এবং স্ত্রী পর্ব – ৩০+৩১

#এবং_স্ত্রী
#পর্ব_৩০
#Jannatul_Ferdos

গোধুলির লগ্নে নিরুপমা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।বাতাসে তার খোলা চুল গুলো আপন মনে উড়ছে।আজ এতোগুলো বছর পর তার মায়ের মৃত্যুর শোক তাকে জেঁকে ধোরেছে।সত্য কতোটা নির্মম, নিষ্ঠুর তা নিরুপমা আজ বুঝলো।বাস্তবতা মানতে আমাদের সকলেরই খুব বেশি কষ্ট হয় নিরুপমার ক্ষেত্রে তার ব্যাতিক্রম কিছু ঘটলো না।উৎস নিরুপমাকে রুমে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে আসে। মেয়েটাকে খুব বিষন্ন দেখাচ্ছে।উৎসের নিজের যে খারাপ লাগছে না তা না সে অনেক বেশি অনুতপ্ত। মিসেস ডালিয়ার জন্য সে নিরুপমার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছে গায়ে হাত তুলেছে পর্যন্ত কিন্তু সেই মিসেস ডালিয়া পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মানুষ গুলোর মধ্যে একজন।একটা মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে তা বোধ হয় মিসেস ডালিয়া আর পারুল বেগমকে না দেখলে সে বুঝতো না।সে নিরুপমার কাছে গিয়ে কাধে হাত দেয়।নিরুপমা উৎসের স্পর্শ পেয়ে চোখের নোনা পানি গুলো মোছার মিথ্যা চেষ্টা করে।কিন্তু কথাই আছে আমরা কিছু লুকাইতে চাইলে সেইগুলো বার বার সামনে চলে আসে আর নিরুপমার চোখের অবাধ্য পানি ও বার বার চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে।
“আমাকে তুমি মাফ করে দেও নিরুপমা
” ক্ষমা চাইছেন কেন?
“আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি অনেক নিরুপমা। আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ……উৎসের চোখের কোনায় পানি দেখেই নিরুপমা বুঝতে পারে উৎস অনুতপ্ত।
নিরুপমা একটা ম্লান হাসি দেয়।
” বাবা চলে যাবেন তোমার জন্য অপেক্ষা করতেছে।
“ওহ আচ্ছা চলেন
উৎস আর নিরুপমা দুজনে মিলে নিচে যায়।মিসেস ডালিয়া বেশ কিছুক্ষণ আগে বেড়িয়ে যায়।নিরুপমার মুখোমুখি থাকার সাহস তার নেই।সে যা করেছে এর ক্ষমা হয় না।নয়ন রহমান নিরুপমার থেকে বিদায় নিয়ে পারুল বেগম,ঝুমুর ও লতিফকে নিয়ে বের হয়।তিনি বাড়িতে গিয়ে একটু শান্তিতে ঘুম দিতে চান।বাবা হিসাবে তিনি আজ পর্যন্ত কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারেন নি।আজ সে অনুতপ্ত মা হারা মেয়েটাকে সে কতোটা কষ্ট দিয়েছেন অবহেলা করেছেন।আচ্ছা বেশিরভাগ বাবারা কেন এমন হয়ে যায়?দ্বিতীয় বিয়ে করলে তখন প্রথম সন্তানকে তারা অবহেলা অনাদরে বড় করেন।এগুলাই শুধুই সৎ মায়ের দোষ নাকি আংশিক ভাবে হলে ও বাবারা ও দোষী?এক হাতে কি তালে বাজে?দ্বিতীয় বিয়ে করার পর তাদের এমন ব্যবহার হয় যেন আগের ছেলেমেয়ে গুলো তার না। তখন দ্বিতীয় বউয়ের প্রতি এতোটা মুগ্ধ থাকে যে দুনিয়ার বাকি দিকে তাদের লক্ষ থাকে না।হায়রে দুনিয়া সবাই এমন কেন?

নিরুপমার দিন ভালোই কাটছে মুসকানকে নিয়ে।মুসকান এখন দৌড়ে বেড়ায়।যখন হাসে নিরুপমার কলিজাটা জুড়িয়ে যায়।এতো মায়া কেন মুসকানের মুখে?মুসকান আদো আদো কথা ও শিখেছে।তবে মুসকান খুবই জেদি ও রাগী হয়েছে। যে জিনিস একবার না বলবে কোনো মতেই তাকে কিছুতেই আর সেই কাজ করানো যায় না।নিরুপমা ভিষণ হিমশিম খাচ্ছে মুসকানকে সামলাতে।এর মধ্যেই প্রেমা আসে নিরুপমার কাছে…
“আজ ভার্সিটিতে যাও নি
প্রেমা মুসকানকে কোলে নিতে নিতে বলে..
” আজ তেমন ইম্পর্ট্যান্ট কোনো ক্লাস নাই সেজন্য।
“ওহ আচ্ছা।মনে হচ্ছে আমার ননোদিনী কিছু বলবে আমাকে হুম?কি ব্যাপার
” ইয়ে মানে ভাবি হইছে কি
“কি হইছে বলো তো
” নিশান ওর বাড়িতে আমার কথা জানিয়েছে।ওনারা আমাদের বাড়িতে আসতে চান
“আলহামদুলিল্লাহ এটাতো ভালো খবর।
” কিন্তু আমি বাড়িতে কিভাবে বলব?আমার তো ভয় করছে।
“প্রেম করছো কয় বছর?
” প্রায় ৫ বছর…প্রেমা মাথা চুলকে বলল
“৫ টা বছর প্রেম করলে ভয় করে নি আর এখন যখন অনিশ্চিত ভালোবাসা পূর্নতা পাবে তখন এতো ভয় কিসের হুম?ভয় নেই আমি পাশে আছি তো
” থ্যাঙ্কিউ ভাবি।আমি জানতাম তুমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আমি কারোর সাথে মনের কথা বলতে পারব না।
“পাগলি একটা। আমার বোন না তুমি?তোমার হাসিমুখ না দেখলে কি আমার ভালো লাগবে?
” আচ্ছা ভাবি তুমি কখনো কারোর প্রেমে পড়ো নি?বা ভাইয়ার আগে কাউকে ভালোবাসো নি?
নিরুপমা স্মিত হাসিটা যেন বিলীন হয়ে গেল।সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল..
“আরে ধুর এগুলা রাখো চলো মায়ের কাছে গিয়ে নিশানের ব্যাপারটা বলি
” উহু না আগে বলো।আমি জানি তুমি কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছো
নিরুপমা চুপ থাকে।প্রেমা আবার বলে…
“আমাকে তো বলতে পারো ভাবি?
” ভালোবেসেছিলাম এখনো ভালোবাসি।তখন বয়সের আবেগ বলে উড়িয়ে দিলে ও তা কখনো আবেগ ছিল না মনের ভিতর থেকে রক্তক্ষরণের মতো সেই ভালোবাসার রঙ ক্ষরিত হয়েছিল।
“এখনো ভালোবাসে মানে বুঝলাম না ভাবি?
” মানুষটা উৎস…নিরুপমা একটা ম্লান হাসি দেয়
“হোয়াট?মানে ভাইয়াকে তুমি আগে থেকেই ভালোবাসতে?
” হুম
“মানে কিভাবে কি? আমার মাথায় ধোরতেছে না।
” তখন ক্লাস টেনে পড়ি।তোমার ভাইয়ের তো তখন বিয়ে হয় নি।অরিত্রা আপুর সাথে রিলেশন। আমি তো এতোকিছু জানতাম না। আমি ছোট থেকেই বোরকা পড়তাম।একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে কিছু ছেলে আমাকে উত্যক্ত করে।আমাদের এলাকার ছেলে।ওরা প্রায় আমাকে বিরক্ত করতো। কিন্তু ওরা সেদিন আমার গায়ে হাত দেয়। তোমার ভাই প্রতিদিন ওই রাস্তা দিয়ে যেত সেদিন সে আমাকে দেখে ছেলেগুলো আমাকে বিরক্ত করছে।তখন উৎস গিয়ে ওদের বাধা দেয় ওরা তখন উৎসকে হুমকি ধামকি দেওয়া শুরু করে।উৎস ওদের তখন ইচ্ছামত মারে আর পুলিশে ফোন দিয়ে তাদের পুলিশের কাছে দেয়।আমি ওই সময়টা শুধু উৎসের দিকেই তাকিয়েছিলাম।আমি কেমন জানি একটা নেশায় ডুবে যাচ্ছিলাম।মানুষটা এতো সুন্দর কেন?আমার তাকে একটা বারের জন্য ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু আমি তো তা পারব না। তখন উৎস আমার কাছে এসে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে আর আমি তাকে গভীর ভাবে দেখে যাচ্ছি ঘাড়ের কাছে একটা তিল ইস কি মারাত্মক লাগছিল সেদিন তাকে।এরপর উৎস আমাকে একটু জোরে ডাকলে আমার ধ্যান ভাঙ্গে।
“এই যে মিস?কি হলো কথা বলছেন না কেন?
” ইয়ে না মানে ধন্যবাদ আপনাকে। ছেলেগুলো আমাকে প্রায় বিরক্ত করতো
“বাসা কোথায় আপনার?
” এইতো সামনেই।
“ওহ আচ্ছা। এভাবে চুপ করে থাকবেন না।প্রতিবাদী হবেন কেমন?সবসময় কিন্তু আমি থাকব না এসব ছেলেদের থেকে আত্মরক্ষা নিজেকেই করতে হবে বুঝলেন?
” জ্বী বুঝেছি।
“স্কুলে যাচ্ছেন?আমি ড্রপ করে দিয়ে আসি?
” ধন্যবাদ কিন্তু আমি একাই যেতেই পারব
“শিওর? ” হ্যা পাক্কা।
“ওকে।আসি সাবধানে যাবেন কেমন?
“আচ্ছা শুনুন
” কিছু বলবেন?….উৎস ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো
“আপনি কি এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন যাওয়া আসা করেন?নাকি আজকে কোনো কাজে এসেছিলেন? ” কেন?
“না এমনিতেই জানতে ইচ্ছা করলো।
“আমার বাসা থেকে আমার ভার্সিটি যাওয়ার এই একটাই রাস্তা।সো এই রাস্তা দিয়েই যাওয়া হয়…উৎস মৃদু হাসে
আমি প্রতি উত্তরে একটা হাসি দিয়ে চলে আসি।তার পর থেকেই আমি ওই সময়ে স্কুলে যেতাম।কেন জানি উৎসকে এক নজর দেখার জন্য মনের ভিতর অস্থিরতা ভর করতো। কোনোদিন উৎসকে দেখতে পেতাম কোনোদিন পেতাম না।কিন্তু পেলেও কয়েক সেকেন্ড এর জন্য কারন ও গাড়িতে থাকত।আর যেহেতু উৎস ড্রাইভ করতো ওকে দেখতে সুবিধা হতো।উৎস হয়তো আমাকে কখনো আর সেভাবে লক্ষ করে নি।আমি ছোট থেকেই বাস্তবতা শিখেছিলাম তাই উৎসের প্রতি আমার এমন অনুভূতিকে আমি আবেগ ছাড়া অন্য কোনো নামে আখ্যায়িত করতে পারছিলাম না।তার পর আবার উৎসের আর্থিক অবস্থা আর আমার অবস্থা দুইটা যখন মিলাইতাম মনে হতো বামন হয়ে আকাশের চাঁদ ছোঁয়ার চেষ্টা করছি।এরপর আর উৎসকে দেখার জন্য একি সময়ে আর যেতাম না।কয়েকদিন উৎসকে দেখতে না পেরে কেমন জানি দম বন্ধ লাগা শুরু হয়ে গেল।তবুও উৎসকে দেখার অদম্য ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিয়ে পড়াশোনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম।এর মধ্যে এসএসসি পরিক্ষা শুরু হলো।পরিক্ষার চিন্তায় কিছুদিন উৎস নামক ভুতটা মাথায় চেপে বসতে পারল না।ভালো রেজাল্ট করে কলেজে ভর্তি হলাম।এরপর একদিন উৎসকে আমাদের কলেজে দেখতে পাই ফিজিক্সের স্যার এর সাথে কথা বলছিল।তাকে দেখে আমার হাত পা অবশ হয়ে আসছিল।তার সাথে অরিত্রা আপু।অরিত্রা আপু শাড়ি পরে আছে।উৎসের হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে দুজনের মুখেই অনাবিল হাসি। সদ্য বিয়ে করা দম্পতি মনে হচ্ছিল তাদের।বুকের মধ্যে অসহ্য তীব্র যন্ত্রণা শুরু হতে লাগলো।চোখ মুখে ঝাপসা দেখছি এমন মনে হতে লাগলো। যখনই নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে যাবো আমাকে মাবিহা ধোরে ফেলে।
“নিরু কি হয়েছে তোর।শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
আমি আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারা করে উৎসকে দেখিয়ে অস্ফুটস্বরে বললাম” উৎস
মাবিহা তাদের দেখে যেন সে নিজেই অবাক হয়ে গেল।
“ওইটার তোর ফুফাতো বোন না ” হ্যা
“কিন্তু ওরা এতো ঘনিষ্ঠ ভাবে?এক মিনিট আমি শুনেছিলাম উৎসের নাকি একটা সিরিয়াস রিলেশনশিপ আছে। তুই কষ্ট পাবি বলে আমি তোকে জানাইনি।কিন্তু সেই মেয়ে অরিত্রা আপু এটা আমি জানতাম না।
আমি কিছু না বলে উৎসের কাছে গেলাম।আমার কেন জানি জানতে ইচ্ছে করলো অরিত্রা আপু কি শুধুই তার প্রেমিকা?নাকি এর থেকে বেশিকিছু? কিন্তু মাঝপথে যাওয়ার পর আর যাওয়ার সাহস হলো না আমার।আমি আবার ফিরে আসলাম।পরে জানতে পারি ওদের বিয়ে হয়েছিল ৪ দিন আগে।ফিজিক্সের স্যার অরিত্রা আপুর বাবার বন্ধুর ছেলে।স্যারের সাথে দেখা করতেই তারা আমাদের কলেজে এসেছিল।
” এরপর?…প্রেমা তার বিষন্নতা গ্রাস করা মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো
“এরপর আর কি উৎসকে ভুলে নতুন ভাবে জীবন শুরু করার চেষ্টা করলাম কিন্তু মোনাজাতে সে সবসময় থাকত।অনেক কথা হয়েছে এখন এগুলা বাদ দাও তো। আম্মুর কাছে যাই চলো।
নিরুপমা আর প্রেমা তনিমা বেগমের কাছে যায়।তনিমা বেগম তখন সোফায় বসে টিভিতে নিউজ দেখতেছিল।বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাওয়ার কোনো এক ফ্লাইটের বিমান ক্র‍্যাশ করেছে।সেটা নিয়েই নিউজ তোলপাড় চলছে।তনিমা বেগম খুব মনোযোগ সহকারে দেখছিলেন নিউজটি। পুত্রবধূ ও মেয়েকে দেখে তিনি হাসলেন।নিরুপমার উদ্দেশ্য নিশানের ব্যাপারে কথা উঠাবে।সেই মূহুর্তে নিরুপমার ফোনে একটা কল আসে। কলটা কানে নিয়েই নিরুপমা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। হাতের থেকে ফোনটি পরে যায়।নিরুপমার শরীর অবস হয়ে যাচ্ছে সে কি ঠিক শুনলো?
#এবং_স্ত্রী
#পর্ব_৩১
#Jannatul_Ferdos

হাসপাতালের এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে মানুষজন।কেউ কেউ হয়তো স্বজন হারানোর কান্নায় ভেঙ্গে পেড়েছেন কেউবা স্বজনকে খুঁজে পাচ্ছেন না বলে আহাজারিতে জর্জরিত হয়ে আছেন।বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় ছেড়ে যাওয়া একটা বিমান উপরে উঠার কিচ্ছুক্ষণ পরই বিধ্বস্ত হয়।ভয়ংকর এক দুর্ঘটনা ঘটে সকাল ১০ টা নাগাদ। সেই বিমানে যাত্রীর আত্মীয় স্বজনেরা এখন তাদের আপনজনদের খুঁজতে ব্যস্ত।সেই দলের মধ্যে এসে যোগ দেয় নিরুপমা ও উৎসের পরিবার।বিমান দূর্ঘটনার শিকার হয়েছেন মিসেস ডালিয়া।তার খোঁজ করতেই তাদের আগমন।মিসেস ডালিয়া তার এতোদিনের করা অন্যায়গুলো বুঝতে পেরে খুব অনুতপ্ত বোধ করেন।কিন্তু এদেশে থাকলে তার এই অনুতপ্ত বোধের যে যন্ত্রণা তা যেন আরো ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হবে।তাই মিসেস ডালিয়া নিরুপমা ও উৎসের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখে তা তার বাসার কেয়ার টেকারের কাছে দেয়। এরপর ফ্লাইট ছাড়া আগ মূহুর্তে উৎসকে ফোন দিয়ে জানায় সে আজীবনের জন্য আমেরিকা চলে যাচ্ছেন তার ছেলের কাছে।কেয়ার টেকার এর থেকে চিঠিটি নিয়ে আসতে বলেন।এইখানে থেকে নিজের অপরাধবোধে দগ্ধ হয়ে পুড়ে যাবেন।তখন কথায় কথায় তিনি উৎসকে বলেছিলেন ১০ নাগাদ তার ফ্লাইট। এরপর উৎস যখন নিউজ দেখেন কন্টিনিউসলি মিসেস ডালিয়াকে ফোন দেন ফোন বন্ধ পায় এরপর উৎস আর দেরি না করে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।এয়ারপোর্টে গিয়ে বিধ্বস্ত বিমানে আরোহন করা যাত্রীদের নাম চেক করে সে শিওর হয় দুর্ঘটনার শিকার মিসেস ডালিয়া ও হয়েছেন।উৎস তখন ধুপ করে মাটিতে বসে পরে।নিজেকে সামলে নিরুপমাকে জানায়।বিমানের বেশির ভাগ মানুষই মৃত্যুবরন করেছেন আর যদি কেউ বেঁচে থাকে তাদের দেখার মতো না কারোর হয়তো হাত অথবা পা নেই শরীর পুড়ে জর্জরিত কেউ বা লড়াই করছে মৃত্যুর সাথে।নয়ন রহমান হাসপাতালের এক কোনায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।তার বোন যতোই খারাপ হোক না কেন তিনি খুব বেশি ভালোবাসতেন।তার বোন জীবিত আছে না মৃত তা ও তিনি জানেন না। বোনকে হারানোর এক অজানা তীব্র ভয় তার মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।হাসপাতালে জীবিত আছে যে মানুষ গুলো উৎস আর নিরুপমা মিলে সবগুলো রুম চেক করে কিন্তু নাহ তাদের মধ্যে মিসেস ডালিয়াকে তারা পায় না।এরপর বাধ্য হয়ে তারা লাশ যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে যায়।নিরুপমার শরীর কাঁপছে।হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে।মিসেস ডালিয়া তার অপকর্মের শাস্তি পাক নিরুপমা চেয়েছিল কিন্তু সেই শাস্তি যে এভাবে সে ভোগ করুক এটা নিরুপমা কখনো চায় নি।এতো লাশ দেখে নিরুপমা উৎসের শার্ট খামছে ধোরে।লাশ গুলোকে চেনা যাচ্ছে না হাত পা মুখে পুড়ে উফফ কি বিচ্ছিরি অবস্থা। নিরুপমা সাহস করে কারোর মুখের উপরে থাকা কাপড় তুলতে পারছে না।চার পাঁচটা লাশের পর একটা লাশের দিকে নিরুপমার চোখ যায়।ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে।লাশটি একটি মহিলার। হাতে দামী একটা সোনার ভ্যাস্লেট।নিরুপমা চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না ভ্যাস্লেটটি মিসেস ডালিয়ার।শরীরের ভিতত অজানা ভয় শিহরণ দিয়ে উঠতেছে তার।উৎস অন্যদিকে খুঁজতেছে।নিরুপমা এক পা দুই পা করে এগিয়ে যায় লাশটির দিকে।এরপর লাশের হাতটি ধোরে ভ্যাস্লেটটা ভালোভাবে দেখে।হ্যা এটা মিসেস ডালিয়ার হাত।তার ভ্যাস্লেটে উপরে ছোট ছোট করে লিখা ছিল ডালিয়া।নিরুপমা এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠে।তার কান্নার আওয়াজে উৎস ছুটে আসে…
“নিরুপমা কি হয়েছে?কাঁদছো কেন?
” উৎস ফু ফু ফুফি।এইযে ফুফি উৎস। ফুফি আর নেই ফুফি চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।
নিরুপমাকে উৎসকে জড়িয়ে ধোরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।উৎসের চোখের নোনা পানিতে উৎসের গাল ভিজে যায়।

মিসেস ডালিয়ার লাশ তার চিহ্নিত করার পর সব ডিটেইলস মিলিয়ে তার লাশ ছেড়ে দেওয়া হয়।উৎস তাদের বাড়িতে নিয়ে আসে।যেহেতু মিসেস ডালিয়ার স্বামী বেঁচে নেই আর একটা ছেলে সে ও আমেরিকাতে তাই উৎস তাদের বাড়িতে আনে।আপনজন বলতে একমাত্র তারাই আছে।নয়ন রহমান বিলাপ করছেন আর কাঁদছেন।
“আমি চেয়েছিলাম আপা তার শাস্তি ভোগ করুক কিন্তু আমি তো কখনোই চাই নি আপা আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যাক।আজকে যে নিজেকে খুব দোষী মনে হচ্ছে।
নিরুপমা তার বাবাকে জড়িয়ে ধোরে কাঁদে।উৎস তাকে বুঝিয়ে জানাজার নামাযে নিয়ে যায় আর তারপর স্থানীয় কবর স্থানে কবর দেয়।

নিরুপমা বেলকনির গ্রিলের সাথে মাথা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মিসেস ডালিয়া মারা গেছেন ১ মাসের মতো হবে।সব কিছু আগের মতো চললে ও নিরুপমা কেন জানি নিজেকে এখনো আগের মতো করতে পারছে না।যে মানুষটাকে সে ছোট থেকে এতো ঘৃনা করতো সেই মানুষটার মৃত্যুতে সে এতোটা ভেঙ্গে পড়েছে।আসলেই নিরুপমা নরম হৃদয়ের অধিকারী।হঠাৎ করেই নিরুপমার মিসেস ডালিয়ার রেখে যাওয়া চিঠির কথা মনে পড়ে।উৎস রুমে কাজ করছিল।সে ড্রয়ার থেকে চিঠিটা বের করে উৎসের পাশে বসে।অপর পাশে মুসকান ঘুমোচ্ছিল।
” চিঠির কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম উৎস..
“আমি ও।আচ্ছা চিঠি খুলো দেখি কি লিখেছেন
নিরুপমা চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলো…
প্রিয় নিরুপমা ও উৎস…
চিঠিটি তোমাদের দুজনকে লিখলে ও উৎসকে জানানো দরকার এমন কিছু কথা আছে চিঠিতে।জীবনে আমি অনেক পাপ করেছি কিন্তু কখনো সেগুলোর জন্য অনুতপ্ত হই নি।আজ কেন জানি অনুতপ্তবোধটা মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে।এই অনুতপ্তবোধের যে দহন তা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।নিরুপমার একটি সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যত আমি নষ্ট করেছি।৪ বছরের একটা বাচ্চাকে মাহারা করেছি।এগুলার জন্য আমি এতোবেশি অনুতপ্ত যে আমার কাছে এই কষ্টে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করছে।কিন্তু জীবনে অনেক পাপ করেছি এই মহাপাপ করার সাহস আমার হলো না।
উৎস অরিত্রা তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করলে ও আমি অরিত্রাকে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম শুধু মাত্র তোমার প্রোপার্টি দেখে।টাকা আর প্রতিপত্তির প্রতি আমার এতো নেশা হয়ে গিয়েছিল যে আমি আমার বিবেকবুদ্ধি সব হারিয়েছিলাম।অরিত্রার হরমোনের প্রব্লেম থাকায় ডাক্তার বলেছিল যে ওর বেবি কন্সিভ করতে সমস্যা হতে পারে।তখন আমার মাথায় চিন্তা আসলো যদি ও কখনো মা হতে না পারে তাহলে তুমি বা তোমার ফ্যামিলি যদি তখন আর ওকে রাখতে না চাও।হায় আমি এতো বেশি নির্বোধ ছিলাম যে তোমার মতো খাঁটি ছেলে আর এতো ভালো পরিবারকে নিয়ে এমন নিচু চিন্তাভাবনা করেছিলাম।অরিত্রাকে এরপর আমি বার বার বোঝাইতে থাকি বিভিন্ন ভাবে তোমাকে হারানোর ভয় দেই। এরপর অরিত্রা তোমাকে চেপে বসে বাচ্চা নেওয়ার জন্য।অরিত্রার প্রেগ্ন্যাসির যখন ২ মাস তখন ডাক্তার বলেছিল এই বাচ্চা রাখা রিস্ক হয়ে যাবে বাচ্চা না রাখাই ভালো তবে অরিত্রা আর কন্সিভ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান তারা।আমি অরিত্রাকে বলি বাচ্চা রাখতে।আমি তখন ও জানতাম না আমি আমার মেয়েকে হারিয়ে ফেলব চিরতরে। অরিত্রা মারা যাওয়ার পরে ও এই অনুতপ্ত বোধ গুলো আমার ভিতরে জাগলো না।আমি তো আছিই আমার বিলাসিতার জীবনে।আমি সত্যিই কখনো অরিত্রার মা হতে পারি নি।ছোট থেকে আর মারা আগে পর্যন্ত আমি কখনো তাকে সময় দেই নি, বুকে টেনে নেই নি, বুকে জড়িয়ে চুমু খাই নি।আমি অনুতপ্ত উৎস।আমাকে তুমি আর নিরুপমা মাফ করে দিও।এতো গুলো করা অন্যায় নিয়ে আমি এই দেশে থাকতে পারব না।বার বার এগুলা আমাকে তাড়া করে বেড়াবে।আর সর্বশেষ একটা কথাই বলবো উৎস তোমাকে নিরুপমার মতো একটা মেয়ে হয় না আমি অরিত্রা ও এতো ভালো ছিল না।একসময় আমি তোমাকে বলেছিলাম সৎ মা কখনো মা হতে পারে না।কিন্তু নিরুপমা পেরেছে।নিরুপমা একজন সৎ মা থেকে মুসকানের আদর্শ মা হয়েছে যা এই যুগে এই দুনিয়াই খুবই দুর্লভ। একজন সৎ মা যদি নিরুপমার মতো করে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় তাহলে হয়তো কোনো ছেলে মেয়ে সৎ মায়ের নির্মম অত্যাচারের শিকার হতো না।আমি শুধু প্রতিহিংসা ও লোভে বশিভূত হয়েই নিরুপমাকে সবসময় তোমার থেকে দূরে রেখেছি। অরিত্রা যেমন আমার মেয়ে ছিল নিরুপমা ও আমার মেয়ে।এর আগে তোমার হাতে এক মেয়েকে তুলে দিয়েছিলাম আর আজ আমার আরেক মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি তার প্রাপ্য সম্মান দিও।আর আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।আমি চলে যাচ্ছি ভালো থেকো আর মুসকানের যত্ন নিও তাকে কখনো বলো না যে তার এই নানু এতো খারাপ ছিল।মুসকানের চোখে অন্তত আমার জন্য ঘৃনা দেখতে চাই না।আল্লাহ হাফেজ।

চিঠিটা পড়ে উৎস নির্বাক হয়ে বসে রইলো।এই মূহুর্তে তার ঠিক কি করা উচিত?মিসেস ডালিয়ার উপরে কি খুব রাগ করা উচিত?নাকি সব ভুলে যাওয়া উচিত।যদি রাগ ও করে তাতে লাভ কোথায়?মানুষটা তো আর বেঁচে নেই।আজ সেই ও নিরুপমার মতো করে মিসেস ডালিয়াকে ক্ষমা করে দিল।

চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here