চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা পর্ব ৬

#চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা-৬
ইউটিউবে রেসিপির ভিডিও দেখে, সসের পুরোনো বোতল ধুয়ে তাতে ব্যাটার ভরে আড়াই প্যাঁচের জিলিপি বানানো শিখলাম, গুঁড়োদুধ আর ডিম মেখে একদিন কালোজাম মিষ্টি আর একদিন রসমালাই বানালাম, চিনি গলিয়ে লাল লাল ক্যারামেল বানিয়ে পুডিং ভাপে দিলাম, আটা দিয়ে পাতিল এঁটে কাচ্চি রাঁধলাম – কিন্তু মিতাভাইর মনের রাস্তার খোঁজ পেলাম না। এতো এতো যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে রান্না করি আমি, সে একচামচ মুখে দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। তার এঁটো করা খাবার আমি প্রসাদ শ্রদ্ধায় খেয়ে ফেলি। তার খাওয়া গ্লাসে পরম প্রেমে ঠোঁট ছোঁয়াই।

বড়চাচি বলে স্বামির এঁটো খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে। কই মিতাভাইর ভালোবাসা তো তৈরিই হলো না? আমি দিবস-রজনি শুধু চাতকের মতো তাকিয়ে থাকি- অপ্রেমের খরায় তপ্ত মাঠঘাট, চৌচির হৃদয় ভিজিয়ে একদিন তুমুল বর্ষা নামবে। আমার পিপাসা মিটবে সেই বৃষ্টির নোনাজলে। কিন্তু কিছুই হলো না, উলটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক ইউনিটের এডমিশন টেস্ট ফেল করলাম। আমার মনে গেলো গেলো রব উঠল। এতোটা কাঁদলাম যে বড়চাচি পর্যন্ত স্বান্তনা দিতে এলো। এবার হয়নি, পরেরবার হবে, অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে – কত কত আশার বাণী! তাদেরকে কিভাবে বোঝাই, চান্স পাওয়া বড় ব্যাপার না, আমিতো শুধু মিতাভাইর কাছাকাছিই থাকতে চেয়েছিলাম! অন্য কোথাও পরীক্ষা দেওয়াটা তো অসম্ভব। এই আশায়ই তো পড়ি আমি। দুটো এ প্লাস নিয়েও মেডিকেল বা বুয়েট ভর্তিযুদ্ধে নামিনি। ক ইউনিটে চান্স পাব, গণিত নিয়ে পড়ব, মিতাভাই লেকচার দেবে, আমি হাঁ করে তাকে গিলব, এইতো আমার পড়াশোনার একমাত্র লক্ষ্য, এইম ইন মাই লাইফ! তবুও সবার জোরাজোরি বেড়ে গেলো, এতো ভালো রেজাল্ট আমার!

কি ছাতা হবে ওই রেজাল্ট দিয়ে যদি মিতাভাইর প্রশংসা না পেলাম?

ঘ ইউনিটে পরীক্ষা দিলাম। কি মনে করে জানিনা ঘ ইউনিটের ফর্ম ফিলআপ করেছিলাম। মন খারাপ নিয়েই পরীক্ষা দিলাম। নিজেকে শান্ত করলাম এই ভেবে যে হাজার হোক এক ক্যাম্পাসেই থাকব। নামাজের পাটিতে বসলাম আর হাত তুলে মোনাজাত করতে থাকলাম এটা যেন হয়। কোনো কোনোদিন মিতাভাই তার গাড়িতে করে আমাকে ভার্সিটি পৌঁছে দেবে। কোনো কোনোদিন কেন, প্রতিদিন নিয়ে যাবে আমাকে। আবার ক্লাস শেষে নিয়ে আসবে আমাকে। আমি নাহয় একটু অপেক্ষাই করে থাকব। লাইব্রেরিতে থাকব, টিএসসির সবুজ ঘাসে বসে অপেক্ষা করে থাকব! অপেক্ষাতে কোনো কষ্ট নেই আমার। একসাথেই বাড়ি ফিরব। কোনোদিন রাস্তার মাঝে গাড়ি থামিয়ে ফুচকা খাবো, আষাঢ়ে কদম ফুল খোঁপায় গুঁজে দেবো, ভিষণ বর্ষায় রাস্তায় পানি জমলে হাঁটুপর্যন্ত শাড়ি গুটিয়ে সেই পানিতে লাফাব। ওহ হ্যাঁ, প্রতিদিন শাড়ি পরব আমি। জামদানি, সিল্ক, তাঁতের সুতিশাড়ি, জুমশাড়ি, একরঙা থানশাড়ি – কত কত শাড়ি কিনব। নীল রঙের অনেকগুলো শাড়ি থাকবে আমার, সব শেডের। কোনোটা আকাশের মতো, কোনোটা ময়ূরকণ্ঠী – সবুজাভ নীল, নেভি ব্লু পরব, ফিরোজা থাকবে! হালকা থেকে গাঢ় সবরকম নীল – একটাতে তো আমায় দেখে মিতাভাই বলবে, ‘এই রঙটা তো তোকে খুব মানিয়েছে, ছুটি!’ আমি সেই রঙে কাবার্ড ভরে ফেলব!

বিড়ালের ভাগ্যে শিঁকে ছিড়ল তবে। ইকোনোমিকস এ চান্স পেলাম। বেশ ভালো সাবজেক্ট, সবাই খুশি হলো। বুবু যেদিন জগন্নাথে চান্স পেয়েছিল বাবা ওকে নতুন গাড়ি কিনে দিয়েছিল। আমাকে বলল আমারও চাই কিনা নতুন গাড়ি। আমি আঁতকে উঠলাম, আমার গাড়ি থাকলে আমি মিতাভাইর সাথে কিভাবে যাব? সিগন্যালে গাড়ি থামলে আমড়া আর ললি আইসক্রিম কিভাবে খাবো?

মা আবার কাঁদুনির ঝুড়ি নিয়ে বসলেন ‘পিউ’র বিয়ে ঠিক হয়েছে। দেখগে জামাই বিরাট ব্যবসায়ী! গার্মেন্টস আছে, ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবসা আছে। ঢাকায় তিনটে বাড়ি, দুটো ফ্ল্যাট আছে। কানাডায়ও বাড়ি আছে।’

আমি ঠোঁট উল্টালাম। আমার জামাইও কম নাকি? প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে যাকে যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। ওসব টাকার কুমিরেরাও তাকে স্যার বলে ডাকে!

বাবাও আজকে শুরু করল ‘টানাটানি করে সম্পর্ক হয়না ছুটি। অনেক তো চেষ্টা করলি। পৃথিবীতে তুই দিয়েই সব সম্পর্ক। নিজেকেই ভালোবাসতে হয় অন্য কারো চাইতে বেশি। সবার চাইতে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট তুই, তোর নিজের কাছে সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি তুই। একবার দেখ নিজেকে কী করে ফেলেচিস তুই, তোকে তো আমরা আর চিনিই না। তোর নিজস্ব কিছু আছে কি? মিতার পছন্দের ছাঁচে নিজেকে ফেলে দিয়েছিস। তোর কোনো অস্তিত্বইতো নেই। এভাবে নিজেকে হারাস না। ফিরে আয়। আমাদের কাছে ফিরতে বলছি না, তোর নিজের কাছেই ফিরে আয়।’

বাবা কেঁদে ফেলে। মাও কাঁদে। বুবুও কাঁদে। আমি বুঝিনা এরা কেন কাঁদে? আমিতো মিতাভাইর ভালোবাসা চাইনি, তাকে ভালোবাসতে চেয়েছি শুধু। বাবার কথায় বুঝলাম, নিজেকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমি শুধু মিতাভাইকে ভালোবাসব কেন, তাকেও আমায় ভালোবাসতে হবে। আমায় সম্মান দিতে হবে, ভালোবাসা দিতে হবে, কাছে টানতে হবে। যা যা আমার প্রাপ্য সব দিতে হবে আমাকে।

*****

মিতাভাই আমাকে কিছু বলে না। কিন্তু আমি জানি, সেদিন হাসপাতালে আমার চালাকিটা সে ধরে ফেলেছে। চুপ করে থেকে সে আমাকে আরও বেশি অপরাধী বানিয়ে ফেলেছে। তার নিরব অভিযোগ আমার সহ্য হয় না। সে তাকায়না আমার দিকে কিন্তু সেই নিচু হয়ে থাকা চোখের দৃষ্টি আমি পড়তে পারি। যেন একরাশ ভর্ৎসনা করছে আমায় ‘ছুটি, এটা করা কি খুব প্রয়োজন ছিলো? কেন করলি এমন?’

চুপ করে না থেকে যদি মিতাভাই জানতে চাইত তো আমি খুব করে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারতাম। বলতাম ‘মিতাভাই, ভালোবাসিতো আপনাকে! আর ভালোবাসলে সব করা যায়… কোনো দোষ হয়না তাতে!’
কিন্তু মিতাভাইতো কিছুই বলেনা আর আমারও কিছুই বলা হয়না।

ইউনিভার্সিটিতে পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়ে গেলো। প্রতিদিন নিয়ম করে ক্যাম্পাসে যাই আবার নিয়ম করে সময়মতো ফিরে আসি। মিতাভাই এমন চোখমুখ কঠিন করে রাখে, ভুঁরু কুঁচকে রাখে যে লিফট দেওয়ার কথা বলতে সাহস পাইনা আমি। মাঝে মাঝে বড়চাচা গাড়ি দেয়, মাঝে মাঝে বুবুর সাথে আসি। মিজাভাইও পৌঁছে দেয় প্রায়ই। মাঝেমাঝে নিয়েও যায়।মিজাভাই ঢাকা মেডিকেলের ইন্টার্ন ডাক্তার। ওর সাথে আসতে-যেতে আমার ভালো লাগে না। ফাইজলামি করে সারাক্ষণ। আর এতো বেশি কথা বলেরে বাবা! মিতাভাইর ভাগের সব কথা ও বলে দেয়। আমি বলি ‘মিজাভাই, মানুষের ভাগে কথার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। সব যদি এখনই বলে ফেলবেন, তো পরে কী করবেন? আয়ু কমে যাচ্ছে তো!’

‘কমবে না! তোর কাছ থেকে বুদ্ধি নিয়ে আজরাইলকে কাত করে দেব। তোর মাথায় যে কিলবিলে বুদ্ধি, বাবারে বাবা!’

মিজাভাই ব্যাঙ্গ করে আমাকে বড়ভাবি বলে ডাকে। আমার কান্না পেয়ে যায়। এতোটাই কি বিদ্রুপের ভাগীদার আমি?
আমার আর সহ্যই হয়না।

মিজাভাইর সাথে আমি আর কথাই বলব না। ওর সাথে জেদ করে ক্লাস শেষে ফেরার পথে উল্টোরাস্তা ধরলাম, বাড়ি ফেরার বদলে। শাহবাগ মোড় থেকে উত্তরার বাসে চেপে ফার্মগেট নেমে গেলাম। মাথার উপরে বিকেলের রোদ চোখে লাগছে। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মাথার উপর খুলে দিলাম। বাতাস এসে লাগছে, আমি ছাতা ঘুরাতে ঘুরাতে হাঁটছি। মাথার ভেতর মা নেই, বাবা নেই, বড়চাচি নেই, মিজাভাই নেই, মিতাভাইও নেই! আনমনে একটু বেখেয়ালে হাঁটছি। বিকেলের দিকে সবাই একটু অলস হয়ে যায়। একটু পরেই রাস্তার দুপাশে সিজনাল ভাসমান দোকানের ব্যস্ততা বেড়ে যাবে, প্রাইভেট, পাবলিক পরিবহনগুলোর স্পিড বেড়ে যাবে অফিসে থেকে বাড়ির দিকে ফেরা মানুষগুলোকে ঠিকানায় পৌঁছে দিতে। আমার জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই। একটা ঘর আছে আমার, বড়চাচা বলে। কিন্তু সেই ঘরের মানুষ আমাকে চায় না, আমাকে বোঝে না! না বুঝুক, তার তো আমাকে বোঝার কথা নয়, তারতো ভালোবাসার কথা নয় আমাকে, শুধু আমারই তো ভালোবাসতে হবে। আমি জানি তা, ভালো করে জানি, দায়িত্ব নিয়েই জানি। তবুও সবার কথা শুনে মাঝেমাঝেই বেসামাল হয়ে যাই, দোটানায় পড়ে যাই, ভালোবাসা যা আমার পাওয়ার না – তাই চেয়ে বসি।

ফোন বাজছে ব্যাগের ভেতর। ভাইব্রেট হচ্ছে। হয়তো মা নইলে মিজাভাই ফোন দিয়েছে। আমি ব্যাগ খুলে ফোন বের না করার অলসতায় হাঁটতে থাকলাম। তেজগাঁও কলেজ বাঁয়ে রেখে আরেকটু সামনে হেঁটে যেতেই আমার পা আটকে গেলো। মিতাভাই, সাথে আরও কয়েকজন; তার বন্ধুই হবে সম্ভবত, দাঁড়িয়ে গল্প করছে আর বাদাম খাচ্ছে।

আমি ছাতাটা চোখের উপর নিয়ে এলাম, যেন আমায় দেখতে না পায়। আস্তে করে পাশ কাটিয়ে চলে যাব নাকি পেছনে ফিরে বাসায় চলে যাবো; বুঝতেই পারছি না।

মিতাভাইর বাদাম খাওয়াটা দেখতে কী ভালো! দু আঙ্গুলে টিপে বাদাম ভাঙছেন, তারপর দানাদুটোকে ঘষে পাতলা খোসাটুকু ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন হাওয়ায়। ফর্সা কবজিতে কালো বেল্টের রিস্টওয়াচ, নেচে নেচে যেন আমাকেই কাছে ডাকছে। আকাশি রঙের হাওয়াই শার্টের নিচটা কুঁচকে আছে, প্যান্টের ভেতর গুঁজে দেওয়া ছিলো বলে। এইযে শার্টটা প্যান্টের উপরে ফেলে রাখা, এতেই কত ভালো লাগছে! একদিকে বাঁকিয়ে দাঁড়ানো মিতাভাই, একপায়ে ভর দিয়ে। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কত কথা বলছে। আমার সাথে কেন কথা বলে না? হু হ্যাঁ তেই সব কথার ঝাঁপি আমার বেলায়ই কেন ফুরায়?

‘ছুটি?’ মিতাভাই হঠাৎ যেন সামনে এসে পড়ল। ‘এখানে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কী করিস?’

এতো ভয় কেন পাচ্ছি জানিনা, গলা কাঠ করে বললাম ‘এমনিই, এক বন্ধুর কাছে এসেছি।’

‘বন্ধু? বন্ধু কোথায়?’

‘চলে গেছে।’

‘তা তুই যাসনি কেন?’

‘এইতো এখুনি যাচ্ছি।’ বলেই ইউটার্ণ নিলাম।

দুপা আগাতেই মিতাভাই ডাকল। ‘এই? চল আমার সাথে। আমিও বাড়ি যাচ্ছি।’

আমি ভুল শুনলাম না তো? আনন্দে দৌঁড়ে মিতাভাইর গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে আমার পাশে বসতে বসতে তার অলটাইম কোঁচকানো ভুঁরু আরও কুঁচকে বললেন ‘যদি হারিয়ে টারিয়ে যেতি..’

আমি কি করে বলব ‘মিতাভাই, আপনি এইযে দুটো ভালো করে কথা বললেন, এইটুকুর জন্য আমি হাজারবার হারিয়ে যাবো, কোটিবার মরে যাবো!’

অনেক আনন্দে আমি হুট করে মিতাভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। তার কাঁধে নাক ঘঁষতে লাগলাম…

মিতাভাই বিরক্ত হলেন ‘আহ ছুটি, ঘেমে গেছিস একেবারে…’

চলবে..

afsana asha
(কপি করা যাবে না)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here