ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর পর্ব ২৫+২৬

#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ

পর্ব-২৫

কিশোরী মন মানেই উপচে পড়া ভালোবাসা আর আকাশ সমান অভিমান।এরা কারণে অকারণে ভালবাসে আর কারণে অকারণেই অভিমানের ডালা সাজিয়ে তোলে।কিশোরীর মনের আনাচে কানাচে ভালবাসা আর অভিমানেরা প্রেমিক-প্রেমিকার মতো জোড়া বেধে বসে থাকে। পুতুলের সেই কিশোরী মনে এখন অভিমানেরা জোড়া বেধে বসে তুমুল প্রেম চালাচ্ছে।আর পুতুল সেই অভিমানের প্রেম নিয়ে তার বেলকনির সোফায় বসে আছে।গলা থেকে মাম্মার চেইন টা হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে পুতুল।মন খারাপের সময়টাই বোধ হয় এরকমই সবথেকে ভরসার মানুষটাকে পাশে চায়, ভীষণ ভাবে কাছে চায়।তাইতো পুতুলেরও এখন মাম্মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।এসব ভাবনার মাঝেই ফোনের বিপ বিপ শব্দে টি-টেবিলে থাকা ফোনের স্ক্রিনে তাকায় পুতুল।মাম্মার কল দেখেই পুতুল খুশি হয়ে চট করে ফোন টা নিয়ে রিসিভ করে।
-” মাম্মা ইউ নো হোয়াট? আমি মাত্রই তোমার কথা ভাবছিলাম আর তোমার কল পেলাম।জাস্ট লাইক আ ম্যাজিক মাম্মা।”
পুতুলের কথায় মিসেস প্রীতি মুচকি হেসে বললেন,
-“তাই নাকি! তো কিসের জন্য মাম্মাকে নিয়ে ভাবা হচ্ছিল শুনি?”
মাম্মার প্রশ্নে পুতুলের মুখটা আবারও মলিন হয়ে যায়।কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
-” মাম্মা আই মিস ইউ সো মাচ।আই ওনা হাগ ইউ মাম্মা জাস্ট আ বিট,জাস্ট ফর আ সেকেন্ড।”
বলতে বলতেই পুতুলের চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।পুতুলের কথায় মিসেস প্রীতির দম বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে, চোখ দুটো জ্বলছে।তিনিও তো মিস করেন তার মেয়ে টাকে,ভীষণ মিস করেন।প্রতি রাতে ফাঁকা বুকে দমবন্ধ অনুভূতি নিয়ে ঘুমোন।এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎই মনে হলো মেয়েটার এতো মন খারাপ কেন?গতকালও কথা বলে মনে হচ্ছিল কোন ব্যাপারে আপসেট হয়ে আছে আবার আজও,,,,,,, তবে কি মেয়েটা ওখানে ভালো নেই?ভেবেই ব্যস্ত গলায় বলল,
-” কী হয়েছে পুতুল?কিসের জন্য মন খারাপ তোর? কেউ কিছু বলেছে সোনা? মাম্মাকে বল।”
মাম্মার কথায় পুতুল নিঃশব্দে কেঁদে দেয়। নরম কন্ঠে বলল,
-” কিছুই হয়নি মাম্মা, আমার তোমার জন্য মন খারাপ হচ্ছে।তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মাম্মা।”
-“আমি তো বলেছি পুতুল আমি চেষ্টা করছি।তুই এভাবে কান্নাকাটি করলে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি আর যোগাযোগ করবো না।”
মাম্মার কথায় পুতুলের কান্নামাখা মুখেই এক টুকরো হাসি দেখা দেয়।সে মন খারাপ করলে মাম্মা তাকে বার বার একই হুমকি দেয়।

সূর্য লিভিং রুমে বসেই বার বার পুতুলের রুমের দিকে তাকাচ্ছে।সেই সকালে দেখা হয়েছে পুতুলের সাথে, ঘুম থেকে উঠে দেখা করতে গেছিল কিন্তু তখন ওর টিউটর এসেছে দেখে আর দেখা হয়নি।উফফ,,,,,,,,মেয়েটা কী আজ পড়তে পড়তে আইনস্টাইন হবে নাকি!আর এর টিউটর টার কী আর কোন কাজ নেই নাকি,মনে হচ্ছে সারারাত টিউশনি করবে।এসব ভেবে ফট করে কিচেনের দিকে পা বাড়ায় সূর্য।স্বপ্না সবকিছু গুছিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিল।তখনই সূর্য এসে বলল,
-” স্বপ্না একটা কাজ করতো, পুতুলের রুমে গিয়ে একবার দেখতো কী করছে ওর টিউটর টা? আজ এতো লেইট হচ্ছে কেন শেষ হতে?”
-” আপামনির পড়া তো শেষ হয়ে গেছে ভাইজান।প্রাইভেট আপাতো অনেক আগেই চলে গেছে।”
-” শেষ হয়ে গেছে?ওর টিউটর কখন গেল দেখলাম নাতো?”
-” তাতো জানিনা ভাইজান,আমি নাস্তা দিতে গিয়ে দেখি প্রাইভেট আপা নাই শুধু আপামনি ছিল।”
স্বপ্নার কথা শুনে সূর্য মাথা নেড়ে পুতুলের রুমের দিকে যায়।সিড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় ফোন টা বেজে উঠে সূর্যর।স্ক্রিনে ফাটা তাহের নামটা দেখেই চ টাইপের শব্দ উচ্চারণ করে সূর্য।প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ফোন টা রিসিভ করে ছাদের দিকে চলে যায় সূর্য।
কথা শেষে কমান্ডার আবু তাহেরকে এক দফা গালি দিতে দিতে আবারও লিভিং রুমে যায় সূর্য।
-” গাইস,ইমারজেন্সি মিটিংয়ে তোদের তিনজন কে এখুনি যেতে হবে।ওর্ডারড বাই কমান্ডার।”
ভরা আড্ডা মহলে কমান্ডারের ওর্ডার শুনতেই সবার মুখ থেকেই ফাটা তাহের নামটা বের হয়।সূর্য আর কল্লোলের ইনজুরির কারণে তাদেরকে মেডিকেল লিভ দেওয়া হয়েছে।সকলে রেডি হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সূর্য হেসে সবার উদ্দেশ্য বলল,
-” হ্যাভ আ সুইট মিটিং গাইস।গুড নাইট।”বলে হামি দেওয়ার ভঙ্গি করে হেলেদুলে ভেতরে চলে যায় সূর্য।আর কল্লোল শ্রেয়ার হাত ধরে এক চোখ টিপ দিয়ে সূর্যর পিছনে হাটা দেয়। ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সকলে হতাশ ভঙ্গিতে গাড়ির ভেতরে উঠে বসে।

সিড়ি বেয়ে উপরে উঠেই সূর্য সোজা পুতুলের রুমে ঢুকে যায়।কিন্তু পুরো রুমে মহারাণীর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।বেলকনিতে আলো দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় সূর্য।বেতের ওয়ান সিটেড সোফায় পুতুলকে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে সূর্য।বিছানার সাথে কী ঝগড়া লেগেছে যে বেচারাকে ফেলে পুতুল এই সোফায় ঘুমচ্ছে।কিন্তু এই অসময়ে না খেয়ে ঘুমচ্ছে কেন পিচ্চিটা?শরীর খারাপ করেনি তো?ভেবেই দ্রুত পুতুলের কাছে এসে কপাল আর গলায় হাত দিয়ে জ্বর চেক করে সূর্য।
মাম্মার সাথে কথা বলার পরে মনটা আরো বিষন্ন হয়ে গেছিল পুতুলের।হঠাৎই তার কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কেন?জানেনা,শুধু মনে হয়েছিল তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে তাই সে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছিল।ঘুম ভাঙলো কারো আদুরে ডাকে।
-” পুতুল! পুতুল! এই পিচ্চি!
পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই দেখে সূর্য সামনে থাকা বেতের টি-টেবিলে বসে তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে।সূর্যকে দেখে পুতুল দ্রুত সোজা হয়ে বসে।ঘুম থেকে উঠে সূর্যকে দেখে ভালো লাগলেও কেন যেন পুতুলের একদম কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।কেমন যেন কান্না পাচ্ছে।তাই চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকে পুতুল।
পুতুলের ফোলা ফোলা চোখ আর লাল নাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেঁদেছে।কিন্তু পিচ্চি টা কেঁদেছে কেন?
সূর্য টি-টেবিল টা টেনে পুতুলের একদম কাছে এসে বসে।কিছুটা ঝুকে পুতুলের মুখে লেপ্টে থাকা চুল গুলো আঙুলের সাহায্যে সরিয়ে বলল,
-” কেঁদেছো কেন?”
সূর্যের প্রশ্নে অভিমানেরা বুক থেকে চোখে চলে আসে পুতুলের।সে তো সূর্যের সাথে কথা বলবে না, একটুও না। ভাবতেই গাল বেয়ে দ্রুত গতিতে নোনাপানিরা নিচে নেমে যায়।পুতুলকে কাঁদতে দেখে সূর্য দ্রুত দু’হাতে পুতুলের মুখ ধরে বলল,
-” কী হয়েছে পুতুল বলো, কাঁদছো কেন?”
সারাদিনে একবারও খবর না নিয়ে এখন এসে বলছে কাঁদছে কেন?সে একদম কথা বলবে না,একদম না।ভেবেই পুতুলের কান্নার গতি বেড়ে যায়।পুতুলের কান্না দেখে সূর্যর কেমন অস্থির লাগছে।পুতুল হঠাৎ এভাবে কাঁদছে কেন?ছোট মায়ের কিছু হয়নি তো?নাকি বখাটে গুলো কিছু করেছে? কিন্তু আজ তো কিছু করার কথা না।নানা প্রশ্ন নিয়ে সূর্য ব্যস্ত হয়ে পুতুলের চোখের পানি মুছে বলল,
-“কী হয়েছে পুতুল? বলো,এভাবে কাঁদছো কেন?,,,,এই মেয়ে বলো কী হয়েছে? আমার টেনশন হচ্ছে তো।”
পুতুলের কোনো ভাবান্তর না দেখে সূর্য ধমক দিয়ে বলল,
-” এই কথা বলছো না কেন? কী হয়েছে বলো?”
সূর্যের ধমকে চমকে উঠে পুতুল।সূর্যকে রেগে তাকিয়ে থাকতে দেখে শব্দ করে কেঁদে ফ্যাসফ্যাস করে বলল,
-” আমি রাগ করেছি,আপনি কেন আমাকে আনতে যাননি? আবার আমাকে ধমকাচ্ছেন,কই শ্রেয়া আপুর সাথে তো কত হেসে কথা বলেন।আমার বেলাতেই আপনি লঙ্কারাজ হয়ে যান শুধু।”
বলে নাক টেনে কাঁদতে থাকে পুতুল।সূর্য এতোক্ষণ ভ্রু কুঁচকে পুতুলের কথা শুনলেও এখন তার ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু প্রিয়তমার দুঃখের সময় হাসাটা নেহাৎই একটা পাপ।আর সে কিছুতেই এমন পাপ করবে না ভেবেই মুখটা যথাসাধ্য সিরিয়াস করে।তারপর পুতুলের হাত ধরে টপাটপ দুটো চুমু দিয়ে কিছু বলবে তার আগেই টুকটুকির ডাকে পুতুলের হাত ছেড়ে সোজা হয়ে বসে।
-” আপু, আপু।কোথায় তুমি?খেতে চলো।”
টুকটুকির ডাকে পুতুল ঝটপট চোখ মুছে নেয়।সূর্য পুতুলের দিকে তাকিয়েই বলল,
-” টুকটুকি তোর আফু সরি আপু বেলকনিতে।”
ভাইয়ের গলা শুনে টুকটুকি বেলকনিতে এসে বলল,
-” তুমিও এখানে? চলো আম্মু খেতে যেতে বললো। আর আপু,,,,(পুতুলের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে কাছে গিয়ে বলল) কী হয়েছে আপু? তুমি কাঁদছিলে নাকি? ভাইয়া তুমি আপুকে বকেছো তাইনা? দাড়াও আমি এখুনি আম্মুকে বলছি।”
বলে উঠে যেতে গেলেই সূর্য টুকটুকির সামনে দাড়িয়ে বলল,
-” আমি মোটেও তোর আফুকে বকিনি,তাইনা আফু সরি পুতুল?”
সূর্যের কথায় পুতুল কিছু না বলেই রুমে চলে যায়।টুকটুকি পুতুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে বলল,
-” ভাইয়া তোমার রুমটা আপুকে দিয়ে দাও।রুমটা মনে হয় আপুর অনেক পছন্দ।তুমি যাওয়ার পর আপু রোজ তোমার রুমেই ঘুমতো।তুমি আসায় ওখানে ঘুমতে পারবেনা ভেবেই হয়তো মন খারাপ হয়ে আছে আপুর।”
সূর্য বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
-” তোর কত বুদ্ধিরে টুকটুকি,আয় কাছে আয়।”
বলে নিজেই এগিয়ে এসে বোনের মাথায় চুমু খায় সূর্য।আর টুকটুকি ভাইকে জড়িয়ে ধরে হেসে দেয়।

_________________

কলেজ শেষে তিতিয়ার সাথে বের হতেই চোখ দুটো হা হয়ে যায় পুতুলের।আশেপাশের মেয়েগুলো তীর্থের কাকের মতো বার বার রাস্তার ওপাশে তাকাচ্ছে।ধ্যান ভাঙে তিতিয়ার কথায়।
-“পুতুল রে আমরা কোথায় আছি বলতো?(পেছন ঘুরে কলেজ গেইট টা দেখে) আমরা তো ঠিক জায়গাতেই আছি কিন্তু এই হলিউড হিরো গুলো কোথা থেকে আসলো বলতো?”
তিতিয়ার কথার শেষে প্রতীক বলল,
-” শুধু কী হিরো? পাশে হিরোইন টাকেও দেখ।”
-” তুই দেখ গরু, আমিতো কেবল হিরো গুলোই দেখবো।”
বাকি ঝগড়া না শুনেই রাস্তার ওপাশে পা বাড়ায় পুতুল।সবাই ভিন্ন কালারের চেক শার্টের নিচে সাদা কালারের টিশার্ট কালো জিন্স আর সাদা স্পোর্টস সু পড়ে সাথে কালো সানগ্লাস গলায়,মাথায়, বুকে ঝুলিয়ে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে সব বন্ধু মিলে এক ড্রেসআপ করেছে।রক্তিম আর সামির ভাইয়ার কিছু নিয়ে বির্তক চলছে,পিয়াস ভাইয়া জিপের ড্রাইভিং সিটে এক পা তুলে ফোন গুতাগুতি করছে, কল্লোল আর শ্রেয়া বাইকে ঠেস দিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চুপিচুপি কথা বলতে ব্যস্ত আর ক্যাপ্টেন সাহেব ফুটপাতে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন।
পুতুল আসতেই রক্তিম আর সামির বিতর্ক রেখে হেসে বলল,
-” বস, ভাবিজান এসে গেছে।”
ওদের কথায় সবাই একসাথে পুতুলের দিকে তাকায়।ওদের কথা শুনে পুতুলের গাল গুলো গরম হয়ে যায়।এরা এতো হনুমান কেন?
সূর্য ফোন টা রেখে এগিয়ে এসে গাড়ির দিকে ইশারা করে হেসে বলল,
-” চলুন ভাবিজান।”
#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ

পর্ব-২৬

পুতুল লেডিস ট্রায়াল রুম থেকে বের হতেই শ্রেয়া হেসে বলল,
-” তোমাকে ভীষণ কিউট লাগছে পুতুল।”
উত্তরে পুতুল মিষ্টি হাসলো।কলেজ থেকে সোজা শপিংমলে এসেছে তারা।সূর্য তার পছন্দ মতো পুতুলকে স্কাই কালারের লেডিস চেক শার্ট, সাদা এনিমেটেড টিশার্ট আর কালো গেবাডিং দিয়ে শ্রেয়ার সাথে ট্রায়াল রুমে চেঞ্জ করতে পাঠিয়েছিল।শ্রেয়া পুতুলের হাত ধরে সূর্যদের কাছে আসতেই কল্লোল দৌড়ে এসে শ্রেয়ার হাত ধরে টেনে একটা টপস শ্রেয়ার সামনে ধরে বলল,
-” ডক্টরপাখি এটাতে ভীষণ ভালো লাগবে তোমাকে, নিয়ে নিই?”
শ্রেয়ার উত্তর শোনা হলো না পুতুলের,তার আগেই সূর্য তার হাত ধরে অন্যপাশে নিয়ে আসে।আর পুতুল তখনও শ্রেয়া আর কল্লোলের দিকে তাকিয়ে নিজের বোকামির কথা ভাবছে।রাতে ডাইনিং টেবিলে শ্রেয়া আর কল্লোল একসাথে আসতেই সূর্য যখন হেসে বলেছিল,
-“লাভ বার্ডস তোরা এবার বিয়ে টা করেই নে।”
-“বিয়ে তো করতেই চাই, কিন্তু শালা ফেমলিতে বোমা ফেলেও ‘বিয়ে কর’ বলাতে পারিনি।”
কল্লোলের কথায় টেবিলে হাসির রোল পড়ে যায়।পুতুল খাবার মুখে পুড়ে সূর্যের দিকে তাকাতেই দেখে সূর্য তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসছে।
ভাবনার ছন্দপাত হয় কপালে টোকা পড়ায়।সামনে তাকাতেই সূর্য তার বাঁকা দাঁতের হাসি দিয়ে বলল,
-” ওদিকে কী দেখছো? এদিকে তাকাও।”
বলে পুতুলের ঝুঁটি খুলে চুল গুলো ঠিক করে একটা সাদা ক্যাপ মাথায় পড়িয়ে দেয় সূর্য।তারপর আবার পুতুলের হাত ধরে হাঁটা শুরু করে।

মল থেকে বের হয়েই সূর্য পিয়াসের বাইকের চাবি টা নিয়ে উঠে বসে।পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” উঠে পড়ো।”
এই ক্যাপ্টেন টা কী ম্যাজিক জানে নাকি!আসার সময় শ্রেয়া আর কল্লোলকে বাইকে আসতে দেখে তারও ইচ্ছে হচ্ছিল।কিন্তু ক্যাপ্টেন টা বুঝলো কী করে!এসব ভেবে উঠে বসতেই সূর্য পুতুলের হাত ধরে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়।আর পুতুল সূর্যের কাজে কাঠকাঠ হয়ে বসে আছে।ইসস,,,,,নিজেকে একদম হিরোইন মনে হচ্ছে পুতুলের আর তার হিরো হলো ইডিয়ট ক্যাপ্টেন টা।উফফ,,,,তার গাল গুলো আবার গরম হয়ে গেছে,আচ্ছা তার কান দিয়ে আবার সত্যি সত্যি ধোঁয়া বের হবে না তো?

অসহ্য টেনশনে মাথা ব্লাস্ট হবার উপক্রম হচ্ছে মিসেস মধুমিতার।অবাকের আচরণ দেখে তিনি কিঞ্চিৎ সন্দেহ করলেও গতদিন রক্তিম আর সামিরের মুখে গল্প শুনে ওনার সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হয়েছে।ছেলেটা সত্যি সত্যি পুতুলকে ভালবাসে।কিন্তু এই ভালবাসার পরিণাম ভেবে ঘেমে যাচ্ছেন মিসেস মধুমিতা।রুমের ভেতর পায়চারি করছেন আর বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন মিসেস মধুমিতা।
গাড়ি থেকে নেমেই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে যাচ্ছেন মি. মাহবুব।ফোনে স্ত্রীর জরুরি তলব পেয়ে লাঞ্চ টাইমেই বাসায় চলে এসেছেন।স্ত্রীর গলা শুনেই বুঝেছেন কোন ব্যাপারে ভীষণ চিন্তিত।কিন্তু কী ব্যাপার হতে পারে? ভাবতে ভাবতেই রুমে ঢোকেন মি. মাহবুব।

‘সঙ্গসুখ’ এ জম্পেশ লাঞ্চ করে সবাই আবার গাড়িতে উঠে বসে।শহুরে কোলাহল ছেড়ে নিরব রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলছে।এবার রক্তিম আর সামির বাইকে উঠেছে, কল্লোল ড্রাইভ করছে আর শ্রেয়া তার পাশে একহাত ধরে নিচু গলায় গল্প করছে।পিয়াস জিপের টু সিটেড সিটে পা ভাজ করে মুখের উপর পুতুলের সাদা ক্যাপটা দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে।আর সূর্য অন্যপাশের টু সিটে একহাতে পুতুলকে ধরে তার মুখে বিকেলের হেলে পড়া সূর্য রশ্মির আনাগোনা দেখছে।শহুরে কোলাহল থেকে বের হবার কিছুক্ষণ পরেই পুতুল ঘুমিয়ে গেছে।গাছের ছায়া গলিয়ে যখন যখন সূর্য রশ্মি মুখে পড়ছে ঘুমের মাঝেই ভ্রু কুঁচকে ফেলছে পুতুল।ব্যাপারটা দেখতে বেশ ভালো লাগছে সূর্যের কাছে,অনেকটা রোদ-বৃষ্টি খেলার মতো।নাহ,,,, ঘুমের মাঝে এরকম যন্ত্রণা করা ঠিক হচ্ছে না ভেবেই আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বসে যেন রোদ পুতুলের মুখটা ছুতে না পারে।তারপর পিয়াসের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো সূর্য।এদের দুজনের কিছু কিছু ব্যাপারে ভীষণ মিল খুঁজে পায় সূর্য,এরা দুজনেই ঘুম কাতুরে, যেকোন অবস্থায় এরা ঘুমতে পারে,দুজনেই এক টাইপের বোকা।যেমন দুজনেই জানেনা কোথায় যাচ্ছে অথচ একবারও জানতে চায়নি,গাধা দুইটা।কথা গুলো ভেবেই মুচকি হাসলো সূর্য।

মিসেস মধুমিতা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছেন।তার ঠিক কি বলা বা করা উচিত বুঝতে পারছেন না।কিছু সময় ঝিম ধরে বসে থেকে স্বামীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-“মাহবুব তুমি ব্যাপার টা আগে থেকেই জানতে!তারপরও কীভাবে ব্যাপারটা এতটা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছো বলবে প্লিজ?”
-” এটা স্বাভাবিক ভাবে না নেওয়ার কিছু নেই মধু।আমার মতে তোমারও এতো হাইপার হওয়ার দরকার নেই।”
স্বামীর কথায় বিস্মিত চোখে তাকালেন মিসেস মধুমিতা। মি.মাহবুব নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে বললেন,
-” মধু,অবাক বড় হয়েছে ও কাকে ভালবাসবে না বাসবে সেটা আমি কিংবা তুমি কেউই ঠিক করে দিতে পারিনা।আর আমিতো বললামই পুতুল মিহিরের মেয়ে জানারও অনেক আগে থেকে অবাক পুতুলকে ভালবাসে।”
-” আমি সেটা বলছি না মাহবুব,তুমি প্রীতির কথা ভেবেছো। ও কখনোই অবাককে মেনে নেবে না মাহবুব।প্রীতি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মিহিরের মৃত্যুর জন্য একমাত্র তার প্রফেশন দায়ী।আর অবাক,,,, তুমি বুঝতেই পারছো কী হবে।”
মি.মাহবুব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
-” অবাক পুতুলকে ভালবাসে,কিন্তু পুতুল যে অবাককে ভালবাসবে এমন কিছু তো নয় তাইনা।আর পুতুল না চাইলে অবাক কখনো আগাবে না আমার দৃঢ় বিশ্বাস মধু।”
মিসেস মধুমিতা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
-“তুমি ভুলে যেওনা তোমার ছেলের রাগ,জেদ,ধৈর্য, ভালবাসার ক্ষমতা মিহিরের থেকেও প্রবল।ওর জেদের কাছে হেরে গেছি বলেই কিন্তু আজ ও স্পেশাল ফোর্সে।চোখের সামনে ছন্দ থাকতে নিশ্চয় তোমার ছেলের ভালবাসার ক্ষমতা দেখার প্রয়োজন পড়বে না আশাকরি মাহবুব।”
স্ত্রীর কথায় চুপ হয়ে যান মি. মাহবুব, স্ত্রীর সবগুলো কথায় সত্যি।তারপরও বললেন,
-”ভালবেসে ধর্মের মতো অভেদ্য দেয়াল ভেঙে যদি তুমি মধুমিতা ব্যানার্জি থেকে মধুমিতা জামান হতে পারো তবে আমার ছেলে অবশ্যই সামান্য প্রফেশনকে টপকাতে বেগ পাবে না মধু।”
বলেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়েন মি. মাহবুব।কিন্তু মিসেস মধুমিতা কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছেন না।শুধুমাত্র মিহিরের প্রফেশনকে দায়ী করে মিহিরের উপর রাগ করে সংসার, দেশ ছেড়ে যে মেয়ে ষোল টা বছর ভিনদেশে পড়ে আছে সে নিশ্চয় এতো সহজে অবাককে মেনে নেবে না।আর পুতুল, মেয়েটাই বা কী করবে।ভেবেই মনটা অস্থির হয়ে উঠছে মিসেস মধুমিতার।

গভীর ঘুমের মাঝেও চেনা মিষ্টি ঘ্রাণ পাচ্ছে পুতুল।কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে তার নাম ধরে ডাকছে।কিন্তু এতো মাতাল ঘুম ছেড়ে চোখ খুলে তাকাতে ইচ্ছে করছে না পুতুলের।কিন্তু ডাকের তীব্রতা বাড়তেই জোর করে চোখ মেলে তাকায় পুতুল।চোখের সামনে টিশার্ট ভেদ করে কিঞ্চিত ফর্সা বুক দেখে পুতুল মুখ তুলে তাকায়।সূর্য তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে,সে তাকাতেই ঝাঁজালো গলায় বলল,
-” রাজকুমারী ঘুমকুমারী আপনার কৃপা হলে একটু ভোজন করে দয়া করে আমাকে উদ্ধার করুন রাজকুমারী।”
সূর্যের কথা শুনে পুতুল চোখ ডলে আশেপাশে তাকাতেই দেখে রাস্তার পাশে একটা খাবার হোটেলের সামনে গাড়িতে বসে আছে তারা।রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে তীক্ষ্ণ আলো নিয়ে গাড়ি গুলো সা করে চলে যাচ্ছে।পুতুল ফট করে নিজের ফোনটা নিয়ে ন’টা বাজে দেখে অবাক হয়ে সূর্যর দিকে তাকায়। সূর্য ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে তার হাত ধরে নামাচ্ছে।
হোটেলের ভেতরে ঢুকতেই দেখে বাকিরা সব বসে কিছু নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।পুতুল আর সূর্য যেতেই কল্লোল হেসে বলল,
-“বুঝলি সূর্য, পুতুল আর পিয়াসকে রাস্তার মাঝে রেখে আসলেও ওরা ঘুম থেকে উঠতো না আমি নিশ্চিত।”
বলতেই সবাই হাসি শুরু করে।পুতুল আর পিয়াস তখনো ঘুম আহত চোখ নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আছে।
খাওয়া শেষে গাড়ির কাছে এসে সূর্য হঠাৎই পুতুলকে বলল,
-” ড্রাইভিং করতে পারো?”
পুতুল প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হলেও মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো।সূর্য ফোঁত করে একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল,
-“শুধু কাঁদতে আর ঘুমতেই পারো।”
বলে পুতুলকে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে।অন্যদিকে পুতুল রেগে সূর্যর দিকে তাকিয়ে আছে।রেগে কিছু বলবে সূর্য তার আগেই বলল,
-” এভাবে তাকিয়ে লাভ হবে না।সাত ঘন্টা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছো।এখন আমি যতক্ষণ ড্রাইভ করবো তুমি আমার সাথে জেগে থাকবে।ঘুমলে শাস্তি, কঠিন শাস্তি।”
পিছন থেকে রক্তিম আর সামির একসাথে বলল,
-” গুড লাক ভাবিজান।”
সবাই তাকে নিয়ে মজা করছে,ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর।তাই পুতুল মনে মনে না ঘুমনোর কঠিন শপথ নেয়।সে একটুও ঘুমবে না, একচুলও না।

চলবে
আপনাদের কমেন্ট পড়ে আমি আপ্লুত তাই আজও দুই পার্ট।হ্যাপি রিডিং 😍

(কার্টেসী ছাড়া গল্পটা কপি করবেন না। ইটস আ রিকুয়েষ্ট।)
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here