কাছে দূরে পর্ব ৩৪

#কাছে_দূরে 💐
#moumita_meher
#পর্ব___৩৪

—-‘ এগুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? রাখ এখানে?’

হীর ঠোঁট উল্টে তাকালো। ঝুমকোজোড়া হাতের মধ্যে লুকিয়ে নিতেই ধমকে উঠল সাবাব। হাজার অনিচ্ছা কাজ করলেও বাধ্য মেয়ের মতো ঝুমকো জোড়া সাবাবের পায়ের কাছে রাখল। তা দেখে সাবাব আবারও বলে উঠলো,

—-‘ ওখানে রাখতে হবেনা। আমার হাতে দে। তোর বিশ্বাস নেই। ওখানে রাখবি আবার কিছুক্ষণ বাদে এসে এগুলো নিয়ে ছুট্টে পালাবি। কে বলতে পারে এগুলো ফর্মালিটিসের জন্য করছিস না।’

হীর ঠোঁট ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঝুমকো জোড়া সাবাবের হাতে তুলে দিলো। ঝুমকোজোড়া হাতে পেতেই সাবাবের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসির রেখা। যদিও তা হীরের অগোচরে। হীর আর দেখল না সাবাবের রিয়াকশন। সে ভারী মন খারাপ করেই বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। যা দেখে সাবাব নিজের হাসি লুকিয়ে আবারও নিরস কন্ঠে ডেকে উঠলো তাকে,

—-‘ কোথায় যাচ্ছিস?’

হীর অসন্তোষ মনে দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছন ফিরে বিমর্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,

—-‘ আবার কি হলো?’

সাবাব এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। হীরের পা থেকে মাথা অব্দি একবার নিরীক্ষণ করে বলল,

—-‘ পারপেল রঙে তোকে ভীষণ মানায়। সুন্দর লাগছে।’

সাবাবের মুখে নিজের প্রশংসা যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা হীর। অবাকের শেষ চূড়ান্তে পৌঁছে হা করে তার মুখপানে চেয়ে রইলো। হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। তাই বোকা গলায় বলে উঠলো,

—-‘ অ্যা?’

সাবাব তুবড়ে গেলো। হীরের সামনে তার নিজের প্রশংসা করে ফেললো সে। ইচ্ছে করে নয়! কিন্তু হীর কি ভাবছে?

—-‘ কিছুনা। যা তো এখন। এতো কথা বলতে ভালো লাগছেনা।’ (ধমকের সুরে)

এই নরম এই শক্ত। এ কেমন রূপ মানুষের। অদ্ভূত এবং চরম বিরক্তিকর লোক এই ছেলে। নিজেই প্রশংসা করছে আবার নিজেই বকছে। হীর গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিছু বলবে তার আগেই সাবাব আবারও বলে উঠলো,

—-‘ আর হ্যাঁ, কাল ভোরে সবার আগে ঘুম থেকে উঠবি। উঠে চারপাশে তাকাবি না। কেউ ডাকলেও শুনবিনা।সোজা আমার রুমে চলে আসবি। এসে তোর এই ঝুমকোজোড়া ফেরত নিবি।’

হীর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,

—-‘ কাল ভোরে এই ঝুমকো নিতে আসবো কেন? আমার আর এই ঝুমকোর দরকার নেই। আমার আরও অনেক ঝুমকো আছে। আর কেউ ডাকলে শুনবো না কেন? আমি কি অভদ্র মেয়ে নাকি হ্যাঁ?’

সাবাব ধমকে উঠে বলল,

—-‘ এতো ভদ্র হওয়ার কোনো দরকার নেই। যা বলেছি তাই করবি। কথার নড়চড় হবে তো খবর আছে।’

হীর চুপসে গেলো সাবাবের ধমকে। আর কিছু বলার সাহস পেলো না। চুপচাপ মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। সাবাব তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে স্মিত হাসল। ঝুমকো জোড়া চোখের সামনে তুলে ধরে বাঁকা হেসে কিছু একটা ভাবল মনেমনে। অতঃপর খুব সাবধানে দুইহাতে ভর দিয়ে বিছানা ছেড়ে নামল সে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বড় আলমারির কাছে গিয়ে আলমারির তালা খুলে তিনটে গলার লকেট আর নেকলেস বের করলো। অন্য হাতে বের করে আনলো কয়েকজোড়া ঝুমকো,কোমর বন্ধনী আর পায়েল । এগুলো সবই হীরের। শপিংমল থেকে সেদিন বাড়ি ফেরার পর তার জুয়েলারির প্যাকেটটা তার রুমেই ছিলো। হীরও পরে আর খুঁজেনি তাই সেও দেয়নি। আজ এগুলোতে আরও কিছু মেলাতে হবে। একদম গোপন কিছু। যার সম্মন্ধে মনি,শীলা ইভেন হীর অব্দি জানতে পারবেনা।

হঠাৎ দরজায় নক করলো কেউ। সাবাব আকস্মিক চমকে উঠলো কিঞ্চিৎ। তবে প্রকাশ পেলো না। কারন সে জানে এই সময় এখানে কে আসতে পারে। সাবাব হীরের বাকি জুয়েলারির সাথে ঝুমকোজোড়া একত্র করে রেখে দিলো। আলমারির দরজাটা আস্তে করে লাগিয়ে লক করে দিলো। পেছন মুড়ে তার টিমদের ভেতরের আসার অনুমতি দিয়ে ধীরেসুস্থে গিয়ে বেড়ের উপর বসল। আভিক সবার শেষে ঢুকতে ঢুকতে দরজা লক করে দিলো। অতঃপর সেও এসে যোগ দিলো সিক্রেট মিটিংয়ে।

___________

সংগীতের শেষ নাচটা তরীর ছিলো। নাচতে নাচতে বেচারি হয়রান হয়ে একপাশে এসে দাঁড়ালো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে আশেপাশে পানির খোঁজ চালালো। এমন সময় পানি নিয়ে হাজির হলো আদ্র। লজ্জিায় মুড়িয়ে আছে তার চোখ,নাক,কান,ঠোঁট। মূলত সে লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। তরীর দিকে পানিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

—-‘ পানি। খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।’

পানি পেয়ে তরীর মুখ হাস্যজ্বল হয়ে উঠলো। আদ্রর পানে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,

—-‘ থ্যাংক্যু ডিয়ার। অনেক উপকার করলে।’

কথাটা বলেই তরী পানিটা নিয়ে ঢকঢক করে খেতে লাগল। যদিও সেই দিকে আদ্রর হুঁশ নেই। সে তো বেহুঁশ হয়েছে তরী তার গালে আলতো স্পর্শ দিয়েছে তাই। তার হৃৎস্পন্দন তরতর করে বেড়ে গেলো। সেই ঢিপঢিপ আওয়াজে যেন সারা বাড়িময় কাঁপছে। আদ্র বুকের মাঝে হাত চেপে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তরী ভীষণ সুন্দরী। আদ্রর মতে পৃথিবীর দ্বিতীয় সুন্দরী মেয়ে তরী। কারন মায়েরা নাকি সর্বদা পৃথিবীর প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য নিয়ে থাকে। আর তার পরে যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে সেটা শুধু এবং শুধুই তরী।

তরী পানির খালি গ্লাসটা আদ্রর দিকে এগিয়ে দিতে গেলে খেয়াল করলো আদ্র কল্পনায় ভাসছে। তার চোখে স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলা খেলছে। কিন্তু কি স্বপ্ন আর কি কল্পনায় ভাসছে আদ্র সেটা তরী ধরতে পারলো না। সে মৃদু হেসে আদ্রর চোখের সামনে হাত নাড়ল। তাতে যেন আদ্র আরও কিছুটা তলীয়ে গেলো কল্পনার জগতে। তরী গ্লাসটা আদ্রর হাতে দিয়ে পূনরায় একই কাজ করলো। আদ্রর গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,

—-‘ কিউট বয়।’

কথাটা বলে চলে গেলো তরী। আদ্র এবার খুশিতে মরে যাচ্ছে। তার ক্রাশ তাকে একবার নয় দু’দুবার গালে আলতো করে স্পর্শ দিয়ে গেলো। হায়! আদ্র খালি গ্লাসটা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে তরীর যাওয়ার পানে ঘুরে দাঁড়াল।

—-‘ তরীর হাঁটার স্টাইলও একদম মাস্ত। একদম পরী পরী ইয়ার।’

অসাবধানতায় মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো কথাটা। আর এমন সময়ই বের হলো যখন তার দুই বন্ধু দূর থেকে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে দৌড়ে এলো। মুহুর্তেই মুখটা ইয়া বড় আকার ধারন করলো এশা এবং মিলির! দু’জনে বিস্মিত চাহনিতে আদ্রর দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করতেই বুঝতে পারলো সে তরীকে দেখছে।

মিলি আদ্রর দিকে কতক্ষণ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে থেকে গাঁট্টা মারলো তার মাথায়। আদ্র প্রথম গাঁট্টা সামলাতেই আরেকটা গাঁট্টা মারলো এশা। বেচারা আকস্মিক ঘটনায় ভড়কে গিয়ে দুই বন্ধুর দিকে বারবার তাকাতে লাগলো। মিলি তরীর দিকে ইশারা করে সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো,

—-‘ কি চলছে এখানে?’

আদ্র পাল্টা জবাবে মিলির মাথায় চাটি মেরে বলল,

—-‘ প্রেম প্রেম খেলা হচ্ছে। দেখছিস না ইডিয়ট।’

মিলি নাক ফুলিয়ে আদ্রকে আরেকটা গাঁট্টা বসিয়ে বলল,

—-‘ ছি! আম্মার বয়েসী এক মহিলার সাথে তুই প্রেম প্রেম খেলছিস।’

পাশ থেকে এশা ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,

—-‘ একদম।’

আদ্র তব্দা খেয়ে বলল,

—-‘ হোয়াট! আম্মার বয়েসী মহিলা কে? আরে ওটা তো তরী আপু!’

এশা মুখ কুঁচকে বলল,

—-‘ তরী আ,,,,পু্?(টেনে টেনে)

—-‘ ঐ বেদ্দপ মহিলা? তুই ভেঙ্গাছ কেন?’

—-‘ তা তুই তরী আপুকেই ওভাবে শকুনি নজরে কেন দেখছিস?’

আদ্র বিষম লেগে বলল,

—-‘ কি বলছিস? শকুনি নজরে কেন দেখুম? আমি কি শকুন নাকি?’

মিলি বলে উঠলো,

—-‘ আচ্ছা ছাড়। শকুনি না। কুত্তা নজর। তুই উনাকে কুত্তা নজরে কেন দেখছিস? আবার বলছিস পরী পরী! কাহিনি কি মামা?'(কাঁধ চাপড়ে)

আদ্র থতমত খেয়ে বলল,

—-‘ শকুন, কুত্তা! আর কি আছে? সব খেতাব দিয়া দে আমারে।’

—-‘ রামপাঠা,ছাগল,খাটাশ,খবিশ,ডাস্টবিন, ড্রেন।’

—-‘ ছি! ইয়াক।’

—-‘ হ্যাঁ। এগুলো সব তুই।’

—-‘ তোরা আমার ফ্রেন্ড নাকি ডাস্টবিনের ময়লা?’

এশা বিরস মুখে বলল,

—-‘ হইছে এতো ভালো সাজতে হবেনা। আগে বল কাহিনী কি? ত,,রী আ,,পু-কে কেন এভাবে দেখছিলি? পুরাই মগা মগা লাগছিলো তোকে।’

আদ্র কাঁদো কাঁদো মুখ করে এশার পানে তাকালো। এশা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

—-‘ সত্যি কথা দোস্ত। তোরে সত্যিই মগা রামের মতো লাগছিলো।’

আদ্র মুখ কুঁচকে বলে উঠলো,

—-‘ আমায় নিয়ে তোরা পঁচাচ্ছিস আবার আমি কি না তোদের কাছে বলবো কাহিনী কি? অসম্ভব।’

এই বলেই হাঁটা ধরলো আদ্র। পেছন থেকে এশা আর মিলি মুখ চাওয়াচাওয়ি করে টেনে ধরলো আদ্রর শার্ট। আদ্র টান খেয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আরেকটু হলেই তার শার্টের বারোটা বেজে যেতো। রেগে পেছন ফিরে তাকাতেই দাঁত কেলিয়ে হাসল এশা আর মিলি। এশা দাঁত কেলিয়েই বলতে লাগল,

—-‘ বলনা দোস্ত। কি কাহিনী?’

মিলিও এশার ন্যায় দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে উঠলো,

—-‘ হ্যাঁ রে দোস্ত। বলনা?’

দু-জনের দাঁত কেলানো হাসিতে আদ্রর রাগ গলে গেলো। সে বেশ আবেগ নিয়ে বলতে উদ্যোত হলো তরীর কথা। যা দেখে এশা আর মিলিও ভীষণ সিরিয়াস হয়ে উঠলো তার কথা শোনার জন্য। তিজনেই এবার কাছাকাছি এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। আদ্র মুখে লজ্জা মিশ্রিত হাসি রেখে বলতে লাগল,

—-‘ আমি না ক্রাশ খেয়েছি তরী আপুর উপর। বলতে পারিস প্রেমেই পড়েছি। জানিস কি সুন্দর করে হাসেন উনি। আবার কথা বলার ভঙ্গি? আমায় হৃদয় ফুটো করে দিয়েছে গাইজ। আর জানিস একটু আগে কি হয়েছে? উনি তো আমার গালে আলতো করে হাত স্পর্শ করেছেন। ইশশ, আমার যে কি লজ্জা লাগছিলো না? বলে বোঝাতে পারবো না।’

আদ্র কথা গুলো বলতে বলতে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিলো। আর অমনি শুরু হলো ভুবন কাঁপানো হাসি। এশা আর মিলি একসাথেই হু হা করে হেসে উঠলো। দু’জনের বিকট হাসির শব্দ আদ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখ তুললো। দু’জনের দিকে বোবা চোখে তাকাতেই এশা আর মিলি চড়থাপ্পড় দিতে লাগলো তাকে। আদ্র মার খেয়ে কুঁকড়ে যেতেই মিলি বলে উঠলো,

—-‘ ক্রাশ খেলি তাও এতো সিনিয়রের উপর। উনি বয়সে তোর থেকে কম করে হলেও চারপাঁচ বছেরের বড় গভেট। এতোই যখন সখ তোর তাহলে আমার নানীর উপর খেতিস। তাও মানাতো।’

আদ্র অসহায় মুখ করে কিছু বলতে নিলেই এশা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

—-‘ ওর নানীর থেকে আমার দাদী তো আরও বেশি সিনিয়র। তুই চাইলে আমি কথা বলে দেখতে পারি। কি বলিস?’

আদ্র বোবা চোখে এশার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

—-‘ আমি বেঁচে আছি কেন? কুত্তে কামিনে।’

আদ্র মুখ কুঁচকে প্রস্থান করলো। যাতে এশা আর মিলির হাসির তীব্রতা আরও কয়েকগুন করে বেড়ে গেলো।
___________________

ভোর পাঁচটা। ফজরের আজান কানে ভেসে আসছে নাজমা বেগমের। দুই একবার এপাশ-ওপাশ করে উঠে বসলেন তিনি। ওযু করে নামাজ পড়তে হবে। আজ সন্ধ্যায় সানিয়ার হলুদ হবে। তার আগে ছেলেমেয়েরা মজা করে রঙ খেলবে। অনেক প্রস্তুতি বাকি। ফজরের নামাজটা শেষ করে কাজে হাত লাগালে অনেক কাজই এগিয়ে থাকবে। তাই করতে হবে। বাইরের লোকেরা আর কতদিক সামলাবে। কতটুকুই বা বুঝবে?

এসব ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছাড়লেন নাজমা বেগম। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে সোজা চলে এলেন নামাজের স্থানে। তোয়ালে দিয়ে হাতের পানি মুছতে মুছতে চোখে পড়ল কে যেন বসে আছে নামাজের পাটিতে। নাজমা বেগম মৃদু হাসলেন। এ নির্ঘাত হীর হবে। মেয়েটা দুই দিন ধরে ফজরের সময় এসে হুট করে হাজির হয়ে যাচ্ছে। হীরকে নামাজ পড়তো আসতে দেখলে নাজমা বেগমের আত্না সন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। এক অদ্ভুত শান্তি পান তিনি। নামাজের নিয়ত করায় নাজমা বেগম আর কথা বললেন না। হীরের পাশ ঘেঁষে এসেই দু’রাকাআত সুন্নত নামাজ আদায় করলেন। সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত ধরবেন এমন সময় মনে হলো তার পাশে হীর নয় কনিকা বসে আছে। নামাজ পড়ছে। ‘কনিকা’ মনে হতেই নাজমা বেগমের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল! তিনি আতংকে কেঁপে উঠলেন। পূনরায় ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন কনিকার দিকে। হয়তো তার চোখের ভুল হবে। কিন্তু না। তার মনকে ভুল প্রমান করল তার চোখ। মস্তিষ্ক জানান দিলো, এ তার ভুল নয়। কনিকা বাস্তবেই উপস্থিত আছে এখানে। নাজমা বেগম সাহস করে হাত রাখলেন কনিকার কাঁধে। মনে হচ্ছে কনিকাকে ছুঁতেই ভ্যানিশ হয়ে যাবে সে। কিন্তু তাও হলো না। উল্টে তাকেই ভড়কে দিয়ে কথা বলে উঠলো কনিকা,

—-‘ আপা,কেমন আছো তুমি? কতদিন হয়ে গেলো আমরা দুই ঝা একসাথে নামাজ পড়িনা। আজ ভীষণ ইচ্ছে হলো তোমার সাথে নামাজ পড়তে। আজ চলেই এলাম। আমি এসেছি বলে কি তুমি রুষ্ট হলে আপা?’

নাজমা বেগম কেঁপে উঠলেন। তার হাত পা কাঁপছে। অবশ হয়ে আসছে শরীর। কথা বলতো চাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না। তাতেও যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। এটা সত্যি কনিকা। কনিকা সত্যি এসেছে। তার সঙ্গে নামাজ পড়েছে। কনিকা সত্যি এসেছে। কতগুলো বছর কেটে গেলো। সেই কাল রাত পেরোলো আজ বারো বছর হয়ে গেলো। তারা একসাথে থাকাকালীন কনিকাও রোজ ঠিক নামাজের সময় এসে হাজির হতো। তার বড় সাধ ছিলো দুই ঝা বুড়ি হলেও ঠিক এভাবেই একসাথে নামাজ পড়বে। এসব ভাবতে ভাবতেই ভেতরটা ডুকরে কেঁদে উঠলো নাজমা বেগমের। তিনি ফুঁপিয়ে উঠলেন চাপা কষ্টে। কনিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নাজমা বেগমের দিকে। নাজমা বেগম কাঁদছেন। অঝোরে কাঁদছেন তিনি। কষ্টে তার ভেতরটা হাহাকার করে ফেটে যাচ্ছে। এমন দুটো মানুষকে ওরা কি করে এতোটা নৃশংস ভাবে মেরে ফেললো? একটুও কি দয়ামায়া হয়নি ওঁদের? একটুও না?

—-‘ গিন্নি! ও গিন্নি? গিন্নি চোখ খুলো? কি হয়েছে তোমার? গিন্নি?’

শেষের ডাকটা বেশ জোরেই ডাকলেন আজিম সাহেব। যার দরুন ঘুম ভেঙে গেলো নাজমা বেগমের। তিনি চোখ খুলে নিজের স্বামীকে আবিষ্কার করতে চমকে উঠলেন। শোয়া থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন। বড়বড় দম ফেলে আশেপাশে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন। আজিম সাহেব অবাক চোখে নাজমা বেগমের দৃষ্টি অনুসরণ করতে লাগলেন। কি খুঁজছেন তিনি?

—-‘ কি হয়েছে তোমার? দুঃস্বপ্ন দেখেছো? পানি খাবে?’

আজিম সাহেব নাজমা বেগমের দৃষ্টিতে উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলে উঠলেন কথা গুলো। নাজমা বেগম স্থীর হয়ে গেলেন। আকস্মিক কি ভেবে স্বামীকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বাস্তবে কনিকা আসেনি। কনিকা তার স্বপ্নে এসেছিলো। স্বপ্নেই তার সাথে নামাজ পড়েছে। কথা গুলো ভাবতে আরও কান্না পেয়ে গেলো নাজমা বেগমের। কনিকা বাস্তবে কি করে আসবে? মৃত মানুষ বাস্তবে আবার কি করে ফিরে আসে?

—-‘ ও গিন্নি? কি হলো তোমার? হঠাৎ এমন বাচ্চাদের মতো কেন করছো? আরে বাবা তুমি কাঁদছো কেন? দুঃস্বপ্ন দেখেছো? বলবে তো আমায়?’

—-‘ আ,,আমি কনিকাকে স্বপ্ন দেখেছি গো! আমার কনিকা কে আমি স্বপ্নে দেখেছি। ও স্বপ্নে এসে আমার সঙ্গে নামাজ পড়েছে। নামাজের পাটিতে বসে…’

আজিম সাহেব মৃদু হাসলেন। গিন্নির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,

—-‘ তা বেশ তো। কনিকা তোমার স্বপ্নে এসে নামাজ পড়েছে সে তো খুবই ভালো কথা গিন্নি। তাতে তুমি খুশি না হয়ে কাঁদছো? হু? পাগলী আমার। আমার মন বলছে কনিকা এবং রিয়াদ দু’জনেই পরপারে খুব ভালো আছে। তাই হয়তো তুমি এমন স্বপ্ন দেখেছো।’

—-‘ আমি জানিনা।’

—-‘ আচ্ছা জানতে হবেনা। এবার একটু থামো তো। এতো কাঁদতে নেই। শরীর খারাপ হয়ে যাবে। এই নাও পানি। খেয়ে নাও।’

#চলবে_

[বিঃদ্রঃ এতদূর কষ্ট করে পড়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেননা। যদি ছোট্ট একটা মন্তব্যে আপনার মতামত জানাতে কষ্ট হয়। ধন্যবাদ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here