এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -০১+২+৪

-স্টুডেন্টের মা বাবার বিবাহ বার্ষিকীতে এসে খাবার চুরি করার মতো নিচ কাজ করতে এতোটুকো লজ্জা করলো না তোমার দোয়া?কিভাবে করলে তুমি এটা?আমাকে বললেই পারতে,বেচে যাওয়া সব খাবার দান করে দিতাম তোমাকে।তুমি গরিব তা জানতাম,এতোটা ছোটলোক জানলে কোনোদিনও আমার মেয়েকে তোমার মতো কারো কাছে পড়তে দিতাম না!লজ্জা করছে না তোমার এখনো,এখানে,এভাবে দাড়িয়ে থাকতে?নাকি অপমানিতো হওয়া থেকে পালানোর মতো আর এতোটুকো আত্মসম্মানও অবশিষ্ট নেই?

বাসাভর্তি মানুষের সামনে এতোবড় ঘৃন্য অপবাদে অপমানিত হওয়ার চেয়ে মৃত্যুকে বেশি সুখের মনে হলো দোয়ার।চোখজোড়া দিয়ে অঝরে অশ্রু গড়াতে লাগলো।নিস্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো এতোগুলো তীক্ষ্ম শব্দবান ছোড়া মহিলার দিকে।চোখ দিয়ে যেনো অগ্নি ঝরছে তার।জলভরা চোখে আশেপাশের সবার ঘৃনা আর অবজ্ঞার দৃষ্টিকে দেখে নিলো ও একবার।পাশেই হাত আটকে রাখা বাচ্চা মেয়েটা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,

-মম,দোয়া মিস খাবার কেনো চুরি করবে?উনি না খেয়ে চলে যাবেন বলে ওনাকে খাবার তো আমিই প্যাক করে দিচ্ছিলাম।বকছো কেনো তুমি মিসকে?

-এই রোতি!একদম মুখে মুখে তর্ক করবে না বুঝলে?চুপ!একদম চুপ!

-না চুপ করবো না!একদম পচা মম তুমি।খালি বকো!আমাকেও বকো,দোয়া মিসকেও বকো!দোয়া মিস কষ্ট পাচ্ছে মম।কাদছে দেখো?ছাড়ো!ছাড়ো আমার হাত!ছাড়ো!

বাচ্চা মেয়েটার ওমন কথাতেও ওর আম্মুর কোনো হেরফের নেই।একটা শুকনো ঢোক গিললো দোয়া।ডানহাতের তালুতে গালটা মুছে,জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললো,

-মমের সাথে এভাবে কথা বলতে নেই রোতি।দোয়া মিস একদমই কষ্ট পায়নি।এই‌ দেখো,আর কাদছে না মিস।তুমি….তুমি আন্টির সাথে আর কোনোদিন এভাবে কথা বলবে না ওকে?

রোতি গাল ফুলিয়ে হাত ছাড়াতে ব্যস্ত।ওর মাকে বারবার হাত ছাড়ার কথার বলছে।ওর মা বেশ কটুগলায় বলতে লাগলো,

-এইসব কথাও এই মিস শিখিয়েছে তোমাকে তাইনা?তাইতো বলি,কয়েকদিন যাবত মমকে এতো কথা শুনাচ্ছিলে কেনো তুমি!পাপা আসুক কনফারেন্স শেষ করে,তোমার এই সব শিক্ষার আজ ইতি টানবো।এই দোয়া মিস কাল থেকে আর পড়াতে আসবে না তোমাকে।শোনো দোয়া,আমার মেয়েকে চৌর্যবৃত্তি শেখানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই!তুমি আর রোতিকে পড়াতে আসবে না কাল থেকে!এই মুহুর্তে বেরিয়ে যাও আমার বাসা থেকে!গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার!

রোতির সামনে হাটুগেরে বসলো দোয়া।ওর গাল ধরতে যাবে,ওর মা সরিয়ে নিলো ওকে।দোয়া নরম গলায় রোতিকে বললো,

-দোয়া মিস লাভস্ ইউ আ লট রোতি।এন্ড শি ইজ গোয়ানা মিস ইউ আ‌ লট!

-হয়েছে হয়েছে।অনেক নাটক করেছো!এবার বেরিয়ে যাও!আমার বাসায় চোরের কোনো স্থান নেই!

রোতির আম্মুর কথায় নিজেকে শক্ত করে আরেকবার চারপাশে তাকালো দোয়া।এতোক্ষন শুধু শুনছিলো।এবার ওর জবাব দেবার পালা।চোখ বন্ধ একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করলো,

-আপনার বাসায় আসার নুন্যতম ইচ্ছা ছিলো না আমার।কোনোদিনই থাকে না,কারনটা শুরুতে আপনার ব্যবহার ছিলো,আর দুদিন আগে থেকে আপনার ছোট ভাইয়ের বাজে চাওনি।নতুন টিউশনির খোজ করছি আমি।এটা ছেড়ে দেওয়ার আগে রোতির একমাত্র আবদার,আজকে আপনাদের বিবাহবার্ষিকীতে যেনো আমি থাকি।দাওয়াত নামের আপনার এই‌ অপমানজগতে আজকে রোতির জন্যই আসা।কিন্তু এখানেও,আপনার ছোটভাইয়ের বাজে দৃষ্টি এড়াতে পারলাম না।আর আজকে তো উনি অসভ্যতার সব সীমাই পার করে দিয়েছেন।

এটুকো বলে দোয়া কিছুটা দুরে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা রোতির মামার দিকে তাকালো।মানুষটা গালে হাত বুলাচ্ছে।কিছুক্ষন আগে কুপ্রস্তাব দেওয়ার জন্য দোয়া চড় মেরেছে তাকে।রোতির আম্মু ফুসে উঠে বললো,

-খবরদার দোয়া!আমার ভাইকে নিয়ে একটা বাজে কথা বলেছো তো!

-আপনার ভাই বাজে কাজ করতে পারবে,আর আমি তা বলতে পারবো না সে ভুল ধারনা থেকে বেরিয়ে আসুন আন্টি।আর শুধু বলা কেনো,আমি তো তার প্রাপ্য সাজাটাও দিয়ে দিয়েছি।আর এজন্যই আপনার এতো রাগ হচ্ছে তাইনা আন্টি?এজন্যই এভাবে মিথ্যে অপবাদে অপমান করছেন আমাকে,তাইনা?

-মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ দোয়া!

তার কথাকে পাত্তা দিলো না দোয়া।বললো,

-আপনাদের মোমেন্টটা নষ্ট করবো না বলে চুপচাপ বেরিয়ে যাচ্ছিলাম আন্টি।কিন্তু রোতি আটকে দিলো।আমি নিতে চাইনি খাবার,ওই‌ জোর করে খাবার প্যাক করে দিচ্ছিলো আমাকে।কিন্তু আপনার এই রিয়্যাক্ট।আমি বেশ বুঝতে পারছি,সবটা জেনেবুঝেই এমনটা করলেন আপনি।নিজের ভাইকে কিছু না বলে উল্টো আমাকেই….

-দোয়া!

-চিৎকার করলে সত্যিটা বদলাবে না আন্টি।আপনার ভাইকে তো সবার সামনে সাজা দেইনি,তবে আপনার ব্যবহারে এই‌ তিক্ত কথাগুলো সবার সামনে বলতে বাধ্য হলাম।যাইহোক,আমাকে আরো কড়া কথা বলতে বাধ্য করবেন না প্লিজ।আজকের এই ব্যবহারে,আপনার আর আপনার ভাইয়ের মতো কুলষ মনোভাববিশিষ্ট মানুষের সাথে সাক্ষাৎলাভের ইচ্ছা আমার শেষ।তাই শেষবারের সাক্ষাতকারে আরো ঝামেলা হোক,সেটা আমি চাইছি না।চলে যাচ্ছি।ভালো থাকবেন।

একশ্বাসে কথাগুলো বলে বেরিয়ে আসার জন্য পা বারালো দোয়া।শুনতে পেলো,পিছনে হুহু করে কেদে চলেছে রোতি।দুর্বলতাটা দেখানো যাবে না এই মুহুর্তে।খুব কষ্টে নিজেকে‌ সামলে আর একবিন্দু দেরি না করে বেরিয়ে এলো জাকজমকপুর্নভাবে সাজানো দ্বিতল ভবনটা থেকে।

.

-স্যার?জারা ম্যাম আপনার সাথে কথা বলতে চায়।ফোন করেছিলো আমাকে।

হ্যান্ডগ্লাভস্ খুলতে খুলতে ল্যাব থেকে বেরোচ্ছিলো আরাব।এসিসটেন্টের কাছে জারার নাম শুনে মাথা না তুলে বিরক্তিমিশ্রিত কন্ঠে বললো,

-তোমাকে বলেছিলাম নিরব,ওর নম্বরটা ব্লক করতে।

-স্যার,এ নিয়ে চারটে সিম পাল্টালাম।

আরাব মাথা তুললো।নিরব এবার চোখ নামিয়ে নিলো।একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ছেড়ে আরাব বললো,

-লিভ ইট।আজকের রিসার্চগুলোর সব ফাইল আমি বাসায় নিয়ে যাবো।আরো ডিপ স্টাডি দরকার।নেক্সট কয়েকদিন ল্যাবে আসতে পারবো না।তুমি এদিকটা হ্যান্ডেল করতে পারবে তো?

নিরব মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো।নিজের কেবিনে ঢুকে এপ্রোন,মাস্ক ছেড়ে গায়ের সাদা গেন্জিটার উপর হুডিওয়ালা জ্যাকেট পরে নিলো আরাব।ব্যাগটা কাধে বাঝিয়ে চাবির গোছা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বেরিয়ে এলো রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর ভেতর থেকে।

.

রাত নেমে এসেছে শহরের বুকে।ল্যাম্পপোস্টের আলোতে‌ রাস্তা উজ্জল।ফুটপাত দিয়ে হাটছে দোয়া।চোখের পানি থামছেই না।একবার শাড়িটার আচলে‌ চোখ‌ মুছছে,তো আবারো গাল বেয়ে পানি গরাচ্ছে।মা আর ছোট ভাইটার মুখে কাল থেকে কিভাবে খাবার তুলে দেবে,সে চিন্তায় বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে ওর নিজেকে।চিৎকার করে কাদতে পারলে যেনো শান্তি লাগতো।তবুও সামলাতে হচ্ছে নিজেকে।আর তাতে শুধু কষ্টটা কয়েকগুন হচ্ছে।

হুট করেই‌ দুটো কুকুর এসে‌ দোয়ার সামনে দাড়িয়ে শব্দ করতে লাগলো।ঘাবড়ে গেলো ও কিছুটা।রিকশা করে যাওয়ার‌ সামর্থ্য ওর‌ নেই।অভিভাবক বলতে বাড়িওয়ালা কাকাবাবুকে বলে এসেছিলো রাত দশটার দিকে যেনো তার সাইকেলে করে রোতিদের বাসা থেকে নিয়ে যায় ওকে।কিন্তু দশটা বাজতে এখনো অনেকটা সময় বাকি।আগেই বেরিয়ে এসেছে দোয়া।আশেপাশে তাকালো দোয়া।মেইনরোড পার করে এসেছে।দুটো মোর নিলেই বাসার সামনের রাস্তাটা।এর আগেও এ রাস্তায় রাতে দুবার চলাফেরা করেছে।তবে সেটা অরুনাভ দাশের সাথেই।আজকের অপমান আর জীবিকার উৎসের চিন্তা,বাকিসব ভুলিয়ে দিয়েছে ওকে।একাই হাটা লাগিয়েছে আজ।

কুকুরগুলো দেখে দোয়া ভয় পেয়েছে খানিকটা।তারপরই ওর মনে হলো,এরা মানুষ নামক পশুর চেয়ে ভালো।পাশ কাটিয়ে চলে আসতে যাবে,আচমকাই একটা বাইক বেশ অনেকটা বেগে এসে একদম সামনে পরলো দোয়ার।কুকুরদুটো দৌড়ে পালালো তৎক্ষনাৎ।হেলমেট পরিহিত মালিক বাইকের নিচে পরে কাতরাচ্ছে।দোয়া শ্বাস আটকে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষন।এভাবে চোখের সামনে অঘটন ঘটতে দেখে কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্র যেনো অচল হয়ে পরেছে ওর।

-হেল্প!

আর্তনাত শুনে মুঠো থেকে আচল ছেড়ে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলো দোয়া।মানুষটা পরনে সাদা গেন্জির উপর কালো জ্যাকেট,পায়ে কেডস্।পেছনে ব্যাগটা অনেকটা দুরে গিয়ে পরেছে।বাইকটা ধরে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করলো দোয়া।লোকটা নিজেও চেষ্টা করছে সরানোর।পায়ের উপরদিক হতে বাইকটা খানিকটা সরে যেতেই লোকটার বুকপকেট থেকে আইডি কার্ডের মতো কিছু পায়ের কাছে এসে পরলো দোয়ার।কার্ডটায় চোখ বুলালো ও।ওতে লেখা,ডক্টর তাহ্সানুল আরাব,এক্সপেরিমেন্ট স্পেশালিস্ট,বায়োমেডি রিসার্চ ইনস্টিটিউট।”সাইন্টিস্ট” আর “বায়োমেডি রিসার্চ ইনস্টিটিউট”শব্দদুটো স্পষ্টতর হতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো দোয়ার।কার্ডটা ফেলে উল্টোদিকে হাটা লাগালো ও।দোয়ার চেহারা বোঝা যাচ্ছিলো না।কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে একজন উল্টোপথে চলে যাচ্ছে,বিষয়টা বেশ বুঝলো আরাব।খানিকটা চেচিয়ে বললো,

-আরে?যাচ্ছেন কোথায়?হেল্প তো করুন?

পেছন ফেরিনি দোয়া।এই বায়োমেডি ওর জীবনকে অন্ধকারে ছুড়ে ফেলেছিলো একদিন।এই সাইন্টিস্ট পদবিটার জন্যই একদিন সব শেষ হয়ে গুয়েছিলো ওর।এই পদবির জন্যই ওর জীবন আজও বিষময়!বড়বড় পা ফেলে,আরাবকে ওভাবেই রেখে,চলে আসলো ওখান থেকে।

সকালের রোদটা সোজা চোখে এসে পরায় পিটপিট করে তাকালো আরাব।মাথাটা প্রচন্ড ভারি অনুভব হচ্ছে ওর।উপরের রঙচটা ছাদটা দেখে বুঝলো,কোথাও শুয়ে আছে ও।অন্য কোনোদিক না তাকিয়ে,উজ্জল আলোর উৎস অনুসরন করতে আলো বরাবরই তাকালো।সেখানে শুরুতেই আবিষ্কার করলো পা বরাবর একদম মেঝে থেকে বেশ বড়সর এক জানালা।ভোরের আলোর উৎস।ব্যস্ত শহরের বুকে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে ঢুকে পরা কিঞ্চিত শিশিরভেজা ঝকঝকে আলো!রঙ উঠে যাওয়া ভেতরের দেয়ালগুলোর জন্য বাইরের আলো,মৃদ্যু হিমেল হাওয়ায় সবুজ নারিকেল পাতার দোল খাওয়ার দৃশ্য,সবটাই চমকপ্রদভাবে জানালায় দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো।কিন্তু হয়তো আলোর উৎস হিসেবে এই বেরঙ চিলেকোঠার সুবিশাল জানালাটা একা ছিলো না।

ধবধবে সাদা ওড়না গায়ে জরিয়ে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে রয়েছে কেউ।কোনো মেয়ে।গায়ে সাদা রঙেরই সালোয়ার কামিজ।আরাবের একবার মনে হলো,সে শুভ্রতাকে পাশ কাটিয়ে আসতেই হয়তো ভোরের রোদ এতো বেশি ঝলমলে হয়ে উঠেছে।লম্বা জানালার রডগুলোর একটা ডানহাতে মুঠো করে রয়েছে মেয়েটা।চোখদুটো একটু ডলে দৃষ্টিস্থির রেখে উঠে বসতে যাচ্ছিলো আরাব।উঠতে গিয়ে হাতে পায়ের ক্ষতগুলোতে টান লাগাতে চোখমুখ কুচকেও নিলো বারদুয়েক।তবুও কোনোমতে উঠে বসে চোখজোড়া আটকালো সে জানালায়,মেয়েটির দিকে।

চেহারা দেখা যাচ্ছে না।বসে থাকার দরুন,মাটি ছুইছুই চুলগুলো,চেহারাসহ দেহের প্রায় পুরোটাই ঢেকে দিয়েছে তার।কোকড়া চুল কখনো এতোবড় হয়,তা হয়তো প্রথমবার দেখলো আরাব।ওর আপুরও তো চুল কোকড়া,কিন্তু তা তো ঘাড় থেকেই নামেনি।অবশ্য এ চুলগুলোকে কোকড়া বলাটা ভুলই হবে।এদের ঢেউ খেলানো বললে বেশি মানানসই হবে।সাদা ওড়নার বেশ অনেকটা মেঝেতে ছড়িয়ে।বা হাতটা দিয়ে হাটু জরিয়ে বসে আছে মেয়েটা।অচেনা অজানা এই মেয়েটার চেহারা ঢেকে রাখা চুলগুলোকে নিজহাতে সরিয়ে দেওয়ার এক অদম্য ইচ্ছা হলো আরাবের।তৎক্ষনাৎ আওয়াজ‌ এলো,

-উঠে পরেছো তুমি?

অরুনাভ দাশের গলা শুনে‌ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আরাব।একজন বেশ স্বাস্থ্যবান লোক।মাথার টাকটার সাথে ভুড়িটা মানানসই।চঞ্চলতার সাথে উন্মুক্ত গায়ের পানি মুছতে ব্যস্ত তিনি।চেহারায় গম্ভীরতা নেই একদমই।মেয়েটার দিকে আরেকপলক তাকিয়ে আরাব প্রশ্ন ছুড়লো ভদ্রলোককে,

-জ্বী।আমি…কোথায়?

-পৃথিবীতেই আছো।নাকি ঘরটা সগ্গের মতো দেখাচ্ছে?

মাথা মুছে গামছাটা দড়িতে ছড়িয়ে দিতে দিতে কথাগুলো বললেন অরুনাভ দাশ।ধুতি আর গেন্জি ছিলোই গায়ে,এবার কাধে ঝুলানো সুতাটা টেনে ফতুয়াটা পরে নিলেন।তারপর কি মনে করে হন্তদন্ত হয়ে আবারো বেরিয়ে গেলেন।এককোনে বসে থাকা মেয়েটাকে লোকটা লক্ষ্যই করলো না দেখে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো আরাব।মেয়েটার দিকে তাকালো।আস্তেধীরে একটু ঘুরে বসতে যেতেই ব্যথায় কুকড়ে উঠলো ও।আবারো টান পরেছে কোমড়ের দিকে কোনো ক্ষততে।

নিজের উন্মুক্ত বুকের দিকে তাকালো আরাব।ফর্সা শরীরের মধ্যে রক্তজমা কালোদাগের ছোপ,কাটাছেড়ার অভাব নেই।কপালের বা দিকটা ব্যথায় টনটন করছে।আঙ্গুল ছুইয়ে বুঝলো সেখানে ব্যান্ডেজ দেওয়া।নিচের ঠোটেও ব্যথা।কেটে গেছে সেদিকটাও।আগের রাতের ঘটনার কথা মনে পরলো ওর।প্রথমে বাইক এক্সিডেন্ট,তারপর ওই‌ লোকগুলোর এসে ওর এক্সপেরিমেন্টের পেপার চুরি করে নিয়ে যাওয়া।সবটা ভেবে একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো ও।

আরাবের সে মৃদ্যু আর্তনাত শুনেই ততক্ষনে ধরফরিয়ে উঠে বসেছে দোয়া।নিজের অবস্থান পর্যবেক্ষন করলো।ওড়না যদিও ঠিকই ছিলো,তবুও টেনেটুনে আরেকটু ঠিক করে আস্তে করে উঠে দাড়ালো।ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।কিন্তু অরুনাভ দাশের কথার নড়চড় করার ইচ্ছা ছিলো না ওর এবারও।মাথা নিচু করে মনেমনে শুধু দোষারোপ করতে লাগলে নিজেকে।এ ঘরে এভাবে ঘুমিয়ে পরাটা,প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো ওর এটা ভেবে।অবশ্য ঘুমেরই বা কি দোষ?মাঝরাত অবদি পড়া শেষ করে,কাথা সেলাইয়ের কাজে বাকি অর্ধেক রাতের ঘুমকে বিসর্জন দিতেই হয় প্রতিরাতে।দুটো টাকা বাড়তি উপার্জনের জন্য।কিন্তু গতরাতে কোনোটাই হয়নি ওর।কিছু অন্ধকার অতীতের হানায় কাদতে কাদতে বারান্দাতেই ঘুমিয়ে পরেছিলো ও।

বাড়িতে ফিরে আরাবকে ফেলে আসার অপরাধবোধে অস্থির হয়ে উঠেছিলো দোয়া।তাই ওকে সাহায্য করার জন্য অরুনাভ দাশকে পাঠিয়ে দেয়।সে নাকি গিয়ে দেখে কিছু লোককে আরাব মারধর করছিলো।সে পৌছানোর আগেই একজন এসে নাকি পেছন থেকে আরাবের মাথায় বারি মারে।কিছু কাগজপত্র নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে লোকগুলো,আর অজ্ঞান হয়ে পরে ছিলো আরাব।তাই বাধ্য হয়ে ওকে বাড়িতেই নিয়ে আসেন অরুনাভ দাশ।

ভোরের দিকে নিচতলা থেকে অরুনাভ দাশের আওয়াজ পেলো দোয়া।ওকেই ডাকছিলেন উনি।চোখটা ডলে বুঝলো তখনো ভোরের আবছা অন্ধকারে চারপাশ ঢাকা,পুরোপুরি সকাল হয়নি।অরুনাভ দাশ তখন পুজোর কাজে বাইরে যাচ্ছিলেন।আরাবের জ্বর ছিলো।তাই দোয়াকে ডেকে জলপট্টি দিতে বলেছিলেন উনি।প্রথমবারের মতো তার কোনো কাজ না করার মনোভাব ছিলো দোয়ার মাঝে।কিন্তু পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতা কোনোভাবেই চায়নি ও।অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাই আরাবের মাথায় জলপট্টি দিতে এসেছিলো দোয়া।অরুনাভ দাশ না ফেরা অবদি দোয়াকে আরাবের কাছেই থাকতে বলেছিলেন।সেটাও অমান্য করে নি ও।আরাবের জ্বরটা কমে আসতে দেখে জানালার ধারে গিয়ে বসে গিয়েছিলো।এরইমাঝে চোখ কখন লেগে গেছে,টেরই পায়নি।সরে দাড়াতে গিয়ে কাঠের জানালায় দোয়ার কনুই লেগে খট করে শব্দ হলো।

আরাব চিন্তাজগত থেকে বেরোলো।পারিপার্শিক উপেক্ষা করে অপলক দৃষ্টিতে দোয়ার দিকে তাকিয়ে ও।মেয়েটা ঘুম ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে গেছে।পুরো চেহারা এখন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তার।অসম্ভব মায়াজড়ানো মুখটা।গায়ের রঙটা একটু চাপা।ফর্সা না বললেও,উজ্জল শ্যামবর্নের বলাই চলে।ভ্রু,ঘন পাপড়ির সে নামিয়ে রাখা চোখজোড়া দেখে মন আওয়াড়ে বাধ্য,মাশাল্লাহ্!হাত,পা,নাক,গলা বা কান,কোথাও গয়নার ছিটেফোটাও নেই।কাচা ঘুমভাঙা চেহারাটায় আকস্মিকতার ছাপ।কপালের সামনে আসা কিছু চুল কানে গুজে দিয়ে মাথা নিচু করে রেখে সমানে হাত কচলাচ্ছে।এমন ভাব,যেনো কতোবড় অপরাধে অপরাধী সে!আরাব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললো,

-কাল রাতে আপনার সামনেই কি আমার বাইকটার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো?

…..

-এটা কোন জায়গা?

……

-আমার জন্য আপনাদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাইনা?আ্…আ’ম সরি।আসলে কালরাতে ওভাবে লোকগুলো পেছন থেকে এটাক করবে বুঝতে পারিনি।

দোয়া চুপ করেই রইলো।ওর চেহারায় রাগের আভাস খুজে পেলো আরাব।যেটা দেখে মনেমনে আহত অনুভব করলো ও।পরপরই ভাবলো মেয়েটার রাগ অস্বাভাবিক না।রাগ করারই কথা।একজন অচেনা,অজানা মানুষকে এভাবে ঘাড়ে চাপতে দেখলে যে কারো রাগই হবে।তাই আর কিছু বললো না ও।অরুনাভ দাশ ঘরে ঢুকলেন।ঠোটে বড়সর হাসি টেনে এগিয়ে এসে খাটে বসে বললেন,

-কি অবস্থা?এখন কেমন অনুভব করছো?

-জ্বী।বেটার।আপনি…

-আমি অরুনাভ দাশ,পেশায় নাড়িটেপা ডাক্তারই বলা চলে।আর এ জায়গার নাম রায়নগর।কালকে রাস্তায় তো তোমার বাইকটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে তুমি।হাতেপায়েও বেশ অনেকজায়গায় স্ক্র্যাচ আছে দেখো।যেহেতু অতো রাতে কোনো ডাক্তারখানা খোলা পাবো না,আবার তোমাকে ওভাবে রাস্তায়ও ফেলে আসা সম্ভব না,আমার বাড়িটাও কাছেই,আর ভগবানের কৃপায়,আমিও একটাইপ ডাক্তার কিনা,তাই এখানেই নিয়ে আসলাম তোমাকে।আপাতত তুমি আমার এই ছোটখাটো চিলেকোঠায়।

লোকটা বিশুদ্ধ হিন্দু,ওনাকে দেখেই তা বুঝেছিলো আরাব।আর ঘটনাও তেমনটাই,যেমনটা ও আন্দাজ করেছিলো।দোয়ার পরিচয়ের প্রতি কৌতুহল নিয়ে আরো একবার দোয়ার দিকে তাকালো ও। আগের মতোই নিচদিক তাকিয়ে দোয়া।ওর ভাবনাজুড়ে আপাতত অন্যকিছুই বিচরন করছে।দোয়ার দিকে আরাবের চাওনি চোখ এড়ায়নি অরুনাভ দাশের।উনি গলা ঝেরে চশমাটা মুছতে মুছতে বললেন,

-ও দোয়া।শেষরাতের জ্বরটায় আমার ওষুধ কাজে দেয়নি,ওর‌ জলপট্টিতে কমেছে।বলতে পারো একপ্রকার ওর জন্যই বেচে গেছো তুমি।ওই তো প্রথম দেখেছিলো তোমাকে।

দোয়া!নামটা মনেমনে দুবার আওড়ালো আরাব।এই মেয়েটাই কি ওকে প্রথম দেখেছিলো?ওই মেয়েটার মুখ দেখেনি আরাব।সে তো শাড়ি পরা ছিলো।আর যদি এই মেয়েই হয়,ওকে বাচাবেই,তবে ওভাবে চলে গিয়েছিলো কেনো তখন?যাইহোক,এই দোয়া,দোয়া হয়েই ওর জীবনে এসেছে।বাচিয়ে নিয়েছে ওকে।কৃতজ্ঞতার চোখে দোয়ার দিকে তাকালো আরাব।কিন্তু সে নিরব।কোনো কারনে যেনো আরাবের উপর রেগে আছে ও এমন মনে হচ্ছে দেখে।ওর অপরাধবোধ হচ্ছে,সেটা বুঝেও দোয়া কোনো সৌজন্যতা দেখাচ্ছে না,এটা ভেবে আরাবেরও রাগ হলো কিছুটা।দোয়ার‌ দিকে তাকিয়ে এবার খানিকটা শক্ত কন্ঠে বললো,

-আ’ম এক্সট্রেমলি সরি।আপনাদেরকে ঝামেলায় ফেলার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।কাল বাইকটা এক্সিডেন্টের পর আপনারা আমাকে…যাইহোক,আপনাদেরকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য আবারো দুঃখিত।

আরাবের গলার স্বর বুঝে দোয়ার দিকে তাকালেন অরুনাভ দাশ।দোয়ার প্রতি তার লব্ধজ্ঞান বলছে,ছেলেটার সাথে সৌজন্যমুলক কোনো কথাই বলেনি ও।ওর আচরনেই এরকমভাবে কথা বলছে ছেলেটা।কে বলবে,কালরাতে এই মেয়েই ছেলেটাকে সবরকমভাবে বাচানোর জন্য অস্থির হয়ে পরেছিলো।আর এখন সামনাসামনি এমন চুপ করে আছে।মেয়েটার এই চাপা স্বভাব কবে যাবে,কিভাবে যাবে ভেবে ছোট একটা শ্বাস ফেললেন উনি।তারপর আবারো হাসি দিয়ে বললেন,

-আরে না!কিসের ঝামেলা বলো তো?তোমার জায়গায় যে কেউ থাকলেই এমনটাই করতাম আমরা।তাছাড়া তুমি আমাদের জায়গায় থাকলে কি করতে বলোতো?অবশ্যই এক্সিডেন্টে তীব্র ব্যথায় কাতরাতে থাকা কাউকে ওভাবেই রাস্তায় ফেলে যেতে না তাইনা?

-তবুও।আমাকে এখানে এনে…

-ছাড়ো তো ওসব কথা!এবার বলো,কি নাম তোমার?বাসা কোথায়?

-আমি তাহ্সানুল আরাব।বাসা ঢাকাতেই।

-বাহ্!তা আরাব?তোমার বাবার নাম?

-তৌফিক ওয়াহিদ।

অরুনাভ দাশের চেহারায় বিস্ময়।বড়বড় চোখ করে,ঠোটজোড়া খানিকটা ফাকা রেখে বললেন,

-তুমি কি ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট তৌফিক ওয়াহিদের কথা বলছো?

-জ্বী।

অরুনাভ দাশ একটু থেমে হেসে বললেন,

-আরে!তুমি ওনার ছেলে?আগে বলবে তো!শহরের এতোবড় নামকরা শিল্পপতির ছেলে তুমি।তাছাড়া উনি মানুষ হিসেবেই অনেক ভালোমানুষ।উনি তো…

মাথা নিচু করে মৃদ্যু হাসছিলো আরাব।বাবার পরিচয়টা দিলে এভাবেই প্রতিক্রিয়া হয় সবখানে।যেটা ওর মোটেও পছন্দ না।এই শিল্পপতির ছেলে পরিচয়ে সাধারনের মাঝে একঘরে হয়ে যাওয়ার চেয়ে,আর পাঁচটা খেটে খাওয়া মানুষগুলোর স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনই ভালো।অরুনাভ দাশের কথা শেষ হওয়ার আগেই ডাক শোনা গেলো,

-আপুনি?আপুনি?কই তুই?

কোনো অল্পবয়সের ছেলের গলা।দরজা দিয়ে বাইরে তাকালো আরাব।এতোক্ষনে মাথা তুলে বাইরে তাকালো দোয়াও।অরুনাভ দাশ বললেন,

-ওইযে,ডাক পরেছে তোর!একমুহুর্তও চোখের আড়াল হতে দেয়না!এই দিয়ানটা কি তোকে ছাড়া কিছুই করতে পারে না দোয়া?

-আমিই তো ওর সব কাকাবাবু।

দোয়ার স্পষ্ট জবাব।গলার স্বর শুনে আরাব তাকালো ওর দিকে।চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের।টানাটানা চোখজোড়ার চাওনি যেনো আরাবের ভেতরটায় দমকা হাওয়ার মতো ঝাড়া দিয়ে গেলো।চোখ সরিয়ে নিলো দোয়া।আর কপাল কুচকে আসলো আরাবের।এই মেয়েটার ওর প্রতি কেয়ারিং,আবার স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠা রাগ,চোখে চোখ রেখে কথা বলা কিংবা চোখ সরিয়ে নেওয়া সবকিছুতে আলাদা ভাব খুজে পাচ্ছে ও।সবটা যেনো কোনো ধোয়াশা,অস্বাভাবিকতার মধ্য‌ দিয়ে যাচ্ছে।দোয়া দুপা এগিয়ে সরু গলায় বললো,

-আমি এখন আসি কাকাবাবু।ছোটু ডাকছে।এ সকালে এখনো অবদি চুলো জ্বলেনি।

-আচ্ছা আয়।আর শোন,আজকে চারতলায় নিমন্ত্রন আছে আমার।দুপুরে আর আমার জন্য তুই রান্না করিস না।তবে আরেকটাকাজ করিস,আজকে তোর সমরেশ কাকু মাছ দিতে আসলে,শিং মাছ নিয়ে রাখিস কেজি দুয়েক।ওটারই ঝোল করবি।এই ছেলের অনেক ব্লাড লস হয়েছে কালকের এক্সিডেন্টে।শিং মাছ খাওয়াবি একে।তুমি শিং মাছ খাও তো আরাব?আমাদের দোয়ার হাতের রান্না কিন্তু অনেক ডেলিশিয়াস!

একপলক আরাবের দিকে তাকালো দোয়া।সরু চাওনি।আরাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।পরিস্থিতি বলছে,আরাবের আগমনে বিরক্ত বলে এমন রিয়্যাক্ট করছে দোয়া।কিন্তু দোয়ার রিয়্যাক্ট বলছে,কারনটা আরাবের আগমন না।রিয়্যাক্টটাও বিরক্তি না।কারন কোনোভাবে আরাবের কোনো কাজ,আর রিয়্যাক্টটা কোনোভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত অভিমান।দোয়া বলে উঠলো,

-আপনার কাগজপত্রগুলো নিয়ে গেছে,আইডি কার্ড কেউ নিয়ে যায়নি।চিন্তিত হবেন না।

ভ্রুকুটি করে তাকালো আরাব।যার এতোটুকোও দোয়ার চোখে পরেনি।সোজা এগিয়ে বিছানার এককোনের তোষক উচিয়ে তার নিচ থেকে কার্ডটা বের করে অরুনাভ দাশের হাতে ধরিয়ে দিলো ও।কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।পলকহীন ভাবে দোয়ার সে প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইলো আরাব।কার্ডটা ওর সামনে তুলে ধরলেন অরুনাভ দাশ।ধ্যান ভেঙে তড়িঘড়ি করে ওটা হাতে নিলো ও।ওটা হারায়নি দেখে খানিকটা স্বস্তি মিলেছে আরাবের মনে।কিন্তু ওর এতোদিনের এক্সপেরিমেন্টের কাগজপত্র নিয়ে কেউ আবার তার বাজে ব্যবহার না করে,সে চিন্তাটাও ঘিরে ধরতে লাগলো ওকে।
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২

বাহাতে লুঙ্গি খানিকটা উচিয়ে ধরে,ডানহাতে নিমের ডাল নিয়ে অবুঝের মতো দাড়িয়ে আরাব।করনীয় কি তা বোঝার জন্য একবার দোয়ার দিকে তাকাচ্ছে,তো একবার নিমের ডালের দিকে।দোয়া একবর্ন না বলে ওর হাতে নিমের ডাল গুজে দিয়ে রক্তমাখা গেন্জি,জ্যাকেট,ময়লামাখা প্যান্ট সবই বালতিতে করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো।আরাব বলে উঠলো,

-এইযে মিস?এটা দিয়ে কি হবে?

দোয়া পেছন ফিরলো।আরাব একটু হেসে বললো,

-তারমানে আপনি মিস,মিসেস নন।যাইহোক,পুরো নাম কি আপনার?আমি জানি আপনি বোবা নন,কথা বলেন না কেনো তাহলে?সমস্যা কোথায়?

দোয়া পুরোপুরিভাবে আরাবের দিকে ঘুরে বললো,

-হ্যাঁ,আমি মিস।পুরোনাম তাকওয়াতুল দোয়া।নিমের ডাল দিয়ে কি করবেন তার বর্ননা আমার মুখে শুনলে আপনার পোষাবে না,তাই বলিও নি।কাকাবাবুর কাছ থেকে ডেমো নিয়ে শান্ত হোন।কথা বললে কি সমস্যা সেটা বলা,বা এতোক্ষন আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া,কোনোটাই আমার জন্য বাধ্যতামুলক নয়।আপনি এখানকার ক্ষনিকের অতিথি।তাই সমাদরটা এই উত্তরগুলো দিয়েই করলাম।

দোয়ার মুখে একটানা এতোগুলো কথা শুনে একটু আটকে গেছে আরাব।পরপরই বললো,

-সমাদরটা এই কয়েকটা উত্তর দিয়ে করলেন তা কে বললো?কাল রাতে আপনি আমাকে ফেলে এসে,আবার কাকাবাবুকে পাঠিয়েছিলেন,আমার হেল্প করতে।আমার মাথায় জলপটিও দিয়েছেন আপনি।ডোন্ট ইউ থিংক,এটা সমাদরের অন্য কোনো লেভেল ছিলো?

বড়বড় চোখে তাকালো দোয়া।নিজেকে সামলে সরে আসলো ওখান থেকে।কথাগুলোর যুক্তিখন্ডন আপাতত ওর সামর্থের বাইরে।আরাব মুচকি হেসে শুধু তাকিয়ে দেখলো ওর চলে যাওয়াটা।বাড়ির সামনের সিড়ি বেয়ে উপরতলায় উঠে গেলো ও।

বাড়িটা পুরোনো ছোটখাটো রাজবাড়িই বলা চলে।রঙ উঠে যাওয়া দেওয়ালগুলোয় শেওলা পড়া,আগাছাও জন্মেছে কোথাও কোথাও।একটু দুর থেকে দেখলে বড়বড় দরজার ছোটছোট রুমগুলো পায়রার খোপের মতোই দেখা যাবে।বাড়িটার বাকি তিনপাশে দেওয়াল তোলা।দেওয়ালের ওপারে গাছ আছে কিছু।আর অনেকটা দুরে দুটো বহুতল ভবন দেখা যায়।ছোট্ট উঠোনের এককোনে তুলসি তলা,যেমনটা সব হিন্দুবাড়িতেই থাকে।আর আরেককোনে টিউবওয়েল।তিনতলা বাড়িটায় বেশ অনেকগুলো ঘর।এ সকালে বাইরে বেরিয়ে আরাব যতোটুকো বুঝেছে,যারা থাকে,সবাই ভাড়াটিয়ার দেখা চারজনের মধ্যে,দুজন ইন করা,পরিপাটি সাজের অফিস যাওয়া লোক।বাকি দুজনকে ওর গার্মেন্টস্ কর্মী মনে হয়েছে।ঘরের ভেতর থেকে অরুনাভ মুখার্জী(ব্রাক্ষ্মনসম্প্রদায় বুঝাতে”দাশ”পদবী সংশোধন করা হলো)হাঁক ছেড়ে বললেন,

-কি ইয়াংম্যান?লুঙ্গি,গেন্জি আর নিমেরডালে কম্ফোর্টেবল তো?

আরাব ভাষাহীনভাবে একবার ভেতরে তাকালো।পরপরই নিজের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো এবার।শার্টপ্যান্ট পাল্টে ওকে লুঙ্গি গেন্জিই দেওয়া হয়েছিলো পরার জন্য।করেছেও তাই।তাহসানুল আরাব,ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট তৌফিক খানের একমাত্র উত্তরাধিকার,আজ লুঙ্গি পরেছে।মা আর আপু দেখলে নির্ঘাত হেসে গড়াগড়ি খেতো।উপর থেকে দুফোটা পানির ছিটে মুখে পরায় ধ্যান ছেড়ে উপরে তাকালো।আরো তৃপ্তির হাসিতে বিস্তৃত হলো ওর ঠোটজোড়া।

বাড়িটার নিচতলা বাদে প্রতিটা তলায় ঘরে যাতায়াতের জন্য সামনে করিডর।নিরাপত্তার জন্য ওতে কোমড় অবদি রেলিংও দেওয়া।তারও খানিকটা উপরে বাধা তারে ভেজা জামা ঝেড়ে মেলে দিচ্ছে দোয়া।যেটুকো দেখা যায়,খোপা করা চুলগুলোর দুকানের সামনে দিয়েও কয়েকটা বেরিয়ে এসেছে।কিছুকিছু গালে লেপ্টে গেছে।আরাবের সাথে চোখাচোখি হতেই তাড়াতাড়ি সরে গেলো ওখান থেকে।

-চিয়ারস্!

আরাবের হাতে থাকা নিমের ডালে আরেকটা নিমের ডাল ঠেকিয়ে বললো অরুনাভ মুখার্জী।উপরতলা থেকে চোখ নামিয়ে কিঞ্চিত ভ্রুকুচকে তাকালো তার দিকে।উনি ফোকলা হেসে নিমেরডাল দেখিয়ে বললেন,

-এটা হলো দন্তমাজন।আমাদের এখানে সকালের ফ্রেশনেস এটা দিয়েই শুরু হয়।আসো,আমি শিখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।

ওনার সাথে উঠোনটার এককোনের টিউবওয়েলের দিকে খোড়াতে খোড়াতে এগিয়ে গেলো আরাব।ট্যাপও‌ আছে ওখানে।ট্যাপ ছেড়ে বালতি ভরতে দিয়ে টিউবওয়েল দেখিয়ে বললেন,

-এটা হলো খাবার জল।আশেপাশের সবগুলো বাসার সবগুলো পরিবার এইখানেই জল নিতে আসে।এর স্বাদ,আহা!যেনো অমৃত!

আরাব হেসে বললো,

-হতেই হতো,মুখার্জী মশাইয়ের রাজবাড়ির জলাধার বলে কথা!

অরুনাভ মুখার্জী একটু বিস্ময়ে তাকালেন।ছেলেটার এই স্বাভাবিকতায় খুশি হলেন অনেকটা।বললেন,

-হ্যাঁ,এটা আ‌মার দাদা‌মশাইয়ের বাড়ি।এই রায়নগরের জমিদার ছিলেন উনি।আগে জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিলো আমাদের।সবাই‌ মিলে একসাথে হৈহুল্লোড়ে মেতে থাকতাম।এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার দুই কাকাসহ ভাইয়েরা সবাই ভারত চলে যায়।দাদামশাইয়ের সম্পত্তি ওখানেও ঢের।তাই এদিকে কেউ ফিরে তাকায়নি,তাকাবেও না।আমিই বাবার একমাত্র ছেলে।বাবা মারা যাওয়ার পর,এখানকার সবটাই তাই আমার।

-তারমানে সত্যিই আপনি একা থাকেন?

-একা কেনো হবো?তিনতলার চারঘরের দুই পরিবার,দুইতলার চারঘরের তিনজন,নিচতলার মেসের চারজন,এরা সবাই তো আমার পরিবার!ওইযে দোয়া?দুবেলা ওর রান্নাটার সাথে স্নান সেরে আমার রান্নাটাও করতে ভোলে না।তাছাড়া ওর মতো আরো দুটো মেয়ে আছে দুইতলায়।ওরা অবশ্য ফ্যামিলি নিয়ে থাকে না।অনাথআশ্রমে বড় হয়েছে দুজনেই।ওরাও রান্না করে দিয়ে যায় কখনো কখনো।তিনতলার পরিবারগুলো মাঝেমধ্যেই নিমন্ত্রনে ডাকে,মেসের ছেলেগুলো হোটেল থেকে খাবার আনলে,আমাকে মাঝে বসিয়ে একসাথে খায়।এইতো,আমার পরিপুর্ন পরিবার।

-বিয়ে করেননি?

আনমনে কথাটা বলে ইতস্তত করতে লাগলো আরাব।অরুনাভ মুখার্জী হেসে বললেন,

-করেছিলাম তো!প্রেমের বিয়ে ছিলো আমার।অশেষ ভালোবাসায় মোড়ানো ছোট্ট একটা সংসার ছিলো।কিন্তু তা ভাগ্যে সয়নি।বারো বছরের একমাত্র ছেলেকে রেখে আমার মিসেস মারা যায়।

-আ্ আ’ম সরি।আমি,আসলে….

-আরে না না।তুমি না বললে অরুনিমা মানে আমার বউকে মনে পরেনা আমার এমনটা নয়।তাকে এতোটাই ভালোবাসি যে,দ্বিতীয় বিয়ের কথা কল্পনাও‌ করতে পারি নি।ও আছে।আমার মাঝে এখনো আছে।এমনটাই বিশ্বাস করি আমি।

কথাটা শুনে মন ভরে গেলো আরাবের।বললো,

-আপনার ছেলে কোথায়?

-ও বর্তমানে হায়ার স্টাডির জন্য ইউকে তে।আমাকেও বলেছিলো যাওয়ার কথা।যাইনি।এখন ওর ফেরার অপেক্ষাও করি না।শুধু প্রতিদিন ও ভালো আছে,এটুকো খোজ নিয়ে ভালোই আছি।এখন এসব ছাড়ো,সকালের খাওয়াটা খাবে তো নাকি?চলো,নিমের ডাল মুখে পোরো!

মানুষটাকে দেখে জীবনের অনেকগুলো রুপ দেখে নিলো আরাব।অরুনাভ মুখার্জী নিমের ডাল মুখে দিয়ে আরাবকে দাত মাজা শিখিয়ে দিতে লাগলেন।তেতো হলেও,বিষয়টা বেশ উপভোগ করছিলো আরাব।হাতের কাটাছেড়ার জন্য আস্তেধীরে নেড়েচেড়ে ওভাবেই নিমের ডাল‌ দিয়ে মুখ পরিস্কার করে নিলো।কপালের কাটা দিকটার জন্য পুরো মুখে পানি দিলো না।শুধু চোখে একটু ছিটে মেরেছে।তারপর ওভাবেই খোড়াতে খোড়াতে এসে অরুনাভ মুখার্জীর ঘরের সামনের বারান্দায় রাখা বেঞ্চটায় এসে বসলো দুজনে।

ইতিমধ্যে দুকাপ চা নিয়ে এক সাত আট বয়সের ছেলে হাজির।আরাব একবার ভাবলো,এটাই হয়তো দোয়ার ভাই।জিজ্ঞাসা করার আগেই অরুনাভ মুখার্জী কাপদুটো হাতে নিয়ে বললেন,

-কিরে সোহেল?বিস্কুট আনলি না?

-তুমি তো বিস্কুট খাও না কাকাবাবু।তোমার এই মেহমান কোন বিস্কুট খায়,তা আমি কেমনে জানুম?

আরাব হেসে বললো,

-তোমার ঘরে‌ যেটা আছে,ওইটাই আনো।

-ঘরে তো নাই।তয় আমি যে দোকানে কাম করি,ওইহানে অনেক রওমের বিস্কুট।আপনে কন কোনডা খাইবেন,হেইডাই আনুম।

ছেলেটা দোকানে কাজ করে শুনেই আরাবের চেহারার ঔজ্বল্য হারিয়ে গেলো।অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-যেকোনোটা নিয়ে আয়।ও সবগুলোই খায়।যা!

সোহেল দৌড়ে চলে গেলো।আরাব চুপ করে আছে দেখে উনি আবারো বললেন,

-ও সোহেল।উপরতলার এক ভাড়াটিয়ার সৎ ভাই।ওর বর গার্মেন্টসে চাকরি করে।সংসার চালাতে তাই ওকেও দোকানের কাজে পাঠিয়েছে।

-তোকে কতোবার বলেছি সিড়ি বেয়ে বেয়ে উপরনিচ করবি না!কথা শুনিস না কেনো আমার?

দোয়ার গলা শুনে সামনে তাকালো আরাব।একটা ছেলে,হাতে ব্যাট নিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে।ধমকে ধমকে কথাগুলো ওকেই‌ বললো দোয়া।হাতে খুন্তি।খোপা করা চুলের খোলা পাওয়া কিছু ঘামে ভিজে গাল,গলায় আটকে আছে ওর। অরুনাভ মুখার্জী এগিয়ে গিয়ে বললেন,

-কি হয়েছে দিয়ান?নিচে এসেছিলি কেনো তুই?

-কেনো আবার?হাতে ব্যাট!দেখে বুঝছেন না কাকাবাবু?ও খেলতে নেমেছিলো!এইযে,আপনি!আপনাকে কতোদিন কতোভাবে বারন করলে আপনি আমার কথা মানবেন বলুন তো!সকালে একটু ঘরে ছিলাম না,মা নাকি সেলাইয়ের কাজ নিতে চলে গেছে,তুইও নিচে নেমেছিস খেলবি বলে।তোরা কি চাস বলতো?আমি এভাবেই তোদেরকে বারন করতে করতে শেষ হয়ে যাই?

-এসব কি বলছিস তুই আপুনি!

-ঠিকই বলছি।ঘরে যা,গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পর!আমি যাচ্ছি মাকে ডাকতে।এসে যদি তোকে বিছানায় না পাই দিয়ান….

আরাব এগিয়ে গেলো এবার।দিয়ানের হাত থেকে ব্যাট নিয়ে দোয়াকে বললো,

-কেমন মানুষ আপনি?বাচ্চা ছেলেটা শুধু খেলতে‌ নেমেছে বলে এইভাবে বকছেন কেনো?ওর তো খেলারই বয়স এটা!কি এমন দোষের হলো তাতে?আর এখন কি শুয়ে থাকার সময় নাকি?

দোয়া চুপ রইলো।অরুনাভ মুখার্জী একটু আমতা আমতা করে বললেন,

-আ্ আরাব,তুমি যাওনা,চা টা শেষ করো।আমি দেখছি এদিকে….

-আপনিও ওনাকেই সমর্থন করছেন?এটা কেমন কথা?

-ছোটু ঘরে যা!

দোয়ার কড়া আওয়াজে আর দাড়ালো না দিয়ান।উপরে চলে গেলো।দোয়াও আরাবের দিকে একপলক সরুদৃষ্টি ছুড়ে খুন্তি হাতে নিয়েই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।কপাল‌ কুচকে তাকিয়ে রইলো আরাব।অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-মেয়েটার বাবা মারা গেছে অনেক আগেই।আমার এখানে আসার পর থেকে প্রতিটা মুহুর্তে ওর স্ট্রাগল দেখে গেছি।টিউশনি আর সেলাইয়ের কাজ করে সংসারটা ওই চালায়।মা ভাইয়ের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য দিনরাত কষ্ট করে।মুখ বুজে সবদিক সামলায়।ওর মা এজমার রোগী।আর দিয়ান….

-দিয়ান?

-দিয়ানের হার্টে একটা ফুটো আছে আরাব।এজন্যই ডাক্তার ওকে রেস্টে থাকতে বলেছে।এ বিষয়ে ও বা দোয়ার মা,কেউই কিছুই জানে না।অপােরেশনের জন্য টাকা জোগার করবে বলে একগুয়ে হয়ে আছে দোয়া।কিন্তু বাস্তবতাটা তো ভিন্নই।তাই মেয়েটা ওমন…

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অরুনাভ মুখার্জী।সবটা শুনে মাথা খালি হয়ে গেলো আরাবের।দোয়া স্ট্রাগলার,সেটা ও বুঝেছিলো আগেই।কিন্তু এই ক্ষুদ্র চিলেকোঠায় এতো ভারি ভারি জীবনকাহীনি জরিয়ে আছে,ভাবতেও বুকের কোথাও খামচে ধরছে ওর।অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-চলো খাবে চলো।মেসের ছেলেগুলো ভোরেই বেরিয়ে গেছে।তবে যাওয়ার সময় খাবার দিয়ে গেছে ‌তোমার জন্য।

আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকলো আরাব।খেতে বসে দরজা দিয়ে দেখলো দোয়া অনেকগুলো জামাকাপড় দুহাতে বুকে জরিয়ে সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে।পেছনে মলিন চেহারার এক ভদ্রমহিলা খুন্তিটা হাতে নিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে ধুকতে ধুকতে আসছেন।ওরা আড়াল হতেই খাবার শেষ করলো আরাব।অরুনাভ মুখার্জী ওর হাতে ওয়েন্টমেন্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

-এগুলো কাটাছেড়া জায়গাগুলোয় লাগিয়ে দিও।আমার এখন যেতে হবে।এখানকার সবাই বিপদে আপদে এই নাড়িটেপা ডাক্তারের কাছেই আসে কি না!দুপুরের আগেই চলে আসবো আমি।আর বাসায় অফিসটাইমে আর কোনো ছেলে থাকবে না দিয়ান ছাড়া।আমি দোয়াকে বলে যাবো ওকে পাঠিয়ে দিতে।থাকতে পারবে তো তুমি?

-জ্বী।থাকতে তো হবেই।আপনারা আমাকে বাচিয়েছেন,আপনাদের দাওয়াতকে কি করে উপেক্ষা করি বলুন?দুপুরের খাবার সেরেই যাবো এখান থেকে।

সৌজন্যে হেসে বেরিয়ে গেলেন অরুনাভ মুখার্জী।খানিকটা সময় রেস্ট নিয়ে ওয়েন্টমেন্ট হাতে জানালার দিকে‌ এগুলো আরাব।গেন্জিটা খুলে হাতের বুকের দিকগুলোতে লাগিয়ে নিলো নিজের মতো করে।কিন্তু পিঠের দিকে হাত পৌছাচ্ছে না কোনো মতেই।শরীর মোচড়াতেও পারছে না ব্যথায়।হঠাৎই আওয়াজ এলো,

-আমি হেল্প করি?

আরাব পিছন ফিরলো।দিয়ান এসেছে।কি নিস্পাপ হাসি ওই চেহারায়।তা দেখে হাসি ফুটলো ওর মুখেও।বললো,

-আরে দিয়ান?এসো ভেতরে।

দিয়ান ঘরে ঢুকলো।আরাব ভ্রু নাচিয়ে বললো,

-তোমার আপুনি আসতে দিলো তোমাকে?বকেনি?

-না না!কাকাবাবু বলে গেছে না!আর আপুনি শুধু আমাকে খেলার জন্য নিচে নামতে দেখলে বকে।কারো হেল্প করতে দেখলে কখনো বকে না!

-হেল্প করাটা তোমাদের এখানের সবার অস্তিত্বে মিশে আছে তাইনা দিয়ান?

দিয়ান বুঝলো না কথাটা।হাসি দিলো একটা।আরাবও হেসে দিয়ে বললো,

-ওয়েন্টমেন্ট লাগাতে পারবে?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো দিয়ান।সুন্দরমতো লাগিয়েও দিলো মলমটা।দেওয়া শেষে আরাব ঘুরে বসলো ওর দিকে।বললো,

-ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসো?

-অন্নেক!কিন্তু আপুনি খেলতে দেয়না।

আরাব হেসে বললো,

-দেবে।আর কয়েকটাদিন পর থেকেই খেলতে দেবে।আমি বলে দেবো তোমার আপুনি কে!

-সত্যি বলছো তুমি?আপুনিকে বলবে?আমাকে খেলতে যেনো বারন না করে!জানোতো,সদর দরজার বাইরের ছোট গলিটায় সবাই ক্রিকেট খেলে।আমি বাদে।আপুনি সবাইকে মানা করে দিয়েছে,যেনো আমাকে খেলায় না নেয়।

আরাব দিয়ানের কাধে হাত রেখে বললো,

-তুমি খেলবে দিয়ান।সবার সাথর,সবার মতো করে খেলবে।তোমার আপুনি মানা করবে না তোমাকে আর।সবাই খেলায় সাথে নেবে তোমাকে।এটা তোমার কাছে এই আরাব ভাইয়ার প্রমিস!এন্ড ট্রাস্ট মি,তাহসানুল আরাব,কোনোদিনও নিজের প্রমিস অপুর্ন রাখে না!

-ছোটু?গ্লাস শেষ করিসনি কেনো?

দোয়ার ডাক।ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন থেকে উপরে তাকালো দিয়ান।বললো,

-ওইটুকো দুধ না খেলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে আপুনি?মাকে দে,নয়তো তুইই খেয়ে নে না!

দিয়ান আবারো ঘরে ঢুকলো।আর আওয়াজ আসে নি দোয়ার।কিন্তু আরাব স্থির থাকতে পারছে না!ঠিক কি ঘটছে ভেতরটায়,না নিজে বুঝছে,না কাউকে বুঝাতে পারছে।ওই আওয়াজ শুনে শান্তি লাগছে,আবার অস্থিরও লাগছে।ওই মায়াবী,মলিন চেহারাটা সামনে আসলে তাকিয়ে দেখার তৃষ্ণাও বাড়ছে,আবার মনে প্রশান্তিও অনুভুত হচ্ছে।এর কি কারন?প্রানঋণে ঋণী করে দিয়েছে,তাই?নাকি ওর এই অদ্ভুত অনুভুতিগুলোর আলাদা কোনো সমাবেশ ঘটতে চলেছে?ঠিক কোন রঙে রাঙাতে চলেছে ওকে,এই বেরঙ চিলেকোঠা???
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৩

ওড়না কোমড়ে বেধে রান্নার কাজে ব্যস্ত দোয়া।ভাগ্যিস আজ ভার্সিটিতে ক্লাস নেই।থাকলে কয়দিক সামলাতো ও?অবশ্য খুব একটা ঝামেলা হচ্ছে,তাও নয়।অভ্যস হয়ে গেছে ওর।ওর কাজগুলোতে সাহায্যের হাত মা ভাইকে কোনোদিনও বানাতে চায়নি,বানায়নি।কেনো বানাবে?শরীরটা যে কারোরই ভালো না।তরকারীটা নামিয়ে রেখে মাটির চুলোতে আরো শুকনো গোবর পুরে দিলো।এ বাড়িতে গ্যাসের ব্যবস্থা আছে।তা শুধু তিনতলার ফ্যামিলিদুটো ব্যবহার করে।বাকি আর সব ভাড়াটিয়ার মতো গ্যাসবিল দেওয়ার সামর্থ্য দোয়ার নেই।মাটির চুলোয় রান্না করে সবাই।যদিও অরুনাভ মুখার্জী ওকে বলেছিলেন,স্টোভ কিনে দেবেন আর এর খরচটা উনিই বহন করবেন,দোয়া রাজি হয়নি।মাটির চুলো বারান্দায় বসিয়ে,পাশের গোয়ালিনিবাড়ি থেকে কমদামে শুকনো গোবর এনে বেশ চলে যাচ্ছে ওর রান্নাঘর।

-দোয়াপু,আজকে ভার্সিটি যাবো না!

হাতের পিঠে কপালের ঘামটা মুছে পাশ ফিরলো দোয়া।তন্নি আর তৃষা।দুইতলার এরাই বাসিন্দা।দুজনেই অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে।ওখান থেকেই পড়াশোনা,তারপর ভাগ্যক্রমে পাব্লিক ভার্সিটিতে চান্স।আঠারো শেষের পর অনাথ আশ্রম ছাড়তে হয়েছে ওদের।তবে দুঃখে নেই।পড়াশোনা করছে,টিউশনির টাকায় নিজেদের ভরনপোষন,নিজের পায়ে দাড়িয়েছে,এ চিলেকোঠায় পরিবার পেয়েছে,আর কি চাই।দোয়া ভ্রুকুচকে বললো,

-কেনো?ভার্সিটি যাবি না কেনো?

-আজকে তোমার রান্নায় হাত লাগাবো।

দোয়া হাসলো।নিজের কাজে মন দিয়ে বললো,

-তাই বুঝি?তা বাটনাগুলো তো বেটেই দিলি।আর কি করবি শুনি?

-তোমার একটা কাজে হাত লাগাতে পারি না দোয়াপু।কোনোদিনও তো ডাকো না।আজ একজন অতিথির রান্না হচ্ছে,সেখানে একটু বাটনা বেটে দিলাম,এতেই এভাবে বলছো?

তৃষার কথায় দোয়া আরো বর্ধিত হাসিমুখে বললো,

-ওমা!মেহমানের রান্না তো কাকাবাবুর রান্নার প্রক্সিতে হচ্ছে।কাকাবাবু তো আজ আর খাবেন না।তাই এটার জন্য আলাদা কোনো ঝামেলা নেই।তাছাড়া তোরা কেনো আমার রান্না নিয়ে পরলি বলতো?সময়ের অভাবে তোদের রান্নাটা করে দিতে পারিনা বলে আমার কি কম আফসোস হয়?তোরাও তো করতে দিস না।যাইহোক,সবে ফার্স্ট ইয়ারে,এখন ক্লাস ফাকি দিলে,সেমিস্টার সেমিস্টারে ডাব্বা মারবি বুঝলি?যা এখন!

-কিন্তু….

-আমার রান্না শেষ তন্নি।এখন যদি তোদের খুন্তি হাতে ধাওয়া লাগাতে হয়,সমস্যা নেই,আমি ফ্রি আছি কিন্তু!

ফিক করে হেসে দিলো তিনজনই।তন্নি-তৃষা উঠে আসলো চুলার কাছ থেকে।নিজেদের ঘরে চলে আসলো ওরা।ভেতর থেকে দোয়ার মা দুবার কেশে বললো,

-দোয়া?ছেলেটা কোথাকার?

কিছুক্ষন চুপ রইলো দোয়া।হাতের কাজটাও থেমে গিয়েছিলো ওর।আবারো তেলে মরিচ ভাজতে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বললো,

-ওনার নাম আরাব।বাসা ঢাকাতে।

-ওহ্।একবার দেখতে যাবো ভেবেছি।এক্সিডেন্ট করে কতোখানি চোট পেলো ছেলেটা,দেখতেও যাইনি।

-ভালোই আছেন।হসপিটালাইজড্ করাতে হয়নি!

-দোয়া!এভাবে কেনো বলছিস?আমি তো শুধু দেখা করতে যাওয়ার কথা….

-কি দরকার মা?সেবা তো কম হচ্ছে না তার।তোমার বারবার উপর নিচ করার কি দরকার?এমনিতেও দিয়ান গেছে ওখানে।

-এমন করছিস কেনো তুই দোয়া?আমি খেয়াল করছি।এ বাড়িতে একটা চড়ুইপাখি আসলে তারও বসার জায়গা করে দিস তুই।নিজে না খেয়ে তার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরিস।আর আজ একজন বিপদে পরে,অসুস্থ্য হয়ে এসেছে,তাকে নিয়ে এতো বিরক্তি কিসের তোর?রাগ কেনো করছিস?

দোয়া থামলো।ইচ্ছা করছিলো চেচিয়ে বলতে,ওই লোকটা বায়োমেডির একজন সাইন্টিস্ট।যে বায়োমেডি ওদের জীবনটাকে এমন করে দিয়েছে।সেই সাইন্টিস্টগুলোর একজন,যারা কয়েকবছর আগে ওদের সর্বস্ব কেড়েছে।তবুও কিছু বললো না।হাতের কাজটুকো নিরবে করে যেতে লাগলো।চুলোর আগুন নিভে গেছে।সালমা বেগম এবার ঘর থেকে বেরোলেন।চুলোর কাছে আসতেই ধোয়ায় দুবার কাশি হলো তার।হাতপাখাটা খুজে বাতাস করে আগুন জ্বালিয়ে দিলো দোয়া।আসমা বেগম ওর কাধে হাত রেখে বললেন,

-আমি জানি,তোর ভেতরটায় অনেককিছু চলে মা।কিন্তু ওই অচেনা ছেলেটার কি দোষ?

-ঘরে যাও।ধোয়া হচ্ছে এখানে।

আসমা বেগম গেলেন না।রান্না করা খাবারগুলো বাটিতে বেড়ে দিতে লাগলেন।ভাত,শিং মাছের তরকারী,লালশাক ভাজা,উঠোনের কোনায় হওয়া ছোট লাউগাছটার পাতা দিয়ে শুটকি।লালশাক দোয়া আগের দিন সকালে কিনেছিলো।দিয়ানের পছন্দ বলে।আরাবের সামনে দেওয়ার মতো খাবার লাউপাতা শুটকি না।তবে লালশাক ভাজাটা দেওয়া যেতেই পারে ভেবে আলাদা করে শিং মাছ আর লালশাক বাড়লেন সালমা বেগম।বাড়া শেষে দেখলো দোয়া শুকনো মরিচ ভাজছে।এটা ওর খাবার।তিনআঙুলের ডগায় তোলা একটুখানি শাকভাজার সাথে দুটো তেলে ভাজা শুকনোমরিচ হলেই পেটপুরে খেয়ে নেয় ও।তরকারী ছুয়েও দেখে না।বলে বেরাবে,এটা ওর প্রিয় খাবার।কিন্তু সালমা বেগম ভালোমতোই জানেন,আরো দুবেলা তরকারী বাচিয়ে রাখার জন্যই ওর এই প্রিয় খাবার।আচলে চোখের জলটুক মুছে বললেন,

-এই সংসারটাকে তুই যেভাবে শুষে নিয়েছিস নিজের মাঝে,তাতে তো তুই নিশেষ হয়ে যাচ্ছিস মা!আর কতো দোয়া?আর কতো করবি তুই?

দোয়া পাশ ফিরলো।মায়ের চোখের জল দেখে বুকফেটে কান্না আসছিলো ওরও।কান্না সংবরন করে বললো,

-মা,তোমরাই তো আমার সব।আমি যা করি নিজের জন্যই তো করি।কেনো এসব বলে আমাকে নিজের কাছে ছোট করে দাও বলোতো?কেনো?

সালমা বেগম থামলেন।মেয়ের উপর পুরো সংসারটা ঠিক কিভাবে রয়েছে,তার আন্দাজ আছে তার।দোয়া ওনাকে ধরে ঘরে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলো।চুলোর ধার থেকে একে একে সবগুলো জিনিস গুছিয়ে ঘরে তুললো।তারপর মেঝেতে বসে মাথা রাখলো মায়ের কোলে।সালমা বেগম মাথায় হাত বুলাতে লাগলো ওর।দোয়া ধীর কন্ঠে বললো,

-মা?আমি তোমাদেরকে তোমাদের প্রাপ্যটা দিতে পারিনি তাইনা?

-এসব কি বলছিস কি তুই দোয়া?

-ঠিকই তো বলছি।পরিবারের বড় মেয়ে হয়েও কি দিলাম তোমাদের?তোমরা তো এই সস্তা খাবার,এই জীর্ন পোশাক,এই বেরঙ চিলেকোঠা ডিসার্ভ করো না মা।বাবাকে তো আমি কথা দিয়েছিলাম মা,তোমাদেরকে আগলে রাখবো।আমি তো সে কথা রাখতে পারছি না মা!পারছি না!

-চুপ!একদম চুপ!আর একটা কথা বলবি না তুই!

-এখন তুমি যদি বারবার আমার পরিবারের প্রতি আমার ভালোবাসাটাকেই আমার কাছে বোঝা বলে বলে আমাকে অপমান করো,তখন আমার এসব বলা অপরাধের কিছু না।খবরদার আর কোনোদিন এসব কথা বলবে না।

মেয়ের দিকে তৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন সালমা বেগম।পাশের মসজিদ থেকে যোহরের আযান ভেসে এলো।দোয়ার মুখের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে কপালে চুমো দিয়ে বললেন,

-ঠিকাছে।ঠিকাছে।আর বলবো না।আযান পরেছে।যা গোসলটা সেরে আয়।

মুখে হাসি ফুটলো দোয়ার।মাকে ছেড়ে আগে গোসলটা সেরে নিলো।তারপর বারান্দায় গিয়ে ডাক লাগালো দিয়ানকে।

পেট চেপে ধরে রেখে উপরের রঙচটা ছাদের দিকে তাকিয়ে আরাব।প্রচন্ডরকমের খিদে পেয়েছে ওর।এতে রাগও হচ্ছে ওর মনে মনে।কিছুক্ষন আগ অবদিও এই রাক্ষুসে খিদেভাব ছিলো না ওর।দিয়ানের সাথে বেশ আড্ডা দিচ্ছিলো।যেইনা দোয়া দিয়ানকে ডাক লাগিয়েছে,আরাবের আশপাশও যেনো ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছে।আসছি বলে দিয়ান তো চলে গেলো,কিন্তু এদিকে হাসফাস করছে আরাব।পেট তো ধরে আছে,অস্থিরতাটা ঠিক কোথায়,তাতে সায় দিচ্ছে না একদমই।উঠে বসলো এবার ও।লুঙ্গিটা নিয়েও হয়েছে জ্বালা।হবেই বা না কেনো?জীবনে লুঙ্গি পরেছে ও?অসহায়ভাবে কাদোকাদো মুখ বানিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো শুধু।ওদিকের সবুজ নারিকেল পাতাটাও দেখতে বিরক্ত লাগছে ওর এবার।ঘার ঘুরিয়ে দরজা দিয়ে তাই বাইরেই তাকালো।বিনিময়ে মুগ্ধতার বহরে আটকে গেলো ওর চোখজোড়া।

কোমড় অবদি ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে দরজার সামনে উঠোন দিয়ে যাচ্ছিলো দোয়া।পরনে আকাশী রঙের থ্রিপিস।অজান্তেই খোড়াতে খোড়াতে দরজায় এসে দাড়ালো আরাব।দরজায় ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে বুকে হাত গুজে দৃষ্টিতৃষ্ণা মেটাতে পারি জমালো অন্য কোনো দুনিয়ায়।

তুলসী গাছটায় পানি দিচ্ছিলো দোয়া।শুধুমাত্র গোসলের পরই তাতে পানি দেওয়ার অনুমতি আছে।অরুনাভ মুখার্জী সবাইকেই বলে দিয়েছেন,গাছটার যত্ম নিতে।কিন্তু সময় আর ভুলোমনের জন্য হয়ে ওঠেনা কারোরই।এ কাজটা দোয়াই করে।সকালসন্ধ্যায় অবশ্য অরুনাভ মুখার্জী নিজেই পানি দেয়।পানি দেওয়া শেষে পেছন ফিরেই আরাবের দৃষ্টি চোখে পরে ওর।ওই মুগ্ধ চাওনি আর মুচকি হাসি দেখে যে কোনো মেয়েই ঘায়েল হবে হয়তো।চোখ সরিয়ে নিতে গিয়ে আরাবের লুঙ্গি পরার স্টাইলটা দেখে আরো বড়বড় চোখে তাকাতে বাধ্য হলো।

লুঙ্গি গুছিয়ে না পরে তা দুটো ভাজে তামিল নায়কদের মতো করে পরেছে আরাব।এতে আগেরদিন দেখা গোছানো পার্সোনালিটির মানুষটাকে বৈদ্যুতিক খুটির মতোই দেখাচ্ছে।কিছুক্ষন হাসিটা অতিকষ্টে আটকে রেখে শব্দ হেসে দিলো দোয়া।হাসিটা দেখে বেশ অনেকটাসময় পর প্রশান্তি অনুভব করলো আরাব।তাকিয়েই রইলো।কিন্তু সেটা একদমই খেয়াল করেনি দোয়া।আরাব বলে উঠলো,

-এইযে মিস দোয়া?হাসছেন কেনো?এখানে কি কেউ লাফিং গ্যাস দিয়ে গেছে?নাকি আমি দেখতে জোকারের মতো?

দোয়া থামলো।এভাবে হাসাটা খুব কম হয় ওর।কিন্তু হাসার কারনটা আরাব ভেবে আবারো রাগ হলো নিজের উপর।ইতস্তত করে বললো,

-দুঃখিত।

এটুকো বলেই চলে আসলো ওখান থেকে।আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরাব।দোয়ার মলিন চেহারায় হাসি দেখতে ঠিক কতোটা শান্তি লাগছিলো ওর তার বর্ননা নেই ওর কাছে।এখান থেকে হয়তো স্বাভাবিকতার শুরু হতে পারে এই ভেবে কথাগুলো মজার ছলেই বলেছিলো ও।কিন্তু এই মেয়ে তো স্বাভাবিক ব্যবহারের ধারই ধারে না।হেসে যেনো কোনো দন্ডনীয় অপরাধ করে ফেলেছে এমন ভাব করে চলে গেলো।জীবনের দুর্বিপাকেই হাসাটা ভুলে যেতে বসেছিলো হয়তোবা।কিন্তু যদি জীবনই তাকে সৌন্দর্যের অনুভবে জরিয়ে নিতে চায়,তবে দোষ কোথায়?স্বীকার করতে ক্ষতি কিসের?

ছোট পড়ার টেবিলটায় দোয়া খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত।দোয়ার মাও এসেছে।আরাব তার সাথে আলাপের মাঝে মাঝে দোয়ার দিকে তাকাচ্ছে।কিন্তু সে নিজের দুনিয়ায় মত্ত্ব।আরাবের মন তখনো অস্থির।কিছুক্ষন আগের হাসিটা দেখার পর এই চিন্তিত হৃদয়ের দোয়াকে দেখতে ওর কষ্ট হচ্ছে।ভেবে পাচ্ছে না ঠিক কিভাবে দোয়ার সাথে দিয়ানকে নিয়ে কথা বলবে।অরুনাভ মুখার্জী এসে গোসল সেরে তিনতলার নিমন্ত্রন খেতে চলে গেছেন।দোয়া আর ওর মা এসেছে আরাবকে খাবার বেড়ে দিতে।দিয়ান তখন যাওয়ার পর আর আসেনি।

খাবার বাড়তে বাড়তেই হাতের উল্টোপিঠে গালে লেপ্টে থাকা কিছু ভেজাচুল সরিয়ে দিলো দোয়া।কিন্তু গালের ওখানেই গুনে গুনে আরো চারটে চুল লেগেই আছে,স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আরাব।কাধের দিকটা দিয়ে গালে আবারো ডলা লাগালো দোয়া।খুতখুত করছে গালের দিকটা।সালমা বেগম বললেন,

-মুখার্জীদা বললো তুমি নাকি দুপুরে খেয়েই চলে যাবে?

-জ্বী।এভাবে আপনাদের উপর বোঝা হয়ে আর কতোদিন?

দোয়ার দিকে তাকিয়েই কথাটা বলেছে আরাব।সালমা বেগমের বুঝতে বাকি রইলো না,আগুন্তক দোয়ার ব্যবহারেই এভাবে কথাটা বললো।বললেন,

-এভাবে কেনো বলছো বাবা?বোঝা কেনো হতে যাবে তুমি?

আরাব স্বাভাবিক হলো।হাসিমুখে বললো,

-বলছেন?বোঝা নই?তাহলে এখানে থেকে যাই আরো কিছুদিন?

দোয়ার হাত থেমে গেলো।এতোক্ষন আরাবের কোনো কথায় ওর কাজে এতোটুকো ব্যাঘাত ঘটেনি।থাকার কথাটা শুনতেই কিছু তো একটা হয়েছে ওর।আর সেটা লক্ষ করেছে আরাব।ঠোট টিপে হেসে সালমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,

-মজা করছিলাম আন্টি।থেকে যাওয়া সম্ভব না।তবে আসবো,মাঝেমধ্যে।আফটার অল,জীবন বাচিয়েছেন আপনারা আমার।

মৃদ্যু হাসলেন সালমা বেগম।মুখ আচলে ঢেকে দুবার কাশি দিয়ে বললেন,

-আমরা বাচানোর কে বলোতো?বাচানোত মালিক তো আল্লাহ্ তায়ালা।যাইহোক,একা একা যেতে পারবে বাসায়?

-সমস্যা নেই আন্টি।ফোন করে দিলেই গাড়ি পাঠিয়ে দেবে বাসা থেকে।

-বেশ।তাহলে তো হলোই।তুমি তবে….

-মা?ও মা?

দিয়ান ডাক লাগিয়েছে উপর থেকে।সালমা বেগম বললেন,

-ওই দেখো।তার ডাক পরেছে।আমি আসি বাবা।কোনো সমস্যা হলে বলো কিন্তু!

আরাব মাথা নেড়ে স্বায় দিলো।সালমা বেগম উঠে দাড়িয়ে দোয়াকে বললেন,

-দোয়া?তুই খাবারগুলো গুছিয়ে দিয়ে আয়।আমি আসছি।

-আমার হয়ে গেছে মা।বাকিটা উনি নিজেই করে নিতে পারবেন।চলো।

আয় বলে সালমা বেগম বেরিয়ে গেলেন।দোয়াও চলে যাচ্ছিলো।উঠে দাড়াতে গিয়ে পা ধরে আর্তনাত করে উঠলো আরাব।থেমে পেছন ফিরলো দোয়া।বড়সর হাসি টেনে আরাব বললো,

-আ’ইল ম্যানেজ।

চোয়াল শক্ত করে আবারো ভেতরে ঢুকলো দোয়া।প্লেটে বাড়া খাবার টেবিল থেকে এনে বিছানায় আরাবের সামনে রাখলো একদম।বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বিছানায় বসলো আরাব।দোয়া পানির জগটা টেবিল থেকে আনতে যাবে,হুট করেই ওর হাত ধরে ওকে আটকে দিলো আরাব।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here