এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -৭+৮+৯

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৭

“রংধনু”…
সুবিশাল বাড়িটার গেইটে বড়বড় লেখাটা সব পথচারীরই নজর কাড়ে।নামের মতোই বাসাটাও যেনো এক কাল্পনিক রঙিন পৃথিবী।দ্বিতল ভবনের সামনের দিকটায় সুবিশাল ব্যালকনি,নিচে হাজাররঙের ফুলে ছেয়ে থাকা বাগান,পার্কিং এরিয়ায় দুটো গাড়ি,তিনটে বাইক,পশ্চাৎ অংশে নীল স্বচ্ছ পানির সুইমিংপুল।আভিজাত্যের ছাপ প্রতিটা কোনায় কোনায়।গেইটের পাশের দেওয়ালে সোনালী নেইমপ্লেটে লেখা তৌফিক ওয়াহিদ নামটা তার কর্মক্ষেত্রের মতোই উজ্জ্বল।আরাবদের গাড়ি পৌছাতেই গেইট খুলে দিলো দাড়োয়ান।বাসার ঔদার্য চোখে পরতেই চোখ বাইরে থেকে সরিয়ে নিলো আরাব।গাড়ি থামালো মুফতাহির।বেরিয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালো আরাব।খোড়াচ্ছে,তবে চেহারা স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো।পেছন থেকে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে মুফতাহির বললো,

-কি শালাবাবু?পুরো একদিন নেটওয়ার্কের বাইরে থেকে বাসায় ঢুকছো,ভয় করছে না?

থেমে গিয়ে বাকা হাসি দিলো আরাব।মানেটা জানে মুফতাহির।মাথা নেড়ে হেসে বললো,

-হ্যাঁ হ্যাঁ,তোমার আপুকে বলেছি আসতে।এসেও গেছে সে রংধনুতে।ফিকার নট!জীজু পেয়েছো মনের মতো।তোমার মনের সব কথা বলার আগেই বুঝে যায় সে!তবুও দেখো!আজ তোমার বোনই তোমাকে বাসায় ঢুকতে দেয় কি না!

আরাব হেসে‌ এগোলো বাসার দিকে। আরাবের বড় বোন থাকলে‌ সবটাই ম্যানেজ করে নেবে।কোনো ঝামেলাই হবে না।তাই আগেই মুফতাহিরকে বলে রেখেছে,সিচুয়েশন বুঝে যেনো তৌফিকাকে এ বাসায় পাঠিয়ে দেয়।দরজা খুলে উকিঝুকি দিলো ভেতরে।দুটো সার্ভেন্ট ছাড়া কাউকে দেখতে পেলো না তেমন।চোরের মতো ভেতরে ঢুকে সবে পেছন ফিরে মুফতাহিরের দিকে বিশ্বজয়ের হাসি দিয়েছে,ওর বা কানটা যেনো সর্বশক্তিতে ধরে ফেললো কেউ।কানমলা খেয়ে‌ অসহায়ের মতো আউচ্ শব্দে পেছন ফিরলো আরাব।

-আউচ্ না?আউচ্?আজ তোর সব আউচ্ বের করে দেবো আমি!

তৌফিকা আরো জোরে কান ধরলো আরাবের।তৌফিকা আইরাত।তৌফিক ওয়াহিদের বড় আর একমাত্র মেয়ে,তার চোখের মনি।আরাবের মতো ওর নামেরও পরের অংশটাই ডাকনাম হতো।কিন্তু তাতে তৌফিক ওয়াহিদের ঘোর আপত্তি।তার মেয়ের ডাকনাম তার নামেই হবে।বেসরকারী মেডিকেল থেকে ডাক্তারী শেষ করলো।মুফতাহিরের সাথে সেখানেই‌ দেখা।তারপর প্রেমের বিয়ে।শুরুর দিকে মুফতাহিরের পারিবারিক পরিচিতি নিয়ে বিয়েতে খানিকটা অমত ছিলো তৌফিক ওয়াহিদের।পরবর্তীতে মেয়ের খুশির জন্য সবটা হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন উনি।মুফতাহিরও এখন এস্টাব্লিশড্!সবমিলিয়ে,সুখেই আছে ওরা।

-আহ্ আপু!কান ছাড়!তোর ভাইয়ের কি এখনও আর কান ধরার বয়স আছে?আ্…তুইই বল!আআআআ!

-নানু!ও নানু!নানুভাই!এসে দেখে যাও!তোমাদের মেয়ে আমার মামার কান ধরেছে!আম্মু মামার কান ধরেছে!কোথায় তোমরা?আসো?

চেচিয়ে পুরো বাসায় ঘটনার জানান দিতে লাগলো সুপ্তি।আরাবের কান ছেড়ে দিলো তৌফিকা।বললো,

-দেখো টুইঙ্কেল,আজ তুমি আমার আর তোমার মামার মাঝে আসবে না!আজ তোমার মামাকে পিটুনি দিয়ে সোজা বানিয়ে তবেই ছাড়বো!

-না আসবো!তুমি বকবে কেনো ‌মা‌মাকে?আমার ‌মামা,বেস্ট ‌মামা!তুমি মামাকে একদ‌ম বকবে না বলে দিচ্ছি!

কোমড়ে হাত দিয়ে ওরদিকে তাকিয়ে রইলো তোফিকা।মেয়েটা বড্ড পাকাপাকা কথা বলে।শাষন করার নামে শোষন চালায় রংধনুতে।সুপ্তিকে আদর করে সবাই টুইঙ্কেল বলেই ডাকে।এইবার ক্লাস টু তে পরে ও।মুফতাহির এগিয়ে এসে বললো,

-এইতো!শালাবাবুর রিয়েল পাঙ্খা!টুইঙ্কেল,আম্মুকে বকে দাও তো!টুইঙ্কেলের আরাব মামার কান ধরেছিলো!ভাবা যায়!কত্তোবড় সাহস তোমার তৌফিকা!

ঠোট উল্টে আরাব কানে হাত বুলাতে লাগলো।তৌফিক ওয়াহিদ আর তার মিসেস বেরিয়ে এলেন টুইঙ্কেলের হাকডাক শুনে।আরাবকে দেখে একপ্রকার ছুটে আসলেন মিসেস ওয়াহিদ।ওর কপালের সেলোটেপটা ছুইয়ে ব্যস্তভাবে বললেন,

-এটা কি আরাব?কি হয়েছে তোর?কিভাবে কেটে গেলো?এমন দেখাচ্ছে কেনো তোকে?ফোন রিসিভ করিসনি কেনো আমার কাল থেকে?মুফতাহির বললো সাজেক যাচ্ছিস।তা বলে ফোন রিসিভ করবি না?এটা কোনো কথা?

আরাব মুচকি হেসে মাকে জরিয়ে ধরে বললো,

-আমি ঠিকাছি মা।একটু শান্ত হও!

মিসেস ওয়াহিদ আরো ব্যস্তভাবে বললেন,

-কোথায় ঠিক আছিস তুই?হাতে এতোগুলো স্ক্র্যাচ কেনো?কি হয়েছিলো তোর?

আরাব কিছু বলার আগেই তৌফিক ওয়াহিদ বললেন,

-কোথায় ছিলে তুমি আরাব?সাজেক তো যাওনি রাইট?

টুইঙ্কেল দৌড়ে গিয়ে আরাবের কোলে উঠতে যাচ্ছিলো।কিন্তু ওর আঘাতের জন্য মুফতাহিরই এগিয়ে কোলে তুলে নিলো ওকে।তারপর ফিসফিসিয়ে বললো,

-মামার একটু লেগেছে টুইঙ্কেল।তুমি পরে কোলে উঠো কেমন?আমরা এখন গিয়ে গেট ওয়েল সুন ড্রয়িং করি মামার জন্য?

টুইঙ্কেল উচ্ছাসিতভাবে হ্যাঁ বুঝালো।ওকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো মুফতাহির।মাকে ছেড়ে আরাব সোজা হয়ে দাড়ানোর চেষ্টা করলো।খুড়িয়ে একপা এগিয়ে বললো,

-আসলে বেরিয়েছিলাম সাজেকের উদ্দেশ্যেই।কিন্তু যাওয়ার পথে কাল একটা ছোটখাটো এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।তাই…

আরাবকে শেষ করতে না দিয়ে তৌফিকা পাগলপ্রায়ভাবে ছুটে এসে ওর গালে মুখে হাত দিয়ে বললো,

-কি বলছিস কি তুই আরাব?তোর এক্সিডেন্ট হয়েছিলো?কোথায় লেগেছে ভাই?দেখা আমাকে?কোথায়…

দুমিনিট আগে কানমলে দেওয়া বোনই এমন করতে পারে ভেবে মুচকি হাসলো আরাব।কিন্তু ওকে তো সামলানোর দায়িত্বে রাখতে চেয়েছিলো আরাব।তা বোধহয় হলো না।মিসেস ওয়াহিদ কেদে দিলেন এবার।বললেন,

-এজন্যই এতো কাটাছেড়া!আমি জানতাম,কাল তুই বাসা থেকে বেরোনোর পরপরই আমার মন কেমন করছিলো।আমার তো…

আরাব তার হাত মুঠো করে নিয়ে বললো,

-মা!প্লিজ শান্ত হও।বাইকটা থেকে পরে গিয়েছিলো শুধু!আর আপু?তুই না ডাক্তার?দেখছিস না,শুধু হাতেপায়ে কিছু কাটাছেড়া আছে।তাছাড়া তো…

-আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি আরাব!

তৌফিকার এবার কড়া গলা।একটু দমে গেলো আরাব।মাথার পেছনদিকে যে আঘাতটা আছে,ওটাতে যথেষ্ট ব্যথা।সবার চোখ এড়ালেও তা তৌফিকার চোখ এড়ায়নি,তা বুঝেছে ও।একটু জোর করে হেসে মা বোন দুজনকেই সোফায় এনে বসালো আরাব।কোনোমতে ওদেরকে শান্ত করে অজ্ঞান হওয়া আর অরুনাভ মুখার্জীর আতিথীয়তার কথা বুঝিয়ে বলে।সবটা শুনে তৌফিক ওয়াহিদ তার গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,

-তোমাকে কতোবার বলেছি আরাব,বাইক না নিয়ে গাড়ি করে বেরোও।গাড়ি নিয়ে গেলে এমনটা ঘটতো না তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?

আবার মৃদ্যু হেসে বললো,

-বাবা,তোমার বিলাসবহুল মডেলের গাড়ি তোমার এই রাজকীয় বাসার গ্যারেজেই মানায়।আমাকে না।আমি ওই নিজের টাকায় কেনা অল্পদামী বাইকেই তুষ্ট।এক্সিডেন্টটা আমার বেখায়ালীপনার জন্য হয়েছে।বাইকের কি দোষ?

-কেনো বেখেয়ালি হয়ে থাকো তুমি বলোতো আরাব?কিসের অভাব তোমার?তোমাকে বলেছিলাম অফিস জয়েন করতে।ইন্ডাস্ট্রির দায়িত্ব নিতে।নাও নি!আমি আর কতোদিন সামলাতে পারবো আরাব?এই ভরপুর বিজনেসের উত্তরাধিকার বলতে,তুমি ছাড়া আর কে আছে?এই দায়ভার তুমি না নিলে কে নেবে?এতোসব ছেড়ে,সরকারী বেতনভুক্ত সাইন্টিস্ট হিসেবে,শুধুশুধু ল্যাবে ওইসব এক্সপেরিমেন্টের ভীড়ে পরে থাকার কোনো মানে তো আমি খুজে পাই না আরাব!

প্রতিটা কথায় বিজনেসে জয়েনের কথা বলাটা ওর বাবার অভ্যসে দাড়িয়েছে,এটা জানে আরাব।মাথা নিচু করে মুচকি হেসে বললো,

-যেটা তোমার কাছে শুধুশুধু,সেটা আমার ড্রিমজব বাবা। পড়াশোনা শেষ করে স্বেচ্ছায় বায়োমেডিতে জয়েন করেছি।আমার লাইফ এই এক্সপেরিমেন্টের ভীড়েই এক্সাইটিং হয়ে উঠেছে বাবা।নয়তো,তোমার কিন্তু সময় কমই ছিলো,আমার ইচ্ছা কি তা জানার,আমার ক্যারিয়ার কিভাবে চাই,তা জানার!

-হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ক্যারিয়ার আরাব?আমি এসব তবে কার জন্য করছি?এই বিষয়সম্পত্তির মালিক বলতে তো তুমিই!তবুও কেনো তোমার এসবে…

তৌফিকা শক্তভাবে বললো,

-বাবা,মেডিকেলে চান্স না পাওয়ার পরও আমাকে আমার স্বপ্নপুরনের জন্য তুমি আমাকে প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি করালে।এখন আরাব যখন ওর ড্রিমজব নিয়ে ক্যারিয়ারে এগোতে চায়,তোমার তাতে এতোটা আপত্তি কেনো বলোতো?তোমার এ বিষয়সম্পত্তি তো এখনই উবে যাচ্ছে না তাইনা?

তৌফিক ওয়াহিদ বিরক্তি নিয়ে অন্যদিক তাকালেন।মিসেস ওয়াহিদও মুখ খুললেন এবার।বললেন,

-ঠিকই বলেছে তৌফিকা।এখন এইসব কথা বলতে হবে তোমার?ছেলেটার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো!এখন এসব কথা কেনো তুলছো তুমি বলোতো?

-তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না বাবা?এই টাকাপয়সার হিসেব কষে আমরা আমাদের লাইফের উপভোগ্য সময়টা হারিয়ে ফেলছি?

মেয়ের কথায় উঠে দাড়ালেন তৌফিক ওয়াহিদ।ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-এই পৃথিবীতে টাকাই সব!প্রতিপত্তিই সব!যদি টাকা না থাকে,তবে এই উপভোগ্য সময়কেই তোমার বিষাক্ত লাগবে তৌফিকা!আমি চাইনা ভবিষ্যতের কোনো এক সময়কে আমার সন্তানরা বিষাক্ত বলে মনে করুক।মানো,বা নাই মানো,এসব যেদিন কাজে লাগবে সেদিন আমার কথার গুরুত্ব ঠিকই অনুভব হবে তোমাদের।

কথাগুলো বলে চলে গেলেন তৌফিক ওয়াহিদ।আরাব কিছুই বললো না।বাবার এ মতবাদ ওর চিরচেনা।সবারই এটা গা সওয়া হয়ে গেছে যাকে বলে।মিসেস ওয়াহিদ বললেন,

-যা!ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হ!আমি খাবার…

-না না!ও বাড়িতে খেয়ে এসেছি!

তৌফিকা বললো,

-তবুও,হিন্দু বাড়ির খাবার…

-রাধুনী মুসলমান।সবটাতে তার হাতের ছোয়া ছিলো আপু।

খানিকটা আনমনে বললো আরাব।বলেও হেরফের নেই ওর।আবারো দোয়ার কথা মনে পরে গেছে যে!শরীরটা ভালো নেই বলে আর কোনো প্রশ্ন করলো না তৌফিকা।মা,বোন দুজনে মিলে ঘরে পৌছে দিয়ে গেলো আরাবকে।তৌফিকা বলেছে একটুপর চেকআপের জন্য আসবে ও।রুমের দরজা লক করে খুড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়না পাস করে ওয়াশরুমে যাচ্ছিলো আরাব।কি মনে করে দুপা পেছনে ফিরলো।অতিকষ্টে টিশার্ট খুলে আয়নায় তাকালো।ছোটছোট কাটা জায়গাগুলোতে রক্ত জমাট বেধেছে।কোথাও‌কোথাও কালো ছোপ ছোপ দাগ।একহাতে উন্মুক্ত বুকের বা পাশটায় থাকা এক ক্ষতস্থানে হাত রাখলো আরাব।কি হলো ওর,তা ও নিজেও জানে না।আকাশসম আনন্দ জোয়ারে নিজেকে খুজে পেলো যেনো।হেসে দিয়ে চোখ বন্ধ করে হঠাৎই চিৎকার করে বলে উঠলো,

-আমার সবটাতে তুমি জরিয়ে গেছো দোয়া!সবটাতে!

-আহ্!

দোয়ার আর্তনাত শুনে ছুটে বারান্দায় আসলেন সালমা বেগম।টিউশনি থেকে ফিরে মাগরিবের কাজা নামাজটা সেরেই চুলোর কাছে গেছে ও।রাতের রান্নার করছিলো।বা হাতের কব্জি ধরে চোখ খিচে বন্ধ করে আছে দোয়া।চোখ দিয়ে পানি পরছে ওর।মাকে আসতে দেখে লবনের কোটোটা থেকে বেশ অনেকখানি লবন তুলে কব্জিতে লাগিয়ে অন্যদিক ঘুরে বসলো ও।সালমা বেগম ব্যস্ত হয়ে বললেন,

-কি হয়েছে দোয়া?কি হলো তোর?ওদিক কেনো ফিরে আছিস?এদিকে ঘোর?কি হয়েছে?

দোয়া ঠোট কামড়ে ফুপাচ্ছে।অন্যমনস্ক হয়ে খালিহাতেই চুলা থেকে পাতিল নামাতে যাচ্ছিলো ও।দুহাতে ধরার আগেই একহাতে ঘেষা লেগেছে বলে বাস্তবে ফিরছে।সালমা বেগম টেনে পাশ ফেরালেন ওকে।হাত দেখার জন্য টানাটানি শুরু করে দিয়েছেন উনি।”কিছু হয়নি,মা ছেড়ে দাও,মা যাওতো” বলে বলে দোয়াও অস্থির হয়ে পরেছে।সালমা বেগম অনড়।জোরাজুরিতে দোয়ার হাত সরাতেই দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় তার।কলিজা মুচরে ধরেছে যেনো কেউ তার।

দোয়ার হাতে কলমের মতো বড় আকারের কালশিটে দাগ। দুঠোট চেপে চোখ বন্ধ করে রেখেছে ও।সালমা বেগমের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। হুহু করে কেদে দিলেন উনি।লবনগোলানো জলে দোয়ার হাত চুবিয়ে দিয়ে দৌড় লাগাচ্ছিলেন নিচতলায়।অরুনাভ মুখার্জীর কাছ থেকে ওয়েন্টমেন্ট আনবে বলে।দোয়া মাকে আটকে দিলো।একটা শুকনো ঢোক গিলে নাক টেনে বললো,

-কাকাবাবুর আগের ওষুধগুলোর টাকা দেওয়া হয়নি মা।

সালমা বেগম আবারো ফুপিয়ে কেদে দিলেন।বললেন,

-তুই কি এভাবেই নিজেকে শেষ করে দিবি বলে ভেবে রেখেছিস দোয়া?একটুখানি মলম নিতে গেলে তোর কাকাবাবু টাকা চাইবে?যখন শুনবে তোর….

-কি দরকার মা?এমনিতেও কম দয়া তো নেইনি তার।কমঋনে তো ঋনী নই।এভাবে একটু একটু করেই তো এতোটা ঋনী হয়ে গেলাম তার কাছে।আরও কেনো ঋন বাড়াতে চাইছো?যেতে দেবো না আমি তোমাকে।ও এমনি সেরে যাবে।লবনগোলানো জলেই কমে গেছে জ্বালা অনেকটাই।

সালমা বেগম কাদছিলেনই।দিয়ানের কানে যায়নি এখনো কিছুই।এখন ওকে ডাকলে দোয়া আরো রাগ করবে।পাশের ঘরে তন্নি তৃষার গুনগুন পড়ার আওয়াজ আসছে।সালমা বেগম চোখ মুছে ডাক লাগালেন,

-তন্নি?তৃষা?এইদিক আয়তো!

হতাশার শ্বাস ফেললো দোয়া।আর রক্ষে নেই।ঘটলোও তাই।তন্নি তৃষা দুজনেই বেরিয়েছে।একছুটে গিয়ে অরুনাভ মুখার্জীকে ডেকেও এনেছে তৃষা।সে লোকটা চুপচাপ এসে সবরকমের মলম লাগানো,ব্যান্ডেজ করে দিয়ে লুকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো শুধু।দোয়াকে বকতে গেলে তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়।আরো কষ্ট হয় আদর করতে গেলে কিংবা শান্তনা দিতে গেলে।এখন কিছু বলতে গেলে দোয়াও তার চিকিৎসার টাকা নিয়ে কথা তুলবে,তাই কিছু বললেন না উনি।মায়ের কোলে মাথা রেখে মেঝেতে বসে রইলো দোয়া।আর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছেন সালমা বেগম।জানালা দিয়ে আসা খানিকটা হিমশীতল বাতাসে সেলাই মেশিনের সামনে থাকা সুতলির নিচে নড়াচড়া করতে থাকা কাগজটার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো দোয়া।ওটা আরাবের দেওয়া সেই কাগজটাই।চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো ওর।আজকেও ওর সেলাইয়ের কাজ করা হবে না।পরিবারের ভরনপোষনের জন্য উপার্জন ক্ষেত্রটায় আজকেও বাধা পরেছে।আজকেও তার কারন,আরাব!আরাবকে নিয়ে ভাবা!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৮

আরো একটি নব্যদিনের সুচনা।ফজরের আযান শুনেই ঘুম ভাঙলো দোয়ার।আস্তেধীরে উঠে বসে হাতটা পরখ করলো।অরুনাভ মুখার্জীর ওষুধ লাগানোতে ব্যথা কমেছে অনেকটাই।নামাজ শেষ করে হাড়িপাতিল উল্টেপাল্টে বুঝলো রাতে রান্না করা খাবার মুখে তোলে নি কেউই।দেরিতে রান্না হওয়ায় টকে যায়নি এখনো।ওগুলোই গরম করে খাওয়া যাবে।ওড়না কোমড়ে বেধে ব্যান্ডেজ করা হাতেই টেনেটুনে বারান্দায় চুলোর কাছে নিয়ে গেলো সব।এটাওটা করার সময় কয়েকবার উকি দিয়েছে মা ভাইয়ের ঘরে।দুজনের ঘুমন্ত মুখ দেখেই সকালটা প্রানবন্ত হয়ে গেলো দোয়ার।

একটু বেলা গরাতেই ধরফরিয়ে উঠে বসলেন সালমা বেগম।রাতে দোয়ার চিন্তায় ঘুমোতে দেরী হয়েছিলো তার।বিছানা ছেড়ে ছুটে বারান্দায় এসে দেখলেন দোয়া সবটা সেরে গুছিয়ে নিচ্ছে।খুব একটা বেলা হয়নি।এগুলো শেষ করতে দোয়া কতো সকালে উঠেছে তার আন্দাজ করলেন সালমা বেগম।এমনই করে দোয়া।আর তারজন্য তার অপরাধবোধ থাকে প্রতিবার।এগিয়ে যেতেই দোয়া হাতের কাজ সারতে সারতে বললো,

-উঠে গেছো?আজ আমার ভার্সিটি আছে মা।কখন ফিরবো ঠিক বলতে পারছি না।তবে এসে দুপুরের রান্না করার সময় করেই আসবো।তুমি কিন্তু একদম চুলোর কাছে আসবে না।আর ছোটুকে একদম উপরনিচ করতে দেবে না।পরেটরে গিয়ে ব্যথা পাবে।আর যদি পারি বাজারটাও….

-তোর হাত কেমন এখন?

দোয়া কাজ ছেড়ে মায়ের গলা জরিয়ে ধরলো।আদুরে গলায় বললো,

-ও তো রাতেই সেরে গেছে।তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলে,তখনই!

মেয়ের গালে আলতো করে হাত ছোয়াকেন সালমা বেগম।একটু চুপ থেকে দোয়া ব্যস্তভাবে বললো,

-চলো চলো,খাবে চলো।রাতে কিছুই খাওনি জানি।ওষুধটাও খাওনি তাইনা?চলো এবার।একসাথে খাবার খাবো।

মা মেয়ে মিলে গুছিয়ে নিলো খাবার।দিয়ান উঠে গেলে একসাথে খেয়ে নিলো তিনজন মিলে।আজ একটু আগে আগেই বেরোবে দোয়া।ভার্সিটি যাওয়ার আগে একবার আশেপাশের কিন্ডারগার্ডেন দুটোতে যাবে।নতুন টিউশনির একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে।তাই খাওয়া শেষ করেই খোপা করে রাখা চুলগুলো হাতেই ঝেড়ে কোনোমতে বিনুনি করে নিলো।সালমা বেগম বললেন,

-আচড়ালিও না চুলগুলো!

-আরে মা সময় নেই!তাড়া আছে!

-কেনো আপুনি?আজ এতো আগে যাবি কেনো তুই?

দোয়া এগিয়ে দিয়ানের নাক টিপে দিয়ে বললো,

-আজকাল আপুনির আগেপরে বেরোনোর হিসাব একটু বেশিই কষছিস না তুই ছোটু?

-তো কি করবো?তো তোর বিয়ে হয়ে গেলে তোর বরকে সুদেআসলে সবটা হিসেব করে বলতে হবে না আমার?

ভেতরটা ধক করে উঠলো দোয়ার।মা ভাইকে ছেড়ে দুরে থাকার কথা তো ও স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।বিয়ে তো আরো দুরের বিষয়।দিয়ানও তো কোনোদিন এভাবে বলে নি!আজ হঠাৎ বিয়ের কথা কেনো বললো ও?ধীরস্বরে বললো,

-ব্ বিয়ে মানে?

-আপুনি মা কাল…

ওকে বলতে দিলেন না সালমা বেগম।বললেন,

-বিয়ে মানে বিয়ে।ও্ ও কথার কথা বুঝিয়েছে।এমনি শুধু…দিয়ান?যা তো একটু,তৃষার কাছ থেকে….

-ওকে বলতে দাও মা!

-আরে,এসব তো…দিয়ান যাক তৃষাকে…

দোয়া চোখ বন্ধ করে কিছুটা কড়া গলায় বললো,

-কোথ্থাও যাবি না তুই ছোটু!বল কি বলছিলি !

-দোয়া…

সালমা বেগম আর বলতে পারলেন না।দোয়ার দিকে তাকিয়ে থেমে যেতে হলো তাকে।দিয়ান একটু চাপা গলায় আমতা আমতা করতে করতে বললো,

-আপুনি,মা অরুনাভ কাকুকে কালরাতে তোর জন্য সম্বন্ধের কথা বলছিলো।

ভাষাহীনভাবে মায়ের দিকে তাকালো দোয়া।দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টায় সালমা বেগম।আগেররাতে দোয়ার বিয়ের বিষয়ে অরুনাভ মুখার্জীকে বলছিলেন উনি।বেশ বুঝতে পারছেন,যতোদিন দোয়া এ সংসারে আছে,ততদিন তাদেরকে ছেড়ে নিজেকে নিয়ে ভাবার কথা ভাববে না ও।এক নতুন পৃথিবীই ওকে এ সংসারের তিক্ততা থেকে মুক্তি দিতে পারে।কিন্তু কথপোকথনের পুরোটাই যে দিয়ান শুনে নিয়েছে,তার ধারনা ছিলো না তার।দোয়া স্ম্লান গলায় বললো,

-এটা সত্যি মা?

-দোয়া আমি…

-হ্যাঁ বা না বলো মা।

-দোয়া…

-আমাকে শুধু এটা বলো তুমি সত্যিই কাল কাকাবাবুকে আমার সম্বন্ধের কথা বলেছো কি না?

-হ্যাঁ বলেছি!কি ভুল বলেছি দোয়া?ভুলটা কোথায় আমার?আর কতোদিন এভাবে এই সংসারের পিছনে পরে থেকে নিজেকে শেষ করে দিবি তুই?আর কতো!

মায়ের কান্নারত চিৎকারে চোখের জল বেরিয়ে আসলো দোয়ারও।দিয়ান মাথা নিচু করে এককোনে দাড়িয়ে।মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে,লুকিয়ে চুরিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে চায়ের দোকান,ইটখোলা,সাইকেলের গ্যারেজ কিংবা দর্জিদোকানে কাজ জুটিয়ে নিতে।ওর বয়সী কতো ছেলেরাই তো কাজ করে ওগুলোতে।ওউ‌ না হয় গেল!পড়াশোনার বাড়তি ঝামেলাও তো নেই ওর!কিন্তু দোয়ার নজর এড়িয়ে তা কখনোই সম্ভব না।তাই এভাবেই চুপচাপ চোখের সামনে বোনের সংগ্রাম,মায়ের আক্ষেপ দেখতে হয় ওকে।সালমা বেগম আবারো বলতে লাগলেন,

-তোর কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না দোয়া!আমাদের দুজনের জন্য কি না করছিস তুই!কিন্তু আর না!আর পাঁচটা মায়ের মতো আমিও আমার মেয়ের একটা গুছানো জীবন দেখতে চাই!একটা সুন্দর,সাজানো সংসার দেখতে চাই!যেখানে শান্তিতে,নিশ্চিন্তে থাকতে পারবি তুই!এই সংসারে তা সম্ভব না দোয়া!তোকে তো…

-আর কয়েকটা দিন সময় দাও আমাকে মা।বাবাকে দেওয়া কথার খানিকটা পালন না করে মরেও শান্তি পাবো না আমি।

শান্ত গলায় বললো দোয়া।সালমা বেগম জাপটে জরিয়ে ধরলেন দোয়াকে।দিয়ানও এসে জরিয়ে ধরেছে ওকে।কাদতে কাদতেই সালমা বেগম বললেন,

-এসব কি বলছিস তুই মা?কি বলছিস এসব?

-এ সংসারে নয়,তো দোয়া এ পৃথিবীতেও থাকবে না মা।কেনো বোঝো না তোমরা বলোতো?আমি যা,তা তো তোমাদেরই জন্য।কেনো এসব বলে বারবার পর করে দাও আমাকে?কেনো?

-দোয়া?মা আমার…আমিতো শুধু…

মাকে কথা শেষ করার সুযোগ‌ দেয়নি দোয়া।ব্যাগ কাধে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।মুখার্জীবাড়ি থেকে হেটে পনেরোমিনিটের পথ মেইনরোডটা।সরু গলির মতো এটুক রাস্তায় যানবাহন বলতে অটো,সবজিওয়ালার ঠেলাগাড়ি,সাইকেল আর রিকশা চলে।উচ্চবিত্তরা প্রাইভেট কার নিয়েও ঢুকে পরে।চোখের জল মুছলে কারো চোখে পরবে না তা!কাদতে কাদতেই স্টপেজে এসে দাড়ালো।ভার্সিটির বাস স্টপেজে থামতেই মাথা নিচু করে উঠে পরলো।মুল গন্তব্য…কিন্ডারগার্ডেন।আগে জীবিকার খোজ!জ্ঞানান্বেষন?তা নিয়ে ভাবার সময়টা কোথায়?

বিছানায় রাখা বাইকের চাবিটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে আরাব।মাঝখানে চার চারটে দিন বাসা থেকে,বলা চলে ঘর থেকেই বেরোয়নি ও।আজ বেরোবে।শার্টের হাতাটা টান মেরে আরেকটু উপরে তুলে চাবিটা হাতে তুলে নিলো আরাব।হুইস্টলিং করে বেরোতে যাবে রুম থেকে,গলার দিকে খোলা বোতামজোড়ার ফাকে দৃশ্যমান ক্ষতটা আয়নায় দেখে থেমে গেলো।ঠোট কামড়ে আবারো হেসে হাত বুলিয়ে দিলো মৃদ্যুভাবে।

-ব্যথা আছে এখনো?

তৌফিকার গলা শুনে পেছন ফিরলো আরাব।সত্যিই এসেছে ও।সেদিন এসে ওরা পরদিনই চলে গিয়েছিলো।বোনের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে বললো,

-আরে আপু?কখন আসলি তুই?

তৌফিকা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

-সবেই এসেছি।

-টুইঙ্কেল কোথায়?

-আসেনি।মুফতাহির ওকে নিয়ে বেরিয়েছে।ডে শিফট আজ দুজনেরই অফ।

-তো এখানেই আসতে বলতি ভাইয়াকে!

আরাবকে আপাদমস্তক দেখে নিলো তৌফিকা।বিছানায় বসে বললো,

-ওসব ছাড়!বললি না?ব্যথা আছে আরো?

-আরেহ্ না!টোটাল চারদিন কুয়োর ব্যাঙের মতো ঘরে পরে আছি।একঘরে হয়ে থেকে এতোটা বোরিং অবস্থা যে,ব্যথাই বিরক্ত হয়ে ছেড়ে চলে গেছে!

হাত দিয়ে ওকে বিছানায় বসার জন্য ইশারা করলো তৌফিকা।দেরি হবে ভেবে মন খানিকটা দমে যাচ্ছিলো আরাবের।তবুও তৌফিকার গাম্ভীরতায় একটু নজরসরু করতে বাধ্য হলো ও।জোর করে হাসি টেনে পাশে বসলো তৌফিকার।তৌফিকা নির্লিপ্ত ভঙিমায় বলে উঠলো,

-প্রেমে পরেছিস?

এমন সোজাসাপ্টা প্রশ্ন তৌফিকাকেই মানায় ভেবে মুচকি হাসলো আরাব।তৌফিকার উত্তরটা বুঝে নিতে খুব একটা কষ্ট হয়নি।খুশির উচ্ছাস বেরিয়েই আসছিলো।তবুও উচ্ছাসিত হওয়াটা আটকে দিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো,

-প্রেমে পরেছিস তা আমার কাছে লুকোচ্ছিস কেনো?

আরাব আরেকটু হেসে ওর সামনে হাটুগেরে বসলো।এ কয়দিনে ওর ভেতরটা যে দোয়ার নামেই শ্বাস নিয়েছে,তা বেশ ভালোমতোই অনুভব হয়েছে ওর।হ্যাঁ,ভালোবাসে ও‌ দোয়াকে।জীবনের প্রথমবার হওয়া এই প্রেমের অনুভব,কোনোভাবেই মিথ্যে হবার নয়।আরাব তৌফিকার হাতদুটো মুঠো করে নিয়ে বললো,

-লুকাই নি আপু।বরং এখন তোদেরকে বা ওকে,বলাটা কতোটা ঠিক তা বুঝে উঠতে পারছি না।

-মানে?

-পরে বলবো।তুই আগে এটা বল,তোর ভাই যে প্রেমে পরেছে,এটা তোর আন্দাজ ছিলো?নাকি মুফতাহির ভাইয়া…

-তুইতো জানিস আরাব,মুফতাহির কিছু লুকোয় না আমার কাছ থেকে।তবে তোর বিষয়গুলোতে আমার জিজ্ঞাসা করতে হয় ওকে।বাসায় আসার পর থেকেই তোর কেমন একটা অস্বাভাবিক বিহেভ নোটিশ করছি।তুই একটুখানি,না!বেশ অনেকটাই অন্যমনষ্ক।যদিও তোর কোনো ডিপ স্টাডির সময়েও এমনই করিস,তাই মা,বাবা,কেউই কিছু বলেনি তোকে।বাট আমার একটু আজব লাগছিলো।অসুস্থ্যতা যে তোকে বাসায় আটকে দিয়েছে,এটা মানাটা,আমার পক্ষে পসিবল না।তাছাড়া যে টুইঙ্কেল বলতে কিনা আরাব পাগল,তাকে অবদি সময় খুব কমই দিয়েছে।এজন্যই চলে গিয়েছিলাম আমরা।তোকে সময় দেবো বলে। মুফতাহিরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,ওকে কিছু বলেছিস কি না।শুধু বললো তোর মাথায় নাকি নতুন ভাবনা ঢুকেছে।এখন তাই আমিই আসলাম সবটা জানতে!ঘটনা কতোদুর।

আরাব আবারো হাসলো।অতঃপর দোয়ার বিষয়ে সবটা জানালো ও তৌফিকাকে।তৌফিকা বেশ খানিকটা সময় ভাইয়ের মুখের দিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো।ওর বর্ননায় দোয়ার প্রতি ওর ভালোবাসা স্পষ্ট।গালে হাত রেখে বললো,

-আ’ম প্রাউড অফ ইউ আরাব।

ভ্রু কুচকে তাকালো আরাব।বললো,

-মানে?

-তুই জানিস,তুই কি।তুই জানিস,তোর কি আছে।তুই এটাও জানিস,দোয়া কে,ওর কি আছে।এসবের পরেও এভাবে কাউকে ভালোবাসা…

-আমি কিছুই নই আপু!কেনো এসব কথা বারবার তুলিস তুই বলতো?মুফতাহির ভাইয়াও বলে!কেনো বলে বলতো?আমি কি চেয়েছি কোনোদিন এসব?আমি তো আমারটুক নিয়েই খুশি।স্বল্পে তুষ্ট এক সাধারন মানুষ।অর্থবিত্তের দেয়াল তো কোনোদিনও আমার কাছে ছিলো না আপু।জানিস তো তুই!দোয়া যেমন,তা নিয়েই আমি ওকে ভালোবাসি।আমার পক্ষে কোনো কিছুর বিনিময়ে তাতে ছাড় দেওয়া সম্ভব না!

এমনটাই উত্তর প্রত্যাশা ছিলো তৌফিকার।ও জানে আরাব কেমন।ভাইকে ভালোমতোই চেনে ও।তবুও!তৌফিক ওয়াহিদের রক্ত বলে কথা!দোয়ার সবটা শুনে যা বুঝলো,মেয়েটা জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত পরিবারের প্রতি এক তুখোড় দায়িত্বশীল মেয়ে।ওর প্রতি আরাবের উপলব্ধিতে এতোটুকো খুত থাকলেও মেয়েটা ঠকে যাবে।তা জেনেশুনে কিভাবে হতে দেবে তৌফিকা? তাছাড়া এ সম্পর্কের সম্পুর্ন বিপরীতে থাকবে খোদ তৌফিক ওয়াহিদ!আরাবের বাবা!আরাবকে যে দুদিকটাই সামলে চলার মতো করে ভালোবাসতে হবে দোয়াকে!একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,

-ওকে।ওসব বাদ দিলাম,কিন্তু জারা?ওর কি হবে?

-এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে!

ভাইয়ের রাগ বুঝলো তৌফিকা।সত্যিই তো!জারাকে তো ও কখনো ভালোবাসে নি।জারাই জেদ ধরে বসে আছে।তৌফিকা আদুরে গলায় বললো,

-আচ্ছা রিল্যাক্স!ভুল হয়ে গেছে।আর বলবো না কোনোদিনও!পাক্কা!

আরাবের মনটাই বিগড়ে গেছে ওই কথাগুলো শুনে।তৌফিকা আবারো নরম গলায় বললো,

-এটা বল আরাব,কি এমন দেখলি তুই দোয়ার মাঝে?এতোটা ভালোবাসতে শুরু করলি?আদর্শ প্রেমিকের মতো বিহেভ করছিস তুই!তোর মাঝে যে দোয়ার জন্য পাগলামি ভালোবাসা দেখছি আরাব!এন্ড ইটস্ ইনজুরিয়াস টু হেল্থ!

-দোয়ার সব আছে আপু।স্পেশালিটি শুনবি?ওই বেরঙ চিলেকোঠার সবচেয়ে রঙিন দৃশ্যপট!ভালোবাসা!তাতেই নিজেকে রাঙিয়ে নেবো আমি আপু!আর হ্যাঁ,আদর্শ প্রেমিক!ওই ট্যাগটা আমারই হবে দেখিস!তবে যতোদিন না ওকে বলতে পারছি,কি করে আমি আদর্শ প্রেমিক বল?এখন তো নিজেকে ওয়ানসাইডেড লাভার,মানে ঠেসখাওয়া টোকাই ছাড়া আর কিছুই লাগছে না!

আনমনে এতোগুলো কথা বলে নিজেই‌ বিস্মিত হলো আরাব।তৌফিকা হেসে দিয়ে বললো,

-তো বলছিস কবে?

আরাব উঠে দাড়ালো।পকেটে হাত গুজে পেছোতে পেছোতে বললো,

-বলবো আপু!আজ যেমন তোকে বললাম,ওকেও বলবো!আপাতত একপলক দেখে আসি!ভালোলাগছে না কিছুই!বাই!

আরাব বেরিয়ে গেলো।আর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তৌফিকার ভেতর থেকে।আরাবের ভাষ্যমতে যা বুঝলো,দোয়ার পরিবার নিম্নবিত্তই বলা চলে।শুধুমাত্র একারনে ওকে ওর বাবা কোনোদিনও মেনে নেবে না।এটা আরাব নিজেও জানে।তবে ভালো যখন বেসেছে,দোয়াকে ছাড়বে না ও।আর তাই এ বিষয়ে আরাবকে বোঝানোর ক্ষমতা রাখে না তৌফিকা।নিজের লাভ ম্যারেজের পর,বাবার সামনে এই বিষয়েই কথা বলার স্পর্ধা দেখানোও ওর ভাবনার বাইরে।দুঃশ্চিন্তাগুলো গা ঝাড়ছে মনের কোনে।পরিবারের দিকে আগমনী ঝড়কে আগেই উপলব্ধি করা সত্ত্বেও থামানোর কোনো উপায় করতে পারছে না।পারবেও না!

সন্ধ্যের আবছা আলো ছায়ার লুকোচুরি খেলায় মেতেছে শহর।পাখিরা আগেই ফিরে গেছে যে যার নীড়ে।হঠাৎ দুচারটে কাক উড়ে যায় কা কা শব্দ ছেড়ে।আজ না কিছু চোখে ধরছে,নাইবা কিছু কানে যাচ্ছে দোয়ার।এই চারদিনে কিন্ডারগার্ডেন,ভার্সিটি,টিউশনি,বাড়ি,বাজার দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত দোয়া।কোথাও কোনোরকমের ব্রেক পায়নি ও।আগের রাতেও ঘুমানোর সুযোগ হয়েছে মাত্র ঘন্টা তিনেক।শরীরের দুর্বলতা আর উষ্ণতায় বুঝতে পারছে,জ্বর হয়েছে ওর।রীতিমতো ধুকে ধুকতে হাটছে ও রাস্তায়।কেমন যেনো শরীর ভর ছেড়ে দিচ্ছে বারবার।কতো কষ্টে মৃত্তিকাকে পড়ানো শেষ করেছে,ওই‌ জানে।তার উপর ওর মায়ের স্লো ঘড়ি!সময়টা যেনো আরো বেশি করে থামিয়ে দিচ্ছে ওর সঞ্চারন।তবুও পা চালাচ্ছে।বাসা পৌছোতে তো হবে!

রাস্তায় হাটতে বের হওয়া মানুষ বাসায় ফিরছে।সবজি ওয়ালাটার সাথে দেখা হলো না আজ।দোয়া টের পেলো,দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই।হাটার গতি আজ অনেকটাই কমে গেছে ওর।আরো দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করলো দোয়া।কিন্তু শরীর তাতে সায় দিলো না।হুট করেই একটা বড়সর কালো গাড়ি এসে একদম সামনে দাড়ালো ওর।চমকে দুপা পিছিয়ে গেলো দোয়া।ওর নিস্প্রান চোখজোড়া ভয়ার্তভাবে চঞ্চল হয়ে উঠলো সেই সাথে।গাড়ির ভেতর থেকে রনোক সাথে আরো দুটো লোকের বেরিয়ে আসতে দেখে,ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ছেয়ে থাকা রাস্তাটা অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো দোয়ার।পেছোতে পেছোতে বিস্ময়ে সামনের মানুষগুলোর নির্দ্বিধায় এগিয়ে আসা দেখছে দোয়া।আশেপাশের দু চারজন লোকের পদাচরনা যেনো গায়ে লাগছে না ওদের কারোরই!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৯

হাতের রুমালটা ঘুরাতে ঘুরাতে দোয়ার দিকে এগোচ্ছে রনোক।রনোকের পেছনে আরো দুজন।গাড়ির জন্য ওপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।পেছনে তাকিয়ে বেশ অনেকটা দুরে দুজন মধ্যবয়স্ক লোককে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো দোয়া।রাস্তার ওপাশ দিয়ে এক মহিলা হেটে যাচ্ছিলেন।খানিকটা সন্দেহের নজরে চারজনের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন উনি।পরপরই বিরক্তির চেহারা করে হাটা লাগালেন।দৌড়াবে,অতোটা গায়ের জোর নেই ওর এই মুহুর্তে।দোয়া ব্যাগে হাত ঢুকালো স্প্রে বের করবে বলে।সবে মহিলাটাকে ডাকতে যাবে,হুট করেই রনোক রুমালটা একদম মুখে পুরে পেছনে বেধে দেয় ওর।গায়ের জোরে ওকে সরিয়ে দিচ্ছিলো দোয়া।মরিচগোলানো স্প্রে টাও বের করেছে।কিন্তু বাকি ছেলেদুটোর একজন পেছনে মুচড়ে ধরলো ওর হাত।ধাক্কাতে থাক্কাতে ওকে গাড়িতে তুলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

আকসাৎ এরকম ঘটনার সম্মুখীন হওয়া একটা মেয়েই জানে তার মনের অবস্থা।আত্মরক্ষা বোধহয় আর সম্ভব হলো না ভেবে কেদে দিলো দোয়া।গাড়ির ব্যাকসিটে একপাশের একজন দুহাত মুড়িয়ে পেছনে ধরে রেখেছে ওর।রনোক আরেকপাশে।দোয়ার জামার বড়হাতা একটানে ছিড়ে দিয়ে রাগী গলায় বললো,

-খুব তেজ তোমার না?খুব তেজ?এই স্প্রের বোতল,আর রাস্তায় দুচারজন মানুষের আনাগোনা নিয়েই এতো তেজ তোমার?এতো তেজ?

রনোকের নখের আচড়ে হাত কেটে গেছে অনেকটা। জববলছে।প্রানপনে আওয়াজ করা আর ছোটার জন্য চেষ্টা করছে দোয়া।কিন্তু জ্বরের দুর্বলতায় আরো বেশি করে হাপিয়ে উঠছে যেনো।রনোক আবারো বললো,

-গত চারদিন হলো এই রাস্তায় ঘুরঘুর করছি।আর তুমি?কোনো পাত্তাই নেই!কোনো ভয় নেই!চোখ সরিয়ে বিনাসংকোচে আমারই সামনে দিয়ে হেটে যাও?তোমার সাহস কি করে হয় রনোকের চাওনিকে এড়িয়ে চলার?হাউ ডেয়ার ইউ?

আরেকবার ঝাড়া মারলো দোয়া। রনোক এবার গলা টিপে ধরলো ওর। রনোকের স্পর্শের চেয়ে মৃত্যুকে বারবার কামনা করতে লাগলো দোয়া।রনোক ওর গলা আরো জোরে চেপে ধরে বললো,

-চাইলেই তোমাকে শেষ করে দিতে পারি দোয়া।শরীরের টেম্পারেচার যা দেখছি,দুমিনিটও লাগবে না তোমার নাম পৃথিবী থেকে মুছে দিতে।

পরপরই ছেড়ে দিলো।কাশি উঠে গেছে এতেই দোয়ার।ভুল বলেনি রনোক।এই চারদিনে ওর উপস্থিতিকে পুরোপুরিভাবে অগ্রাহ্য করেছে ও।ভয় পেলে আরো বেশি করে ভয় দেখাবে রনোক।এমনটাই বুঝিয়েছিলো ও‌ নিজেকে।অন্তত নিজের পারিবারিক মর্যাদার কথা ভেবে পাব্লিক প্লেসে বাজে কোনো পরিস্থিতি তৈরী করবে না এমনটা ধারনা করেছিলো ও।কিন্তু ওকে ভুল প্রমান করেছে রনোক।দোয়া কাদছেই। যদি রনোককে দেখা শুধু ভয় পাওয়াটা আজকে ওর আত্মসম্মানকে বাচিয়ে দেয়,তবে পাবে ও ভয়।ভয় পেয়েই এ পথে চলবে ও।কিন্তু সে সুযোগ কি পাবে ও?বলারই কি সুযোগ পাবে? এই চলন্ত গাড়ি কোন অন্ধকারের অতলে নিয়ে যাচ্ছে ওকে ভাবতেই বুকফেটে কান্না আসছে দোয়ার।রনোক আবারো বললো,

-বাট তোমার ইগ্নোরেন্সের শাস্তি তো আমি মৃত্যু ঠিক করিনি দোয়া! তারথেকেও যন্ত্রনার কিছু ঠিক করেছি যে! যাতে প্রতিদিন মরো তুমি! আমাকে দেওয়া থাপ্পরের চেয়ে বড় অপমানে প্রতিদিন অপমানিত হও তুমি! এমন শাস্তি দোয়ারানী! এমন শাস্তি চুজ করেছি তোমার জন্য!

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দোয়া। রনোক বাকা হেসে বললো,

-এবার তবে সব হিসেব মেটানো যাক?

আরো উত্তেজিত হয়ে পরলো দোয়া। ওর ছটফটানি বেশ আনন্দের সাথে কিছুক্ষন দেখলো রনোক।তারপর বললো,

-ওমন করে না দোয়ারানী! কিচ্ছুটি করবো না তোমাকে আজ! বলেছি তো,তোমাকে মারবো,ভয়ে ভয়ে!ভয় দেখতে চাই তোমার চেহারায়! তাই আজ শেষবারের মতো ওয়ার্নিং‌ দিয়ে গেলাম ম্যাডাম!রনোক কে ভয় পাও!নইলে পরেরবার…

কথা শেষ না করে বাকা হাসলো রনোক।গাড়িও থামলো।ধাক্কা মেরে দোয়াকে গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো ওরা।মেইন রাস্তায়ই ছেড়েছে ওরা দোয়াকে।আসেপাশের লোকজনের অভাব নেই।সবাই দোয়াকে ওই অবস্থায় দেখে বলাবলি শুরু করে দিলো।ওড়না চাদরের মতো জরিয়ে ছেড়া হাতাটা আগে ঢাকলো দোয়া।ভীত দৃষ্টিতে চারপাশের অবজ্ঞার দিকে তাকালো।হাতের কনুই কেটে রক্ত ঝড়ছে।এক মহিলা ছুটে এসে বললেন,

-কি হলো মা তোমার? ওরা কারা ছিলো?

মহিলার দিকে তাকিয়ে তারবুকে মুখ গুজে হুহু করে কেদে দিলো দোয়া।এতোক্ষনে যেনো শ্বাস ফেলার জায়গা হয়েছে ওর।ওর সাথে তো তেমন কিছুই ঘটেনি,যেমনটা সবাই ভাবছে। তাই কারো ভাবনা নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওর। কিন্তু রনোকের স্পর্শের কথা মনে পরতেই ভেতরটা দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে ওর।দোয়ার কান্নায় নুইয়ে গেলেন মিসেস ওয়াহিদ।তৌফিকাসহ বাকি সবার সাথে বাইরে বেরিয়েছিলেন ওনারা।তৌফিক ওয়াহিদ রেস্ট্রুরেন্টের বিল পে করছিলেন। উনি বাইরে এসে দাড়িয়েছিলেন।আর বাকিসব ভেতরেই ছিলো।এরইমাঝে রনোকের গাড়িটা ফেলে যায় দোয়াকে।একটা মেয়ের এই দুরবস্থায় যখন বাকিসব বলাবলিতে ব্যস্ত,না এগিয়ে গিয়ে থাকতে পারেননি উনি।অনেকটা সময় দোয়াকে কাদতে দিয়ে বললেন,

-শান্ত হও মা।আর কেদো না।অনেকক্ষন হলোই কাদছো তুমি।

দোয়া শক্ত করে ধরে রাখলো মিসেস ওয়াহিদকে।ফুপাচ্ছে।ভয় পুরোপুরি কাটে নি ওর।মিসেস ওয়াহিদ বললেন,

-তুমি চেনো ওদের?

দোয়া এবার মাথা তুললো।বাস্তবতা বুঝে চোখের পানি মুছে নিলো।নাক টেনে বললো,

-ওরা আমার সাথে কিছুই করেনি আন্টি।বিশ্বাস করুন,শুধুমাত্র ভয় দেখাবে বলে এভাবে…

আবারো কেদে দিলো। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন মিসেস ওয়াহিদ। শুধুমাত্র ভয় দেখানো মানে? কান্না থামিয়ে দোয়া আবারো বললো,

-এতোক্ষন আমাকে সময় দেওয়ার জন্য থ্যাংকস্ দিলে কম পরবে আন্টি। তবুও,থ্যাংকস্।আসছি।

মিসেস ওয়াহিদকে বলার সুযোগ না দিয়ে হাটা লাগালো দোয়া।যন্ত্রমানবীর মতো সোজা বাড়িতে ঢুকলো।উপরতলা থেকে ওর অবয়বকে দেখেই সালমা বেগম বললেন,

-দোয়া এসেছিস?নিচের কলপাড় থেকেই মুখহাত ধুয়ে আয়।ওয়াশরুমে তৃষা আছে।ওদেরটায় পানি আসছে না নাকি!

মাথা তুলে উপরে তাকালো দোয়া।তারপর তাকালো টিউবওয়েলের কাছে থাকা পানিভর্তি বালতির দিকে।এগিয়ে গিয়ে বসে গেলো ওখানেই।ব্যাগটা পাশে রেখে একের পর এক মগভর্তি পানি মাথায় ঢালতে শুরু করলো। রনোকের নখের আচড়ে হাতের কেটে যাওয়া জায়গাটা জ্বলতে শুরু করেছে।ওড়না সরিয়ে সেদিকে তাকাতেই তীব্র ঘৃনায় বুকফেটে কান্না আসছিলো দোয়ার। নিশব্দে অশ্রুবিসর্জন দিতে দিতে আরো ডলতে লাগলো কাটা জায়গাটা। গলা টিপে ধরেছিলো,সেখানটাও ডলছে।ওর কব্জি একজন মুঠো করে রেখেছিলো,সেখানেও ছাড় দেয়নি।যেনো চামড়া খুলে নিতে পারলে সুবিধা হতো ওর।

পানি পরার আওয়াজ শুনে অরুনাভ মুখার্জী ঘর থেকে একপ্রকার ছুটে বেরিয়ে এলেন। দোয়া ওভাবেই পানি ঢালছে আর কাটা জায়গাটা ডলছে। রক্তও বেরোচ্ছে ওখান থেকে।অরুনাভ মুখার্জী দৌড়ে এসে মগটা কেড়ে নিলেন ওর কাছ থেকে। চোখ তুলে তাকালো দোয়া। ভেজা চেহারার জন্য কান্নাটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে ওর। অরুনাভ মুখার্জী খানিকটা আতকে উঠে বললেন,

-কি হয়েছে তোর দোয়া? এমন করছিস কেনো?

দোয়ার হুশ ফিরলো। তাড়াহুড়ো করে ওড়না দিয়ে ভালোমতো ঢেকে নিলো আচড়ের জায়গাটা। ভেজা কাপড়েই দৌড়ে চলে এলো দোতালায় । বারান্দার তালাটা আটকানো।দুবার নাড়াতেই তা খুলে দিলো তন্নি। দোয়া একছুটে নিজেদের ঘরে চলে গেলো। সবে ওয়াশরুম থেকে বেরোনো তৃষা ওর ছুটে ভেতরে ঢোকা দেখলো।মিহি স্বরে ডাকও লাগালো দোয়াপু বলে। দোয়া তোয়াক্কা করেনি।ছুটে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজা লক করে দিয়েছে।পাশেররুম থেকে সালমা বেগম,দিয়ান দুজনেই বেরিয়ে আসলো। তৃষা নির্বোধের মতো বললো,

-দোয়াপু মনে হয় কাদছিলো চাচীমা।ভিজে গেছে পুরোপুরি।

দিয়ান,সালমা বেগম দুজনেই হতবাক।দোয়ার কান্নার কোনো কারন খুজে পেলো না কেউই। নাইবা ভেজার কারন আছে।দুবার দোয়াকে ডাকলেন সালমা বেগম।ভেতর থেকে আওয়াজ এসেছে আসছি।বেশি সময় নেয়নি দোয়া।জামাকাপড় পাল্টে বেরিয়ে আসলো।সালমা বেগম বললো,

-তুই নাকি ভিজে গিয়েছিলি?কেদেছিলি?

-কলপাড়ে হাতমুখ ধুতে গিয়ে পরে গিয়েছিলাম।

-কি?দেখি দেখি,কোথায় লেগেছে?খুব লেগেছে?কিছু বলছিস না যে?

সবে দোয়ার গায়ে হাত দিতে যাবে,লাফিয়ে দু পা পিছিয়ে গেলো ও।বললো,

-ব্যস্ত হয়ো না মা। কিছু হয়নি আমার।ঘুম পাচ্ছে। খেয়েদেয়ে ঘুমাবো!

মেয়ের মুখে যেনো অশ্রুতপুর্ব কথা শুনলেন সালমা বেগম।তাড়াতাড়ি সরে এসে দুপুরে রান্না করা খাবারটা বেড়ে নিলেন। আজ দোয়া এগোয়নি।চাদরের মতো করে ওড়না জরিয়ে এককোনে বসে ছিলো শুধু। রনোকের কাজটার কথা ভাবতেই শরীর জ্বলে উঠছে ওর।তাছাড়া জ্বরও বাড়ছে।মায়ের ধারেকাছে গেলেই মা টের পেয়ে যাবে, ব্যস্ত হয়ে উঠবে। তাই দুরে থাকাই শ্রেয়।খাওয়া শেষে কাথা জরিয়ে চুপচাপ উল্টোপাশ হয়ে শুয়ে পরলো দোয়া।দিয়ানও শুয়ে পরেছে ওর ঘরে।কিন্তু সালমা বেগমের মন মানতেই চাইছে না।আস্তেধীরে মেয়ের দিকে এগোলেন উনি।কপালে হাত দিয়ে পর্যবেক্ষন করে বুঝলেন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ কম।কাথাটা দোয়ার গায়ে আরেকটু জরিয়ে দিয়ে সরে আসলেন ওখান থেকে।

হাতের মুঠোয় থাকা ভেজা কাপড়ের টুকরোটা আরো জোরে মুঠো করে ধরলো দোয়া। জানতো মা সন্দেহ করবে,তাই বেশ অনেক্ষন যাবত নিজেনিজেই কপাল ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে নিচ্ছিলো। মায়ের চলে যাওয়া দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো ঠিকই,কিন্তু শরীর যেনো আরো বেশি দুর্বল হয়ে পরতে লাগলো।

মুখার্জি বাড়ির সামনে এসে বাইক থামালো আরাব।জরুরি কাজে আগে ল্যাবে যেতে হয়েছিলো ওকে।তাছাড়া ও জানতো ও সময় দোয়া টিউশনিতে থাকবে,তাই আগে ল্যাবে গিয়ে কাজ সেরেই আসলো একপলক দোয়াকে দেখবে বলে।বাইক থেকে চাবি খুলে সোজা দোতালায় তাকালো আরাব।আর তৎক্ষনাৎ তৃপ্তির হাসির দেখা মিললো ওর ঠোটে।বারান্দার রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে উল্টোদিক হয়ে বসে কেউ।তার ঢেউখেলানো ছাড়া চুলগুলো জানান দিলো,সে দোয়া।রাতের অন্ধকার যেমন চারপাশের দৃশ্যকে গ্রাস করে,তেমনি ওই চুলগুলো আড়াল করে দিয়েছে দোয়ার সম্পুর্ন আঙিকে।

বাসার ভেতর থেকে হাসনাহেনার তীব্র ঘ্রান নাকে লাগছে।পুর্নচাদ পুর্নতার সাথেই তার কিরন বিলি করতে ব্যস্ত।খোলা সদর দরজা দিয়েই দেখা যাচ্ছে ও,নিচতলার মেসের ছেলেগুলো ফিরেছে।ঘরগোছাতে ব্যস্ত সবাই।আরেকবার দোতালার বারান্দার দিকে তাকিয়ে বাইকের চাবিটা পকেটে পুরলো আরাব।পা বাড়ালো অরুনাভ মুখার্জীর ঘরের দিকে।কিছুটা এগোতেই টুপ করে দুফোটা জল সোজা এসে ওর গালে পরলো।

চোখ বন্ধ করে সে জলকনাকে অনুভব করলো আরাব।পুরো দেহমনই প্রশান্তি অনুভব করছে তাতে।একপা পিছিয়ে আবারো উপরে তাকাতেই দ্বিতীয়বারের মতো জলের ফোটা ভিজিয়ে দিলো ওর চিকুর।গালে হাত দিয়ে পানিটুকো ছুইয়ে দিলো আরাব।স্পষ্ট বুঝতে পারছে,এ জল,দোয়ার ভেজাচুল থেকেই গরাচ্ছে।খানিকটা হাসির রেখা দেখা দিতে গিয়েও থেমে গেলো। চিন্তিত হৃদয় প্রশ্ন করে বসলো আরাবকে,এ সময় দোয়ার চুল ভেজা কেনো?এ অসময়ে কেনো গোসল করলো দোয়া?এখন গোসল করলে অসুখ করবে,এটা একবারও ভাবলো না মেয়েটা?কেনো?

-আরে আরাব!তুমি?

ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন অরুনাভ মুখার্জী।আরাব জোরপুর্বক হাসি টেনে বললো,

-জ্বী।কেমন আছেন কাকাবাবু?

-এইতো!তুমি?হাতপায়ের কাটাছেড়া…

-পুরোপুরি সুস্থ্য আছি কাকাবাবু।

-কিভাবে এলে তুমি?

-ড্রাইভ করেই এসেছি। অসুবিধা হয়নি।

অরুনাভ মুখার্জী আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।আরাব সুযোগ না দিয়ে বলে উঠলো,

-কাকাবাবু,দোয়া?

একটা ছোট শ্বাস ফেললেন উনি।বললেন,

-আছে।ভালোই আছে।উপরে গিয়ে দেখা করে আসো?

এই দেখা করে আসো অনুমতিটাই চাইছিলো আরাব।একমুহুর্ত দেরী করলো না।সিড়ি বেয়ে চলে আসলো দোতালায়।বন্ধ কেচিগেইটের ওপারে বারান্দায় মাথা ঠেকিয়ে বসে দোয়া।রাতের আধারে চেহারা অস্পষ্ট।ওর চোখের কোনের জল দৃশ্যমান হলো না আরাবের কাছে।কারো কাছেই যাতে না হয় তাইতো ঘুমোনোর ভান করে ছিলো এতোক্ষ। বারান্দায় এসে ওড়না জরিয়ে বসেছে কান্না করার জন্য।জলপটি দেওয়াতে জ্বর কমলো নাকি আরো বেড়ে গেলো,বুঝতেই পারছে না। খানিকটা সময় নিরবে ওর ওই অবয়বকেই দেখে পার করে দিলো আরাব।এতেও শান্তি আছে।কিছুক্ষন পরই দোয়ার মা একটা জামা হাতে বেরিয়ে এলেন ভেতর থেকে।মেয়ে যে ঘুমোয়নি,টের পেয়েছেন উনি।কাধে হাত রাখতেই একপ্রকার ধরফরিয়ে উঠলো ও। তার অলক্ষে চোখের কোনার জল মুছে নিলো।সালমা বেগম বললেন,

-কিরে মা?ঘুমোসনি?

-ন্ না মানে,এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে অভ্যাস নেই তো,তাই ঘুম আসছিলো না।ত্ তুমি যাও,আসছি আমি।

বড় বড় শ্বাস ছেড়ে বললো দোয়া। সালমা বেগম ওর কাছে বসতে যাচ্ছিলো। উঠে আরো দাড়ালো দোয়া। দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে,টলছে। তবুও মাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। সালমা বেগমও দাড়িয়ে বললেন,

-এমন করছিস কেনো তুই?

-মা প্লিজ। ঘরে যাও না! আসছি আমি! বললাম তো!

দোয়া খানিকটা ধমকির সুরে বলেছে কথাটা। ওর ধমক শুনে তন্নি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে । কিই বা করবে দোয়া?মায়ের সামনে অসুস্থ্যতা দেখানো যাবে না কোনোমতে। এদিকে দাড়িয়ে থাকাও এখন ওর জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছে। চারপাশ ঘুরছে ওর।সালমা বেগম বললেন,

-আচ্ছা শান্ত হ! যাচ্ছি আমি!

দোয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তন্নি গেইটে তাকাতেই চকিত হলো। আরাব গেইট মুঠো করে ধরে দাড়িয়ে। সেদিনের দেখায় ওর ধারনা আরাব দোয়ার আত্নীয়। ঘরে গিয়ে চাবিটা এনে তালা খুলে দিলো। সৌজন্য হাসলো আরাব। গেইট টেনে ভেতরে ঢুকতে‌ যাবে,সালমা বেগম হাতের আধভেজা জামাটা দেখিয়ে বলে উঠলেন,

-আচ্ছা দোয়া?এই জামাটার হাতা কি করে ছিড়লো রে?এটা তো তুই টিউশনিতে পরে গিয়েছিলি!

জামাটা দেখেই সন্ধ্যের সমস্ত ঘটনা দোয়ার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।আর পারলো না নিজেকে আয়ত্ত্বে রাখতে।চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো ওর।ওকে টলতে দেখেই ছুট লাগিয়েছে আরাব। অজ্ঞান হয়ে পরেই যাচ্ছিলো দোয়া। কিন্তু আরাব বাহুডোরে সামলে নেয় ওকে। দোয়ার গায়ের তাপমাত্রা অনুভব হতেই মাথা ফাকা হয়ে যায় আরাবের। ততোক্ষনে সালমা বেগম দোয়া বলে আর্তনাত করে উঠেছেন। কোনোকিছুর পরোয়া না করে দোয়াকে কোলে তুলে নিলো আরাব।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here