কোনো_এক_বসন্তে পর্ব ৪

#কোনো_এক_বসন্তে
#Khadija_Akter
#পর্ব_০৪

সবার প্রতি প্রচুর অভিমান জমতে জমতে শেষমেষ অনেক চিন্তাভাবনা করে পরিকল্পনামাফিক একটা একটা কান্ড ঘটিয়ে বসলাম।
আর তাতে সফলতাও পেলাম।ক্যান্সেল হয়ে গেল আহিল রোবটের সাথে আমার বিয়ে!

————————
আজ আমার মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।যেদিকে তাকাই,যা দেখি সবই ভালো লাগে।বিশেষ করে আহিল ভাইকে চোখের সামনে দেখতে হচ্ছে না।আহ্ শান্তি!অবশেষে আমি পেরেছি।

অনেক চেষ্টা করেও যখন কাউকে মানাতে পারছিলাম না।কেউ আমার কথার পাত্তাই দিচ্ছিল না,তখন অনেক ভেবে ভেবে গতকাল একটা প্ল্যান তৈরি করি।
যদিও একটু হেরফের হয়ে গিয়েছিল,আরেকটু হলে সত্যি সত্যিই জীবনটা চলে যাচ্ছিল!
ঘটনাটা ভাবলেই এখনো কেমন জানি শরীরটা শিউরে উঠে।

আমার প্ল্যান ছিল,আমার কথার সিরিয়াসনেস সবাইকে বুঝানোর জন্যই আমি সুইসাইডের অভিনয় করবো।আর তা দেখে সবাই তখন আমাকে গুরুত্ব দিবে।আমার কথা মেনে নিবে।
মেয়ের জীবনের চেয়ে নিশ্চয়ই বিয়েটা বড় না,আমার আব্বু-আম্মুর কাছে!

পরিকল্পনামাফিক সন্ধ্যার পরপরই সবাই যখন ড্রয়িংরুমে আড্ডা দেওয়ার জন্য জড়ো হলো,আমি তখন চুপি চুপি সেখান থেকে সটকে পড়লাম সাথে আয়রাকে নিয়ে।

আয়রাকে আমার রুমে এনে চকোলেট দিলাম।কিছুক্ষণ ওর সাথে বউপুতুল খেললাম।আয়রাকে কিছুক্ষণ বেশ আদর করে তারপর বললাম,

–আয়রা,তুমি এখন যাও।আপু একটা কাজ করবো।কিন্তু তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।

–কি কাজ ভাব্বী?

–শুনো,এখন থেকে ঠিক ২/৩ মিনিট পর তুমি আমার আম্মুকে গিয়ে বলবে, “তনয়া আপ্পি তোমাকে ডাকে।”
ঠিক আছে পাখি সোনা?

আয়রা মুখ বাঁকিয়ে বললো,

–না,না ঠিক নাই। তুমি তো আপ্পি না,তুমি তো ভাব্বী।

আমি মনে মনে হাসলাম,ভাবী ডাকতে হলে ডেকে নাও আজই।আমার প্ল্যান সাকসেসফুল হয়ে গেলেই আর এই সুযোগ পাবে না।মুখে বললাম,

–ওরে আমার ছোট্ট ননদটা রে,আচ্ছা ঠিক আছে ভাব্বীই।একটু পর কিন্তু তোমার রাহেলা আন্টিকে গিয়ে বলবা,আমি ডেকেছি।ওকে?

–অক্কে ভাব্বী।

আয়রা চলে যেতেই আমি দরজাটা আধখোলা রেখে তাড়াতাড়ি কাজে লেগে গেলাম।
ওয়ারড্রব থেকে আমার লম্বা জর্জেট ওড়নাটা বের করে হাতে নিয়ে নিলাম।
আগে থেকে রেখে দেওয়া বারান্দা থেকে লম্বা টুলটা নিয়ে খাটের উপর রেখে সেটাতে দাঁড়িয়ে গেলাম।
আনাড়ি হাতে যতটা পারলাম দ্রুত ফ্যানের সাথে ওড়নাটা পেঁচিয়ে একটা ফাঁস তৈরি করলাম।

তারপর দরজার দিকে কান পেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
“যখনি বুঝতে পারবো আম্মু এদিকটায় আসছে,তখনি আমি ফাঁসটা গলায় পড়তে যাব।আর ঠিক এই সময়েই আম্মু আমাকে এই অবস্থায় থেকে নিবেন।তারপর তো……. কেল্লাফতে!”
ঠিক এরকমটাই ছিল আমার পরিকল্পনা।

সবকিছুই ঠিকঠাক হচ্ছিল প্ল্যানমাফিক,কিন্তু শেষটায় এসে ভয়ংকর রকম একটা গন্ডোগোল পাকিয়ে ফেললা।।

দরজার বাহিরে যেই না কারো পায়ের আওয়াজ পেলাম অমনি তড়িঘড়ি করে ফাঁসটা নিজের গলায় পড়ে নিলাম।এদিকে অতিরিক্ত উত্তেজনার কারনে আমার পা কাঁপতে কাঁপতে টুলটা একসময় কাঁত হয়ে পড়ে গেল।আর আমি সত্যি সত্যি ঝুলে পড়লাম!

হাতে ল্যাপটপ নিয়ে সেদিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখতে দেখতে আহিল ভাই ধীর পায়ে আমার রুমে প্রবেশ করেন,

–তনু দেখতো এই আংটিটা কেমন?বিয়ের রাতে তোকে গিফট করতে চাচ্ছিলাম।

সাড়া না পেয়ে এবার আহিল ভাই ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে বিছানার দিকে তাকায়।সাথে সাথেই উনার হাত থেকে ল্যাপটপটা নিচে পড়ে যায়!

————————–
কাল রাতেই আব্বু সবার সামনে ঘোষণা করে দিলেন যে,
“আহিলের সাথে তনয়ার বিয়ে ক্যান্সেল।আমার মেয়ে যেহেতু চায় না এই বিয়েটা করতে, তাই আমরা ওকে জোর করতে পারি না।
ছোটবেলায় একবার ওর বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সেটা মুখে মুখেই, কাগজে কলমে কোনো দলিল নাই।তাই প্রয়োজনে আহিল মৌখিক ভাবেই তনয়াকে তালাক দিয়ে দিবে। তাহলেই ঝামেলা মিটে যাবে।তবে এই তালাকের ব্যাপারটা আমরা তিন্নির বিয়ের পরে দেখবো।আপাততঃ কোনো ঝামেলা করতে চাইছি না।
আমার মেয়েকে বিয়ের ব্যাপারে আর কেউ যেনো ফোর্স না করে এটাই আমার শেষ কথা।”

আব্বু যখন কথাগুলো বলছিলেন,পরিবারের সকলেই তখন আমার রুমে আমাকে ঘিরে উপস্থিত ছিলেন।সবার মধ্যেই পিনপতন নীরবতা।কেউ আর আব্বুর কথার উপরে কথা বললেন না,এমনকি দাদুও না।
আব্বুর কথা শেষ হতেই খেয়াল করলাম,ঘরের এককোণে বিষন্নভানে দাঁড়িয়ে থাকা আহিল ভাই আস্তে করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

এদিকে আমার মনে তখন লাড্ডু ফুটছিল।যাক কাজ তাহলে হয়েছে!

আমি যে ডেকেছি সে কথা আয়রা আম্মুকে গিয়ে বলেছিল ঠিকই কিন্তু আম্মু গল্পে বেশ জমে থাকায় আয়রার কথায় তত একটা গুরুত্ব দেয়নি।
এদিকে আহিল ভাইয়ের পায়ের আওয়াজেই আমি ফাঁস পরে নিয়েছিলাম!ভাগ্যিস আহিল ভাই ঠিক সময়ে এসেছিলেন।নাহয় যে আমার কি হতো।আমার রুমে না এসে তো উনি অন্য রুমের দিকে চলে যেতেও পারতেন।
হয়তো আমার হায়াত ছিল বলেই এই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম।
তবে মনে মনে সিদ্ধান্তও নিয়ে নিয়েছি,এরপর আর কখনো এমন রিস্কি প্ল্যান করবো না।

———————

কালকের ঘটনার পর থেকে সবাই আমাকে এখন বেশ তুলোতুলো করে পালছে!চোখে চোখে রাখছেন,বহাল তবিয়তে আছি এখন আমি।

আসলে পরিকল্পনাটা ফেইকভাবে করতে চাইলেও,কপালের ফেরে সেটা আসল হয়ে গিয়েছিল।তাই কারো মনেই আর সন্দেহ রইলো না যে,আমি সত্যি সত্যি আহিল ভাইকে চাই না।
তবে সবাইকে এভাবে বোকা বানাতে চাইনি আমি মোটেও।তারা যদি আগেই আমার কথা মেনে নিত,আমি মোটেও এরকম জঘন্য একটা পরিকল্পনা করতাম না।
কাল একেকজনের এক্সপ্রেশন দেখে বুঝতে পেরেছিলাম,সবাই কতটা আমায় ভালোবাসে।

আম্মু তো খুব কান্নাকাটি করলেন অনেক রাত পর্যন্ত আমার কাছে বসে।আব্বু জোর করে অবশেষে ঘুমাতে নিয়ে গেলেন আম্মুমে।
আম্মুর শরীর এখনো সুস্থ হয়নি পুরোপুরি,পুরো উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন উনি আমার এই কান্ডে।
একমিনিটও আমাকে চোখের আড়াল হতে দিতে চাইছে না এখন।

কাল সারারাত সোহেলী খালামনি আমার সাথে ছিলেন।বিয়েটা ভেঙে যাওয়ায় উনার মনটা বেশ খারাপ থাকলেও।আমাকে একটুও অবহেলা বা খারাপ ব্যাবহার করেননি আমার সাথে।
উল্টো মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বুঝিয়েছেন,

“তোর আহিলকে পছন্দ না সেটা তো তুই অনেকবার আমাদের বলছিস রে মা।আমরাই তোর কথায় গুরুত্ব দেইনি।সবাই ভাবছিলাম,হয়তো তুই মনে মনে আহিলকে পছন্দ করিস কিন্তু লজ্জা পেয়ে মুখে বিয়ের জন্য ‘না,না’ করছিস।

আমরা নাহয় তোকে বুঝতে ভুলই করছিলাম,তাই বলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিবি তুই?আমাদের সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করলি?আমরা কি তোর কেউ না?এতো অল্পতেই মরে যেতে হয় না রে মা।
আর কখনো এমন কাজ করবি না সাবধান।তুই যা চাস তাই হবে।”

—————————-
কালকের এই দূর্ঘটনার পর আজ খুব সকাল সকাল উঠেই আহিল ভাইয়া চলে গেছেন উনার বাসায়।

উনার নাকি ইম্পোর্ট্যান্ট কাজ আছে,তাই ঠান্ডা মাথায় নিরিবিলি করতে চান,যা এই বাসায় সম্ভব না।

কিন্তু সামনে তিন্নি আপুর বিয়ে,এই মুহূর্তে আহিল ভাইয়াকে এই বাসা ছেড়ে যেতে দিতে চাইলেন না কেউই।

আহিল ভাইয়া সবাইকে কথা দিলেন,বিয়ের ঠিক ২দিন আগেই তিনি আবার চলে আসবেন।
তারপর বিয়ের সকল ফাংশন শেষ করে তবেই তিনি যাবেন।

মাঝখানের এই কয়েকটা দিন নিজের মতো করে একা উনি উনার বাসায় গিয়ে কাজ করতে চান।উনার মা আর বোন তো এই বাড়িতেই আছে সমস্যা নেই।
সবাকে বুঝানোর পরেও যখন কেউ আহিল ভাইয়াকে যেতে দিতে রাজী হচ্ছিল না,তখন আব্বুই সবাইকে ম্যানেজ করে আহিল ভাইকে যেতে দিলেন।

আমার আব্বুর কোম্পানিতে এতোদিন একজন ঘুমন্ত অংশীদার হিসেবেই ছিলেন আহিল ভাইয়া।উনার বাবার শেয়ারগুলো উত্তারাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন উনি।
এই দেশে না থাকার কারণে কোম্পানির কোনো কাজ উনি করতেন না।শুধু মূলধন থেকে মাসে মাসে লভ্যাংশ নিতেন।

কিন্তু আজকাল এই কোম্পানিতে কাজের চাপ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায়,আবার এদিকে আহিল ভাইয়ার মতো একজন ব্রিলিয়ান্ট ব্যবসায়ী নিজের বিজনেস ফেলে শুধু শুধু অবসর বসে আছে এই দেশে,এটা দেখে আব্বুই আহিল ভাইয়াকে অফার করেছিলেন যতদিন দেশে আছে কোম্পানি পরিচালনায় অংশ নিতে।

সেটারই ধারাবাহিকতায় দেশে আসার কিছুদিন পর থেকেই আহিল ভাইয়া সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।

উনি অফিসে যাচ্ছেন খুব কম,ঘরে বসেই কোম্পানির অনলাইন কার্যক্রমের সমস্তটা দেখছেন।
আব্বু নিজেও অনেক কাজের চাপে আছেন।
নিজের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে যে একসপ্তাহ আগে ছুটি নিবেন সেই জো নেই তার।
আহিল ভাইয়ার উপর কাজের চাপটা বুঝতে পেরেই,তিনি আহিল ভাইকে নিজের মতো করে উমার বাসায় গিয়ে কাজ করার অনুমতি দেন।

—————————
বিকালে ফুরফুরে মন নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্যস্ত শহরটাকে দেখছিলাম।রাস্তা দিয়ে একটা,দুইটা গাড়ি শা শা করে চলে যাচ্ছে।অন্যদিনের তুলনায় শহরটা আজ একটু মরামরা লাগছে।

আয়রা যে কখন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি।পিছনে ফিরতেই দেখি মন খারাপ করে আয়রা অন্যদিকে চেয়ে আছে।
আমি ওকে আমার দিকে ফিরালাম।গাল দুটো একটু টেনে দিয়ে বললাম,

–কি ব্যাপার আয়রা মনির মন খারাপ কেন?

আয়রা কন্ঠ থেকে যেনো কান্না ঝরে ঝরে পড়লো!কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,

–আমি ভাইয়াকে খুব মিস করছি আপ্পি।ভাইয়া আমার কল ধরছে না।ভাইয়া চলে গেল কেন তনয়া আপ্পি?তুমি কি ভাইয়াকে বিয়ে করবে না আর?

জানো,ভাইয়া যাওয়ার আগে আমাকে বলে গিয়েছে তোমাকে যেনো আর ভাবী না ডাকি।
তুমি কি আমার ভাবী হবে না বলো না আপ্পি?ভাইয়াকে বিয়ে করবে না তুমি?আমার ভাইয়া তো অন্নেক ভালো।আমার মতো তোমাকেও খুব আদর করবে।করবে না বিয়ে আপ্পি?

আমার সাড়া না পেয়ে আয়রা বারবার আমার হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলো উত্তরের আশায়।
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।আয়রার ছোট্ট মনে আঘাত করে কথা বলার মতো কোনো ইচ্ছাও নেই।ওকে কাছে টেনে এনে বললাম,

–মন খারাপ করে না আপ্পি।আমি তোমার ভাবী হবো না তো কি হইছে;দেখবা আমার চেয়েও খুব ভালো একটা ভাবী আসবে তোমার ।
ভাইয়ার জন্য খুব বেশি মন খারাপ লাগছে তোমার আয়রা?কথা বলতে চাও ভাইয়ার সাথে?

–হুম চাই তো।কিন্তু ভাইয়া তো আমার কল পিক করে না তনয়া আপ্পি।

–আচ্ছা,আসো আমরা দুজন মিলে ট্রাই করি।

আয়রাকে সাথে নিয়ে রুমে এসে আহিল ভাইয়ার নাম্বারটায় ডায়াল করলাম।কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গেল,ফোন ধরলো না।
বারবার ট্রাই করেও যখন ব্যর্থ হলাম তখন আয়রা বুঝে গেল তনয়া আপ্পিও তাকে তার ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবে না।সে হতাশ হয়ে মন খারাপ চলে গেল।

আমি আবারও বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে বাহিরে এখন।

দূর দিগন্তে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে গেল কাল গভীর রাতের কথা….

“আব্বু বিয়ে ক্যান্সেল ঘোষণা করার সাথে সাথেই যে আহিল ভাই বেরিয়ে গেছিল রুম থেকে তারপর আরেকবার এসেছিল আমার রুমে,তখন গভীর রাত।

আমি আর খালা মনি তখন জেগেই ছিলাম।দরজা নক করতেই খালামনি উঠে দরজা খুলে দিয়েছিল।আহিলকে দেখেই দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে আহিল ভাইকে রুমে ঢুকতে দেন তিনি।তারপর খালামনি কিছু না বলেই কিছু সময়ের জন্য ড্রয়িং রুমের দিকে চলে যায়।

খালামনি চোখের আড়াল হয়ে যেতেই,আহিল ভাইয়া রুমের দরজাটা বন্ধ করে দেয়।বেশ শান্ত দেখাচ্ছিল উনাকে।

আমার বিছানার পাশে এসে পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল আমার দিকে অনেকক্ষণ। তারপর খুব ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

–এখন কেমন লাগছে?

–ঠিক আছি।

–এই পাগলামীটা কেন করতে গেলি!

–আমার কিছু করার ছিল না আর।কেউ আমার কথা শুনতেই চাচ্ছিল না।আপনি নিজেও তো জোর করেই বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন আমায়।আমি আর কি করতে পারতাম বলেন?আপনিই বলেন আপনি কি এমন একটা মানুষের সাথে সারাটা জীবন কাটাতে চাইবেন,যাকে আপনার ভালোই লাগে না?

–আমাকে তোর সত্যিই পছন্দ না?

–না।

–তোর ভাষায় আমি রোবট, তাই?

–………….

–আর যদি আমি তোর মতো করে, তোর চাওয়ার মতো করে রোমান্টিক হয়ে যাই?তোর যা যা পছন্দ, তা তাই করি তবুও বিয়েটা করবি না?

–না,না,না।তবুও না…..।আপনাকে আমার ভালোই লাগে না একদম,কেনো বুঝতে চাইছেন না আহিল ভাইয়া?

আমার স্ট্রেইট কথা শুনে আহিল ভাইকে কিছুটা বিচলিত দেখালো।এভাবে করে উনার মুখের উপর হয়তো এর আগে কেউ কখনো “না” বলেনি।

তিনি দাঁড়িয়ে না থেকে এবারে পায়চারী করতে শুরু করে দিলেন সারাঘরময়।
একটু পর আবার স্থির হয়ে দাঁড়েলেন।পকেট থেকে বাম হাতট বের করে,কপালটা হালকা করে টিপতে লাগলেন চোখটা বন্ধ করে।

আমি উনার প্রতিটা কান্ডকারখানা খেয়াল করছিলাম খুব মনোযোগ দিয়ে।মনে মনে খুব খুশি হচ্ছিলাম,অবশেষে আমি তার মাথা ব্যাথার কারণ হতে পেরেছি।
এতোদিন আমার কথায় কোনো পাত্তা দাওনি,নিজেকেই নিজের রাজ্যের রাজা ভেবেছিলে মিঃআহিল,এবার বুঝো।

এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর হঠাৎ করেই চোখটা খুলে আহিল ভাই আমার পাশে বিছানায় বসে পড়লেন।আমি কিছুটা ভয় পেয়ে একটু সরে গেলাম।
উনি আমার একটা হাত টেনে নিয়ে বেশ অনুনয় করে৷ বললেন,

–আর একবার ভেবে দেখ তনু।তুই যেভাবে বলবি…

আমি টান দিয়ে উনার হাত থেকে আমার হাতটা সরিয়ে নিয়ে আসলাম।এবার আমার সত্যিই বিরক্ত লাগছিল।বেশ কড়া কন্ঠে বললাম,

–আহিল ভাই,আপনার যদি আর একবারও আমার উপর ফোর্স করার চেষ্টা করেন তাহলে কিন্তু আমি আবারও এই কাজটা করবো।
একবার বেঁচে গেছি,বলে বারবার যে বেঁচে যাব তা নয়।এছাড়া….

–অকে অকে,অকে তনু!রিলাক্স,জাস্ট রিলাক্স।
কেউ তোমায় কোনো ফোর্স করছে না, আর করবেও না।এটা আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।
কিন্তু সাবধান!এরকমটা তুমি আর কখনো করবে না…কখখনো না।

বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় আহিল ভাই।বেশ অস্থির দেখায়,আহিল ভাইকে।সাথেই সাথেই গেলেন না উনি রুম থেলে।
একদৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন চুপচাপ।দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা উনি চেপে ধরে রেখেছেন সবেগে।ডীম লাইটের আলোয় আমার একবার যেনো মনে হলো আহিল ভাইয়ার চোখদুটো ছলছল করছে।

পরবর্তীতে আমি ভালো করে দেখার জন্য আবার তাকাতেই দেখি আহিল ভাই ইতিমধ্যে হাঁটা শুরু করেছেন দরজার দিকে।

আহিল ভাই চলে যেতেই খালামনি রুমে ঢুকে।আহিল ভাই কি বলেছে বা আমাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে কিছুই জিজ্ঞেস করেননি খালামনি আমাকে।এসে চুপচাপ আমার পাশে শুয়ে পড়েছিলেন।”

আচ্ছা আহিল ভাই কি আমাকে ভালোবাসে নাকি!নাকি জাস্ট ছোট বেলায় বিয়ে হয়েছিল বলেই,এখন দায়ে পড়ে বিয়েটা টিকিয়ে রাখার জন্য আমাকে ফোর্স করছেন।এরকমটাই যদি হয়,তবে বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় এতোটা বিষন্ন কেনো দেখাবে উনাকে।
তবে কি উনি আমাকে ভালোবাসেন!

ধুর কি ভাবছি এসব!ভালোবাসার জন্য যতটা অনুভূতি থাকার কথা তার অর্ধেকও আহিল ভাইয়ের মাঝে আছে কিনা সন্দেহ।আর যদি আমার প্রতি উনার এমন কোনো ফিলিংসই থাকতো,তাহলে কি আগে কখনোই আমি বুঝতাম না!
উনি তো আমার দিকে একবারও ভালো করে চেয়ে দেখেছে কিনা আজ পর্যন্ত তাতেও সন্দেহ!….

–কি রে,অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছিস কেন এখানে!রুমেও আলো দিসনি যে?

সাইকার কথায় আমি যেনো বাস্তবে ফিরে এলাম।ভালো করে চেয়ে দেখলাম চারদিকে সন্ধ্যা নেমে গেছে।আমি বেশ হকচকিয়ে গেলাম,এতো সময় কখন পার হয়ে গেল!তবে চারপাশে অন্ধকার থাকায় আমার হতভম্ব বা উদাসীন রুপটা সাইকার চোখে পড়েনি বলে কিছুটা স্বস্তি পেলাম মনে মনে।

–তনয়া জানিস আজকে ছোট ফুপুরা আসতেছে আমাদের বাসায়।একটু আগেই ফোন করেছিল।আজ রাতের ট্রেনেই এসে নামবে।
উফফ তিন্নি আপুর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তাহলে এতোদিন হিংসুটে রাইসা আপুকে সহ্য করতে হবে আমাদের!
এখন আবার তাদের জন্য রুমও গুছাতে হবে আমার,বড় ফুপুর অর্ডার।প্লিজ চল না আমার সাথে,একা একা পারবো না এতো কাজ করতে।

রাইসা আপু,আমার ছোট ফুফুর একমাত্র মেয়ে।আমার আর সাইকার ১ বছরের সিনিয়র উনি,অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।ছোট ফুফুরা চাঁদপুর শহরে থাকেন।সেখান থেকেই আজ আমাদের বাসায় আসছে তিন্নি আপুর বিয়ে উপলক্ষ্যে।

রাইসা আপুকে আমারও একদম অসহ্য লাগে।সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে প্যানপ্যান করতেই থাকে।আমাদের সব কাজিনদের থেকে রাইসা আপু সবচেয়ে আলাদা।এ বাসায় বেড়াতে আসলে আমাদের সাথে ভালো করে মিশেও না।বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান বলে,উনার ভাবের কোনো শেষ নাই।

যাইহোক,সাইকার সাথে গিয়ে উনাদের জন্য রুম রেডি করতে হবে জলদি।
এসে রুমে আবার একটু ধুলাবালি পেলেই প্যানপ্যান শুরু করে দিবে মহারানী রাইসা।

–আচ্ছা চল,দুজন মিলে যতটা পারি গুছিয়ে দেই।

কথাটা বলে আমি পা বাড়াতেই সাইকা আমাকে পিছন থেকে টেনে ধরে।ভারাক্রান্ত গলায় বলে,

–তনয়া,আমি স্যরি রে।

–কেন!

–আহিল ভাইকে নিয়ে তোর সাথে সেদিন যে মজা করলাম তাই।আমি না সত্যিই বুঝতে পারিনি আহিল ভাইকে তুই মন থেকেই অপছন্দ করিস।

আমরা কেউই তোকে বুঝিনি,আর তাই তুই অভিমান করে….।
তুই চলে গেলে আমার কি হতো রে,আমি কার সাথে আমার সব কথা শেয়ার করতাম।মরে যাওয়া কি সব সমস্যার সমাধান হলো!

বলতে বলতে আমাকে জড়িয়ে ধরে সাইকা ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললো। সে এতোক্ষণে তনয়াকে একটু একা পেয়েছে।একা পেতেই নিজের আবেগ আর সংবরণ করতে পারলো না।এই বাড়িতে তার সমবয়সী আর কেউ নেই তনয়া ছাড়া।আর সেই তনয়াও কিনা সবার উপর রাগ করে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল!সাইকা আরও জোরে জোরে কেঁদে উঠে।

সাইকা একটু বোকা বোকা আর একগেয়ে টাইপের হলেও ওর মনটা খুব নরম এটা আগেই জানতাম।আমিও জড়িয়ে ধরলাম ওকে।
ওর কান্না দেখে আমারও চোখে পানি চলে আসলো।এই বাড়ির সবাই যে আমায় এতো এতো ভালোবাসে তা হয়তো কখনোই এভাবে জানা হতো না যদি সত্যিই মরে যেতাম।

ফুপা-ফুপি আর রাইসা আপুর জন্য দোতলায় একদম কোনার দুইটা রুম রেডি করতে হবে।রাত ১২টার আগেই উনারা চলে আসতে পারে। তাই দ্রুত হাতে রুম না গুছালে সময়মতো রেডি করতে পারবো না।

আমি আর সাইকা উত্তর পাশের কোনের ঘরদুটোর কাছে যেতেই দেখি রুম অলরেডি অর্ধেক গুছানো শেষ!চাচী, তিন্নি আপু,রনি ভাইয়া,শুভ,সাইকার বোন সাইফা,রনি ভাইয়ার ছোট দুই ভাই রাহি,রাফি সবাই মিলে ভাগাভাগি করে দুইরুম গুছাচ্ছে।
সাইকা আর আমাকে আসতে দেখেই চাচী সাইকাকে একটা কাজে লাগিয়ে দিল।কিন্তু আমাকে কেউ কোনো কাজ করতে বললো না।
আমি নিজে থেকেই বিছানার চাদরটা হাতে নিয়ে বিছাতে যাব,তখনই তিন্নি আপু এসে বাঁধা দিলেন।

–তনয়া,তুই রেস্ট কর গিয়ে যা।আমরা করছি তো..এই তো একটুপর হয়ে যাবে গুছানো।তুই যা বোন…

‌পরিবারের সকলের এই ব্যবহারটা এখন আর নতুন লাগছে না আমার কাছে!কালকে রাতের পর থেকেই সবাই আমাকে খুব আদর করছে,কোনো কাজে হাত লাগাতে দিচ্ছে না।

যাক বাবা এই উছিলায় কাজ থেকে একটু রেহাই পেলাম।যাই পড়তে বসি,কয়েকদিন পর এমনিতেও অনেক মিস যাবে পড়ালেখায়।

‌ড্রয়িং রুমে দেখলাম আব্বু,চাচ্চু আর দাদাভাই, তিন বাপ-বেটা মিলে চা খাচ্ছে আর খোশ মেজাজে গল্প করছে।একটু দূরেই দাদু আয়রার সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে দুষ্টুমি করছে।একটু পরপর আয়রা খিলখিল করে হেসে উঠছে,আয়রা সাথে দাদুর খুব জমে ভালো।
‌আমাকে ওখান দিয়ে যেতে দেখে,দাদাভাই ডাকলেন চা খাওয়ার জন্য।

‌–না,দাদাভাই।এখন পড়তে বসবো তো।

রুমে ‌আসার আগে রান্নাঘরেও একটু উঁকি মারলাম।

আম্মু,সোহেলী খালামনি আর বড় ফুপি মিলে রাতের রান্নার আয়োজন করছেন।ছোট ফুপির কি একটা কথা নিয়ে তারা তিনজনে হেসে একদম লুটোপুটি খাচ্ছেন।
“ছোট ফুপি,ছোট ফুপা আর রাইসা” তাদের তিনজনের ফ্যামিলিটাই একটা হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মাঝেমাঝে আমাদের কাছে।
‌আমাকে দেখে বড় ফুপি ডাক দিলেন,

‌–কি রে তনয়া?ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?আয় এদেকি আয়।কিছু খাবি,ক্ষুধা লাগছে?

‌– না ফুপি।একবারে ভাত খাব একটু পরে।এখন পড়তে বসবো।

‌বড় ফুপি আমাদের বাড়িতেই থাকেন অনেক বছর ধরে।উনার স্বামীটা ভালো পড়ে নাই,ফুপিকে কথায় কথায় মারধোর করতেন,খারাপ ব্যবহার করতেন।
অনেক সহ্য করার পর ফুপি যখন আর নিতে পারেননি এই অত্যাচার তখন দাদাভাইয়ের কাছে এসে সব বলে দেন।

নিজের আদরের মেয়ের সাথে স্বামীর বাড়িতে এহেন অত্যাচার হয় শুনে, দাদাভাই আর সময় নষ্ট না করে কিছুদিনের মধ্যেই ফুপিকে ডিভোর্স করিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন।সেই থেকে তিনি তার তিন ছেলেকে নিয়ে এখানেই আছেন।

বড় ফুপির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো,কথায় কথায় হাসবেন আবার একটু কিছু হলেই কান্না করে ভাসিয়ে দিবেন সব।

বড় ফুপিকে আড়ালে আমরা ছিচকাঁদুনি ফুপি বলেই ডাকি।
উনার এই নিকনেইম একদিন কোনোভাবে উনি শুনে ফেলেছিলেন……আর সে কি কান্না..বাবাহ্ রে বাবা।

আমাদের বাসার প্রত্যেকটি মানুষেরই আলাদা আলাদা কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে,যা নিয়ে আমরা একজন অন্যজনকে ক্ষ্যাপাই সুযোগ পেলেই।

দাদা ভাইয়ের এই বিশাল বাড়িটা আজ অনেক ভরা ভরা লাগছে। সবাই বাড়িতেই আছে আজ,শুধু আহিল ভাই ছাড়া!

——————————
অনেক রাতে আয়রা হঠাৎ করেই বায়না ধরলো সে তার ভাইয়ার কাছে যাবে।
আয়রার বায়না শুনে খালামনি আহিল ভাইকে ফোন দিয়ে এই বাসায় আসতেও বলেছিল।আহিল ভাই নাকি আসতে পারবে না এখন।
তার প্রজেক্টের কাজ শেষ করে একবারে দুইদিন পরে এখানে চলে আসবে বলে আয়রাকে ফোনে শান্তনা দিয়ে দিল।

আয়রা তখনকার মতো মেনে গেলেও,আহিল ফোন রাখতেই আবার সে একই জেদ করতে লাগলো!
খালামনি শেষে বিরক্ত হয়ে দুই ঘা বসিয়ে দিলেন আয়রার পিঠে।
আয়রার সে কি কান্না..!সবাই খালামনিকে বকতে লাগলো আয়রাকে কেন মারলো!

আসলে আয়রা আর আহিল ভাই দুজন, দুজনার চোখের মনি।আর এতোটা সময় আহিলকে দেখতে না পেয়ে আয়রা বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিল।বিশেষ করে রাতের বেলায় আয়রা একদম অস্থির হয়ে যায় ভাইয়াকে না দেখতে পেলে।

আমি আয়রাকে আমার রুমে নিয়ে আসলাম।অনেকভাবে আদর করে ওকে শান্ত করতে চেষ্টা করলাম।কিন্তু ও কিছুতেই থামছে না।

তারপর আহিল ভাইকে ফোনে ট্রাই করলাম।তিনিও ফোন ধরছেন না।

শেষমেষ আয়রাকে এই বলে শান্ত করলাম যে, “কাল যে করেই হোক সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা আহিলের কাছে যাব দেখা করতে।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here