এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -১০+১১+১২

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১০

দুহাতে জরিয়ে শুন্যে তুলে নিয়ে দোয়াকে ঘরে নিয়ে আসলো আরাব। সালমা বেগম মুখে আচল গুজে কাদছেন। তন্নি,তৃষা,দিয়ান সবাই আছে। দোয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কপালে হাত রাখলো আরাব। জ্বরের মাত্রাটা বেশিই। দোয়ার শ্যামবর্নের চেহারায় হলুদাভ বর্নের ছোয়া। একমুহুর্ত দেরী না করে ও ছুট লাগালো নিচতলায়।অরুনাভ মুখার্জী বই হাতে চশমা খোজায় ব্যস্ত।আরাব দৌড়ে ঘরে ঢুকে বললো,

-কাকাবাবু…দোয়া….

অরুনাভ মুখার্জী পেছন ফিরলেন।আরাবের হন্তদন্ত অবস্থা দেখে উনিও ঘাবড়ে গেছেন অনেকটাই। বললেন,

-কি হয়েছে আরাব? কোনো সমস্যা?দোয়া কিছু বলেছে তোমাকে?

-নাহ্!

কোনোমতে শব্দটা বের করে ঔষুধের বক্স খুজতে ব্যস্ত হয়ে পরলো আরাব।অরুনাভ মুখার্জী ভ্রুকুচকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটার এমন ব্যবহারের আগামাথা কিছুই ঢুকছে না তার মস্তিষ্কে।এগিয়ে গিয়ে বললেন,

-কি খুজছো আরাব?

-ওষুধের বক্স কোথায় আপনার?

মাথার চুলগুলো উল্টে ধরে দিশেহারার মতো দুসেকেন্ড দাড়িয়ে আবারো হন্ন হয়ে খুজতে লাগলো আরাব। অরুনাভ মুখার্জী টেবিলে তাকালেন। পাশের টেবিলে,আরাবের চোখের সামনেই ওটা রাখা। তবুও চোখে পরেনি ওর।এগিয়ে গিয়ে বক্সটা দিলেন উনি। আরাব ওটা নিয়ে খুজতে খুজতে বললো,

-দোয়া জ্বরে সেন্সলেস হয়ে গেছে। আই থিংক ওষুধ খাওয়ানো পসিবল হবে না,আর এ মুহুর্তে তা কাজেও দেবে না। ইন্জেক্ট করতে হবে।

বিমুর্তভাবে কিছুক্ষন আরাবের মুখপানে তাকিয়ে রইলেন অরুনাভ মুখার্জী। দোয়ার অবস্থা শুনে চকিত উনি। তবে কেনো যেনো আরাবের ব্যস্ততা তার চোখে গাঢ়ভাবে ধরা দিচ্ছিলো।নিজেকে সামলে বললেন,

-ইন্জেকশন আছে দেখো ওতেই। আমার চশমাটা যে কোথায় রাখলাম! খুজ্…

-পেয়েছি। আপনিও আসুন কাকাবাবু!

আরাব আবারো দৌড় লাগিয়েছে দোতালায় । ততক্ষনে তন্নি,তৃষা বালতিভর্তি পানি এনে বিছানার কাছে রেখেছে। সালমা বেগম মুদ্যুভাবে দোয়ার গালে হাত রেখে কাদতে কাদতে ডেকে চলেছেন। দিয়ান এখনো আকস্মিকতায়। আরাব ইন্জেকশন হাতে এগিয়ে বললো,

-আন্টি দোয়ার বড়হাতা একটু গুটিয়ে দিন।ওকে ইন্জেকশন পুশ করতে হবে।

দিয়ানের হুশ ফিরলো যেনো। ছুটে গিয়ে দোয়ার হাত ধরে বললো,

-আপুনি!কি হলো তোর? চোখ খুলছিস না কেনো? আরাব ভাইয়া দেখ ইন্জেকশন নিয়ে এসেছে!আমার ভয় করছে আপুনি! চোখ খোল প্লিজ!চোখ খোল!

-শান্ত হও দিয়ান। কিছুই হবে না তোমার আপুনির। সেন্স ফিরলেই হসপিটাল নিয়ে যাবো ওকে। শি উইল বি ফাইন।

আরাব দিয়ানকে টেনে তন্নিকে ইশারা করলো ওকে সামলানোর জন্য। সালমা বেগম কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে আছেন একপ্রকার। ওদের সব পরিস্থিতিতে দোয়াই ওদের ঢাল।সবসময় সামলেছে ওদেরকে। আজ ওর এই পরিস্থিতিতে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে।আরাব আবারো দোয়ার পাশে বসে বললো,

-আন্টি হাতাটা গুটিয়ে দিন!

ভাষাহীন দৃষ্টিতে শুধু আরাবের দিকে তাকালেন সালমা বেগম। অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-আরাবকে ইন্জেকশনটা দিতে দাও সালমা। নইলে দোয়ার জ্ঞান ফিরবে না। আমার চশমাটাও খুজে পাচ্ছি না!

ওনার কথায় দেরী না করে দোয়ার জামার হাতা গুটাচ্ছিলেন সালমা বেগম।কিন্তু রনোকের নখের আচড়ের দাগটা চোখে পরতেই থেমে গেলেন উনি।একপলক বাইরে শুকোতে থাকা দোয়ার আধভেজা জামার ছেড়া হাতার দিকে তাকালেন।ওনাকে থেমে যেতে দেখে অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-কি হলো সালমা?থামলে কেনো?

নিরুত্তর রইলেন সালমা বেগম। অনেকটা পাথরের মতো। এদিকে দোয়ার হাতের দাগ দেখেই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসলো আরাবের। ভেতরটায় তোলপাড় হচ্ছে ওর। সহ্য হচ্ছে না কিছুই। দোয়ার শরীরে আঘাতের দাগ ওকে কতোটা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে,ক্ষনে ক্ষনে অনুভুত হতে লাগলো ওর। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,ওটা নখের আচড়। দাতে দাত চেপে নিজেকে শক্ত করলো আরাব। তারপর দোয়ার হাতা নামিয়ে দিয়ে চুপচাপ আরেকহাতে ইন্জেকশন পুশ করে দিলো।আলতোভাবে দোয়ার গালে হাত রেখে ধীর গলায় বললো,

-দোয়া?এই দোয়া?চোখ খোলো?শুনতে পাচ্ছো?দোয়া?

একটুপরই দোয়ার চোখের পাপড়ির নড়াচড়া দেখা মিললো। পাশ থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাড়ালো আরাব।শক্ত হাতে রেলিং চেপে ধরে তাকিয়ে রইলো নিস্তদ্ধ অন্ধকার আকাশের দিকে।
জ্ঞান ফেরার পর চারপাশে সবাইকে দেখে দোয়া টের পেলো কিছু একটা ঘটেছে।উঠে বসতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠলো।অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-থাক না!শুয়েই থাক!তৃষা?ওকে একটু জলপটি দে,আমি গাড়ি ডাকতে যাচ্ছি! হসপিটাল নিয়ে যাবো।

নিজেকে সামলে উঠে বসলো দোয়া। তপ্ত শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো,

-আ্…আমি ঠিক আছি কাকাবাবু। হসপিটালে যেতে হবে না।

দিয়ান ছুটে এসে বোনের কাছে বসলো। বললো,

-আপুনি?চল না হসপিটাল? তোর অনেক জ্বর!

দোয়া মৃদ্যু হেসে ওর গালে হাত রেখে বললো,

-না রে! এখন আর অতোটা খারাপ লাগছে না।ঘরে আসলাম কিভাবে আমি?

-তোকে তো আর্…

-শুয়ে পর দোয়া! আমি জলপটি দিচ্ছি। সকালে যাবো হাসপাতালে।

দিয়ানকে বলতে না দিয়ে কথাটা বলে দোয়াকে শুইয়ে দিলেন সালমা বেগম। দিয়ান আদেশের মতো করে বললো,

-হ্যাঁ! চুপচাপ শুয়ে থাক তুই! আর একটাও কথা না!

-ছোটু,তুই এভাবে অস্থির হয়ে পরেছিস কেনো বলতো? কিছুই হয়নি আমার! মা? তুমিও এমন কেনো করছো?

সালমা বেগম চুপ রইলেন। অরুনাভ মুখার্জী গম্ভীরভাবে বললেন,

-কাল তুই ভার্সিটি যাবি না দোয়া। তোকে নিয়ে হসপিটাল যাবো আমি।

কথাটা বলেই বেরিয়ে এলেন উনি ঘর থেকে।বারান্দায় আরাবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে থামলেন অরুনাভ মুখার্জী। বললেন,

-বাসায় যাবে না আরাব?

আরাব পেছন ফিরলো। আকাশে চাদ ছিলো।সে আলোতে স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো ওর ছলছল চোখ,শক্ত চোয়াল।হাত মুঠো করে অরুনাভ মুখার্জীর দিকে একপা এগিয়ে আরাব বললো,

-দোয়া বিকেলে কোথায় কোথায় টিউশনি করায় কাকাবাবু?

-এটা তুমি কেনো জানতে চাইছো?

-নিজের জন্য।

অরুনাভ মুখার্জী নির্লিপ্ত দৃষ্টি আটকে রাখলেন আরাবের দিকে। কি ছিলো ওর ভাষায়,ওর ভঙিমায়,বুঝে উঠলেন না তিনি। তবে এটা ভালোমতোই অনুভব করতে পেরেছেন,যা ছিলো,তা দোয়ার নামে ওর নিজের জন্য ছিলো।তা বড্ড দরকার দোয়ার।বড্ড দরকার!

টিউশনি শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রাস্তায় বেরোলো দোয়া। ভার্সিটি যায়নি আজ,অরুনাভ মুখার্জী জোর করে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো ওকে। ওষুধে জ্বর কমেছে খানিকটা।টিউশনি কামাই করলে মৃত্তিকার আম্মুর আড় কথা শুনতে হয়। সালমা বেগমের বারন করা সত্ত্বেও তাই বেরিয়েছে ও। তবে মায়ের ব্যবহারে কিছু তো আলাদা ছিলো আজ সকালে। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলো,কোনো ঝামেলা হয়েছে কি না।কিন্তু কেনো জিজ্ঞাসা করলো মা ?সে জানবে কি করে?নাকি শুধু ওর অসুস্থতার জন্য বেশি ভেবেছে?আর ভাবতে পারছিলো না দোয়া। মাথায় যন্ত্রনা অনুভব হয়। দুর্বলতা তো আছেই।

মৃত্তিকাদের বাসার নিচে নামতেই দুর থেকে দোয়া লক্ষ্য করলো রনোক নামের ঘৃন্য মানুষটা পায়ের উপর পা তুলে চায়ের দোকানটায় বসে বিশ্রি হাসছে। মাথা নিচু করে দ্রুত পা চালালো ও।হঠাৎই সামনে এসে দাড়ালো কেউ।জুতোজোড়া দেখেই দোয়া বুঝলো,এটা রনোক।মাথা তুলে তাকাতেই নিজের অনুমানের সত্যতা খুজে পেলো ও।একা এসেছে রনোক। বাকা হেসেই বললো,

-দোয়ারানী,মাথা নিচু করে যাচ্ছো যে?

দোয়া কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলো। আবারো সামনে এসে দাড়ালো রনোক।বললো,

-ভীতু ম্যাডামকে যে আজ বেশ লাগছে দেখতে।

….

-ইশ্!আফসোস হচ্ছে এবার দোয়া।বড্ড আফসোস হচ্ছে,কাল তোমাকে একটু আদ্…

এরমধ্যে পাশ থেকে দুজন মহিলা এগিয়ে এলেন।দোয়ার পাশে দাড়িয়ে একজন বললেন,

-এই ছেলে!কি সমস্যা তোমার?

-সমস্যা কেনো হবে?আমাদের বিষয়।আপনি মাঝে আসছেন কেনো?

আরেকজন মহিলা বললেন,

-তোমাদের বিষয় বুঝলাম।কিন্তু এভাবে কথা বলছো কেনো মেয়েটার সাথে?

দোয়া কিঞ্চিত অবাক হলো। মহিলাদুটোকে এর আগে এ রাস্তায় দেখেছে বলে মনে পরলো না ওর। আগেরদিনের ঘটনার পর এ রাস্তার কেউ যে ওর সাথে রনোকের ব্যবহারকে লক্ষ্য করবে,এমনটার আশা ছেড়ে দিয়েছিলো ও। তাছাড়া রনোক কথাগুলো অনেকটা ধীরে বলেছে,যা এই মহিলাদুটোর শোনার কথা না।রনোক বললো,

-শুনুন,আমি ওকে চিনি। সো আমাদের কথার মাঝে আপনারা আসবেন না।নিজেদের কাজে যান!

-তুমি চেনো ওকে?

একজন মহিলা দোয়ার কাধে হাত রেখে বললো। চমকে উঠলো দোয়া। অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো এটুক আশ্বাস।আগেরদিন তো চিত্র ভিন্নই ছিলো।আরেক মহিলা বললো,

-বলো?তুমি চেনো ওকে?নাকি থ্রেট দিয়েছে কোনো তোমাকে?

বিস্ময়ে তাকালো দোয়া। কিন্তু রনোকের ধৈর্য্যের বাদ ভেঙে গেছে।চেচিয়ে বলে উঠলো,

-আপনাদের নিজস্ব কাজ নেই কোনো? ওর আমার গার্লফ্রেন্ড! আমি ওর লাভার!এবার যান তোহ্!আমাদের নিজেদের কোয়ালিটি টাইমে বিরক্ত করছেন কেনো?

-মাঝ রাস্তায় একটা মেয়েকে হ্যারাস করছো,আর বলছো গার্লফ্রেন্ড,বয়ফ্রেন্ড?কোয়ালিটি টাইম?তোমাকে এর আগেও‌ এই মেয়েটার সাথে ধমকাধমকি করতে দেখেছি আমি।

আরো বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দোয়া।মধ্যবয়স্ক দুজন লোক। সবাই অচেনা। আজব লাগছে,কিন্তু প্রত্যেকের কথায় মন ভরে উঠছে ওর।রনোক হুট করেই দোয়ার হাত ধরে টান লাগিয়ে বললো,

-চলোতো দোয়া ! এরা তো…

দাড়িয়ে গেলো দোয়া।বললো,

-হাত ছাড়ুন!

-কেনো?

– যাবো না আমি।

-তুমি যাবে!চলো!

-হাত ছাড়ুন প্লিজ!

দোয়ার মানা শুনে একটু ভ্রুকুচকে তাকালো রনোক।তারপর বুঝলো আশেপাশের লোকজনই দোয়ার এই সাহসের কারন। খানিকটা এগিয়ে নিচু হয়ে বললো,

-বাড়াবাড়ি করো না দোয়া! আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিও না! তোমাকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম।আমার কথামতো না চললে আমি কিন্তু তোমাকে…

-হাত ছাড়ুন!

কড়া গলায় বললো দোয়া।তবুও হাত ছাড়েনি রনোক।বরং আরো জোরে টান লাগিয়েছে। দোয়া হুমড়ি খেয়ে পরেছে একপ্রকার।পরমুহুর্তেই সশব্দে চড় পরলো রনোকের গালে। ওর স্পর্শ সহ্য হচ্ছিলো না দোয়ার। বিষাক্ত লাগছিলো। নিজেই হাত ছাড়িয়ে চড় লাগিয়েছে রনোককে। গালে হাত রেখে রনোক চেচিয়ে বলে উঠলো,

-এই দোয়া!হাউ ডেয়ার ইউ?

ততক্ষনাৎ দুতিনটে ছেলে এসে রনোকের কলার চেপে ধরলো। একজন রনোকের নাক বরাবর ঘুষি লাগিয়ে বললো,

-আবে শালা! আমাদের এলাকায় এসে ইভটিজিং করিস? তোর সাহস তো কম না!

তিনজনে মার লাগাতে লাগলো রনোককে।মধ্যবয়স্ক লোকদুটো কিছুই বলছে না ওদের।মহিলাদুজন দোয়ার কাধে হাত রেখে ওকে শান্তনা দিচ্ছে। শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। সবটা ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।ঘটনাপ্রবাহ এমন হবে কল্পনাও করেনি ও।একসময় বললো,

-ছেড়ে দিন ওনাকে,এভাবে মারলে…

পাশের মহিলা বললেন,

– কিছুই হবে না। তুমি এতো ভেবো না!

-কিন্তু….

দোয়াকে ধরে উল্টোপথে হাটা লাগালেন মহিলা দুজন। একজন বললেন,

-অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখো মা! অভিযোগ করতে শেখো!মনে রেখো,তুমি একা নও।আমরা আছি তো তোমার পাশে!আজকে তুমি একে ছাড় দিলে ও আর ভয় পাবে না। কাল এ আরেকটা মেয়েকে এভাবে হ্যারাস করবে। আজকে তোমার হাত ধরেছে,কাল হয়তো অন্যকাউকে আরো বাজেভাবে…পুলিশ আসছে,ওকে পুলিশে দিয়ে দেবে ওরা। আর বিরক্ত করতে পারবে না তোমাকে।

চোখ ভরে উঠলো দোয়ার। প্রতিবাদ তো করতে চায় ও। করতোও।কিন্তু আগেরদিন ওকে রনোক যেভাবে বলেছিলো…পেছন ফিরে দেখলো আরেকবার। রনোক তখনও মার খাচ্ছে ছেলেগুলোর হাতে। মহিলাদুটো সরিয়ে নিয়ে আসলো ওকে ওখান থেকে।

দুর থেকে বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে পকেটে দুহাত গুজে সবটাই দেখছিলো আরাব।মাস্কের জন্য ওর ঠোটের হাসিটা দৃষ্টিগোচর হলো না শুধু। আগেররাতে আর বাসায় ফেরেনি ও। অরুনাভ মুখার্জীর কাছ থেকে দোয়ার টিউশনির জায়গার কথা জেনেছে । সারাদিন ঘুরে ঘুরে,চায়ের দোকানদারটা থেকে রনোকের দোয়ার পথ আগলে দাড়ানোর বিষয়ে খবর লাগিয়ে,এদিকটায় ওই মহিলাদুটোকে ঠিক করে রেখেছিলো রনোকের সামনে‌ ওভাবে বলার জন্য। ছেলেগুলোও ওর চেনাজানা।ওর সাহায্য নেওয়ার মতো মেয়ে দোয়া নয়। কিন্তু পথচারীদের আশ্বাসে কোনো প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকবে না দোয়ার কথায়।তাই বাধ্য হলো এভাবে কাজ হাসিল করার জন্য। গনধোলাইয়ের পর্যায় শেষ করবে বলে আরাব এগোলো এবার । ছেলেগুলো ওকে দেখেই ছেড়ে দিলো রনোককে।আরাব ওর সামনে দাড়িয়ে পকেটে হাত গুজে বললো,

-শিক্ষা হয়েছে?

উঠে দাড়িয়ে গায়ের ময়লা ঝাড়ছিলো রনোক। আরাবের কথায় চোখ তুলে তাকালো। মারামারি করার ইচ্ছা থাকলেও আরাবের আশেপাশের ছেলেগুলোকে দেখে সাহসটা হলো না রনোকের।বললো,

-কিসের শিক্ষা?রনোককে শিক্ষা দেওয়ার তোরা কে?আমি চাইলেই তোদের…

ছেলেগুলো আবারো এগুচ্ছিলো ওকে মারবে বলে।আরাব থামিয়ে দিলো ওদের। একপলক সবাইকে দেখে নিয়ে রনোক রাগী গলায় আঙুল উচিয়ে বললো,

-শোন,যা করলি,একদম ঠিক করলি না! রনোকের গায়ে হাত দিয়েছিস তোরা! এতো সহজে এসব ভুলবো না আমি! সবটার হিসেব নেবো!সবটার!

কথাগুলো বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো রনোক।কিছুক্ষন সেদিক তাকিয়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো আরাব। হিসেব মেটানো তো ওর বাকি। দোয়ার গায়ের আচড়ের কারন যে রনোক,তা আরেকটু পরিস্কার হলো ওর কাছে । বাকিটা ওর কাছেই না হয় শুনবে। ডানহাতে শার্টের বা হাতাটা টান মেরে চোয়াল শক্ত করে বাইকের‌ দিকে এগোলো ও। এমনিতেও পুরোপুরিভাবে আত্মিক প্রশান্তি মেলেনি। আর যতোক্ষন না সে প্রশান্তি মিলছে,কোনোকিছুতেই মনোযোগ থাকবে না ওর। রনোক নামক এই বিষাক্ত কাটার জন্য দোয়া কেনো কষ্ট পাবে?আরাব কেনো যন্ত্রনায় রবে? যার যা প্রাপ্য,তাকে তা দিয়ে দিলেই তো হয়!ছোটখাটো সরল যুক্তিতে নিজের মতামতকে অধিষ্ঠিত করে নিলো ও।অতঃপর বাকা হেসে বাইক স্টার্ট দিলো। রনোকের গাড়ির ঠিক পেছনেই ছুটতে লাগলো বাইকটা।
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১১

তীব্র রাগ নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলো রনোক। দোয়ার জন্য পাব্লিক প্লেসে আজকে গায়ে হাত উঠেছে ওর।আচমকা গাড়ির সামনে বাইক চলে আসায় মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো রনোকের। কোনোমতে ব্রেক কষে ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে আসলো বাইকারকে মার লাগাবে। ওকে আসতে দেখেই হেলমেট ছেড়ে মাস্ক পরে এগোলো আরাব। সন্ধ্যে নেমেছে অনেক আগেই।মোটামুটি ফাকা রাস্তা। রনোককে বলার সুযোগ না দিয়ে আরাব বললো,

-ব্রো? তুমিই সেই পাব্লিক না যাকে দুরুম দুরুম করে আমাদের ওখানের বাচ্চাগুলা মার লাগালো?

আরাবের কথার ভঙিমা শুনে রনোক ভ্রুকুচকে তাকালো। ভালোমতো পরখ করে বুঝলো এটা ওই ছেলেটাই যে ওকে শিক্ষা হয়েছে কথাটা বলেছিলো। দাতে দাত চেপে বললো,

-শালা,তুই এখন আবার এসেছিস….

-কারেক্ট!তুমিই তো!আরেহ্ চলো তো ব্রো! দেখবে চলো,সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য। দোয়া রিলেটেড!

কাধে হাত রেখে আরাব হাটা লাগালো রনোককে নিয়ে। যদিও বিষয়ের আধ্যোপান্ত কিছুই বুঝছিলো না রনোক,তবুও দোয়া রিলেটেড কথাটা শুনে যেনো আপনাআপনিই পা চলতে লাগলো ওর। হাটতে হাতটে কুচকানো কপাল রেখেই বললো,

-কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে?কে তুই?

-আরেহ্ ব্রো!মেয়েটাকে তো সেই লেভেলের ভয় দেখিয়েছো তুমি! এলাকার বড়দের সামনে কিছু বলতে পারলাম না তোমাকে।তাই চলে আসলাম বাহবা দিতে। চলো চলো,গেলেই দেখতে পাবে!

আরাবের কথা শেষ হতে না হতেই রনোক খেয়াল করলো কোনো এক বড়সর গোডাউনের পেছনদিকে দাড়িয়ে ওরা।খানিকটা অবাক হলো ও। দুমিনিটও হাটেনি ওরা। কোথায় নিয়ে আসলো ওকে আরাব,তাও বুঝে উঠতে পারছে না। ছেলেটা কথার ছলে এভাবে নিয়ে আসলো,আর ওউ চলে আসলো ভেবেই রাগ উঠলো ওর নিজের উপর।রাগী গলায় বললো,

-শালা,এটা কোথায় আনলি তুই আমাকে?

আরাব মুচকি হাসলো। বায়োমেডির এক পরিত্যাক্ত কেমিক্যাল গোডাউন এটা।একসময় একটা ব্রাঞ্চ ছিলো এখানে। প্রতিটা কোনা কোনা চেনে ও। সবচেয়ে সৌভাগ্যজনক যা তা হলো,রনোক এখান দিয়েই যাচ্ছিলো।তাই জেনেবুঝেই আরাব বাইক থামিয়েছে ওখানটায়। গলাটা ঝেড়ে বললো,

-ভেতরে গিয়ে বসে কথা‌ বলি?

রনোক খিচে উঠে ওর কলার চেপে ধরলো।বললো,

-তোর সাথে আমার হিসেবমেটানো আছে। আর‌ তুই‌ আমাকে বলছিস বসে কথা বলি?

রনোকের মুঠোতে থাকা কলারের দিকে তাকালো আরাব । ঠান্ডা আওয়াজে বললো,

-বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না?

রনোক আরো এগোতে যাবে,ওর দুহাত ধরে পেছনে আটকে দিলো‌ আরাব। হাটুতে লাথি মেরে বসিয়েও দিয়েছে ওকে।অতপর পেছনদিক থেকে রনোকের পায়ের উপর উঠে খানিকটা ঝুকে দাড়িয়ে বললো,

– শান্তভাবে কথা বলতে চেয়েছিলাম।কিন্তু তুই ভায়োলেন্ট হতে বাধ্য করলি!

মুহুর্তেই কি ঘটে গেছে টের পেলো না রনোক। তবে ওর ছাড় পাওয়ার কোনো উপায় রাখে নি আরাব। হাটুতে বসা,পেছনে পায়ের উপর দাড়ানো আরাব,হাতদুটোও পেছনে আটকানো। কিছু বলার আগেই কাধের দিকটায় কনুইয়ের আঘাতে অন্ধকার হয়ে আসলো ওর চারপাশ।

পানির ছিটায় যখন জ্ঞান ফিরলো,নিজেকে চেয়ারে হাতপা বাধা অবস্থায় খুজে পেলো রনোক। আরাব মাস্ক পরিহিত অবস্থাতেই একটা চেয়ার টেনে রনোকের সামনে বসলো। বললো,

-তোকে কিছু প্রশ্ন করবো। তুই সেগুলোর সুন্দরমতো জবাব দিবি। দ্যাটস্ ইট! আমি কোনো ঝামেলা করতে চাইছি না!

রনোক চেচিয়ে বলে উঠলো,

-শালা কু** বাচ্চা!আমাকে ঠকিয়ে এখানে এনে,পেছন থেকে আঘাত করে এখন ভয় দেখাচ্ছিস?কে তুই? কি ভেবেছিস?তোর মতো ছেলেকে আমি ভয় পাবো?রনোক ভয় পাবে?যার একটা ডাকেই কিনা শ খানেক লোক জড়ো হয়ে যায়,সেই রনোক ভয় পাবে তোকে?ভুলে যা!

মাথা ঝাড়া মারলো আরাব। জোরে শব্দ শুনে অভ্যাস নেই তো,তাই রনোকের চিৎকারটা কানে লেগেছে ওর। পাশের টেবিল থেকে ছুড়ি এনে রনোকের বাধা হাতের তালুতে আকিবুকি শুরু করে দিলো। রক্ত ঝড়ছে রনোকের তালু থেকে। চিৎকার করছে রনোক।কিন্তু এবার যেনো তা কানেই যাচ্ছে না আরাবের। ছুড়ির সাথে লবনমরিচ লাগিয়ে পাউরুটিতে জ্যাম লাগানোর স্টাইলে রনোকের তালুতে ছুড়ি চালাচ্ছে আরাব।রনোক কাদছেই। রাতের নির্জনতায়,বড়বড় দেওয়ালগুলোয় ওর কান্নার প্রতিধ্বনি বাজছে।আরাব বললো,

-আমি যা করছি,তা দোয়া রিলেটেড । ঠকাইনি তোকে।আর পেছন থেকে কখন আঘাত করলাম?তুইই তো আগে কলার ধরলি আমার।আমি কে তা সময় নিয়ে জানাবো একদিন।আর রইলো বাকি ভয় দেখানো,আমি যতোটা ভোলাভালা দেখতে,ততোটাও ভালো ছেলে না। ভয় পাবি কিনা তোর ব্যাপার।কিন্তু ভয় দেখাতে আমি কি কি করতে পারি,সেটা আমার উপর ছেড়ে দে।এবার এটা বল,দোয়াকে কিভাবে চিনিস?

রনোক একটু থামলো।কি মনে করে আবারো চেচিয়ে উঠে বললো,

-ও!তারমানে দোয়ারানীই তোকে….

আবার একহাতে ওর কলার টেনে এগিয়ে এনে বললো,

-আর একটু পরেই দোয়ার নাম অবদি মনে থাকবে না তোর। ততক্ষন অবদি যেনো আমি নিজের ওপর আয়ত্ব না হারাই সে দায়ভার তোরই। ভাষা,গলা,আওয়াজ সংযত করে কথা বল আর আমার প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দে!নইলে আমি যদি খারাপ কিছু করে বসি….

এটুক বলেই আরাব রনোককে ছেড়ে দিলো আরাব।পানি দিয়ে হাতটা ধুয়েও দিলো ওর।তারপর আবারো ছুড়িটা হাতে নিয়ে ঘোরাতে লাগলো। ওটার দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললো রনোক। আরাব বললো,

-দোয়াকে কিভাবে চিনিস?

…..

-বল!

কড়া গলায় বলে আরেকহাতেও ছুড়ি চালাতে যাচ্ছিলো আরাব।রনোক চেচিয়ে বললো,

-আমার…আমার বোনের মেয়েকে পড়াতো ও!

রনোকের উত্তর। ছুড়িটা রেখে চেয়ার ঘুরিয়ে বসে আরো আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকালো আরাব।বোনের মেয়ের টিচার কথাটা বেশ লেগেছে ওর।পড়াতো কথাটা আরো বেশি ভালোলেগেছে।বললো,

-পড়াতো?বাদ দিলো কেনো?

গলার স্বর পুরোপুরি বদলে গেছে আরাবের।রনোকের এমন মনে হলো যেনো ওর কোনো এক সময়ের জিগরি দোস্ত হয় ও। ঠোট কামড়ে ধরে রেখে হাতের যন্ত্রনাটা ভোলার চেষ্টা করে বললো,

-কিছুদিন আগে আমার বোন-দুলাভাইয়ের বিবাহবার্ষিকী ছিলো।দ্ দোয়ার প্রতি আগে থেকেই দুর্বলতা ছিলো আমার। সেদিন ওউ গিয়েছিলো ও বাসায়। একা দাড়িয়ে ছিলো এককোনে। কিছু না ভেবে মনের কথা বলে দিয়েছিলাম ওকে।কিন্তু কথাটা বলাতে ও উল্টো রিয়্যাক্ট করে চলে আসে ওখান থেকে। আর যায়নি রোতিকে পড়াতে।

আরাব মুচকি হাসি দিলো। শুধু ভালোলাগার কথা বলাতে টাকা রোজগারের একমাত্র অবলম্বন টিউশনি ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে দোয়া না। এটা ভালোমতোই জানে ও। তাছাড়া দোয়ার রিফিউজ করাটাও রনোকের রাগের একমাত্র কারন হওয়াটা মানাচ্ছে না।হাতের ছুড়িটা আলতোভাবে রনোকের হাতে চালাতে চালাতে বললো,

-এইসব ভালোলাগা নামক সাধুভাষা তোর মুখে মানায় না। আর না এটুকের জন্য দোয়ার টিউশনি ছেড়ে দেওয়া। নাইবা,দোয়ার প্রতি তোর এখনো এতো রাগ পুষে রাখা! এই আগডুম বাগডুম রচনা আর লুকোচুরি ছেড়ে পুরো ঘটনা বল!

ছুড়িটার দিকে তাকিয়ে রনোক গড়গড় করে সেদিনের ওর বাজে কথা বলা,দোয়ার চড়,ওর বোনকে অপমান করা সবটা বলে দিলো। আরাব হাসলো । দোয়াকে নিয়ে ওর সমস্ত ধারনা যথাযথভাবে মিলে যাচ্ছে। অদ্ভুত তৃপ্তি মনে হচ্ছে ওর এতে। চেয়ারের হেলান দেওয়ার দিকটায় থুতনি ঠেকিয়ে কৌতুহল নিয়ে বললো,

-বুঝলাম।আচ্ছা এবার এটা বল,যে মেয়ে কিছুদিন আগে তোকে চড় মারতে পারলো,কি এমন ঘটেছে কাল যে সেই মেয়েই আজ তোকে দেখে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিলো?

রনোকের ভয় হচ্ছে। হাত জ্বলছে ওর তখনো। নাক চোখ দিয়েও পানি পরছে। নাক টেনে বললো,

-চড় মেরেছিলো বলে রাগ ছিলো ওর প্রতি। চেয়েছিলাম আমার প্রতি যেনো ততোটাই ভয় থাকে ওর। ওকেও বলেছি,রনোক ওকে শান্তিতে বাচতে দেবে না,এমনটা ভয় দেখতে চাই আমি ওর চেহারায়। কিন্তু তবুও ও ইগ্নোর করেছে আমাকে,ভয় তো দুরেই থাক,দেখেও না দেখার মতো করে চলে যেতো। তাই আগেরদিন টিউশনি থেকে ফেরার পথে ওকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিলাম। ওকে….

আরাব এবার ছুড়িটা রনোকের গলায় ধরলো। আতকে উঠলো রনোক।আরাব ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলে ধীর গলায় বললো,

-তোর পরবর্তী কথাটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে রনোক।

রনোক তাড়াহুড়ো করে বললো,

-কিছু করিনি!ক্ কিছুই করি নি ওকে!জ্ জাস্ট ভয় দেখাবো বলে তুলেছিলাম। আ্ আর শুধু ভয়ই দেখিয়েছি। কিচ্ছু করিনি দোয়াকে। কিছুই না!ট্রাস্ট মি!

আরাব ছুড়ি সরালো। দাতে দাত চেপে বললো,

-তাহলে দোয়ার হাতে নখের আচড় কেনো?

বিস্ময়ে তাকালো রনোক। এই ছেলে এভাবে গুনে গুনে সবকিছু ধরে রেখেছে দেখে ওর পাগলামী ছাড়া অন্যকোনো শব্দ মাথায় আসলো না। আবারো শুকনো ঢোক গিলে বললো,

-ও্ ওটা…শুধু সবার সামনে অপমান করবো বলে ওর জামার হাতা….

আরাব উঠে ওর মুখ বেধে দিলো। দিনভর চেচালেও আওয়াজ বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু আপাতত রনোকের কোনো কথা শোনার প্রয়োজনবোধ করছে না ও। পাশের টি টেবিলটা রনোকের সামনে টেনে দিয়ে ব্যস্তভাবে বললো,

-এসিড অর বেস?কোনটা বেশি প্রেফার করিস তুই? দু সেকেন্ডের মধ্যে ইশারায় বোঝাবি! নইলে আমিই চুজ করে দেবো।

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো রনোক। আরাব বললো,

-টু সেকেন্ডস্ আপ! এক্সট্রা টাইম দেবো না।ওকে,তোর জন্য আমার ফেভারিট! পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড,বেস!

কথাটা বলে হ্যান্ডগ্লাভস্ পরে একটা রিয়েজেন্টের বোতল হাতে নিলো আরাব। রনোক শুধু সবটা দেখছে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। আরাব চেয়ারে বাধা ওর আঙুলগুলো পরখ করতে করতে বললো,

-তোর কোন হাতের কোন আঙুলে দোয়ার হাত কেটেছে?

রনোক নড়াচড়া করছে।কিছু বলতে চাইছে। আরাবের ভ্রুক্ষেপ নেই।নও রনোকের আঙুল দেখতে ব্যস্ত। ওগুলোর দিকে তাকিয়েই‌ বললো,

-দেখ,আমাকে খুব বেশি নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করিস না। আমি খুব হাশিখুশি,ইনোসেন্ট,কিউট,খেয়ে ফেলা টাইপ ছেলে। মানুষজন আমাদের সেক্টরের সবাইকে গম্ভীর উপাধি দেয়। কিন্তু আমি মোটেও ওমন না। এটা সবাই বলে। এখন তুই যদি না বলিস এক্সাক্ট কোন আঙুলের নখে দোয়ার হাতে আচড় লেগেছে,আমার সবগুলোর আঙুলের সাথেও অনর্থক….

-উম্ উম্ ম!

আরাব রনোকের মুখ খুলে দিলো। বললো,

-হ্যাঁ বল,কোন আঙুল?

রনোক আহাজারির মতো করে বলতে লাগলো,

-আমাকে ছেড়ে দিন ভাই!আমি দোয়ার সামনে আর কোনোদিনও যাবো না! ক্ষমা চেয়ে‌ নেবো!কোনোদিন ওকে….

বিরক্তি নিয়ে আবারো ওর মুখের বাধন তুলে দিলো আরাব। ডানহাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে কোনোভাবেই ওমন কাটাছেড়া হওয়া সম্ভব না জেনেও সে আঙুলেই কেমিক্যাল ঢেলে দিলো। তৎক্ষনাৎ আঙুলের মাংস গলে পরার মতো করে ছেড়ে হাত থেকে মাটিতে পরলো। মুখবাধা বলে গুমড়ে গুমড়ে কাদতে লাগলো রনোক। আরাব রনোকের বৃদ্ধাঙ্গুলেও কেমিক্যাল ঢেলে‌ দিলো। আর্তনাত শুধু রনোকের নিজকানেই বারি খেলো হয়তো।আরাব সবে মধ্যমাতে কেমিক্যাল ঢালতে যাবে,চেয়ার উল্টে একদম ওর পায়ের কাছে পরলো রনোক। চেয়ার ঠিক না করে আরাব মেঝেতে বসলো।রনোকের মুখের বাধন সরিয়ে দিয়ে বললো,

-কোন আঙুল?

রনোক যেনো এইটাই চাচ্ছিলো। ও বুঝে গেছে,আরাব থামবে না। কষ্ট বেশি করে দেবে বলে জেনেশুনে কনিষ্ঠা,বৃদ্ধাঙ্গুলি,মধ্যমা ধরেছে ও।হাতের পাঁচ আঙুল একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার চেয়ে একটার যন্ত্রনা সহ্য করা সহজতর। তাই কাদতে কাদতেই বললো,

-অনামিকা ভাই!অনামিকা!

বাকা হাসি ফুটলো আরাবের ঠোটের কোনে। চেয়ার ঠিক করে দিয়ে মুখ আটকে দিলো ও রনোকের। ও কাতরাচ্ছে। বাকি আঙুলদুটোর যন্ত্রনায় অনামিকার শাস্তিভোগ কম হবে ভেবে ওগুলোতে কোনো একপ্রকার নিউট্রিলাইজিং পাউডার লাগিয়ে দিলো। খানিকটা শান্ত হলো রনোক।জ্বালা কমেছে কিছুটা। কিন্তু ওকে চুপ থাকতে দেখাটা যেনো আরাবেরই সহ্য হলো না। বোতলের পুরো কেমিক্যাল ঢেলে দিলো অনামিকা আঙুলে।

সবেমাত্র জবেহ্ করা কোনো প্রানীর ন্যায় ছটফট করছে রনোক। যে হাত দোয়ার হাত ধরেছিলো,সে হাতের হাতের তালুতে ছুড়ির কাটাছেড়া,লবনমরিচের প্রলেপ।যে আঙুল দোয়ার হাতে নখের আচড়ের কারন,তা সহ আরো দুটো আঙুল বিগলিতপ্রায়। আরাবের মনে প্রশান্তি। উঠে দাড়িয়ে রনোকের চুলগুলোতে আলতোভাবে আঙুল চালিয়ে বললো,

-শোন রনোক! এই গোডাউনটা মেবি দিনতিনেক বন্ধই থাকবে। যদিও শিওর না,তার বেশি কি না! তুই একটু কষ্ট করে,মানে একটু কষ্ট করে দিনগুলো পার করে দিস। কপাল ভালো হলে তার আগেই কেউ চলে আসতে পারে। তখন অবশ্য ছাড়া পেয়ে যাবি।আজ আমি আসছি কেমন? তোর সাথে সময় কাটিয়ে বেশ ভালোলাগলো।

আরাব উঠে চলে যাচ্ছিলো। রনোক ওভাবেই ছটফট করছে। কি মনে করে আরাব পিছনের দিকে ঘাড় একটুখানি ঘুরিয়ে বললো,

-দোয়া নামটা মাথা থেকে মুছে ফেল এ তিনদিনে। নইলে তোর নাম পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার দায়িত্ব নিতে আমি দুবার ভাববো না। আমি চাইনা এর থেকেও কোনো বাজে সাক্ষাতের। টিল দেন,টেক কেয়ার অফ ইউরসেল্ফ!

হুস্টলিং করতে করতে,পকেটে হাত গুজে,হেলেদুলে বেরিয়ে গেলো আরাব।রনোক হাত মুচড়াতে মুচড়াতে তাকিয়ে রইলো ওর চলে যাওয়ার দিকে। এ কেমন মানুষ?নিজেকে ভদ্রসভ্য দাবীও করছে,আবার সাইকোর মতো কাজও করছে। দোয়ার নাম তো এখন ও আরো ভুলতে পারবে না। এই নাম যে দুঃস্বপ্ন হয়ে প্রতিমুহুর্তে ওকেই ভয় দেখাবে এবার থেকে!গলে যাওয়া নখগুলোর দিকে তাকিয়ে জোরেসরে আর্তনাৎ করে উঠলো আরো একবার।

ক্লাসে শেষবেঞ্চে বসে এদিকওদিক তাকাচ্ছে দোয়া। আগেরদিন ওর একমাত্র বান্ধবী তাজীনের নানুবাসা থেকে আসার কথা ছিলো। দশদিন থেকেছে নানুবাসায়।তাই আগেরদিনই যে তাজীন ভার্সিটি আসবে তা ও নিশ্চিত ছিলো। আর হসপিটাল গিয়েছিলো বলে আগেরদিনই ভার্সিটি মিস দিতে হয়েছে ওকে।এবার তাজীন এসে যে কতোখানি রাগ দেখাবে ভেবেই বিচলিত হয়ে পরেছে ও।মন ভালো নেই এমনিতেও।আগেরদিন রনোককে চড় মারার পরিনতি ভাবতেই শিউরে উঠছে বারবার। হুট করে কাধে কারো স্পর্শ পাওয়াতে চমকে দাড়িয়ে গেলো দোয়া।ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে থেকে গাল ফুলিয়ে ওর পাশেই বসে গেলো তাজীন।দোয়া নিজেকে সামলে বসে গিয়ে বললো,

-কেমন আছিস তাজ?

দোয়ার কাছে তুই সম্বোধন শুনে রাগ গায়েব হয়ে গেলো তাজীনের।ও সবসময় তু ডাকলেও ওকে খুব কম সময়ই তুই ডাকে দোয়া। তবুও এতোসহজে রাগ কমেছে বোঝাবে না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

-আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি।তুই?

-তোকে ছাড়া ভালো থাকতে পারি?

তাজীন সরু চোখে তাকালো দোয়ার দিকে। ঠোট টিপে হাসলো দোয়া।ওভাবে তাকিয়ে থেকেই তাজীন বললো,

-বেশ ভালোমতোই ইমোশনাল ড্রামেবাজ হয়ে গেছিস দেখছি তুই!

-হতেই হতো।তাজের বেস্টু বলে কথা!

দুজনেই হাসলো।খানিকটা সময় কথাবার্তার পর তাজীনের একটা ফোন আসে।অন্যমনস্ক হয়ে পরে দোয়া।বিকেলে টিউশনিতে যাবে কি না,গেলে রনোক কি করতে পারে,হাজারটা দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরছে ওকে।ফোনে কথা বলা শেষে তাজ দোয়ার উদাসীনতা লক্ষ্য করলো। দোয়ার সংসার,আর্থিক অবস্থা,দিয়ানের অপারেশনের বিষয়ে সবটাই জানে ও।সবসময় এটা নিয়েই চিন্তিত থাকে দোয়া এটাও জানে। তাজীন যথেষ্ট বড়ঘরের মেয়ে। এ কারনে দোয়া শুরুরদিকে ওর সাথে বন্ধুত্বও‌ করতে চায়নি। ওর ধারনা ছিলো,বাকিসব মেয়েগুলোর মতো তাজীনেরও হয় অর্থহংকার থাকবে,নয়তো ওর প্রতি করুনা থাকবে। খুব কষ্টে দোয়ার এ ধারনা পাল্টেছে তাজীন। আর্থিক সহয়তার চেষ্টাটাও করলে ওদের বন্ধুত্ব সেদিন নষ্ট হয়ে যাবে,এটা ভালোমতোই জানে তাজীন। তাই চেষ্টা করে দোয়াকে মানসিক প্রশান্তি দেওয়ার। ওর কাধে ধাক্কা মেরে বললো,

-দোয়া বেব,আমি না প্রেমে পরেছি!

দোয়া খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। সুন্দরী হওয়ায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রেমের প্রস্তাব আসেই ওর জন্য।কিন্তু তাজীন কোনোদিনও একটাও প্রেমপ্রস্তাবে রাজি হয়নি। আর প্রেমে পরা!সেটা হলেও ওকে আগেআগে জানাতো।তাই‌ ওর উচ্চারন করা শব্দসমষ্টিকে মিথ্যে আখ্যা দিয়ে দোয়া চুপই রইলো। হঠাৎই ওর সামনে মোবাইলের স্ক্রিনে একজন পুরুষের ছবি। এপ্রোন পরিহিত উজ্জ্বল শ্যামবর্নের চেহারার লোকটি বেশ সুদর্শন।দোয়া বড়বড় চোখে তাজীনের দিকে তাকালো ।তাজীন মুচকি হেসে বললো,

-নানুভাইয়ের বন্ধুর নাতি। হার্টসার্জন। এই ডক্টর আমার হার্টের দশা খারাপ করে ছেড়েছে ইয়ার!

দোয়া হেসে দিলো।তাজীনের চেহারায় লাজুকতা।ওকে এই প্রথমবার কোনো ছেলে নিয়ে কথা বলতে দেখলো ও। হৃদয়ের কোনো এক কোনে অনাদরে পরে থাকা “ভালোবাসা” শব্দটার প্রতি সুপ্ত মুগ্ধতাগুলো হঠাৎই নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো ওর। পরমুহুর্তেই দায়িত্বগুলোও গা ঝারা দিলো। মৃদ্যু হাসিতে বিনুনির অগ্রভাগের চুলে দৃষ্টিস্থির করে মনেমনে আওড়ালো,তোর প্রেমে পরা বারন দোয়া।প্রেমে পরা বারন….
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১২

উন্মুক্ত পিঠে ভার অনুভব হতেই নড়েচরে আরো আরাম করে শুয়ে পরলো আরাব। ঘাড়ের দিকটা বেশ অনেকটাই ব্যথা হয়ে আছে। তার যথেষ্ট কারনও আছে। আগের দু দুটো রাত ঘুমোয়নি। নিজের বাসায় চোরের মতো ঢুকেছে ভোরররাতের দিকে। এসেই ঘুম! বিছানার পায়ের দিকটায় মাথা দিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে আছে ও। চোখ না খুলে ঘুম জরানো কন্ঠে বললো,

-কখন এসেছো টুইঙ্কেল?

-কিছুক্ষন আগেই।

সামনে থেকে টুইঙ্কেলের আওয়াজ পেয়ে চোখ মেললো আরাব। সামনেই দাড়িয়ে চকলেট খাচ্ছে টুইঙ্কেল। সাদা রঙের ফ্রক পরে আছে।মুখে একগাদা চকলেট লেগে আছে ওর। সকাল সকাল ছোট্ট শুভ্র পরীটাকে দেখে মনটাই ভালো হয়ে গেলো ওর। একটুপরেই মনে পরলো,টুইঙ্কেল তো সামনে দাড়িয়ে। তবে ওর কাধে ভারি লাগছিলো কি? ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো আরাব। টুইঙ্কেলকে দেখে যতোটা মন ভালো হয়েছিলো,নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো সবটা।
ও ভেবেছিলো ওকে উপুর হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে বরাবরের মতো টুইঙ্কেলই উঠে দাড়িয়েছে ওর পিঠের উপর। কিন্তু না। তেমনটা একদমই না। বিছানার পাশেই জারা দাড়িয়ে। আরাবকে ফিরতে দেখে একটা হাসি দিয়ে বললো,

-গুড মর্নিং আরাব!

আরাবের বুঝতে বাকি রইলো না জারাই স্পর্শ করেছে ওকে। কড়া মেজাজে উঠে বসলো ও। রাগ হচ্ছে,কিন্তু প্রকাশ করার ইচ্ছে ওর নেই। বিছানায় থাকা টিশার্টটা পরতে পরতে বললো,

-তুমি এ ঘরে কেনো?

জারার দৃষ্টি আরাবের উন্মুক্ত বুকে। ঠোট কামড়ে হেসে বললো,

-কেনো মিস্টার? বারন বুঝি আমার এ ঘরে আসা?

আরাব বিছানা ছেড়ে নামলো। স্বাভাবিক গলায় বললো,

-একটা কথা বলো আমাকে জারা,আমি একটা ব্যাচেলর ছেলে। একটা বাঙালি মেয়ে হয়ে আমার ঘরে এভাবে বিনা অনুমতিতে ঢোকা,রুচিতে বাধে না তোমার?

জারা দমে গেলো। রাগ দেখায় না,কিন্তু প্রতিবারই মিষ্টিভাষায় জারাকে এভাবে অপমান করে আরাব। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাগ সংবরন করলো ও। তারপর একটা জোর করে হাসি দিয়ে বললো,

-শোল্ডারে পেইন ছিলো তোমার? ম্যাসাজ করে দেবো?

-নো নিড। নিজের লিমিটগুলো ভুলো না জারা।

আরাব একটু শক্তভাবে বললো।তারপর তোয়ালেটা কাধে ঝুলিয়ে টুইঙ্কেলকে বললো,

-টুইঙ্কেল? আম্মু এসেছে তোমার? আব্বু?

-আব্বু আসেনি। আম্মুও আমাকে রংধনুতে রেখে হসপিটাল চলে যাবে বলে এসেছে। তোমার সাথে দেখা করবে বলে ওয়েট করছে।

-ফাইন,তুমি নিচে যাও,আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি হুম?জারা? তুমিও বেরোও রুম থেকে এখন। আর নেক্সটটাইম আমার পারমিশন ছাড়া এ ঘরে ঢুকবে না।

-কিন্তু তৌফিক আঙ্কেল যে বলে…

-রুমটা আমার। তোমার তৌফিক আঙ্কেলের নয়। তুমি আরেকবার জিজ্ঞেস করে নিও বাবাকে।

জারা মনটা ছোট করে ফেললো। বললো,

-আমি তো জানতাম তোমার স্টাডিরুমে যেতে বাসার বাকিসবার মতো পারমিশন লাগে। এই রুমে আসতেও পারমিশন লাগবে বলছো?

-মানুষের বেডরুম মানে স্টাডিরুমের চেয়ে আরো বেশি পার্সোনাল কিছু।ডাক্তারি পরছো,এটুকো কমন সেন্স তো রাখো জারা!

-সেন্স তো তোমার জন্যই হারিয়েছি।আর এ রুমটাও কয়েকদিন পর আমাদের হয়ে যাবে। এতো কমন সেন্স দিয়ে কি হবে তখন বলোতো?

বিরবিরিয়ে বলে জারা লাজুক ভঙিমায় কপালের কিছু চুল কানে গুজলো। আরাবের সবকথাতেই ওর ভালোলাগা কাজ করে। যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে অপমান বকে মনে হয়,ওর কাছে যেনো তা শাষন। জারার বলা কথাটা পুরোপুরিই কানে গেছে আরাবের। ছেচড়ামো ছাড়া আর কোনো শব্দ আবিষ্কার করতে পারলো না ও জারার জন্য। বিরক্তির শ্বাস ফেলে তোয়ালে কাধে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে হাটা লাগালো ও। পেছন থেকে জারা বলে উঠলো,

-তোমাকে এই থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর খালিগায়ে অনেক হট লাগে আরাব!

-রুম থেকে বেরোও!

চেচিয়ে বলে ধরাম শব্দে ওয়াশরুমের দরজা লাগালো আরাব। শাওয়ার অন করে দেয়ালে একহাত রেখে দাড়ালো। মন পুরোটাই বিগড়ে গেছে ওর। আর সবটার জন্য ওর বাবা দায়ী। ওর জীবনে তৌফিক ওয়াহিদের ভুমিকা তেমনভাবে ছিলো না কোনোদিনই। সে তো চেয়েছিলো আরাবের নিয়ন্ত্রক হতে,এখনো চায়। কিন্তু হয়ে উঠতে পারেনি। হতে দেয়নি আরাব। মাধ্যমিক পাশের পর থেকেই নিজের স্কলারশিপের টাকায় পড়াশোনা শেষ করেছে। তৌফিক ওয়াহিদের বিশাল সম্পত্তির টিকিটার দিকেও ফিরে চায়নি। নিজেরমতো করে স্বাধীন জীবনযাপন করবে মাঝেমধ্য রংধনু থেকে চলে যাওয়ার কথাও ভেবেছে। মা বোনের কথা ভেবে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আর তার সুযোগটা তৌফিক ওয়াহিদ ভালোভাবেই নিতে শিখে গেছেন। বড়লোক বাবার মেয়ে জারাকে ছেলের বউ করবেন বলে উনি মাতোয়ারাপ্রায়।

মাথার ভেজা চুলগুলো উল্টে চোখ বন্ধ করলো আরাব।হুট করেই দোয়ার সেদিনের হাসিমুখটা ভেসে উঠলো ওর চোখের সামনে। হাসি ফুটলো ওর চেহারাতেও। অশান্ত হৃদয়জুড়ে ক্রমশ নামলো শীতলতা।
বাইরে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে জারা। টুইঙ্কেল এগিয়ে এসে চকলেটটা জারার সামনে ধরে বললো,

-আরাব মামা রাগ করেছে জারা আন্টি। তুমি নাও,চকলেট খাও!

এতোক্ষনে জারা টের পেলো। ঠিকই তো,আরাব রাগ করেই দরজা লাগিয়েছে,ওকে রুম থেকে বেরিয়েও যেতে বলেছে। টুইঙ্কেলের হাত থেকে চকলেটটা নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারলো ও। তারপর ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। মেঝেতে পরে থাকা চকলেটের দিকে তাকিয়ে ঠোট উল্টালো টুইঙ্কেল। আরাব মামা বলেছে,যেদিন নানুভাই বাসায় থাকবে,সেদিন জারা আন্টির যে কাজেই রাগ হবে,নানুভাইকে বলে দিতে। এতে ও এক্সট্রা দুটো চকলেট পাবে। আর নানুভাই না থাকলে একটা চকলেট পাবে। আজ নানুভাই বাসায় নেই।তাই শর্তমতো আরাবের টেবিলের ড্রয়ার খুলে ওখানে একটা চকলেট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো আরাব। রুমে বুকে হাত গুজে তৌফিকা দাড়িয়ে। ওকে বেরোতে দেখেই বললো,

-তোর শার্টে রক্ত কেনো আরাব?

হচকিয়ে গেলো আরাব। মনেমনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো জারাকে নিয়ে তৌফিকাকে শুনাবে বলে। কিন্তু ওর বোন সবসময়ই এক ক্লাস উপরে। পর্যাপ্ত ঘষেমেজে ধুয়ে মেলে দেওয়া শার্টটায় থাকা রনোকের হাতের রক্তের ছিটেফোটা দাগ ঠিকই চোখে পরেছে তৌফিকার। আরাব জোরপুর্বক হেসে বললো,

-কিহ্? রক্ত? কি রক্ত?কিসের রক্ত? কোথায় রক্ত? কেনো রক্ত?কিভাবে রক্ত? কোন পিএইচের রক্ত?

তৌফিকা এগিয়ে এসে শার্ট দিয়েই বারি লাগালো ওকে। হাতে দুটো কিল বসিয়ে বললো,

-উদ্দীপকের গুরুত্ব অপরিসীম। এতেই চলবে? নাকি আরো বুঝাবো?

-আরে আরে,মারছিস কেনো? আপু তুই কিন্তু কথায়কথায় আমার গায়ে হাত তুলিস। আমার আর ওই বয়স আছে?

-তোর বয়সের সেকেন্ডের হিসাব আছে আমার। টপিক একদম চেইন্জ করার চেষ্টা করবি না আরাব। এই রক্ত কিসের? কি হয়েছিলো? বললি দোয়ার ওখানে যাবি,দুইদিন কোথায় ছিলি তুই? বাসায় বলেছি আবারো ট্রিপে গেছিস,আমার কথা হয়েছে তোর সাথে। কাল নির্ঘাত চোরের মতো বাসায় ঢুকেছিস? এমন কেনো করিস তুই? টেনশন হয়না আমার? তোর কিছু হয়ে গেলো…

তৌফিকা ফুপিয়ে কেদে দিলো। আরাব‌ হেসে জরিয়ে ধরলো‌ বোনকে। মাথায় হাত বুলিয়ে‌ দিয়ে‌ বললো,

-তুই জানিস আমি এমনই।

আরো কাদছে তৌফিকা। ভাইটার এতো গা ছাড়া স্বভাব বরাবরই ওর ভয়ের কারন। আরাব তৌফিকার চুলগুলো নেড়েচেড়ে বললো,

-আপু জানিস,দোয়ার চুলগুলোও‌ কার্লি। কিন্তু একেবারে কোমড় অবদি। আর তোর চুলগুলো দেখ? এগুলোতে গ্রোথ হরমোন দরকার। কমপ্লান খাওয়াবি। আমি রেকোমেন্ড করে দিলাম।

তৌফিকা মাথা তুলে আরেকটা ঘুষি লাগিয়ে দিলো আরাবের বুকে। ওর গাল ফুলানো দেখে আরাব হেসে দিলো। তৌফিকা চোখের পানি মুছে বললো,

-বলনা আরাব,কিসের রক্ত ওটা? তোর শার্টে রক্ত লাগলো কি করে? কার রক্ত?

-রক্ত না সিস্টার বিডি,ওটা ইন্ডিকেটর। মিথাইল রেড!

ইনোসেন্ট একটা হাসি দিলো আরাব। তৌফিকা কিছুক্ষন সরু চোখে তাকিয়ে থেকে ‌বললো,

-ডাক্তারি পরেছি বলে কেমিস্ট্রির সাধারন জ্ঞান নেই,এমনটা কেনো ভাবছিস তুই? আমাকে শিখাবি,কোনটা ব্লাড আর কোনটা মিথাইল রেড? সত্যিটা বল আরাব,নইলে জারাকে গিয়ে বলবো তুই ডাকছিস!

-ও যায়নি এখনো?

-না।

আরাব হতাশার শ্বাস ফেলে বললো,

-এক ছেলে দোয়াকে ডিস্টার্ব করতো। ওকে একটু বোঝাতে গিয়ে…

খানিকটা চুপ থেকে তৌফিকা মুচকি হাসলো। বললো,

-একটু বোঝানো? আর তুই? তোকে আমি ভালোমতো চিনি আরাব। এখন শুধু তোর ভালোবাসার সীমাটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি। বেচারা টিজার!

ঘাড়টা চুলকে লাজুক হাসলো আরাব।তৌফিকা বললো,

-বেরোবি?

-হুম। বায়োমেডিতে যাবো। ওখানেও ঝামেলা লেগে আছে কিছু।

-আবার কি?

-পরে বলবো। তুই আমার একটা কাজ কর।

-কি?

-তোর জুনিয়রকে সামলা আপু! জারাকে একটু সামলা? বাবাকে বোঝা? এই একটা আউটসাইডার মেয়ের জন্য আমি তোদের ছেড়ে,রংধনু ছেড়ে যেতে চাইনা আপু। বাবার সাথে আমার আর ঝামেলা করতে ভালো লাগে না! তিক্ত আমি!

আরাব একেবারে বাচ্চাদের মতো করে বললো। তৌফিকা বেশ কিছুক্ষন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। বললো,

-দোয়ার বিষয়ে ওকে বললে হতো না?

-দুটো ঘটনা ঘটতো। এক, বাকিগুলোর মতো বিশ্বাস করতো না।দুই,বিশ্বাস করে বাবাকে সবটা জানাতো। প্রথমটা বিরক্তিকর। দ্বিতীয়টা এইমুহুর্তে চাইছি না আমি।

-তাহলে বাবাকে বলবি কবে?

বোনের সামনে থেকে সরে তোয়ালে বিছানায় ছুড়লো। ব্যালকনির দিকে এগোলো আরাব। বাগানের কাঠগোলাপ গাছটা ফুলে ভরে আছে। ইদানিং এই গাছের দিকে তাকালেও ওর দোয়ার কথা মনে পরে। মুচকি হাসিতে চেহারা আবৃত রেখে বললো,

-শুধু একবার,একটাবার দোয়াকে‌ বলি,ওকে ভালোবাসি।প্রতিউত্তরে ও‌উ‌ বলুক,আমাকে ভালোবাসে। সেই‌ মুহুর্তটার অপেক্ষায় আছি আপু। সেই পার্ফেক্ট সময়টার অপেক্ষা। সেদিন আমি বাবা কেনো,পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দেবো,দোয়া আমার। আমি দোয়াকে‌ই ভালোবাসি। সে মুহুর্ত থেকে দোয়া আমার রঙে সাজবে। কোনো আড়াল,দেয়াল থাকবে না আমাদের মাঝে। আমি থাকতে দেবো না! কোনোভাবেই না!

হাতের কব্জি কচলাতে কচলাতে মৃত্তিকাদের বাসা থেকে বেরোলো দোয়া। মাঝে একদিন পেরিয়ে গেলো।আগেরদিন ফেরার সময় অরুনাভ মুখার্জীকে আসতে বলেছিলো, বাজার করার নাম করে। কিন্তু সেটা মুলত ছিলো রনোকের ভয়। আজকে কি বলতো কাকাবাবুকে?একাকীই বাড়ির জন্য হাটা লাগিয়েছে। তাই ভয়টাও বেশি। রাস্তায় লোকজনের চলাচল আছে। এদিকওদিক তাকিয়ে সেদিনের আন্টিদুটোকে খুজলো দোয়া। নেই। সেদিন যারা যারা ছিলো,তাদের একজনকেও দেখলে শান্তি পেতো ও। কিন্তু কেউই‌ নেই। পা কাপছে ওর। তবুও জোরে হাটা লাগিয়ে অনেকটা পথ চলে আসলো। সন্ধ্যা নেমেছে। এদিকটায় লোকজনের আনাগোনাও কম। যদিও রনোককে যেখানে দেখেছিলো,সে‌ জায়গা পার করে এসেছে ও। তবুও ফাকা রাস্তা দেখেই ভয় বেড়ে গেলো ওর। ঝড়ের পুর্বের শীতলতায় গা ছমছম করছে যেনো। আচমকাই ভুতের মতো কেউ একজন পায়ের তলায় এসে পরলো ওর। লাফিয়ে চারকদম পিছিয়ে গেলো দোয়া। লোকটা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে দোয়ার পা জরিয়ে ধরে আর্তনাত করে উঠলো,

-ক্ষমা করে দাও দোয়া। আর কোনোদিনও এই মুখ দেখাবো না তোমাকে। আর কোনোদিনও আমার মুখোমুখি হতে হবে না তোমাকে। আর কোনোদিনও আমার নামও উচ্চারন করতে হবে না তোমাকে। ক্ষমা করে দাও। প্লিজ ক্ষমা করে দাও!

পা ছাড়ানোর জন্য অস্থির হয়ে পরলো দোয়া। চেহারা দেখেনি মানুষটার। তবে গলার আওয়াজ চিনতে ভুল হলো না এর। এটা রনোক। অস্ফুটভাবে বললো,

-ক্ কি করছেন কি? ছ্ ছাড়ুন আমার পা!

-আগে তুমি বলো আমাকে ক্ষমা করেছো?

-আ্ আরে,এসব…পা ছাড়ুন!

-না বললে ছাড়বো না দোয়া। এই মুখও দেখাবো না তোমাকে।

-আ্ আচ্ছা বেশ,ছাড়ুন পা। আ্ আপনি….

দোয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই উঠে দাড়ালো রনোক। আবছা আলোতে ওর চেহারা দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে দোয়া। ওকে থ্যাংকস্ বলে এদিকওদিক তাকিয়ে একপ্রকার ছুটে পালালো রনোক। দোয়া কয়েকসেকেন্ড তব্দা মেরে দাড়িয়ে রইলো। রনোকের এই অবস্থা,নাকি ওই ভুল দেখলো,ভুল শুনলো বুঝে উঠতে পারছে না ও একেবারেই। গলির পাশের বিল্ডিংটার তিনতলার ব্যালকনি থেকে এক বারোতেরো বয়সের ছেলে চেচিয়ে বললো,

-এইযে লম্বা বিনুনিওয়ালা আপু? তোমার সামনে থাকা পায়ড়াগুলো উড়িয়ে দাওতো।বাসায় আসুক! এই ভরসন্ধ্যায় এখনো রাস্তায় বসেবসে কি খাচ্ছে কে জানে!

উপরে তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখলো দোয়া। তারপর সামনে তাকালো। অনেকগুলো কবুতর রাস্তায় পরে থাকা ঝালমুড়ি খাচ্ছে। দোয়ার চেহারায় একরাশ আনন্দের ঝলকানি। গলার সামনে দিয়ে রাখা শান্ত বিনুনিটাকে কাধে ছুড়ে মারলো। ওড়নাটা একহাতে বাতাসে ছড়িয়ে উচ্ছলভাবে দৌড় লাগিয়ে উড়িয়ে দিলো কবুতরগুলো।

দোয়া হাসছে। উড়তে থাকা পায়ড়াগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর সে হাসি বিদ্ধ হচ্ছে আড়ালে থাকা একজোড়া মুদ্ধ চাওনিতে। প্রেম পায়ড়া উড়তে শুরু করেছে তার হৃদমাঝারে। বুকে হাত গুজে খানিকটা দুরেই একটু আধারে বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইলো আরাব। দোয়ার হাসিতে চাওনি স্থির রইলো ওর। আগেরদিন অরুনাভ মুখার্জীকে নিয়ে বাসায় ফেরা,খেয়াল করেছিলো ও দোয়ার ভয়। এই ভয় কাটানোর উদ্দেশ্যেই রনোককে ছেড়েছিলো ও। কিন্তু তা যে দোয়ার হাসিতে ওকেই প্রশান্ত করে গেলো,এমনটা একদমই ভাবেনি ও। ডানহাতে বুকের বা পাশটা চেপে ধরলো আরাব। মুচকি হেসে মৃদ্যস্বরে আওড়ালো,

-চাইলেও তুমি আমার,না চাইলেও,তুমি আমার।তুমি…আমার!আমার এ ভাবনায় কোনোদিনও তোমার জোর খাটবে না দোয়া। মনে রেখো,তোমার এই বেরঙ শহর এভাবেই নিজ হাতে রাঙিয়ে দেবো আমি।তোমার ওই নিস্প্রান চাওনিতে এভাবেই প্রানোচ্ছলতা এটে দেবো।তোমার নিঃস্ব হৃদপ্রাঙনে প্রেমের সমৃদ্ধতা এনে দেবো আমি।ওই গম্ভীর,মায়াভরা মুখটায় এভাবেই জীবনের সবটুকো সুখপ্রাপ্তির হাসি একে দেবো।হ্যাঁ,এ সবটাই হবে! আমার পাগলামীগুলোতে পরিপুর্নতা পাবে সবটা। তোমাকে মুড়িয়ে আমার এ পাগলামীগুলোর নামকরনও হয়ে গেছে!ভালোবাসা!ভালোবাসি তোমাকে।এতোটা ভালোবাসি,হয়তো তার অনুভবটুকোও ধারন করার সাহস তোমার নেই।তাইতো অস্বীকার করো,চোখ সরিয়ে নাও। তাইনা? তোমার সব কথায়,সব কাজে এ ভালোবাসা বেড়ে যাচ্ছে দোয়া। নাও আই ফিল,ও শুধু বাড়তেই জানে। ইটস্ ইউর টার্ন টু ফিল,তোমার সবটা নিয়ে,আমি তোমাকেই ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি! আমার ভালোবাসাকে একবার অনুভব করলে,তুমিও ভালোবাসবে আমাকে। ট্রাস্ট মি। তখন আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা হবে তোমার নিজের চেয়েও বেশি,তোমার কল্পনার চেয়েও বেশি!দেখে নিও!

#চলবে…

]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here