টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ৭

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৭ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
পূর্বের আকাশে সোনালী আলোর খাণিক রেশ স্ফুরিত হচ্ছে। ফজরের আজান দিতে আরও বেশ কিছু সময়ের অপেক্ষা। বাসন্তী এক পোশাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এপার্টমেন্টের বাহিরে এসে দাঁড়াতেই দেখা হয় মৈত্রীর স্বামী সায়মানের সাথে। অবশ্য প্রথমে সে চিনেনি মাস্ক ও ক্যাপ পরা থাকায়। খেয়াল করতেই বুঝে যায়।

লোকটাকে বেশ ভালো ও সরল মনের লাগে বাসন্তীর কাছে। দেখা হলেই বোন, বোন বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে। আপন ভাইরাও এত বিনয়ী হয় কী না…

“কী ব্যাপার? তুমি এই অসময়ে বাসার বাহিরে কী করো?”

মিষ্টি গলার মানুষটার উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত গলা শুনে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে না বাসন্তী। সে এমনিতেও এই ক্ষণে মানসিক ভাবে অত্যন্ত বিধ্বস্ত ও দুর্বল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একে একে বলে দেয় সবকিছু। সেই সাথে এও বলে সে এখান থেকে দূরে চলে যেতে চায়।

কী যেন একটা ভাবে সায়মান। তারপর হুট করেই প্রস্তাব রাখে,

“বোন, আমার এক পরিচিত জায়গা আছে। তুমি চাইলে আপাতত রেখে আসতে পারি। পরে নাহয় অন্য এক ব্যবস্থা করে দিলাম।”

বাসন্তী বিনা কোনো ভাবনায় রাজি হয়ে যায়। মানুষটাকে সে খুব বিশ্বাস করে, কোনো সাহায্য না করলেও ক্ষতি যে করবে না এ সে নিশ্চিত, তবুও কোথাও একটা দ্বিধা, অনিষ্ঠ হওয়ার ভয়।

তারপর সায়মানের সাথেই এগিয়ে যায় বামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায় বাসন্তী। সায়মান কাউকে কল করলে একটা বেশ পুরনো মডেলে গাড়ি এসে দাঁড়ায় তাদের সামনে। তাতে চড়ে বসার পর সায়মান তাকে পানি করতে। অদম্য সব দুর্ভাবনায় বাসন্তীর তৃষ্ণা পেয়েছিল বেজায়, তাই না ভেবেই পান করে নেয়। অতঃপর কিচ্ছু মনে নেই।

বর্তমানে, নিজের মন্দ ভোরটির কথা ভাবছে বাসন্তী। এখনো সে সেই নোংরা খাটেই গুটিশুটি দিয়ে বসে। না কেউ এসেছে এই ঘরে, না সে বাহিরে বের হয়ে সব পর্যবেক্ষণ করার মতোন দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছে। বারবার নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছে সে জীবনের সবচেয়ে জঘন্য সিদ্ধান্তটা নেওয়ার জন্য।

“এ কী ভুল করলাম আমি! নিজেকে কলঙ্কিনী বানানোর ব্যবস্থা করলাম! সমাজে আর ঠাঁই হবে না আমার। সবাই ঘৃণ্য চোখে দেখবে। নিজের জীবন তো ধ্বংস করলাম, বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসার আগেই তার ললাটেও এই কালিমা লেপণ হবে। আল্লাহ! এর চেয়ে ভালো তুমি মৃত্যু দেও আমায়!”

এসব কিছুর মাঝেও বাসন্তীর মনে ক্ষীণ ভাইয়ের মতোন সম্মানিত মানুষটা তাকে ধোঁকা দিবে না। তবুও বাস্তবতা? তাকে অস্বীকার করা যে অসম্ভব।

___

নায়িমের ব্লাড প্রেশার হাই, ডাক্তার সহ দুজন নার্স বিরতিহীন ভাবে তাকে অবজার্ভেশনে রাখছে। কারণ যেকোনো সময় একটা এক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে। চৈতালি সামনে তেঁতুল টক এনে রেখেছে তার খাওয়ার জন্য, কিন্তু খাওয়ার নাম নেই নায়িমের। সে তো উন্মাদ হয়ে রয়েছে বসন্ত কুমারীর খোঁজে।

“কী রে অনিমেষ? বসন্তের কোনো খবর জানতে পারলি না? তাহলে কী হবে এত পাওয়ার, ফেম, আর টাকা দিয়ে?”

বিকট শব্দে বলল নায়িম। সে দু’হাতে চুল আঁকড়ে বসে আছে। খ্যাতনামা, স্টাইলিশ গায়ক নায়িমের কী বিধ্বস্তপ্রায় এলোমেলো দশা এই মেয়েটিকে হারিয়ে। অথচ, মেয়েটিকে তার জীবনে অতিনগণ্য বলেই সর্বদা জেনেছে সে, মেনেছে সে।

এদিকে অনিমেষ ফোনে কমিশনার, আইজি সহ বিভিন্ন পাড়ার মাস্তান ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। তার নিতান্তই বিরক্ত লাগছে নায়িমের আচারণে।

“তুই না বললি তুই ভাবীকে ভালোবাসিস না। তাহলে…? তোর পবিত্র, চল-চাতুরী বোঝহীন মেয়ে লাগবে তো আমি দুদিনের মাঝেই হাজির করব। একদম স্কুল গোয়িং চৌদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ে।”

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে নায়িম। রেগে পাগলের মতোন চেঁচিয়ে বলে,

“তোরে কী আমাকে দেখলে মি. খানের মতোন লাগে? আমার জীবনে একটা নারীই থাকবে, যাকে আমি গভীর ভাবে ছুঁব। আর সেই নারীর জীবনেও আমি একটাই পুরুষ থাকব, শুধু আমার ছোঁয়াই লাগবে তার দেহে।

আমি কিচ্ছু জানি না, আই জাস্ট নিড মাই গার্ল। একদম ইন্টেক লাগবে আমার ওরে, যেমনে গেছে তেমনেই। যত পাওয়ার ইউজ করা লাগে, টাকা খরচ করা লাগে কর। যদি ওরে না পাই না, পুরা দুনিয়া তছনছ করব আমি।”

অনিমেষ বলতে চেয়েও বলতে পারছে না তার হৃদয়ের বুলিগুলো। যতটা সে ঘটনাটা পরখ করে ধারণা পেয়েছে তা হলো, মেয়েটা নির্ঘাত কোনো মন্দ চক্রের হাতে পড়েছে। কারণ রেইল স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, সিএনজির স্ট্যান্ড এমন কী এয়ারপোর্ট কোথাও যায়নি মেয়েটা। এছাড়া তার অতীতের বন্ধু-বান্ধব, নানার বাড়ি, বাপের বাড়ি সব স্থানে খোঁজ নেওয়া শেষ।

“কী রে? তুই হাতে হাত রেখে বসে আছিস কেন? কিছু কর!”

“এই ছেলে রে কী করে বোঝাই তার বউ শুধু পালায়ই নাই কুরবানির ছাগলও হইসে! যেই মেয়ের দিকে তাকালেও এই ছেলের রক্ত ফুটতে শুরু করে সে… কীভাবে মেনে নিবে এই ছেলে?”

কথা টুকু মনে মনেই শুধাল অনিমেষ। মুখে বলার সাহস তার নেই। বরং, মুখে বলল,

“আমি দেখছি। কী একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া নিসোস সিসিটিভিও নেই! তা থাকলেও একটা উপায় ছিল।”

নায়িমের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে। যেন সিক্ত দিয়াশলাইয়ের আগুন জ্বলে উঠেছে।

“পুরো ধানমণ্ডি এলাকাতে যত বাড়ির বা শপের সিসিটিভি ফুটেজ আছে সব বাইর কর। কারণ ও মনে হয় ফজরের আগে বের হয়েছে, তখন তো কোনো যানবাহন পাওয়ার কথা না। এই এলাকা দিয়েই যেহেতু গিয়েছে, কোনো না কোনো বাড়ির ফুটেজে তো নির্ঘাত ওকে পাওয়া যাবেই।”

অনিমেষ অনিমেষনেত্রে চেয়ে রইল। এই যুবক আসলেই তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন। সে একটা উকিল হয়ে এতক্ষণ ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেও যা বের করতে পারেনি তা সে মাথা গরম অবস্থাতেই ভেবে নিয়েছে।

___

বাসন্তীর এপার্টমেন্টের বিপরীতে দুই বাড়ির পরের বাড়ির বাহিরের ক্যামেরার ফুটেজেই পাওয়া যায় বাসন্তীকে। তার সাথে এক অজানা যুবক ছিল। কিন্তু যুবকটিকে চেহারা দেখা যাচ্ছে না মাস্ক ও ক্যাপের জন্য। হুট করেই নায়িমের মনে পড়ে এই ক্যাপ আর শার্টটা সে মৈত্রীর বাসায় দেখেছে।

নায়িমের মাথায় হাত। সে আগে থেকেই ভালো চোখে দেখত না এই দম্পতিকে। সে তো ভেবেই পাচ্ছে না বাসন্তীর এত সাহস হয় কী করে এক পুরুষের পায়ে পা মিলিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার? তার চোখজোড়া রক্তলাল, মাঝে নীলচে মণি। দেখতে ভয়ংকর ও সর্বনাশাই লাগছে তাকে।

“খালি একবার হাতের কাছে পাই তোমায় বসন্তকুমারী। তোমার লোম লোমকে যদি পালানোর সখ না বুঝিয়েছি তো আমিও নায়িম নই!”

অনিমেষ খুব ভালো করেই বুঝতে পারে নায়িমের এই চাহনিকে। তার সাঙ্গপাঙ্গকে কিছু একটা ইশারা করে চোখজোড়া দিয়ে। কয়েক মিনিটের মাঝেই তারা মুখ, হাত, পা বেধে তুলে এনে মৈত্রী ও সায়মানকে।

কাঠের বেত তেল দিয়ে মাখিয়ে নায়িম এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে মৈত্রী ও সায়মানকে। সায়মান আর সহ্য করতে না পেরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠে,

“ব-বলছি, ব-বলছি। আ-আর মারবেন না প্লিজ।”

নায়িম অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থামে। মৈত্রী ক্লান্ত নজরে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সায়মানের দিকে।

“তাড়াতাড়ি বল বসন্ত কোথায়?”

ভয়ে ফটাফট ঠিকানা বলে দেয় সায়মান। অনিমেষ ঠাশ করে এক চড় লাগায়।

“তোকে কত বিশ্বাস করত মেয়েটা আর তুই…! তোদের ধর্মে নারীদের ঘরের রাণী, মূল্যবান রত্ন, একজন মা নামক নারীর নিচে জান্নাত বলা হয়েছে, আমাদের ধর্মে মেয়েদের দেবী তুল্য বলা হয়। নারীরা প্রতিটি ধর্মেই সম্মানিত। কিন্তু তোদের মতোন জ্ঞানহীন মূর্খ জানোয়ার, কুলাঙ্গারের জন্য তাদের শানে দাগ পড়ে। আগে ভাবীকে আনি, তোর এমন হাল করব না…”

“ভাই দয়া করে মাফ করে দেন আমায়। ঐ এসকর্ট সার্ভিসের মালিক আমার থেকে অনেক টাকা পায়। অনেকদিন ধরে সেই টাকার জন্য হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। সেই টাকা পরিশোধে করতেই আমি এই নোংরা কাজ…”

তার ভয়ার্ত গলা, চোখের পানি কিছুতেই সামান্য প্রতিক্রিয়া নেই কারো। মৈত্রী পূর্বেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

___

“হে লেডি, গেট রেডি ফাস্ট! একটু বাদেই তোমাকে ক্লায়েন্ট দেখতে আসবে।”

কারো ডাকা ঘোর ভাঙে বাসন্তীর। সে ভীতিগ্রস্ত হয়ে তাকায় এই গলার মালিকের দিকে। ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরুয়া একজন বিশ উর্ধ্ব নারী। সে অবাক হয়ে যায় তার মুখের বুলি শুনে ও চালচলন দেখে।

“পতিতারাও বুঝি শিক্ষিত হয়? এত স্মার্ট হয়?”

“হোয়াদ্দা হেল? গেট রেডি গার্ল, ক্লায়েন্ট আসবে তোমার জন্য। ম্যাম আসলে ইউ আর জাস্ট গন্না বি ডেড।”

ভয়ে সারা শরীর এক সূক্ষ্ম শীতলতা বয়ে যায়। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তার। কী হবে তার? ভাগ্য কী তার উপর নিষ্ঠুরতম এই হাতিয়ার চালিয়েই দম ফেলবে। নায়িম যদি তাকে এ যাত্রায় বাঁচিয়েও ফেলে বাসন্তির প্রতি তার নিষ্ঠুরতা কত দূর এগুবে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here