ঝরা_ফুলের_কান্না পর্ব ৭+৮

সত্য ঘটনা অবলম্বনে,
#ঝরা_ফুলের_কান্না
#রাবেয়া_সুলতানা।

কেটে গেল একটা মাস। কোনো ভাবেই সম্পূর্ণাকে হিমেলের কাছ থেকে সরাতে পারছে না।আতিকা বেগম নিজের ঘরে গিয়ে দেখে সাইফুল ইসলাম দম মেরে বসে আছেন অন্যমনস্ক হয়ে।
তিনি কাছে গিয়ে বসে বললেন,”এখনো ভালো ছেলের খোঁজ পাওনি?”
সাইফুল ইসলাম স্থির হয়ে আতিকা বেগমের দিকে তাকিয়ে, ” ছেলে পাওয়া কী এতই সহজ? প্রেম করেছে বলে তো যার তার সাথে বিয়ে দেওয়া যায় না। ওকে এত বুঝাই আদীলের মা ওর কী কথাগুলো কানাই যায় না? ছেলেটা যদি ভালো হতো তাহলে বিশ্বাস কর টাকার দিকেও তাকাতাম না। বিয়ে দিয়ে একটা লাইন ধরিয়ে দিতাম।মেয়ে সুখে থাকবে ভেবেই বিয়েটা দিতাম।আমার কাছে কী মনে হয় জানো, ওর সাথে জ্বীন টিন থাকে না-তো?”
আতিকা বেগম কাছে গিয়ে বললেন,” একটা কথা বলি?”
-” কী?”
-” বড় ভাবি বলছে কোন হুজুরে পানি পোড়া দেয় আবার না-কি তাবিজও দেয়। যদি ওই পানি সম্পূর্ণারে খাওয়াইতে পারি ও নাকি সব ভুলে আমাদের কথাই শুনবে।”
-” তুমি পাগল হয়ে গেছ আদীলের মা? এইগুলো আমার বিশ্বাস হয় না। এইসব তাবিজ পানি পোড়া বাদ দিয়ে মেয়েটাকে আরেকটু বুঝাও।”
-” আর কত বুঝাবো? তুমি ওর শরীরে মাইরের দাগগুলো দেখছ? খুন্তি দিয়ে ছ্যাকা দিয়েছি হাতে, চুল টেনে মেরেছি,পিঠে মাইরের দাগ ছাড়া কিছু নাই। আমি আর এইটা ছাড়া উপায় দেখি না।”
সাইফুল ইসলাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখে পানি মুছে নিয়ে,” ঘটক তো লাগিয়েছি। দেখি কী হয়!”
হঠাৎই দরজা জোরে ধাক্কানো চেঁচামেচি শুনে দুজনে দৌড়ে গিয়ে দেখে সম্পূর্ণার চেঁচামেচি।আতিকা বেগম বললেন,” দেখেছ আবার শুরু হয়ে গেছে। এইভাবে আটকিয়ে রাখা যায়?” সাইফুল ইসলাম কিছু না বলে দরজা খুলতে যাবে তখনই আতিকা বেগম বললেন,” ওকে দরজা খুলো না। যদি খুলে দাও তাহলে ও আবার তাবিয়ার ফোন কিংবা আমার ফোন দিয়ে হিমেলের সাথে কথা বলবে। কত লুকানো যায় ওর থেকে ফোন?”
সাইফুল ইসলাম কিছু বলতে যাবে তখনই ভেতর থেকে শুনা যায়,” কতদিন আমাকে আটকিয়ে রাখবে তোমরা? যদি ভেবে থাকো এইগুলো করলে আমাকে হিমেলের থেকে সরানো যাবে তাহলে ভুল ভেবেছ। তাই ভালোই ভালোই আমাকে হিমেলের কাছে যেতে দাও। তাবিয়া এসে আতিকা বেগমকে রুমে চলে যেতে বললেন।
-” বাবা আপনার ছেলে কথা বলবে।”
সাইফুল ইসলাম তাবিয়াকে বলল,” যা হয়েছে আদীলকে বলার দরকার নেই। ও শুনলে চিন্তা করবে।”
-” বাবা আমি বলতে হয়নি। লামিয়া ভাবি না-কি ফোন দিয়ে সব বলেছে। আপনার ছেলে বলল আপনার সাথে কথা বলবে তাই আমি ফোন নিয়ে এসেছি। এই নিন।”
সাইফুল ইসলাম বললেন,” রেখে দাও। আমি রাতে ফোন দিয়ে কথা বলে নেব। ওকে বলবে রাতে আমার ফোনে কল দিতে।
-” ঠিক আছে বাবা।”

পরের দিন সকাল সকাল আতিকা বেগম কোথায় গেলেন তাবিয়া জানে না। সাইফুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও বলতে পারেননি। তাবিয়া তাই নিজেই নাশতা বানিয়ে সাইফুল ইসলামের সামনে দিল। সম্পূর্ণার জন্য ট্রেতে করে নিতে যাবে তখনই আতিকা বেগম এসে বললেন,” বড় বউ, খাবারের সাথে যখনই পানি দিবে তখনই এই পানিটা সাথে মিলিয়ে দিবে।”
ব্যাগ থেকে বলতটা বের করে টেবিলের উপর রাখলেন।
তাবিয়া উচ্চস্বরে বলল,” কিসের পানি?”
আতিকা বেগম বিরক্তিকর গলায় বললেন,” তুমি আস্তে কথা বলতে পারো না? ও শুনলে এইসব খাবে? বউ মানুষ আস্তে কথা বলো। তোমাদের বাপু লজ্জাশরম কিছু নাই। আর আমাদের সময় দশ বছরেও কথা বলতাম না শ্বশুর বাড়ির লোক কী ভাববে। কত ভেবে চিন্তে উত্তর দিতাম। এইগুলো পড়া পানি। লামিয়ার সাথে গিয়ে নিয়ে আসছি।”
তাবিহা কিছু না বলে গ্লাসে বতলের থেকে পানি মিশিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণার দরজা খুলে দেখে সে খাটের কিনারায় বসে পা দোলাচ্ছে। তাবিয়া কিছুটা অবাক হয়ে,” মা মা এইদিকে আসুন। দেখুন সম্পূর্ণা কী করছে।
আতিকা বেগম গিয়ে দাঁড়াতেই সম্পূর্ণা বলল,” পড়া পানি নিয়ে আসছ কী আমার জ্বীন দৌড়াতে? হিমেলের ভর করা জ্বীন এত সহজে যাবে না। পড়া পানি, তেল পড়া যা আছে নিয়ে আসো সমস্যা নেই। আতিকা বেগম বললেন,” বড় বউ, ট্রেটা রেখে চলে আসো। যখন আশেপাশে পানি পাবে না তখন এমনিই খাবে। খাবার রেখে তাবিয়াকে নিয়ে এসে দরজায় আবার তালা লাগিয়ে দিলো।

তাবিয়া আবার দুপুরে ভাত নিয়ে গেল সকালের খাবার এখনো পড়ে আছে। রাতে গেল সারাদিনের খাবার পড়ে আছে। পরেরদিন সকালে আবার সেই একই কাহিনি, দুপুরে আগে তাবিয়া আর না পেরে এক গ্লাস জুস বানিয়ে নিয়ে গেল।
-” সম্পূর্ণা এইটা কীভাবে সম্ভব? মানুষ পানি না খেয়ে থাকতে পারে? এই নাও জুস খাও। এইটা তো আর পানি না।”
সম্পূর্ণা ম্লান হেসে,” পানি দিয়েই তো বানিয়েছ। তোমরা পারবে না। আমি মরে যাব তবুও হিমেলের কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না।”
তাবিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে, ” তুমি ওর জন্য এত পাগল। কই ও তো তোমার কথা ভাবলো না। তোমার তো খবর নিলো না।”
-” ও নিবে কেমন করে? তোমরাই আমাকে আটকিয়ে রেখেছ।”
তাবিয়া জুসের গ্লাস রেখে আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলো। তিনদিন হয়ে গেল। সে একগ্লাস পানি খায়নি।
আতিকা বেগম ভেজা চোখে দরজা খুলে দিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। সম্পূর্ণা কেমন যেন পাগলের মতো দৌড়ে বাহিরে কলে গিয়ে হাতের তালুতে করে পানি খেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো । পানি খেয়ে শরীরটা যেন দুলছে। নিজের ঘরে না এসে লামিয়াদের ঘরে গিয়ে দেখে লামিয়ার শ্বাশুড়ি সামনের দরজায় বসে তরকারি কাটছে। জেঠি আমাকে এক প্লেট ভাত দেন।”
লামিয়ার শ্বাশুড়ি অবাক হয়ে বলল,” ভাত হয়েছে কিন্তু কিছু তরকারি তো চুলার উপরে আর কিছু আমি কাটতে নিয়ে আসছি। লামিয়া এসে শ্বাশুড়িকে বলল,” মা কালকের তরকারি আছে আমি ওইটা দিয়েই দিচ্ছি। লামিয়া প্লেটে করে ভাত আর একটা বাটিতে তরকারি নিয়ে এসে সম্পূর্ণাকে দিলো। সম্পূর্ণা সিঁড়িতে বসে গাপুরগুপুর করে খেতে লাগলো। ভাতগুলো নিমিষে শেষ করে,” ভাবি আমাকে আরেক প্লেট ভাত দাও। লামিয়া ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার এনে দিলো। ভাত খেয়ে উঠে যেতেই লামিয়া বলল,” এইসব পাগলামি তুই করে কেন নিজের জীবনটাকে শেষ করছিস? তুই এখনো ছোট। তোর অদূর ভবিষ্যত পড়ে আছে। যেখানে সব মেয়ে ভালো স্বামী, ভালো ঘর, ভালো সংসার চায়। কিন্তু তুই কী চেয়ে হিমেলকে ভালোবেসেছিস? তোর মা বাবা ভাইদের কথা চিন্তা কর। ”
সম্পূর্ণা করুণ স্বরে বলল, ” সামান্য কয়টা ভাত খাইয়ে খোটা দিয়ে দিলা? ঠিক আছে আর খাব না। তবুও হিমেলের নামে আমাকে কিছু বলিও না ভাবি। আমি জানি ও ভালো ছেলে। ও আমায় ভালো রাখবে।”
লামিয়া হতভম্ব হয়ে, “খোটা দিলাম!”
-” হ্যাঁ। না হলে কী আর এইগুলো বলতে? খাওয়াইছো দেখেই তো বলছ।”
-” আচ্ছা ঠিক আছে তোকে আর কিছু বলবো না। তোর যখন খুশি এসে খেয়ে যাস।”
সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে চলে এলো। আতিকা বেগম সব দূর থেকে দেখে চোখে পানি মুছে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,” সারাজীবন মানুষকে খাইয়ে আসছি। আজ আমার নিজের মেয়েই খাবারের জন্য অন্যের দরজায় হাত পাতে। বড় বউ কিসের জন্য কার অভিশাপ লাগছে? আমার মেয়েটা কী সত্যিই এমন পাগল হয়ে যাবে?”
তাবিয়া ভেজা গলায় বলল, ” মা আপনি এইভাবে কাঁদবেন না। আপনি এইভাবে কাঁদলে সম্পূর্ণার উপর সত্যিই অভিশাপ চলে যাবে। আল্লাহকে ডাকুন। উনিই ভরসা।

দুইদিন লামিয়াদের ঘরে যখন তখন না খেয়ে শুধু দুপুরেই ভাত খেত সম্পূর্ণা। আর সারাক্ষণ এমনিই দিন কাটাতো। একদিন দুপুরে খাওয়া শেষ করে আসার পথে দেখে লামিয়া আর তার মা দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
সে দৃশ্য দেখেই পরেরদিন লামিয়াদের ঘরেও খাবার বন্ধ করে দিলো। লামিয়া যখন এসে বলল,” কিরে আজ ভাত খাবি না? সম্পূর্ণা হালকা মাথা নেড়ে, দোকান থেকে কলা আর পাউরুটি খেয়েছি। খিদে নাই।”
-” ভাত খাবি না কেন?”
-” তোমার ঘরেও যে পড়া পানি চলে গেছে সেটা আমি বুঝেছি।”
-” কিসের পড়া পানি?”
-” নাটক টিভিতে গিয়ে দেখাও। কাল আমি সব দেখেছি। এখন যাও। ”
লামিয়া আর কিছু না বলে ওর রুম থেকে বেরিয়ে এসে,” চাচি পড়া পানি দিয়েছেন ও জানলো কী করে?
এইভাবে না খেয়ে থাকবে কতদিন?”
আতিকা বেগম কিছু না বলে সম্পূর্ণার রুমে গিয়ে,” তুই টাকা পেলি কোথায়? আর তুই দোকানে গেলি কখন? ”
-” বাড়ির সামনে দোকান যখন ইচ্ছে যেতেই পারি। আর আমি খেতে টাকা লাগে না৷ সাইফুল ইসলামের মেয়েকে বাকিতে দিলে তাদের লস নাই। টাকা ওরা ঠিকি পাবে।”
আতিকা বেগম ফিরে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

কেটে গেল টানা একটা মাস। দোকানের খাবার ছাড়া সম্পূর্ণা ঘরে এক গ্লাস পানিও খেত না। আজ দুপুরে যখন দোকানে গেল তখন রাস্তায় হিমেলকে দেখলো রিকশা থেকে নামতে। কাধে একটা ব্যাগ। মনে হচ্ছে কোথাও থেকে এই মাত্র এসেছে। সম্পূর্ণা কথা বলার আগেই হিমেল তাড়াহুড়ো করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। সম্পূর্ণা আর দোকানে না গিয়ে ফিরে এলো। সারাদিন পায়চারি করেছে৷ এইভাবে আর কতদিন। না খেয়ে থাকতে থাকতে যেন নিজেকেও এখন চেনা যায় না। শুকনো কাঠের মতো সোনালী শরীর খানা দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে।
চারদিকে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। আতিকা বেগম আজান শেষ হতেই নামাজ পড়তে গেলেন। তাবিয়াও নিজের রুমে। সাইফুল অসলাম মসজিদে।
লামিয়াদের ঘরের পানি শেষ হওয়ার কারণে বাহিরে কলে আসছে অজু করতে। হঠাৎ দেখে সম্পূর্ণা ভূতুড়েভাবে এক দৌড়ে রাস্তার মাথায় গিয়ে হিমেলদের ঘরে ঢুকে গেল। লামিয়া অজু শেষ করে ভেবেছিল নামাজ পড়া শেষ হতেই ও ফিরে আসবে। হিমেল আজ বাড়ি এসেছে লামিয়াও দেখেছে। লামিয়া আর কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেল। নামাজ শেষ করে উঠতেই দেখে আতিকা বেগমের চিৎকার সম্পূর্ণাকে পাওয়া যাচ্ছে না। লামিয়া বেরিয়ে এসে বলল,” ও এখনো ঘরে আসেনি?”
-” না তো। তুই দেখেছি কোথায় গেছে?”
লামিয়া ভয়ে বলল,” না দেখিনি। তবে হিমেলদের ঘরে দেখতে পারো।কারণ হিমেল দুপুরে বাড়ি এসেছে। আতিকা বেগম, লামিয়া, তাবিয়া গিয়ে দেখে সম্পূর্ণা হিমেলর পা জড়িয়ে পড়ে আছে ওকে রাখার জন্য।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে,
#ঝরা_ফুলের_কান্না
#রাবেয়া_সুলতানা
#৮

আতিকা বেগম মেয়ের এমন দৃশ্য দেখে যেন ভীমড়ি খেলেন। চিৎকার করে বললেন,” সম্পূর্ণা! তোর এই দৃশ্য দেখার জন্য বেঁচে আছি আমরা?”
সম্পূর্ণা হিমেলের পা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হিমেলের এক হাত চেপে ধরে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। আতিকা বেগম ধমক দিয়ে বললেন, ” আয় বাড়ি আয়।”
সম্পূর্ণা বলল,” না আমি যাব না। আমি হিমেলের কাছেই থাকবো। বরং তুমিই এইখান থেকে চলে যাও।”
মসজিদ থেকে মানুষ বেরিয়ে এমন কোলাহল দেখে এগিয়ে এসেছে। একেএকে সবাই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে।সাইফুল ইসলাম মেয়ের হাত টেনে আনতে যাবে তখন হিমেল বলল,” ওকে নিলেই কী ওর মন থেকে আপনি আমার নাম মুছে দিতে পারবেন? আমি এতক্ষণ চুপ ছিলাম আপনার আসার অপেক্ষায়। একমাস আগে আপনি আমায় গ্রাম ছাড়া করেছিলেন লোক লাগিয়ে। আপনি কী ভেবেছেন লোক লাগিয়ে রাখলে আমি আর গ্রামে আসবো না? আপনার ধারণা ভুল।দেখুন আমি গ্রামে এসেছি কেউ আমার একটা বাল ছিড়তে পারেনি।”
কথাটা বলতেই সাইফুল ইসলাম হিমেলের গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে,” আমি যদি চাইতাম না তোদের মা ছেলেকে এইখানেই পুঁতে ফেলতাম।শুধু করুণা করে তোদেরকে থাকতে দিয়েছি এইখানে।আর সেই তুই আজ আমার গলায় ছুরি ধরলি। সম্পূর্ণা চল এইখান থেকে। কত বড় বেয়াদব তুই নিজের চোখে দেখ। এরপরেও তুই ওর সাথে থাকবি?”
-” বাবা হিমেল কোনো অন্যায় করেনি। যা করেছে আমাকে ভালোবেসে করেছে। বরং তুমি অন্যায় করেছ ওদের উপর। তোমরা চলে যাও। আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই না। ”
সাইফুল ইসলাম কিছু বলতে যাবে তখন আতিকা বেগম হাত ধরে বললেন,” চলো এইখান থেকে। থাকুক ও এইখানে। তবে আজ থেকে এই সবার সামনে বলে রাখলাম তুই আমাদের কাছে মৃত। আমার কোনো মেয়ে নেই।”
সাইফুল ইসলাম টলমল চোখে বলল,” আতিকা, তুমি পাগল হয়ে গেছ।মেয়েকে এইখানে রেখে যাবো?”
-” হ্যাঁ যাবো। এই ছাড়া তো উপায় নেই৷ তবে তুই একটা কথা মনে রাখিস, জীবনে যখনই পিছনে ফিরবি তখনই দেখবি তোর মা বাবাই তোর পাশে ছিল।তোর ভালো চায় বলে তোর সব ভুল মাপ করে দিয়ে নতুন করে বাঁচতে দিতে চেয়েছে। যা দুইদিনের ভালোবাসার মানুষ করে না। আর করবেও না। তাহলে কেন তুই আমাদের কষ্ট দিচ্ছিস? আমি জানি না তুই ভালো থাকবি কি-না। তবে আমি তোকে অভিশাপ দিব না। শুধু বলব মা কথাটা উচ্চারণ করিস না। তোর পরিবার তোর পাশে আজ থেকে আর দাঁড়াবে না।” কথাগুলো বলে তিনি সাইফুল ইসলামকে টেনে নিজের ঘরে গেলেন। সাইফুল ইসলাম এসে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। লামিয়ার শ্বশুর শ্বাশুড়ি সবাই এসে বুঝাছে। সাইফুল ইসলাম কোনো কথা বলছেন না। দম মেরে বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ির দশ বছরের একটা ছেলে এসে,” কাকীমা ও কাকীমা হুজুর আসছে সম্পূর্ণা আপুর বিয়ে পড়াতে। হিমেল ভাইয়ার বন্ধুরাও নাকি আসছে। ”
আতিকা বেগম চুপ করে চোখের পানি মুছে নিচ্ছেন। সাইফুল ইসলাম বাহিরের দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বলতে, ” মা এই পঁচা কাজ করিস না। তুই ভালো মেয়ে হয়ে থাকলে তাহলে বাবা তোকে আরও ভালো খেলনা কিনে দেবো। কিন্তু মেয়েটার তো এখন আর খেলনার বয়স নয়। তাই হয়তো মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ফেরাতে পারলাম না।

হুজুর বিয়ে পড়িয়ে গেলেন অনেকক্ষণ হয়ে গেল। সম্পূর্ণা স্থির হয়ে বসে আছে। রাত কিছুটা গভীর হয়ে এলো৷ হিমেলের মা আজ এই ঘরে ঘুমাবেন না।ঘুমাবেনই বা কী করে। একটা মাত্র চৌকি এই ঘরে। আগে মা ছেলে কোনোমতে ঘুমাতো।এখন ছেলের বউ হয়েছে।এইখানে তো আর ঘুমানো যায় না। তাই তিনি পাশের বাড়িতে গিয়ে রাত কাটিয়ে দিবেন ভেবে চলে গেলেন। হিমেল এসে সম্পূর্ণার পাশে বসে হাতটা ধরে আফসুস হচ্ছে?”
সম্পূর্ণা চোখ বড় বড় করে তাকালো তার দিকে। চোখগুলো ভেজা। চোখেমুখে অনুতপ্তের চাপ।
হিমেলের হাতদুটোকে শক্ত করে জড়িয়ে, ” হিমেল,আমি ভুল করিনি তো? আমি তো যা করেছি তোমাকে পাবার জন্য করেছি। কিন্তু এখন কেন ইচ্ছে হচ্ছে বাবাকে একটা নজর দেখতে? বাবাকে জড়িয়ে বলতে বাবা আমাকে মাপ করে দাও। হিমেল আমি ভুল করেছি?”
হিমেল মুচকি হেসে সম্পূর্ণাকে নিজের কাছে টেনে বুকের সাথে লাগিয়ে,” না তুমি কোনো অন্যায় কিংবা ভুল করোনি। তবে চিন্তা করো না। তোমার পরিবার একদিন ঠিক তোমায় মেনে নেবে।”
সম্পূর্ণা ভেজা গলায় বলল,” তোমাকে নেবে না?”
-” তোমাকে নেওয়া মানে তো আমাকে। তাই না?”
সম্পুর্ণা আর কথা বাড়ালো না। আবেগের ভালোবাসা তাকে ঘিরে ফেলেছে।নিজেকে হারাচ্ছে হিমেলের ভালোবাসার কাছে।

রাত দুটো, সাইফুল ইসলাম জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন। অঝর নয়নে গাল ভিজে যাচ্ছে। আতিকা বেগমকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছেন তিনি। নানায় বিনায় কান্না করে যাচ্ছিলো। মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসে সে। আমার কথা বাদ দিলাম। আমি পুরুষ মানুষ।মন পাথরে পরিনত করতে পারব কিন্তু আতিকা নিজেকে সামলাতে পারবে তো? আতিকা হয়তো ভুলে গিয়েছে বেশি ভালোবাসার জিনিস বেশি দিন টিকে না। সহজেই হারিয়ে যায়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আতিকা বেগম নামাজ পড়লেন। তারপর লামিয়াদের ঘরে গিয়ে বললেন, ” লামিয়া হাঁটতে যাবি? চল রাস্তা থেকে হেঁটে আসি।”
লামিয়া ম্লান হেসে দরজা বাহিরে দিয়ে লাগিয়ে, “চলেন চাচী। কিন্তু আপনি তো এত ভোরে হাঁটেন না। আজ সম্পূর্না ওই ঘরে আছে বলেই যাচ্ছেন তাই না?”

আতিকা বেগম হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাথায় এসে বারবার হিমেলদের ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। লামিয়া নিজে থেকে বলল,” দরজা বন্ধ। বুঝা যাচ্ছে এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।”
আতিকা বেগম বললেন,” তুই কার কথা বলছিস? কে ঘুম থেকে উঠেনি?”
-” সম্পূর্ণা।”
-” সে আবার কে?”
লামিয়া আর কথা বাড়ালো না। চুপ করে আছে দেখে আতিকা বেগম বললেন,” ওই নামের মানুষকে কালই কবর দিয়েছি। তাই নতুন মানুষটা চিনতে পারছি না।”
দুজনেই আবার বাড়ির পথে বা বাড়াতেই সম্পূর্ণা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আতিকা বেগমকে রাস্তায় দেখে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আতিকা বেগম বললেন,” লামিয়া এইখান থেকে চল। আমার ঘরে আমার মেয়ে তাবিয়া বসে আছে। এইখানে থাকলে ও চিন্তা করবে।”
কথাটা বলে হনহন করে হেঁটে চলে এলেন।
সম্পূর্ণা আর কিছু বলল না। লামিয়া সম্পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,” এইটা কী করলি তুই? নিজের হাতেই নিজের জীবনটা শেষ করে দিলি? আমি শুধু এটাই ভাবছি তোকে যেন কালকের দিনটার জন্য আফসোস করতে না হয়।” লামিয়াকে কথা বলতে দেখে হিমেলের মা এসে বলল,” সকাল বেলাই শুরু করছ আমার ছেলের বউয়ের কান ভাঙ্গানি? ও এখন আর তোমাগো মেয়ে না। তাই যখন তখন এসে কথা বলবা না। সম্পূর্ণা যা ঘরে যা। কালকে রাতের বাসনকোসনগুলো ধুয়ে নিয়ে আয়। এইখানে আসছোস যখন কাজ করেই খেতে হবে। এমনি এমনি পেটে ভাত যাবে না।” সম্পূর্ণা লামিয়ার কথায় কিছু না বলে ঘরে গেল। এঁটো বাসনগুলো পুকুরে নিয়ে ধুয়ে নিয়ে এসেছে সে। হিমেল আস্তেধীরে ঘুম থেকে উঠে সম্পূর্ণাকে খাটের কিনারায় বসে থাকতে দেখে,” কী ব্যাপার, এইভাবে বসে রইলে যে? মা কোথায়?”
-” ফুফু পাশের বাড়ির কাজে গেছে। তুমি উঠে হাতমুখ ধুয়ে আসো।”
-” তুমি কিছু খাইছো?”
-” আমার খিদে পায়নি। ফুফু বলেছে কালকের পান্তা ভাত আছে তুমি আমি যেন খেয়ে নিই। তুমি খাও আমি ঘর ঝাড়ু দিয়ে ফেলি।”
হিমেল বুঝতে পেরেছে সম্পূর্ণা পান্তা ভাত খায় না। সকাল বেলায় ওর এইসব অভ্যাস নেই। সম্পূর্ণার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে,” অনেক কষ্ট তোমায় সহ্য করতে হবে সম্পূর্ণা। তুমি কাল এইভাবে আসাটা ঠিক হয়নি।আমার কাজ নেই মা পরের বাড়িতে কাজ করে যা পায় তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে যেতো। এখন তুমি এইসবে মানিয়ে নিতে পারবে?”
সম্পূর্ণা শান্ত গলায় বলল, ” পারবো। তুমি পারলে আমিও পারবো। এতদিন আমি ছিলাম না তুমি হেলায় দিন পার করেছ। এখন আমি আসছি একটা কিছু করো।” হিমেল আর কথা না বাড়িয়ে কলে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে শার্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল। বিশ মিনিট পরে এসে ছোট কাগজের একটা প্যাকেট সম্পূর্ণার হাতে দিয়ে,” কই আমাকে ভাত দাও। খেয়ে বের হতে হবে।”
সম্পূর্ণা কাগজের মোড়ানো প্যাকেট খুলে দেখে দুটো সিঙ্গারা আর দুই পিস জিলাপি। গরম গরম সিঙ্গারা দেখে,” হিমেল তুমি আমার জন্য এইসব আনতে গেছো?”
হিমেল হাত ধুয়ে নিজেই ভাত নিয়ে,” হু,আমি তো জানি আমার ছোট্র বউটা সকালে পান্তা ভাত মোটেও খাবে না।তাই ভাবলাম নিয়ে আসি।”
হিমেল ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে, ” মা’কে কিছু বলো না এই ব্যাপারে। না হলে রাগ করবেন।”
-” ফুফুকে ছাড়াই খাব?”
-” হ্যাঁ খাবে।না হলে তোমার কপালে এটাও জুটবে না।”

বিয়ের কয়েকটি দিন পার হলো। হিমেলের মা কয়েকদিন থেকে সম্পূর্ণার কান গলার দিকে তাকিয়ে বলতো কিছু টাকা হলে ঘরটা ঠিক করতে পারতাম। মানুষের ঘরে কয়দিন ঘুমানো যায়?
হিমেল আজ রেগে বলেই ফেললো,” তুমি কথাগুলোকে কেমন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে না বলে সরাসরি বলতে পারো না? ঘরে আসলেই তুমি এই কথাটা বলো।”
হিমেলের মা বললেন,” সম্পূর্ণার কানে এক জোড়া দুল আছে গলায় একটা চেইন। এইগুলো নিশ্চয়ই সোনার হবে তাই না? ওর বাবা মায়ের কী কম আছে না-কি? মায়েকে নকল জিনিস পরানোর মন তাদের নয়। আমি বলি কী ওর এইগুলো বিক্রি করে অন্তত ঘরটা যদি একটু বড় করে আরেকটা চৌকি দেওয়া যেতো তাহলে ভালো হতো।”

হিমেল রাগি গলায় বলল, ” মা তুমি পাগল হয়ে গেছ? এইগুলো ওর সাথে থাকলে মনে হবে ওর বাবা মা ওর পাশেই আছে। আমরা তো কিছুই মেয়েটাকে দিতে পারিনি। এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে ও। দুইটা সুতি শাড়ি এনে দিয়েছিলাম ওইটাতেই কোনোমতে দিন পার করছে ও। তারউপর কোন মুখে ওকে বলবো এইসব? ”
হিমেলের মা কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন। বিড়বিড় করতে করতে পাশের ঘরে গেলেন। হিমেল উঠে এসে দেখে সম্পূর্ণা শুয়ে আছে গুটিসুটি হয়ে। হিমেলকে দেখে উঠে বসে ধীর গলায় বলল, ” তোমার মা ঠিকি বলেছে। আমাদের একটা ঘরের প্রয়োজন। এইভাবে অন্যের ঘরে ঘুমাতে নিশ্চয়ই ফুফুর খারাপ লাগে। কাল তুমি এইগুলো বিক্রি করে টিন কিনে নিয়ে এসো। এইগুলো দেখে বাবা মায়ের অনুভূতি আমি পাই না। বরং কষ্ট লাগে।”
সম্পূর্ণার কথা শুনে হিমেল সম্পূর্ণার কোলে মাথা রেখে,” একদিন দেখবে আমাদের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। সেদিন তোমাকে আমি অনেক অনেক গহনা কিনে দিব।”
সম্পূর্ণা মুচকি হেসে,” লাগবে না আমার এইসব। এইগুলো চিন্তা বাদ দিয়ে কালকের কথা ভাবো। মিস্ত্রি খবর দিয়ে কোনো মতে হলেও ঘরটা ঠিক কর।”
-” দেখি কী করা যায়। সকাল তো হোক।”

চলবে,,,,
চলবে,,,,,

বিঃদ্রঃ গল্পে পানি পড়া কিংবা তাবিজ নিয়ে কিছু কথা উল্লেখ হয়েছে। সেটা নিয়ে কেউ ভুল কিছু ভেবে বসবেন না। আমি যেহেতু আগেই বলেছি এইটা সত্য ঘটনা আর বাস্তব জীবনে গ্রামের অনেক মানুষই এইগুলা বিশ্বাস করে থাকে। তাই সেটা নিয়ে আশা করছি আপনারা টানাটানি করবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here