টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ৯

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৯ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“আপনাকে এখন পাওয়াই যায় না। খুব ব্যস্ত দিনকাল যাচ্ছে না কি গায়ক নায়িমের?”
হাস্যোজ্জ্বল মুখে ললিতা সেনের প্রশ্ন। প্রতি উত্তরে মৃদু হাসে নায়িম।

“ব্যস্ততা নয়, বাধ্যতা ও নেশা সুরের খেলার। তবে ফিরিয়ে দেইনি তো আপনাকে। সময় দিয়েছি দেরিতে হলেও।”

“শুনেছি, আপনাকে খুব সরল, সোজা, প্যাঁচহীন মানুষ হিসেবে সকলে জানলেও বাস্তবে এর উল্টোই। শুনেছি প্রচণ্ড ধূর্ত, জটিল, নিম্নগামী, মেয়েবাজ এক পুরুষ আপনি।”

“কী অদ্ভুৎ না! আপনিই বললেন সবাই আমাকে সরল-সোজা বলে জানে। তবে আপনি আমার বিষয়ে দ্বিতীয় ধারণা শুনেছেন কার থেকে? ভেরি কনফিউজিং লেডি! না কি আমার সম্পর্কে জানার এত আগ্রহ যে গোয়েন্দা লাগিয়েছেন?”

উত্তর দেয় না ললিতা সেন। শুধুই শব্দ করে হেসে যায়, হয়তো এটাই এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা।

“মেয়েদের সম্পর্কে আপনার ধারণা বা উপলব্ধি কী?”

“সরি ম্যাম। আমার এত এক্সপেরিয়েন্স নেই মেয়েদের নিয়ে উপলব্ধি হওয়ার মতোন। যদি তিন-চারটা বিয়ে, বিচ্ছেদ হত তাহলে আজ আমিই আপনার আসনে হতাম।”

চমকিত হয় ললিতা সেন। তার কপায় বেয়ে সূক্ষ্ম ঘাম ঝরে, তবুও নিজেকে সামলে নেন। বস্তুত, তিন বার সংসার ভেঙেছে তার। কারণ কোনো স্বামীই তার অতিরিক্ত পুরুষের সাথে মেলামেশা ও মদ্য পান মেনে নিতে পারেনি।

“রিসেন্টলি ঘটা ঘটনাটা সকলেরই জানা। একজন অদম্য লাস্যময়ী ও সুন্দরী নারী নিজে থেকে কাছে আসলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা… সবাই জানে ব্যাপারটা নিছকই অসম্ভব যেকোনো পুরুষের পক্ষেই। তাহলে কি আপনার পুরুষত্বে সমস্যা না কি অন্য কোনো ঘাপলা আছে?”

এবার হয়তো বাধ ভাঙবে ভেবে আছে ফিনফিনে পাতলা কালো নেটের শাড়ি পরনে থাকা নারীটি। কারণ পুরুষত্বে প্রশ্ন কোন পুরুষই বা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে! লাইভ ইন্টার্ভিউ চলছে নির্ঘাত কোনো বাজে কাজ করেই ছাড়বে। কিন্তু তাকে অবাক করে নায়িম তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই দেয় না। বরং, ভ্রু নাচিয়ে বলে,

“সবাই এটাও জানে আপনি মিস. শবনমের কত বড় বান্ধব! এমন কী তার ইমেজ ক্লিয়ার করাতে আর আমাকে হেনেস্তা করাতেই যে এখানে ডাকা। বাট কথা হলো যার ইমেজ ঠিক নাই, সে কী করে অন্যের ইমেজ ঠিক করবে?”

তার কথায় নড়চড়ে বসে নারীটি। নায়িম সামনে রাখা কোকাকোলার বোতলটি তুলে একটু পান করে পায়ে পা তুলে বসে। আয়েশি ভঙ্গিমা তার।

“আর যতটুকু আপনার স্টেটমেন্ট ‘কোনো পুরুষের পক্ষেই অসম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা’ এ সম্পর্কে আমি কী বলব? আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবে আমাদের অডিয়েন্স। শুনেন মিস অর মিসেস হোয়াট এভার ইউ আর কোনো মানুষ কি কখনো কারো ইউজ করা টিস্যু ব্যবহার করে? না, দেখলে নাক কুঁচকায় বটে। তেমনি কোনো রুচিশীল সুপুরুষ এমন ধরনের নারীর দিকে হাত বাড়ায় না, বরং তাদের গা ঘিনঘিন করে। আই থিংক ইউ গট ইউর এন্সার।”

উক্ত বাক্যগুলো উচ্চারণ করেই লাইভ ইন্টার্ভিউয়ের মাঝ থেকে উঠে যায় যুবক। এক পলক ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত রাজকীয় ভাবে চোখে দামী সানগ্লাসটা এঁটে নিয়ে বের হয়ে যায়।

ললিতা সেন বিস্মিত হয়ে সেখানেই বসে। লাইভ ইন্টার্ভিউয়ে যে কেউ এত খোলামেলা শত্রুতা প্রকাশের সাহসিকতা ইন্ডাস্ট্রিতে কেউ রাখে তা তার জানা ছিল না।

___

বাসন্তীকে খাবার দিয়ে গেছে একজন সবুজ পোশাক পরিহিতা নারী। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না এই নারীরা কারা বা কী করে এখানে? আর এই রাজকীয় কামরা ও বাড়িটাই বা কার? পুরোটা দালান ও ফার্নিচার সোনালী ও শুভ্র রঙের তাল-মিল রেখে ডিজাইন করা। এমন কী বর্তমানে সে যেই শাড়িটি পরা সেটাও বেশ দামী স্বর্ণজরি দিয়ে কাজ করা কাতান। বাসন্তীর মাঝেসাঝে মনে হচ্ছে সে রাজরাণী এই রাজপ্রাসাদের।

“ছোট মালকিন, আপনার জন্য মালাই চা।”

“মালাই চা?” বিড়বিড়ায় বাসন্তী। চায়ের এমন নাম সে কখনোই শুনেনি।

“হুম, ছোট মালকিন। অনিমেষ বাবুই তো বললেন আপনার আর তার জন্য মালাই চা পাঠাতে।”

“অনিমেষ ভাইজান? কিন্তু কোথায় তিনি? আর আপনি বারবার আমাকে ছোট মালকিন বলছেন কেন?”

“উনি স্টাডিরুমে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। চলেন, আমি নিয়ে যাই।”

ছোট্ট এক বিরক্তিমাখা শ্বাস ফেলল বাসন্তী। মেয়েটা আবারও কায়দা করে শেষ প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। যতবার সে জিজ্ঞেস করেছে ততবার এমনই হয়েছে। এখন তো জিজ্ঞেস করার মানসিকতাই হারিয়ে গিয়েছে।

“আচ্ছা চলেন।”

চায়ের ট্রে হাতে নিয়েই মেয়েটি এগিয়ে চলল। বাসন্তীও গেল তার পিছু পিছু। বড় একটা ঘর, যার চারটা দেওয়াল জুড়ে শেলফ্ এঁটে আছে। কী গাঁদা গাঁদা বই! এতটা বই তো সে নিজের শিক্ষা জীবনেও দেখেনি।

“বসো।” গভীর ভাবনার মাঝে শব্দটি শুনে কেঁপে উঠে বাসন্তী।

অনিমেষ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। তার ইশারায় চায়ের কাপ সমেত ট্রে রেখে চলে যায় সাথে আসা মেয়েটি।

“আপনার সাথে বেশ কিছু কথা বলার আছে আমার ভাবী। কখনো ভাবিনি কথাগুলো কাউকে বলব, নিজের জীবনের চেয়ে অধিক প্রিয় বন্ধুকে করা ওয়াদা ভাঙব।”

কথাটুকু শেষ হতে ঘরে পা রাখে আরেকজন ব্যক্তি। চৈতালি সে।

“হ্যাঁ, অনেক কিছু তোমার জানার আছে। তোমার জীবন কেন এতটা বিষাক্ত বা কেন এত টক্সিক রিলেশনশীপ তোমার আর নায়িমের তা তোমার জানতে হবে।”

“আমি কখনো বলতাম না। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে অতীত খোলাসা হওয়া খুব জরুরি তোমার ও নায়িমের ভালো জীবনের জন্য।”

বাসন্তী কিছুই বুঝতে পারছে না। একে তো নিজেরই এত মানসিক চাপ যন্ত্রণা, তার উপর চৈতালি ও অনিমেষের এত ধাঁধাময় কথাবার্তা সবটাই তার কাছে এখন নিছকই হেয়ালিপনা লাগছে।

তার খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে, “হেয়ালি বন্ধ করে দয়া করে বলুক কেন এতটা বিষাক্ত ছোঁয়ায় দগ্ধ হতে হয় আমায় বিনা অপরাধেই?” কিন্তু স্বভাবগতই সে বলতে পারে না।

“নায়িম টক্সিক রিলেশনশীপে বেড়ে ওঠা একজন পুরুষ। নায়িমের জন্মদাতা মি. নিয়াজ খান ছিলেন একজন জমিদার ও নামকরা বস্ত্র ব্যবসায়ী। নায়িমের জন্মদাত্রী নুসরাত মোস্তফা ছিলেন নিয়াজ খানের দাদূর বন্ধুর নাতনি। এছাড়াও তার আরেক পরিচয় হলো বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের একমাত্র কন্যা। পারিবারিক ভাবেই নিয়াজ খান ও নুসরাত মোস্তফার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর স্ত্রীকে খুব বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিলেন নায়িমের বাবা। অনেক বিশ্বাস করতেন স্ত্রীকে। ভালোই চলছিল তাদের সংসার, আরাম, আয়েশে ও আদরে বেড়ে উঠছিল তাদের একমাত্র পুত্র নায়িম।

কিন্তু হুট করেই আবার যেন অতীত ফিরে আসে নুসরাত মোস্তফার জীবনে। প্রথম প্রেম না কি ভুলা যায় না। তিনিও ভুলতে পারেননি হয়তো। তাই তো স্বামী-সন্তানের উর্ধ্বে রেখেছিলেন প্রেমিককে। প্রতিনিয়ত স্বামীকে মিথ্যে বলে ছেলের চোখের সামনে পরপুরুষের সাথে মিলিত হতেন তিনি। নায়িম বাধা দিতে গেলে বা কাউকে বলতে চাইলে মার-ধর, গালাগালি করতেও থামেননি তিনি। হেসে-খেলে চলা ছেলেটা হুট করেই নীরব থাকত, স্তব্ধ থাকত সদা। সে বুঝত না মায়ের এমন করার কারণ।

এর মধ্যেই একদিন সময়ের আগে ফিরে স্ত্রীকে হাতেনাতে ধরেন নিয়াজ খান। নুসরাত মোস্তফা একটু অনুতপ্ত তো হয়ই নাই। বরং, দাম্ভিকতার সহিত মুখ ঝামটা মেরে সংসার ছাড়েন তিনি। ঐ যে বললাম স্ত্রীকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন তিনি। তাকে ফেরাতে পায়ে সুদ্ধ ধরে তবুও লাভ হয়নি। তার পাগল দশা। সারাদিন মদে ডুবে থাকতেন। ঘৃণা করতে শুরু করেন স্ত্রীকে। দিন নাই, রাত নাই বাড়িতে নানা মেয়ে আনতেন। বাসায় যে একটা সদ্য কিশোর ছেলে আছে ভুলেই যেতেন। নায়িমকে দেখলেই রেগে যেতেন তিনি। মার-ধর ও গালিগালাজ করতেন মা তুলে।

ছেলেটা দিনে দিনে আরও ভেঙে পড়েছিল মানসিক ভাবে। চুপচাপ থাকত, কাঁদতে ভুলে গেছিল, সারাক্ষণ কেমন আবদ্ধ স্তব্ধতা তার মাঝে। আমাকে সব বলত ও, তবে আগের মতোন সেসব বলার সময় রাগ ও ঘৃণা ছাড়া কোনো অনুভূতি প্রকাশ পেত না তার মাঝে। অত্যন্ত সাবলীল ভাবে বলত সে যেন এটাই স্বাভাবিক। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল ওর আজকের এই নায়িম হওয়া।”

অনিমেষ থামে, তার ভিষণ তেষ্টা পেয়ে গেছে। পানি নেই আশেপাশে, তবে ঠাণ্ডা মালাই চা সম্মুখে রাখা। তা-ই পান করে নেয় সে।

চৈতালি বাসন্তীর ফ্যাকাসে হয়ে উঠে মুখ খানার দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। এই মেয়েটা যে তাকে ভালো দৃষ্টিতে দেখে না, তা তার খুব করে জানা।

“আমি নায়িমের কোনো বোন নই। আমার মা ছিলেন এই সবুজ শাড়ি পরা অন্যান্য মেয়েদের মতোই এই বাড়ির একজন কাজের মেয়ে। নায়িমের দেখভাল করাই ছিল তার প্রধান কাজ। নায়িমের বাবা স্ত্রীর বদলে যাওয়া, অতিরিক্ত ড্রিংক, শৃঙ্খলছাড়া জীবন-যাপনের জন্য ছয়-সাত মাসের মাঝেই স্টক করে মারা যায়। উইল অনুযায়ী নায়িমের আঠারো হওয়া অবধি সব কিছু নুসরাত মোস্তফার। তিনি স্যারের মৃত্যুর পরই সবকিছুতে হক নিতে নিজের প্রেমিক সহ এসে পড়েন। আর প্রেমিকের কথাতে নিজের ছেলেকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন, তখন নায়িমকে আগলে নেন আমার মা। নিঃস্বার্থ ভাবেই যে সবটা করেছিল এ দাবী করব না। কিন্তু নায়িমকে নিয়ে কখনো হেলাফেলা করেনি। কষ্ট করেও নায়িমের পড়াশোনা আগের মতোই চালানোর চেষ্টা করেছে।

বছর এক যেতেই এক লোক আসেন নায়িমের সন্ধানে, চিনতাম না। তিনি বলেন নায়িমের দাদার ভাইয়ের ছেলে। নায়িমের দায়িত্ব নিতে চান। আমাদের জন্য নায়িমের খরচ চালানো কষ্টসাধ্য ছিল, আমার মা তাই অনতিবিলম্বেই সায় দিয়ে ফেলে। কিন্তু নায়িম বলে সে তার বাড়িতে যাবে না। বরং, তাকে যেন একটা হোস্টেলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। এত সহায়-সম্পত্তির মালিক হয়েও এতিমদের মতোন ছিল সে আঠারো হওয়া অবধি। কীভাবে যেন আঠারো হওয়ার পরপরই নিজের সবকিছু আবার নিজের অধীনে আনে নায়িম। ভাগ্যের খেলায় জয়ী হয়। কিন্তু সবকিছুর সে এক অমানবিক মানসিকতার যুবকে পরিণত হয়েছে। ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তার গোটা ভালো মানসিকতা, নির্মলতা ও অনবদ্যতা। সে এমন এক মানুষ, যার মাঝে মনুষ্যত্বেরই বড় অভাব”

ফোস করে এক শ্বাস ফেলে অনিমেষ। বাসন্তীর দিকে বিনয়ী ও অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।

“ও অসুস্থ, কিন্তু পাগল কী আর মানে সে পাগল! আমি বহু চেষ্টা করেছি ওকে সায়কায়ট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়ার, কিন্তু পারিনি। যতটুকু সায়কায়ট্রিস্ট থেকে জেনেছি, সেও খুব একটা লাভ করতে পারবে না। ওর মানসিকতা বদলাতে হবে। তোমার একটু সাহসিকতাই পারে ছেলেটাকে বদলে দিতে। কাঠের পুতুল কিন্তু বিপ্লব বয়ে আনবে না, তা কঠোর ও দৃঢ় মানুষের দ্বারাই সম্ভব। নায়িমকে তো অনেক ভালোবাসো, তবে তাকে ভালোবাসেই নাহয় পুতুল থেকে বিপ্লবী হও।”
বলে থামে অনিমেষ।

বাসন্তী তীব্র ঘোরে ডুবে। সব তার মাথার উপর দিয়েই যেন যাচ্ছে। তার একটু বিরতি প্রয়োজন, আরাম প্রয়োজন।

“কী রে অনি তুই না চলে যাবি বললি? আর কী কথা হচ্ছে এখানে সবার?”

হুট করেই নায়িমের কণ্ঠস্বর শুনে হচকচিয়ে যায় উপস্থিত সকলেই। শুধু বাসন্তীরই শূণ্য দৃষ্টি।

“তেমন কিচ্ছু না হালকা-পাতলা আড্ডা দিচ্ছিলাম। আর ভেবেছি আজ থেকে যাব এখানে, মামনিকেও বলেছি।”

“ওহ, আচ্ছা। বাসন্তী ঘরে চলো।” বলে নায়িম চলে গেল। তার কিছু সন্দেহ হলো কি না কে জানে?

নায়িমের পিছু হাঁটা ধরল বাসন্তীও। যাওয়ার আগে একবার অনিমেষের চোখ জোড়ার দিকে তাকালো। ছেলেটি চোখে গভীর আবেদন। যেন বলছে, “ভালোবেসে বিপ্লবী হও নারী, পুতুল নও।” কিন্তু বাসন্তী কি পারবে বিপ্লবী হতে? তার আবেদন গ্রহণ করতে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here