ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব -০১

তোমার মতো একটা কুৎসিত মেয়ে কিভাবে আমাকে প্রপোজ করলে? নিজেকে আয়নায় দেখেছ কখনো? কালো ভূত একটা।

নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে এভাবে অপমানিত হয়ে চোখের জল আটকে রাখতে পারে না শ্রাবন্তী। কলেজের সবার সামনে তাকে এভাবে বলছে আরিয়ান। যেই ছেলেটাকে সে সেই স্কুল লাইফ থেকে ভালোবেসে এসেছে। শুধুমাত্র দেখতে সুন্দর নয় বলেই তার অনুভূতিগুলোকে এভাবে ভেঙে দিল আরিয়ান। শ্রাবন্তী নিজের চোখের জল মুছে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে। কলেজ থেকে বের হতেই শ্রাবন্তীকে নিয়ে উপহাস করতে থাকে তার কিছু সহপাঠী। একটি মেয়ে বলে, এই চেহারা নিয়ে গিয়েছিল আরিয়ানকে প্রপোজ করতে। ঠিকই হয়েছে। বামন হয়ে চাঁদে হাত দিলে এমনই হয়। যেই মেয়েটা অসুন্দর বলে আমরা কেউ তার সাথে মিশি না পর্যন্ত তার শখ দেখ কত।

শ্রাবন্তী আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাড়িয়ে দৌড়ে নিজের বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। আসলেই কি খুব অসুন্দর সে? শুধুমাত্র গায়ের রংটাই যা একটু কালো। তার মুখের গঠন তো খারাপ না। শ্রাবন্তীর নিজেকে নিয়ে এতদিন কোন আফসোস ছিলনা। তার মতে সৃষ্টিকর্তা তাকে যেভাবে তৈরি করেছে সেভাবেই সব ঠিক। তাই তো বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের হাজার অবজ্ঞা সহ্য করেও শ্রাবন্তী সেগুলো গায়ে মাখেনি। কিন্তু আজ আরিয়ানের অপমান শ্রাবন্তীকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে এখন চায় সবাইকে যোগ্য জবাব দিতে। সামনেই তাদের এইচএসসি পরীক্ষা। তারপরে শুরু হবে ভার্সিটির জীবন।

শ্রাবন্তী বরাবরই পড়াশোনায় ভালো। শ্রাবন্তী এখন সিদ্ধান্ত নেয় নিজেকে প্রচুর পরিবর্তন করে নেবে সে। নিজের মৃত মায়ের ছবির দিকে তাকায় শ্রাবন্তী। তার মা দেখতে অনেক তার মতোই কালো ছিল। শ্রাবন্তীর বাবার অবশ্য ভীষণ সুদর্শন। শ্রাবন্তী শুনেছিল তার বাবা আর মায়ের ছিল ভালোবাসার বিয়ে। শ্রাবন্তীর বাবা শাহাদাত হোসেন শ্রাবন্তীর মায়ের রূপ না গুণ দেখেই তাকে পছন্দ করেছিল। তাদের ভালোবাসা ছিল গভীর। শ্রাবন্তীকে জন্ম দেওয়ার সময়ই তার মা মারা যায়। শাহাদাত হোসেন সুদর্শন হওয়ায় অনেক মেয়েই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু শাহাদাত হোসেন তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। তাই তার যায়গা আর কাউকে দেয়নি।

শ্রাবন্তীর চোখে তার বাবা একজন শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। তাই তো সে স্বপ্ন দেখতো তার জীবনেও এমন কেউ আসবে। কিন্তু এখন শ্রাবন্তীর মনে হচ্ছে দেখতে সুন্দরী না হলে বোধহয় ভালোবাসা পাওয়া যায়না। তাই নিজের জীবনের অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত সে নিয়ে ফেলেছে।

❤️
ভার্সিটিতে নতুন যারা এডমিশন পেয়েছে আজ তাদের প্রথম ক্লাস। নবীন বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আর এই আয়োজনের দায়িত্বে রয়েছে রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীগণ। যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে আদিল। দেখতে যেমন সুদর্শন, পড়াশোনাতেও তেমনি তুখোর মেধাবী আদিল। তাই ভার্সিটির অনেক মেয়েরই স্বপ্নের পুরুষ সে। তবে আদিল কোন মেয়ের প্রতি আগ্রহ দেখায় না। সে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত।

নবীন বরণ অনুষ্ঠানে একটি মেয়েকে দেখে আদিলের চোখ ধাধিয়ে যায়। অত্যাধিক সুন্দরী একটি মেয়ে এসেছে ভার্সিটিতে। মেয়েটির দিকে অনেক ছেলেই তাকিয়ে আছে। তবে আদিলের যেন বেশিই ভালো লেগে গেছে মেয়েটিকে।

আদিল তার বন্ধু রূপককে দায়িত্ব দেয় মেয়েটির সম্পর্কে জেনে আসার জন্য। রুপক মেয়েটির সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে আসে। আদিলকে এসে বলে, দোস্ত মেয়েটির নাম শ্রাবন্তী। ওর বাড়ি ঢাকাতেই। রসায়ন বিভাগে প্রথম বর্ষে চান্স পেয়েছে।

আদিল অপলক তাকিয়ে ছিল শ্রাবন্তীর দিকে। একটা মেয়ে এত সুন্দরী কিভাবে হয় সেটাই বুঝতে পারছিল না আদিল।

শ্রাবন্তী লক্ষ্য করে অনেক ছেলেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। এসব দেখে ক্রুর হাসে শ্রাবন্তী। কারণ সে জানে সবাই তো রূপের পাগল। শ্রাবন্তী মেকআপ করে এত সুন্দর করে সেজে এসেছে জন্যই সবাই তাকে এভাবে দেখছে। আগে তো কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাত না। এসব সৌন্দর্যের পূজারীদের আর ভালো লাগে না শ্রাবন্তীর। কারণ এরা কেউই প্রকৃত সৌন্দর্য বোঝে না। শ্রাবন্তী নিজের আসল রূপে আসলে কেউ তো ফিরেও তাকাত না তার দিকে। তাই শ্রাবন্তী কাউকেই পাত্তা দেয়না। ইতিমধ্যেই অনেক ছেলে এসে তার থেকে ফোন নাম্বার, ফেসবুক আইডি চেয়েছে। আবার অনেকে তাকে কফিও অফার করেছে। শ্রাবন্তী তাদের সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছে। একপর্যায়ে শ্রাবন্তীকে মঞ্চে ডাকা হয়। আদিল নিজের হাতে ফুল দিয়ে শ্রাবন্তীকে বরণ করে নেয়। একজন প্রফেসর শ্রাবন্তীর প্রশংসা করে বলে, এই মেয়েটি আমাদের ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় সবথেকে বেশি মার্কস পেয়েছে। আসলেই অনেক মেধাবী সে।

সবাই শ্রাবন্তীর জন্য করতালি দেয়। আদিল শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শ্রাবন্তীকে দেখছিল। শ্রাবন্তীর কৃত্রিম সৌন্দর্যই যেন তাকে বশ করে নিয়েছে। শ্রাবন্তী বেশিক্ষণ মঞ্চে না থেকে তাড়াতাড়ি মঞ্চ থেকে নেমে যায়।

আদিল শ্রাবন্তীর পিছন পিছন যায়৷ শ্রাবন্তী খেয়াল করে একটি ছেলে তার পিছনে আসছে। পিছনে ঘুরে তাকিয়েই একটু আগে যেই ছেলেটি তাকে বরণ করেছিল তাকে দেখে শ্রাবন্তী ভ্রু কুচকে ফেলে। বলে, কি চাই আপনার?
আদিল বলে, কিছু না। আমি একটু এদিকটায় যাচ্ছিলাম। শ্রাবন্তীকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় আদিল। হঠাৎ করেই তার হার্টবিট বেড়ে গেছে। শ্রাবন্তী আবার হাটতে শুরু করে। একটু সামনে গিয়ে দেখতে পায় কয়েকটা ছেলে মিলে কিছু ছেলেদের কান ধরে ওঠবস করাচ্ছে। ছেলেগুলো অসহায়ের মতো মুখ করে আছে। কিন্তু তারা নির্দয়ের মতো তাদের বলছে চালিয়ে যেতে। শ্রাবন্তী এই দৃশ্য দেখে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

যেতে যেতে ছেলেগুলোর উদ্দ্যেশ বিড়বিড় করে বলে, জানিনা এরা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে আসে নাকি গু*ন্ডা*গিরি করতে। শ্রাবন্তীর কথাটা র‍্যা*গিং করা ছেলেদের লিডার গৌরবের কানে যায়।

গৌরব একপ্রকার রে*গে গিয়ে শ্রাবন্তীর হাত ধরে বলে, সাহস কি করে হলো আমার ব্যাপারে এমন একটা কথা বলার। তুমি জানো আমি কে?
শ্রাবন্তী হাত ঝাড়া দিয়ে বলে, জানিনা আর জানতেও চাইনা।

শ্রাবন্তী নিজের মতো হেটে যেতে থাকে। একপর্যায়ে ভার্সিটির প্রায় বাইরে চলে আসে শ্রাবন্তী। তখনই গৌরব পিছন থেকে এসে শ্রাবন্তীর মাথায় পানি ঢেলে দেয়। শ্রাবন্তী পুরো ভিজে যায়। পানিতে তার সব মেকআপ ধুয়ে যায় যার কারণে তার আসল রূপ বেড়িয়ে আসে।

গৌরব শ্রাবন্তীকে শায়েস্তা করতে পেরে খুব খুশি হয়। বিজয়ী হাসি দিয়ে শ্রাবন্তীর সামনে এসে দাঁড়াতেই তার হাসি থেমে যায়। মেকআপ উঠে যাওয়ায় শ্রাবন্তীর আসল রূপ দেখে ফেলল গৌরব। শ্রাবন্তী কাঁদো কাঁদো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। স্কুল কলেজের ভয়ংকর স্মৃতিগুলো শ্রাবন্তীর মনে হানা দেয়। তার মনে হতে থাকে আবার হয়তো তাকে এখানেও অপমান সহ্য করতে হবে। এই ভয়েই তো মেকআপ করে নিজের রূপ ঢেকে ভার্সিটিতে আসে শ্রাবন্তী।

গৌরব শ্রাবন্তীকে একপলকে দেখতে থাকে। শ্রাবন্তীর মায়াবী চোখের জল তার যেন সহ্য হচ্ছিল না। শ্রাবন্তী গৌরবের কাছে অনুরোধ ব্যক্ত করে বলে, ভাইয়া আপনার কাছে অনুরোধ আমার এই রূপের কথা কাউকে বলবেন না প্লিজ। আমি যদি আপনার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করে থাকি তো মাফ করবেন। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিন।
গৌরব শুধু শ্রাবন্তীর কথাই শুনে যাচ্ছিল বিপরীতে কিছু বলছিল না। এই কালো রংয়ের মায়াবী মেয়েটাকে মুগ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছিল গৌরব। তার সহজ সরল অনুরোধ দেখে হাসি ফুটে ওঠে গৌরবের মুখে। গৌরব শ্রাবন্তীকে ভরসা দেয়, আমি কাউকে কিছু বলবো না। তুমি এখন যেতে পারো। একটা কথা বলি তোমায় নিজেকে নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করবে না। কারণ তিনি তোমায় যথেষ্ট সুন্দর করে তৈরি করেছে।

চলবে….

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#১ম_পর্ব
#লেখনিতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here