ঝরা_ফুলের_কান্না পর্ব ১১+১২

সত্য ঘটনা অবলম্বনে,
#ঝরা_ফুলের_কান্না
#রাবেয়া সুলতানা
#১১

শাদাব এসে সসম্পূর্ণার খাটের কোণেয় গিয়ে বসলো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” আগের বিয়েটা ভেঙেছে কেন? যদিও আমি কিছুটা শুনেছি তবে আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”
সম্পূর্ণা কথাটা শুনে চুপ করে আছে দেখে শাদাব বলল,” দেখুন সারাজীবন কাটাবেন যেই মানুষটার সাথে তাকেই যদি বিশ্বাস করতে না পারেন তাহলে করবেন কাকে? জানি না মা কেন আপনাকে এক দেখায় পছন্দ করে ফেলেছে। এখন এসে দেখলাম আপনি পছন্দের যোগ্য মানুষ। কিন্তু আপনার অতীত তো আমায় জানতে হবে তাই না? আমি যেহেতু আগে বিয়ে করেনি লোকে শুনলে কী বলবে বলেন? কিন্তু আমার মা আর বড় ভাই আপনাকে বিয়ে করাবেই। আমরা যারা প্রবাসী তারা পরিবারের সাপোর্টই বিয়ে করতে হয়। কারণ সেখানে তো আর প্রেম করার মতো সময়ও থাকে না। তাই বাড়ি আসলে বাবা মা যা বলে তাই হয়।”
সম্পুর্ণা এখানো নিচের দিকে তাকিয়ে চোখের কোণ থেকে টপটপ করে পানি ফ্লোরে পড়ছে। শাদাব সেদিকে লক্ষ্য করতেই বলল,” আপনি কী এই বিয়েতে রাজি না? যদি না থাকেন বলেন আমি নিষেধ করে দিব।”
সম্পূর্ণা শ্লেষ গলায় বলল,” আমি ইচ্ছে করে বিয়েটা ভাঙতে চাইনি। আসোলে সবকিছু সহ্য করলেও কিছু নির্যাতন সহ্য করা যায় না। তাই হয়তো আমার ডিভোর্সটা হয়েছে। কিন্তু এতে যদি আপনার দ্বিমত থাকে তাহলে বিয়েটা করা কী ঠিক হবে?”
শাদাব মুচকি হেসে বলল,” আপনি তো ভালোই কথা বলতে পারেন। আমার যা বুঝার বুঝেছি। তাহলে আমি আসছি আপনি কী আমার সাথে যাবেন না এইখানেই থাকবেন?”
-” আমি এইখানেই আছি।আপনি যেতে পারেন।”
শাদাব গিয়ে বসতেই তার বড় ভাবি বলল,” ভাইয়া,কেমন দেখলেন?”
শাদাব মুচকি হেসে বলল, ” ভালো।”
শাদাবের মা বললেন,” তাহলে আপনারা সন্ধ্যায় বাজারেই বসে পাকা কথা বলেন। দেখুন এই বাড়ি ওই বাড়িতে ঝামেলার দরকার নেই। আজমল রাজি হয়ে একগাল হেসে বললেন, ” ভাবি ঠিক বলেছেন। তাহলে আজ উঠাই যাক।”
সেদিন যাওয়ার সময় শাদাব তাবিয়ার নাম্বারটা নিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার পরেই রাত আটটায় শাদাব তাবিয়ার ফোনে কল দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে সম্পূর্ণার কাছে দিতে বলল,” সম্পূর্ণা কথা বলবে না বলবে না বললেও তাবিয়া জোর করেই ফোনটা তার হাতে দিলো। সম্পূর্ণা সালাম দিয়ে,” জি বলুন?”
-” কেমন আছেন?”
-” আলহামদুলিল্লাহ। ”
-“জিজ্ঞেস করবেন না আমি কেমন আছি?”
-” বিকেলেই তো দেখেছি আপনি ভালোই আছেন।”
-” সে জন্য জিজ্ঞেস করবেন না? এইটা ঠিক বললেন না। যাইহোক, কিছু শুনেছেন?”
-” কী?”
-” আপনার বাবা বাড়ি এখনো যায়নি?”
-” না।”
-” সত্যিই শুনেননি?”
-” বললাম তো না।”
-” রেগে যাচ্ছেন কেন?”
-” স্যরি আসোলে…..
-” ইট’স ওকে আমিই বলছি লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে। বিয়েটা সামনের শুক্রবার হচ্ছে। এখন যেহেতু আশি পার্সেন্ট হয়েই গেল তুমি করে বলা যায় না?”
-” আপনার ইচ্ছে।”
-” আমার তো ইচ্ছে বলার।”
-” তাহলে ঢং করছেন কেন?”
-” এই তুমি কী এইভাবে রসকষহীন কাঠখোট্টা কথা বলো।”
-” বলতে পারছি না। তবে জানি এমন ছিলাম না।”
-” তাহলে নো প্রবলেম আমি ঠিক করে নিবো।”
কথাটা বলেই লাইনটা কেটে দিলো শাদাব। কারণ তার বড় ভাইয়ের বউ আর বোন পিছনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ অনেক কথায় শুনেছে। কিন্তু কেউ কিছু বলল না সবাই মুচকি হেসে চলে গেল। শাদাব লজ্জা পেয়েছে খানিকটা। নিজেকে বেহায়া মনে হচ্ছে।

শাদাবের বড় ভাবি শারমিন এসে ইয়াসমিন বেগমের পাশে বসে বলল,” আম্মা একটা কথা বলি?”
-” হ্যাঁ বল।”
-” শাদাব ভাইয়া কেমন পাল্টে গেল না একদিনে?”
-” কেন?”
-” আপনি বলুন। ফ্রান্স থেকে আসার পর কারো সাথে তেমন কথা বলেনি। কেমন গম্ভীর হয়ে থাকতো।কিন্তু এখন দেখি ওই মেয়েটার সাথে কী সুন্দর করে কথা বলছে।”
-” আরে বলুক। বিয়েটা যখন হবেই বললে আর সমস্যা কী?”
-” সে জন্য বলছি না আম্মা। কেমন জানি।”
ইয়াসমিন বেগম কিছু বললেন না। চুপ করে আছেন দেখে শারমিনও কথা বাড়ালো না।

দুইদিন পরে হিমেলের মা সম্পূর্ণার বিয়ের কথা শুনে
দৌড়ে এলেন সাইফুল ইসলামের বাড়ি। কিছুটা পাগলের মতো ছুটেই এলেন। আতিকা বেগমের হাতে পায়ে ধরে বললেন,” সম্পূর্ণারে বলেন আমার পোলাটারে এনে দিতে। আমি সত্যি বলতেছি আপনাদের বিয়েতে আমি কিছু করবো না। কাউকে কিছু বলবো না।”
আতিকা বেগম বললেন, ” তুই বললেই কী আর না বললেই কী। ছেলে পক্ষ সব জেনেই বিয়ে করতে আসতেছে। তুই এইখান থেকে যা। শুধু শুধু কথা বাড়াস না। আদীলের বাপ আসলে তোরে দেখলে গায়ে হাত তুলবো।”
-” ভাবি, আপনারা তো জানেন আমি কেমন করে পোলাটারে মানুষ করছি। সম্পূর্ণা ফিরে আসছে কিন্তু আমার পোলা তো আসে নাই।আমি কারে নিয়া থাকবো বলেন?”
-” তুই এইখান থেকে যা। আমরা কোথায় থেকে তোর ছেলে এনে দিব?”
-” সম্পূর্নারে বলেন।”
-” হিমেলের মা এখন আমারই রাগ লাগে। যা এখন। কাজের সময় যত আজগুবি কথাবার্তা।”
এমন সময় তাবিয়া এসে,” মা, বাবা আসতেছে।”
কথাটা শুনেই হিমেলের মা সেখান থেকে চলে গেল। সাইফুল ইসলাম এসে চেয়ার নিয়ে বসে বললেন,” ডেকোরেশনের লোকদের বলে আসছি। বড় বউ, মেজ বউ গিয়ে কী কী কেনাকাটা করা লাগবে নিয়ে আসুক। সাথে আশিকরে নিয়ে যাক। আশিক কোথায়? মেজ বউ আশিকরে একটু ডাকো তো।”
-” বাবা ও তো বাজারে গেছে।”
-” ওহ তাহলে ও আসলে তোমরা বেরিয়ে পড়ো। সম্পূর্ণা গেলে ওকে নিয়ে যাও।”

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। সুন্দর করে বিয়েটাও হলো। বিদায়ের বেলা যেন সম্পূর্ণার চোখ দুটো পুরোই শুকনো ছিল। বড় ভাবিই সবচেয়ে বেশি কেঁদছিল আমার জন্য। মায়াটা বড় অদ্ভুত ছিল তার সাথে। কখনো ননদ হিসেবে দেখেনি। মেজ ভাবির বিয়ে হয়েছে কয়দিনই বা হলো। আমিও তার সাথে তেমন কথা বলতাম না। আর সে বললেও চুপ করে শুনে হ্যাঁ না বলেই উত্তর দিতাম। ভাইয়া মেজ ভাবিকে নিয়ে যাবে লন্ডন। তাই মায়া বাড়িয়ে লাভ কী। থাকুক না যেই যার মতো করে।
ভাবতে ভাবতেই শাদাবদের বাড়ির সামনে গাড়ি থমকে দাঁড়িয়েছে। শাদাবের বড় বোন আমাকে ধরে গেইটের ভিতর ঢুকালো। আড় চোখে যা বুঝলাম দোতলা বাড়ির সামনে অনেক গাছগাছালি। আমাকে ঘরে নিয়ে তার মায়ের রুমে বসিয়েছে। চাচী, জ্যাঠি, ফুফু, দাদী, নানীরা সবাই এসে আমার চারপাশ ঘিরে কেউ দাঁড়িয়ে আবার কেউ বসেছে। হঠাৎই শাদাবের মা সামনে আসতেই কানে ভেসে এলো পা ছুঁয়ে সালাম করতে। আমিও করলাম। আগেরটা ভালোবাসার বিয়ে ছিল। অনেকেই বলে ভালোবাসার বিয়েতে সুখী হওয়া যায় না। এবার তো বাবা মায়ের পছন্দ মতো করেছি দেখা যাক না কত সুখ কপালে আছে।
সালাম করে দাঁড়াতেই তিনি একটা চেইন বের করে আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। একে একে দেখলাম সবাই একটা না একটা কিছু দিয়েই দোয়া করে যাচ্ছে। বেশির ভাগ লোকের দোয়া ছিল একবছরের ভিতর নাতি চাই। তবে এইটা কেমন দোয়া কোন হাদিস থেকে করেছে আমার জানা নাই। হয়তো এইটা কোনো তাদের বানানো নতুন হাদিস। এর ব্যাখ্যা নেই তাই।

সন্ধ্যায় ওরা নাশতা খাচ্ছে সবাই মিলে। আমাকেও এনে দিলো।চা আর মুড়ি মাখানো। ছোলা, চানাচুর, আর মাংসের ঝোল দিয়ে মাখানো। বড় একটা গামলায় এনেছে। আমাকে খেতে বলছে। ক্ষিধে পেট চোঁ চোঁ করছে কিন্তু ইচ্ছে করছে না। শাদাবের বোন চা নিয়ে এলো সবার জন্য। আমাকেও এককাপ দিলো। চা খেলে হয়তো মাথা ব্যথাটা কমে যাবে। এমন সময় শাদাব এসে নিজের ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। সবাই মুচকি হাসছে। শাদাবের ফোন এগিয়ে দেওয়াতে আমি ফোন হাতে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নিচে নামালাম। কানে দিতেই দেখি বড় ভাবি। ভালো আছি কিনা জিজ্ঞেস করতেই বললাম, ” ভালো।” কিন্তু মনে মনে বললাম ভালো থাকার জন্যই তো আমাকে বিয়ে দিয়েছো। তাহলে আর জিজ্ঞেস করছো কেন?
কয়েকটা কথা বলেই রেখে দিলাম। দেখি শাদাব দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। কাপটা আমারই ছিল। ফোন বাড়াতেই চায়ের কাপটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ফোন নিয়ে। সবাই হয়তো বিষয়টা খেয়াল করেনি। কিন্তু আমার অদ্ভুত লাগছে। খুব খুব অদ্ভুত,,,,
সত্য ঘটনা অবলম্বনে,
#ঝরা_ফুলের_কান্না
#রাবেয়া_সুলতানা
#১২

রাতে ফুলে সাজানো বাসর ঘরে গেলাম। শাদাবের জ্যাঠাতো ভাইয়ের বউ নিয়ে এসেছে আমায়। ভাবি আমাকে খাটে বসাতে চাইলেন। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন লজ্জা কেন পাচ্ছি। আমি মাথা নাড়িয়ে বুঝলাম লজ্জা পাচ্ছি না। কিন্তু তাদের আমি বুঝাতে পারবো না হিমেলের কথা আমার খুব মনে পড়ছে। ফুল দিয়ে সাজানো কিংবা রাজকীয় ঘর ছিল না। কিন্তু হিমেলের প্রতি ভালোবাসা ছিল অগাধ। হঠাৎ শাদাব এলো। কিন্তু বাসর ঘরে তাকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না টাকার জন্য। সম্পূর্ণা তাকিয়ে ছিল সেইদিকে। শাদাব সম্পূর্ণার দিকে তাকিয়ে কোনো রকম টাকাটা দিয়ে রুমে ঢুকলো। বড় ভাবি বলল তোরা কথা বল আমরা যাই। আর সম্পূর্ণা, ওই লাগেজে জামাকাপড় সব আছে।তোমার যা লাগবে ওইখান থেকে নিয়ে নিও।”
-” সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। শাদাব গিয়ে দরজাটা আটকিয়ে দিয়ে,” দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। সম্পূর্ণা বসলো খাটের কিনারায়। শাদাব হাত টেনেই সম্পূর্ণাকে খাটের মাঝখানে বসিয়ে,” তোমার চ্যাটাং চ্যাটাং কথাগুলো এখন বলো তো একটু শুনি।”
সম্পূর্ণা চুপ করে রইল। শাদাব আবার বলল,” ভালোবাসা আমি জানি না।তবে ভাবছি তোমার কাছ থেকে শেখবো।” কথাটা বলতেই সম্পূর্ণা শাদাবের দিকে তাকিয়ে, ” কী বলতে চাইছেন?”
-” বললাম আরকি তোমার কাছ থেকে শেখব। কারণ আমার থেকে তুমিই ভালো জানো।”
সম্পূর্ণা কিছু বলল না। হঠাৎ শাদাব সম্পূর্ণা একেবারে সামনে বসে গাঢ় গলায় বলল,” তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরলে কী বেশ ক্ষতি হবে?”
-” সম্পূর্ণা ম্লান হেসে বলল,” আমি তো ভেবেছিলাম অনুমতির আপনার প্রয়োজন হবে না। কারণ আপনি বিয়ে করেছেন ধুমধামে ফ্যামিলিকে জানিয়ে। চোরা চোরির তো কিছু নেই। আপনার যা ইচ্ছে করতে পারেন। আমার বাঁধা দেওয়ার অধিকার নেই। কারণ আপনি আমাকে সবার সামনে দিয়ে এনেছেন।”
শাদাব মুচকি হেসে,” ঠিকি বলেছ। দশ লক্ষ টাকা কাবিন দিয়েছি। তাহলে আর অনুমতি কিসের! কথাটা বলেই সম্পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরলো। রাতে অনেক কথা হলো। সেদিন কেন জানি মানুষটার প্রতি নিজের ভালো লাগা করেছে। না চাইতেই সবকিছু উজাড় করেছিলাম। গভীর রাতে যখন দুটো মানুষ এক হবো তখন তার নজর পড়ে আমার অপারেশনের জায়গায়। সে অবাক বিস্ময়কর গলায় বলল,” তোমার এইখানে কী হয়েছে?”
সম্পূর্ণা কী বলবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ এমন প্রশ্ন নিজেকে ঘাবড়ে গিয়েছে সে। ঘামতে শুরু করেছে।
সম্পূর্ণা চুপ করে আছে দেখে শাদাব আবার ধমক দিয়ে বলল,” কী হয়েছে বলবে তো। না হলে কাল তোমাকে ডাক্তার কাছে নিয়ে যাব।তখনই বুঝা যাবে তুমি কী লোকাচ্ছ।”
সম্পূর্ণা চোখ বন্ধ করে বলে ফেললো,” আমার একটা কিডনি নেই।”
শাদাব উৎকণ্ঠে বলল,” মানে? এই তোমার কিডনি নাই মানে কী? ফাইজলামি করো?”
-” আপনি সেদিন বললেন না আমার ডিভোর্স হয়েছিল কেন?”
-” হ্যাঁ তার সাথে কিডনির সম্পর্ক? ”
সম্পূর্ণা তখন হিমেলের ব্যপারে সব খুলে বলল।শাদাব শুনে শান্ত গলায় বলল,” তুমি সেদিন পুলিশকে না জানিয়ে নোয়াখালী কেন এসেছ? ওই ডাক্তার? ওরাও পুলিশকে জানাতে পারলো না? এইটা কেমন কথা?”
-” ডাক্তার জানাতে বলেছিল। আমি জানাইনি। ভালোবাসতাম তো মানুষটাকে। তাই কষ্ট বাড়াতে চাইনি। ওর কিছু হলে সেই কষ্টটা আমারই হতো।”
শাদাব মুখে আর কিছু না বলে উঠে চলে যেতে চাইলে সম্পূর্না হাত ধরে মাঝ পথেই, “চলে যাবেন? আপনি যেভাবে বলেছেন তাই তো করেছি।তাহলে চলে যাচ্ছেন কেন?”
-” আমার মুড নেই। তুমি ঘুমাও।”
-” আমি তো ঘুমাবো না। আমি জানি আপনি আফসোস করছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে বলতে চেয়েও সেদিন পারিনি। আমার পরিবারের খুশি ভাঙতে চাইনি। জীবনে কারও জন্য কিছু করতে পারলাম না। তাই আপনাকে ঠকিয়ে হয়তো করেছি। আপনি আমাকে মাপ করে দিন প্লিজ।”
শাদাব কিছু না বলেই উঠে গেল। বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরিয়ে বসে রইল। একটার পর একটা ধরিয়ে নিচ্ছে। ভোরের আগ মুহুর্তে রুমে গিয়ে সম্পূর্ণার দিকে তাকিয়ে হয়তো নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। উন্মাদ এক ভালোবাসায় নিজেকে হারালো সম্পূর্ণার মাঝে।

সম্পূর্ণা সকালেই উঠে দরজা খুলতেই অনেকগুলো ছেলেমেয়ে এসে ঢুকে পড়লো। হৈচৈ তে শাদাবের ঘুম ভেঙতেই দেখে সম্পূর্ণা নেই।আছে কতগুলো ছোট ছেলেমেয়ে। উঠে ফ্রেশ হয়ে নিজের মায়ের ঘরে গেল। সেখানে গিয়ে দেখে সম্পূর্ণা বসে আছে। শাদাবের বড় ভাবি এসে শাদাবের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসে বলল,” রাত কেমন কাটালেন?”
শাদাব বলল,” মা’কে ডাকো তো। কথা আছে।”
-” বিয়ের পরের দিন মানুষ ভাইয়ের বউদের সাথে সব শেয়ার করে আপনি কী মায়ের সাথে করবেন?”
শাদাব ধমক দিয়ে বলল,” তোমাকে এত কিছু জিজ্ঞেস করেছি? তখন থেকে বকবক করে যাচ্ছ।মা ও মা। ”
শাদাবের ধমক শুনে ইয়াসমিন বেগম এসে চেঁচাচ্ছিস কেন? তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক আসবে। ডেকোরেশনের লোকেরা রান্না করছে। কী লাগবে না লাগবে দেখতে হচ্ছে না? এই যে এতগুলো লোক। সকালে তাদের খাবারেরও ব্যবস্থা করতে হবে তাই না?”
-” মা তোমার ঘরে আসো। আমি এখন তোমার সাথে কথা বলতে চাই।”
-” ঠিক আছে চল। ”
ইয়াসমিন বেগম এসেই দেখে সম্পূর্ণা সেখানে আছে।
শাদাব মাকে বলল,” বিয়েটা তোমরা জেনে আমায় করিয়েছ না-কি না জেনে?”
-” জানবো না কেন? দেখ শাদাব বিয়েটা ওর আগে হয়েছে মানছি কিন্তু মেয়েটা ভালো সুন্দরী।”
-” সুন্দরী দিয়ে পানি খাবো? না-কি চায়ের মধ্যে বিস্কুট চুবিয়ে খাব? তুমি জানো ওর একটা কিডনি নেই? ”
ইয়াসমিন বেগম হতভম্ব হয়ে বললেন,” কী বলছিস?”
-” মা আমি সত্যি বলছি। শেষে জেনে শুনে তোমরা আমাকে এই মেয়েটাকেই বিয়ে করালে? আমার কিসের অভাব ছিল মা? যার জন্য আমাকে বিবাহিত একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে?”
সম্পূর্ণা চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।ভেবেছিল শাদাব তার ভালোবাসার পরশ পেয়ে সব ভুলে যাবে। কিন্তু ধারণাটা এতটাই ভুল যে সে কল্পনায়ও করতে পারেনি।”
ইয়াসমিন বেগম ছেলের কথা শুনে সম্পূর্ণার দিকে তাকিয়ে, ” কী ব্যাপার ছোট বউ? তোমার পরিবার আমাদের এইভাবে ঠকানোর মানে কী? তাদের মেয়ে চলছিল না বলে আমাদের কাঁধে ঝুলাবে? আজমল কে ফোন দে। আমি কথা বলবো। উনিও তো সব জেনে আমাদের কিছু বললেন না।”
শাদাব বলল,” এখন জল ঘোলা করে লাভ নেই। মেহমান সবাই চলে যাক তারপর এইটা নিয়ে কথা বলা যাবে।” কথাটা বলে শাদাব নিজের রুমে এলো। ইয়াসমিন বেগম লোকলজ্জার ভয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। সম্পূর্ণা মাথা নিচু করে সেই ঘর থেকে এসে শাদাবের ঘরে এসে,” আপনার কথাগুলো আজই বলতে হলো?”
শাদাব চুপ করে শার্ট পরছে। সম্পূর্ণা আবার বলল, ” বিয়েটা কী আমি নিজের ইচ্ছে করেছি? আপনিই তো আমাকে পছন্দ করে এনেছেন।কিন্তু এখন আমাকে আপনি দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। তাহলে কী আপনি আমাকে কাল রাতে শরীরের প্রয়োজনে এনেছেন?”
শাদাব শার্টের হাতা ভাজ করে সম্পূর্ণার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে,” জীবনে তিড়িংবিড়িং কম করোনি। আমি তো ওই হিমেল নামের ছেলেটার কোনো দোষ দেখছি না। তুমি যদি বেহায়া মেয়েদের মতো তার ঘরে না যেতে সেতো তোমায় নিতো না। বাপরে বাপ কী ভালোবাসা। এক মাস কেউ না খেয়ে থাকতে পারে? আমি জানি না সেদিন কী দেখে তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। তোমার এই চেহারা পিছনে যে এত নোংরামি লুকিয়ে আছে আগে জানলে তোমার দিকে থুতু ফেলতাম না।”
শাদাব কথাগুলো বলে পা বাড়াতেই সম্পূর্ণা কিছু বলতে যাবে তখন শাদাব বলল, ” লিসেন, তুমি আজ থেকে আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে। আমি যদি বলি বসে থাকতে বসে থাকবে। আমি যদি বলি দাঁড়িয়ে থাকতে দাঁড়িয়ে থাকবে। এর অন্যথায় করেছ সোজা বাপের বাড়ি। এইবার তো আমার মা ভুল করেছে দ্বিতীয়বার কেউ করবে না।”

কথাগুলো বলে শাদাব বেরিয়ে গেল। সম্পূর্ণা খাটের কিনারায় ধপাস করে বসে পড়লো। এই পৃথিবীতে কী সুখ নামের পাখিটা তার খাঁচায় ধরা দিবে না? কোনো বিয়েতেই তো সে সুখ বলে কিছু পায়নি। তাহলে কেনো মানুষ বলে বাবা মায়ের পছন্দ মতো বিয়ে করলেই সব ভালো হয়?”

সম্পূর্ণার বাপের বাড়ি থেকে দুপুরে সবাই এসেছে। আতিকা বেগম আসতেই সম্পূর্ণা এইদিক সেদিক তাকিয়ে মাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আতিকা বেগম বললেন,” শাদাব খুব ভালো ছেলে।ছেলেটা অনেক বুঝের।সকালে আমাকে ফোন দিয়ে বলল,” সম্পূর্ণার জন্য চিন্তা করবেন না। মানুষের জীবনে ট্রাজেডি হতেই পারে। তাই বলে কী তার সুখী হওয়ার অধিকার নেই?”
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে সম্পূর্ণার কলিজা ফেটে চৌচির হচ্ছে। না পারছে কাউকে বলতে না পারছে সইতে।
বিকেলে সবাই চলে গেল। সম্পূর্ণাকে দিবে না ইয়াসমিন বেগম। বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেছে। শাদাব সারাদিন ব্যস্ত ছিল বিকেলে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছে। সম্পূর্ণা এসে শাদাবকে দেখে রুম থেকে বের হতে যাবে তখই শাদাব ডেকে বলল দরজাটা আটকিয়ে কাছে আসতে।
-” চলে যাচ্ছিলে কেন?”
-” আপনি ঘুমাবেন তাই?”
-” তোমাকে বলেছি আমি?”
-” না। মনে হলো।”
-” তোমাকে দেখলেই এখন আমার রাগ লাগে। কিন্তু দেখ, কাল রাতেই তোমাকে আমি মন থেকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন নিয়েছি তখন নিজের প্রয়োজনে। ছেলেরা কখনো একটা মেয়েকে পাশে রেখে এমনি এমনি ছেড়ে দেয় না। ওইগুলো শুধু সিনামায় মানায়। তবে আমার জীবনটা সিনামার থেকে কম নয়। কথাটা বলেই সম্পূর্ণাকে টেনে নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে,” আমাকে ক্ষমা কর বা না কর সেটা তোমার ইচ্ছে। কিন্তু আমি যখন চাইবো স্বামীর অধিকার আমি খাটাবো। এতে তোমার কিছু যেন বলার না থাকে।”
সম্পূর্ণা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে,” আপনি চাইলে এখনই খাটাতে পারেন। আপনাকে আমি বাঁধা দিচ্ছি না। তবে যাই করেন আমাকে ছেড়ে যাবেন না।”

চলবে,,,,
চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here