কাঠপুতুল পর্ব ৩

#কাঠপুতুল
#লেখনীতে-তানভীন শিলা
#পর্ব-৩
আমি দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে চলে আসলাম। এবাড়িতে কি হচ্ছে কিছুই বোধগম্য নয় আমার। পরশের ডিভোর্সের আগেই বিয়ে ঠিক করা হয়ে গেছে? কিন্তু কেন? পরশ কি সত্যিই আমায় ভালোবাসে না? পরশের সাথে কথা বলতে হবে আমার। মাথাটা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে মাথাটা কেঁটে ফ্রিজে কিছুক্ষণের জন্য রেখে যদি ঠান্ডা করা যেতো খুব স্বস্তি পেতাম। পরীর সাথে কথা বলতে হবে। আমি দ্রুত পায়ে পরীর নিকট যাওয়ার জন্য বের হতেই কাকিমা কপাট রাগ দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন-
“তোকে কি এই ৪বছরে কিছুই শিখাতে পারলামরে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ কেমন কামচোর মেয়ে এইটা দেখ দেখ বাড়িতে একজন এসেছে কোথায় তাকে নাস্তা দিবে নাহ্ সে তো ঘুরে বেড়াইতে ব্যস্ত। নাস্তা পরে আনিস আগে আমার রুমে আয়।”(আমিও বাধ্য মেয়ের মতো তার পিছু নিলাম)
রুমে ঢুকতেই কাকিমা আমার হাত টেনে নিয়ে দড়জা লাগিয়ে সামনে দাড়ালেন। তার এহেন কান্ডে আমার জান পাখি উড়াল দেয় দেয় অবস্থা না জানি আবার কি করেন। আমার ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করে দিয়ে খুব জোরে বলা যায় তার শরীরে যতটুকু শক্তি ছিলো সম্পর্ণটাই আমার উপরে খরচ করলেন। আমি গালে হাত দিয়ে ভাবলেশহীন হয়ে তার দিয়ে চেয়ে আছি এতে মনে হচ্ছে সে আরোও রেগে গেলেন।কিছু একটা খুঁজতেছেন হয়তো কোনোকারণে রেগে আছেন। শুধুমাত্র মিফতি আপুকে নাস্তা দেইনি বলে এমনটা করছেন বলে মনে হচ্ছেনা। তার সেই নতুন এনে রাখা বেঁত দিয়ে কতো সুন্দর করে করে মারছেন আমায় আর আমি? কেন জানি মনে হচ্ছে আমি এটার-ই অপেক্ষায় ছিলাম। আমাকে ১৫মিনিট পিটানোর পরে কাকিমা কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন আর আমি হতোবাক!!! কাকিমা কান্না করছেন? কিন্তু কেন?
“কাকিমা কি হয়েছে গো তোমার? এভাবে কেন কাঁদছো?”
“তুই কেন দুনিয়াতে এলি মৃদু? না আসলে হতো না? তোর জন্য আমার কলিজার টুকরা বোনটা আজ আমার পাশে নেই।”আবারো কান্নার বেগ বেড়ে গেলো।
“আমি? আমি ওনার বোনের মৃত্যুর জন্য দায়ী? কিন্তু কীভাবে? এজন্যই কি কাকিমা আমায় পছন্দ করেন না?।–মনে মনে বলল মৃদু।
“দূর হ চোখের সামনে থেকে”
আমিও চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। নাস্তা সব তৈরিই ছিলো কাকিমাই সবাইকে নাস্তা পরিবেশন করেছেন।
“কাকিমা কেন বললেন আমি তার বোনের মৃত্যর জন্য দায়ী?”
আমি কিভাবে দায়ী সেটা জানতে চাই। তাই ছোটবেলার সবকিছু মনে করতে লাগলাম। যদি কিছু মনে পরে যায় তাহলে হয়তো জানতে পারবো।
.
আমরা ভাইবোনেরা সবাই প্রায় একই বয়সী। সুমেন ভাই আমার ৫বছরের বড় আর পরশের ২বছরের। আমি আর পরী ক্লাস সিক্স-এ পরি। পরশ নিউ-টেন আর সুমেন ভাই ইন্টারমিডিয়েট ২য় বর্ষের ছাত্র।
বাড়িতে আমি আমার বাবা-মা আর বড় আম্মুর সাথে থাকি। একদিন ক্লাস থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে বড় আম্মুর কাছে খাবার চাইলে সে আমাকে খুব জোরে গালে চড় মারে। চড়টা হজম করতে না পেরে কান্না করতে করতে ফ্লোরে গড়াগড়ি করতে শুরু করে দিয়েছি। আম্মু দৌড়ে বেড়িয়ে এসে আমায় উঠিয়ে চুপ করতে বললেন আর প্রশ্ন ছুড়লেন-
“কি হয়েছে আমার মৃদুর কেন কান্না করছে পাখিটা আমার?”
“বড় আম্মু মেরেছে আম্মু”
আম্মু বড় আম্মুকে প্রশ্ন করলেন কেন সে আমায় এভাবে মারলেন? আমার গালে ৩টা আঙ্গুলের দাগ রিতিমতো ফুলে উঠেছে।
“এই মৃদুলা, এই মৃদুলার জন্য হইছে। উফ্ কেন যে ওকে দুনিয়াতে আনার জন্য আমি আমার জীবনটা শেষ করলাম। ইয়া মাবুদ তখন আমাকে আটকাউনি কেন?”
“এইসব কি বলছেন আপা? মৃদুকে তো আপনি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন তবে আজ কেন এভাবে বলছেন? আপনারই তো মেয়ে।”
“নিজের মেয়ের মতো কিন্তু নিজের মেয়েতো না। ও আমার মেয়ে কখনো হতেও পারবেনা। আমার মেয়ে থাকলে এমন হতোনা”
পিছন থেকে আব্বু সবশুনে বড় আম্মুর সামনে এসে তাকে খুব জোরে ‘ঠাসসসসসস’ একটা চড় মারলেন আর বললেন-
“এজন্যই তোর কোন মেয়ে নাই। আরেহ্ মেয়েই কেনো তোর তো কোন সন্তানই নেই।”
.
রাতে আমাকে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দেয় আম্মু। ভোরে চিল্লাচিল্লির আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। টলতে টলতে রুমের বাহিরে বের হয়ে দেখি উঠোনে মসজিদে যে রাখে ছোট খাটের মতো ওটাতে কেউকে সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। অনেকে মুখ দেখে যাচ্ছেন কিন্তু আমি যেই পজিশনে আছি সেখান থেকে দেখা যাচ্ছেনা। কিছুটা দূরে আম্মুকে কান্না করতে দেখে দৌড়ে তার কাছে চলে যাই। আশেপাশের পরিবেশ আর আগরবাতির গন্ধে খুব খারাপ লাগতেছে আমার। আগরবাতির গন্ধ ভালো লাগেনা আমার। আমি কোনোমতে আম্মুকে প্রশ্ন করলাম-
“আম্মু!! ওখানে কে ওটা?(লাশটাকে দেখিয়ে) এভাবে কেন কান্না করতেছো?”
আম্মু আমায় পেঁচিয়ে ধরে কান্না করেই চলছেন। এতে আমার অস্বস্তি আরো বেড়ে যায়। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আব্বুর কাছে যাই। আব্বুর চোখমুখ কেমন ফুলে আছে। কে ওটা যার কারণে আব্বুও এভাবে কান্না করছেন?
“আব্বু কি হয়েছে তোমার? এভাবে কেনো কান্না করছো তুমি?”
“আম্মু তোমার বড় আম্মু আর নেই।”
“নেই মানে কোথায় গেছে বড় আম্মু? কখন আসবে?”
“আর আসবে না তোমার বড় আম্মু”
“কোথায় গেছে সেটা তো বলো।”
“আকাশের তারা হয়ে গেছে”
আব্বুর কথা শুনে আমি আকাশের দিকে তাকালাম। কই আকাশে তো তারা নেই। মেঘ দিকে ঢাকা আছে আকাশ। তাই আব্বুকে আবারো প্রশ্ন করলাম-
“কই আব্বু আকাশে তো তারা নেই গো দেখো। কোথায় বড় আম্মু? আমার বড় আম্মুকে চাই” (আমিও কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম)
.
.
আজ ২মাস হয়ে গেছে বড় আম্মুর চলে যাওয়ার কিন্তু তার যাওয়ার কারণ আমি এখনো জানতে পারলাম না। ওদিকে পরশ ভাইয়ার পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই আমাদের। পরীকে খুব মনে পরতেছে। আমার ভাবনার মাঝেই পরীকে নিয়ে উপস্থিত হয় পরশ ভাই। পরীকে আমার রুমে যেতে বলে পরশ ভাই আমাকে নিয়ে বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়। বাড়ির পিছন হলেও মানুষের আনাগোনার কোন কমতি নেই। আমাদের বাড়ির পিছন হলেও অনেকে এই রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফিরে। পরশ ভাই আমার হাত ধরেই আছে আমি কিছুই বুঝতেছিনা। হুট করে পরশ ভাই আমাকে টান দিয়ে নিজের অনেক কাছে নিয়ে যান। আমি কিছু বলতে যাবো অমনি আমায় আচমকাই জড়িয়ে নিলেন নিজের বাহুডোরে। আমার কিশোরী মনের ভালোবাসা উনি তাই আমিও বাঁধা দেইনি। এই বাঁধা না দেওয়াটা যে আমার কাল হয়ে দাড়াবে সেটা তো আমার জানা ছিলোনা।
.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here