কাছে দূরে পর্ব ১

🥀.

সুপ্ত হলেও প্রগাঢ় আত্মসম্মানের উপর এভাবে কেউ হস্তক্ষেপ করে ফেলবে কখনো ভাবতে পারেনি হীর। পুরো কফি-শপকে সাক্ষী রেখেই ছেলেটা হঠাৎ করে হীরকে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো। ছেলেটার শক্ত হাতে স্ব-জোরে থাপ্পড় খেয়ে বেসামাল হয়ে আদ্রর গায়ে ঢলে পড়লো হীর। মিলি আর এশা দাঁড়িয়ে গিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলো ছেলেটির দিকে। এমন নীরব নিস্তেজ পরিবেশে কোনো এক অপরিচিত ছেলে আকাশ থেকে টপকে পড়ে হঠাৎ করে হীরকে চড় মারার সঠিক কোনো কারন খুঁজে পাওয়া কারোরই সম্ভব হলো না। আদ্র ভয়ার্ত দৃষ্টিতে হীরের দিকে তাকালো। হীরকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

—-” হোয়াট দ্য হেল ইজ দিস! কে আপনি? আর হঠাৎ করে আমাদের ফ্রেন্ডের গায়ে কেন হাত তুললেন? আপনি চিনেন ওকে? আপনি জানেন ও কে?”

আদ্রর ক্ষেপা গলায় ছেলেটির কোনো ভাবাবেগ দেখা গেলোনা! সে ভাবলেশহীন ভাবে তার চোখের সানগ্লাসটি ঝাটকা মেরে খুললো। কিছু একটা ভেবে হীরের দিকে তাকাতেই হীর টলমল চোখে তাকালো তার দিকে। হীরের মনের মধ্যে ধেয়ে চলা আগুনের ফুলকি গুলোর আচ ছেলেটা এক হাত দূরে দাঁড়িয়েও বেশ বুঝতে পারছে। চারপাশে চাপা গুঞ্জন! কফি-শপের প্রত্যেকটি মানুষ ছেলেটাকে নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করে দিয়েছে। তার সাহস আর তার কেয়ারলেস ভাবে সবাই আশ্চর্যান্বিত। আজিম আহমেদের এক মাত্র ভাতিজীকে এই ভরা কফি-শপে এভাবে কোনো ছেলে বিনা কারনে চড় মেরে তার পুরুষত্ব প্রমান করবে সেটা কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারছেনা। আর তারা যা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারছেনা ঠিক সেটাই ছেলেটি করে দেখালো। ছেলেটিকে দেখতে ঠিক রাজপুত্রের ন্যায়। সম্পূর্ণ ব্লু ড্রেসআপ পরহিত সুঠাম দেহের অধিকারী ছেলেটির একবার তাকানোর সুপ্ত বাসনায় কেউ কেউ আহত মর্মাহত হয়ে যাচ্ছে। শুধু দৃষ্টি আকর্ষণীয় হয়নি হীরের। আপাতত এই রাজপুত্রের ন্যায় ছেলেটাকে তার মনের কোথাও গিয়ে এক গুন্ডা মাস্তান টাইপ ছেলে বলেই ঠাহর হচ্ছে। যে স্বাভাবিক নয় কেবল অস্বাভাবিক দুর্দান্ত দুঃসাহস নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দূর থেকে কিছু কিছু মেয়ে হা-হুতাশ করে একজন অন্যজনের গায়ে ঢলে পড়ছে। শুধু পরিস্থিতিটা এখন স্বাভাবিক নয় বলে কোনো মেয়ে সাহস করে উঠে আসতে পারছেনা এখানে।

হীর ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে পাল্টা জবাবে শুধু একটা নয় সে ইচ্ছে করলে অসংখ্য চড়-আঘাত করতে পারে সে। কিন্তু সে তা করবেনা। সামান্য ছুঁচো মেরে সে হাত দুর্গন্ধ করতে চায়না। তাকে পাল্টা জবাবে বড়সড় কোনো ধামাকা না দিলে কি করে হয়? হ্যাঁ, হীর এর পাল্টা জবাবে বড়সড় কোনো ধামাকা ঠিকই রটাবে। টলমল করা জলটুকু চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তেই হাতের পাশের কফির মগটা ছুঁড়ে মারলো হীর। পাশ থেকে পার্সটা তুলে হনহন করে চলে গেলো সেখান থেকে। পেছন থেকে আদ্র, মিলি আর এশা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। তারাও তাড়াহুড়ো করে যে যার ব্যগ তুলে হীরকে ডাকতে ডাকতে তার পেছন ছুটলো। বন্ধুদের ডাক হীরের কান অব্দি পৌঁছলেও হীর কারোর ডাকেরই জবাব দিলো না। পার্কিংএ এসে ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষা না করেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো সে। আদ্ররা তার পেছন পেছন দৌড়ে এসেও শেষ অব্দি আটকাতে পারলো না হীরকে। পেছন থেকে হীরের গাড়ির ড্রাইভার ছুটে আসলো। বাকি তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখ করে বলল,

—-” ছোট ম্যাডাম হঠাৎ এভাবে চলে গেলেন কেন? আদ্র ভাই? কি হয়েছে ভেতরে?”

আদ্র জবাব দিলো না। মিলি আর এশা চোখ ইশারা করে কথাটা চেপে গেলো। এশা মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে বলল,

—-” তেমন কিছু না ফিরোজ ভাই। তুমি জলদি কোনো টেক্সি বা সিএনজি বুক করে ওর গাড়িটাকে ফলো করে যাও। দেখো বাসায় ফিরে নাকি অন্য কোথাও যায়।”

মিলি, এশার কথার রেশ টেনে বলল,

—-” হ্যাঁ ফিরোজ ভাই। জলদি করো।”

ড্রাইভার ফিরোজ আর কথা বাড়ালো না। মাথার সাদা ক্যাপটা একহাতে চেপে ধরেই দৌড়ে গেলো হীরের যাওয়ার পথে। কিছু টা সামনে এগিয়ে একটা সিএনজি পেতেই উঠে গেলো সে।

আদ্র সেদিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,

—-” ছেলেটা কে বলতো? দেখে তো মনে হলো এদেশের না! আই মিন এদেশেরই তবে এদেশে থাকে না, অন্য দেশে থাকে। দেশি লোক কিন্তু কেমন একটা বিদেশি বিদেশি ভাব!”

মিলি এশার হাত চেপে ধরে আহত কন্ঠে বলল,

—-” আরে রাখ তর দেশি আর বিদেশি! ঐ ছেলে যা করলো তাতে উনার সামনে কি দশা হবে ভাবতেই আমার হাত পা সব জমে যাচ্ছে!”

এশা ঢোক গিলে বলল,

—-” আজিম আঙ্কেল যদি বিন্দু মাত্র আচ করতে পারেন ব্যাপারটা তাহলে আম ড্যাম সিওর সেদিনই ঐ ছেলেটার শেষ দিন হবে।”

আদ্র চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

—” ইম্পসিবল কিছু নয় গাইজ।”

______________________

বাসায় ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালো হীর। আহমেদ ভীলা আজ হঠাৎ এতো সেজেছে কেন? কিসের আমেজে? ঘরের প্রতিটি কোনায় কোনায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো সে। এতোটা আকর্ষণীয় সাজে বোধহয় কারোর বিয়েতেই সেজেছিলো এই বাড়ি। আর সেটা খুব সম্ভবত আজিম সাহেব এবং নাজমা বেগমের বিয়ের সময়ই ছিলো তখন। এক অন্য রকম সাজে পুরো বাড়িটা সেজে উঠেছিলো। তারও খুব গর্ব হয়েছিলো এমন মনোরম সাজে।

—-” হীর!”

উৎসাহে মোড়ানো কারোর ডাক পড়তেই আঁড়চোখে তাকালো হীর। তার থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে সানিয়া। সানিয়ার উৎসাহে ঘেরা কন্ঠে হীরের মাথায় সর্বপ্রথম যে ভাবনাটা এলো, “নেহাল আর সানিয়ার বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়েছে আগামী সাতদিনের মাথায়। আর তার জন্যই আহমেদ ভীলা সাতদিন আগে থেকে পুরো রেডি হয়ে থাকবে। হতেই পারে।”

—-” এসে পড়েছিস? আমিও ভাবছিলাম তোকে কল করবো!”

হাসি মুখে কথা গুলো বলতে বলতে এগিয়ে এলো সানিয়া। হীর স্মিত হেসে চারপাশে নজর দিতে দিতে সানিয়ার বাহু আগলে বলল,

—-” কংগ্রেস আপি। কখন ঠিক হলো সবটা? আর আজ যে নেহাল ভাইয়ারা আসছে কই আমাকে তো জানাওনি? তাহলে তো আমি আজ বের হতাম না। অবশ্যই সেই শুভক্ষণে তোমার সাথে থাকতাম!”

সানিয়া চোখ গোলগোল ঘুরিয়ে অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-” আমায় হঠাৎ কংগ্রেস করছিস কেন? আর এখানে তোর নেহাল ভাইয়া কোথা থেকে আসলো? কিসের শুভক্ষণ হীর? কি বলছিস সোনা আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা!”

হীর সানিয়াকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভ্রু বাঁকিয়ে চারপাশে ইশারা করে বলল,

—-” তোমার আর নেহাল ভাইয়ার বিয়ের ডেট ঘোষণা হওয়ার শুভক্ষণ আর কিসের? তাই তো আজ থেকে বাড়ি সাজানো স্টার্ট হয়ে গেলো তাই না?”

সানিয়া হীরের ভাবনাটা আন্দাজ করতে পেরে হেসে ফেললো। হীরের দু’গালে হাত রেখে বলল,

—-” আরে না রে পাগলী। না আমার আর নেহালের বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়েছে আর না সেই খুশিতে বাড়ি সাজানো হচ্ছে। কেউ একজন অনেক বছর বাদে আসছে! তারই খুশিতে….”

” মামনি! ফিরেছো? কাম কাম? কখন ফিরলে হু? বাবাই কে কল করলে না কেন?”

পেছন থেকে আজিম সাহেবের স্নেহ ভরা কন্ঠটি ভেসে আসতেই হীর আর সানিয়া দুজনেই ফিরে তাকালো। সানিয়া স্মিত হেসে বলল,

—-” যা বাবার কাছে গিয়ে বস আমি রুবিকে তোর জন্য কাঁচা আমের জুস দিতে বলছি!”

হীর হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে আজিম সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলো। আজিম সাহেব মৃদু হেসে হীরকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে সোফায় বসলেন। আদুরে গলায় বললেন,

—-” মামনি বাবাই কে কল করলো না কেন? বাবাই তবে নিয়ে আসতো তার মামনি কে?”

হীর মৃদু হাসলো। আজিম সাহেবের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

—-” ইট’স ওকে বাবাই। হীর এখন বড় হয়ে গিয়েছে আর সে একা একা বাসায় ফিরতে পারে। তাকে নিয়ে তোমাদের এতো এতো চিন্তা না করলেই হবে।”

আজিম সাহেব শব্দ করে হেসে উঠলেন। বললেন,

—-” তাই বুঝি? আমার মামনি সত্যি অনেক বড় হয়ে গিয়েছে?”

হীর নিঃশ্বাস টেনে বলল,

—-” হু! অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা বাবাই আপি বলছিলো বাড়িতে কেউ আসবে? কে আসবে বলোতো? কোনো স্পেশাল গেস্ট?”

“কই গো হীর ফিরেছে?”

রান্নাঘরের দরজার পাশ থেকে ভেসে আসলো নাজমা বেগমের গলা। হীর আর আজিম সাহেব সোফায় বসেই মুখ উঁচিয়ে তাকালেন। আজিম সাহেব গলা উঁচিয়ে বললেন,

—-” হ্যাঁ গো এসেছে।”

উত্তর শুনে আর কোনো জবাব এলোনা নাজমা বেগমের। টুকটাক শব্দ করে আবারও কাজে মনোনিবেশ করলেন তিনি।

হীর নাজমা বেগমের হদিশ চালিয়ে আজিম সাহেবের উদ্দেশ্য বলল,

—-” আজ আসবেটা কে শুনি যার জন্য বাড়ির সবাই এতো ব্যস্ত?”

সোফা কাঁপিয়ে বেজে উঠলো আজিম সাহেবের ফোন। আজিম সাহেব হীরের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে ফোন নিয়ে উঠে গেলেন। হীর তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলো,

—-” কে আসবে বাবাই? বলে যাও!”

“আফা, জুস!”

কোমর বেঁকে জুসের গ্লাস নিয়ে হীরের সামনে দাঁড়াল রুবি। হীর ভ্রু বাঁকিয়ে ভাবুক কন্ঠে বলল,

—-” এখন জুস খাবোনা নিয়ে যা।”

রুবি ফ্যাকাসে মুখে বলল,

—-” খাইবেননা ক্যা?? খালাম্মায় হাতে কইরা বানায় পাঠাইছে! খায়া লন!”

হীর কিছুক্ষন ঠোঁট কামড়ে লেপ্টে রইলো সোফার সাথে। অতঃপর আবারও রুবির দিকে দৃষ্টিপাত করলো। সোফা ছেড়ে উঠে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে বলল,

—-” বড় মা কে বল আমি বাইরে থেকে পেট ভরে খেয়ে এসেছি! এখন আমার পেটে এক ইঞ্চি পরিমানও জায়গা নেই। পেট খালি হলে নিজে এসে খেয়ে নিবো।”

রুবি সরু চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো হীরের যাওয়ার পানে। হীরকে রুবি ঠিকঠাক কোনো কালেই বুঝতে পারলো না। আজও তার ব্যাতিক্রম নয়। সানিয়া রান্নাঘরে গিয়ে যেভাবে বলল জুসের কথা তাতে রুবি ভেবেছিলো হীরের হয়তো আজ একটু বেশিই কাঁচা আমের জুস খেতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু এখন তার রিয়াকশন দেখে রুবির এটা মনে হচ্ছে “হীর কোনো কালেই এই কাঁচা আমের জুস ঠিক পছন্দ করতো না। নেহাত কাঁচা আম সানিয়ার পছন্দ তাই সেও হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে খায়।”

#কাছে_দূরে♥️🥀
#moumita_mehra
#সূচনা_পর্ব

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here