কাছে দূরে পর্ব ৫১

#কাছে_দূরে 💞
#moumita_meher
#পর্ব___৫১

—-‘ তোদের দাদুভাইয়ের বাবার পূর্ব পুরুষরা সবাই ইরানের লোক ছিলেন। বাংলাদেশে তারা ব্যাবসার জন্য আসতেন। তেমন ভাবেই এসেছিলেন তোদের দাদুভাইয়ের বাবা। তিনি বাংলাদেশে ব্যাবসা করতে এসে তার পূর্বপুরুষের ধর্ম রক্ষা করে আবার ফিরে যাননি। বরং বাংলাদেশের এক সুন্দরীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বরাবরের মতো থেকে যান বাংলাদেশে। বিয়ে নতুন সংসার শুরু করেন আহমেদ ভিলায়। ‘আহমেদ ভিলা’ নামকরন টা উনার স্ত্রীর ইচ্ছেয় হয়েছিলো। কেননা, তোদের দাদার নাম ছিলো আর-রহমান আহমেদ। তিনি চেয়েছিলেন তাদের একমাত্র ছেলের নামেই থাকুক এই বাড়ির নাম। এবাড়ির লোকজন বরাবরই অঢেল টাকাপয়সার মালিক ছিলো। তোদের দাদুভাইয়ের বাবা তার যৌবন কালে এতো টাকা পয়সা রোজাগার করেছেন যে তাতে তার পরবর্তী সাত প্রজন্ম বসে বসে খেতে পারতো। তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমি মানুষ। তার এতো টাকা-পয়সা থাকা সত্বেও সে কখনও ঘরে বসে থাকেননি। জীবনের শেষ দিন অব্দি আয় রোজগার করে গিয়েছেন। ঠিক তেমনই ছিলন আমার শশুর মশাই। মানে তোদের দাদুভাই। তিনি ছিলেন প্রচন্ড কর্মঠো। ঠিক বাবার মতোই জীবনের শেষ দিন অব্দি কাজ করেছেন। তার মতো ভালো এবং সৎ মানুষ এই দুনিয়াতে খুব কমই ছিলোরে। ইরানী মানুষ আমি কখনও দেখিনি বটে তবে তোদের দাদুভাইয়ের চেহারায় তার বাবার চেহারার একটা ছাপ ছিলো। মনে হতো নুরে ভরা সেই সুন্দর মুখ। আমাদের বাসা পাশাপাশিই ছিলো। ছোট থেকে এই ঘর আর ঘরের প্রত্যেক টা মানুষ কে আমার মুখস্থ ছিলো। বাবা (শশুর) আমায় ছোট থেকে ভীষণ আদর করতো জানিস। আমাকে কখনও মা ছাড়া ডাকতেননা৷ আর মা-ও (শাশুড়ী) ছিলেন ঠিক একই রকম। জানিস এই ঘরে ছোট থেকে যতবার এসেছি কখনও এবাড়ির বড় ছেলের মুখ দেখিনি। কেবল রিয়াদকেই দেখতাম। রিয়াদ ছিলো বরাবরই লাজুক স্বভাবের ছেলে। মেয়েদের খুব ভয় পেতো। (হেসে) আর পাবেইই না কেন বলতো? মেয়েরা যে ওকে কি পরিমান জ্বালাতো বাপরেহ্। মেয়েদের ভয়ে ও স্কুল, কলেজ যেতে পারতো না। তাই স্কুল-কলেজের পুরো পড়াশোনা ও বাসায় থেকেই করেছে। কেবল সময় মেইনটেইন করে এক্সাম গুলো দিয়ে আসতো। ওর এসব কান্ড দেখে আমার ভীষণ হাসি পেতো আবার খারাপ লাগতো। আমার সবচেয়ে বেশি অবাক লাগতো কি জানিস? নব্বই দশকের মেয়েরা এতোটা নির্লজ্জ কেমন করে হয়। আমি তো কোনো পরপুরুষের দিকেও চোখ তুল তাকাতে লজ্জা পেতাম। রিয়াদ যদি তোর মা ছাড়া কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেছে সে ছিলাম আমি। আমাকে ও নিজের বড়বোনের মতো ভালোবেসেছিলো। ভালোতে মন্দোতে ও শুধু এই আমাকে খুঁজতো। ভালো রেজাল্ট করা থেকে শুরু করে সব কিছু আমার কাছে বলতো। আপা আপা করে বাড়ি মাথা করে ফেলতো। জানিস রে মা, আজও যেন সেই ছোট্ট রিয়াদের ডাক গুলো কানে ভাসে। ভেতরটা হাহাকার করে। আমার পরিবার বলতে ছিলো আমি আর আমার মা। আমার না ছিলো কোনো ভাই আর না ছিলো কোনো বোন। ভাই বলে রিয়াদকেই কাছে পেয়েছিলাম। একদিন হঠাৎ এক অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে বাবা আমাদের বাড়িতে আসে। সাবাবের বাবার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব। মা এই প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হয়ে যায়। মা ভেবেছিলো তার মেয়েটা রাজমহলে থাকবে। সারাজীবন রাজত্ব করে ভালো থাকবে। তবে আমি রাজমহল আর রাজত্ব নিয়ে কোনোদিন ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম ঐ মানুষটার কথা যাকে কোনো দিন চোখের দেখাও দেখিনি তাকে কি করে বিয়ে করি? রিয়াদ আমার আর তার বড় ভাইয়ের বিয়ে হবে শুনে খুশিতে পাগল প্রায়। আমার হাত ধরে বলেছিলো, ‘আপা আজ থেকে তুমি পার্মানেন্টলি আমাদের বাড়িতে থাকবে। আমার কি যে খুশি লাগছে।’ আমিও হেসেছিলাম রিয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে। বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো কিন্তু তখনও আমার সৌভাগ্য হয়নি লোকটার মুখ দেখার। সেই সৌভাগ্য হয়েছিলো বিয়ের রাতে। রাত বললে ভুল হবে, বিয়ের দিন মধ্যরাতে। আমি ঘোমটার আড়ালে আমার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। মনে ছিলো এক অজানা ভয়। আমার ভাবতেই অদ্ভুত লাগছিলো আমার বিয়ে হয়ে গেছে। মধ্যরাতে আচমকা দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করলো ভেতরে। ঘোমটার আড়াল থেকেই লোকটার মুখ দেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু দেখা মিলল না৷ গুরুজনদের শিখিয়ে দেওয়া প্রথা মানতে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ালাম। মাথা ঝুকিয়ে তার পায়ের কাছে বসে যেই না সালাম করবো উনি স্ব জোরে লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন আমায়-

হীর কেঁপে উঠলো। নাজমা বেগমের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরতেই নাজমা বেগম তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন। ভেজা চোখ জোড়া হাতের উল্টোপিঠে মুছে বললেন,

—-‘ এমন আঘাত অসংখ্য বারবার পেতে হয়েছে রে মা। অসংখ্য বার! লাথি খেয়ে আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম নীচে। উনি হুংকার করে উঠলেন আমার উপর। বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বললেন,’তোর সাহস কি করে হয় আমার কাছে আসার? আমার পা ছোঁয়ার? শরীরে খুব চাহিদা তাই না? পুরুষ মানুষের গায়ে ঢলাঢলি করিস এটাই তো স্বভাব তোদের মতো ছোটলোকের বাচ্চাদের। বাবাকে বারবার বলেছি আমি বিয়ে করবো না। তবুও বাবা জের করে আমার বিয়ে দিয়েছে। কেবল তোর জন্য। তোর মধ্যে নাকি মানুষকে ভালো করার জাদু আছে। তুই নাকি আমাকে ভালো করবি। হাহাহা। ভালো করবে। তুই জানিস আমি কি করি? জানিস আমার প্রফেশন কি? জানিস আমি আদৌও কিছু করি কিনা? শোন, আমি বেকার। আমি শুধু বাপের টাকা উড়াই। আমি কোনো রোজগার করিনা। আমি আমার বাপের টাকা দিয়ে ফূর্তি করি। তোর মতো এমন হাজারো একটা মেয়ের সাথে আমি রাত কাটাই। মজা করি, ফূর্তি করি। বাবা ভাবছে আমি তোকে বিয়ে করলেই হয়তো এসব ছেড়ে দিবো। আরে বাবা তো জানে না আমি এখন থেকে রোজ তোর সামনে বসে এসব কাজ করবো। আর খবরদার তুই যদি এসব কথা বাবাকে কিছু বলেছিস তাহলে মনে রাখিস! জানে মেরে ফেলবো তোকে।’

উনার এমন কুরুচিপূর্ণ আচরণ আর কথায় আমি সেদিনই ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম আমার দোযখের মতো ভয়াবহ ভবিষ্যৎ। এবাড়ির আনাচে-কানাচে আমার মুখস্থ থাকলেও এমন কথা বাড়ির কাউকেই বলতে পারিনি কখনও। রোজ রাতে উনার এসব কুকর্ম নিজের চোখে দেখেও দিনের পর দিন মুখ বুঝে সহ্য করে যেতে হয়েছে। এর মধ্যে ভাগ্যের পরিহাস আমার ফেরেশতার মতো শশুর আর শাশুড়ীকে পৃথিবী থেকে নিয়ে গেলো। তার কিছুদিন পরই আমার মাও গত হলো। আমি হয়ে গেলাম নিঃস্ব। রিয়াদ ওর স্বপ্ন পূরনের জন্য চলে গেলো মালয়েশিয়া। আমি আরও একা হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন উনার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়ে আমিও এক অপরাধ করে ফেললাম। উনার খাবারে নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে দিলাম। উনি ঘোরের মাঝে অন্যমেয়েদের স্বপ্ন দেখে আমাকে কাছে টেনে নিলেন। জানতাম কাজটা অপরাধ ছিলো কিন্তু আমিও যে নিরুপায় ছিলাম। উনার ঘরে যদি সন্তান না আসে তাহলে ঘরের টান উনি কোনোদিনই বুঝবেন না। আর আমার একাকিত্বও কোনোদিন ঘুচবেনা। মাস খানিক বাদেই আমি অন্তঃসত্ত্বা হলাম। এই খবর উনার কানে যেতেই উনার অত্যাচার আরও দিগুন বেড়ে গেলো। উনি তখন আমাকে বলতেন ‘তুই কার কাছে গিয়ে মুখ কালো করিয়েছিস সত্যি কর বল? এই সন্তান কখনই আমার হতে পারেনা।’ আমি উনার এই কথারও কোনোদিন প্রতিবাদ করিনি। কারন আমি জানতাম আমি সফল হতে পেরেছি। এবার হয়তো উনাকে আমি ঘরে ফেরাতে পারবো। আমার বাচ্চা হবার কথা শুনে রিয়াদ ভীষণ খুশি হলো। পড়াশোনা কিছুদিন অফ রেখে দেশে ফিরতে চাইলো। আমি বারন করে বললাম ডেলিভারির সময় এসো। ও মেনে নিলো। আবারও মন দিয়ে পড়াশোনা করতে লাগলো। কিছুদিন বাদে রিয়াদ টেলিফোন করে বলল, ‘আপা, ঠিক তোমার মতোই একটা মানুষ পেয়েছি। ঠিক তোমার মতো।’ আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম কে রে? ও হাসতে হাসতে বলল, ‘জান্নাতের হুর আপা।’ এরপর দেখতে দেখতে আমার ডেলিভারির সময় হয়ে গেলো। হঠাৎ দেখলাম আজিম সাহেব দিনদিন একটু একটু করে পাল্টাচ্ছেন। হঠাৎ আমার প্রতি তার কোমল দৃষ্টি দেখে তৎক্ষনাৎ মনে হচ্ছিলো আমি জান্নাত পেয়ে গেছি। উনি আমার প্রতি নরম হলেন। আমার ডেলিভারির শেষ একমাস উনি পুরো বদলে গেলেন। বাবার ব্যবসা একা হাতে সামলে আবার আমাকে সামলাতেন। তখন মনে হতো আমার মতো সুখী মানুষ হয়তো দুনিয়াতে আর একটাও নেই। ডেলিভারির এক সপ্তাহ আগে রিয়াদ আসলো। দেশে ফিরে সারাক্ষণ আমার কাছে থাকতো ও। সাতটা দিন বাসার সব কাজ ও নিজের হাতে করেছে। কাজ করেছে আর গল্প শুনিয়েছে কনিকার। কনিকার ব্যাপারে সবটা সাত দিনেই পুরো মুখস্থ করিয়ে ফেলেছিলো আমাকে। আজিম সাহেব রিয়াদের কান্ড দেখে বলেছিলেন, তুই এসে যা শুরু করলি দেখে মনে হচ্ছে আমি এবাড়ির লোকই না। বেশ কাটছিলো সময় টুকু। সাতদিন বাদে আমার কোল আলো করে এলো আমার দুই সন্তান। দুই ভাই খুশিতে পাগলের মতো করেছে। পুরো হসপিটাল মাথায় করে ফেলেছিলো খুশিতে। আজিম সাহেবকে এমন হাসিখুশি,প্রাণোচ্ছল আগে কখনও দেখিনি। উনার মুখে হাসি টুকু ঠিক এভাবেই সারাজীবন ধরে রাখার প্রার্থনা করেছিলাম উপরওয়ালার কাছে। কিন্তু তখন তো আর জানতাম না তার এই খুশির পেছনেও ছিলো বিশাল বড় স্বার্থ।’

এটুকু বলেই থামলেন নাজমা বেগম। আতংকে তার চোখ মুখ শুঁকিয়ে এসেছে। ভয়ে জমে যাচ্ছে তার হাত-পা। হীর নাজমা বেগমের এই অদ্ভুত আচরনে অবাক হলো। নাজমা বেগমের হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল,

—-‘ কি স্বার্থ ছিলো বড়মা? বলো?’

—-‘ ধন। গুপ্তধন!’

নাজমা বেগমের শীতল কণ্ঠে গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো হীরের। হীর অস্থির হয়ে বলল,

—-‘ গুপ্ত ধন!’

—-‘ হুম। গুপ্ত ধন। এখনি বললাম না? তোদের দাদুভাইয়ের বাবা তার মরনের আগ পর্যন্ত যতোটা রোজগার করেছেন সেটা তার পরের সাত প্রজন্ম খেয়েও শেষ করতে পারবে না। তিনি সব টাকা, পয়সা,সোনা,কড়ি সমস্ত কিছু একটা গোপন জায়গায় রেখেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ইতিহাসের পাতায় এসবের নাম থাকুক। গুপ্তধন গুলো গোপনেই থাকুক। বাকি যা থাকবে তাতেও তার পরের সাত প্রজন্ম বসে বসে খেতে পারবে। তিনি যেমন কর্মঠ ছিলেন তেমনই ছিলেন বুদ্ধিমান। তার একটা টাকা পয়সাও কখনও খারাপ পথ থেকে আসেনি আর খারাপ পথেও যায়নি। তিনি মরার আগে তার ছেলে মানে তোদের দাদুভাইকে এই গুপ্তধনের কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন। তোদের দাদুভাইয়ও ছিলেন বাবার মতো সৎ এবং বুদ্ধিমান। তিনিও কোনোদিন অসৎ পথে একটা টাকা কামাই করেননি। তিনি যেমন সৎ ছিলেন সেই মোতাবেক তার ভাবনা ছিলো তার দুই ছেলেও তার মতোই সৎ হবে। কিন্তু নিয়তির খেলা তার বড় পুত্র তৈরি হলো এক কুলাঙ্গার। যে অসৎ পথ ছাড়া কখনও হাঁটেনি। যে ঘর দুইপুরুষের সৎ কামাই আর সততায় হয়ে উঠেছিলো জান্নাত সে ঘর কেবল এক কুলাঙ্গারের পদচারণে হয়ে উঠেছিলো জাহান্নামের থেকেও ভয়ংকর। বিয়ের পর স্বামীর অত্যাচারে বুঝেছিলাম কেন তাকে বিয়ের আগে কখনও এই বাড়িতে দেখিনি। বাবা ওকে ঘরে ঢুকতে দিতেননা। বছরের পর বছরের বাবা ওকে ঘরের বাইরে রেখেছেন। সবার থেকে আলাদা। তবুও কখনও আজিম নিজের পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। যেদিন আমার কোল আলো করে আমার দুই সন্তানের জন্ম হলো সেদিন জানতে পারলাম আজিমের হঠাৎ পরিবর্তন হওয়ার কারন কি ছিলো! বাবা তার পূর্বপুরুষের সব ধন-সম্পদ এবং গুপ্তধন তার ছোট ছেলের নামে করে দিয়েছেন। আর করবেনই না কেন? রিয়াদ যে তার সব পূর্বপুরুষের গুন নিয়ে জন্মেছিলো। যেমন ছিলো আগুনের মতো দেখতে ঠিক তেমনই ছিলো তার প্রখর বুদ্ধি। কখনও অন্যায়কে সমর্থন করেনি। সর্বদা সৎ এবং নিষ্ঠাবান ছিলো রিয়াদ। বাবা চোখ বন্ধ করেও তার ছোট ছেলের প্রতি ভরসা করতে পারতেন। বাবা সবসময় চাইতেন তার ছোট ছেলেকে তার সমস্ত ধনসম্পদ সবটা বুঝিয়ে দিতে। কিন্তু রিয়াদ কখনও বাবার এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি। তার কাছে মনে হয়েছিলো এই বিশাল সাম্রাজ্যে তার যেমন অধিকার আছে তার বড় ভাইয়েরও ঠিক একই অধিকার আছে। তাহলে বাবা কেন সবটা তাকেই দিবেন। দিলে তো দুই ভাইকে সমান সমান দেওয়া উচিৎ। বাবা ছেলের এমন মনোভাব দেখে খুশি তো হয়েছিলেন কিন্তু কখনও সেই মোতাবেক কাজ করেননি। বাবা তার বড় ছেলেকে কিছুই দিতে চাননি কিন্তু আমার মুখ চেয়ে বাবা কিছু না দিয়েও থাকতে পারেনি। বাবা আমাদের থাকার জন্য এই বাড়িটা আর একটা কোম্পানি আজিমের নামে লিখে দিয়ে গোপনে বাকি সবটা রিয়াদের নামে করে দিয়ে গেলেন। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরদিনই আজিম পাগল হয়ে গেলো। ধনসম্পদ তার মৃত বাবা তার নামে কতটুকু দিয়ে গেলো সেই চিন্তায় পাগল প্রায়। অবশেষে জানতে পারল এই বাড়ি আর একটা কোম্পানি ছাড়া বাকি সমস্ত টা তার ছোট ভাইয়ের নামে দিয়ে গেছেন। আজিম এসব দেখে পাগল হয়ে গেলো। এর মধ্যে সাবাব আর সানিয়া আমার পেটে আসে। একেই তো তার মাথা খারাপ তারউপর আমার গর্ভবতীর খবরে ও আরও ক্ষেপাটে হয়ে উঠলো। আমার প্রতি ওর অত্যাচার আরও বেড়ে গেলো। কিন্তু একপর্যায়ে গিয়ে ও বুঝতে পারলো আমাকে অত্যাচার করলে ওর কোনো লাভ নেই বরং ক্ষতি আছে। তাই ও পাল্টাতে শুরু করলো। আমার দেখভাল শুরু করলো। এর পেছনের স্বার্থ থাকলেও আমার ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করে। লাগবেই না কেন বলতো? কোন মেয়েই বা না চায় তার স্বামী তাকে ভালোবাসুক। যত্নে রাখুক।
সেদিন আজিমের মুখোশ বেরিয় এলো। সাবাবকে দেখে তার মাথায় আবারও শকুনি পোকারা বাসা বাঁধল। আজিক ছক কষলো। রিয়াদের সমস্ত সম্পত্তির মালিক সে তার ছেলেকে করবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে রিয়াদ যেন কখনও বিয়ে না করে। কিন্তু তার এই স্বপ্নও পূরন হলো না। সাবাব-সানিয়ার দু-বছরের মাথায় রিয়াদ কনিকাকে নিয়ে দেশে ফিরলো। মাস খানিকের মাথায় ওদের বিয়ে হলো। আজিম হাজারটা চেষ্টা করেও এই বিয়ে আঁটকাতে পারেনি। মূলত আমার জন্যই পারেনি। ও যে কয়টা পরিকল্পনা করে ওদের বিয়েতে বাগড়া দিতে গিয়েছে সে কয়বার আমি বুদ্ধি করে ওর পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছি। কনিকা-রিয়াদের বিয়ে হয়ে গেলো। আমার শূন্য বাড়ি আবারও পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। কনিকা হয়ে উঠলো এ-বাড়ির চোখের মনি,আমার চোখের মনি। মেয়েটা এতটা ভালো ছিলো কল্পনার বাইরে। সাবাব-সানিয়া সারাক্ষণ ছোটমা ছোটমা করে পাগল করে ফেলতো। কনিকাও কখনও ক্লান্ত হতো না আমার জমজ বাচ্চা দুটোকে নিয়ে। এর মাঝেও আজিম বহুবার চেষ্টা করে কনিকার ক্ষতি করার। কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে সে ঠিকই ব্যর্থ হতো। এভাবেই দেখতে দেখতে দেড় বছর পেরিয়ে গেলো। একদিন কনিকা-রিয়াদ আমার ঘরে এসে চুপিচুপি জানালো কনিকা মা হতে চলেছে। (হীরের মাথায় হাত বুলিয়ে) তখন তুই গর্ভে এলি কনিকার। রিয়াদ বলল, আপাতত কিছুদিন এই খবর কাউকে না দিতে। কারন কিছু লোক আছে কনিকার ক্ষতি চায়। রিয়াদ জানতো না তার নিজের ভাই সম্পত্তির জন্য তার বউকে মারার ফাঁদ তৈরি করে। তবে তার সন্দেহ হতো। কিন্তু নিজের ভাইয়ের উপর সন্দেহ করার চেয়ে নিজের মৃত্যু বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো রিয়াদ। দেখতে দেখতে কনিকার প্রেগ্ন্যাসির ছয়মাস কেটে গেলো। আজিম একদিন হুট করে ধরে ফেললো কনিকা মা হতে চলেছে। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সে উন্মাদ হয়ে গেলো। সেদিন রাতে নেশা করে বাসায় ফিরলো। তখন রাত ৩টা। বাড়ির সবাই তখন গভীর ঘুমে। আমার চোখে ঘুম নেই। ঐ জানো** যখন জানতে পেরেছে কনিকার গর্ভে তুই আছিস তখন নিশ্চয়ই কোনো পরিকল্পনা করে এসেছে। হয়তো মা-সন্তানকে একবারেই খুন করার পরিকল্পনা থাকতে পারে। আমি বুদ্ধি খাটিয়ে ওদের অন্য একটা রুমে ঘুমোতে বলি। আর ওদের রুমে ঠিক কনিকার মতো কোলবালিশ সাজিয় রাখি। আজিম নেশার ঘোরে বুঝতে পারেনি ওটা কনিকা ছিলো নাকি কোলবালিশ। আজিম ওদের রুমে এসে কোলবালিশ টা কনিকা ভেবে ইচ্ছে মতো কোপাতে থাকে। কোপাতে থাকে আর মুখ থেকে কুরুচিপূর্ণ সব কথা বলতে থাকে। ওর মনে যত রাগ,ক্ষোভ,সম্পত্তির প্রতি লালসা সবটাই নিমিষেই প্রকাশ পেয়ে যায়। আমি পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিলাম। তবে আমি এটা খেয়াল করিনি যে আমার পেছনে কনিকা-রিয়াদ ছিলো। বড় ভাইয়ের এমন আচরনে রিয়াদ খুব ভেঙে পড়ে। তার মনে আতংক সৃষ্টি হয় তার ভালোবাসার মানুষকে হারানোর। আজ নিজের ভাইয়ের যে রূপ দেখেছে তাতে তাকে কোনো হিংস্র পশুর থেকে কম মনে হয়নি। রিয়াদ ভাবতে পারছিলো না আজ যদি ঐ কোলবালিশটার জায়গায় কনিকা থাকতো তাহলে কি হতো! রিয়াদ তেড়ে আসে আজিমের দিকে। তার শার্টের কলার্ট ধরে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। বড় ভাই হিসেবে নয় একজন খুনী হিসেবে। এক পর্যায়ে গিয়ে রিয়াদ তার পিস্তল বের করে আজিমের মাথায় ঠেকায়। আমিও মনেমনে চাচ্ছিলাম এই জালেম যেন আজই মরে। এটাই হবে ওর শাস্তি। কিন্তু কনিকার জন্য সফল হয়নি। কনিকা আজিমের প্রান ভিক্ষা চায় ছোট বোন হিসেবে। তার কোনো বড় ভাই নেই। এই বাড়িতে এসে কনিকা আজিমকে বড় ভাইয়ের মতো পেয়েছে। রিয়াদের কাছে বারবার অনুরোধ করে ভাইজান কে একটা সুযোগ দাও। উনার ভুলগুলো শুধরানোর একটা সুযোগ দাও। কনিকার অনুরোধে রিয়াদের মন গলে। সে তার ভাইকে আরেকটা সুযোগ দিয়ে দ্বিতীয় ভুলটা করে। ভাইকে সুযোগ দিয়ে সে তৎক্ষনাৎ কনিকাকে নিয়ে চলে যায়। দুইমাসের মধ্যে নিজের বাড়ি তৈরী করে রিয়াদ। কনিকাকে নিয়ে সেখানেই থাকে। আরও একমাস পেরোতে তোর জন্ম হলো। তোর মুখটা দেখে মায়ের মুখটা খুব ভাসছিলো চোখের সামনে। মনে হচ্ছিলো বাবা-মায়ের আবার জন্ম হয়েছে তোর আর সাবাবের মাঝে। দিনকাল খুব ভালোই কাটছিলো। হঠাৎ একদিন খবর এলো কারা যেন মানুষ দুটোকে মেরে ফেলেছে। ওদের মৃত্যুর সময় মিলিয়ে দেখলাম ঠিক ঐ সময়ই আজিম বাড়িতে ছিলো না৷ বুঝলাম এই পাপ ও ছাড়া আর কেউ করতে পারেনা। আজিম বাসায় ফিরতেই আমি প্রশ্ন করি ওকে। ও জবাবে হাসতে হাসতে বলল,

—-‘ অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে।’

সেদিন ওর মধ্যে কোনো মানুষের ছাপ দেখিনি। দেখেছিলাম এক ভয়ংকর দানবকে। আমার বুকে ভয় ঢুকে যায়। যে নিজের ভাইকে এভাবে মেরে ফেলতে পারে তার কাছে আমি কিছুই না। হয়তো আজ সম্পত্তির জন্য তার ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখবে কিন্তু কখনও যদি স্বার্থে আঘাত লাগে তবে নিজের ছেলেমেয়েদের ও ছাড়বেনা। আমি ভয়ে সিঁটিয়ে রইলাম। ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে সারাক্ষণ ভয়ে থাকতাম। তার কিছুদিন বাদে তোকে নিয়ে এলাম এ বাড়িতে। তোকে দেখলেই মনে হতো তোর মধ্যে থেকে কনিকা আর রিয়াদ আমার দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করছে। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে আর বলছে,

—-‘ আপা গো! ভাইজান আমাদের বাঁচতে দিলো না আপা! ভাইজান কে শাস্তি দাও আপা। ভাইজান আমাদের বাঁচতে দিলো না।’

কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছি এই ভয়ে ঐ জানো** আমার ছোট্ট হীরপরিকে আবার না আঘাত করে। তোকেও না মেরে ফেলে। তোকে আর মারলো না। একপর্যায়ে দেখলাম ও তোকে খুব আগলে রাখছে। ও তোর জন্য নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করছে। সবকিছু করছে। তখন বুঝলাম এর পিছনেও স্বার্থ আছে। সম্পত্তি পাওয়ার স্বার্থ।’

কথা গুলো শেষ করে দম ফেললেন নাজমা বেগম। হীর নাজমা বেগমের মুখ চেয়ে বলল,

—-‘ আমি যদি তোমার লোভী স্বামীকে মেরে ফেলি তোমার কি খুব কষ্ট হবে বড়মা?’

নাজমা বেগম চমকে গেলেন। হীরের হাতটা খামচে ধরে বললেন,

—-‘ না মা। তুই এই কাজ ভুলেও করতে যাস না। ও কিন্তু একা না মা। ওর সাথে আরও-

—-‘ আরও দু’জন মাস্টারমাইন্ড আছে তাই তো?’

নাজমা বেগম আবারও চমকে উঠলেন। জড়ানো কন্ঠে বললেন,

—-‘ তুই কি করে জানলি?’

হীর হেসে ফেললো। বড়মার দুগালে আলতো করে হাত রেখে বলল,

—-‘ আমি রিয়াদ আহমেদের অংশ বড়মা। তার মতো ধূর্ততা,আর প্রখর বুদ্ধি আমার মাথাতেও আছে। তার মতো তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক নিয়ে ভাবার ক্ষমতা নিয়েই জন্মেছি আমি। গত পাঁচটা বছর ধরে একটু একটু করে সবটা জোগাড় করেছি। একদিন ভুম করে ব্লাস্ট করে দিবো।’

নাজমা বেগম ঢোক গিললেন। চিন্তা সুলভ কন্ঠে বললেন,

—-‘ তবে এতোদিন যে অত্যাচার গুলোর স্বীকার হয়েছিস,সবটা মুখ বুঝে সহ্য করেছিস! সেটা কেন? কিসের জন্য? যখন তুই প্রতিবাদ করতেই জানতিস তবে সবটা মুখ বুঝে সহ্য করার কি মানে ছিলো।’

হীর মলিন হাসলো। ভাবনার জগতে ডুব দিয়ে বলল,

—-‘ সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বড়মা। আমি আমার কোনো দুর্বলতা রাখতে চাইনি সেজন্য। আমি আঘাতের উপর আঘাত পেয়ে নিজেকে তৈরী করছিলাম বড়মা৷ যেন তাদের একশটা আঘাতের সমান হয় আমার একটা আঘাত। এবার সময় হয়েছে তাদের পাল্টা আঘাত করার।’

নাজমা বেগম ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন,

—-‘ সাবধানে করিস মা। বিপদ চারদিকে শকুনের দৃষ্টি নিয়ে মুখিয়ে আছে।’

—-‘ আর সাবধানে,লুকিয়ে,চুরিয়ে নয় বড়মা। এবার যা হবে সরাসরি হবে। পাল্টা আঘাতের জন্য প্রস্তুত হও আজিম আহমেদ,মনিকা,আর-

—-‘ আর-

—-‘ কিছু না। চলো তো এবার। আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। তোমার ছেলেও নিশ্চয়ই উঠে পড়েছে। চলো।খাবো।’

—-‘ কিন্তু তুই-

—-‘ আহ্ চলো না।’

#চলবে_ 💞

[ বিঃদ্রঃ এতদূর কষ্ট করে পড়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেননা। যদি ছোট্ট একটা মন্তব্যে আপনার মতামত জানাতে কষ্ট হয়। ধন্যবাদ। ]

[ বিঃদ্রঃ আপনার অনেকেই আছেন নিরব পাঠক। পড়ে চুপিচুপি চলে যান। কিন্তু আপনারা যদি চুপিচুপি চলে যান তাহলে লেখিকা জানবে কি করে তার প্রিয় পাঠকদের পরিচয়। আপনারা দয়াকরে সাড়া দিন। বেশি বেশি কমেন্ট করে জানান গল্পের ভালো মন্দ। আর পারলে শেয়ার করুন। যেন আরও মানুষ পড়ার সুযোগ পায়। লেখিকার তরফ থেকে অনুরোধ। ধন্যবাদ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here