তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব -১০

#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(১০)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

শীতের সকাল চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে ঠান্ডা আবহাওয়ায় ঘেরাও। তার‌উপর রুমের সমস্ত দরজা, থাই গ্লাস খুলে রেখে দিয়েছে রাহা। এই কনকনে শীতের মাঝেও মেয়েটা গরম পোশাক পরিধান করেনি। শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে আছে। তারা কথা বলতে পারলে হয়তো চিৎকার করে বলতো, আমাদের ভীষণ ঠান্ডা লাগছে আমাদের এভাবে কষ্ট দিও না। কিন্তু আফসোস তারা বলতে পারছে না। নজরাত কাবার্ড খুলে একটা চাদর নিয়ে রাহা’র শরীরে জরিয়ে দিল। তারপর ঠান্ডা মাথায় রাহা’কে বলল,
—” সেল্ফ হার্ম অর্থাৎ নিজেকে নিজে কষ্ট দেওয়া বা ধ্বং’স করা নিষিদ্ধ। কেননা মূলত এই দেহের প্রকৃত মালিক আল্লাহ। আর আমরা কেবল সাময়িক ভোগ দখলকারী মাত্র। যেহেতু মূল মালিক আমরা নই তাই একে ক্ষ’তির সম্মুখীন করার অধিকারও আমাদের নেই। এর দ্বারা বরং আমানাতের খেয়ানত হবে। এবং কুরআনে এর স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে। যেমনঃ নিজের জীবনকে ধ্বং’সের সম্মুখীন করো না।[১]

তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হ’ত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।[২]

রাহা নজরাত কে জরিয়ে ধরে কান্না করে বলে,
—” না ভালো মেয়ে হতে পেরেছি, না ভালো ননদিনী আর না ভালো স্ত্রী। আমি কি করবো বলো তুমি? ভাইয়া যেন সুখী হতে পারে তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে সে জন্য আমি মিথ্যা বলতেও দ্বিতীয় বার ভাবিনি।

নজরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—” সেসব কথা বাদ দাও এখন। এখন কিছু খেয়ে নাও প্লিজ?
—” বিশ্বাস করো আমার একদম ই খেতে ইচ্ছে করছে না।
—” তুমি না খেলে আমিও কিন্তু খাবো না। এবার তুমি ঠিক করো খাবে কি খাবে না।
এই বলে নজরাত মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। রাহা চোখের পানি মুছে বলল,
—” আচ্ছা খাবো।
তারপর নজরাত রাহা কে খাওয়ানোর সাথে সাথে নিজেও খেল।

সাজেদা চৌধুরীর থেকে অনুমতি নিয়ে রাহা কে বাহিরে বের হয় নজরাত। বিষন্নতায় ছেয়ে যাওয়া রাহার মনটা কিছুটা হলেও যেন ভালো হয়।
সারাদিন দুজনে মিলে শপিং করলো, খাওয়া দাওয়া করলো। এর মাঝে নজরাত ভাইকে কল করে শান্তনা দিয়ে বলল,
—” অল্পতেই রেগে গেলে তো হেরে গেলে। ধৈর্য হারা হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিও না প্লিজ।

বোনের কথায় রুপক চুপ করে শুনেছিল, কিচ্ছুটি বলেনি।
______

রাদ অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বোনের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো নজরাত আর রাহা মিলে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। তখন গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দেয় সে। রাহা আর নজরাত দু’জনেই চমকালো, ভরকালো। নজরাত দমে যাওয়া কন্ঠে বলল,
—” আমি তাহলে যাই তোমরা কথা বলো।
রাহা প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল,
—” তুমিও থাকো না, সমস্যা কোথায়?
—” আমার কিছু কাজ আছে তাই যাচ্ছি।
নজরাত আর র‌ইলো না, চলে গেল নিজের রুমে। রাদ লক্ষ্য করে গতকাল তার বোনটি যতটা বিধ্বস্ত ছিল আজকে তার থেকে ভালো আলহামদুলিল্লাহ। তবে একদিনেই বেশ শুকিয়ে গেছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বোনের পাশে সোফায় বসে রাদ। বিনা ভূমিকায় বলল,
—” বোন বিয়েটা কিন্তু করে নিতে পারিস! ছেলেটা ভালো আমি খবর নিয়ে দেখেছি।
রাহা চমকানো কন্ঠে বলে,
—” তা হয় না ভাইয়া। যদি উনার বোনের সাথে তোমার সম্পর্কটা ঠিক থাকতো তাহলে আমি দ্বিতীয়বার ও ভাবতাম না। কিন্তু..
রাদ হতাশ গলায় বলল,
—” তুই তো জানিস আমি রুপকথা কে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারি না। ওর গল্পের প্রতিটি শব্দ থেকে শুরু করে একেকটা গল্প আমাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে প্রতিটা ক্ষনে ক্ষনে। আমি কিছুতেই ওকে ভুলতে পারবো না।
রাহা ক্ষীণ একটু হেসে বলল,
—” তাহলে আমার কথা ভেবো না, এমনি করে আমি জীবন কাটাব।
—” তোকে অসুখী দেখে আমি কি সুখী হতে পারবো?
এ কথার জবাব দিল না রাহা। ভাইয়ের দিকে ফিরে বলল,
—” সেদিন তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম আমি।
রাদ সকৌতুকে প্রশ্ন করলো,
—” কোন দিন? কি মিথ্যে?
রাহা খানিকটা বিষন্ন গলায় বলল,
—” সেদিন ভাবীমণি তোমার র’ক্তের ব্যবস্থা করেছিল! আমি রুপকথা আপুর কথা মিথ্যা
বলেছিলাম তোমাকে।

রাদ বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। বলল,
—” তাহলে রুপকথা ও মিথ্যা বলল? তাছাড়া ও তো ওর গল্প পেইজে এই নিয়ে পোস্ট ও করেছিল! সেখানেই তো শত শত মানুষ ব্লাড দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
রাহা মুখচোখে বিহ্বল ভাব ফুটিয়ে তোলে বলল,
—” তা তো আমি জানি না। তবে সেদিন ভাবীমণি দুজন লোক কে হসপিটালে নিয়ে এসেছিলেন। আমি নিজে ব্লাড ডোনেট এর ব্যবস্থা করেছিলাম।

রাদ উদাস দৃষ্টিতে বসে রইল।
_______

আজ পহেলা ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সারা মাস ব্যাপী এই উৎসবে মেতে ওঠে সাহিত্য প্রেমী নর-নারী। বিশাল আয়োজনে শুরু হয় এই উৎসব। ছোট বাচ্চাদের ঠাকুর মার ঝুলি থেকে শুরু করে সব ধরনের ব‌ই পাওয়া যায়। নিজেদের কে বিভিন্ন সাজে সজ্জিত করে দূর দূরান্ত থেকে সাহিত্য প্রেমীরা ছুটে আসে ব‌ইমেলায়। আবার কিছু লেখক-লেখিকাদের ও সাক্ষাত মিলে। খুব কাছ থেকে তাদের অটোগ্রাফ নিতে পারাটা সৌভাগ্য বান মনে হয় নিজেদের।

গত চার বছর যাবত এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আছে রাদ শাহমাত। তার প্রিয় পিচ্চি লেখিকা রুপকথার ব‌ই প্রকাশ হবে এই আশায়।

সাহিত্য প্রেমী হ‌ওয়ার দৌলতে রুপকথার সাথে পরিচয় হয় রাদ শাহমাত এর। রাদ এর বন্ধু শিহাব একদিন বলেছিল,
—” দোস্ত একটা পিচ্চি মেয়ে সবে মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ে। ওই পিচ্চি মেয়ের হাতের জাদু দেখলে তুই প্রেমে পড়ে যাবি।
এমনিতেই রাদ শাহমাত সাহিত্য প্রেমী তার উপর বন্ধুর এমন কথায় আগ্রহ জাগে সেই পিচ্চির গল্প পড়ে দেখার। শিহাব সেই পিচ্চি লেখিকার নিজস্ব পেইজ লিঙ্ক দিল রাদ কে। সেদিন রাতে লাইব্রেরী কক্ষে সারারাত জেগে গল্প পড়েছিল রাদ। একেকটা গল্প তার মন ছুঁয়ে দিয়েছিল। যার লেখার হাত এতো দারুন সে জানি কেমন হবে? নিশ্চয়ই ভীষণ সুন্দর মনের অধিকারীনি। গল্পের সাথে সাথে সেই রূপকথা নামক পিচ্চি লেখিকার প্রেমে পড়ে যায় রাদ শাহমাত। কিন্তু সমস্যা হল রুপকথা নাম দিয়ে সার্চ করলে হাজারো রুপকথা নামক আইডি হাজির হয়। এর থেকে আসল রুপকথা কে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একদিন নিউজ ফিড স্ক্রল করতে করতে রুপকথা নামক আইডি থেকে গল্প পোষ্ট করা দেখল রাদ। আনন্দে তার চোখ দুটো ঝলমল করে উঠল। সাথে সাথে লেখিকা আইডিতে ঢুকে। আইডি লক বলে ঢুকতে পারে না কিছুতেই। ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায় রাদ এর। বন্ধু শিহাব কে বিষয়টি জানালে সে পরামর্শ দিল রিকোয়েস্ট দেওয়ার জন্য। এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে একদিন রাদ রিকোয়েস্ট দিয়েই দিল। আশ্চর্য বিষয় ছিল রিকোয়েস্ট সাথে সাথে একসেপ্ট হয়। তবে এতো সব ভাবে না রাদ। সে ভীষণ আনন্দিত এই ভেবে তার স্বপ্নের পিচ্চি লেখিকার ফ্রেন্ড লিস্টে যায়গা পেয়ে। এই ডের, আর কি চাই? এমনি করে মাস খানেক চলে যায়। রাদ তখনো অফিসে জয়েন করেনি। দিন রাত গল্প পড়ে লাইব্রেরী কক্ষেই সময় কাটায়। গল্প পড়ে যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায় রাদ। দিন রাত রুপকথা নামক পিচ্চি লেখিকাকে নিয়েই তার জল্পনা কল্পনা। কিছুতেই ভুলতে পারে না। বন্ধু শিহাব এর পরামর্শে একদিন টেক্সট করে রাদ। কিন্তু কয়েকদিন কোন রিপ্লাই আসে না। এতে ভীষণ মন খারাপ করে রাদ এর। তবে রাদ অপেক্ষায় থাকে রিপ্লাই এর। একদিন হুট করে রিপ্লাই আসে। রাদ কিযে খুশি হয় তখন বলে বোঝানোর মতো না।
তারপর পর থেকে একটু একটু করে কথা বলতে বলতে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব তারপর হয়ে উঠে প্রেমিক প্রেমিকা।
______
বর্তমান
রুপকথার কোন পাত্তা নেই! আথচ তার ব‌ইমেলায় থাকার কথা। আর পাশে গর্বের সাথে রাদ শাহমাত থাকবে বলে এত্ত গুলো দিন অপেক্ষা করে ছিল। অথচ আজ রুপকথা এমন কেন করছে?….
_______
রেফারেন্স:
[১]( সুরা আল বাকারাঃ ১৯৫)।
[২](সূরা নিসাঃ ২৯)
______

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

(আসসালামু আলাইকুম।
রি-চেক করা হয় না। তাই ভুল গুলো মার্জিত ভাষায় ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইল। “জাযাকিল্লাহু খাইরন”।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here