চিত্তদাহ #লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ১

#চিত্তদাহ
#লেখিকা : শুভ্রতা আনজুম শিখা

পর্ব ১

🍂🍂🍂

আজানের ঠিক কিছু মিনিট আগেই ঘুম ভাঙলো নুরের। সচরাচর এই সময় সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, অ্যালার্মের কর্কশ শব্দেও তার ঘুম ভাঙ্গতে চায় না তাই ফজরের নামাজটা প্রায় সময়ই তার মিস যায়। অলসতা দেখিয়ে পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টা করলেও তার চোখে ঘুম ধরা দিল না। কোনো এক অজানা কারণে তার মনে অস্থিরতা কাজ করছে। এই ধরনের অস্থিরতা তার মোটেও পছন্দ নয়। যতবার এমন অস্থিরতা তার মনে হানা দিয়েছে ততবারই কোনো না কোনো খারাপ কিছু ঘটেছে তার জীবনে। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতেই আজানের ধ্বনি কানে এলো। অলসতা কাটিয়ে উঠে অজু করে, নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষে উঠে বারান্দায় যেয়ে দাড়ালো। গতকাল রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। রাতের মত ঝমঝমে বৃষ্টি পড়ছে না, ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। চারদিকে কেমন থমথমে ভাব বিরাজমান, সকাল হলেও আজ আকাশে সূর্য উঠবে না হয়তো। আজ এত ভোরে উঠেও সূর্য উঠা দেখতে পারলো না ভেবে চাপা আফসোস অনুভব করলো। আপাতত এই আফসোসটাকে পাত্তা না দিয়ে কিচেন থেকে এক মগ ধোয়া ওঠা কফি বানিয়ে নিয়ে আবারও বারান্দায় এলো। প্রতিবারের মতো দুধ, চিনি দিয়ে বানানো কফি না বরং আজ তার বান্ধবীর প্রিয় কফিটি টেস্ট করে দেখার শখ জাগলো তার মনে। চিনি, দুধ বিহীন, শুধুমাত্র এক মগ গরম পানিতে ২ চামচ কফি। একে লোকে ব্ল্যাক কফি বললেও ওর বন্ধুমহলে একে তিতাপানি বলে সম্বোধন করা হয়, কথাটা মনে পড়তেই আলতো হাসলো নুর। দোলনায় বসে দুলতে দুলতে বৃষ্টি দেখতে মনোযোগ দিলো। কিন্তু নাহ! প্রতিবারের বৃষ্টির আওয়াজ যেমন তার মনে চঞ্চলতা আর ভালো লাগা এনে দিতো আজকে তেমন অনুভব হচ্ছে না বরং আজকে তার মনে অস্থিরতাভাব বেড়ে চলছে। এই অস্থিরতার কারণও আজ তার অজানা। বান্ধবীর বলা নিয়ম অনুযায়ী বানানো কফিতে চুমুক দিতেই চোখ মুখ কুচকে গেলো তার। দ্রুত ওয়াশরুমে যেয়ে কুলি করে এলো। চোখ, মুখ কুচকে কিছুক্ষণ সে কফি মগের দিয়ে চেয়ে থেকে দম ছেড়ে বিড়বিড় করে বললো “ছ্যাহ!এটা খাওয়া আমার মত চা প্রিয় মানুষের পক্ষে সম্ভব না, কখনো না।” বিছানা হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে ফোন নিতেই তাতে ভেসে উঠলো একটা পরিচিত নম্বর কিন্তু অদ্ভুত হলো সেই নম্বরটা ফোনে সেভ নেই। এই পর্যন্ত প্রায় ২৫ টা কল আর ১৭ টা মেসেজ এসেছে। এই নম্বর থেকে কোনো কল বা মেসেজ আসে না প্রায় দুই বছর। আজ এই নম্বর থেকে নোটিফিকেশন আসায় সে কিছুটা অবাকই হলো। মেসেজ অপশনে যেতেই একটা মেসেজ এ নুরের চোখ আটকে গেলো। মেসেজটা পড়েই নুর বিরক্ত হলো, যাকে বলে চরম বিরক্ত। বিড়বিড় করে কয়েকটা অশ্রাব্য ভাষায় গালি ছাড়লো মেসেজ প্রেরণকারীর উদ্দেশ্যে। মেসেজ এ বলা কথাটা তার বিশ্বাস হলো না কেননা এমন মজার সাথে সে পরিচিত। দক্ষ হাতে সে জবাব দিলো, “এই ধরনের ফাজলামি আমার মোটেও পছন্দ না। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি”। মেসেজ দিতেই সিন হয়ে গেলো তা। চোখের পলকেই আবারো ওই নম্বর থেকে কল এলো। নুর রিসিভ না করেই ফোনটা ভাইব্রেট করে মাথার বালিশের দিকে ঢিল মারলো। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে বসে রইলো। হটাৎ দরজায় করাঘাতের আওয়াজে লাফিয়ে উঠে ঘড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সবে মাত্র ৫ টা বেজে ৫৭ মিনিট। এ সময় বাড়ির কেউ ঘুম থেকে উঠে না, উঠলেও এই সময় কেউই তাকে ডাকার সাহস করবে না তা জানে সে। তবে কি কোনো দরকার পড়লো? হাজারো চিন্তা মাথায় নিয়েই ঘরের দরজা খুলে দেয় সে। সামনে মা আর ছোট বোনকে কান্নারত অবস্থায় দেখে হকচকিয়ে গেলো। বাবার কিছু হলো না তো? ভাবতেই হৃদপিন্ডটা যেনো দ্রুত বেগে ছুটতে শুরু করলো। সে কোনো প্রশ্ন করার আগেই নুরের মা নিতা তাড়া দিয়ে বললো,
আমাদের এখনি ঢাকা যেতে হবে নুর। তোর বাবা গাড়ি বের করছে। তুই দ্রুত আয়। আমরা নিচে অপেক্ষা করছি।
নুর কারণ জিজ্ঞেস করলেও তিনি জবাব দিলেন না। ছোট মেয়েকে চোখের ইশারায় নিজের সাথে নিয়ে চলে গেলেন। তাদের যাওয়ার সময় নুর তার ছোট বোন নীরার দিকে চেয়ে ছিল। যার চোখই বলে দিচ্ছে যে সে নূরকে কিছু বলতে চায় কিন্তু তা এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। মা আবার ডাক দিতেই নুর তার ওড়না, ফোন আর ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়ে। পা যেনো চলছেই না তার, মনের মধ্যে অজানা কারণে অস্থিরতা বেড়ে চলছে। গাড়িতে বসতেই দেখতে পেলো মা আর নীরা কাদঁছে। এতো সকালে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আর ওরা কাদঁছে কেন? জিজ্ঞেস করলেই বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন “গেলেই দেখতে পাবে। তুমি আপাতত ঘুমানোর চেষ্টা করো”। হয়তো ছোট মামার বাড়ির কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এটা ভেবে নিয়েই নুর তাদের নিয়ে এতোটা মাথা ঘামালো না। মা, বোনের ফ্যাচফ্যাচ কান্নার আওয়াজটা এই মুহূর্তে বিরক্ত লাগছে। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা যেতে প্রায় ৪ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। অনায়াসে একদফা ঘুম দেওয়া যাবে ভেবেই কানে হেডফোন গুজে দিয়ে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে বসে থাকে। হটাৎ মনে পড়ে আজকে সকালে পাওয়া মেসেজটির কথা। অদ্ভুতভাবে দেড় বছর পর আজ আবার সে ঢাকা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো হাজারো স্মৃতি। যার শুরুটা অত্যন্ত সুখকর হলেও, এর শেষটা ছিল ভীষন বিষাক্ত। আজ আবারও ডুব দিলো সে স্মৃতির পাতায়…

🍂 আড়াই বছর আগে 🍂

~হেই! ৩০৭ নম্বর কেবিনটা কোন দিকে বলতে পারবেন?
রিসিপশনের দাড়িয়ে থাকা মানবীকে প্রশ্ন করেই শুভ্রতা আবার ঠোঁট কামড়ে এদিক ওদিক তাকানো শুরু করলো। মেয়েটি জবাব না দিয়েই তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে দেখতেই সে কপাল কুঁচকে ফোঁস করে এক দম ছাড়লো। গায়ে লাল-সাদা রঙের আটপৌরে শাড়ি, চোখে গারো কাজল, চুলগুলো এলোমেলো ভাবে হাত খোঁপা করা, হাত ভর্তি কাচের চুড়ি, হাতে পায়ে আলতা পড়ে কোনো রমণী এমন হটাৎ সামনে এসে দাঁড়ালে যে কেউ হা করে চেয়ে থাকবে। এটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। শুভ্রতা মাটির দিকে চোখ রেখে কপাল চুলকে বিড়বিড় করে বললো,
লোকটা আর কোনো দিন ক্ষণ পেলো না অ্যাকসিডেন্ট করার! জাস্ট বিরক্তিকর!
চোখ তুলে সামনে থাকা মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখলো সে এখনও তার দিকে হা করে চেয়ে আছে। আশেপাশের মানুষগুলোও তার দিকে আড়চোখে চেয়ে আছে। হাসপাতালে এরূপে কাউকে দেখে যেনো ব্যাপারটা সবারই হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। শুভ্রতা কণ্ঠে রম্যতা এনে বললো,
আই নো আম কিউট। হা করে চেয়ে না থেকে ৩০৭ নম্বর রুমটা কোনদিকে তা বলুন।
শুভ্রতার কথায় মেয়েটি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। চোখ দুটো যেনো এখনি কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে, গাল দুটোতে লজ্জায় লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো। সাধারণত মেয়েদের দিকে কেউ এক ধ্যানে চেয়ে থাকলে তারা অস্বস্তিতে পড়ে যায়, কথা বলতেও দ্বিধাবোধ করে কিন্তু শুভ্রতা এমন করলো না সে উল্টো নিজের কথায় মেয়েটাকেই অস্বস্তিতে ফেলে দিলো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতেই এক জোরপূর্বক হাসি দিয়ে হাত উঠিয়ে কেবিনে যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দিলো। মেয়েটার এমন হাবভাব দেখে শুভ্রতা ঘাড় বাঁকিয়ে কিছুক্ষন মেয়েটির মুখের পানে চেয়ে রইলো। পরমুহূর্তেই ধন্যবাদ জানিয়ে শাড়ি ধরে কেবিনের দিকে হাঁটা দিলো। শুভ্রতার যাওয়ার দিকে মেয়েটি চেয়ে থাকলেও তাতে শুভ্রতার মধ্যে কোনো প্রকার হেলদোল দেখা দিলো না।
.
কেবিনের সামনে দাড়াতেই দেখতে পেলো তিলোত্তমা, রিদিতা, রূপা, উপমা আর নুর বসে আছে। শুভ্রতা এগিয়ে যেতেই তারা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো।
~তুই এই অবস্থায় কেন?(নুর)
~আসতে এত দেরি হলো কেনো?(রূপা)
~স্যার জিজ্ঞেস করতে বলেছেন যিনি রক্ত দিবে সে কি এসেছে? নাহলে স্যার অ্যারেঞ্জ করাবে?(নার্স)
শুভ্রতা নুরদের দিকে বাঁকা চোখে চেয়ে বললো,
~তোদের প্রশ্নের উত্তর বেশি জরুরী নাকি লোকটাকে রক্ত দেওয়া বেশি জরুরি? কোনটা?(শুভ্রতা)
~আগে রক্ত দিয়ে আয়। (তিলোত্তমা)
শুভ্রতা নার্স এর সাথে যাওয়ার সময়ও খেয়াল করলো যে তার দিকে নার্সসহ সবাই অবাক হয়ে চেয়ে আছে। শুভ্রতা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নার্স এর পিছু পিছু চলে গেলো। অন্যদিকে বিস্ময় নিয়ে কয়েক জোড়া চোখ তার যাওয়ার দিকে দৃষ্টি স্থির করেই বসে রইলো।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here