গোধূলি বেলায় তুমি পর্ব -১৯

#গল্প_গোধূলি_বেলায়_তুমি
#Writer_Ritu_Bonna
#পর্ব_১৯
.
.
আভিয়ান কোন কথা না বলে একটি রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। আদ্রিজা দেখেই চিনতে পারে এটা তো সেই রুম যেটাতে সব সময় তালা দেওয়া থাকে। কিন্তু আভিয়ান আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে? কি করতে চাইছে সে? তার ভাবনার মাঝেই আভিয়ান তালা খোলে রুমের ভিতরে প্রবেশ করে। আদ্রিজাও তার পিছনে পিছনে রুমের ভিতরে ঢুকে চমকে যায়,,,,,,,,,,

রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। অন্ধকারের জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আভিয়ান গিয়ে লাইট অন করে। লাইট অন করতেই আমি থমকে যাই। আগে ভেবেছিলাম রুমটা হয়তো কোন স্টোর রুম। আগের সব পুরোনো জিনিস রাখা। কিন্তু আমার ধারণা পুরোই ভুল। ঘরটা একদম পরিপাটি করে গুছানো। চারপাশের দেওয়ালে পিংক কালারের রং করা। পুরো রুমের দেওয়ালে একটি মেয়ের ছবিতে ভরা। মেয়েটির চেহারা ভারি মিষ্টি। যে কেউ দেখলেই হয়তো তার মায়ায় পরে যাবে। আমি অবাক হয়ে প্রতিটি ছবি দেখে যাচ্ছি। অন্য পাশে ফিরে দেখি আভিয়ানের সাথে মেয়েটির অনেক গুলো ছবি। আমি চমকে আভিয়ানের দিকে তাকালাম কিন্তু কিছু বললাম না। আভিয়ানের মা ছোট সময় মারা যান। বিয়ে আগে আভিয়ানের বাবাকে দেখেছি। একটি ছবিতে তাদের তিন জনকে একসাথে দেখতে পাই। তবে কি মেয়েটি আভিয়ানের বোন। কিন্তু আভিয়ানের সাথে পরিচয় হওয়ার সময় ও তো কখনো বলে নি ওর কোন বোন আছে। তবে মেয়েটি কে?আমি জিজ্ঞেসা সূচক দৃষ্টিতে আভিয়ানের দিকে তাকালাম,,,,,

আভিয়ানের দিকে তাকাতেই আমার ভেতরটা ছ্যাঁট করে উঠলো। সে মেয়েটির ছবি বুকের মাঝে নিয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। তার চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। আমি ধীরে ধীরে তার সামনে গিয়ে বসি। আমাকে নিজের সামনে বসতে দেখে সে এক নজর আমার দিকে তাকায় পরে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। আমি তার এমন আচরণে অনেকটা অবাক হয়ে যাই। তাকে দেখে অনেকটা বিষন্ন লাগছে। দেখেই মনে হচ্ছে খুব কষ্ট পাচ্ছে, তাই আমিও আর কিছু বলি না। কিছুক্ষন পরে ওনী নিজেই আমাকে ছেড়ে দেন। এক হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। তার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল যা আমার ভেতরটা এলোমেলো করে দেয়।

আভিয়ান করুন স্বরে বলতে শুরু করে,,,, জানো বন্যা পৃথিবীতে চারটা মানুষকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। তাদের ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনা করেতে পারতাম না। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখো সেই চারজন মানুষের মাঝে তিন জন আজ আমার পাশে নেই।তাদের আমি আর কখনো দেখতে পারবো না। আর একজন আমার পাশে থেকেও আজ আমার পাশে নেই। বলতে পারবে বন্যা সব সময় আমার সাথেই কেন এমনটা হয়। কেন আমিই বারবার আমার কাছের মানুষ গুলোকে হারিয়ে ফেলি?যাদেকে আমি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই ভাগ্য কেন তাদেরকে আমার থেকে ছিনিয়ে নেয়? আমার কি ইচ্ছে করে না অন্য সবার মতো একটু ভালোবাসা পেতে! আমার কি ভালো থাকার অধিকার নেই বলো???

আভিয়ানের কথা গুলো শুনে আদ্রিজা কি বলবে তা বুঝতে পারছে না। সে অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,,,,

আভিয়ান কিছুক্ষন ছবির দিকে তাকিয়ে আবার বলা শুরু করে,,,, জানো বন্যা আমার বয়স যখন ১০ বছর তখন মা মারা যান। মার ক্যান্সার ছিল এবং আমরা যখন তা জানতে পারি তখন তা লাস্ট স্টেজে ছিল। মাকে সুস্থ করতে বাবা অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু পারেন নি। মা যখন মারা যান আমার বোনের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। মা মারা যাওয়ার আগে তার দ্বায়িক্ত আমার কাছে দিয়ে যান। মা মারা যাওয়ার সময় আমার হাতে বোনের হাত দিয়ে বলেন,,, আমি জানি আমি আর বাঁচবো না। আমাকে ক্ষমা করে দিস্। আজ থেকে তোর বাবার আর এই ছোট বোনটার দ্বায়িত্ব তোর। তাদের তুই কখনো কষ্ট পেতে দিবি না। জানিস্ মানুষটা বড্ড ভালোবাসে আমাকে। আমি জানি আমার কিছু হয়ে গেলে ওনী কখনো নিজের খেয়াল রাখবেন না। তুই সবার খেয়াল রাখবি। তোর বোনটা তোর কাছে আমানত। তাকে কখনো কষ্ট পেতে দিবি না। নিজের সবটুকু দিয়ে তাকে আগলে রাখবি। কথা দে কখনো তার কোন ক্ষতি হতে দিবি না। আমি তখন মায়ের এক হাত ধরে কান্না করছি৷ বাবাও কান্না করতে করতে বলে,,,, তোমার কিছু হবে না আছমা। তুমি চিন্তা কোন চিন্তা করো না। দরকার হলে দেশের বাহিরে নিয়ে গিয়ে তোমার চিকিৎসা করাবো। তুমি আর কখনো এইসব কথা বলবে না। তুমি জানো তোমার মুখে এইসব কথা শুনে আমার কতটা কষ্ট হয়। মা তখন মুচকি হেসে বলে,,, আজ আমাকে বলতে দাও।জানি না পরে কখনো বলতে পারবো কিনা,,,,, তুমি কথা দাও আমার মৃত্যুর পরে কখনো ভেঙে পরবে না। নিজের আর ছেলে- মেয়ের খেয়াল রাখবে। আমাকে মনে করে কখনো কষ্ট পাবে না। পারলে আবার বিয়ে করে নিবে,,,,,

মার শেষ কথাটা শুনে বাবার চোখ লাল হয়ে যায়,,, তিনি মার হাত ছেড়ে অন্য দিকে ঘুরে তাকান। মা বাবার হাত ধরে বলে,,, কি হলো আমাকে কথা দাও।
বাবা মার হাত ধরে বলে,,, একবার বলেছো আবার বিয়ে করার কথা আরেক বার যদি বলো তবে সত্যিই আমি নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলবো। তোমার মৃত্যুর আগেই আমি নিজে মরে যাবো, তবুও তোমার যায়গা কখনো অন্য কাউকে দিতে পারবো না।

মা শান্ত স্বরে বললেন আচ্ছা আমার যায়গা অন্য কাউকে দিতে হবে না। তুমি কথা দাও আমার মৃত্যুর পরে কখনো ভেঙে পরবে না। নিজের আর ছেলে- মেয়ের খেয়াল রাখবে। আমাকে মনে করে কখনো কষ্ট পাবে না।

বাবা চুপ করে থাকে,,,,

মা অশ্রু সিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,, কি হলো আমাকে কথা দিবে না। বাবা মায়ের হাত ধরে বলে,,,, আমি কথা দিলাম। মার মুখে প্রশান্তির হাসি ফোঁটে উঠে।পরে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,,,, কি হলো তুই তোর মায়ের কথা রাখবি না। আমি তখন ছোট ছিলাম কিন্তু পরিস্থিতির কাছে আমার নিজেকে অনেক বড় বলে মনে হয়েছে। মার হাত ছোঁয়ে কথা দিলাম,,, নিজের সবটুকু দিয়ে আমি বোনকে আগলে রাখবো৷ বোন তখন অনেক ছোট এইসবের কিছুই বুঝে না। সে আমাকে আর বাবাকে কান্না করতে দেখে একবার আমার মুখের দিকে তাকায় আরেকবার বাবার মুখের দিকে তাকায়,,,, পরে মাকে জিজ্ঞেস করে,,,, মা মুচকি হেসে তার মুখে, কপালে অজস্র চুমো খেলো। পরে বলবো,,, আজ থেকে বেশি দুষ্টমি করবে না। বাবা আর ভাইয়ের সব কথা শুনবে,,, ঠিক আছে।

বোন কি বুঝলো জানি না কিন্তু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো৷

এর এক সাপ্তাহ পরে মা মারা যায়। বাবা মার মৃত্যুতে অনেক ভেঙে পরেন। বোন তো কান্না করতে করতে চোখ- মুখ ফুলিয়ে ফেলে। সবাই খাওয়া – দাওয়া একদম ছেড়ে দেয়। বোনকে খাওয়ানো যাচ্ছিল না কোন ভাবেই। তার এক কথা,,, তার মা চাই তো চাই৷ মাকে ছাড়া সে কিছুতেই খাবে না। কিন্তু মাকে কি করে এনে দিতাম বলো। যে একবার না ফেরার দেশে চলে যায় তাকে কি কখনো ফেরানো যায়। কিন্তু এই কঠিন কথাটা বোনকে কি করে বুঝাতাম বলো?সেদিন আমার নিজেকে বড় বলে মনে হয়। মা আমাকে যেই দ্বায়িত্ব দিয়েছে তা আমাকে রাখতেই হবে। বোনকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে খাইয়ে দেই। বাবা আর নিজের বোনকে আগলে রাখতে গিয়ে, তাদের খেয়াল রাখতে গিয়ে আমি নিজের কথাই ভুলে গেছিলাম। যেখানে অন্য ছেলে- মেয়েরা খেলাধুলা, মজা করে সময় কাটায়। সেখানে সবার দ্বায়িত্ব নিতে গিয়ে আমি নিজের ছেলেবেলাই হারিয়ে ফেলি। মাঝে মাঝে আল্লাহর কাছে কান্না করে বলতাম,,,, তুমি আমার সাথে এমনটা কেন করেছো? কেন আমার থেকে আমার মাকে কেড়ে নিয়েছো?আমার বোন কি দোষ করেছিল যে এত কম বয়সে তাকে মা ছাড়া করলে? আমি কি করে সব কিছু সামলাবো,,,,,,

এইটুকু বলতেই আভিয়ানের চোখ দিয়ে আবারও পানি পরতে শুরু করে। পুরোনো কষ্ট আবারও বুকের ভিতরটা বিষিয়ে দিচ্ছে। সব কিছু তার কাছে বিষাদময় লাগছে। আদ্রিজার চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে ভাবতেই পারেনি যে মানুষটার হাসি মুখের পিছনে এতটা কষ্ট জমিয়ে রেখেছিল।প্রিয় মানুষটির কষ্টে তারও কষ্ট হচ্ছে,,,,,,,

…..
..
.
চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here