চেনা রোদে বসন্ত পর্ব -০৩

#চেনা_রোদে_বসন্ত
#পর্ব_৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

চোখে দল বেঁধে থাকা অশ্রুজল গুলো লুকিয়ে আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম। রাফায়াত ভাইয়ার কথায় মোটামুটি আশ্বস্ত হলাম। কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করেই আমি আঁচলে মুখ চেপে এক ছুটে নিজের বেড রুমে এসে প্রবেশ করলাম!

তাৎক্ষণিক বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। বাঁধ ভাঙা অশ্রুজলে নিজেকে ভাসিয়ে চলছি অবিরত। এই মুহূর্তে তরুনকে বড্ড ভয়ংকর, ছলনাময় এবং দ্বিগুন রহস্যময় মনে হচ্ছে আমার! কেন জানি না মন বলছে তরুনের এই আমুল পরিবর্তনের পিছনে যতো রহস্য আছে সব রহস্য নির্ঘাত আমার শ্বশুড় কিংবা শ্বাশুড়ী মা জানেন! বসার ঘরে তাঁদের অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি দেখেই খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিলাম আমি! তবে এর আগে আমার আরও একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। তা হলো বড় আপুর ননদের সাথে পার্সোনালী কথা বলা কিংবা সরাসরি দেখা করা! তাদের মধ্যে আদৌতেই কোনো সম্পর্ক আছে কিনা বিনা সংকোচে তা জানতে চাওয়া। যদি উনার কথার আকার ইঙ্গিতে কোনো ভাবে বুঝতে পারি যে, তাঁদের উভয়ের মধ্যে কোনো ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে তবে ধরে নিতে হবে তরুন প্ল্যানিং করেই আমাকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে এসেছিল! সঠিক জায়গায় সত্য কথাটি বলার অপরাধে আমাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করার জন্য!

শরীর ক্রমাগত নিস্তেজ হয়ে আসছিল আমার! অতিরিক্ত কান্নার প্রভাবে আঁখি জোড়া জ্বালা পোঁড়া করতে শুরু করল। গলা শুকিয়ে শুকনো কাঠে পরিণত হলো। ক্ষুধা মন্দা বৃদ্ধি পেয়ে শরীরটিকে অত্যধিক দুর্বল করে তুলছিল। সব মিলিয়ে অবস্থা আমার সূচনীয়! এই মুহূর্তে নিজের জন্য চিন্তা না করলেও আমার অনাগত বাচ্চার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। নিজেকে অভুক্ত রাখা মানে তো আমার বাচ্চাটিকেও অভুক্ত রাখা! বাচ্চার কথা ভাবতেই উদ্বিগ্নতায় নাক-মুখ কুঁচকে এলো আমার। আধ খোলা দৃষ্টিতে দেয়াল ঘড়ির দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম ঘড়িতে রাত প্রায় ১০:০০ টা বাজছে প্রায়! তরুনের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল সকাল ঠিক ১০:০০ টার কাছাকাছি সময়ে। আর এখন বাজছে রাত ১০:০০ টা! মাঝখানে মোট ১২ ঘন্টার ব্যবধান। বসার ঘরে বর্তমানে ঠিক কী কী ঘটছে কেন জানি না তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ, কৌতুহল কিংবা ইচ্ছেবোধ জাগ্রত হচ্ছে না আমার! আপাতত পেট ভরে খেয়ে-দেয়ে একটু ঘুমোনোটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি। যাই হয়ে যাক, বাচ্চার জন্য আমাকে স্বার্থপর হতেই হবে। শক্ত হতেই হবে।

ক্ষুধা মন্দায় শরীর বেগতিক অস্থির হয়ে উঠতেই আমি পেটে হাত রেখে অস্পষ্ট গলায় বিছানায় শুয়ে থেকেই রামিশাকে যতো খানি সম্ভব ডাকতে শুরু করলাম। তবে আমার মিহি গলার স্বর হয়তো শোবার ঘরের দরজা পেরিয়ে বসার ঘর অবধি পৌঁছোচ্ছে না! তাই তো রামিশা আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। জানি না এই মুহূর্তে বসার ঘরে ঠিক কী পরিমান জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে! আদৌতেই দুই পরিবারের মধ্যে সব ঠিক আছে কিনা তাও জানি না আমি! তবে ক্ষিদের তাড়নায় ছটফট করতে করতে এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম! সেই ঘুম ভাঙল আমার মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শে! কেউ অতি যত্নে, আদরে, ভালোবেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলছে! মন তো চাইছিল তার যত্নে আরও একটু ঘুমিয়ে থাকি! তবে দেহের প্রখর অনুভূতি বোধগুলো অচিরেই আমাকে জাগ্রত করতে বাধ্য হলো! কৌতূহল, উচ্ছ্বাস এবং উদ্বিগ্নতা নিয়ে আমি আঁখি পল্লব মেলে ধরতেই দৃষ্টিতে এক রাশ মগ্নতা নিয়ে বসে থাকা রাফায়াত ভাইকে দেখতে পেলাম! জাগ্রত অবস্থায় আমাকে দেখা মাত্রই রাফায়াত ভাই মগ্নতা কাটিয়ে ম্লান হেসে উঠলেন! পুনরায় তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই আমি তাৎক্ষণিক রাফায়াত ভাইয়ার হাতটি এক ঝটকায় আমার মাথার উপর থেকে সরিয়ে দিলাম! জায়গা থেকে অনেকখানি সরে এসে আমি বিস্মিত দৃষ্টিতে রাফায়াত ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,,

“কী হলো রাফায়াত ভাই? এতো রাতে তুমি আমার ঘরে কী করছ?”

ব্যথিত দৃষ্টিতে রাফায়াত ভাই আমার দিকে তাকালেন! একই দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি অবিলম্বেই বাড়িয়ে রাখা হাতটি গুটিয়ে নিলেন! তাৎক্ষণিক মাথা নুইয়ে তিনি বুকের মধ্যখানে হাতটি গুজে অপরাধ সূচক গলায় প্রত্যত্তুরে বললেন,,

“তোর কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা জানতে এসেছিলাম!”

প্রসঙ্গ পাল্টে আমি উৎসাহী গলায় শুধালাম,,

“তরুন কী চলে গেছে?”

মাথা উঁচিয়ে রাফায়াত ভাই আমার দিকে তাকালেন! কিঞ্চিৎ মুহূর্ত মৌণ থেকে তিনি বেদনাহত দৃষ্টিতেও ম্লান হেসে বললেন,,

“কেন? তরুনকে খুব মিস করছিস?”

নেত্র কোটরে একটু একটু করে জল ভরাট হতে লাগল আমার! সঙ্গে সঙ্গেই চোখের জল ছেড়ে দিলাম আমি! কাতর গলায় প্রত্যত্তুরে বললাম,,

“হুম!”

“খুব ভালোবাসিস তরুনকে তাই না?”

“ভালো না বাসলে হয়তো পাঁচ মাস তার সাথে সংসার করা হতো না!”

“কিন্তু, তরুন তো তোকে ভালোবাসে না!”

থমকালাম আমি! অশ্রুসিক্ত আঁখি জোড়ায় প্রবল উদ্বিগ্নতা নিয়ে শুধালাম,,

“কে বলল ভালোবাসে না?”

রাফায়াত ভাই ক্রুর হেসে উঠলেন! ব্যগ্র গলায় বললেন,,

“তুই নিজের মুখেই বলেছিলি, তরুনের অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে।”

“উঁহু! মন থেকে বলি নি! আন্দাজের বসে বলেছি। খুব রাগ হচ্ছিল তাই! আর রাগ হলে আমার মাথা ঠিক থাকে না।”

মুহূর্তের মধ্যেই রাফায়াত ভাইয়ার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা সেই বাঁকা হাসি কোথায় যেনো মিলিয়ে গেল! অচিরেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল! দাঁতে দাঁত চেপে তিনি আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“আন্দাজের বসে তরুনকে এভাবে ব্লেইম করার মানে কী ছিল রিয়াশা? তুই জানিস তোর একটু খামখেয়ালীপনার জন্য তরুন কতোটা কষ্ট পেয়েছে?”

ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। অস্পষ্ট গলায় বলতে আরম্ভ করলাম,,

“আমিও তো কম কষ্ট পাই নি রাফায়াত ভাই! সকালেই তো তরুন আমায় যা নয় তা বলে অপমান করল। আমাকে এবং সন্তানকে মেরে ফেলার কথা পর্যন্ত বলছিল। গাঁয়ে হাত তোলাই শুধু বাকি ছিল! সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি কীভাবে পারতাম তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে? নিজেকে ঠিক রাখতে? মনকে স্থির রাখতে?”

রাফায়াত ভাই তব্ধ শ্বাস ছাড়লেন! তেজী দৃষ্টিতে মৌনতা এনে নমনীয় গলায় আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“তাহলে এখন মিস করছিস কেন তাকে? কেন তার জন্য কাঁদছিস? মনকে স্থির করতে পারছিস না?”

আমাকে প্রত্যত্তুর করার কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনি বসা থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন! ব্যস্ত ভঙিতে প্যান্টের পকেট থেকে উনার ব্যবহার করা সেলফোনটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,,

“ধর৷ তরুনের সাথে কথা বলে নে! দেখবি মন শান্ত হয়ে গেছে!”

দ্রুত বেগে শোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি! মৃদ্যু হেসে রাফায়াত ভাইয়ার হাত থেকে ফোনটি হাতে তুলে নিলাম। দ্বিগুন উৎসাহিত হয়ে আমি তরুনের নাম্বারে ডায়াল করতেই রাফায়াত ভাই কেমন যেনো গলা জড়ানো স্বরে শুধালেন,,

“খুব বেশি খুশি হয় না? যখন প্রিয় মানুষটির সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ হয়ে ওঠে?”

স্ক্রিণ থেকে দৃষ্টি উঠিয়ে আমি তাৎক্ষণিক রাফায়াত ভাইয়ার ব্যথিত দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলালাম! কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করেই আমি উচ্ছ্বাসিত গলায় বললাম,,

“হুম। খুব খুশি হয়!”

বিমূর্ষ দৃষ্টিতে রাফায়াত ভাই আমার দিকে তাকালেন! অতঃপর নাক টেনে ভগ্ন গলায় বললেন,,

“কিন্তু আমার ভাগ্যে এই খুশিটা কখনও জুটে নি জানিস? আমার মনে বাস করা প্রিয় মানুষটি কখনও আমার মনের খবর জানতেই পারে নি! কখনও উপলব্ধি করতে পারে নি, আমাকে একটু খানি বুঝার অপেক্ষায় চাতক পাখির মতো কত বছরের পর বছর অবলীলায় কাটিয়ে দিয়েছি আমি! তাকে একটি নজর দেখার প্রতীক্ষায় প্রেম পিপাসু আঁখি জোড়া কতো শতো রজনী যে চেয়ে চেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে সে কখনও জানতেই পারবে না! তাকে নিয়ে স্বপ্নপুরীতে যে বিশাল রাজ্য গড়েছিলাম আমি? দীর্ঘ দশ বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করার পর জানতে পারলাম, এতো অধ্যবসায়ের ফলে যে রাজ্য আমি রচিত করেছিলাম? সেই রাজ্যসহ রাজ্যের রাণীও এখন অন্য কারোর হয়ে গেছে! সেই প্রত্যাশিত রাজ্য এখন আর আমার নেই! চোখ বুজতেও এখন ভয় হয় জানিস? চোখে সহস্র ক্লান্তি ভর করলেও এখন চোখ বুজতে ভয় হয়। নিজের তৈরী করা রাজ্যে আমি দ্বিতীয় কারো বিচরণ সহ্য করতে পারছি না!”

হতভম্ব দৃষ্টিতে আমি রাফায়াত ভাইয়ার গভীর শোকাহত দৃষ্টিতে তাকালাম! নেত্র কোটর জুড়ে অবলীলায় জল চিকচিক করে উঠতেই আমি শুকনো ঢোক গিলে উৎসুক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,,

“কে সেই রাণী রাফায়াত ভাই? যে তোমার ভালোবাসা বুঝল না?”

রাফায়াত ভাই থমকালেন। চোখের জল আটকে রাখার অদম্য চেষ্টা করে বিমূঢ় গলায় বললেন,,

“সে আমার ভালোবাসা বুঝে নি বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। একটু খানি হলেও বুঝেছিল! কিন্তু…

“কিন্তু কী রাফায়াত ভাই?”

“আমি ফিরে আসতেই অনেক খানি দেরি করে ফেলেছি! অন্য কাউকে ভরসা করে নিজেই হেরে গিয়েছি! মানুষ চিনতে ভুল করেছিলাম আমি! ভেবেছিলাম পৃথিবীতে হয়তো সবাই আপন!”

তাৎক্ষণিক রাফায়াত ভাই পিছু ঘুরে দাঁড়ালেন। নেত্র কোটরে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু অশ্রকণা গুলোকে দু’হাত দ্বারা মুছে তিনি নির্লিপ্ত গলায় বললেন,,

“তরুনের সাথে কথা বল তুই। আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি!”

প্রত্যত্তুর করার সুযোগ দিলেন না তিনি। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে থেকে প্রস্থান নিলেন। নির্লিপ্ত নির্বিকার দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ লোকটির যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলাম আমি! কে সেই রাণী, কাকে ভরসা করে রাফায়াত ভাই ঠকেছেন বিষয় গুলো যেনো আমার কাছে ধাঁধার মতো মনে হচ্ছিল। যার উত্তর হয়তো আমাকে নিজেই খুঁজে বের করতে হবে। আপাতত বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে আমি পুনরায় ফোনের স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি বুলালাম। তরুনের নম্বরে কল ঢুকতেই ঐ পাশ থেকে তরুন সঙ্গে সঙ্গে কলটি তুলে নিলেন! কম্পিত গলায় তিনি অর্ণগল বলতে আরম্ভ করলেন,,

“কে? রিয়াশা? আমি জানতাম তুমি কল করবে। তাই তো তোমার প্রতীক্ষায় এখনও আমি না ঘুমিয়ে জেগে আছি।”

“শুনুন? আমার সাথে নাটক করবেন না, একদম না। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই আপনি আমার সাথে ক্রমাগত নাটক করে আসছেন! এতোই যেহেতু ভালোবাসেন আমাকে তাহলে সকালে আমার সাথে এমন খারাপ আচরণ করলেন কেন? কেন বললেন আমাদের বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দিতে? আমাকে মুক্তি দিতে? বাচ্চাটা আপনার নয়। বাচ্চাটা আমার পাপের ফল!”

“বিশ্বাস করো রিয়াশা। সকালে আমি তোমার সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছি, তোমাকে কতোটা হার্ট করেছি, কী থেকে কী বলেছি কিছুই মনে নেই আমার! জ্ঞানত আমি তোমার সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করতে পারি না রিয়াশা। আমার দ্বারা তা কখনও সম্ভবই না। তুমি তো আমাকে চিনোই রিয়াশা। দুই বছর সম্পর্কের পর আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছি! এতো বছরেও তুমি আমাকে চিনতে পারো নি বলো?”

“এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড? দুই বছর সম্পর্কের পর আমরা বিয়ে করেছি মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি? বিয়ের আগে তো আমাদের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না! আমাদের তো এরেঞ্জ ম্যারেজ ছিল!”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here