এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -০৪+৫+৬

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৪

-আপনার এই স্পর্শকে আমি আরো অনেক কঠোর পদ্ধতিতে ফিরিয়ে দিতে পারি মিস্টার আরাব!

দাতে দাত চেপে কথাটা বললো দোয়া।বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে,রাগে কাপছে ও।চোখ লাল হয়ে ছলছল করছে।কিন্তু তবুও ওর কথায় প্রতিক্রিয়ার খুব একটা পরিবর্তন হলো না আরাবের।ও বুঝে গেছে দোয়া কেমন মেয়ে।আত্মসম্মান যে ওর সবকিছু তা বোঝার জন্য খুব একটা সময় লাগেনি ওর।সবটা জেনেবুঝেই এভাবে দোয়ার হাত ধরেছে ও।ডোন্টকেয়ার ভাবে আস্তেধীরে দোয়ার মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের আঙুল আলতোভাবে খুলে তাতে একটা কাগজ গুজে দিয়ে বললো,

-চড় মারতেই পারেন।আই ওন্ট মাইন্ড।ভুল করেছি,শাস্তি বেয়ার করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

হাত ছাড়া পেলো দোয়ার।আবার নিচের ঠোট কামড়ে ধরে দুহাত পেছনে দিয়ে আরো আরাম করে বসলো বিছানায়।ওর দৃষ্টি দোয়ার হাতের কাগজটার দিকে।কাগজটার মচমচ শব্দ যেনো চিৎকার করে বলছে,লাগা!এই ছেলে তোর হাত ধরেছে!এতোবড় সাহস ওর!চড় লাগা!দে একটা চড়!আমাকে এভাবে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে কি শান্তি পাবি তুই বইন?ছেড়ে দে না!ওই লোককে চড় লাগিয়ে আত্মতৃপ্ত হ?দোয়া সবে কাগজটা ছুড়ে মারবে বলে হাত উঠিয়েছে,আরাব চেচিয়ে বললো,

-মিস দোয়া!ঘর নোংরা করবেন না প্লিজ।এটা আমার নিজের ঘর না।আমি আশ্রিত এখানে।তাই ফেলার হলে ওটা বাইরে ফেলে আসুন।এ ঘরটা নোংরা করিয়েন না প্লিজ।

দোয়া থামলো।চোখ দিয়ে টুপটাপ দু ফোটা জল পরলো ওর।এতোক্ষন দোয়ার রাগটা মাথা পেতে নেবে বলে প্রস্তুত ছিলো আরাব।কিন্তু ওর চোখের জলের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না ও।একটা শুকনো ঢোক গিলে কাটাছেড়ার ব্যথা নিয়েই ওর সামনে উঠে দাড়ালো।অস্থিরভাবে বললো,

-আ’ম সরি মিস দোয়া।আপনাকে কাগজটা দেওয়ার অন্য কোনো উপায় মাথায় আসে নি আমার।ওটা…ওটা তো ডক্টরের ভিজিটিং কার্ড ছিলো।দিয়ানের জন্য।

বিস্ময়ে তাকালো দোয়া।দিয়ানের জন্য মানে?তবে কি অরুনাভ মুখার্জী তাকে দিয়ানের বিষয়ে বলেছে?এসব ভাবনার মধ্যেই ওর বুঝ আসলো,হাতে মচমচ করতে থাকা সাধারন লেখার কাগজটা কখনোই ভিজিটিং কার্ড হতে পারে না।চোয়াল শক্ত করে বেরিয়ে আসছিলো ও।আরাব পেছন থেকে চেচিয়ে বললো,

-ওটা সার্জন ড.সজল মুফতাহিরের চেম্বারের ঠিকানা।উনি দেশের বেস্ট হার্ট সার্জনগুলোর একজন।আমার বোনের বর হন উনি।কার্ড নেই এখন,তবে আমি সাইন করে দিয়েছি।এতেই সহজেই আপনি ওনার সাথে দেখা করতে পারবেন।

রুমের বাইরে চলে গেছে দোয়া।কিন্তু কথাগুলো ঠিকই শুনেছে‌ ও।আরাবের সাইন আছে শুনেই বারান্দায় দাড়িয়ে গেলো ও।আস্তেধীরে কাগজটা খুললো।ছলছল চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো লেখাগুলো,ড.সজল মুফতাহির,কার্ডিওলজিস্ট,**হসপিটাল।পাশেই ইংরেজীতে আরাবের সাইন।তাহসানুল আরাব।সাইনটা চেনা ওর।কি করে ভুলবে এই সাইন?এই স্বাক্ষরই তো সেদিন…কান্না বাড়লো দোয়ার।আরাব ভেবেছিলো দোয়া চলে গেছে।মন খারাপ করে তবুও রুমের বাইরে বেরোলো ও।কিন্তু বারান্দায় দাড়িয়ে দোয়াকে কাগজটা পড়তে দেখে হাসি ফুটলো ওর চেহারায়।খুড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে বললো,

-আমি জানি,আপনি ঠিক দিয়ানের অপারেশনের টাকা জোগার করে নেবেন।আমার আর্থিক সাহায্যের ধার আপনি ধারবেন না।তাই সে বিষয়ে বলে আপনার আত্মসম্মানকে আঘাত করতে চাইনি।আমার জীবন বাচিয়েছেন।আমার থেকে অন্তত এটুকো এক্সেপ্ট করুন।সবটা দিয়ানের জন্য মিস দোয়া।

দোয়া চোখের জল মুছলো।এই কাগজ ফেলবে না ও।এই সাইন হাতছাড়া করবে না ও।একটা শুকনো ঢোক গিলে,নাক টেনে বললো,

-খাবারটা খেয়ে নেবেন।

পা বাড়ালো দোয়া।কাগজটা নিয়েছে ও,রাগও করেনি,এটুকোতেই খুশি হয়ে গেলো আরাব।সজল ভাইয়ার কাছে গেলে,টাকা পয়সার দিকটা ঠিক একভাবে না একভাবে সামলে নিতে পারবে ও।তাই এভাবেই দোয়াকে রাজি করালো।খুশিমনে তাড়াহুড়ো করে,খোড়াতে খোড়াতেই ঘর থেকে খাবার প্লেটটা নিয়ে আবারো দরজায় এসে দাড়ালো ও।দোয়া ততক্ষনে সিড়ি দিয়ে উঠে গেছে।ও মাছের ঝোলে একলোকমা ভাত মাখিয়ে তা মুখে পুরে দিলো।উচু আওয়াজে বললো,

-ইটস্ ডেলিশিয়াস!সত্যিই আপনার হাতের রান্না দারুন মিস দোয়া।

দোয়া পেছন ফিরলো।শান্ত দৃষ্টি রেখে বললো,

-থ্যাংকস্।

-থ্যাংকস্ টু ইউ।

আরাব হেসে মাথা দরজায় ঠেকালো।ওর খুশিটা যেনো এই মুহুর্তে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলেছে।চেহারাতেও সে আনন্দ স্পষ্টতর হচ্ছে।চোখ নামিয়ে চলে‌ গেলো দোয়া।ও জানে,আরাবের এ আনন্দের কারন অনিচ্ছাকৃতভাবে ওই।যা ও একদমই চায়নি।চায় না!

খাওয়া শেষ করে ‌প্লেট দিতে খোড়াতে খোড়াতে দোতলায় আসলো আরাব।অরুনাভ মুখার্জী তখনো নামেননি তিনতলা থেকে।ভাবলো প্লেটগুলো দিয়ে ওনাকেও ডেকে আনবে।দোতালায় উঠে দেখলো বারান্দা আর সিড়ির মাঝে আরেকটা গেইট দেওয়া।এটা খুব একটা পুরাতন নয়।বছরখানেক আগে আলাদাভাবে বানানো হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।ওতে তালা ঝুলছে।পাশেই এক সাইনবোর্ডে অতিসুন্দর লেখা,”পুরুষের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ”।কথাটা দেখেই হেসে দিলো আরাব।মনটাও ভালো হয়ে গেছে ওর।ও জানে দোতলায় দোয়ার পরিবার আর দুটো মেয়ে ভাড়াটিয়া।ওদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে অভির্ভুত না হয়ে পারলো না।ঝুলন্ত তালা নাড়িয়ে ঠুকঠুক শব্দ করলো দুবার।

সামনের ঘরটা থেকে শুধু মাথা বের করে একজন উকি দিলো।বেশ বুঝতে পারছে,বাকি মেয়েদুটোর একজন ওটা।হাত নেড়ে”হাই”বুঝালো আরাব।মেয়েটা দুবার দ্রুত পলক ফেলে হচকিয়ে যাওয়া চেহারা করে ঘরের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে নিলো আবারো।মন ভেঙে গেলো আরাবের।প্লেটগুলো নিয়ে নিচতলার দিকে হাটা লাগাচ্ছিলো ও।পেছন থেকেই সালমা‌ বেগম বলে উঠলেন,

-আরে,আরাব?তুমি দোতলায়?

আরাব পেছন ফিরলো খুশিমনে।অতঃপর কাদোকাদো চেহারা বানিয়ে ইশারায় একবার ওর হাতের প্লেট,আরেকবার গেইটের তালাটা দেখালো সালমা বেগমকে।ওর ওমন মুখ দেখে হেসে দিলেন সালমা বেগম।আচলের গোছায় রাখা চাবিটা দিয়ে গেইট খুলতে খুলতে বললেন,

-এই অবস্থায় সিড়ি বেয়ে উঠতে গেলে কেনো?এসো এসো,ভেতরে এসো।

-কিন্তু এই নোটিশ?

-ওই সাইনবোর্ডের কথা বাদ দাওতো!ওর কোনো কাজ নেই এ চিলেকোঠায়।নিচতলার মেসের ছেলেগুলো তো বলতেই পারবে না এই সিড়িটা কোনদিক দিয়ে উঠে এসেছে।আর উপরতলার ছেলেদুটোও চোখ বন্ধ করে অফিস,আর অফিস থেকে তিনতলায় পৌছে যায়।মুখার্জীদা আর দিয়ান ছাড়া কোনোদিনও কোনো ছেলেমানুষ আসেনি দোতলায়।

গেইট খুলে সরে দাড়ালেন সালমা বেগম।আরাব হাসিমুখে প্লেটদুটো এগিয়ে দিয়ে বললো,

-আমি রেকর্ডব্রেকার হবো না আন্টি।এই প্লেটগুলো দিতে এসেছিলাম জাস্ট।

-তাতে কি?এসোনা?দিয়ান ঘরেই আছে।

-না আন্টি।থাক।আমি বরং কাকাবাবুকে ডেকে আনি তিনতলা থেকে।

-মুখার্জীদা তিনতলা থেকে নামার সময় প্রতিবারই দোতালায় থামে,তন্নি,তৃষা,দোয়া,দিয়ান কারো না কারো নাম ধরে ঠিক ডাকবে।তুমি এসো তো!

-কিন্তু….

-কোনো কিন্তু না।তুমি এসো তো!

সালমা বেগম মানতে নারাজ।এতো কষ্টে সিড়ি উঠেছে,ওকে আসতেই হবে ভেতরে।আরাব হার মানলো।পা বারালো দোয়াদের ঘরের দিকে।পাশের পর্দা দেওয়া দরজাটা পাস করতে করতে সালমা বেগম বললেন,

-এটা,তন্নি তৃষার ঘর।ওরাও ভাড়াটিয়া।দোয়া ওদের ছোটবোনের চোখেই দেখে।

আরাব তাকালো না সেদিকে।সামনের দরজায় সাদা পর্দা উরছে।আর অসম্ভব গতিতে হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে ওর।দোয়ার অস্তিত্বকে যেনো অনুভব করতে পারছে ও।কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা না।পরিচয়ের তো দুদিনও পুরো হয়নি ওদের।তবে এই মিশ্র অনুভুতিগুলোকে সামলাতে এতো বেসামাল কেনো হয়ে পরছে ও?কেনো?

ঘরে ঢুকলো আরাব।দোয়া খোপা বাধতে বাধতে পাশের ঘর থেকে অন্যদরজা দিয়ে ওই ঘরেই ঢুকছিলো।আরাবকে দেখে আটকে গেলো ও।ঘাড়ের পিছনে থেমে থাকা হাত,ললাটজুড়ে ছাড়া পাওয়া কিছু চুলের মাতলামি,টানাটানা চাওনি,থুতনির বা পাশটায় মুক্তোর মতো ঝিলিক দিয়ে চোখ ঝলসে দেওয়া পানিবিন্দু।ভেতরটায় এবার তান্ডব শুরু হয়ে গেছে আরাবের।চোখ সরিয়ে
অন্যদিকে ফিরলো ও।ফু দিয়ে দুবার জোরে শ্বাস ফেলে আবারো হাসিমুখে তাকালো দোয়ার দিকে।দোয়া চুল থেকে হাত নামিয়ে হাতের পিঠে মুখের পানিটুকো মুছলো।কড়াকন্ঠ বজায় রেখে বললো,

-আপনি এখানে কেনো?সাইনবোর্ড দেখেননি?

আরাব আরো বড়সড় হাসি দিলো।মায়ের দিকে তাকালো দোয়া।সালমা বেগম বললেন,

-আহ্ দোয়া!তুইও না!সবসময়…

কথা শেষ না করে আতিথীয়তা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন উনি।দেখাবেনই না কেনো?ছেলেটা বড়ঘরের ছেলে হয়েও বেশ ভালোভাবেই ওদের ছোটছোট আতিথ্য হাসিমুখে গ্রহন করছে যে!সালমা বেগম আরাবের হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে বিছানা দেখিয়ে বললেন,

-বসো বাবা।এখানে বসো।

আরাব বসলো।পাশের ঘর থেকে দিয়ান বেরিয়ে আসলো।আরাবের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে ওরও।এগিয়ে এসে বললো,

-তুমি এসেছো আরাব ভাইয়া?আমি সবেই মাকে বলতে চাচ্ছিলাম,তোমাকে আমাদের ঘর দেখাতে নিয়ে আসতে।

ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো না দোয়া।জানালার ধারে গিয়ে উল্টোপাশ হয়ে বসলো।সুতোর গোছা নিয়ে তা সুইয়ে পরাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।দোয়ার কাধের উপর বড়সড় খোপাটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো আরাব।ওই খোপায় সাদা ফুলের গাজরা পরিয়ে দিলে বেশ মানাবে।পরেছে কোনোদিন ও গাজরা?আচ্ছা,ওর চুলগুলো ছাড়া পেলে কেমন দেখাবে এখন?ওর পরনে তো আকাশী রঙের জামা।পিঠজুড়ে কালো চুলগুলো ছড়িয়ে দিলে নীল আকাশের কালোমেঘের মতো দেখাবে না?

-কিছু খাবে আরাব?

ধ্যান ভাঙলো ওর।নিজেকে সামলে বললো,

-না না!সবেই তো খেলাম আন্টি।ব্যস্ত হবেন না প্লিজ!

দিয়ানকে কাছে বসার জন্য ইশারা করলো ও।তারপর পুরো ঘরটায় চোখ বুলালো।বাড়ির সবগুলো দেয়ালই রঙচটা।ঘরে আসবাব বলতে একটা বেশ বড় চৌকি,আলনা,পড়ার টেবিল,তাতে অবশ্য বই ছাড়াও অনেককিছু রাখা।কালি লেগে থাকা হাড়িপাতিল গুলো মেঝেতেই একটার উপর আরেকটা।দেয়ালে দুটো পুরোনো ক্যালেন্ডার,মেঝের এককোনে ছোটখাট একটা ট্রাংক,তার পাশ দিয়ে বালতি,ছোট দুটো ড্রাম,আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা কিছু সবজি।আর ঠিক পশ্চিমদিকে মেঝে থেকে প্রায় ছাদ অবদিই লম্বা জানালা।যেমনটা অরুনাভ মুখার্জীর ঘরেও আছে।তবে এই জানালার রডগুলোর নিচদিক মরিচায় কালো হয়ে যায়নি।আরাব কল্পনা করলো,দোয়া ওর অবসর ওই রড ধরে,জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে থেকেই কাটিয়ে দেয়।ঘরের ছাদের কাছাকাছি দিকটা কিছু পুরোনো ওড়না মুড়িয়ে সজ্জাদানের চেষ্টা করেছিলো কেউ।এসবের মধ্যে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য খুজে পেলো আরাব।বলা বাহুল্য,প্রান জুরিয়ে গেলো ওর।সালমা বেগম দোয়ার দিকে এগিয়ে বললেন,

-কিরে?সুইসুতো নিয়ে বসলি যে?টিউশনিতে যাবি না?

আগেরদিন রোতিদের বাসার টিউশনিটা হারানোর বিষয়ে মাকে কিছু বলেনি দোয়া।বললে উপার্জন নিয়ে আরো চিন্তায় পরে যেতো সে।নিজের মতো ব্যস্ত থেকেই বললো,

-কাল অনুষ্ঠান ছিলো তো,তাই রোতির আম্মু আজকে ছুটি দিয়েছে।তবে বাকিদুটো আছে।যাবো একটু পর।

বিকেলের এটুকো সময়ে তিন তিনটে টিউশনি দোয়ার।একটাতে ছুটি বলে,সুইসুতো হাতে তুলে নিয়েছে।হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসছিলো আরাবের।হয়তো কষ্টে।নিজেকে সংযত রাখাটা সত্যিই সম্ভব হচ্ছে না ওর।ইচ্ছে তো করছে,সবটা উজার করে দিয়ে এই বেরঙ চিলেকোঠার হৃদয়গুলোকে রাঙিয়ে দিতে।কিন্তু ওর সে রঙ স্বীকার করবে না কেউ।দোয়া তো নয়ই!প্রশ্নটা আরো এক জায়গায়,ও তো ভাবতে চেয়েছিলো শুধু দিয়ানকে নিয়ে।প্রানঋনের দায় কিছুটা কমাতে।তবে দোয়াকে নিয়ে হাজারটা ভাবনা কেনো ঘিরে ধরছে ওকে?ক্ষনিকের সাক্ষাতে এতোগুলো অনুভুতির সমারোহ কি করে হয়?ওর ভেতরের অস্থিরতা যে বারংবার জানান দিচ্ছে ওকে,এ চিলেকোঠায় সর্বস্ব হারিয়েছে ও,কোনো এক অন্য জগতের রঙে!তবে কি ও স্বীকার করতে বাধ্য নয়,এই মায়াবী চেহারা,গভীর চাওনি,আর কঠোর শব্দতীরের ভীড়েই কোনো এক অদৃশ্য বাধন জড়িয়ে নিয়েছে ওকে।হয়তো যে বাধন হয় ভালোলাগার।ভালোবাসার!

মনের সাথে যুক্তিখন্ডনে পেরে না উঠে দাড়িয়ে গেলো আরাব।অস্থির লাছে ওর।তাকাতে পারছে না আর দোয়ার দিকে।একবার মনে হলো,এ ঘরে আসাই ওর উচিত হয়নি।এ বৃথা আফসোস তো আর কমাতে পারবে না ওর এ অস্থিরতা।তাই চলে যাওয়াই উত্তম মনে করলো ও।জিভ দিয়ে ঠোটটা ভিজিয়ে বলে উঠলো,

-আ্…আমি আসছি।

কথা কোনোমতে শেষ করে বেরিয়ে এলো ও।ঘরের তিনজনই তাকিয়ে রইলো ওর চলে যাওয়ার দিকে।দিয়ান আর সালমা বেগম বেরিয়েও আসলেন ওর পিছনে।আরাব থামে নি।সুচ ফুটে হাতে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে দোয়ার।কোনোরুপ আর্তনাত না করে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো শুধু ওই ক্ষতর দিকে।
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫

দেয়ালে তারকাটায় আটকানো ছোট আয়নাটায় তাকিয়ে দোয়া।নিজেকে না,ওতে আটকানো ছোট কালো টিপটার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে।কতোদিন হয়ে গেলো,চেহারায় প্রসাধনীর প টাও ছোয়ায় নি ও।অবশ্য,ওসব আর মানায় না ওকে।খানিকটা তাচ্ছিল্যে হেসে বিনুনির আগাটা চিরুনি করতে লাগলো।চুলগুলো বেধেই রাখে বেশিরভাগ সময়।ছাড়তে ইচ্ছা করে না ওর।ছাড়লেই যে ওর বাবার কথা মনে পরে যায়।চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে বাবার বলা সে কথাগুলো মনে পরে যায়।
“জানিস দোয়া?তোর বর যে হবে,সে তোর এই ঢেউখেলানো চুল দেখেই তোর প্রেমে পরবে দেখিস।বাবার মতোই তোর খোলা চুলগুলো দেখতে ভালোবাসবে।সবসময় চেচামেচি করবে তোর সাথে,চুলের অযত্ম করা নিয়ে।তারপর এগুলোকে অতি সযত্মে আচড়িয়ে দেবে।একদম তোর বাবার মতোই।”
অজান্তেই হেসে দিলো দোয়া।ওর ধারনা,ওর বাবাই সে একমাত্র পুরুষ,যার মতবাদে,চুলের প্রেমে পরা যায়।

-তুই এখনো বেরোস নি আপুনি?

দিয়ানের কথায় বাস্তবে ফিরলো দোয়া।জানালা দিয়ে উকি দিলো।নিচের এক সেলুনে টাঙানো দেয়াল ঘড়িটায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে,তিনটে বেজে আটচল্লিশ মিনিট।ওড়নাটা ঠিকঠাক করতে করতে বললো,

-মা কোথায় রে?

-মা তো নিচে গিয়েছিলো,আরাব ভাইয়ার জামাকাপড় দিয়ে আসতে।তুই ওগুলো ধুয়ে বারান্দায় রেখেছিলি না?

ব্যস্ততার মাঝেও মলিনতা আসলো দোয়ার চেহারায়।খাবার পরই আরাবের চলে যাওয়ার কথা।এতোক্ষনে চলে গেছেও হয়তো।জিজ্ঞাসা করলো না দিয়ানকে।পাটের আশ দিয়ে বানানো স্বল্পদামী ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে বললো,

-আমি বেরোচ্ছি।আজকে আসতে দেরি হতে পারে একটু।মাকে বলিস খরবদার যেনো রান্না না চড়ায়।আমি এসেই রান্না করবো।আর তুই!খরবদার লাফালাফি করবি না।ঘরেই থাকবি!মনে থাকবে?

দিয়ান মাথা নেড়ে স্বীকারোক্তি বোঝালো।নিচে নেমে গোটা নিচতলাতেই চোখ বুলালো দোয়া।মেসের লোকগুলো সকাল সাতটায় বেরিয়ে যায়,রাত আটটায় আসে।ওদের রাধুনী সকালে ছটার দিকে এসে রান্না করে দিয়ে যায়।দুপুরেও আসে।দোয়া সকালে বেরোয় দশটায়,ফেরে আযানের পরপরই,বা ক্লাস না থাকলে অনেক আগেই।আবার বিকেলে বেরোয় তিনটায়,বাড়ি ফেরে সাতটায়।কারো সাথে দেখা হবার সুযোগ নেই।নিচতলা পুরোই ফাকা এখন।অরুনাভ মুখার্জীর ঘরের দরজা ভেতর থেকে লাগানো।আরাব গেছে কি না তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ও।তবে মা যখন জামা দিয়েই গেছে,চলেই গেছে হয়তো।এমনটা ধারনা করে গুটিগুটি পায়ে অরুনাভ মুখার্জীর ঘরের দিকে এগোলো ও।কেনো যেনো ঘরটায় চোখ বুলানোর ইচ্ছা হলো ওর।কেনো আবার?কাকাবাবুর জন্যই।কারনটা আরাব হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।সদর দরজার দিকে তাকিয়ে ঘরের দরজায় আঙুলের উপরপিঠে টোকা দিতে দিতে ডাক লাগালো,

-কাকাবাবু?ক্ কাকা…

কাঠের দরজা ছেড়ে আঙুলটা গিয়ে কারো মুখে লেগেছে এমনটাই অনুভব হলো দোয়ার।ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় তাকালো ও।আরাব দরজা খুলে দিয়েছে।আর সত্যিই ওর আঙুল আরাবের মুখে লেগেছে।হচকিয়ে গিয়ে হাত নামিয়ে নিলো দোয়া।আরাব বড়সর একটা হাসি দিলো।ওর এই ইনোসেন্ট হাসি দেখে কপালে ভাজ পরলো দোয়ার।পরমুহুর্তেই খেয়াল করলো প্যান্টটা পরে সম্পুর্ন উদোম গায়ে দাড়িয়ে আছে আরাব।তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,

-কাকাবাবু কোথায়?

-তোমার কাকাবাবু মোবাইলটা তার চেম্বারেই রেখে এসেছে।সেটাই আনতে গেছেন।

আচমকা আরাবের মুখে তুমি সম্বোধন শুনে আশ্চর্যের এর অন্য পর্যায়েই চলে গেছে দোয়া।হলো কি এর?তুমি করে কেনো বললো ওকে?কিছুক্ষন আগেই তো ওর ঘর থেকে একপ্রকার ছুটে বেরিয়ে এলো।তখন তো আপনি করেই বলছিলো।ও তো ভেবেছিলো,ওর ব্যবহারে আর হয়তো ওর মুখোপেক্ষী হবে না আরাব।কিন্তু ঘটনা তো পুরো উল্টোটাই ঘটলো।কিন্তু সেটা মানার জন্য বাধ্য নয় ও।আরাব খালি গায়ে আছে বলে চোখ তুলে তাকালো না দোয়া।বললো,

-আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন না!

আরাব ঠোট কামড়ে হাসলো।ইচ্ছে করেই তুমি করে বলেছে ও দোয়াকে।বলবে।তুমি করেই বলবে।যাতে ও তৃপ্ত হয়।আজ প্রথমবার মুখ লুকিয়ে চলে এসেছিলো কারো সামনে থেকে ও।কোনোদিনও যা হয়নি।পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বেরানোর ছেলে ও নয়।এ ঘরে এসে কিছুটা সময় ভাবতেই ওর মনে হলো,কেনো চলে আসলো ও দোয়ার ওখান থেকে?পালিয়ে আসলো কেনো?উত্তর পায়নি।তবে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।সব রকমের অনুভুতিকে সামনে থেকে দেখতে চায় ও।যা কোনোদিনও ছিলো না ওর মাঝে,সে নতুন অনুভুতিগুলোকে আরো সুন্দরভাবে অনুভব করতে চায় ও।পালিয়ে বেরানোর বা ভয়ের তো নয় সে অনুভুতি।যদি তা ভালোলাগা হয়,তবে সে ভালোলাগাকে উপভোগ করবে ও।আর যদি ভালোবাসা হয়,আজীবনের তরে আকড়ে ধরবে।ব্যস্!এটুকোই!হাসি কমিয়ে আরাব স্বাভাবিক স্বরে বললো,

-বেশ স্পষ্টবাদী তুমি!যাইহোক,অনেক ভেবে দেখলাম,জানোতো দোয়া?তুমি তো বয়সে ছোট আমার।আপনি কেনো বলবো?তাই এবার থেকে তুমি করেই‌ বলবো তোমাকে!

দোয়া ভেবে পেলো না প্রতিত্তরে কি বলবে।এতোটা স্পষ্টভাবে বলার পরও যদি কেউ জেদ ধরে বসে তুমি করেই বলবে,সেখানে কথা না বাড়ানোই উচিত মনে হলো ওর।নিচু গলায় বললো,

-আপনি এখান থেকে যাননি কেনো এখনো?

-কিভাবে যাবো?বাসায় ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বলবো,তখনই তো দেখলাম কাকাবাবুর ফোনটা নেই।তাইতো…যাইহোক,তুমি কোথাও বেরোচ্ছো বুঝি?

উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না দোয়া।চলে আসতে যাবে,হঠাৎই ওর বিনুনিটায় টান পরলো।পেছন ফিরে দেখে আরাব দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।আর দরজার দুই পাল্লার মাঝে ওর অর্ধেক বিনুনি আটকা পরে আছে।চোখ কপালে উঠলো ওর একপ্রকার।সর্বশক্তিতে টানাটানি শুরু করে দিলো বিনুনিটা ধরে।

দরজার এপারে বুকে দুহাত গুজে দরজার নড়চড় দেখছে আরাব।ইচ্ছে করেই বিনুনিটা আটকে দিয়েছে।বলা চলে,প্রথমদিন জানালা দিয়ে আসা বাতাসের সাথে চুলগুলোর তরঙ্গের মতো উচ্ছলতা দেখার পর,এই মলিন বিনুনি সহ্য হচ্ছিলো না ওর।ওপার থেকে টানলেও যাতে না বেরোয়,এজন্য দরজায় আরো দুটো আলাদা কাঠ দিয়ে ঠেস দিয়ে রেখেছে।আওয়াজ এলো,

-মিস্টার আরাব?মিস্টার আরাব?দরজাটা খুলন!এদিকে…মিস্টার আরাব!

আরাব কিছুটা পিছিয়ে উচ্চস্বরে বললো,

-কি হয়েছে দোয়া?এনি প্রবলেম?

-দরজাটা খুলুন!

-কিন্তু এখন তো খোলা যাবে না।আমি আমার ব্যক্তিগত….

-দেখুন,আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে!

আরাব এগোলো।বিনুনির ব্যান্ড খুলে আস্তেআস্তে খুলে দিতে লাগলো চুলগুলো।অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে ওর এতে।দরজার এপারে থাকা সবটুকোর বিনুনি খুলে দিয়ে বললো,

-দরজা খুলতে পারি,এক শর্তে!

-মানে?

-মানে তোমাকে আমার একটা হেল্প করতে হবে।

-দেখুন মিস্টার আরাব!আমি….

-আমাকে হেল্প না করলে আমি কেনো তোমার কথা শুনবো?খুলবো না দরজা!

আরাবের জেদের পরিমাপ সম্পর্কে কিছুটা অনুমান হলো দোয়ার।রাগ,বিরক্তি,হতাশা সবই এক দীর্ঘশ্বাসে বের করে দিয়ে বললো,

-বেশ।করবো হেল্প।খুলুন দরজা।

আরাবের চেহারায় বাকা হাসি।এই‌ মেয়েটা কথার এদিক ওদিক করবে না এটা ওর দৃঢ় বিশ্বাস।দরজা খুললো ও।চুল ছাড়া পেলো দোয়ার।অর্ধেক বিনুনি খোলা দেখে বড়বড় চোখে তাকালো আরাবের দিকে।আরাব খালি গায়ে থাকায় ওর সে দৃষ্টি স্থায়ী হলো না।আরাব ঠোট উল্টে,কাধ উচিয়ে মাটিতে পরে থাকা ব্যান্ড দেখিয়ে বুঝালো,দোয়ার টানাটানিতেই ব্যান্ড,বিনুনি খুলে গেছে।চোখ নামিয়ে রেখেই দোয়া বললো,

-কি সমস্যা?

আরাবের চেহারায় বর্ধিত হাসি।জানতো,দোয়া হেল্প করার কথাটা মাথায় রাখবে।দরজা ছেড়ে দাড়িয়ে হাত ছড়িয়ে ঘরের ভেতরটা দেখিয়ে বললো,

-এইযে দেখো।

দোয়া উকিঝুকি দিলো ঘরে।তেমন কিছুই বুঝলো না।আরাবের সাথে কথা বলার ইচ্ছে ওর নেই।তাই ঘরের ভেতরেই ঢুকে দেখার চেষ্টা করলো কি হয়েছে।পেছন থেকে আরাব ওর টিশার্ট হাতে নিয়ে বললো,

-এটা পরিয়ে দাও তো!

পেছন ফিরে চোখ কপালে দোয়ার।হতবিহব্বলের মতো তাকিয়ে রইলো আরাবের দিকে।আরাব ওর সেই বিখ্যাত ইনোসেন্ট হাসি দিয়ে বললো,

-কাটাছেড়ায় টান লাগে।পরতে পারছি না।তুমি তো রাজি হয়ে গেলে হেল্প করার জন্য।পরিয়ে দাও?

-অসম্ভব!

-তুমিই তো বললে হেল্প করবে!

-আমি দিয়ানকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

-ও সবে রুমে গেছে।ওকে এভাবে উপরনিচ করাতে খুব শান্তি লাগবে তোমার?

-কাকাবাবু…

-উনি একদম রেডি হয়ে থাকতে বলেছেন আমাকে।এসে এখনো আমাকে খালি গায়ে দেখলে,তোমাকেই বকবে।আমাকে হেল্প না করার জন্য।

চোয়াল শক্ত করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো দোয়া।আরাব ওর পথ আগলে দাড়ালো।দোয়া কিছুটা চেচিয়ে বললো,

-এবার কিন্তু আপনি বাড়াবাড়ি করছেন!

-আমাকে হেল্প না করলে যেতে দিচ্ছি না।তাছাড়া তোমার সমস্যা কোথায়?কাকাবাবু তো বলেছেন আমাকে,আমি যখন সেন্সলেস ছিলাম,তুমিই টিশার্ট খুলে ওয়েন্টমেন্ট লাগিয়েছিলেন আমার গায়ে।এটা খোলার সময় সমস্যা হয়নি,পরিয়ে দিতে কিসের সমস্যা?

দোয়া এবার অস্বস্তিতে পরে গেছে।এটা সত্যি।ওই সেদিন শার্ট খুলে দিয়েছিলো আরাবের।অরুনাভ মুখার্জী গিয়েছিলেন তার চেম্বারে বাকিসব ওষুধ আনতে।না চাইতেও,ওই ছিলো আরাবের পাশে।কিন্তু কথাগুলো আরাবকে বলার কোনো মানে খুজে পেলো না দোয়া।আরাব গলা ঝেড়ে বললো,

-কি ঠিক করলে?আমি কিন্তু পথ ছাড়ছি না!

আরাবের হাত থেকে শার্টটা নিলো দোয়া।বাধ্য শিশুর মতো এসে বিছানায় বসলো আরাব।একরাশ ইতস্ততবোধ নিয়ে ওকে টিশার্টটা পরিয়ে দেবে বলে এগোলো দোয়া।আরাবের দৃষ্টি আর উদোম দেহদর্শনকে উপেক্ষা করতে অন্যদিক মুখ করে রইলো।দুহাত দুরে থেকে গলাটা ঢুকিয়েই ছিটকে সরে এলো।দম বন্ধ লাগছিলো ওর।আরাব কপাল কুচকে বললো,

-হোয়াট হ্যাপেন্ড?

-বাকিটা নিজে করে নিন।

আরাব জানতো ওর কাছে আসার মতো অসম্ভব কাজ দোয়া করবে না।তবুও কিয়দাংশ ঘটেছে তার।ওই অল্প সময়টুকোতে দোয়ার অস্বস্তি,ওর চোখের পাপড়ির যে কম্পনের দেখা মিলেছে,তাতেই তৃপ্ত আরাব।কষ্ট হচ্ছিলো জামায় হাত ঢুকানো নিয়ে।তবুও‌ নিজের মতো করে একাএকাই টিশার্টটা পরে নিলো ও।ঘর থেকে বেরিয়ে এলো দোয়া।পেছন থেকে আরাব চেচিয়ে বললো,

-চুলগুলো আচড়িয়ে যাও?খুলে যাও?

দোয়া পেছন ফিরলো।আরাবের কাছে চুলের যত্মের কথা,খুলে রাখার কথা শুনে রাগটা তরতর করে বেড়ে গেলো ওর।ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে,দাতে দাতে চেপে চুল বিনুনি করে নিলো পুরোটা।ব্যান্ড দিয়ে বেধেও‌ নিলো।আরাব তিক্ত মুখ করে দোয়ার বিনুনিটার দিকে তাকিয়ে রইলো।এই মেয়ে কি সবসময় এভাবেই ওর কথার উল্টোটাই করবে?উল্টোটাই বুঝবে?

-আপুনি?তোর স্প্রে?

উপরে তাকালো দোয়া।বারান্দায় দিয়ান দাড়ানো।হাতে মরিচগুড়ো মেশানো পানির স্প্রে।বাসার বাইরে বেরোলে এটা নিয়েই বেরোয় দোয়া।একমাত্র বান্ধবীর কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া একমাত্র জিনিস,স্প্রের খালি বোতল।ওতে দৈনিক একচিমটে মরিচগোলানো পানি পুরে দেয় দিয়ান।আরেকপলক আরাবের দিকে দৃষ্টিতাক করলো দোয়া।এই লোকটার উপর স্প্রে টার প্রথমবারের মতো প্রয়োগ করতে পারলে মন্দ হতো না।ওর চুল নিয়ে কথা বলার অধিকার কারো নেই।হনহনিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো ও।কিঞ্চিত হা হওয়া মুখ নিয়ে আরাব মাথার উপরের ছাদের দিকে তাকিয়ে হতবুদ্ধির মতো বললো,

-কিসের স্প্রে?
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৬

মুখার্জী বাড়ির সদর দরজার সামনে অরুনাভ মুখার্জীর সামনে মেকি হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আরাব। হাতে থাকা ফোনটার দিকে অসহায়ভাবে তাকালো একবার। অরুনাভ মুখার্জী ওকে বলেছেন,বাসায় ফোন করে এই‌ ঠিকানায় গাড়ি পাঠিয়ে দিতে। ওকে গাড়িতে তুলে না দেওয়া অবদি নাকি শান্তি নেই তার। গাড়ি পাঠাতে বলাটা ব্যাপার না আরাবের জন্য। কিন্তু পুরো একদিন পর মা,বাবা যে কাউকে ফোন করলেই তারা অস্থির হয়ে পরবে। গাড়ি পাঠাতে বললে,তারাই না চলে আসে!তাছাড়া,বাসায় ফোন করলে প্রতিবার জারা নামক ঝামেলার কথা মনে পরতেই মেজাজ টগবগিয়ে ওঠে ওর।অরুনাভ মুখার্জী গলা ঝেড়ে বললেন,

-কোনো সমস্যা আরাব?

-জ্..জ্বী মানে,হ্ মানে,মানে না!

হ্যাঁ বলতে গিয়েও না বেরোলো আরাবের মুখ দিয়ে।দোয়া বারান্দায় দাড়িয়েছে। দেওয়ালের এপার থেকে দেখা যাচ্ছে ওকে।আরাবের চট করেই বোনজামাইয়ের কথা মনে পরে গেলো।ফোন লাগালো ড.মুফতাহিরের নাম্বারে। ফোনটা রিসিভ হলে বললো,

-হ্যালো?ভাইয়া?আমি আ্….

-আরাব!তুমি কি মানুষ?সবাই মিলে পাগল হয়ে যাচ্ছি তোমার চিন্তায়!আর তুমি?পুরো আঠারো ঘন্টা পর তোমার মনে পরলো আমাদের কথা?মা তো….

চোখ বন্ধ করে কথাগুলো হজমের চেষ্টা করলো আরাব। দোয়া ওর চেহারা দেখেই বুঝলো,কেউ ফোনের ওপার থেকে ঝারছে ওকে।নিজেকে শক্ত করে নিলো ও। আরাব চলে যাবে এখনি। ওর বিষয়ে আর একবিন্দুও মাথা ঘামাবে না ও। জোরে শ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসলো বাসা থেকে। সদর দরজার সামনে দিয়ে আরাবকে পাস করে চলে যাচ্ছিলো,অরুনাভ মুখার্জী ডাক লাগিয়ে বললেন,

-দোয়া? যাসনি তুই এখনো? আজকে দেরি কেনো হলো?

দোয়া থামলো। বোনজামাইয়ের কথা শুনতে শুনতে দোয়ার আগমনকেই লক্ষ্য করছিলো আরাব। এবার ওর শুনানোর পালা।দোয়া কিছু বলে ওঠার আগেই উচু আওয়াজে বলতে লাগলো,

-ওওও!তারমানে রায়নগরের মুখার্জী বাড়ি থেকে বাসা খুব একটা দুরে না তাইতো?

কপালে ভাজ ফেলে আরাবের দিকে তাকিয়ে রইলো দোয়া। বাসা দুরে না মানে? ঢাকার কোথায় থাকে আরাব?এ মহল্লা তো শহরের একপ্রান্তেই বলা চলে। যেখানে খুশি বাসা হোক আরাবের। তাতে ওর কিছুই না। নিজের প্রতি করা সে মনোভাবকে অটুট রেখে অরুনাভ মুখার্জীকে লক্ষ্য করে বললো,

-আগের টিউশনিটায় ছুটি আজ কাকাবাবু।বাকিদুটো আছে।তাই দেরিতেই বেরিয়েছি।

-ও।আরাবকে….

-বেশ অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে কাকাবাবু।আসছি।

চলে গেলো দোয়া। আরাবদৃষ্টি স্থির করে রইলো ওর চলে যাওয়ার দিকে। দোয়া চোখের আড়াল হতেই আরাব ফোনে শান্ত গলায় বললো,

-রায়নগর মুখার্জী বাড়িতে গাড়ি পাঠাও ভাইয়া।বাসায় ফিরবো।

কল কেটে দিলো আরাব।ভেতরটা কেমন যেনো ফাকা ফাকা লাগছে ওর।দোয়ার বাই,খোদাহাফেজ এমন কোনো কথা‌ আশা করেনি ও।তবুও মনে হলো,ওর মুখে ওর জন্য এরকম কোনো কথা শুনতে পারলে বড্ড শান্তি লাগতো ওর।পরপরই আনমনে হাসলো।এভাবে কোনোদিন তাহসানুল আরাব শান্তিকামনা করেনি!আজই প্রথমবার!দোয়ার জন্য! অরুনাভ মুখার্জীর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো,

-কাকাবাবু,আপনাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য আবারো দুঃখিত।

-এসব কি বলছো আরাব?তুমি আমার আতিথীয়তা গ্রহন করেছো,এই শ্যাওলাপড়া দেওয়ালের মাঝে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছো,এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া ছিলো।আশীর্বাদ করি,জীবনে অনেক ভালো কিছু করো।আর হ্যাঁ,এরপর থেকে বাইক সাবধানে চালাবে।আর তোমার কাগজপত্রগুলো কারা নিয়ে গেছে,তাদের খুজে বের করার কথাও ভুলো না।লোকগুলো খুব মেরেছিলো সেদিন তোমাকে।দোয়া না বললে তো…

থেমে গেলেন অরুনাভ মুখার্জী।কথা শেষ করার অনুমতি দোয়া তাকে দেয়নি।এটা জানে আরাব।এটাও বুঝে গেছে,ওর জীবনে দোয়া,দোয়া হয়েই এসেছে।তাইতো সেদিন জীবন বেচে গিয়েছিলো ওর।তাইতো আজ এতোগুলো মিষ্টি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে ও।বাকি রইলো কাগজপত্র আর ওর উপর এটাকারের কথা,সেটা ও একদমই ভোলেনি।ঠিক বের করবে এসবের হোতা কে!আপাতত ওর ভাবনাজুড়ে অন্যকিছুরই বিচরন।

মুচকি পেছন ফিরে পকেটে হাত গুজে বাড়িটার দিকে তাকালো।এই চিলেকোঠায় আসার পর থেকে হাজারটা অভুতপুর্ব,কতো সুন্দর অনুভুতি ঘিরে ধরেছে ওকে।কথায় বলে,দুরুত্ব নাকি অনুভবকে জোরালো করে।তাই বাস্তবে পরখ করে নেবে আরাব।সে অনুভুতিগুলোকে নিয়ে বেরিয়ে তো যাচ্ছে,পরিনতি খুজবে বলে।কিন্তু কি তার পরিনতি?ক্ষনিকের ভালোলাগা?যা দুরুত্বের সাথে লোপ পাবে?নাকি ভালোবাসা?যা চিরতরে রাঙাতে চলেছে ওকে!

গাড়ি ছুটে চলেছে স্বাভাবিক গতিতে।জানালা দিয়ে আরাব বাইরে তাকিয়ে রয়েছে।যেগুলোকে পিছনে ফেলে সামনে এগুচ্ছে ও,সেগুলোকে না ভুলে আরো মস্তিষ্কে বসিয়ে নিচ্ছে যেনো।ঠোটের কোনে মুচকি হাসি।যতোটা দুরে সরে যাচ্ছে,এই চিলেকোঠায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।চোখ বন্ধ করলে সেই মায়াময় চেহারাটাই দৃশ্যমান হচ্ছে।আর চোখ খুললে চারপাশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে।বেশ অনেকটা সময় পর নিরবতা ভেঙে মুফতাহির বললো,

-এভাবে চুপ করে আছো কেনো শালাবাবু?

-কাউকে নিয়ে ভাবতে ভালোলাগছে ভাইয়া।

মুফতাহির ভ্রুকুচকে তাকালো।শ্যালকের মুখে এমন কথা শোনা আর অমাবশ্যার চাঁদের দর্শন পাওয়া তার কাছে একই কথা।আরাব বরাবরই ভ্রমনপ্রেমী।ওর জীবনে ভালোলাগা বলতে ল্যাবের এক্সপেরিমেন্ট আর ঘোরাঘুরি।ল্যাবের কাজে ফাকফোকর পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে যায়।আগেরদিনও সে ওকে বলেই বেরিয়েছিলো,শীতের শুরুটা সাজেক থেকেই করে আসবে।তাই অতোটা ব্যস্ত হয়নি কেউই।ওর ফোন পেয়ে,রায়নগরের মুখার্জী বাড়ির কথা শুনে সে নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছিলো।তাই চেম্বার রেখে গাড়ি নিয়ে চলে আসে ওকে নিতে।আরাবের হাতেপায়ে কাটাছেড়া দেখে জিজ্ঞাসা করাতে এক্সিডেন্টের কথা বললো ও।অরুনাভ মুখার্জীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পরে দুজনে।সবটা স্বাভাবিকই ছিলো।কিন্তু আরাবের এই কাউকে নিয়ে ভাবার বিষয়টা ওর কৌতুহল না বাড়িয়ে পারলো না।মুফতাহির গাড়িতে ব্রেক কষে বললো,

-আরাব?আমি কি ঠিক শুনলাম?

-একদম সঠিক কম্পাঙ্কে ঠিক শুনেছো!গাড়িটা স্টার্ট দাও।স্থির দশা চিন্তাশক্তিতে আঘাত হানছে।

হেসে দিলো মুফতাহির।আরাব এমনই।যখন নিজের দুনিয়ায় ডুবে থাকে,ওর কথাবার্তাও ওর বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের রুপ নেয়।গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বললো,

-তা কাকে নিয়ে ভাবছো তুমি?

-যে আমাকে তাকে নিয়ে ভাবার অধিকার দেয়নি,তাকে নিয়ে।

আবারো হেসে দিলো মুফতাহির।আরাবের হেরফের নেই।ও‌ নিজের মতোই ওর ভাবনায় ডুবে আছে। প্রতিবার দমকা হাওয়া খুজে পাচ্ছে দোয়ার সেই ঢেউখেলানো চুলের চঞ্চলতা।হাতের দিকে তাকালে প্রতিটা মুহুর্তে মনে পরছে,নিজহাতে ওই চুল খুলে দিয়েছিলো ও।নিজের দিকে তাকালে টিশার্ট পরানোর সময় দোয়ার ইতস্তত ভাবের চেহারাটা মনে পরছে ওর।ঝাকিতে কিছুটা ব্যথার আবেশে চোখ বন্ধ করলেই মনে পরছে,সে ক্ষতগুলোতে দোয়ার স্পর্শ আছে।মুফতাহির ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ রেখে বললো,

-তো আরাব?যে তোমাকে ভাবার অধিকার,ইনফ্যাক্ট সবকিছুর অধিকারই‌ দিতে চায়,তাকে নিয়ে কি ভাবলে?

আরাবের মেজাজের ঘন্টা বেজে গেলো।চরম বিরক্তি নিয়ে তাকালো মুফতাহিরের দিকে।বললো,

-এখনই এইসব বলতে হবে?

-তো কি করবো?তোমার বোনের এই জুনিয়র,তোমার প্রেমে ঠিক কিভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে,তার রচনা শুনতে শুনতে আমার সাংসারিক জীবনের অর্ধায়ু শেষ শালাবাবু!জারা তো কাল বিকেলে আমার চেম্বারে অবদি চলে এসেছিলো,তুমি কোথায় গেছো জানতে।কোনোমতে জানলে এতোক্ষনে জারাও‌ সাজেক পৌছে যেতো।

আরাব চুপ রইলো।জারা মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী।বাবার টাকায় প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াশোনা করছে।সবদিকেই ঠিক আছে,তবে দোষ বলতে শুধু ওই‌ একটাই।যেকোনো মুল্যে ওর আরাব চাই!আর এটাই আরাবের ওকে ভালো না লাগার কারন।বিষয়টা ওর মা আর বোন তৌফিকা বুঝলেও,বাবা আর বোনজামাই মুফতাহির মানতে নারাজ।তাদের মতে,আরাবের জন্য নাকি জারা পার্ফেক্ট।আর তাদের সাহচর্যে জারারও বেশ ভালোমতোই ওদের পরিবারে জায়গা করে নিয়েছে।একটা জোরে শ্বাস ফেলে বাচ্চাদের মতো করে বলে উঠলো,

-এই ঝামেলাকে ডিরেক্ট রিজেক্ট করেছিলাম।তারপরও এমন ছেচড়ামি করলে,আমার কি করার আছে?

-বাহ্!শিল্পপতি তৌহিদ ওয়াহিদের একমাত্র উত্তরসুরী তাহসানুল আরাবের করার কিছু নেই?এটাও শুনতে হলো আমাকে?

-প্লিজ ভাইয়া,স্টপ দ্যাট উত্তরসুরী টপিক!

-বেশ,ওই টপিক বাদ।কিন্তু আরাব,তোমার মা বাবার একমাত্র ছেলে তুমি।ওভাবে হুটহাট উধাও হয়ে গিয়ে কি পাও বলোতো?প্রতিবার অবশ্য ট্রিপে‌ যাও,পৌছে জানিয়ে দাও,মানলাম।কিন্তু এবার তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো আরাব!পুরো আঠারো ঘন্টা যোগাযোগের বাইরে ছিলে তুমি!তুমি ভাবতে পারছো,মা বাবা,তৌফিকা মনে ঠিক কি চলছে এই মুহুর্তে?

জানালায় মাথা ঠেকালো আরাব।চোখ বন্ধ করে আবারো ভাবনায় ডুব দিলো।জানে,মা,বাবা,আপু চিন্তা করছে।ওকে এই কাটাছেড়া অবস্থায় দেখলে তারা আরো কতোকমের কথা শুরু করবে,তারও ধারনা আছে ওর।তবুও সবটাই ভালোলাগছে।এক্সিডেন্ট,এটাক,সবটাই ওর ভালোলাগর অংশে জাগা করে নিয়েছে।এই মুহুর্তে ওর একটাই অনুভব,দোয়ার জন্য বাকিসব মানিয়ে নিতে পারবে ও!সবকিছু!

পড়ানো শেষে মৃত্তিকাদের বাসা থেকে বের হলো দোয়া।রাস্তার পাশের দোকানের দেয়াল ঘড়িটায় দেখলো ছয়টা আটাশ বাজে।কিন্তু মৃত্তিকাদের ড্রয়িংরুমের ঘড়িটায় বেরোনোর সময় দেখেছে ছয়টা ছয় বাজে।ওর কাছে ফোন বা হাতঘড়ি না থাকার এই একটা সুবিধা মৃত্তিকার আম্মুর।বাসার ঘড়িটার টাইম স্লো করে দিয়ে রেখেছেন উনি।যাতে আসল ঘড়ি দেখে ওর পৌছানোর তাড়া থাকে আর ভুল সময় দেখে পড়ার সময়টা বাড়ানো যায়।মানুষের চালাকির শেষ নেই।যে যখন যেভাবে বিপদে পরবে,কেউ না কেউ তার সে অসহায়ত্বের সুযোগ ঠিক নেবে।হাটতে হাটতে তাচ্ছিল্যে হাসলো দোয়া।

সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে এভাবেই বহুতল ভবনগুলোর মিটমিটে আলো দেখতে দেখতে বাড়ি পৌছে যায় দোয়া।আগের টিউশনিটায় মাহিমের আম্মুকে বলেছে,পারলে যেনো ওকে আরেকটা স্টুডেন্ট খুজে দেয়।সে হাসিমুখেই রাজি হয়েছে।কিন্তু মৃত্তিকার আম্মুকে বলতেই সে বলে উঠলো,”আমি কোথ্থেকে খুজবো দোয়া?তুমি নিজে গিয়ে কিন্ডারগার্ডেনের সামনে গিয়ে দাড়ালেই তো পারো।ওখানে অনেক গার্ডিয়ানরাই তো আসে!”

কথাটা প্রথমে তিক্ত লেগেছিলো দোয়ার কাছে।পরে মনে হলো,ভুল তো কিছু বলেন নি উনি।ওর জীবীকার খোজ তো ওর নিজেরই করা উচিত।কিন্তু স্কুলের সামনে দিয়ে যেতেই যে বুক ফেটে কান্না আসে ওর।দিয়ানের কথা ভেবে।ক্লাস ফোর থেকে পড়াশোনা আটকে গেছে ওর।বাবা মারা যাওয়ার পরও দোয়া চালিয়ে নিচ্ছিলো ওর পড়াশোনা,কিন্তু ওর ভেতরের অসুখটার জন্যই তো ডক্টর মানা করেছে ওর লাফধাপ।তাই চোখের আড়াল করেনি।মা বুঝেছিলো,অর্থসংকট।কিছু বলেনি।কিন্তু ভাইকে কিভাবে বুঝিয়েছে,তা ওই‌ জানে।লুকিয়ে অবাধ্য চোখের জল মুছলো।এই রাস্তার সবসময় মানুষের আনাগোনা।কিন্তু একাকী পথ চলাটা প্রতিদিন সব দুঃখকে মনে করিয়ে দেয় দোয়ার।সারাদিনের ব্যস্ততায় ভুলে থাকতে চাইলেও,এই রাস্তায় হাটতে হাটতে নিজের সমস্ত দুর্ভাগ্য আর তার পরিনতি‌ মনে পরে যায় ওর।ভাগ্যও চায়,বাস্তবতাকে মনে রেখে সবসময় যেনো ও নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকে।

-কি দোয়া?কোনো সবজি নিবা আইজ?

সবজি‌বিক্রেতা!এ কলোনির সবজিবিক্রেতার সাথে পরিচয় হয়ে গেছে দোয়ার।বাড়ি ফেরার সময় এখান থেকেই সবজি নিয়ে যায় ও কোনো কোনো দিন।মাথা নেড়ে মৃদ্যু হেসে না বুঝালো ও।লোকটা তার খালিপ্রায় গাড়িটা ঠেলে চলে গেলো।সবজি প্রায় সবই বেচা হয়েছে আজ তার।দিনশেষে হাতে দুটো রোজগারের পয়সা আসার মতো আনন্দের হয়তো আর কিছুই না।সে টাকায় ছোট্ট পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার মতো শান্তির আর কিছুই না।ভাবলেও তৃপ্তিতে মন ভরে যায়।কিন্তু দোয়ার দায়িত্ব তো শুধু সে অবদি নয়!ওর মা যে অসুস্থ্য,ভাই যে মরনরোগ সাথে নিয়ে বেচে আছে।ওদেরকে বাচাতে হবে।ওদের নিয়েই তো ও বেচে আছে!

-এইযে দোয়া মিস!

অচেনা গলা শুনে চোখেরজল মুছে পেছন ফিরলো দোয়া। মাস্ক পরিহিত এক লোক।আবছা অন্ধকারে ঠিক চিনে উঠতে পারছে না লোকটাকে।মানুষটা এগোলো দোয়ার দিকে। মাস্ক খুলতেই দৃষ্টি প্রসারিত হলো দোয়ার। হাতে খামচে ধরলো কাধে ঝুলানো ব্যাগটা। পাশ ফিরে চলে আসতে যাবে,লোকটা পথ আগলে দাড়ালো ওর।বাকা হেসে নিজের গালে হাত বুলিয়ে বললো,

-ভাগ্নি আমার বড্ড বায়না করছে জানো তো‌ ম্যাডাম,দোয়া মিসকে এনে দাও! দোয়া মিসকে এনে দাও!কি করা যায় আপনিই বলুন তো দোয়া মিস?

-পথ ছাড়ুন!

-চড়টার কথা ভুলে গেলে দোয়া?ওটার পাওনা নেবে না?

আশেপাশে তাকালো দোয়া।রাস্তায় লোকজন আছে।তারপরও এই লোক এভাবে কথা বলছে দেখে খানিকটা দমে গেলো ও।পরপরই‌ একটা শ্বাস নিয়ে বললো,

-দেখুন,আপনি আপনার বাজে কথার জন্য সাজাটা পেয়ে গেছেন।আপনার সাথে আর কোনোরকমের কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই।আমাকে যেতে দিন।

লোকটা আবারো হাসলো।পরপরই দাতে দাত চেপে বললো,

-যদি না দেই?

-মানে?

-মানে বুঝতে মন বোঝা দরকার দোয়া!তুমি তো আমার মনটাই বুঝলে না।না বুঝে চড় মেরে‌ দিলে।কি এমন ক্ষতি হতো আমার কাছে আসার জন্য রাজি হয়ে গেলে হুম?এখন আমার মন বোঝানোর জন্য যদি তোমাকে জবরদস্তি করতে হয় তো….

-দেখুন,সেদিন আপনার কথায় রাগের বশে গায়ে হাত তুলেছিলাম।ওই টিউশনি আমি ছেড়ে দিয়েছি।আপনাকে আর আমার মুখোমুখি হতে হবে না।প্লিজ বিষয়টাকে আর বাড়াবেন না!আমি…

-বাড়াবো!আরো বাজেভাবে বাড়াবো!রনোকের গায়ে হাত তোলার মুল্য তো তোমাকে দিতে হবে দোয়া ম্যাডাম!আমার বোনকেও অপমান করতে ছাড় দাওনি তুমি।সবটা শুধু চুইচাপ দেখেছি।বাট ইউ উইল হ্যাভ টু পে!

বেশ অনেকটা চেচিয়ে বললো রনোক।পাশের পথচারী এক মহিলা একটু তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন।দোয়া বড়বড় চোখে তাকালো।মানুষটা এখনো এভাবে রাগ পুষে রেখেছে ভাবতেই কিছুটা ভয় কাজ করতে লাগলো ওর ভেতরে।রাগটা কমিয়ে রনোক আবারো বললো,

-শোনো দোয়া,একটা ফোনকল!জাস্ট একটা ফোনকলে তোমার সর্বস্ব হরন হয়ে যাবে!এই রাস্তায় দুচারজনকে দেখে এতোটা আস্বস্ত হয়ো না।কেউ টেরটিও পাবে না,কখন কিডন্যাপার এলো,আর মেয়েটা উধাও হয়ে গেলো!

দোয়া ঘাবড়ে গেছে।তবুও গলা নরম করে বললো,

-দেখুন,আপনি আমার‌ বয়সে বড়।আমি চাইনা আর কোনো ঝামেলা…

-ভয় পেয়ছো ভাগ্নির ম্যাডাম?ভয় পাও!তুমি আমাকে চড় মেরেছো না?আমিও মারবো তোমাকে!ভয়ে ভয়ে মেরে ফেলবো!আজ থেকে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার প্রতিমুহুর্তে ভয় পাবে তুমি!এই বুঝি রনোক এসে তোমায় তুলে‌ নিয়ে যায়!এই বুঝি রনোক তোমাকে এই কোলাহলপুর্ন রাস্তা থেকে জনশুন্য জায়গায় নিয়ে যায়!এই বুঝি রনোক তোমার দেওয়া থাপ্পড়টার জবাব উশুল করে…তোমার পবিত্রতার বিনিময়ে!ভয় পাও তুমি!ভয় পাও!

আঙুলতাক করে কথাগুলো বলে গালে হাত বুলাতে বুলাতে চলে গেলো রনোক।জলভরা চোখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া।কর্মজীবী মেয়েদের জীবনে ঠিক কতোরকমের মানুষের সাথে লড়াই করে বাচতে হয়,তার ধারনা নিয়েই বেচে আছে ও।নিজেকে খুব শক্তভাবে প্রস্তুতও করেছে।কিন্তু আজ অবদি এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি ওকে।অরুনাভ মুখার্জী অনেকটাই আগলে রেখেছিলেন ওকে।কিন্তু আজ?আজকে রনোক যা বলে গেলো,সে ভয়টা কি ফেলনা?সত্যিই কি এ ভয় ঘিরে ধরবে না ওকে?

#চলবে….

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here