হবে!

নিশান্তের কথায় অবাক হলো সানি। ঠোঁট উল্টে সে বলে উঠলো,

—- কি বলিস? এতো সুন্দর ফিগারের একটা মাইয়া পাগল? কাহিনী কি মামা বলতো?

সানির কথায় মুচকি হাসলো নিশান্ত। বাইকটা রাস্তা থেকে টেনে তুলে সানিকে পেছনে বসতে ইশারা করে সে বললো,

—- যেতে যেতে বলবো। আয় উঠে পড়।
.
.
.
চলবে………………🌿

#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#সূচনা_পর্ব♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here