তোমায় চেয়েছি পুরোটাই পর্ব -২৯+৩০

#তোমায়_চেয়েছি_পুরোটাই
#পার্টঃ২৯
#জয়ন্ত_কুমার_জয়

বৃষ্টিতে মিষ্টির শরীরে চিপকে থাকা শাড়ির আঁচলটা বিষন্নের ছোঁয়ায় নিচে পড়ে গেলো।এই বড়বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো তারাও পরম সুখে ঝড়ে পড়ে যাচ্ছে।

কালো পোশাকের কোর্ট পরিহিত একজন লোক তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।তার হাতে একটা বড় মাপের ট্যাব এবং একটা লম্বা খাতা।সম্ভবত তিনি এই ট্রেনের টিকিট মাষ্টার।বিদ্যুৎ চকমকানোর ক্ষনিকের আলোতে তিনি বিষন্ন এবং মিষ্টিকে দেখতে পেলেন।বিষয়টা দেখে তিনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলেন।শব্দ করে কাশলেন।কাশির শব্দে বিষন্ন তেমন চমকালো না,তবে মিষ্টির ইচ্ছে এখনি এই চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়তে।টিকিট মাষ্টার কাছে আসতেই মিষ্টি লজ্জায় সেখান থেকে সরে গেলো।তিনি স্বাভাবিক ভাবেই বললেন

” নাম্বার কত ”

” কিসের নাম্বার ”

” সিট নাম্বার,টিকিট দেখান ”

বিষন্ন কি উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না।সরাসরি কি বলে দিবে যে তাদের কাছে কোনো টিকিট নেই,একটা মেয়ের মন ভালো করার একটা চেষ্টায় হঠাৎ ট্রেনে উঠে পড়েছে।এইসব বলা অর্থহীন।বিষন্নর একটু ভয় হতে লাগলো,তবে এখন ভয় পেলে হবে না,সাহস রাখতে হবে।বিষন্ন বললো

” আসলে আমি টিকিট কাটিনি ”

” টিকিট ছাড়াই ট্রেনে উঠে পড়লেন? এর জন্য যে আইনি ব্যবস্থা হতে পারে সেটা জানেন? ”

” সত্যি বলতে টিকিট কাটার সময় পাইনি,কাউন্টারে যাবো এমন সময় ট্রেন ছেড়ে দিলো ”

” আচ্ছা বুঝলাম,কোন স্টেশনে নামবেন ”

বিষন্ন হকচকিয়ে গেলো।ট্রেনে এর আগে কখনো সে কোথাও যায়নি।আর এই ট্রেন কোন কোন স্টেশনে থামে সেটাও তার জানা নেই,তাহলে এখন উত্তরে কি বলবে সে?।বিষন্ন ইতস্তত করে বললো

” সামনের দুইটা স্টেশন পরেই নেমে যাবো ”

” সামনে দুইটা স্টেশন নেই,একটা আছে আর ডিরেক্ট সেই স্টেশনেই থামে ”

” আ….আসলে….মানে…..”

” আরে ব্রাদার এতো ভয়ের কিছু নেই।এইটা কোনো বিষয়ই না,আপনার বয়সে আমরাও এরকম কত করেছি।”

বিষন্ন একটু লজ্জা পেলো।বুঝতে পারলো মিছেমিছি ভয় পাচ্ছিলো এতোক্ষণ,টিকিট মাষ্টার অতি ভালো মানুষ,তিনি কোনো ঝামেলা করবেন না।টিকিট মাষ্টার কাছে এসে বললেন

” ব্রাদার মা’লটা আগুন।আসেন দু’জনে মিলে মজা করি,”

বিষন্ন প্রথমে বুঝতে পারলো না তিনি ঠিক কি বলছেন।ভ্রু কুচকে বললো ” কিসের মজার কথা বলছেন ”

” যে মজা এতোক্ষণ নিচ্ছিলেন সেই মজা।এই টাইপের মেয়েরা যে এতো সুন্দর হয় আগে দেখিনি।দু’জনে মিলে সারারাত মজা করবো,কি বলেন?কেবিন ফাঁকা আছে ”

_____________________

” আর কত সিগারেট খাবে? একদিনে আট প্যাকেট শেষ করেছো,”

” রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠছে,কত্তবড় সাহস,এইটুকু বয়সেই নাকি,” এতটুকু বলেই বিষন্নের বাবা পরের সিগারেট ধরালেন।বিষন্নের মা বললেন

” বাচ্চা ছেলে, এখনি তো ভূল করবে তাই না? আমার মনে হয় এটা বেশি বেশি হয়ে গেছে।ছেলেটাকে কাল রাত থেকে দেখিনা,বু’কটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে আছে ”

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে রাগি স্বরে বললেন ” বেশি বেশি মানে কি? এইটুকু বয়সে কিসের প্রেম, আর মিষ্টিই বা কিভাবে সেটাকে সায় দিলো ”

” আমার ছেলের মতো শান্তশিষ্ট ছেলেকে যেকোনো মেয়েই ভালোবাসবে, তোমার মত না যে সারাক্ষণ টাকের আগালে রাগ নিয়ে থাকে ”

” আমি টাকের আগালে রাগ নিয়ে থাকি? ”

” তাতো থাকোই।আর ছেলের দোষ কেনো দিচ্ছো,নিজের কথা ভুলে গেছো নাকি? মনে আছে ওর বয়সে তুমি কি কি করছো? ”

বিষন্নের বাবা ইতস্তত ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিতে দিতে বললেন ” আমার আর ওর বিষয়টা এক হলো নাকি,কি যে বলো ”

” হ্যা এক তো নয়’ই।তোমার ছেলে করেছে ইন্টারে উঠে আর তুমি তো ক্লাস নাইনে থাকাতে।বাপের গুন ছেলের মধ্যে তো থাকবেই ”

” আরেহ বাহ,,শুধু এইগুনটাই নিলো? ”

” হ্যা, এখন এইসব রাগটাগ বাদ দিয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।তোমার বাবার তিন ছেলে,তাই তোমাকে বাড়ি থেকে বেড় করে দিয়েছে,তিনবছর পর আবার মেনে নিয়েছে।আর আমার একটাই ছেলে ”

” হ্যা এখন যা দোষ সব আমার,আমার বাপের আমার তিনপুরুষের ”

” হ্যা ঠিক তাই।তোমার ম্যানেজারকে বলো বিষন্নকে খুঁজে আনতে।নীলু রাতে খায়নি,এই মেয়েটার এতো রাগ কেন বুঝিনা,বাপ মায়ের থেকে কি ভাইয়ের প্রতি ওর ভালোবাসা বেশি নাকি ”

” হাহাহা,ও হয়েছে আমার মতো,রাগী হলেও ভেতরে ভেতরে অনেক ভালোবাসা।দেখোনা বিষন্নর একটু জ্বর হলেই কেমন চিল্লাচিল্লি লাফালাফি করে বাড়ি মাথায় তুলে রাখে,”

নীলু জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে।এমন সময় সমুদ্রর ফোন এলো।ফোন রিসিভ করে নীলু বললো

” আমার খুব মন খারাপ লাগছে জানেন? ইচ্ছে করছে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলি ”

” কিসের জন্য মন খারাপ? ”

” ওইযে তখন ওভাবে রেগে ফোন কেটে দিলাম এজন্য।জানেন কি হইছে? বিষন্ন আমার বান্ধবীকে ভালোবাসে,সেটা বাবা বুঝতে পেরে ওকে বাড়ি থেকে বেড় করে দিছে।এটা শুনে তো আমার মাথায় র’ক্ত উঠে গেছে।আমার ভাইকে বাড়ি থেকে বেড় করে দিবে আর আমি চুপচাপ মেনে নিবো নাকি।সোজা গেলাম বাবার কাছে,গিয়ে বলে এসছি কাল সকালের মধ্যে যদি বিষন্নকে না আনলে কি অবস্থা করি দেখবে ”

” উনি কি বললেন? ”

” শুনিনি,বলেই চলে এসছি ”

” বলেন কি।আঙ্কেলের এতো রাগ?আমার তো এখন ভয় হচ্ছে ”

” আপনার কিসের ভয়?”

” বারবার তো বলছেন বিয়ের কথা আপনার বাবাকে বলতে।যদি বলি তাহলে তো আমায় খু’ন করে ফেলবে ”

” কিসব যে বলেন আপনি,বাবা খুব ভালো মনের মানুষ ”

” একটু ছাঁদে আসবেন? ”

” এই বৃষ্টিতে ছাঁদে কেনো? ”

” তখন রাগ করে ফোন কেটে দিলেন,আমার ভিষণ খারাপ লাগছিলো।চিন্তায় মাথা কাজ করছিলো না,তাই আপনার বাড়ির সামনে এসে তখন থেকে দাড়িয়ে আছি ”

” মানে কি? তখন থেকে দাড়িয়ে আছেন? ফোন করে বললেই তো যেতাম ”

” সাহস হয়ে ওঠেনি,এখন একবার যদি আসতেন।একবার দেখে চলে যাবো ”

” দাঁড়ান আমি আসছি ”

নীলু ফোনটা কেটে দিলো।অজান্তেই চোখ ভিজে উঠলো।মনে মনে ভাবলো,এতো ভালো একটা মানুষকে আমি কষ্ট কেনো দিলাম।রেগে ফোন কেটে দিছি জন্য বোকাটা বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে আছে।এই সরলতাই জন্যই তো আপনাকে এতো ভালোলাগে।আপনাকে এতো ভালোবাসি কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারিনা।অথচ দেখা হলে শুধু ঝগড়া,তর্ক এগুলাই করি।আপনি মনে হয় আমাকে খুব রাগি মেয়ে ভাবেন তাই না? সত্যি বলছি আমি রাগি হলেও আপনাকে অনেক ভালোবাসি।আমি অনেক ভালো একটা মেয়ে,আপনি সেটা বুঝবেন,কিন্তু একটু দেরিতে।

_________________________

বৃষ্টির ঘন কালো মেঘ সরে গিয়ে ভোরের আলোর আলো চারদিকে উপচে পড়ছে।মিষ্টি ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে। সারারাত কেটেছে ভেঁজা শাড়ি পড়ে।বিষন্নও ঠান্ডায় কাঁপছে। দু’জন একসাথে বসে ঠান্ডায় কাঁপছে।অপেক্ষা করছে কখন ট্রেন স্টেশনে থামবে।মিষ্টি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাড়ালো। ওয়াসরুমে যেতে হবে,উপায় না থাকলেও নোংরা ওয়াসরুমে যেতেই হচ্ছে। মিষ্টি লোহার প্লেনশিটের দরজাটা খুলে ভেতরে তাকাতেই আঁতকা এক চিৎকার দিয়ে পেছনে সরে গেলো।পেছনে সরে যেতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো।তাকিয়ে দেখলো বিষন্ন।বিষন্ন জানে মিষ্টি এভাবে ভয় পাবে।কেন ভয় পাবে সেটা আগেই বলা উচিৎ ছিলো,কিন্তু বলেনি,বললে মিষ্টি শুধু শুধু চিন্তা করতো।

মিষ্টি দরজা খুলতেই ভেতরে দেখলো কালো কোর্ট পড়া একজন লোক চোখ বন্ধ করে গুটিশুটি মেরে পা মেঝেতে ছড়িয়ে আছে।মুখ র’ক্তে মাখামাখি।ভয়ে মিষ্টির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেলো।বিষন্নর টি-শার্ট শক্ত করে ধরে বললো

” বি…বিষন্ন,ভেতরে ল…..লা’শ ”

” এতো ভয় পেয়ো না,ওটা লা’শ না,বেঁ’চে আছে ”

” এ…এখানে কিভাবে এলো,”

বিষন্ন মিষ্টিকে রাতের ঘটনা বললো।মিষ্টি ফ্যাকাসে মুখ করে বললো

” এজন্য এইভাবে মা’রবি?লোকটাতো ম’রেই যেতো ”

” তোমায় নিয়ে একটু বাজে কথাও আমার সহ্য হয় না ”

” এরকম কেন তুই বিষন্ন?তোকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয়,কেনো সবসময় এতো মা’রপিটে যাস। তোর যদি কিছু হয়ে যেতো ”

কথাটা বলে মিষ্টি বিষন্নর বু’কে মুখ গুজে কান্না করছে।বিষন্ন মিষ্টির চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো
” তোমার নিয়ে এতটুকু বাজে কথা আমি কখনো সহ্য করবো না,”

এখন মিষ্টি বেশ স্বাভাবিক।এনাউন্সমেন্ট করা হলো দুই মিনিট পর স্টেশনে ট্রেন থামবে। মিষ্টি বললো

” লোকটা এভাবে থাকলে তো ম’রে যাবে,ওর হাত পা খুলে দেওয়া দরকার ”

” একটু আগে গিয়ে খুলে দিয়ে এসছি ”

” এরজন্য কোনো বিপদে পড়ে যাবো না তো?এই সিসি ক্যামেরাগুলো মনে হয় এক্টিভ আছে,আমার কেন জানি ভয় করছে ”

” শুধু শুধু ভয় পাও তুমি ”

স্টেশনে ট্রেন থামলো।বিষন্ন, মিষ্টি দু’জনই নামলো।তারা দুজন নামতেই বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো।মিষ্টির মুখ ভয়ে রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে বর্ণ ধারন করলো।তাদের সামনে পাঁচজন পুলিশ দাড়িয়ে আছে।নির্জন স্টেশনে মিষ্টি বিষন্ন আর একদল পুলিশ। তবে টিকিট মাষ্টারকে মা’রার কথা পুলিশ কোনো ভাবে জেনে গেছে?

পুলিশের মধ্যে থেকে একজন বললেন ” অনেক তো ঘুরলেন,এবার থানায় চলুন ”

মিষ্টির মনে হলো,” ঘোরার কথা কেন বললো? তবে কি সত্যি সত্যিই টিকিট মাষ্টার কোনোভাবে পুলিশকে বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছে? সিসি ক্যামেরায় কি সবটা রেকর্ড করা হয়েছে?

চলবে?#তোমায়_চেয়েছি_পুরোটাই
#পার্টঃ৩০
#জয়ন্ত_কুমার_জয়

গাড়িতে মিষ্টি বিষন্ন দু’জনই উঠে বসলো। ভয়ে মিষ্টির সারা শরীর কাঁপছে।বিষন্নকে দেখে মনে হচ্ছে তার এই বিষয়ে কোনো কৌতুহল নেই।বরং এমনটাই হওয়া যেন স্বাভাবিক। স্টেশন ছেড়ে পুলিশের গাড়িটি দেড় ঘন্টা পর শহরের রাস্তায় পৌঁছালো।বিষন্নের কাঁধে হেলান দিয়ে এতোক্ষণ মিষ্টি ঘুমাচ্ছিলো।হঠাৎ হর্ণের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেলো।তাদের সামনে তিনজন পুলিশ ঝিমুচ্ছে। বিষন্ন গাড়ির ফাঁকা অংশ দিয়ে বাইরের জ্যাম খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে।বিষন্ন সামনের ড্রাইভারের সাথে বসে থাকা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বললো

” স্যার আমরা কোথায় যাচ্ছি ”

” ঢাকায় ”

” ও আচ্ছা।আমার খুব খিদে পেয়েছে,আর শপিং ও করতে হবে ”

পুলিশ অফিসার ভ্রু কুচকে বললেন ” শপিং করবেন?”

” জি।ভেজা কাপড়ে আর থাকতে পারছি না।এক কাজ করুন, আপনাদের কাউকে পাঠান,একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার কিনে আনতে বলুন।ভয় নেই টাকা দিবো ”

” জ্যামে আঁটকা অবস্থায় সম্ভব না ”

” ভয় নেই,এই জ্যাম আরো এক ঘন্টা থাকবে,এতোক্ষণে কেনাকাটা হয়ে যাবে ”

অফিসার তাদের একজনকে বললেন ড্রেস কিনে আনতে।সামনে বসে থাকা পেটমোটা মাঝবয়সী পুলিশ নেমে বললো ” টাকা দেন ”

” টাকা তো নেই,কার্ড আছে, কার্ড নিয়ে যান ”

অফিসার বললেন ” কার্ড রাখুন, আমি ক্যাশ দিচ্ছি,পরে দিয়ে দিবেন ”

” আচ্ছা ”

মিষ্টি ভেবে পাচ্ছে না বিষন্ন এতো স্বাভাবিক আছে কিভাবে।এদিকে রাত থেকে কিছু না খেতে পেরে মিষ্টির পেট মোচড় দিচ্ছে। বিষন্ন আবারো চেঁচিয়ে পেটমোটা পুলিশটাকে ডাকলো।তিনি দূর থেকে ফিরে এলেন রাগি মুখে।বিষন্ন বললো ” ড্রেসের সাথে কিছু খাবার নিয়ে আসতে হবে।একটা বার্গার,একটা কোক।মিষ্টি তুমি কি খাবে? ”

হঠাৎ প্রশ্ন করায় মিষ্টি কাচুমাচু করতে করতে বললো ” আমার খিদে নেই ”

বিষন্ন বললো ” তাহলে শুধু এটাই নিয়ে আসুন।”

থানায় পনেরো মিনিট ধরে অফিসারের সামনে বসে আছে বিষন্ন এবং মিষ্টি। বিষন্ন অফিসারের উদ্দেশ্য বললো

” আমাদের থানায় কেনো নিয়ে এসছেন ”

” আপনার বাবার কথায় ”

” মানে? ”

” আপনার বাবা বলেছেন আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ”

” ও আচ্ছা ”

অফিসারের কথায় মিষ্টির বু’কের ওপর থেকে যেন বড় একটা পাথর সরে গেলো।তারমানে সে যা ভাবছে তেমনটা নয়।মিষ্টি উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে বললো

” তার মানে টিকিট মাষ্টারের অভিযোগে আমাদের ধরে আনেননি।ওহহ গড,আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম ”

কথাটা বলে মিষ্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে আরামে হেলান দিয়ে বসলো।অফিসার ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করলেন

” টিকিট মাষ্টারের অভিযোগ মানে? ”

অফিসারের প্রশ্নে মিষ্টি চোখ বড়বড় করে তাকালো বিষন্নের দিকে।দেখলো বিষন্নও ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মিষ্টি বুঝতে পারলো সে একটা গাধার মতো কথা বলে ফেলছে।অফিসার আবারো বললো

” কি হলো বলুন? টিকিট মাষ্টার কি? ”

মিষ্টি ঠোক গিলে দ্রুত গতিতে বললো ” আমি কিছু জানিনা,বিষন্ন জানে,ওকে বলুন ও সবটা বলবে ”

অফিসার বিষন্নকে উদ্দেশ্যে করে বললো ” বলুন কি হয়েছে ”

বিষন্ন আমতা আমতা করে বললো ” না মানে টিকিট না কেটেই উঠেছিলাম,সেটার কথাই বলছে ”

” ওহ আচ্ছা,”

বিষন্ন অফিসারের দিকে হেসে তাকালো মিষ্টির দিকে।মিষ্টি একচোখ মেলে বিষন্নের রাগি মুখ দেখে আবারে চোখ বন্ধ করে দুহাত দিয়প মুখ ঢেকে ফেললো।বিষন্ন অফিসারকে বললো

” বাবা কি আসবে বলেছে? ”

” হ্যা,ওনাকে খবর পাঠানো হয়েছে,কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন ”

” ওহ আচ্ছা,আমরা কি বাইরের টংটাতে বসতে পারি? ”

” হ্যা পারেন ”

বিষন্ন মিষ্টিকে নিয়ে টংয়ে গিয়ে বসলো।মিষ্টি মাটিতে তাকিয়ে আছে।সে জানে এখন বিষন্নের কাছ থেকে বকা শুনতে হবে তখন অফিসারের সামনে গাঁধার মতো প্রশ্ন করার জন্য।বিষন্ন কিছি বলবে তার আগেই মিষ্টি বললো

” আমার কেমন যেন মাথা ঘুরাচ্ছে,আমি মনে হয় ম’রে যাচ্ছি! ওমাগো ম’রে গেলাম ”

কথাটা বলে মাথায় হাত রেখে অজ্ঞান হওয়ার ভান করতে লাগলো মিষ্টি। বিষন্ন বেশ বুঝতে পারছে মিষ্টি ইচ্ছে করেই এমন করছে যেন সে বকা দিতে না পারে।বিষন্ন গম্ভীর স্বরে বললো

” ঢং করবা না ”

মিষ্টি আহ্লাদী সুরে বললো ” আমি ঢং করি? ”

” শুধু ঢং না,যত অকাম,বোকামি যা আছে সব করো ”

” হু জানি জানি,এখন সব দোষ তো আমার।এখন তো আমাকে আর ভাল্লাগবে না।কত দোষ বেড় হবে,কেবল শুরু ”

বিষন্ন কি বলবে বুঝতে পারছে না।তবে মিষ্টির বাচ্চামি স্বভাবটা এই প্রথম সে দেখছে।এর আগে মিষ্টি সবসময় ম্যাচিউরিটি দেখাতো,সবসময় এমন ভাবে কথা বলতো যেন মনে হতো সেই একমাত্র সিনিয়র।মিষ্টি আবারো বললো

” আমার খুব খিদে পেয়েছে,খিদের জ্বালায় পে’টে ইঁদুর ডিম পেড়েছে বোধহয় ”

” তাহলে তো ভালোই,ডিমটা বেড় করে খেয়ে ফেলো,”

” ছিহ,কিসব বলে, ওয়াক ”

” একটু আগেই তো গাড়িতে বললাম, তখন বললে খিদে পায়নি ”

” তখন তে ভয় পেয়েছিলাম, এখন ভয় নেই ”

” আচ্ছা বুঝলাম ”

” এই বিষন্ন শোননা ”

” বলো ”

” আঙ্কেল তোকে খুঁজতে পুলিশকে পাঠিয়েছে, তার মানে কি আঙ্কেল আন্টি সবটা মেনে নিয়েছে?আমার কেন জানি এমনটা মনপ হচ্ছে, তোর কি মনে হচ্ছে ”

” আমি কি জানি,”

বিষন্নের উত্তরে মিষ্টির উৎসুক মুখ ভোতা হয়ে গেলো।ভোতা মুখে মিষ্টি পাশ ফিরে বসলো।মনে মনে ভাবলো ” এই ব্যাটা এতো বদমাশ কেন?এমনি হলে তো রোমান্টিজম গলে গলে পড়ে। ” বাবা,মা আমাদের মেনে নিয়েছে,আমাদের বিয়ে খুব শীঘ্রই হবে ” এরকম কিছু একটা বললে কি এমন হতো ওর?কেন যে এটা বলতে গেলাম,এখন নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে।ছিহ মিষ্টি, তুই কিভাবে নিজের বিয়ের কথা বলিস?।নিমিষেই এইসব চিন্তা হাওয়া হয়ে গেলো।ব্যাথায় মিষ্টি চিল্লিয়ে উঠলো কেননা বিষন্ন মিষ্টির চুল টান দিয়েছে। মিষ্টি বিষন্নের নাক টেনে ধরে বলল

” কেমন লাগে এখন হ্যা? চুল টেনেছিস না? এইবার দেখ তোরনাক টমেটো বানায় ফেলবো ”

বিষন্ন ব্যথায় কুঁকড়ে বললো ” আউ,মিষ্টি লাগছে।ছাড়ো,আমার কুতকুতি লাগছে খুব ”

একটুপর মিষ্টি ছাড়লো। বিষন্ন দুইহাতে নাক চেপে ধরে আছে।বিষন্নেই এই অবস্থা দেখে মিষ্টির খুব হাসি পাচ্ছে। পরোক্ষনেই দেখলো টংয়ের ওপর তিন প্লেট ফুসকা,একটা কোক।মিষ্টি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফুসকা একেরপর এক টপাটপ মুখে দিচ্ছে।

দুই প্লেট শেষ করে তৃতীয় প্লেটের ফুসকা হাতে নিয়ে মুখে তুলবে এমন সময় চোখ পড়লো বিষন্নের দিকে।বিষন্ন চকচকে চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মিষ্টি পরোয়া না করে হাতে থাকা ফুসকা মুখে দিলো।মুখে দিয়ে আবারো তাকালো বিষন্নের দিকে।চোখ পড়লো বিষন্নের লাল টসটসে নাকেট ওপর।এটা দেখে মিষ্টি হাসি থামাতে পারলো না, হাসতে গিয়ে মুখের ফুসকা পুরোটাই উড়ে এসে পড়লো বিষন্নর পুরো মুখে।

” কই দেখি চোখটা, ইশশ লাল হয়ে গেছে ”

মিষ্টির কথায় বিষন্ন কিছু বললো না।ফুসকার ঝাল অংশের অনেকটাই বিষন্নের চোখে পড়েছে।প্রায় এক ঘন্টা ধরে ফুসকার দোকানের মাঝারি কলটা থেকে বিষন্ন চোখে জল দিয়েছে।মিষ্টি হন্তদন্ত হয়ে কলে চাপ দিচ্ছিলো।আর বারবার বলছিলো

” সরি রে,হাসি আটকাতে না পেরে মুখ থেকে বেড় হয়ে গেছে।বেশি বেশি করে চোখে জল দে,”

বিষন্ন খুব দ্রুত জলের ছিটে চোখে দিচ্ছে। মাঝেমাঝে মিষ্টি বলছে
” জলের ছিটে দেওয়ার সময় চোখ বন্ধ করলে জ্বালা কমবে কেমনে? চোখ খোলা রেখে তারপর জলের ছিটে দে ”

মিষ্টির পাকনামি কথায় বিষন্ন বললো ” চুপ থাকো,কল জোরে চাপো ”

” আমি কি আস্তে চাপতেছি নাকি? ছোট কলে আর কত জোরে চাপ দিবো ”

মিষ্টি একটু নীচু স্বরে বললো ” এখনো কি জ্বালা করছে? ”

বিষন্ন এবারেও চুপ।কিছু বললো না।বিষন্নর চুপ থাকা দেখে মিষ্টি বললো ” কিছু না বললে বুঝবো কেমন করে জ্বালা করছে কিনা? ”

” একটু একটু করছে ”

” কই দেখি দেখতে দে,হাত সরা ”

বিষন্ন চোখ থেকে হাত সরালো।মিষ্টির মন খারাপ হয়ে গেলো।বিষন্নের চোখ গাঢ় লাল বর্ণ ধারন করেছে।মিষ্টি দুঃখিত ভঙ্গিতে বললো ” আমি ইচ্ছে করে করিনি রে,”

” আমি জানি,মন খারাপ করিও না,এখন আর জ্বালা করছে না ”

মিষ্টির চোখে জল চলে এলো।বিষন্নকে জরিয়ে ধরে বললো ” এতো কষ্ট দেওয়ার জন্য এত্তোগুলা সরি,আই লাভ ইউ ”

” চোখে ফুসকার ঝাল দিয়ে আই লাভ ইউ বলতেছে, বাহ,সে আমারে কত্তো ভালোবাসে।আমার কপাল এরকম ভালোবাসা পাইছি ”

” এবার কিন্তু ভালো হচ্ছে না, ”

” মজা করছি পাগলি ”

কিছুক্ষণ পর বিষন্নের বাবা এলেন।বিষন্ন এবং মিষ্টিকে নিয়ে গেলেন বাড়িতে।এরমধ্যে বিষন্নকে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যাওয়া হলো।ডাক্তার চোখ দেখে কিছু ঔষধ লিখে দিলেন,সাথে একটা গ্লাস দিলেন।বিষন্নকে দেখে তার মা ছুটে এলেন।ছেলেকে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরলেন,সাথে মিষ্টির কপালেও চু’মু দিলেন।বিষন্ন মাকে বললো ” মা মিষ্টির কাপড়টা ভেজা,একটু চেঞ্জের ব্যবস্থা করো ”

” হইছে থাক,অনেক হইছে ভালোবাসা।বাকিটা এবার আমি দেখে নিবো,তুই নীলুর ঘরে যা তো।ও কাল রাত থেকে কিচ্ছু খায়নি,রেগে ফুলে আছে ”

বিষন্ন একটু লজ্জা পেলো।ইতস্তত হয়ে ওপরের নীলুর ঘরের দিকে গেলো।দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে নীলু কড়া গলায় বললো

” বললাম না কেউ বিরক্ত করবে না,এবার কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম ”

” আপু আমি,বিষন্ন ”

প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুললো নীলু।বিষন্নে জরিয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো ” তুই কোথায় ছিলি? আমিমকত খুজলাম,তোর বন্ধুদের বাড়িতে খোজ নিলাম ওরা বললো তুই ওদের কারো বাড়িতে নেই ”

” একটা ফ্রেন্ডের মেসে ছিলাম”

” একদিনেই কেমন মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।তুই বস আমি খাবার নিয়ে আসছি ”

বিষন্ন বিছানায় বসলো।নীলু খাবার নিয়ে এসে বলল ” হা কর,আমি খাইয়ে দিবো ”

দরজায় দাড়িয়ে মা তার দুই ছেলে মেয়ের ভালোবাসা দেখছেন। নীলু পরম যত্নে বিষন্নকে খাইয়ে দিচ্ছে,বিষন্নও খাইয়ে দিচ্ছে নীলুকে।ভাই বোনের এই ভালোবাসা দেখে তার চোখে জল চলে এলো।নীলুর কাছে বসে তিনি বললেন

” এখন খুশি তো? ”

নীলু ভ্রু কুচকে বললো ” মা তুমি এখন এখান থেকে যাও,আমার রাগ এখনো কমে নি ”

তিনি হাসতে হাসতে উঠে চলে গেলেন।ভাই বোনের এই ভালোবাসায় তিনি বেমানান।বিষন্ন নীলুর মুখে পরোটার টুকরো তুলে দিতে দুতে বললো

” তারপর বলতো আপু,মিঃসমুদ্রর কি খবর!”

নীলু লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে বললো ” ধূর কি যে বলিস ”

” হাহাহা,তুমি না বললেও আমি বুঝিতো,আমি এখন বড় হয়ে গেছি ”

” হু তুমিতো অনেক বড় হয়ে গেছো ”

” এখন বল,আচ্ছা তোরা বিয়ের বিষয়ে কিছু ভেবেছিস নাকি? ”

নীলু লজ্জায় অন্যদিকে মুখ করে বললো ” না এখনো এসব কিছু বলেনি।বলছে সব চাকরি পেলো,কিছুদিন যাক,আমার পরিক্ষাটাও হয়ে গেলে তখন বাবাকে বলবে ”

” বাবাকে বলার মতো সাহস ওনার আছে? ”

” তুই আছিস কি জন্য,তুই বুঝিয়ে বাবাকে রাজি করাবি।উনি তো হাদারাম,বাবার সামনে এলে কথাও বলতে পারেনা ভয়ে ”

” আমি বাবাকে রাজি করাবো? হাহাহা,একবার বাড়ি থেকে নির্বাসিত হয়েছি,আর না ”

” প্লিজ লক্ষ্ণী ভাইটি আমার,বোনের জন্য এটুকু করবি না? ”

সারারাত তেমন ঘুম হয়নি।ফ্রেশ হয়ে বিষন্ন মিষ্টি দু’জনই ঘুমিয়েছে।মিষ্টি ঘুমিয়েছে বিষন্নের মায়ের ঘরে,বিষন্ন নিজের ঘরে।রাতে খাবারের পর বিষন্নের বাবা বিষন্ন, মিষ্টি দু’জনকেই ডাকলেন।বিষন্নের মা,নীলু,এবং মামাও উপস্থিত। বিষন্নর বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন

” আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা জানাতেই সবাইকে এখানে ডাকা ”

মামা আনন্দিত গলায় বললেন ” সিদ্ধান্তটা তো সবাই জানে।বিষন্ন আর মিষ্টির বিয়ে।দুলাভাই আমি কার্ডের ডিজাইন পছন্দ করে রেখেছি,কার্ডের ওপরে লেখা থাকবে আমার নতুন একটা ছন্দ, আর…..”

মামার কথা থামিয়ে দিয়ে বাবা কঠিন গলায় মাকে বললো ” তোমার ভাইকে থামতে বলবে?”

মামা গম্ভীর স্বরে বললেন ” আমি একজন কবি দুলাভাই,আর কবিকে কখনো থামানো যায় না ”

বাবা ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না।শান্ত ভঙ্গিতে বললেন

” আমার সিদ্ধান্ত হলো বিষন্ন আর মিষ্টির বিয়ে হবে না।মিষ্টি, বিষন্ন, তোমরা দু’জন এরপর থেকে কখনো একসাথে হবে না।পরিক্ষাটা শেষ হলেই বিষন্নকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে হায়ার স্টাডিজের জন্য। এই নিয়ে আর কোনো কথা আমি শুনতে চাচ্ছি না।আমার মতের একটুও নড়চড় হলে আমি ভুলে যাবো বিষন্ন আমার ছেলে ”

কথাগুলো যেন মিষ্টির কানে বুলেটের মতো আঘাত করছিলো।মনে হচ্ছিলো কেউ বুলেট তার কানের দিকে তাক করে চালাচ্ছে। চোখের সামনটা হঠাৎ যেন কালো হয়ে গেলো।মিষ্টি বুঝতে পারলো সে টলে মেঝেতে পড়ে যাচ্ছে।এখানেই হয়তো সবটার সমাপ্তি।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here