তোকে দিয়েছি মন পর্ব ৩+৪

#তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ৩+৪
Writer: Sidratul muntaz

ইশান ভাইয়ার কবল থেকে ছাড়া পাওয়ার আশায় আমি চাতক পাখির মতো ছটফট করছি…. কিন্তু এই নিয়ে উনার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে। উনি আমার মুখ আরো শক্ত করে চেপে ধরে আমার এক হাত পেছনে আমার পিঠের সাথে লাগিয়ে আমার উপর ঠেস দিয়ে দাড়ালেন। আমি দরজার সাথে একদম মিশে আছি….. আর উনি মিশে আছেন আমার সাথে। নড়তেও পারছি না…. কিছু বলতেও পারছি না। ইচ্ছে করছে উনার হাতের মধ্যে একটা কামড় বসিয়ে দিতে। দিবো নাকি কামড় বসিয়ে?? তারপর বুঝবে আমি কি জিনিস। কামড় দেওয়ার প্রয়োজন হল না। তার আগেই উনি আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে একটু বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন–

সারাক্ষণ এতো ছুটোছুটি করো কেনো তুমি?? একটু স্থির হয়ে দাড়ানো যায় না???

আমি কাদো কাদো ভাব করে বললাম–

দেখুন আপনি আমাকে ছেড়ে দিন। আমার হাত ছাড়ুন। নাহলে কিন্তু আমি….

চুপ!! একদম সাইলেন্ট। আর একটা শব্দ করলে এক চড় দিবো।

কি?? আপনি আমাকে চড় দিবেন?? আপনার এতো বড় সাহস?? একবার দিয়েই দেখুন না। আমি আপনার হাতে কামড়ে দিবো একদম।

আমার কথায় উনি উৎসাহ নিয়ে মুচকি হেসে বললেন–

তুমি তো দেখছি আমার থেকেও কয়েক ধাপ উপরে। আমি তো শুধু কিস করার কথা ভাবছি। আর তুমি ডিরেক্ট কামড়াকামড়ি তে চলে গেলে?? আচ্ছা বলেছোই যখন তখন কর। আমার কোনো সমস্যা নেই। কোথায় কামড়াবে বলো??

উনার কথায় আমি শকড। এসব কি ধরনের কথা বলছেন উনি? অবশ্য এই ধরনের বাজে কথা একমাত্র উনার মুখেই মানায়। ছি! কি পরিমাণ নোংরা এই ছেলে। আমি দাতে দাত চেপে বলে উঠলাম–

দেখুন আপনি যদি আমাকে না ছাড়েন তাহলে আমি কিন্তু চিৎকার করব এবার।

— এখনো তো চিৎকার করার মতো কিছুই করিনি আমি। ( আমার মুখের উপর ঝুকে)

উনার কথা শুনে ভয়ে হার্টবিট ফাস্ট হয়ে যেতে লাগল আমার। আল্লাহই জানে এখন মাথায় কি চলছে উনার। কি করে রেহাই পাবো এই শয়তানের হাত থেকে??
আমাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ আমার কপালে আলতো করে চুমু দিলেন উনি। তারপর আমার চোখের নিচে আলতো করে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বললেন–

চোখে কাজল পড়াটা কি খুব জরুরি তারা?? তোমার এই কাজল মাখা চোখের নেশা ধরানো দৃষ্টিতে যে আমি আসক্ত হয়ে পড়ছি। নিজেকে সামলাতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছি বারববার। তাই হয়তো ছোটখাটো কিছু ভুল হয়ে যাচ্ছে । সেইজন্য সরি তারা!

কথাগুলো ফিসফিসিয়ে বলা হলেও স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমি। আর শুনে ভীষণ লজ্জা লাগছে এবার। আমার লজ্জাকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে উনি আরেকবার খুব আবেগী কণ্ঠে বলে উঠলেন–

শোনো কাজল চোখের মেয়ে… আমার দিবস কাটে বিবশ হয়ে তোমার চোখে চেয়ে। ( সাদাত হোসাইন)

উনার আওরানো এই কয়েকটা পরিচিত লাইন হাজারবার শুনে থাকলেও এই প্রথম কেমন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে আমার। আমাকে উদ্দেশ্য করে কেউ এই কথাগুলো বলছে সেটা ভাবতেই লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে আমার। এই লজ্জা থেকে রেহাই পেতে প্রসঙ্গ পাল্টানোর ইচ্ছায় বলে উঠলাম আমি–

দে দেখুন….. আমার নাম তারিন। আপনি আমাকে তারা বলে ডাকবেন না। আমি আকাশের তারা না….

উনি আমার পেছনে চেপে রাখা হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরতেই থেমে গেলাম আমি। হাতের পেশিতে খুব ব্যথা লাগছে আমার। ইশান ভাইয়া বললেন–

আকাশের তারা কেনো হবে?? তুমি তো ইশানের তারা। ( আমার চোখে চোখ রেখে)

আমি সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে বললাম–

আমার হাতটা ছাড়ুন। ব্যথা পাচ্ছি আমি।

উনি হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন–

ওপপস….. সরি! খেয়াল ছিলনা। বেশি ব্যথা পেয়েছো??

যদিও পেশিতে টনটন করে খুব ব্যথা করছে। তবুও বললাম — না।

ইশান ভাইয়া এবার উনার দুই হাত আমার কোমড়ের উপর রেখে আমাকে কাছে টেনে নিলেন। আমি বিরক্তি দৃষ্টি নিয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমি বুঝতে পারছি না উনার সমস্যা টা কোথায়। কি চায় উনি আমার কাছে?? সত্যিই কি আমাকে ভালোবাসেন উনি?? না এইটা কখনোই হতে পারে না। উনার পরিবেশ আর আমার পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। উনার মতো ওভারস্মার্ট বিত্তশালী অত্যাধুনিক টাইপ একটা ছেলে কখনোই আমার মতো মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ মেয়েকে ভালো বাসতে পারে না। কি নেই উনার?? সবই তো আছে। আমার থেকেও হাজার হাজার সুন্দরী রুপসী মেয়েরা উনার পিছে লাইন লাগিয়ে আছে। এ সবকিছুকে ছেড়ে উনি আমাকে ভালোবাসতে যাবে কোন আক্কেলে? এখন যেটা উনি করছেন সেটা উনার চোখের ভালো বাসা। আমাকে হয়তো উনার চোখে ধরেছে…. মনে নয়। এই কথাটা খুব ভালোভাবেই জানি আমি। কিন্তু তবুও কেন জানি উনার চোখে রাখতেই আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় উনাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় হয়তো সত্যিই আমায় ভালোবাসেন উনি। কিন্তু কেনো এমন মনে হয়?? এটাই কি তাহলে আমার দুর্বলতা?? উনার প্রতি যে আমিও দুর্বল হয়ে পড়ছি। কিন্তু এই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না। ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে ভালোবাসার আগেই কষ্ট পাওয়াটা ভালো নয় কি?? আমার ভাবনার মাঝপথেই হঠাৎ ইশান ভাইয়া আমার কপালে পড়ে থাকা চুল গুলো পরম যত্নে সরিয়ে দিলেন। অতঃপর আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বললেন —

এই মাতাল করা সুভাষ আমার নেশা।

বলেই আমাকে হালকা উচু করে আমার গলায় মুখ গুজলেন উনি। আমি আতকে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে। এর আগে কখনো কোনো ছেলের এতোটা সংস্পর্শে আসিনি আমি। জীবনের প্রথম এই অনুভূতি টা প্রচন্ড যন্ত্রণার মতো লাগছে। আমি উনার শরীরের উষ্ণতা অনুভব করতে পারছি। যা আমার যন্ত্রণা কে আরো কয়েক গুন বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যরকম এই অনুভূতি কে না পারছি সহ্য করতে আর না পারছি অসহ্য করতে। পুরো শরীর যেন কেপে উঠছে বারবার। উনি হয়তো আমার অস্বস্তির কারণ টা বুঝতে পারলেন। তাই মাথা উঠিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়ে নামিয়ে দিলেন আমাকে। আমার পা মাটি স্পর্শ করতেই হাফ ছেড়ে বাচলাম আমি। যেন অনেক বড় একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। আমি উপলব্ধি করলাম আমার চোখের কোণে পানি জমে উঠেছে। জানিনা কেন। ইশান ভাইয়া আমার দুই কাধ স্পর্শ করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন আমাকে। আমার মুখ উচু করে ধরলেন যাতে আমি উনার দিকে তাকাই। কিন্তু লজ্জার কাছে হার মেনে উনার চোখে চোখ রাখতে ব্যর্থ হলাম আমি। এই ব্যপারটিও হয়তো উনি বুঝে নিলেন। পকেট থেকে কিছু একটা বের করে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। জিনিসটা ঠান্ডা হওয়ায় হালকা কেপে উঠে গলায় হাত রাখলাম আমি। যা বুঝলাম এইটা একটা হার। উনি আচমকা আমাকে উল্টো ঘুরিয়ে দিয়ে আমার পিঠে পড়ে থাকা চুল গুলো এক সাইডে সরিয়ে দিয়ে হারটা গলায় পড়িয়ে দিলেন। সবুজ পাথরের এই হারটা আমাকে পরিয়ে দিয়ে উনি কি বোঝাতে চাইছেন সেটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না…. পর মুহুর্তেই পিঠে ঠোটের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম আমি। সাথে সাথে উনার দিকে ঘুরে তাকালাম। উনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পকেটে হাত গুজে আমার দিকে দৃষ্টি রেখে বলে উঠলেন–

এই হারটা বাবা বানিয়েছিলেন। মায়ের জন্য। বিয়ের আগে। অনেক বছর ধরে স্টোর রুমে অনাদরে পড়ে ছিল । আমারও দয়া হল…. ভাবলাম জিনিসটাকে তুলে এনে একটা নতুন রুপ দিলে কেমন হয়?? পাথর গুলো বিন্যস্ত করে নতুন রঙে সাজিয়ে বানিয়ে ফেললাম নিজের মতো করে। ভালোবাসার এই সবুজ পাথরের হার। এতোদিন ধরে উপযুক্ত জায়গা খুজছিলাম এটার জন্য। কখনো ভাবিনি যে এইখানে এসে পেয়ে যাব। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে আমিও পরিয়ে দিলাম তোমার গলায় ভালোবাসার এই পরশ পাথর।

আমি উনার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। হঠাৎ ভাইয়ার গলার আওয়াজে চমকে উঠলাম আমি। ভাইয়া ইশানের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে হয়তো এদিকেই আসছে। ব্যাপারটায় আমি যতটা না ভয় পেলাম তার চেয়ে দ্বিগুণ ভয় পেলেন ইশান ভাইয়া। ভয়ে চমকে উঠে আমার থেকে এক হাত দূরে গিয়ে দাড়ালেন। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুজতে লাগলেন উনি। যা বুঝলাম এখান থেকে পালানোর রাস্তা খুজছেন। দরজা দিয়ে তো কিছুতেই বের হওয়া যাবে না তাহলে নিশ্চিত ভাইয়ার সামনে পড়তে হবে। আমি ইশান ভাইয়ার কান্ড দেখে হেসে দিলাম। ইশান ভাইয়া বিরক্তি ভরা মুখ নিয়ে বললেন —

তোমার ভাইটা আস্তো একটা প্যারা। শালা আমার প্রেমের দফা রফা না করে শান্ত হবে না যা দেখছি।

বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে লাগলেন উনি। হঠাৎ দরজায় ভাইয়া কড়া নাড়ল। ভাইয়ার আওয়াজ শুনে আমার তো আত্মায় পানি নেই। ইশান ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম খাটের নিচে ঢুকে পড়ছেন। এইরকম একটা পরিস্থিতিতেও হাসি আসছে আমার। উনার লম্বা পা গুলো যে খুব সুন্দরভাবে দেখা যাচ্ছে….. আমি চটজলদি বিছানা থেকে কাথা নিয়ে পা গুলো ঢেকে দিলাম। ভয় লাগছে প্রচুর। ধরা পড়ে যাব না তো ভাইয়ার কাছে?? দরজা খুলবো কি খুলবো না বুঝে উঠতে পারছি না।

চলবে।

#তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ৪
Writer: Sidratul muntaz

দোটানায় পড়ে গেছি আমি। নখে কামড় দিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম কি করব। কিন্তু চিন্তা করার সুযোগ টাও বেশিক্ষণ পেলাম না। তার আগেই ভাইয়ার ভারী কণ্ঠের আওয়াজের কাছে হার মেনে দরজা খুলে দিতে হল আমায়। আমি ঘুমের ভান করে ভাইয়ার সামনে দাড়ালাম। আমার এই ভং ধরার আইডিয়া টা কতটুকু কাজে দিল বুঝলাম না…. ভাইয়া আমার দিকে না তাকিয়ে ঘরের ভিতর উকি মেরে কিছু একটা খুজতে লাগলেন। আমি জায়গা থেকে নড়লাম না। খাটের সামনে ঠাই দাড়িয়ে রইলাম। কারণ এখান থেকে সরে পড়লেই কেল্লাফতে। ভাইয়া ইশারা করে আমাকে সাইড হতে বললেন। ভাইয়ার আচরণে ঘাবড়ে গেলাম আমি। কখনো এতোটা গম্ভীর হয়ে আমার সাথে কথা বলেনা ভাইয়া। সবসময় তো মুখে হাসি লেগেই থাকে। তাহলে আজ এতোটা গম্ভীর লাগছে কেনো ভাইয়াকে?? আমি সাইড হয়ে দেয়ালের সাথে লেগে দাড়াতেই ভাইয়া রুমের ভিতর ঢুকে পড়লেন। দুই হাত কোমরে গুজে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলে উঠলেন–

ইশান কোথায় রে??

ভাইয়ার কথা শুনে বেশ অবাক হলাম আমি। ভাইয়া কি তাহলে সবটা বুঝে গেছে?? অবশ্য বোঝারই কথা। ওই ইশান টা যা শুরু করেছে…..ভাইয়া তো আর এতোটাও আহাম্মক না যে কিছুই আন্দাজ করতে পারবে না। কিন্তু এখন চিন্তা হচ্ছে ভাইয়াকে কি জবাব দেব। ভাইয়া যদি একবার বুঝতে পারে ইশান আমার ঘরেই লুকিয়ে আছে….. তাও আবার খাটের তলায়….. ছি কি বিছরি একটা ব্যাপার হয়ে যাবে। কল্পনা করতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে আমার। আতঙ্ক আর ভয় একসাথে মনের মধ্যে চেপে রেখে খুব শান্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে উঠলাম আমি—

ইশান ভাইয়া?? উনাকে তুমি আমার ঘরে এসে খুজছো কেন আজব তো?? যাও দেখো বাহিরে কোথাও আছে হয়তো। অয়ন্তি আপু আর সাফিন ভাইয়াদের সাথে। ( হাই তোলার ভং ধরে)

ভাইয়া রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল–

আমি ইশানের গলার আওয়াজ শুনেছি। তোর ঘর থেকেই আসছিল। আর তুইও কার সাথে যেন কথা বলছিলি। তুই নিশ্চয়ই একা একা কথা বলছিলিস না??

ভাইয়ার কথা শুনে ঘুম টুম সব উড়ে গিয়ে চোখ বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু সেরকম কোনো রিয়েকশন না দেখিয়ে আধখোলা চোখেই ভ্রু কুচকে বলে উঠলাম–

কি আবল তাবল কথা বলছো হ্যা?? ইশান ভাইয়া আমার ঘরে কেনো আসবে?? আর উনার সাথে আমি কথাই বা কেন বলবো?? কথা বলার প্রয়োজন হলে তো সকালেও বলতে পারি। মাঝরাতে ঘুম বাদ দিয়ে উনাকে ডেকে এনে কথা বলতে হবে আমায়?? খেয়ে কাজ নেই নাকি?? যত্তসব আজাইরা।

বলেই আড়মোড়া ভাঙানোর ভান করে হাত দুটো উচু করে টেনে ধরলাম আমি।

ভাইয়া এখনো আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। আমি আড়চোখে ভাইয়াকে একবার দেখে নিয়ে আবার হাই তুলতে তুলতে বললাম–

যাও তো এখান থেকে। নিজেও ঘুমাও আর আমাকেও একটু ঘুমাতে দাও। বিয়ের টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার।

আমার কথা ভাইয়া কতটুকু বিশ্বাস করলেন জানিনা….. কিন্তু হঠাৎ আমাদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে ইশান ভাইয়া বলে উঠলেন —

তারিফ! আমায় খুজছিলিস??

ইশান ভাইয়ার গলার আওয়াজ শুনে আমি তড়িৎ গতিতে খাটের নিচে তাকালাম। কিন্তু খাটের নিচে উনি নেই। ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম ভাইয়া দরজার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমিও দরজার দিকে তাকিয়ে ইশান ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। উনি খাটের নিচ থেকে কখন উঠলেন আর বাহিরেই বা কখন চলে গেলেন কিছু বুঝতে পারছি না আমি। এইটা কি মানুষ নাকি জ্বীন ভুত টাইপ কিছু যে হাটলেও শব্দ পাওয়া যায়না??
তারিফ ভাইয়া দরজার সামনে গিয়ে ইশান ভাইয়ার সাথে হাত মেলাল। এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক লাগছে ভাইয়াকে।
ভাইয়া হাসিমুখ নিয়ে ইশান ভাইয়াকে বলল–

দোস্ত একটা প্রবলেম হয়েছে। আমার ঘরে আয় তোকে বলছি।( আমার দিকে তাকিয়ে) আর তারু তুই দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়। শুধু শুধু ঘুম টা ভাঙালাম তোর।

আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। ভাইয়া সামনের দিকে যেতে লাগল। ইশান ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি হাসি দিয়ে চোখ টিপলেন। অতঃপর ভাইয়াকে অনুসরণ করে শিষ বাজাতে বাজাতে সামনের দিকে পা বাড়ালেন। উনার আচরণে রাগ লাগছে আমার। রাগে গজগজ করতে করতে দরজা লাগাতে যাবো তার আগেই আচমকা ইশান এসে দরজা ঠেলে ধরলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠলাম আমি। ইশান ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বলে উঠলেন–

ভয় পেয়েছিলে?? তোমার ভাই আসলেই একটা ডাফফার। এই ছোট্ট রুমটায় লুকানোর মতো ওই খাটের তলাটা ছাড়া আর কি ছিল?? তবুও একবারও সেদিকে চোখ গেল না তার। তোমার সাথে এতোক্ষন দাড়িয়ে থেকেও গলার নেকলেস টা লক্ষ্য করেনি সে।

নেকলেসের কথা শুনেই গলায় হাত রাখলাম আমি। আসলেই তো….. ভাইয়া এইটাও খেয়াল করলো না??

— পুরাই ইডিয়েট একটা।

ভ্রু কুচকে কথাটা বলেই দরজা ছেড়ে চলে গেলেন ইশান। আমি নাক গাল ফুলিয়ে উনার চলে যাওয়া দেখলাম। তারপর দরজাটা ঠাস করে আটকে দিলাম।

..

..

মায়ের মধুর কণ্ঠের ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার। বেলা বারোটা বেজে গেছে প্রায়। আর আমি এখনো বিছানার মায়া ত্যাগ করিনি। এরজন্য যে মা কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেয়নি এই অনেক। এতোক্ষনে সুনামী বা সাইক্লোন এর মতো কিছু একটা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাসা ভর্তি মেহমান থাকায় হয়তো মায়ের কণ্ঠে কিছুটা মিষ্টতা এসেছে। তাইতো এতোটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ডেকে তুলল আমায়। আমি চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসতেই মা আমার হাতে বড়সড় একটা লিস্ট ধরিয়ে দিলেন। আর সাথে এক গাদা তত্ত্ব। এসব নিয়ে এখন আমায় যেতে হবে ইনা আপু মানে আমার হবু ভাবীর বাড়িতে। এতোকিছু একসাথে ধরবে তো আমার ছোট্ট সাইকেলটায়??
টেবিলে বসে নাকেমুখে নাস্তা খাচ্ছি। খুব জলদি খাওয়া শেষ করে বের হতে হবে আমায়। অনেকটা পথ যেতে হবে। এই আকাবাকা রাস্তা ধরে সাইকেল নিয়ে এতোটা পথ যাওয়া অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জে আমি অভ্যস্ত ছোটবেলা থেকেই। আমার বয়স যখন আট বছর তখন বাবা সাইকেল টা কিনে দিয়েছিলেন আমায়। এখন বাবা নেই….. বাবার সাইকেল আছে। এটা নিয়েই আমার পথচলা। মা ধপ করে পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখায় চমকে উঠলাম আমি। ভ্রু কুচকে মায়ের দিকে তাকাতেই মা বলে উঠল–

উঠেছিস তো বেলা বারোটায়। আর এখন মুরগির মতো ঠুকরে ঠুকরে খাবার খাচ্ছিস। বলি সবকিছু নিয়ে টাইমলি পৌছাতে পারবি তো?? ( ঘাড় বাকিয়ে)

মায়ের কথার উত্তরে কিছু বললাম না আমি। তাকিয়ে রইলাম শুধু। মা ধমকের সুরে বলে উঠলেন–

আবার তাকিয়ে আছে! খা জলদি!

মায়ের ধমকে চমকে উঠে আমি তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। মা চলে গেলেন রান্নাঘরে। আমি খাচ্ছি আর আশেপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছি। খাবার টেবিলটা এমন একটা জায়গায়….. যেখানে বসলে প্রায় পুরো বাড়ির প্রত্যেকটি কোণায় কোণায় নজর রাখা যায়। তারিফ ভাইকে দেখলাম গলায় গামছা পেচিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে হেটে যাচ্ছে। সাফিন ভাইয়া আর অয়ন্তি আপু লুডু খেলছে উঠানের ঠিক মাঝখানটায় বসে। আয়মান ভাইয়ার কানে হেডফোন। ফোনে কথা বলছে না গান শুনছে কে জানে?? কিন্তু মুখের ভঙ্গিমা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে। জায়মা টা কই আছে আল্লাহ মালুম। আশেপাশে তো দেখতে পাচ্ছি না। আমার সঙ্গে ইনা আপুদের বাসায় যেতে হবে ভেবে ভয়ে পালিয়েছে নিশ্চয়ই। এতো মানুষের ভীড়েও আমার চোখ জোড়া শুধু একজন কেই খুজছে। সে হল ইশান ভাইয়া। আমি একদমই চাইছি না উনার কথা ভাবতে কিন্তু তবুও কেনো জানিনা বারবার উনার কথাই মনে আসছে। যত মাথা থেকে উনাকে ঝেড়ে ফেলতে চাই ততই যেন মাথায় আরও ভালো মতো চেপে বসে। খাবারের প্লেট টা রান্নাঘরে রেখে এসে হাত ধুয়ে নিলাম। সবকিছু ঠিকঠাক….. এবার বের হওয়ার পালা। সাথে জায়মা থাকলে ভালো হতো…. কিন্তু মহারাণী তো লাপাত্তা হয়েছেন। অবশ্য তাতে কিছুই আসে যায়না। আমি একাই একশো। গলা থেকে ওরনা টা নিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিলাম। সাইকেলের কাছে যেতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম আমি। সাইকেলের উপর বসে আছে ইশান ভাইয়া। এ্যাশ কালার শার্টের সাথে কালো জিন্স…. চোখে আবার সানগ্লাস ঝুলিয়েছে। বলাই বাহুল্য যে উনাকে পুরা চকলেট বয় লাগছে। একটা জিনিস খেয়াল করলাম….. ইদানীং উনাকে দেখলেই আমার হার্টবিট ফাস্ট হয়ে যায়। জানিনা কেনো।
আমাকে দেখেই সানগ্লাসটা খুলে গলায় ঝুলালেন উনি। সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রেখে মুচকি হেসে বললেন–

লেটস গো!

উনার কথায় ভ্রু কুচকালাম আমি– লেটস গো মানে?? আপনিও আমাদের সাথে যাচ্ছেন নাকি??

উনি ভ্রু নাচিয়ে বললেন — শুধু আমি না… টায়রাও যাচ্ছে। (সাইকেলের ঝুরি থেকে টায়রার খাচাটা বের করে)

— টায়রা কেনো যাবে আমাদের সাথে??

— দরকার আছে। তুমি উঠো।

— উঠো মানে?? আপনি সাইকেল চালাবেন নাকি?? এইটা কিন্তু আপনাদের রাজধানী না….. এইখানকার আকাবাকা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালানো কোনো সহজ ব্যপার না। এইটা একটা চ্যালেঞ্জ।

— চ্যালেঞ্জ টা একবার নিয়েই দেখি।

বলেই সাইকেলের উপর বসে পড়লেন উনি। হুহ….. বেশি ভাব দেখাচ্ছে না….. কিছুক্ষণ পর উনার ভাব কোথায় উড়ে যাবে?? ঝাকি খেয়ে খেয়ে যখন অবস্থা হালুয়া টাইপ হবে তখন বুঝবে। আমি উনার পেছন দিকটায় বসতে যাব ঠিক তখনি উনি বাধ সাধলেন–

এই ওয়েট ওয়েট! এইখানে কেনো বসছো তুমি?? সামনে বসো।

কেনো? সামনে কেনো বসবো?

আরে সামনে সেফটি বেশি। তার ওপর তোমার যেই শরীর। এমন কাঠির মতো শরীর নিয়ে কখন কোথায় পড়ে যাবে….. তারপর পেছনে তাকিয়ে দেখব নেই।

উনার কথা শুনে চোখ সরু করে কোমরে হাত রাখলাম আমি। এর সাথে তর্ক করে আপাতত কোনো লাভ নেই। তাই বাধ্য মেয়ের মতো দুই পা একত্র করে সামনে বসে পড়লাম। আমি বসে পড়তেই সাইকেল চলতে শুরু করল। কিন্তু প্রথমেই এতো স্পিড…….আমি অজান্তেই উল্টোদিকে ঘুরে গলায় জড়িয়ে ধরলাম উনার। ইশান উল্লাসের হাসি হাসতে হাসতে সাইকেল চালাতে লাগলেন। আর আমার মনে হচ্ছে এক্ষুনি সাইকেলটা উল্টে পড়ে যাবে। চারদিকে সবুজ পাহাড় আর আকাবাকা মেঠোপথের রাস্তা অতিক্রম করছি আমরা……. মনে হচ্ছে মনের মধ্যে কেউ ক্রমাগত হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারছে। হ্রৎপিন্ড নামক জিনিসটা যেন বেরিয়ে আসবে এবার। সহ্য করতে না পেরে এবার চোখমুখ খিচে চিৎকার শুরু করলাম আমি। আমার চিৎকারে উনি হাসতে লাগলেন। আমাকে আশ্বস্থ করে বললেন –” কিছু হবে না….. আমি তো আছি!”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here