ঝরা_ফুলের_কান্না পর্ব ৯+১০

সত্য ঘটনা অবলম্বনে,
#ঝরা_ফুলের_কান্না
#রাবেয়া_সুলতানা
#৯

তাবিয়ার গলার চেইনটা লামিয়ার ছোট মেয়েকে কোলে নিতে গিয়ে ছিড়ে যায়। মেয়েটা মনে হয় না বুঝেই টান দিয়েছিল। তাবিয়া সারাকে টেবিলের উপর বসিয়ে চেইনটা নিয়ে দেখছে। এমন সময় সাইফুল ইসলাম নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখে তাবিয়া চেইনটা নিয়ে খুটিয়ে লাগার চেষ্টা করছে। তিনি সোফায় বসে বললেন,” বড় বউ সারা পড়ে যাবে তো। কী করছো তুমি?”
-” বাবা ও আমার চেইটা টেনে ছেড়ে ফেলেছে। এখন দেখছি বাজারে নেওয়া ছাড়া ঠিক হবে না।”
-” চেইনটা একটা কাগজে মুড়িয়ে আমার কাছে দাও। আমি এখন বাজারে যাচ্ছি আসার পথে ঠিক করে নিয়ে আসবো।”
-” ঠিক আছে বাবা।”
তাবিয়া সাইফুল ইসলামের কোলে সারাকে দিয়ে চেইনটাকে কাগজে মুড়িয়ে এনে দিলো। সাইফুল ইসলাম বাজারে যাওয়ার পথে দেখলো সম্পূর্ণার হাত কাটে গেছে আর হিমেলের মা দৌড়ে এসে একটুকরো কাপড় দিয়ে বেঁধে দিচ্ছে। তিনি আর দাঁড়ালেন না। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। গলার মাঝ পথে যেন দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়েছে কিছু একটা। সাইফুল ইসলাম শাহিনের দোকানে এসে, ” কিরে কেমন আছিস?”
-” ভালো।হঠাৎ তুই?”
-” আর বলিস না। বড় বউয়ের চেইনটা ছেড়ে গেছে। তাই ঠিক করাতে নিয়ে আসলাম। ”
-” আচ্ছা তুই বস।” শাহিন দোকানের একটা ছেলেকে ডেকে চেইনটা ঠিক করতে দিয়ে সাইফুল ইসলামকে বলল,” হিমেল আজ দোকানে এসেছে। তোর মেয়ের চেইন আর কানের দুল বিক্রি করেছে। তোর মেয়েটা কী বুঝে এমন একটা কাজ করলো? আসোলে মেয়েটার বয়সটাই খারাপ ছিল। তাই বলে এত বড় ভুল?”
সাইফুল ইসলাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,” তোর ভাবি তো মেয়েটার জন্য কেঁদে অস্থির। চোখের সামনে না খেয়ে থাকে। হিমেলের মা সারাদিন দৌড়ের উপরে রাখে। যে মেয়ে নিজের হাতে ঠিক মতো খেতে পারতো না আজ সে মেয়ে কত কাজ করে। আসার সময় দেখে আসছি রান্না ঘরের চাল বাঁধতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। তুই বল আমার মেয়েটা এইগুলো করেছে?”
-” মেয়েটাকে নিয়ে আয় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে।”
-” ছেলেরা বড় হয়েছে। এখন আমি বাবা হলেও তাদেরও একটা মতামত আছে। বড় দুই ছেলে তো সাফ জানিয়ে দিয়েছে সম্পূর্ণার নামটাও যেন বাড়িতে কেউ না বলে। ছোটটা তো মুখে কিছু না বললেও যে রেগে আছে সেটা তো বুঝি। শুধু এইটুকুই বলে আমাদের আদরের জন্য না-কি আজ এই অবস্থা।”
কথা বলতে বলতে চেইন ঠিক হয়ে গেল। সাইফুল ইসলাম বসে অনেক কথাই বললেন।

হিমেল সম্পূর্ণার হাত কাটা দেখে, ” সাবধানে কাজ করতে পারো না? মা ও মা ওর হাতে এইসব কাজ করানোর দরকার কী। না হলে আরেকটা মিস্ত্রি নিই?”
-” হিমেল, বউয়ের প্রতি এত আবেগী হয়ে যাস না। স্বামীর বাড়ি আসলে সব কাজ করতে হয়।ঘরের সাথে সাথে রান্নাঘরটাও তো ঠিক করতে হবে। এখন যদি মিস্ত্রি নিই তাহলে টাকা লাগবে না?”
-” তাই বলে ওকে দিয়ে করাবে?”
-” কিচ্ছু হবে না। সম্পূর্ণা, যা মই বেয়ে উপরে উঠ আমি খড়গুলো দিচ্ছি তুই সিরিয়ালে বেঁধে দে। বৃষ্টির সময় আর পানি পড়বে না। সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে উপরে উঠতে গিয়ে হাঁটুতে জায়গায় জায়গায় চামড়াগুলো উঠে রক্ত বের হচ্ছে। হাতের ব্যথায়ও অসহ্য লাগছে। কিন্তু কী বলবে? হিমেলের দিকে তাকিয়ে হলেও এইসব করতে হবে৷ সাইফুল ইসলাম রিকশা থেকে নেমে ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে নজর পড়তেই দেখে সম্পূর্ণা রান্নাঘরের বাঁশের উপরে কোনো ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। হিমেলের মা নিচ থেকে খড়ের গোছা তুলে উপরে দিচ্ছে আর সম্পূর্ণা কোনো মতে উপরে বেঁধে দিচ্ছে সারি সারি ভাবে।
তিনি আর কিছু বললেন না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়িতে এসে দেখে,” তাবিয়া এখনো সারাকে নিয়ে বসে দুষ্টামি করছে। চোখে পানি টলমল করছে। কপালের লেখা যদি পাল্টানো যেতো তাহলে মানুষ দৈনিক পাল্টিয়ে নিতো। তাবিয়া আর সম্পূর্ণার মধ্যেই বুঝা যায়। আমার মেয়েটা ছোট বেলা থেকে রাজকন্যার মতো ছিল। কিন্তু আজ তার ভাগ্য চাকরানীর চেয়ে খারাপ অবস্থা। আর তাবিয়ার মা ওকে ছোট বেলা থেকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছে লেখা পড়া করিয়েছে। অনেকদিন না-কি তাদের না খেয়েও থাকতে হয়েছে তার বাবা মারা যাওয়ার পর। কিন্তু আজ তাবিয়া রাজরানীর মতো আছে। এটাই হচ্ছে জীবন। আল্লাহ সবাইকে নিচ থেকে উপরে উপর থেকে নিচে করতে সময় নেন না। তাবিয়া এগিয়ে এসে,” বাবা আপনি বসুন আমি চা নিয়ে আসছি। ”
-” বড় বউ,চা খাব না এখন। তোমার শ্বাশুড়ি মাকে বলো আমি গোসল করবো। লুঙ্গি আর গামছাটা ঘাটে যেন দিয়ে আসে। আর এই নাও চেইন।”
তাবিয়া কাগজটা খুলে দেখে চেইনের সাথে এক জোড়া কানের দুল। দেখে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণার ছিল এইটা। তাবিয়া কপাল কুঁচকে বলল,” বাবা আপনি সম্পূর্ণার কানের দুল নিয়ে এসেছেন কেন? সামান্য কানের দুলের জন্য আপনি ওদের সাথে কথা বলতে গেলেন?”
-” না,হিমেল বাজারে এইগুলো বিক্রি করেছে।চেইনও করেছে। টাকা ছিল না বলে চেইনটা আনতে পারিনি।কানেরগুলো নিয়ে এসেছি।”
তাবিয়া অবাক হয়ে বলল,” এরা মা ছেলে সামান্য এই জিনিসটুকুরও লোভ সামলাতে পারিনি! আমার মনে হয় এইগুলো বিক্রি করে ঘর বানানো হচ্ছে।”
-” থাক আর বাড়াবাড়ি করতে যেও না। তোমার শ্বাশুড়িকে এসব বলার দরকার নেই। পরে আবার নতুন ঝামেলা শুরু হবে। কথাটা বলে তিনি চলে গেলেন।

সারাদিন কাজ সেরে সন্ধ্যায় গোসল করে সম্পূর্ণা না খেয়েই শুয়ে পড়েছে। শরীরের ব্যথায় কাতর হয়ে আছে সে। হিমেলের মা ইশার আগেই আজ ভাত খাতে বসেছেন সম্পূর্ণাকে অনেকবার ডেকেছে ভাত খেতে। কিন্তু সে চুপচাপ শুয়ে আছে। হিমেল বাহিরে থেকে এসে সম্পূর্ণাকে শুয়ে থাকতে দেখে,” মা ও শুয়ে আছে কেন?”
-” কি জানে বাবা। খেতে ডাকলাম রাগ করে মনে হয় কথাও বলে না। সারাদিন কাজ করছে এইটা তোরে বুঝান লাগবে না? এইভাবে শুয়ে না থাকলে তো আবার তুই বুঝবি না সারাদিন কত খাটছে। আরে বাবা, এইসব কী আমি আমার জন্য করি? আমি মরে গেলে তো এইসব তোদেরই তাই না? এখন তোর বউ যদি আমার বদনাম করার জন্য এইসব করে তাহলে আমার কী বলার আছে?”
সম্পূর্ণা উঠে এসে,” ফুফু আমি আপনার বদনাম কেন করতে যাব?আমার ভালো লাগছিল না তাই খেতে আসিনি।”
হিমিলের মা সম্পূর্ণার দিকে তাকিয়ে, ” দুইদিন চুপচাপ থেকে আমাদের দেখাইছো তুমি ভদ্র মাইয়া। হিমেলরে আমি আগেই বলছি বড়লোকের মাইয়ারা রঙ ঢং এইগুলো দেখিয়ে বেড়ায় যখন স্বামীর বাড়ি এসে এইসব পায় না তখন মুখে বুলি ফুটে। হিমেল এখন বিশ্বাস হইছে?”
হিমেল কিছু না বলে নিজের খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সম্পূর্ণা এসে কিনারায় বসে,” সারাদিন তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেরিয়েছ। আমাকে আর ফুফুকে সাহায্য তো করতে পারতা? তুমি এইভাবে কাজ না করে কত দিন থাকবে? একটা কিছুতো কর। ”
-” তুমি আমাকে কাজ করার জন্য বলার কে? তোমাকে কী আমি টেনে নিয়ে আসছি? নিজের ইচ্ছায় তো দেখে শুনে আসছ। আমি তো জোর করে তোমাকে নিয়ে আসিনি।” হিমেলের রাগ দেখে হিমেলের মা বলল,” আমি ঘুমাতে গেলাম। ঘর তো এখনো পুরাপুরি ঠিক হয়নি। কাল ঠিক হলে এই ঘরেই ঘুমাতে পারবো। হিমেলের মা চলে যাওয়ার পরে সম্পূর্ণা গিয়ে দরজা আটকিয়ে এসে আবার বসে পড়লো। হিমেল আবার বলল,” আমি আগেই বলেছিলাম আমার ঘরে এসে কষ্ট সহ্য করে থাকতে হবে।”
সম্পূর্ণা করুণ গলায় বলল,” আমি কী বলেছি কষ্ট সহ্য করতে পারবো না? তুমি একটা কাজ করলে তো আমাদের এত অভাবে পড়তে হয় না। ফুফুও অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয় না। আমি শুধু এই জন্যই বলেছি।”
সম্পূর্ণার কথা শুনে হিমেল এসে সম্পূর্ণার কোলে মাথা রেখে,” আচ্ছা ঠিক আছে কাঁদতে হবে না। কাল থেকে একটা কিছু করবো। এখন চলো খাবে।”
হিমেল কলমিশাক আর আর ডাল দিয়ে ভাত নিয়ে এসেছে। সম্পূর্ণা বলল,” আমার হাত কেটে গেছে খাব কী করে?”
-” হিমেল পানির গ্লাস টেবিলে রেখে,” দাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি।” প্লেট নিয়ে সম্পূর্ণাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল,” মায়ের কথায় কষ্ট পেও না। মা তো এমনি আগেই জানো তুমি। আমার মা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে। হয়তো পড়াশোনা সেইভাবে করাতে পারেনি তাই বলে মাকে তো ফেলে দিতে পারবো না। মা যা বলে শুনে থাকবা। যা করতে বলবে করবা।”
সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে পানি খেয়ে বলল,” বাবাকে দেখেছি মন খারাপ করে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। কারও কিছু হয়েছে?”
-” না। কী হবে?”
-” হু।”
সম্পূর্ণা খাওয়া শেষ করে এসে শুয়ে পড়লো। হিমেল এসে পাশে শুয়ে নানারকম গল্প বলতে বলতে সম্পূর্ণার পায়ের উপর পা রাখতেই সম্পূর্ণা চিৎকার দিয়ে উঠে বসে পড়লো। হিমেল হতভম্ব নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে বলল,” কী হয়েছে? এই সম্পূর্ণা কী হয়েছে তোমার?”
সম্পূর্ণার চোখের পানি টলমল করছে দেখে হিমেল হাঁটুর উপর থেকে কাপড় সরিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,” কীভাবে হলো?”
সম্পূর্ণা ধীরে বলল,” রান্নাঘরের চাউনিটা দিতে গিয়ে। -“মলম নেই ঘরে? একটু মলম তো দিতে?”
-” না নেই।”
হিমেল উঠে শার্টটা গায়ে দিয়ে,” তুমি দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দাও আমি বাজার থেকে আসছি। দেখি ব্যথা কমানোর জন্য ঔষধ নিয়ে আসি।”
হিমেল বাহিরে যেতেই মিনিট দুয়েক পরেই তাবিয়া আর লামিয়া এসেছে মলম নিয়ে। তাবিয়া আর লামিয়াকে দেখে সম্পূর্ণা আবেগে কেঁদেই ফেললো। তাবিয়া মলম লাগাতে লাগাতে বলল,” নিজের বিপদ তুই নিজেই ডেকে এনেছিস। এখন এমন অবস্থা যে তোর ভাইয়ারাও তোর নামটা শুনতে পারে না।”
সম্পূর্ণা তাবিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে বলল,”তোমরা কী করে জানলে হিমেল নেই,আর আমি ব্যথা পেয়েছি?”
লামিয়া বলল,” আমি আর তাবিয়া এসেছি রাস্তায় তোকে দেখার জন্য। তোদের ঘরের পাশে তোর চিৎকার আর কথাবার্তা শুনেই মলম নিয়ে এলাম। তুই দরজাটা এবার আটকিয়ে দে। তাবিয়া চল। দেরি করলে চাচী টের পেলে তোকে আর বাড়িতেও ঢুকতে দিবে না। হিমেল আসার আগেই তাবিয়া আর লামিয়া চলে গেল। হিমেল এসে মলমের ঘ্রাণ পেরে,” ঘরে কে এসেছে?”
সম্পূর্ণা ভয়ে ভয়ে বলল,” লামিয়া ভাবি।”
-” আর কে?”
-” আর কেউ আসেনি। উনি রাস্তায় এসেছে হাঁটতে হাঁটতে। তারপর আমার চিৎকার শুনে মলম নিয়ে এসে দেখে তুমি নেই।”
-” ওহ। ঠিক আছে ঔষধগুলো খেয়ে নাও দেখবে ব্যথা কমে যাবে।”
সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে চুপ করে বসে রইল। হিমেল গিয়ে আবার শুয়ে পড়েছে। জোরালো নিঃশ্বাস শুনে বুঝায়ই যাচ্ছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। সম্পূর্ণা বসে আছে চুপ করেই। পানির গ্লাস নিয়ে ঔষধগুলো খেয়ে চিন্তায় বসেছে কালকের দিনের কথা ভেবে। এইভাবেই কী যাবে তার জীবন? ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয় এইটা সে শুনেছে। তবে এতটা কষ্ট পেতে হবে সেটা হয়তো জানা ছিল না। আচ্ছা সবাই আমাকে বলে আমি আবেগে বাড়ি ছেড়ে এসেছি। তাহলে দশ বছর আগেও যখন বারো/চৌদ্দ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতো তারা কী সংসার করতো না?তাদের কী ছেলেমেয়ে হতো না? তারা কী আবেগ ছাড়াই জন্ম নিয়েছিল? এখন যদি এইটা আমার আবেগ হয় তাহলে তখনকার মেয়েদের কী ছিল? তারা বুদ্ধি মত্তা? আর বুদ্ধি মত্তা ছিল বলেই কী তাদের বিয়ে দিতো? তাহলে আমরা কেন বুদ্ধি মত্তা নয়? ওদের খাবার আমাদের খাবার আলাদা? আমি তো আলাদা কিছুই দেখি না।তাহলে সবাই কেন এমন করে? সবাই কেন বয়সের দোহাই দিয়ে আমায় দোষারোপ করছে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সম্পূর্ণা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে,
#ঝরা_ফুলের_কান্না
#রাবেয়া_সুলতানা
#১০

পরেরদিন সকালেই মিস্ত্রি এসেছে। হিমেলের মা মিস্ত্রিকে বলল আজ থেকে যা লাগবে সম্পূর্ণাকে বলার জন্য। মিস্ত্রির সাথে কামলার মতো খেটেখুটে সন্ধ্যার আগেই ঘরটা ঠিক হয়েছে। আজও সন্ধ্যায় গোসল করে যখন ভাত খেতে গেল পাতিলটা খালি পড়ে আছে। সম্পূর্ণা হিমেলের মা’কে বলল,” ফুফু ভাত নাই?”
-” না নাই। ঘরে চাল নাই। পাশের বাড়ি থেকে এক বাটি নিয়ে আসছি আসার সময়। ওইগুলো আমি আর হিমেল খাইছি। তুই এককাজ কর। বয়ামে মুড়ি আছে পানিতে ভিজিয়ে খেয়ে নে।” সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে পেটে ক্ষুধা নিয়ে মুড়ি পানিতে ভিজিয়ে চিনির পটে দেখে চিনিও নাই। হিমেলের মাকে বলতেই বলল,” মুড়ি খাইতে চিনি লাগে? লবণ দিয়ে মেখে খেয়ে নে।”
সম্পূর্ণা টলমল চোখে কোনোমতে খেয়ে খাটে এসে শুয়ে পড়লো।
প্রতিদিন এইভাবেই যাচ্ছে তার দিন। বিয়ের দুইটা মাস কখন পার হয়ে গেল হিমেল টের না পেলেও সম্পূর্ণা ঠিকে পেয়েছে। এই দুইটা মাস যুগে পরিনত হয়েছে।
পনের দিন থেকে হিমেল গ্যারেজে কাজ করে নিয়মিত। হঠাৎই বাড়ির একটা ছেলে এসে,” হিমেল ভাইয়া আপনার মায় সম্পূর্ণা ভাবিরে বেদম মার মারতেছে।’
হিমেল অবাক হয়ে,” কী বলিস?”
-” হ তাই তো আমি ছুটে এলাম। এই নেন। সাইকেলটা নিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি যান।”

হিমেলের মা রান্না ঘরের বাঁশের সাথে সম্পূর্ণার চুল গুলো প্যাঁচিয়ে মেহগনি গাছের মোটা ঢাল দিয়ে ইচ্ছে মতো মারছে।
সম্পূর্ণা যখন দূর্বল হয়ে পড়ে তখন লাথি দিয়ে চুল টেনে উঠানে নিয়ে ফেলেছে। ”
লামিয়া দৌড়ে এসেও থমকে গেছে হিমেলের মায়ের গালিগালাজ শুনে। অনেকেই গিয়ে আতিকা বেগম আর সাইফুল ইসলামকে বলেছে। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। সবাই চুপ করে বসে আছে। লামিয়া আবার দৌড়ে সাইফুল ইসলামের পায়ে পড়ে,” আপনার আল্লার দোহাই লাগে কাকা। আপনি সম্পূর্ণারে নিয়ে আসেন। এইভাবে থাকলে মরে যাবে।”
সাইফুল ইসলাম শান্ত গলায় বললেন,” তুমি তোমার ঘরে যাও। তুমি এই বাড়ির বড় বউ। শুধু শুধু নিজের মানসম্মান নিচে নামিও না ওর পক্ষে কথা বলে।”

হিমেল সাইকেল রেখে এসে দেখে, সম্পূর্ণা এখনো উঠানেই বসে কাতরাচ্ছে। হিমেল এসে বুকের সাথে মিলিয়ে,” কী হয়েছে তোমার? মা কেন তোমাকে মারছে?”
সম্পূর্ণা শুধু মাথা নাড়িয়ে পানি চাইছে। হিমেল দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে পানি এনে দিয়েছে। পানি খেয়ে সম্পূর্ণা বলল,” আমারে নিয়ে একটু খাটে শুয়ে দাও। আমি উঠতে পারছি না।”
হিমেল কাঁদো কাঁদো হয়ে সম্পূর্ণাকে নিয়ে শুয়ে দিয়ে,” মা ও মা, তুমি ওরে এইভাবে মারছ কেন? কী করছে ও?”
-” কী আর করবো? রান্না করতে দিছি গিয়া দেখি ওইখানেই মাটিতে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। যে আমি বলেছি তখনই আমার মুখে মুখে তর্ক। আমি কী ওর তর্ক শুনার জন্য তোরে মানুষ করছি? তুই কী আমার জন্য ভাড়া কইরা লোক নিয়ে আসছোস?”
কথাগুলো বলে বিড়বিড় করতে করতে হিমেলের মা বাহিরে চলে গেলেন। হিমেল সম্পূর্ণার পিঠে মালিশ করে দিতে দিতে,” তোমাকে বলেছিলাম না? মায়ের সাথে তর্ক করতে না। তাহলে কেন করেছ?”
সম্পূর্ণা শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তবুও আস্তে আস্তে বলল,” আমি কতদিন ঠিক করে খাইনি। ভাত চাইলেই ফুফু মুড়ি খাইতে বলে। শেষ কবে খাইছি জানি না। হয়তো তাই শরীর খারাপ করছে। রান্নাঘরে মাথাটা কেমন জানি করে উঠলো তাই শুয়ে গেলাম৷ তখন আমি বুঝতেই পারিনি ওইটা রান্নাঘর ছিল। কিন্তু ফুফু এসে আমাকে কয়েকটা চড় থাপ্পড় মেরে উঠিয়ে অনেক কথা শুনাতে লাগলো। মা বাবা তুলেও গালাগালি করছিল। তাই আমি আর সহ্য করতে না পেরে বলেছিলাম আপনি আমার বাবা মা’কে গালাগালি না করে নিজের বাবা মাকে করেন। তাহলে কবরে থেকেও তারা আপনার জন্য দোয়া করবেন। তারপর ফুফু কী করলো আমি বুঝে উঠতে পারিনি।”
হিমেল সম্পূর্ণার ক্ষত জায়গায় মলম লাগিয়ে দিয়ে,” তুমি বসো। আমি আসছি।”
হিমেল বাজারে গিয়ে হোটেল থেকে বিশ টাকার ভাত আর ত্রিশ টাকার তরকারি নিয়ে এসেছে। সাথে বাসের দুইটি টিকেট।
সম্পূর্ণাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে কোনো রকম জামাকাপড় কিছু গুছিয়ে ব্যাগে নিলো। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়েছে তখন সম্পূর্ণাকে ডেকে মাথা আঁচড়াতে বলল।”
-” এত রাতে মাথা আঁচড়াবো কেন?”
-” আস্তে কথা বলো। মা উঠে যাবে। আর উঠে গেলেই যেতে পারবে না।”
-” কোথায় যাব আমরা?”
-“চিটাগং। ”
-” এত রাতে?কিন্তু কেন?”
-” আরে রাত বেশি হয়নি। আমি চাই না তুমি এইভাবে কষ্ট পাও। আমি জানি মা যখন তোমার গায়ে একবার হাত তুলেছে তাহলে এখন বারবার তুলবে। এরচেয়ে বরং চলো আমরা এইখান থেকে চলে যাই।”
-” আমরা গিয়ে কোথায় থাকবো হিমেল? তোমার কাছেও তো টাকা পয়সা নেই।”
-” আরে চিন্তা করো না। গ্যারেজে যে কয়দিন কাজ করছি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসেছি। দেখি না! গেলে একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নিবো। চিটাগং সব আমার চেনা।”
সেদিন বেরিয়ে পড়লো হিমেল আর সম্পূর্ণা। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারেনি। সকালে হিমেলের মায়ের আহাজারি আর আর্তনাদে কেঁপে ছিল বাড়ির উঠান। তবে সম্পূর্ণার জন্য নয় শুধুই হিমেলের জন্য। সম্পূর্ণার বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গালাগালি করছে দেখে সাইফুল ইসলাম বেরিয়ে এলেন।
তিনি ধমকের স্বরে বললেন, “কী হয়েছে তোর? তোর ছেলে মরছে না-কি এমন মরা কান্না করছিস?”
-” তোর মেয়ে মরছে হারামজাদা। তোর মাইয়ার কারণে আজ আমার ছেলে আমারে রাখি কোথায় গেছে কে জানে? তাড়াতাড়ি তোর মাইয়ারে বল আমার ছেলেরে আমারে ফিরত দিতে। না হলে আমি চেয়ারম্যানকে জানাবো। থানায় মামলাও করবো।”
-” যা কর। তুই কী মনে করছোস? কাল যে তুই আমার মেয়েকে এইভাবে মারছস আমি কিছু জানি না? তোর কপাল ভালো আমি তোর গায়ে হাত তুলিনি এখনো পর্যন্ত। তুই যা কোথায় যাবি যা। আমি যদি একবার নামি তাহলে সারাজীবন প্রস্তাবি মা ছেলে মিলে।”
সাইফুল ইসলাম কথাগুলো বলে দরজা লাগিয়ে দিলেন। সেই দিন থেকে হিমেলের মা প্রায়সময় গিয়ে ঝগড়াঝাটি করতেই থাকতো।
আর এইদিকে হিমেল প্রথম দিকে ভালোই ছিল আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে লাগলো। সাথে সাথে আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়ে গেল। যে আমাকে মারার জন্য বাড়ি ছেড়ে ছিল। একদিন যেই আমাকে প্রাণেই মেরে ফেলতে চেয়েছে। কথাটা শুনতেই কেমন যেন। তাই না?”

আফরা কান্নাক্লান্ত চোখে সম্পূর্ণার কাঁধে হাত দিয়ে,” হিমেলকে ছেড়ে আসার পর বিয়েটা করে নিলে? নাকি এখনো হিমেলের ঘরেই আছো?”
সম্পূর্ণা আফরার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,” জীবনে তো আরও রহস্যময় কাহিনি ঘটে গেছে। হিমেলের থেকে আসার পর আমার দিক থেকে ডিভোর্সটা হয়ে যায়। হিমেল আর বাড়ি আসেনি। বাবা থানায় মামলা করেছিল অবশ্য হিমেলকে পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রামের ঠিকানা দিয়েছিলাম পুলিশ গিয়ে সেখানেও পায়নি। জানি না তখন কোথায় গিয়েছিল। একবছর পরে আজমল আংকেলের এক আত্মীয় এসেছিল আমাকে দেখতে। তিনিই নিয়ে এসেছিলেন তাদের। মেজ ভাইয়া তখন বাড়িতে এসেছে বিয়ে করার জন্য। বাবা বলেছিল যদি এইখানে আমার বিয়েটা হয় তাহলে ভাইয়ার সাথে একসাথেই অনুষ্ঠান করে বিয়েটা হবে। এক বছরে হিমেলের দেওয়া কষ্টগুলো ভুলতে ইচ্ছে করছিল। কেন জানি মনে হচ্ছিল হিমেলকে একবার সুযোগ দিলে ভালো হতো না? মনের কোণে আবার শয়তান বাসা বেঁধে ছিল। কিন্তু তাবিয়া ভাবি বুঝে ফেলেছে আমার মনের কথা হয়তো। তিনিই বুঝালেন রাতভর। আবার মনকে শান্ত করলাম। মেজ ভাইয়ার বিয়েটাই আগে হয়েছিল। কারণ সেদিন পাত্র পক্ষ আমাকে দেখে গিয়ে কিছু জানায়নি। শুধু বলেছিল পরে জানাবে। বাবা ভেবেছিল তারা হয়তো আর আসবেন না। তাই মেজ ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে যায়। ভাইয়ার বিয়ের একমাস যেতেই ছেলে পক্ষ আবার আসে সাথে তাদের ছেলেকে নিয়ে। সেদিন এসেছিল শাদাব, তার মা,বোন, বড় ভাইয়ের বউ, আর ছোট ভাই। সাথে আজমল আংকেলেও ছিলেন। ছেলের মা হঠাৎই আমার হাতে আংটি পরিয়ে দিতেই বাবা হতবাক হলেন। আজমল আংকেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,” আংটি পরানোর কথা তো ছিল না আজ? তাহলে? আংকেল বাবাকে আস্বস্ত করে বললেন,” আমিই বলেছিলাম কারণ আমাদের সব তো দেখাশোনাই আছে। তাহলে শুধু শুধু দেরি করে কী হবে?” বাবা আর কথা বাড়ালেন না। শাদাব হঠাৎ করে মুখ ভেঙে বলল,” আমার সাথে আলাদা কথা বলা যাবে কি-না?”
সবাই এক কথায় রাজি হয়ে গেল। সেদিন শাদাবকে দেখে আমার মনে হয়েছিল ওভার স্মার্ট, অহংকারী, রাগী, গম্ভীর। কিন্তু এইগুলো মনে হলে কী হবে! পরিবারের খুশি মানে আমার খুশি। নিজের রুমে এসে খাটের কিনারায় বসলাম,,,।

চলবে,,,,,,
চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here