কাঠগোলাপের সাদার মায়ায় পর্ব ৪

#কাঠগোলাপের সাদার মায়ায়
#পর্ব-৪
টানা কয়েকদিন আমার খাওয়া, ঘুম, পড়াশুনা কিছুই হলো না। জীবনের প্রথম প্রেম এসেছে তাও আবার একা না, বসন্তের সব রঙ নিয়ে এসেছে। ভাবা যায়! কলেজ, পড়াশুনা, আড্ডা, হৈ, হুল্লোড়ের বাইরে আমার সকাল শুরু হবে নিলয় কে ভেবে আবার রাতও শেষ হয় নিলয় কে ভেবে। এটা, ওটা ছুতোয় নিলয়দের বাড়িতে যেতাম এক নজর দেখব বলে। তবে ঝগড়াঝাটি, লেগপুলিং একদম ছেড়ে দিয়েছি। তার বদলে একটু ভালো মেয়ে হবার চেষ্টা করছি। আফটার অল নিলয় ভালো ছেলে বলে কথা। ও হ্যাঁ নিলয় কিন্তু একদম আমার মতো না। বরং পুরোপুরি আমার উল্টো। নিলয় বুয়েট থেকে ট্রিপল ই তে পাশ করেছে। এখন হায়ার স্টাডিজের জন্য দেশের বাইরে যেতে চায়। আর আমি কোনো রকম উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে পাড়ার কলেজে পড়ছি। এই ব্যপার টা দুদিন খুব পীড়া দিয়েছে। তার উপর দেখতে শুনতেও আহামরি না। চোখে কাজল না দিলে চোখটাও ভালো লাগে না। নিলয় কী করে আমার প্রেমে পড়বে! যতবার এটা ভেবেছি ততবারই আমার চোখ ফেটে জল আসতে চাইছে। তারপর নিজেকে সান্ত্বনা দিতে বললাম, থাক প্রত্যাশা কী হয়েছে তোর ভালো রেজাল্ট নেই, পড়াশুনা নেই, অনেকের ই তো থাকে না। আর তাছাড়া দেখতে বা খারাপ কই! এই যে হাসলে গালে সুন্দর একটা টোল পড়ে! তাছাড়া ঠোঁটের তিল টা’ও তো মারাত্মক রকম সুন্দর। তাছাড়া তুই কী ভুলে গেছিস যে কলেজে পড়ার সময় কতো ছেলেরা পাগল ছিলো!

এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে আবারও নিলয় কে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

একদিন বিকেলে এক বাটি পায়েশ নিয়ে হাজির হলাম নিলয়দের বাসায়। দরজা খুলল নিলয় নিজেই। দরজাটা খুলে ধড়াম করে বন্ধ করে দিলো। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশী সময় লাগে নি, দ্বিতীয়বার দরজা খুলতে। দরজা খুলে নিলয় বলল,

“আম্মু বাড়িতে নেই। ”

আমি অতি কষ্টে হাসি চাপিয়ে রাখলাম। নিলয়ের প্রথমবার দরজা বন্ধ করার কারণ হলো ও একটা হাতকাটা গেঞ্জি পরেছিল। তাই দরজা বন্ধ করে অতি দ্রুত হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরে আবারও দরজা খুলেছে। আমি স্মিত হেসে বললাম,

“মা পায়েশ পাঠিয়েছে তো তাই এলাম”

আচ্ছা বলে ভিতরে ঢুকতে জায়গা করে দিলো। আমি ভিতরে ঢুকে বাটিটা টেবিলের উপর রাখলাম। দেখলাম নিলয় এখনো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ আমাকে বসতে না বলে, বিদেয় করবে। আর আমিও একটা চূড়ান্ত গাধা শ্রেণীর মানুষ। কী দরকার ছিলো বলার যে, মা পাঠিয়েছে তাই এসেছি। এটা বলেই তো ফ্যাসাদে পড়েছি।

আমাকে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিলয় বলল,

“তুমি কী কিছু বলবে?”

“কী বলব?”

“না মানে মা তো নেই। যদি আম্মু’কে কিছু বলতে চাও আমাকে বলে যেতে পারো। আমি আম্মুকে বলে দেব। ”

“না। আমি তো আন্টির কাছে আসিনি। আমাকে মা পাঠিয়েছে তাই এসেছি। ”

আবারও সেই একই ভুল করলাম। এরপর তো আর এখানে কোনো বাহানায় থাকাও যাবে না।

“আচ্ছা আন্টিকে থ্যাংকস বলে দিও”।

কথাগুলো যেন একটু জোর করে বলছিল। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমাকে তাড়ানোর জন্য একদম দাঁড়িয়ে আছে।

আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

“তুমি কী এবার যাবে?”

আমার ফুরফুরে মেজাজ টা মুহুর্তেই খারাপ হয়ে গেল। শয়তান টা আমাকে সরাসরি চলে যেতে বলছে! এতো অভদ্রতা! কী লজ্জার ব্যাপার!

“কেন আমি থাকলে বুঝি অসুবিধা? ”

“হ্যাঁ। ”

কতোবড় শয়তান! আবার বলে কী না হ্যাঁ।

আমি কোমড়ে হাত দিয়ে ওর দিকে ভালোভাবে চেয়ে বললাম, কী অসুবিধে শুনি?

“তোমার মতো ডেঞ্জারাস মেয়ে আশেপাশে থাকা মানেই তো অসুবিধে। ”

এই কথাটা একদম স্বাভাবিক গলায় বলল। অথচ আমি কতো আয়োজন করে ওর জন্য পায়েশ রেঁধে নিয়ে এসেছি। দুপুরে ভাত পর্যন্ত খাই নি। মা’কে বলেছি ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না একটু পায়েশ রাঁধি। আর এই ছেলে আমাকে ইনিয়েবিনিয়ে বিদেয় হতে বলছে! একেই বলে, যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর।

আমি রাগী গলায় বললাম, আপনি চূড়ান্ত রকম অভদ্র একটা লোক। দেখতে যত সুন্দর, ব্যবহার তত পঁচা। একটা মানুষ এতো কষ্ট করে পায়েশ রেঁধে নিয়ে এসেছে আর আপনি তাকে বিদেয় করে দিচ্ছেন? একটুও ম্যানারস নেই!

“কিন্তু তুমি যে বললে আন্টি পায়েশ টা পাঠিয়েছে।”

আমার থোতা মুখ ভোতা হয়ে গেছে। আমতা আমতা করে বললাম,

“মা পাঠিয়েছে তাতে কী? রান্না তো আমি করেছি। ”

নিলয় ঠোঁট টিপে মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আন্টি আর আম্মু তো একসাথে বেরিয়েছিল, আন্টি ফিরে এসেছে।

ইশ! মা যে আন্টির সাথে বেরিয়েছে সেটা তো জানা ছিলো না। ভালোরকম কেস খেয়ে গেলাম। আমি রাগ দেখিয়ে বললাম,

“আপনার কী মনে হয় আপনি হিরোর মতো দেখতে যে আমি আপনার সাথে গল্প করার জন্য বাহানা খুঁজে এসেছি।”

“না আমার সেটা মনে হয় না। কিন্তু তুমি ই তো এইমাত্র বললে যে আমি দেখতে অনেক সুন্দর। দ্যাট মিনস আমার লুক হিরোর মতো। ”

“আপনি একটা অসভ্য, অভদ্র লোক। আর মোটেও দেখতে সুন্দর না। সেদিন আপনার সাথে সেদিন এক রিকশায় বসে লজ্জায় আমার কতটা মাথা কাটা গেছে। আমার সব বান্ধবীরা ছিঃ ছিঃ করেছে যে কেন আমি আপনার সঙ্গে রিকশা চড়েছি। আর জানেন কতো ছেলেরা আমার জন্য পাগল। আমাদের ক্লাসের তুষার তো হাত কেটে আমার নামের অক্ষর ও লিখেছে।”

“হ্যাঁ জেনে নিলাম। ভালো করে নোট করে রাখব। যদি পরীক্ষায় এসে যায় তখন ফটাফট লিখে দশ নম্বর পেয়ে যাব। থ্যাংক ইউ সো মাচ প্রত্যাশা।”

এই অপমানের পর ওখানে থাকার আর মানেই হয় না। আমি চলে এলাম। ঘর থেকে বেরোতেই বলল,
আঙ্কেল, আন্টির জন্য খুব খারাপ লাগে। একমাত্র মেয়ে তাদের অথচ মাথার স্ক্রু ডিলে।

“আপনার খবর আছে। আপনার মা, বাবাকে এইসব বলব। তাদের ভালো ছেলের গুনকীর্তন সব বলব। ”

“আমার গুনকীর্তন আম্মু, আব্বুকে সবাই ই বলে। তুমি বললে তাতে তারা মাইন্ড করবে না সম্ভবত। ”

কথা শেষ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাগে আমার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। কী বাজে ব্যবহার করলো আমার সাথে! অথচ আমি ভেবেছিলাম আলাভোলা টাইপের ছেলে। এ তো দেখছি শয়তানেরও বাপ। নেহাৎ প্রেমে পড়ে গেছি বলে ছাড় দিলাম। নাহলে দেখিয়ে দিতাম হাউ মেনি পেডি, হাউ মেনি রাইস।

*****
পুরো একদিন নিলয়ের সাথে দেখা হলো না। এদিকে আমি ভিতরে ভিতরে ছটফট করছি এক নজর দেখার জন্য, কিন্তু কি অজুহাতে যাব। তাছাড়া যে অপমান করছে তারপর গেলে ব্যাপার টা নিজের জন্যেও লজ্জাকর। তাই কারনে অকারনে নিচে যাবার জন্য ওদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছি। চারবার ছাদেও গেছি। ফোন নাম্বারও নেই যে একটা ফোন করবো। এই টা একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। ফোন নাম্বার টা নেয়া উচিত ছিলো। ফেসবুকে নিলয় লিখে সার্চ দিলাম। শত শত নিলয় এলো অথচ শয়তান টা’কে পেলাম না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম যে দোকানে গেলে একটু দেখতে পাব কিন্তু সেটাও হলো না। শেষমেস না পেরে লজ্জা, শরম গুলে খেয়ে ওর বাসায় গেলাম পায়েশের বাটি ফেরত আনার অজুহাতে।

আন্টি সবসময়ের মতো গল্প জুড়ে দিলো। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম নিলয় পায়েশ খেয়েছে কি না। আন্টি বলল, খায় নি।

এবার আমার সত্যি সত্যি খারাপ লাগতে শুরু করলো।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here