ডাহুক নদীর তীরে পর্ব -০২+৩

#ডাহুক নদীর তীরে (পর্ব-২)
# হালিমা রহমান

তথাদের বাড়ি পুরান ঢাকায়।পুরান ঢাকার বাড়িগুলো দেখতে বেশ সুন্দর।বেশিরভাগ বাড়ির চেহারা অন্যরকম।তথাদের এলাকায় এখানে গলি,সেখানে গলি।বাড়ির ছাদগুলোও পরিপাটি থাকে।তাছাড়া, হোটেলগুলোর সামনে দিয়ে তো আসাই যায় না।খাবারের গন্ধেই অর্ধেক পেট ভরে যায়।তথা আজ খুব খুশি।খুশির চোটে নাচতে ইচ্ছে করছে তার।তথার কত শখ অভিনয় করার।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে হাত নাড়িয়ে কথা বলে।নায়িকাদের মতো চুল গুছিয়ে রাখে।নিজেকে সবসময় পরিপাটি করে রাখে।কয়েকদিন পর তথাও অভিনয় করবে।নিজের সবটুকু দিয়ে নির্ধারিত চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলবে।তারপর?তারপর তথার অভিনয়ের মাধ্যমে সবাই তথাকে চিনবে,ভালোবাসবে।তথার রূপের আগে গুণ চোখে পড়বে সবার।ছেলে-বুড়ো সবাই বলবে–“নাহ,মেয়েটা শুধু রূপবতীই নয়।তথা একজন গুণী অভিনেত্রীও বটে।”
বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দেয় তথা।তথাদের বাড়ির নিচে সাড়ি সাড়ি দোকান।এখানে একটা বিরিয়ানীর হোটেল আছে।এই হোটেলের বিরিয়ানী তথার খুব পছন্দ।রিকশা থেকে নেমে তথা ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দেয়।এদিক-ওদিক হাত বুলাতেই, হাতের নিচে খুচরো টাকাগুলো তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়।টিউশনির বেতন এখনো পুরোপুরি খরচ হয়নি।পাঁচ প্যাকেট বিরিয়ানী কিনে নিলে কেমন হয়?পরিবারের সবার জন্য ছোট্ট একটা ট্রিট।রুবাইদা- মাহাদি নিশ্চয়ই তথার পথের দিকে চেয়ে আছে।তথার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে। ওর চাইতে ওর ভাই-বোনের আগ্রহ বেশি।তথা দু-পা সামনে এগিয়ে হোটেলের সামনে দাঁড়ায়।তাকে দেখামাত্রই হোটেলবয় যেন উড়ে আসে।তথার সামনে এসে হাসিমুখে প্রশ্ন করেঃ” কয় প্যাকেট লাগব,আপা?”

—” পাঁচটা।”

হোটেল বয় আবারো ভিতরে চলে যায়।তথা ওড়নার আঁচল দিয়ে গলায় জমে থাকা ঘাম মুছে নেয়।এই রাস্তাটা সবসময় ব্যস্ত থাকে।রিকশা, মোটরসাইকেলের আনাগোনা থাকে সেই রাত দশটা পর্যন্ত।আর মানুষের চিল্লাচিল্লির কথা না বললেই নয়।এখানে যেন অদৃশ্য একটা প্রতিযোগিতা চলে,কে কার চেয়ে বেশি চেঁচিয়ে কথা বলতে পারে। মাঝে মাঝে তথা একদম হাঁপিয়ে যায়।মানুষগুলো কি একটু জিরোতে পারে না?

হোটেলের ভিতরের দিকে একটা চেয়ারে বসেছিল ইরফান।তার দৃষ্টি তথার দিকে।মেয়েটাকে সেই ক্লাস টেন থেকে চিনে সে।ভালো লাগার শুরু তখনই।ইরফানদের বাড়ির সামনে দিয়েই স্কুলে আসা-যাওয়া করতো তথা।ইরফান তখন ভার্সিটিতে পড়ে।ছোট্ট মেয়েটাকেই কি করে যেন মনে ধরে গেল।না চাইতেও তথাতেই আটকে গেল ইরফান।অকারণে তথার স্কুলের সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো,তথাকে একবার দেখার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা কোচিং সেন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো,তথা বিকালে যখন হাঁটতে বেরোতো তখন ইরফানও বাইক নিয়ে পিছু পিছু আসতো।কিন্তু ইরফান কখনো তথার মুখোমুখি দাঁড়ায়নি।নিজের দূর্বলতা বুঝতেই দেয়নি তথাকে।সে যেন তথার এক অদৃশ্য ঢাল।তথার অগোচরেই তাকে ছোট্ট পাখির ছানার মতো আগলে রাখছে।
হোটেলবয় সোনাই,পাঁচটা প্যাকেটে বিরিয়ানী ভরছিল।তাকেই হাত বাড়িয়ে ডাক দেয় ইরফান।

—” সোনাই,এদিকে আয়।”

সোনাই হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে আসে।কাউন্সিলরের ছেলে হিসাবে ইরফানের খুব ক্ষমতা এখন।সোনাই ইরফানের সামনে দাঁড়ায়।মাথা নিচু করে বলেঃ ” জ্বি,ভাই?”

—” তোর ভাবির থেকে ভুলেও টাকা নিবি না।ওর বিল আমার বিলের সাথে হিসাব করবি।বুঝছিস?”

—” জ্বি,ভাই।”

সোনাই চলে গেলে ইরফান আবারো তথার দিকে নজর দেয়।তার সামনে রাখা একপ্লেট বিরিয়ানী সেই কখন ঠান্ডা হয়ে গেছে।ইরফান একা নয়।তার সামনে বসে আছে রাফায়েত।রাফায়েত তার অন্তরঙ্গ বন্ধু।রাফায়েত একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তথার দিকে তাকায়।তথাকে একনজর দেখে আবারো বন্ধুর দিকে নজর দেয়।তারপর মুচকি হাসে।

—” ইরফান,তুই কি আর খবি ?”

—” উঁহু। ”

—” এইভাবে তাকায় থাকিস না।নজর লাগবে।”

—” প্রশ্নই আসে না।আমি যতক্ষণ তাকায় থাকি ততোক্ষণ সেকেন্ডে সেকেন্ডে মাশাল্লাহ বলি।”

—” তুই খুব বাড়াবাড়ি করিস ইরফান। ”

—” মোটেও না।”

—” তোর মনে হয় তথা তোরে পছন্দ করবে? অত্যধিক রূপবতী মেয়েরা বর হিসাবে অত্যধিক রূপবান ছেলেদেরকে পছন্দ করে।”

—” তুই কি পরোক্ষভাবে আমাকে অসুন্দর বলছিস?”—ইরফানের কপাল কুঁচকে যায়।

— ” না,তা বলছি না।কিন্তু তথার পাশে তোকে মানাবে না।তোর সৌন্দর্য খুব সাধারণ। চলতি পথে এরকম দেখাই যায়।কিন্তু তথা তো আর এরকম না।তথার পাশে মানাবে রাজপুত্রের মতো কাউকে।ধর তুর্কি নায়কগুলো আছে না?ওরকম।একদম কাটকাট বডি,নজরকাড়া স্টাইল–এরকম আরকি।”

—” শোন ভাই,মানুষ এখন আর শুধু রূপ দেখে না।যোগ্যতাও দেখে।আমি ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম,ভালো ছেলে,কর্মঠ,টুকটাক রাজনীতি বুঝি,আমার নিজের রেস্টুরেন্টের ব্যবসা আছে।আর চরিত্রের কথা তোকে নাই বা বললাম।এই যুগে আমার মতো এরকম ভদ্র-সভ্য ছেলে তুই কোথায় পাবি?যেহেতু আমি ছেলে হিসেবে ভালো তারমানে স্বামী হিসেবেও ভালো হব,তাই না?তাছাড়া, তথার সাথে আমি প্রেম করব না।

—” তাহলে কি করবি?”

—” ডিরেক্ট বিয়ে করব।একদম পিউর এরেঞ্জ ম্যারেজ যাকে বলে।তাহলে,এখানে শুধু তথার পছন্দ ভেবে কি হবে?আমার টার্গেট তথার অভিভাবক। আমি নিশ্চিত তথার চাচা-চাচি আমাকে পছন্দ করবে।”

রাফায়েত আর কথা বাড়ায় না।এই পাগলকে বুঝানো আর কলা গাছে আম ফলানোর চেষ্টা একই কথা।ইরফান হাতের উপর মাথা রেখে আবারো তথার দিকে তাকায়।মেয়েটা কি সুন্দর করে এদিক -ওদিক দেখছে।মেয়েটার সবকিছুই সুন্দর।কেন যে এতো ভালো লাগে তাকে!

তথা একবার হোটেলের দিকে নজর দেয়।সোনাইকে উদ্দেশ্য করে বলেঃ” সোনাই,দেরি হবে আরো?”

—” না, আপা।আর পাঁচ মিনিট।”

তথার দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না।একছুটে বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছে।রুবাইদা -মাহাদী কতক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছে।তথা হাতঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলায়।আযানের দেরি নেই খুব।মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সোনাই এসে দাঁড়ায় তথার সামনে।মুখে ঝুলায় বিনয়ের হাসি।

—” আপা,এই যে নেন।”

—” কত হলো?”

—” আপনার বিল দেওয়া লাগব না আপা।”

—” কেন?—তথার চোখ-মুখ কুঁচকে যায়।

—” এমনেই। আপনের টাকা লাগব না আপা।”

পুরো বিষয়টা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে তথার।এটা যে ইরফানের কাজ তা বুঝতে খুব দেরি হয় না।মুহূর্তেই রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তথার।কপালের দু’পাশের রগগুলো স্পষ্ট হয় ফর্সা মুখটাতে।

—” সোনাই,তুমি কার কথায় এরকম করছো?”

—” কারো কথায় না, আপা।”

—” লাগবে না আমার বিরিয়ানী।এগুলো নিয়ে যাও।আর যে বাড়াবাড়ি করছে তার চেহারায় ছুড়ে মারো।অসহ্য বিরক্তিকর। ”

তথা আর দাঁড়ায় না।মুখ ঝামটা দিয়ে বাড়ি চলে যায়।সোনাই মুখে একরাশ অসহায়ত্ব ফুটিয়ে ছুটে যায় ইরফানের কাছে।মিনমিন করে বলেঃ” আপা নিলো না ভাই।”
সোনাইয়ের চেহারা দেখে মনে হয়,পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অঘটনটা মাত্র ঘটে গেছে।

ইরফানের আগেই উত্তর দেয় রাফায়েত।
—” তোমার ভাই এরকম বাড়াবাড়ি করলে কেন নিবে?”

ইরফান কিছুই বলে না।শুধু একবার বিরক্ত চোখে রাফায়াতের দিকে তাকায়। তারপর সোনাইকে বলেঃ” একটু পরে ওদের ঘরে যেয়ে দিয়ে আসবি।গেটের সামনে রেখে গেট নক করেই দৌড় দিবি।পারবি না?”

সোনাই মাথা নাড়ায়।এ আর এমন কি কাজ।

***

—” আপু,সত্যিই তুমি চান্স পেয়েছ?মানে এটা মিথ্যা নয়তো?”

এ নিয়ে পাঁচবার একই প্রশ্ন করলো রুবাইদা।তথা বালিশে হেলান দিয়ে মুচকি হাসে।আশ্বস্ত গলায় বলেঃ” হ্যাঁ রে বোন।সত্যি চান্স পেয়েছি।”

—” তাহলে তুমিও এখন নায়িকা?”

—” আরে না,আমি নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করব না।একটা সহকারী চরিত্রে অভিনয় করব।”

—” ধুর,নায়িকা না হলে কি আর মানুষের চোখে পড়ে?–আনন্দে ভাটা পড়ে রুবাইদার।

—” এটা তো শুরু মাত্র।আর অভিনয় তো অভিনয়ই। এখানে নায়িকা আর খলনায়িকা কি?”

—” তবুও।আচ্ছা আপু,তোমার কাছে এগ্রিমেন্ট পেপারের ছবি আছে?আমি একটু দেখতাম।”

—” মোবাইলে আছে।”

রুবাইদা খাট থেকে লাফিয়ে নামে।টেবিলের উপর থেকে তাড়াহুড়ো করে মোবাইল নেয়।ক্লাস টেনে পড়ুয়া মেয়ের কাছে অভিনয়ের জগৎ অনেক বিশেষ কিছু।রুবাইদা খুটিয়ে খুটিয়ে ছবিটাকে দেখে।মিনিট কয়েক পরে খুব উত্তেজিত হয়ে যায় সে।গলা উঁচিয়ে বলে—” আপু তুমি পঞ্চগড় যাবে?এতো দূর?”

—” হ্যাঁ, যেতেই হবে।শুটিং হবে ডাহুকের তীরে।নাটকের নামটা দেখেছিস?”

—” হ্যাঁ। ডাহুক নদীর তীরে–তাই না?”

—” হুম।উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটের নাটক।একটা জমিদার বাড়ি আছে সেখানে।সেখানেই থাকব আমরা।ওই বাড়ি আর নদীকে কেন্দ্র করেই নাটক হবে।”

—” নায়ক কে?”

—” নায়কের সাথে এখনো কথা হয়নি আমার।দেখিনি এখনো।তবে সেও বোধহয় নতুন মুখ।”

—” মা তোমাকে এতো দূরে যেতে দেবে?”

—” কি জানি।আমি তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ। যেতে তো হবেই।কাকিমাকে আমি বুঝিয়ে বলব। এখন যা এখান থেকে।আমি একটু ঘুমাব।আটটার আগে আমাকে ডাকবি না।মনে থাকবে?”

—” হুম।”

রুবাইদা যাওয়ার আগে ঘরের লাইট বন্ধ করে দেয়,দরজা চাপিয়ে দেয়।বোনকে সে অত্যন্ত ভালোবাসে।তথা এ বাড়ির আপন কেউ না।এটা তার চাচার বাড়ি।আপন চাচা না।তথার বাবার চাচাতো ভাই।সেই হিসেবে সম্পর্কটা একটু দূরের।তবে, তথাকে কখনোই বুঝতে দেয়নি কেউ।তথা যেন এঘরেরই মেয়ে।রুবাইদা তার ছোট বোন,মাহাদি ছোট ভাই।বোনটা ক্লাস টেনে আর ভাই ক্লাস সিক্সে পড়ে। বাবা- মাকে মনে নেই তথার।তথার জন্মের কয়েকমাস পরেই তার মা মারা যায়।আবার একবছরের মাথায় চলে যায় তার বাবা।তারপর থেকে তথা এ পরিবারের মেয়ে।বাবা-মায়ের বিয়ের ছবিটা এখনো তথার কাছে আছে।মাঝে মাঝেই তাতে হাত বুলায় তথা।কখনো কখনো সাদা-কালো ছবিটাতে দু-ফোটা চোখের জল ঝরে পড়ে। বাবা-মায়ের লোভ বড় লোভ।চাচা-চাচি যতই আদর করুক,শাসন করুক ; তাদেরকে কি কখনো বাবা-মায়ের স্থান দেওয়া যায়?হয়তো যায়।কিন্তু তথা পারে না।চাচা-চাচিকে সে জীবনের চাইতে বেশি ভালোবাসে কিন্তু বাবা-মা বলে তাদেরকে ডাকতে পারে না।তথার ভাবনায় সে অনাথ।একদম অনাথ।

***

বিলাসবহুল হোটেলের একটা রুমে বসে আছেন ডিরেক্টর আখতার হোসেন।তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে,হাত-পা কাঁপছে।আখতার হোসেনের মুখোমুখি বসা ইউসুফ।ইউসুফের সাথে যতবার দেখা করতে আসেন ততোবারই হাত-পা কাপে ডিরেক্টরের। অথচ,ইউসুফ কখনো তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে না।তবুও কেন যে আখতার হোসেন তাকে এতো ভয় পায় তা সে ভেবেই পায় না।হাঁটুর বয়সী একটা ছেলেকে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে?
ইউসুফ ফোন থেকে একবার চোখ তুলে ডিরেক্টরের দিকে তাকায়।ভরাট গলায় বলেঃ” সবগুলোই নতুন মুখ?”

—” জ্বি স্যার।”

—” পরিচয় পর্ব শেষ?”

—” জ্বি না স্যার।কাল সবাইকে নিয়ে একটা ছোটখাটো মিটিং করব।ওখানেই পরিচয় করিয়ে দেব সবাইকে।”

—” এই মাসের শেষের দিকেই ঢাকা ছাড়বেন।বাড়ি ঝাড়া-মোছা শেষের দিকে প্রায়।শুটিংয়ের কোনো ছবি বা খবর যেন ফাঁস না হয়।সমস্যা হবে তাহলে।মনে থাকবে?”

ইউসুফের অবিচল শক্ত কন্ঠে খানিকটা ঘাবড়ে যায় ডিরেক্টর। ঘন মাথা নাড়ায়।কাঁপা গলায় বলেঃ” জ্বি স্যার,মনে থাকবে।”

—” এডভান্স আপনার একাউন্টে পৌঁছে যাবে।আসতে পারেন এখন।”

আখতার হোসেন ঝট করে উঠে দাঁড়ায়।আরেকবার সালাম দেয় ইউসুফকে।তাড়াতাড়ি দরজার দিকে পা বাড়ায়। আহমেদ ইউসুফ বিপজ্জনক মানুষ।এই ছেলেকে কোনো বিশ্বাস নেই।

—” শুনুন।”

দরজার বাইরে পৌঁছানোর আগে আবারো ফিরে তাকায় ডিরেক্টর। ইউসুফ তার দিকে শীতল চোখে তাকায়। ঠান্ডা গলায় বলেঃ” আবারো বলছি,তথার যেন কোনো সমস্যা না হয়।কোনো ছেলে যাতে ওকে বিরক্ত না করে।তথার দায়িত্ব আপনার উপর।দায়িত্ব ভুলে যাবেন না।পঞ্চগড় যাওয়ার পর আমার দায়িত্ব আমি বুঝে নেব।ততোদিন তথার বিন্দুমাত্রও সমস্যা যেন না হয়।”

আখতার হোসেন মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে যান ঘর থেকে।বাইরে বেড়িয়ে বড় করে দম নেন।মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে তার।মেয়েটা নিজেও জানে না,কার নজরে পড়েছে সে।আহমেদ ইউসুফের চোখে পড়ার চাইতে মৃত্যু ঢের ভালো।
# ডাহুক নদীর তীরে (পর্ব-৩)
# হালিমা রহমান।

জমিদার বাড়ির আগাছা পরিষ্কার করা হচ্ছে।সেই কোন আমলের বাড়ি!এখানে এককালে জমিদার ছিল,একদল রাজাকার ছিল।এতোদিন পর বাড়িটাকে আবার ঝকঝকে করতে দেখে গ্রামবাসীর চক্ষু চড়কগাছ। এই ভূতের বাড়ি ঝাড়া -মোছা করে কি হবে?তবে দু একদিনের সাফ-সুতরোতেই বাড়ির জৌলুশ যেন একশগুণ বেড়ে গেছে।কে বলবে, এই বাড়িটাকে এতোদিন ভূতের বাড়ি বলা হতো?নতুন করে সাদা রঙে রাঙানো হয়েছে পুরো বাড়ি।বাড়ির পিছনে গাছ- গাছালিতে একদম জঙ্গল হয়েছিল।সেগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে।বড় বড় গাছের ডাল-পালা কেটে দেওয়া হয়েছে।অশ্বত্থ গাছের নিচে একটা বাঁশের বেঞ্চি তৈরি করা হয়েছে।নতুন করে লোহার সদর দরজা তৈরি করা হয়েছে।আজ সেটা জায়গামতো লাগানো হচ্ছে।দুজন মিস্ত্রি চুপচাপ কাজ করছে।তারা এ গ্রামের নয়।এ গ্রামের কোনো মিস্ত্রি ভয়ে কাজ করতে রাজি হয়নি।এই বাড়ি নিয়ে এখনো অনেক ভৌতিক গল্প প্রচলিত আছে।বাড়ির কাজ তদারকি করছে মামুন।সে এই বাড়ির ম্যানেজার। ব্যাচেলর ছেলে।এই বাড়ির নিচ তলার একটা রুমে থাকে সে।মামুন এই গ্রাম বা পাশের গ্রামের ছেলে না।সে কথা খুব কম বলে।তাই তার পরিচয় সম্পর্কে বেশিরভাগ গ্রামবাসী কিছুই জানে না।
মামুন সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাজ দেখছে।এই পথ দিয়েই মাঠে যাচ্ছিলো মতিন মিয়া।ভূতের বাড়ি নিয়ে তার আগ্রহের শেষ নেই।মামুনকে দেখে হাঁটার গতি কমিয়ে দেন তিনি।মামুনের সামনে দাঁড়িয়ে বিগলিত হাসেন।

—” কি গো মিয়া,বাড়ি নতুন করতাছো যে?মালিক আইবো নাকি?”

—” স্যার আসবেন নাকি জানি না।”

—” তাইলে?”

—” শুটিং হবে এখানে—কাঠ কাঠ গলায় উত্তর দেয় ম্যানেজার।

মতিন মিয়া প্রথমে একটু থমকে যান।কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই তিনি পুরোপুরি চমকে যান।কি বললো ছেলেটা? শুটিং হবে? এখানে? অবিশ্বাস্য বিষয়! এই অজপাড়া গায়ে কে আসবে শুটিং করতে?কি আছে এখানে?গ্রামবাসীর কাছে রূপালী পর্দা মানেই ভিন্ন কিছু।চাকচিক্যময় অন্য একটা জগৎ।মতিন মিয়া প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননা।গলায় সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করেনঃ” হাছা কথা কইতাছো?”

—” মিথ্যা বলে আমার কি লাভ?”

ম্যানেজারের ঘুরানো-প্যাচানো কথায় ভয়াবহ বিরক্ত হন মতিন মিয়া।মনে মনে অশ্রাব্য গ্রাম্য কিছু গালি দেন।কথা বলার ইচ্ছাই তার মরে গেছে।মতিন মিয়া আর দাঁড়ান না।সোজা পথ ধরে সামনে চলে যান।খবরটা দিতে হবে না সবাইকে? মামুন একবার আড়চোখে তাকায় মতিন মিয়ার দিকে।আহমেদ ইউসুফ জনসমক্ষে আসবে এবার।তবে মামুনকে আগে থেকেই এসব প্রকাশ করতে নিষেধ করেছে সে।ইউসুফের কথা শুনলে গ্রামবাসী ভীড় করে দেখতে আসবে তাকে।জমিদার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী বলে কথা।মামুন আবারো কাজে মনোযোগ দেয়। ইউসুফের ডানহাত সে।তাই ভিতরের খবর সব জানা তার।সবাই জানে, পুরোনো বাড়িটাকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। কিন্তু মামুন জানে,বাড়ি নয় একটা মৃত্যুপুরী সাজানো হচ্ছে নতুন করে।

***

রুবাইদা দাঁড়িয়ে আছে তথার রুমে। আলমারি থেকে সব জামা-কাপড় নামিয়েছে সে।এই ঘরটাতে তথা ও রুবাইদা একসাথে থাকে।রুবাইদা একটার পর একটা জামা নামিয়েই যাচ্ছে।কিন্তু একটাও মনমতো হচ্ছে না।তথা খাটের উপর বসে চুপচাপ বোনের কান্ড দেখছে।এতো কিছু নামিয়েছে, গোছাবে কে?তথা বোনের দিকে তাকিয়ে মুখ বাকায়।মেয়ের কান্ড দেখে মনে হচ্ছে তথা হিমালয় জয় করতে যাবে।

—” রুবি, আমি কিন্তু কিছু গোছাতে পারব না।সব তুই গোছাবি।”

—” আচ্ছা,গোছাব।কিন্তু তুমি কি পরে যাবে? আজকে ডিরেক্টরের সাথে দেখা করতে যাবে না?”

—” হুম। ”

—” ওখানে কত মানুষ থাকবে।তুমি কোন জামাটা পরবে? এই সাদা জামাটা নাকি সবুজ রঙেরটা?নাকি ওই কালোটা?কোনটা পরলে ভালো লাগবে তোমাকে?”

—” তুই বল, কোনটা পরব?”

—” এই সাদা জামাটা পরো।না থাক এইটা না এই লালটা পরো।এটাতেই ভালো লাগবে বেশি।”

—” আচ্ছা।এটা নিচে রেখে বাকি সব গুছিয়ে রাখ।”

লাল রঙের জামাটা খাটের উপর রাখে রুবাইদা।তথার সাথে তারও যেতে ইচ্ছে করছে খুব।ওখানে কত কত নায়ক-নায়িকা থাকবে! তাদেরকে একদম কাছ থেকে দেখার খুব শখ রুবাইদার।রুবাইদা একটার পর একটা জামা আবারো গুছিয়ে রাখে।তথা খাটে বসে মোবাইল টিপছে।তার কোনো কাজ নেই এখন। টিউশনিগুলো ছেড়ে দিয়েছে।মাসের শেষেই হয়তো পঞ্চগড় যেতে হবে।
ধীর পায়ে তথার রুমে ঢুকেন আকলিমা খাতুন।তিনি তথার চাচি।আকলিমা খাতুন তথার দিকে আড়চোখে একবার তাকান।দুইদিন যাবৎ তথার সাথে কথা বলেন না তিনি।কেন বলবেন?মেয়ে নাকি পঞ্চগড় যাবে! পঞ্চগড় কি বাড়ির কাছে?এতোদূর যাওয়ার কি দরকার?ভাগ্যে থাকলে বাড়ির কাছেই ক্যারিয়ার হবে। মেয়েটাকে এতোবার নিষেধ করেছেন কিন্তু মেয়েটা শুনছেই না।কতবড় সাহস হয়েছে মেয়ের! ভাবতেই রাগে মাথা নষ্ট হয়ে যায় আকলিমা খাতুনের।অবশ্য এর পিছনে বিরাট অবদান তথার চাচার।তথার চাচা,ইকবাল মিয়ার আগ্রহ যেন সবচেয়ে বেশি।মেয়ের ছোটোবেলার স্বপ্ন পূরণ হবে,তার মেয়েকে সবাই চিনবে—এ কি কম কিছু?তাই আকলিমা খাতুনের হাজার অভিযোগের কানাকড়িও গায়ে মাখেন না তিনি। আকলিমা বেগম যখন তথার অত্যধিক সাহসের নিন্দা করে স্বামীর কাছে বিচার দেন,ইকবাল মিয়া তখন আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুহাত তুলে দেন।মুচকি হেসে বলেনঃ” লিমা,এতো খিটখিট কইরো না।তথার বাপে ছিল যাত্রাদলের অভিনেতা। আমার মাইয়ার শরীরে অভিনেতার রক্ত।রক্তে কথা কয়।মাইয়াও অভিনেত্রী হইতে চাইব,এডাই স্বাভাবিক।”
আকলিমা খাতুনও চুপ মেরে যান।এরপরে আর কিইবা বলার থাকে?

চাচিকে ঘরে ঢুকতে দেখে ফোন রেখে দেয় তথা।মাতৃসম চাচির মুখভার তার সহ্য হয় না।কিন্তু কিছু করার নেই।আকলিমা খাতুন কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না তথার বিষয়টা। তথা চুক্তিবদ্ধ —এই কথা চাচিকে কে বুঝাবে?তথা খাটের কোনে চুপ করে বসে থাকে।রুবাইদাও মাকে দেখে এককোনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।দুদিন যাবৎ ঘরের আবহাওয়া অত্যন্ত অস্থিতিশীল। খাটের উপর একগাদা জামা-কাপড় দেখে মুহূর্তেই ফুসে উঠেন আকলিমা খাতুন।রুবাইদাকে ঘর কাঁপিয়ে ধমক দেন।

—” আমার ঘরটাকি বস্তি বাড়ি? নাকি আমি মইরা গেছি? যার যা ইচ্ছা তাই করবি ঘরের মধ্যে?আলমারির সব কাপড় নামাইছোস ক্যান?”

—” এখনি গুছিয়ে রাখছি মা “—- মিনমিন করে উত্তর দেয় রুবাইদা।ইদানিং মাকে খুব ভয় পায় সে।আকলিমা খাতুন মেয়ের কথায় মনোযোগ দেন না।গজগজ করতে করতে জামা-কাপড় ছুড়ে মারেন আলমারির ভিতর।ঘর-সংসারের প্রতি বিরক্তি এসে গেছে তার।

—” কষ্ট কইরা কোকিলের ডিমে তা দিছি।আমার কথা শুনব ক্যান?আমি কি আর জন্ম দিছি?নিজের মা হইলে ঠিকই কথা শুনতো।আমার কি? আমার কিছু?দূরদেশে নাটক করতে যাইব,অঘটন ঘটলে মাইষের মাইয়ার ঘটব।আমি আর কিচ্ছু জিগামু না……”

গলা উঁচিয়ে বকতে বকতে ঘর ছাড়েন আকলিমা খাতুন।ঘর থেকে চলে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার কন্ঠও মিলিয়ে যায়।রুবাইদা হাফ ছাড়ে। মায়ের মেজাজের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।তথার মুখটা ছোট হয়ে যায়।কথাগুলো যে তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে-তা বুঝতে কষ্ট হয় না।কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সেও দো-টানায় পড়ে যায়।কাজটা কি সত্যিই ঠিক হলো?আখতার হোসেন তার পরিচিত কেউ নয়।ক্যারিয়ারের খাতিরে হুট করেই তার সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?পঞ্চগড় অনেক দূরের রাস্তা।যদি কিছু হয়?যদি কোনো অঘটন ঘটে?তবে কি হবে?

***

আখতার হোসেনের পি.এর নাম খোকন।খোকন নামের সাথে একটা কোমল,আদুরে ভাবের সম্পর্ক আছে।কিন্তু আখতার সাহেবের পি.এর নাম খোকন না হয়ে অন্যকিছু হলে ভালো হতো।ছেলেটা সবসময় কপাল কুঁচকে রাখে।কপালের দু’দিকের চামড়া একদম কপালের মাঝখানে জড়ো হয়ে থাকে।চোখে-মুখে থাকে রাজ্যের বিরক্তি।ভাব দেখলে মনে হয়, সে দয়া করে এখানে কাজ করছে।তাকে ছাড়া শুটিং হবেই না।খোকনকে সিড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখ বাকায় তথা।সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে সে।আখতার সাহেবের সাথে আজ একটা মিটিং আছে।এখানে নাকি সবাই থাকবে।একে অন্যের সাথে পরিচিত হবে।আখতার সাহেব নাটক সম্পর্কে, শুটিং স্পট সম্পর্কে সবাইকে বুঝিয়ে বলবেন।সেই জন্যই আজ এখানে এসেছে তথা।কিন্তু সেই কখন থেকে খোকন তাকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।আখতার সাহেব নাকি ভিতরে কার সাথে পার্সোনাল মিটিং করছেন।এখন দেখা করা যাবে না।এটা কোনো কথা?সাড়ে চারটার কথা বলা হয়েছে তথাকে। এখন বাজে চারটা চল্লিশ।আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে!

তথা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তাতে মনোযোগ দেয়। ভালো লাগছে না এসব।প্রথমে খুব ইচ্ছে থাকলেও এখন আর আগের মতো আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছে না সে।চাচি খুব করে নিষেধ করছেন।ছোট থেকে এই মানুষটাই বড় করেছেন তথাকে।কখনোই তার কথার অমান্য করেনি তথা।এইবারই প্রথম।কাজটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না।

—” এক্সকিউজ মি।আপনি কি বলতে পারেন ডিরেক্টর আখতার সাহেবকে কোথায় পাওয়া যাবে?”

একটি পুরুষালি কন্ঠের বিনয়ী প্রশ্নে ভাবনার রাজ্যে ভাঙন ধরে তথার।মাথা তুলে তাকাতেই একটি বলিষ্ঠ চেহারা চোখে পড়ে।তথার উত্তরের আশায় আছে সে।

—” ডিরেক্টর সাহেবকে এই রুমেই পাবেন।উনি মিটিং-এ ব্যস্ত আছেন।—তথা ডানহাত দিয়ে পাশের রুমটি দেখিয়ে দেয়।

—” আপনি কি তার পি.এ?এখন তো আমাদের টিমের সাথে মিটিং করার কথা ছিল।”

—” আপনি কি নতুন কাজ করছেন এখানে?”

—” হ্যাঁ। নতুন যেই নাটকটা তৈরি হবে,সেখানে নায়কের চরিত্রে আমি আছি।”

—” ওহ,আচ্ছা।আমিও ওই নাটকেই একটা চরিত্রে কাজ করছি।আমরা বোধহয় সহকর্মী। ”

—” তাহলে,এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?ভিতরে যান।”

—” ভিতরে নাকি স্যার মিটিং করছেন।”

—” আমাদেরকে ডেকে আরেকজনের সাথে মিটিং করছেন! আশ্চর্য! সময়জ্ঞান নেই নাকি?”

তথা কোনো উত্তর দেয় না।তার নিজেরও বিরক্ত লাগছে খুব।পাঁচটা বেজে গেছে।এখানে কাজ শেষ হবে কখন?

—” আপনাদেরকে স্যার যেতে বলেছেন।ভিতরে যান আপনারা।”

এখনো খোকনের কপাল কুঁচকানো।এই ছেলেটা কি হাসতে জানে না?কার উপর এতো বিরক্ত সে?

—” চলুন,ভিতরে যাই।আপনার নামটাই জানা হলো না এখনো।”

—” আমি সায়রা খানম তথা।আপনি?”

—” শাফিন আহমেদ।আপনি কি নায়িকা নাকি?”

—” জ্বি,না।সহকারী চরিত্র।”

—” ওহ”— একটু মিইয়ে যায় শাফিনের কন্ঠ।সে বোধহয় এতোক্ষণ তথাকে নায়িকা ভেবেছিল।

***

—” তোমাদেরকে এতোক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আসলে পুনমকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম,তাই দেরি হলো।পুনম এই নাটকে নায়িকার চরিত্রে কাজ করছে।”

তথা আড়চোখে একবার পুনমের দিকে তাকায়।মেয়েটার বয়স বোধহয় উনিশ- বিশ।তথার চাইতে দু-এক বছরের ছোটই হবে।অথচ,কি উদ্ধত ভাব-ভঙ্গি! যেন সে একাই এখানে বসে আছে।পায়ের উপর পা তুলে আরামে ফোন টিপছে।মেয়েটার পোশাকও খুব দৃষ্টিকটু।নতুন অবস্থাতেই এই রকম,একটু জনপ্রিয় হলে কি হবে আল্লাহ মালুম।

—” তারপর তথা,কি খবর তোমার?”

—” জ্বি স্যার, ভালো।”

—” শাফিনের সাথে আলাপ হয়েছে তোমার?”

—” জ্বি।”

সদস্যদের ভালো- মন্দ জিজ্ঞেস করে মূল কথায় আসেন ডিরেক্টর।অনেকটা সময় নিয়ে নাটকের কাহিনী বর্ণনা করেন। এই নাটকটা মূলত প্রেম বিষয়ক সামাজিক একটা নাটক।প্রেক্ষাপট সেই উনিশ শতকের।শাফিনের বিপরীতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করবে পুনম।আর তথা হবে অন্যতম প্রধান নারী চরিত্র।শাফিন তথার প্রতি দুর্বল থাকবে আবার পুনমের প্রতিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে।একটা ত্রি-কোন প্রেমের গল্পের ভিত্তিতেই নাটকটা তৈরি হবে।ডাহুক নদীর পাড়ের পুরোনো জমিদার বাড়িতে নাটকের শুটিং হবে।এই মাসের শেষের দিকেই ঢাকা ছাড়তে হবে সবাইকে।বেশিরভাগ মেয়ে চরিত্র।পুরুষ চরিত্র হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র।

প্রায় ত্রিশ মিনিট আলোচনা করলো ডিরেক্টর সাহেব।আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলেন সবকিছু।কাজের ক্ষেত্রে তিনি খুব সচেতন।আলোচনা শেষে একটু ব্যস্ততা দেখিয়েই উঠে গেলেন আখতার সাহেব।তার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ পড়ে গেছে। এখন না গেলেই নয়।ডিরেক্টরের পিছনেই হাই হিলে গটগট আওয়াজ তুলে রুম ছাড়লো পুনমও।মেয়েটার আচরণ দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় তথা।মেয়েটা রীতিমতো অসামাজিক। এর সাথে কাজ করবে কিভাবে?

—” কি বুঝলেন মিস তথা?কাজটা কি সহজ?”
তথা উঠে যাচ্ছিলো।কিন্তু শাফিনের কথায় আবার বসে পড়ে চেয়ারে। মাথা নেড়ে বলেঃ” উঁহু। এরকম অসামাজিক মেম্বারদের সাথে কি করে কাজ করব?”

—” মিস পুনম ডিরেক্টরের খুব কাছের মানুষ।একটু-আকটু অসামাজিক তো হবেই”— ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দেয় শাফিন।

—“মানে?”

—” আরে পার্সোনাল মিটিং, কাজ বুঝানো — এসব বুঝেন না?এতো অবুঝ হলে চলে?আমি শখে অভিনয় করতে এসেছি।সিলেক্ট হওয়ার জন্য দশহাজার টাকা পকেট থেকে খসাতে হয়েছে। অথচ,মিস পুনমকে ডিরেক্টর সাহেব হাতে ধরে কাজ শিখিয়ে দিচ্ছেন।বিষয়টা অদ্ভূত না?আপনিও দেখতে অসাধারণ সুন্দরী।আপনারও বোধহয় টাকা-পয়সা লাগেনি।আপনারা মেয়ে হয়ে বেঁচে গেছেন,বুঝলেন।আমি ছেলে বলেই আমার চান্স পেতে টাকা লাগে অথচ……”

—” আমি আসছি শাফিন সাহেব।পুনমের থেকেও আপনি বেশি অসামাজিক।পরেরবার কথা বলতে হলে সাবধানে বলবেন।মেধা দিয়ে টিকেছি এখানে, সৌন্দর্য দিয়ে নয়।কথাটা মাথায় রাখবেন।”

প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে রুম ছাড়ে তথা।আগ্রহের নদীতে পূর্ণ ভাটা চলছে। ইশ! আবেগের বশে এগ্রিমেন্ট পেপারে সাইন না করলেই ভালো হতো।এদের সাথে সে কাজ করবে কিভাবে???

চলবে…
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here