তুমি আসবে বলেছে হৃদয় পর্ব -০৮

#তুমি_আসবে_বলেছে_হৃদয়
#পর্ব-৮
#মেঘলা_আহমেদ

কখন থেকে কলিংবেল বাজছে। অথচ কেউ দরজা খুলছে না। এই ভোর সকালে কে এলো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে বিছানা থেকে উঠে রিদিশা। ছুটির দিনে একটু ঘুমাতেও পারবেনা শান্তি মত। গ্র্যান্ডমা আর গ্র্যান্ড পাপা হয়তো ঘুমোচ্ছে, তাই দরজা খোলা হয়নি। রিদিশা ঢুলতে ঢুলতে নামছে সিঁড়ি দিয়ে। দরজা খুলে একটা ছেলেকে দেখলো রিদিশা। ছেলেটা উল্টো ঘুরে আছে। তা দেখে রেগেমেগে রিদিশা বলল-

-” এই আপনার কি ম্যানার নেই? এত সকালে কেউ কারো বাসায় আসে? আসছেন ভালো কথা এতবার কলিংবেল দেয়া লাগবে কেন? আমার ঘুমের ১২টা বাজানো। আপনাকে তো..

ছেলেটা এদিকে ঘুরতেই রিদিশার পকরপকর অফ হয়ে যায়। মুখটা হা করে তাকিয়ে আছে রিদিশা। এরিক এত সকালে? তার বাসায় কি করছে? সে স্বপ্ন দেখছে না তো? রিদিশার অবাক হওয়া চোখদুটো দেখে ভাবান্তর ঘটলো না এরিকের। সে যেনো জানতো রিদিশাই দরজা খুলবে। সে রিদিশাকে আগামাথা নিরীক্ষণ করলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল-

-” আমার ম্যানার আগে ছিলো। একটা মেয়ের জন্য ম্যানারলেস হয়ে গেছি। তা তো তুমি জানোই। বাই দা ওয়ে ইউ আর লুকিং সো হ|ট। এভাবে আমার সামনে এলে। অন্য কেউ হলে কি হতো? এভাবে কারো সামনে যেওনা রিদিমনি। বিনা বাক্যে হার্ট অ্যা|টাক হয়ে যাবে যে কারো। সবাই আমার মত কন্ট্রোল করতে পারবেনা‌।

এরিক চোখ টিপে দিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। রিদিশার গা জ্বলে ওঠে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে টি শার্ট আর প্লাজু পড়া। রিদিশা উল্টো ঘুরে দেয় দৌড় উপরে। তাকে আর পায় কে। কি একটা বিব্রতকর অবস্থা। এরিক হাসতে হাসতে বাড়িতে ঢোকে। দরজা লক করে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত রুমের দিকে আগাতে থাকে। রিদিশা নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। বুকের হৃদযন্ত্র টা ধ্রিম ধ্রিম শব্দ তুলে কাঁপছে। এই অবস্থায় এরিকের সামনে গিয়েছে ভাবতেই গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।‌ ছেলেটা কি না কি ভাবছে? আর যাইহোক এরিক এই বাসায় কেন? সে কি করে জানলো আমি এখানে থাকি। এরিক তো আমাকে দেখে একটু চমকায় নি। ও কি জানে আমি এখানে থাকি? আচ্ছা ও এখানে কেন এসেছে? রিদিশা সাতপাঁচ ভাবনা বাদ দিয়ে, তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর ড্রয়িংরুমের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এখন উদ্দেশ্য একটাই। এরিক কি আছে না নেই তা দেখা। থাকলে এখানে কেন এসেছে তার কারণ জিজ্ঞাসা করা। কিন্তু নিচে গিয়ে যা দেখলো তাতে রিদিশা বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। গ্র্যান্ডমা সোফায় বসে বসে কাঁদছে। এরিক নিচে বসে তার কোলে মাথা দিয়ে রেখেছে। মহিলার ফর্সা নাকটা লাল হয়ে গেছে কান্না করার জন্য। কান্নার হিরিকে কেঁপে কেঁপে উঠছে গ্র্যান্ডমা। এরিক নিজেও হালকা কাঁপছে, কিন্তু কোল থেকে মাথা তুলছে না‌। দৃশ্যটা দেখে রিদিশার নিজের চোখেও পানি এসে গেল কেন জানি। আচ্ছা এরিক গ্র্যান্ড মাকে ধরে এভাবে কাঁদছে কেন? মিসেস ময়ূরীর চোখ পরে রিদিশার দিকে। সে চোখ মুছে হাত বাড়িয়ে রিদিশাকে বাংলায় বলল-

-” এদিকে আয় রিদিশা। ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

এরিক ঝট করে কোলে থেকে মাথা তুলে ফেলে। নিজের চোখের পানি আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করে। যদিও দাদির বাংলা কথা সে বুঝতে পারেনি। তবুও আন্দাজ করা যায় সে রিদিশাকে এদিকে ডেকেছে হয়তো। কান্না করার জন্য চোখদুটো লাল হয়ে গেছে দুজনের। রিদিশা রোবটের মতো এগিয়ে যায় মিসেস ময়ূরীর কাছে। তার পাশে যেতেই তিনি হাত ধরে রিদিশা কে তার পাশে বসায়। এরিক উঠে সামনে পা বাড়ালেই মিসেস ময়ূরী খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। এরিক হাতের দিকে তাকিয়ে বলে-

-” গ্র্যান্ড মা আজকে যাই। অন্যদিন আসবো। তোমাকে যা বলেছি ব্যাপারটা দেখবে ভালো করে‌।

মিসেস ময়ূরী ফোকলা দাঁতে হেঁসে ইংরেজি তে বলে-

-” বিপদে পড়লেই বুঝি দাদিকে মনে পড়ে? তখন গ্র্যান্ডমা গ্র্যান্ডমা করে ছুটে আসো। তার আগে আমার সাথে ফোনেও যোগাযোগ করো না ভাই! একটু থাকনা। তোর দাদুর শরীর টা ভালো না ওনাকে একটু দেখে যা। উনি তোর কথা বলে শুধু। বাবা মায়ের মতো হলি একেবারে। তোর ছোট বোনটা আমাদের কথা মনেই করেনা দেখছি। তুই একটু থাক না হয় আজ। বিকেলে চলে যাবি না হয়।

এরিক দাদির মিনতি আর ফেলতে পারলো না‌। সত্যিই তো কতশত অযুহাতে এই মানুষ দুটোকে সময় দেয়া হয়নি। অথচ এই মানুষ দুটো না থাকলে হয়তো এই পৃথিবীর আলো দেখা হতো না।এরিক দাদির পাশে গিয়ে বসে। রিদিশার দিকে একবার তাকিয়ে চোখজোড়া ফ্লোরে নিবদ্ধ করে। রিদিশা এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। কথা শুনে তো মনে হচ্ছে এই ভদ্রমহিলাই এরিকের গ্র্যান্ডমা। মিসেস ময়ূরী এবার রিদিশার মাথায় হাত রাখলো। রিদিশার ভাবনার এখানেই সমাপ্তি ঘটে। মিসেস ময়ূরী মিষ্টি হেসে বাংলায় রিদিশাকে বলে-

-” তোকে বলতাম না আমার একটা নাতি আছে। এই যে এরিক তাহসান! ও হচ্ছে আমার সেই আদরের নাতি। আর ওর একটা ছোট বোন আছে এলিনা তাহসান। আমার এই নাতিকে আমি বড্ড ভালোবাসি। তুই ওর সাথে কথা বল আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।

মিসেস ময়ূরী তাহসান কিচেনের দিকে চলে গেল। এই বয়সে এসেও সে নাস্তা নিজে তৈরি করবে। তেজ আছে বলতে গেলে এখনো। এরিক নিজের মধ্যকার দুরত্ব একটু ঘুচিয়ে দিয়ে রিদিশাকে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে-

-” গ্র্যান্ডমা তোমাকে বাংলায় কি বলেছে? আমি না বুঝতে পারিনি। যাষ্ট এলিনার নামটা বুঝেছি! এলিনা আমার ছোট বোন, অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। তোমাকে একটুও জ্বালাবে না। তোমার সাথে অনেক সুন্দর ব্যবহার করবে দেখো।

রিদিশা চমকে এরিকের দিকে তাকায়। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে –

-” তোমার বোন আমাকে জ্বালাবে কেন? আমি কি ওর কাছে গিয়ে বসে থাকবো?

এরিক নিজের চোখদুটো বন্ধ করে ফেলে। শীট আবারো ভুল জায়গায় সে ভুল কথা বলছিলো। কন্ট্রোল হারাচ্ছে কেন বারবার। রিদিশা কি কিছু বুঝে ফেলেছে? রিদিশা হা করে এরিকের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘন পাপড়ি বিশিষ্ট চোখদুটো এত সুন্দর লাগছে। বদ্ধ চোখদুটো খুব করে টানছে রিদিশাকে। ঐ চোখে অধর ছুঁয়ে দিলে কি হবে? ধুর কি উল্টাপাল্টা ভাবছি আমি। ও আমার ছোট ভাইয়ের মত। হুহ। এরিক পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। রিদিশা ভ্রু নাচিয়ে বলে-

-” কি বলছো না কেন? তোমার বোন আমাকে জ্বালাবে কেন?

এরিক ঠোঁট কামড়ে কথা সাজিয়ে নেয়। রিদিশার দিকে তাকিয়ে বলে-

-” আসলে কথাটা ওভাবে বলিনি। বলেছি যে আমার বোন এতই ভদ্র যে। যে কেউ তার কাছে গেলে তাকে একটুও জ্বালাবে না। ওটাই তোমাকে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছি। আচ্ছা গ্র্যান্ড মা তোমাকে তখন কি বলেছে?

রিদিশার এরিকের কথা কতটুকু বিশ্বাস হলো সে জানেনা। তবুও উদাসীন হয়ে ইংরেজি তে বলল-

-” তোমার গ্র্যান্ড মা বলেছে তোমার সাথে কথা বলতে সে নাস্তা নিয়ে আসছে।

এরিক মুচকি হেসে বলল-

-” আওও মাই ডিয়ার সুইট গ্র্যান্ড মা।

মিসেস ময়ূরী একটা ট্রে তে করে কিছু খাবার এনে টেবিলে রাখে। তারপর মুচকি হেসে বলে-

-” হ কাজের সময়েই সুইট গ্র্যান্ডমা তাইনা? আর এমনিতে বুড়ি গ্র্যান্ড মা।

এরিক উঠে তার দাদিকে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে। দাদির গালে একটা চুমু দিয়ে বলে-

-” আরে গ্র্যান্ড মা তুমি সবসময়েই সুইট। গ্র্যান্ডপাপা তোমাকে বিয়ে না করলে আমি নিজেই বিয়ে করতাম তোমাকে। এত সুইট একটা বউ থাকলে আর কি লাগে?

রিদিশা মুখ টিপে হাসছে এরিকের কথা শুনে। মিসেস ময়ূরী তখন মুচকি হেসে বলে-

-” রিদিশাও কিন্তু অনেক সুইট। আমরা বাংলাদেশের সব মেয়েরাই সুইট।

এরিক থতমত খেয়ে গেল দাদির কথায়। দাদির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল –

-” তুমি কি আমাকে মা|রার প্ল্যান করছো গ্র্যান্ডমা? এই মেয়ে এসব শুনলে আমাকে বৃন্দাবন পাঠাবে। তুমি যত মজা করো যাই করো আমারদের দু বছরের কষ্ট মাটিতে মিশিয়ে দিও না প্লিজ।

রিদিশা হাসি থামিয়ে সিআইডির মতো তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। এরা দাদি নাতি কি ফুসুরফুসুর করছে কে জানে? এরিকের কথায় মিসেস ময়ূরী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে-

-” চিন্তা কইরো না নাতি তীরে এসে তরী ডুবতো না। আমি তরীর রশি ধরে বসে থাকবো।

রিদিশা কথার আগামাথা কিছু না বুঝে, পরীক্ষার খাতার ৭ নং সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর “ঘ” এর হাতের লেখার মতো তাকিয়ে রইলো। তাকে এখানে কমেডি সো দেখাতে বসানো হয়েছে নাকি কে জানে। কতক্ষন তার প্রশংসা করছে। কতক্ষন ফুসুরফুসুর করছে। এরিক মাথা চুলকে একটা হাসি দিয়ে মনে মনে বলল-

-” আমার এই গ্র্যান্ড মাই এখন সব ঠিক করতে পারবে। কিন্তু সে খুশির ঠ্যালায় আমাকে নদীতে ফেলে নিজে নৌকাভ্রমণ না করলে বাঁচি। ফেলিক্স অপেক্ষা করো বাবা তোমার খেল এবার শেষ করবে আমার গ্র্যান্ডমা।

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here