কাছে দূরে পর্ব ৩

#কাছে_দূরে♥️🥀
#moumita_mehra
#পর্বঃ০৩

হীর চেয়ার ধরে বসে পড়ল জায়গায়। সাবাবকে দেখে সে ভয় পাওয়ার চেয়েও খুব বেশি আনন্দিত। কিন্তু সেই আনন্দ সে প্রকাশ করতে পারছেনা! মনে হচ্ছে যেন প্রকাশ করলেই ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো হীর। ক্ষিধেয় পেট জ্বালা করছে তার। বড়মায়ের দিকে আঁড়চোখে একবার তাকালো। বড়মা নিজের ছেলে দেশে ফেরার আনন্দে আত্মহারা। তবে কি তার না খেয়েই উঠে যাওয়া উচিৎ?

—-” তোকে ভীষণ মিস করতাম রে ভাইয়া। কতগুলো বছর হলো আমেরিকায় গেলি! সেই যে গেলি আর এতগুলো বছরেও বাড়ি ফেরার নাম নিলিনা! আচ্ছা এতগুলো বছরেও কি তোর ফ্যামিলির কথা মনে পড়ে নি?”

সাবাব চোখ ঝাপটে না সূচক মাথা নাড়ল। মুখ বাঁকিয়ে বলল,

—-” কখনই না! শুধু মায়ের কথা মাঝেমধ্যে মনে পড়ত। এই যা।”

সানিয়া অভিমানি কন্ঠে বলল,

—-” যা যা! কথা বলবি না একদম!”

পাশ থেকে আজিম সাহেব মেয়ের কথার রেশ টেনে বললেন,

—-” শুধুই কি মায়ের কথা? আর কারোর কথা কখনও মনে পড়তো না বুঝি?”

সাবাব ছোট্ট করে হাসল। বোনকে ছেড়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

—-” মিসড ইউ সো মাচ বাবা।”

আজিম সাহেব নিজের নিশপিশ করা হাত দুটো আর সামলে রাখতে না পেরেই বুকে জড়িয়ে নিলেন ছেলেকে। জড়ানো গলায় বললেন,

—-” কতগুলো বছর কিভাবে দেখতে দেখতেই কেটে গেলো!”

—-” বারো বছর বাবা!”

হীর চমকে উঠল। বারো বছর ধরে সাবাব আমেরিকায় ছিলো। সাবাব আমেরিকায় যাওয়া কালিন ওর বয়স বারো ছিলো। তখন সাবাব খুব সম্ভবত ক্লাস সিক্সে ছিলো। হীর মাথায় চাপ ফেলে মনে করার চেষ্টা করল। তার মস্তিষ্ক বারবার একই উত্তর দিচ্ছে।

—-” তোর বাসায় ফিরতে এতো লেট হলো কেন বলতো? তোর ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা তো সেই সকাল নয় টায়। আর এখন সময় প্রায় আড়াইটা।”

সানিয়ার কথায় সবারই চিন্তামনি হানা দিলো মনে। হীর চুপচাপ বসে রইল। কেননা, বাকিরা কেউ না জানলেও সে তো খুব ভালো করেই জানে তাদের এই বিলেত ফেরত ছেলে দেশের মাটিতে পা রেখেই সর্বপ্রথম তাকে চড় মারার উদ্দেশ্য সফল করেছো! আমেরিকাতে যাওয়ার আগে তাকে সে কথা দিয়ে গিয়েছিলো যে সে দেশে ফিরলে সর্বপ্রথম তার সামনেই আসবে। তবে এভাবে আসবে সেটা হীর ভাবেনি কখনও।

—-” আর বলিস না, ফ্লাইট ল্যান্ড করল পরেই দেখা হলো লাবিবের সাথে। লাবিবকে চিনিস তো? আমার ক্লাস ফাইভের ফ্রেন্ড। আমি যদিও ওকে চিনতে পারিনি কিন্তু ও আমাকে দেখেই চিনে ফেললো। আমরা একই ফ্লাইটে এসেছি। আগে দেখা হয়নি। আর তারপর তার সে কি খোশগল্প! বিশ্বাস করো মা, আমি ওকে এতো বার করে বুঝালাম আমাকে বাসায় ফিরতে হবে বাসায় ফিরতে হবে ঐ বেয়াদব বুঝতেই চাইছেনা আমার কথা। নিয়ে গেলো ওর বাবার রেস্টুরেন্টে। স্পেশাল সব মেনু অর্ডার করে আঁটকে দিলো আমার ঘন্টা দুই। তারপর যখন বাসার উদ্দেশ্যে বের হলাম সে কি জ্যাম! জ্যামেই আঁটকে ছিলাম বাকি ঘন্টা তিনেক! আর এভাবেই কেটে গেলো সময়।”

হীর রাগের কটমট করে তাকালো সাবাবের দিকে। কি অনর্গল মিথ্যে বলে যাচ্ছে সাবাব। একবারও মুখে আটকালো না। কথার মাঝখান থেকে ভাবার উদ্দেশ্যে থামলোও না! মিথ্যে বলাতে কতটা চালু হলেই এভাবে না থেমে থেমে কথা বলতে পারা যায়।

—-” ইশ দেখেছো কান্ড। ঘেমে-নেয়ে কি অবস্থা হয়েছে ছেলেটার আমার। বাবা তুই বস তো। এই সানি, মা এসির পাওয়ারটা আরেকটু বারিয়ে দে তো?”

নাজমা বেগমের ব্যস্ত কন্ঠে সাবাবও ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আঁড়চোখে একবার হীরের দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” ভীষণ গরম মা। অনেকের তো এতক্ষণে গা জ্বালা করছে বলো? তবে আমার ততটাও করছে না। সামান্যই করছে!”

হীর পূর্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সাবাবের দিকে। সাবাব কথা ঘুরিয়ে বলল,

—-” মা এটা কি আমাদের হীর?”

হীরের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মুখটাও মলিন হয়ে গেলো। শুঁকনো মুখ করে একবার নাজমা বেগমের দিকে তাকাতে লাগল তো একবার সাবাবের দিকে। আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিলেই নাজমা বেগম বলে উঠলেন,

—-” হুম। আমাদের সেই ছোট্ট হীরপরি। দেখছিস কত বড় হয়ে গিয়েছে সে।”

সাবাব ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বলল,

—-” হুম তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”

হীর দাঁড়িয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগল,

—-” হাই ভাইয়া।”

সাবাবের মুখটা নিমিষেই ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। গলা খাঁকারি দিয়ে কান চুলকানোর ভাব ধরে বলল,

—-” হ্যালো। কেমন আছিস পিচ্চি?”

হীরের কপাল কুঁচকে গেলো মুহুর্তেই। সাবাবের মুখের উপর কড়াকড়ি একটা জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, তাকে কোন এঙ্গেল থেকে পিচ্চি লাগছে? একটা পাঁচ ফিট চার ইঞ্চি লম্বা মেয়েকে আর যাই হোক পিচ্চি বলা যায় না। নিজের অদম্য ইচ্ছে কে হীর মনের মধ্যে চেপে রেখে বলল,

—-” আমি ভালো। তুমি কেমন আছো?”

—-” হুম। চলে যাচ্ছে। তোর স্টাডি কেমন যাচ্ছে?”

—-” ভালো।”

—-” কি রে তোরা এমন অপরিচিতর মতো আলাপচারিতা কেন করছিস বলতো? আচ্ছা বাদ দে এসব। আমার জন্য কি এনেছিস ভাইয়া?”

শেষের কথাটা বলতে বলতে দাঁত কেলিয়ে হাসল সানিয়া। সাবাব হীরের দিকে আঁড়চোখে তাকালো একবার। ওর চোখ মুখে আজও সেই ভয়। সেই পুরনো ভয়! যা আজ বারো বছর বাদেও একই ভাবে অটুট আছে। কমেনি এই এক ইঞ্চিও।

—-” এনেছি! সবার জন্যই অনেক অনেক গিফটস এনেছি। তবে এখন দিবো না পরে দিবো। মা? খেতে দাও না কিছু? আমার কিন্তু খুব বেশি ক্ষিদে পেয়েছে।”

ছেলের কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেই নাজমা বেগম। বিচলিত হয়ে ছুটলেন রান্না ঘরে। ছেলের জন্য রান্না করা সকল খাবারই এনে হাজির করলেন টেবিলে। হীরের জন্য নেয়া খাবার সেভাবেই প্লেটে পরে শুঁকোতে লাগল। হীর আর দেখলো না সেই খাবার। সে আরেকটা প্লেট তুলে নতুন করে খাবার বেড়ে চুপচাপ খেতে লাগল। তাকে আর কেউ খেয়াল না করলেও বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগল সাবাব। এটাই সেই হীর!ছোট বেলায় যখন বাবা-মার মৃত্যুকে ভুলে এই বাড়িতে পা রেখেছিলো প্রথম। টানা পঁচিশ টা দিন হসপিটালের বেডে শুইয়ে কেবল লড়াই করে গেলো মৃত্যুকে হারাবে বলে। অবশেষে কেটে গেলো মৃত্যু ভয় আর জিতে গেলো সেই ছোট্ট হীর। যে কিনা তখনও জানত না তার বাবা-মা আর নেই। এই মেইন গেটের কাছেই হাতে ময়লা একটা পুতুল কোলে করে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। নাজমা বেগম তাকে আগলে নিয়েছিলো সেদিন। সেই থেকেই হীর এই বাড়িতে। সেই পুতুল পুতুল দেখতে মেয়েটা আজ এতগুলো বছর বাদেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই মায়ায় জড়ানো চোখ, মন কাঁড়ানো মুচকি হাসি। সবই একই রকম আছে। হীর ধবধবে সাদা নয়। হীরের গায়ের রং দুধের মধ্যে কাঁচা হলুদ। গোলগাল মুখ, চোখে ঘন পল্লব, গোলাপের পাপড়ির ন্যায় পাতলা ঠোঁট। ঠোঁটের মাঝ বরাবর কালো ছোট্ট একটা তিল।নিমিষেই চোখে পড়ে তা। মাথায় ঘন কেশ। অনুমান করা যায় কোমর ছুঁয়েছে। হীরের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো সে স্বল্পভাষী শান্ত স্বভাবের মেয়ে। তার কান্না পেলে নাকের ডগা লাগ মরিচের মতো লাল হয়ে ওঠে। কফি-শপে সাবাব যখন তাকে অকারনেই চড় মারে তখন রাগে দুঃখে হীরের নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছিলো। সাবাবের পুরোনে অভ্যাস হীরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। কফি-শপে ওমন একটা বেগতিক পরিস্থিতিতেও সে তার অভ্যাস থেকে পিছুপা হতে পারেনি।

—-” মা, এতো খাবার একসাথে দিওনা প্লিজ! একটু একটু করে খেতে দাও!”

নাজমা বেগম গায়ে মাখলেন না ছেলের বারন। সে একের পর এক খাবার তুলে ছেলের প্লেট ভর্তি করছেন। পাশ থেকে আজিম সাহেব এবং সানিয়া দুজনেই চেয়ে থেকে তার কান্ড দেখছে। আজিম সাহেব বললেন,

—-” কি গো করছোটা কি? দেখো ওর প্লেটটা ভর্তি হয়ে গিয়েছে। আর দিও না। আরে বাবা খাওয়ার সময়টা তো দিবে?”

নাজমা বেগম কুঁচকানো ভ্রু নিয়ে তাকালেন স্বামীর দিকে। রুক্ষ স্বরে বললেন,

—-” ছেলেটা এতোদিন বাদে আজ আবারও মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছে। অল্প অল্প দেই কি করে বলো? ইচ্ছে তো করছে সব বাটি একসাথে করে ওর প্লেটে তুলে দেই৷ তাতেও আমার মন ভরবে না বুঝেছো!”

হু হা করে হেসে উঠলেন আজিম সাহেব। সাথে যোগ হলো সাবাব আর সানিয়াও। ছেলেকে নিয়ে নাজমা বেগমের বরাবরই বড্ড বাড়াবাড়ি। তবুও যে এতগুলো বছর ছেলেকে চোখের আড়াল করে থেকেছেন সেটা সত্যি অপকল্পনীয় ব্যাপার।

খাওয়া শেষ হতেই চুপচাপ করে উঠে দাঁড়ালো হীর। সাবাব ভাতের লোকমা মুখে নিতে নিতেই তাকালো হীরের দিকে। নাজমা বেগমের এতক্ষণে মনে পড়ল হীরের জন্য তিনি খাবার বেড়েছিলেন। হীরকে রুমের উদ্দেশ্যে হেঁটে যেতে দেখেই তিনি অপরাধী গলায় বলে উঠলেন,

—-” হীর! মা খেলেনা তুমি?”

হীর পেছনে মুড়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো,

—-” ডান বড়মা। আমি রুমে যাচ্ছি!”

নাজমা বেগম অসহায় চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। আজিম সাহেব চোখ ঝাপটে ভরসা দিয়ে হীরের উদ্দেশ্যে বললেন,

—-” মামনী? আজ বাবাইয়ের থেকে এক লোকমাও খাবেনা বুঝি?”

হীর আবারও দাঁড়িয়ে পড়ল। আজিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,

—-” আজ আর খেতে ইচ্ছে করছে না বাবাই।”

কথাটা বলে আর এক মিনিটও দাঁড়ালো না হীর। চুপচাপ প্রস্থান করল। সাবাবের কপালের মাঝে চিন্তার সুক্ষ্ম ছাপ ফুটে উঠল। আজিম সাহেব হীরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নাজমা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,

—-” আভিমান হলো?”

নাজমা বেগম অসহায় কন্ঠে বললেন,

—-” সাবাব কে নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি শুরু করলাম যে মেয়েটার দিকে একবারও তাকালামই না!”

সাবাব মায়ের হাত ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

—-” হীর কিন্তু তোমাকে কারোর সাথে শেয়ার করতে পারেনা মা।”

নাজমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—-” সব তোর জন্য হয়েছে। এবার জলদি করে খেয়ে নে তো।”

সাবাব হেসে উঠলো। বলল,

—-” হু এখন সব দোষ এই নন্দ ঘোষের! তাই তো?”

সানিয়া হাসতে হাসতে বলল,

—-” মা ঠিকই বলেছে৷ সব তোর জন্যই হলো।”

সাবাব খাবার চিবোতে চিবোতে একবার আঁড়চোখে তাকালো হীরের যাওয়ার পথে।

_________________________

বিছানায় আধশোয়া হয়ে কফি-শপের নিউজটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখছে হীর। ঘড়িতে সময় এখন ___৮টা বেজে ৪৬ মিনিট। সকাল পেরিয়ে রাত হয়ে এলো এখনও ওখানে লোক উদ্ধার করা হচ্ছে! কারোর কারোর লাশের হদিশও খুঁজে পাওয়া যায়নি আবার কারোর কারোর লাশ এখনও উদ্ধার করা হচ্ছে। ব্লাস্ট হওয়ার কারনে নীচের দিকে অনেকাংশে ভাগ হয়ে গিয়েছে। কফিশপের নীচেই ছিলো ছোট্ট একটা মল। সবকিছুই এখন কয়লা হয়ে আছে। সেই সাথে আটকা পড়েছে অসংখ্য মানুষ।

—-” এখনও উদ্ধারের কাজ চলছে! কাল সকাল অব্দি চলবে।”

আকষ্মিক পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসতেই আঁতকে উঠল হীর। ফোনটা হাত থেকে পাশে পরে গেল। ফোনটার দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করল হীর। সাবাব দাঁড়িয়ে। ধূসর রঙের একটা টি-শার্ট আর তার নীচে একটা শর্ট প্যান্ট পরে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। আকর্ষণীয় চোখ দুটো চকচক করছে। ঠোঁটের কোনে সতেজ হাসি। হেলতে দুলতে হীরের দিকে এগিয়ে আসতেই ফোনটা উঠিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো হীর। পাশে ছোট্ট ড্রায়ারটার উপর ফোনটা রেখে কাচুমাচু করে দাঁড়ালো। সাবাব তাকে পাশে কাটিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। হীর আরেকটু সরে দাঁড়ালো। সাবাব খেয়াল করল হীর ভয় পাচ্ছে। ভয়ে তার গোলাপি ঠোঁট খানা বিচলিত হয়ে পড়েছে। বারবার শুঁকিয়ে যাচ্ছে আর সাহায্য নিচ্ছে জিহ্বার। জিহ্বা এসে তাকে বারবার ভিজিয়ে দিয়ে আস্বস্ত করছে তবুও সে অপারগ! সাবাব আরও খেয়াল করল, হীরের গালে লালচে দাগ পড়ে আছে। দুটো দাগ! সাবাবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে এড়াতেই হীর কানের পাশের চুল গুলো ছেড়ে দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক চুল এসে হীরের গালের একপাশ ঢেকে দিলো। সাবাব কেশে উঠল। ঘরের চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বলল,

—-” বেশ পরিপাটি রুম। ভাবছি বিয়ে করে বউকে নিয়ে এ ঘরেই শিফট করব।”

হীরের গা জ্বলে উঠলো। কপাল কুঁচকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছু বলল না! মনে মনে বকে বলল,(কত সখ! বিয়ের পর বউকে নিয়ে এ-ঘরে শিফট করবে। বলি ঘরের কি অভাব পড়েছে নাকি? যে আমার ঘরে থাকতে হবে?)”

—-” আমার জন্য রুম ছাড়তে পারবি না?”

হীর ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। সাবাবের সাথে কথা বলতে তার মোটেও ইচ্ছে করছে না। তাই জবাবেও কিছু বলল না। সাবাব অধৈর্য্য হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো! ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে এক রাম ধমক মারতে! সে কতগুলো কথা বলে ফেলল কিন্তু এই মেয়ে! কেমন নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! কিন্তু তাকে আর ভয় দেখালো না সাবাব। পকেটে হাত গুঁজেই সামনে গিয়ে দাঁড়ালো হীরের। ঠোঁটের কোনে কোমল হাসি জুড়ে একহাত বের করে হীরের ডান গালে রাখল। হীর চমকে উঠলো সাবাবের ছোঁয়ায়। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো সাবাবের দিকে। সাবাব জানে, সে যদি এখন হীরের চোখে চোখ রাখে তবে সে আরও ঘাবড়ে যাবে। তাই সে হীরের দৃষ্টিকে সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে হীরের গালের উপর পড়ে থাকা চুল গুলো আলতো স্পর্শ করে কানের পাশে গুঁজে দিলো। গালের উপর থেকে চুল গুলো সরে যেতেই সাবাবের চোখে পড়ল গালের উপর তিনটে দাগ! ইশশ, কি জোরেই না মেরেছিলো সে! দাগ গুলো দেখে তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। বসে থাকা অবস্থায় দুটো দাগই চোখে পড়েছিলো। কিন্তু এখন তিনটে দাগ স্পষ্ট। নিজের উপরই তার রাগ হচ্ছে খুব! প্ল্যানটা সে অন্য ভাবে করলেও পারত! হীরকে এভাবে আঘাত করা তার মোটেও ঠিক হয়নি! তবে অন্য প্ল্যান গুলো এটার মতো কার্যকর তো নাও হতে পারত! পাছে হীরের কষ্ট হবে ভেবে হীরকে তো সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলত।

হীর দূরে সরে গেলো সাবাবের থেকে। ভয়ার্ত হরিণীর মতো সে পালানোর পথ খুঁজতে লাগল! সাবাবের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্য বাঘের গুহার থেকে কিছু কম মনে হয় না। হীর সাবাব কে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই সাবাব কড়া গলায় বলে উঠলো,

—-” কোনো মেডিসিন লাগাসনি কেন?”

হীর দাঁড়িয়ে পড়ল। জবাব দিলো না। সাবাব গলা উঁচিয়ে রুবিকে ডাকতে লাগল! রুবি না পারে প্লেনে করে উড়ে আসে। এক দৌড়ে হাজির হলো রুবি। সাবাব রুবিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—-” কয়েক টুকরো বরফ এনে হীরকে দিবি। দরকার পড়লে নিজ হাতে ওর গালে লাগিয়ে দিবি! যতক্ষণ না ওর গালের ব্যাথা কমে ততক্ষণ অব্দি লাগাবি।”

রুবি তড়িঘড়ি মাথা নেড়ে আবারও ছুট লাগালো। হীর রুবির যাওয়ার পানে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

—-” আমার বরফের কোনো প্রয়োজন নেই।”

সাবাব যেন ধন্য হলো হীরের কথায়। একটা মানুষ এতোটা চুপচাপ কি করে থাকতে পারে?

—-” প্রয়োজন আছে কি নেই সেটা আমি দেখব। চুপচাপ বস এখানে।”

সাবাবের কঠিন স্বর হীরকে বাধ্য করল বাধ্য মেয়ে হতে। সাবাব ভাবল হীর বাঁধ সেধে আরও কিছু বলবে কিন্তু হীর আর কিছুই বলল না। চুপচাপ বসে পড়ল বিছানার উপর। সাবার হীরের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

#চলবে____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here