তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব -০৭

#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(০৭)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

সমরেশ মজুমদার এর “সাতকাহন” ব‌ইটা পড়তে পড়তে কখন পৌঁছে যায় টের পায়নি নজরাত।ড্রাইভার মতিন বললেন,
—” আপামণি আমরা আইসা গেছি।
নজরাত জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখলো সত্যি চলে এসেছে। ব‌ই পড়তে পড়তে কখন পৌঁছে গেছে জানা নেই তার। ব‌ই ও একটা নে’শার বস্তু যদি সেরকম ভাবে মন দিয়ে পড়া হয়। তাছাড়া ‘সাতকাহন’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দীপাবলি। কোনো কিছুতে হার না মেনে চলা এক অসাধারণ নারী। যার একটি নামের ভেতর লুকিয়ে আছে এক সম্পূর্ণ বাঁধা বিহীন সত্ত্বা। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে বিধবা হয়ে যাওয়া এই মেয়েটিকে সবসময় থাকতে হয়েছে এক অদ্ভুত গণ্ডির ভেতর। সেই গণ্ডি সমাজের তৈরি। যে সমাজ তৈরিই হয়েছে আমাদের মত মানুষদের নিয়ে। অল্প বয়সে বিধবা মেয়েটি জীবনের পথচলা তবু থামায়নি। অসাধারণ একটি ব‌ই পড়লে এমনিতেই নেশা ধরে যায়। যতক্ষন পর্যন্ত শেষটা জানা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত মন শান্ত হয় না। নজরাত না চাইতেও ব‌ইটা বন্ধ করে সিটের উপর রেখে নেমে দাঁড়ালো গাড়ি থেকে।মতিন কে বলল,
—” ভাইয়া যাওয়ার সময় কল করে আপনাকে ডেকে নিব আমি।
মতিন ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
—” আচ্ছা ঠিক আছে।
তারপর নজরাত রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেলে মতিন গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন।

নজরাত এদিক ওদিক তাকিয়ে দক্ষিণ পাশের এক কোনায় বসে থাকতে দেখে রাহা কে। তারপর এগিয়ে যায় সেদিকে।
রেস্তোরাঁর পরিবেশটা ভীষণ সুন্দর। ছোট ছোট সবুজ গাছে পরিপূর্ণ। শীতের মৌসুমে খোলা আকাশের নিচে সূর্যের “রৌদ্র স্নান” মন্দ নয়। নজরাত কাছে যেতে রাহা কে সালাম দিল। রাহা সালাম এর জবাব দিয়ে বলল,
—” কেমন আছো? ভাবীমণি!
ভাবীমণি সম্বোধন টা ভীষণ মধুর শোনালো নজরাত এর কাছে। সাথে মনটা আনন্দে ভরে গেল। মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল,
—” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি এবং বাসায় সবাই কেমন আছেন?
—” আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছেন।
—” দাঁড়িয়ে কেন? বসো।
নজরাত মাথা নাড়িয়ে বলল,
—” তুমিও বসো। আচ্ছা আমরা বোধ হয় সেইম ব্যাচ তাই না?
রাহা খানিকটা হেসে বলল,
—” হুম।
—” কোন কলেজ তোমার?
প্রশ্নটা করে নজরাত সাথে সাথে বলল,
—” সরি, আমি বোধহয় বেশি প্রশ্ন করে ফেলছি।
—” কোন ব্যাপার নয়। আসলে আমাদের সম্পর্কটা ভঙ্গুর! তাই এখনও পর্যন্ত একে অপরের সম্পর্কে চেনা জানা হয়ে উঠেনি।

তারপর রাহা তার কলেজের নাম বললে, নজরাত বলল,
–” এই কলেজে আমার ভাইয়া ও পড়াশোনা করেছে। আমার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ততদিনে ভাইয়ার গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে ফেলে। তাই আর ভর্তি হ‌ওয়া হয়নি।
রাহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—” অহ আচ্ছা।
—” আচ্ছা কি খাবে বলো?
—” আমি তোমাকে ডেকেছি, তাই আমি কিন্তু
বিল পরিশোধ করবো।
—” আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।

দু’জনের পছন্দ মত কফি, প্যানকেক অর্ডার করে। খাবার আসতে আসতে রাহা হতাশ গলায় বলল,
—” তোমাকে, আমার সম্পর্কে কিছু জানাতে চাই! সে জন্যই ডাকা।
নজরাত খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল,
—” হুম বলো?
রাহা নির্বিকার মুখে বলতে শুরু করে,
—” তখন সদ্য কলেজে ভর্তি হ‌ই আমি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা মাস্তিতে বেশ ফুরফুরে জীবন পার করছি। কলেজের এক বড় ভাই কে প্রায়ই কলেজ ক্যাম্পাসে তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দেখা যেত। শুনেছি তিনি সদ্য অনার্স ফাইনাল এক্সাম দিয়েছেন। তাছাড়া টিচার দের মুখে তার প্রশংসা শুনতাম। সবাই তাকে এক নামে চিনতো তার কারণ তিনি ছাত্রলীগের নেতা! তবে খুব সৎ এবং ব্যক্তিত্ববান ছিলেন। যার দরুন আমি দিন দিন দূর্বল হয়ে পরি সেই ছেলেটার!

এতটুকু বলে রাহা থামে। নজরাত অধৈর্য হয়ে পড়ে, হাঁসফাঁস করে বলল,
—” তারপর? তারপর কি হয়েছিল?
—” এরকম করে অনেক দিন কেটে যায় আমার বন্ধুরা জানতে পারে এ ব্যাপারে। তারা প্রতিনিয়ত বলতে থাকে আমি যেন সেই যুবকটিকে প্রপোজ করি! কিন্তু আমার ভীষণ আন ইজি ফিল হয়। মেয়ে হয়ে কিভাবে কি?
আমাদের সমাজে মেয়েরা যখন কোন ছেলেকে পাগলের মত পছন্দ করে, ভালোবাসে তখন তাকে বলা হয় ছেচরামি! আর কোন ছেলে যখন কোনো মেয়েকে পছন্দ করে তখন তাকে বলে পাগলামো, ভালোবাসা ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ভয়ে সাহস হয়ে উঠেনি আমার।

নজরাত মন খারাপ করে বলল,
—” তাহলে কি আর বলা হয়নি?
—” হয়েছে!
নজরাত উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, বলল,
—” তবে কি হয়েছিল?
ওয়েটার তাদের মেনু অনুযায়ী খাবার নিয়ে এলো। তখন রাহা সেসব কথা বাদ দিয়ে বলল,
—” কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে, শুরু করা যাক?
তারপর দুজনের মাঝে নিরবতা চলে। কফি শেষ করে রাহা আবারো বলতে শুরু করে,
—” কলেজে পা রেখে যে জায়গাটায় যুবকটিকে দেখা যেত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে, আজকে আর দেখতে পেলাম না! দিনটা আমার মনমরা হয়ে কাটলো। আমার বন্ধুরা বুঝতে পেরে অনেক হাসি ঠাট্টা করলো। কিন্তু সেখানে আমি কোন তোয়াক্কা করলাম না। যুবকটির কথাই ভাবছিলাম। এমনি করে দ্বিতীয় দিন ও কলেজে তাকে দেখতে পেলাম না। খুব কষ্ট হয় আমার, ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। শুধু কাউকে দেখাতে পারি না। মনের মাঝে খারাপ আশঙ্কা জেঁকে বসে, মনে হয় তার কোন বিপদ আপদ হলো না তো? এরকম ভেবে আরো মুষড়ে পড়ি আমি।
এমনি করে নয় দিন পার হয়। দশ দিনের বেলা কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে কলেজে পা রাখি ভাবি আজকেও হয়ত তার দেখা পাবো না আমি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। কলেজে ঢুকে ক্যাম্পাস পেরিয়ে দূরের একটা বড় গাছের দিকে নজর পড়তেই আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরি। কেননা ঐ গাছের বড় বড় শিখরে আমার সুদর্শন যুবক আর তার বন্ধুরা বসে আছে! দিক বেদিক বিবেচনা করার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি! দৌড়ে সেখানে উপস্থিত হ‌ই! আমাকে দেখতে পেয়ে সকলের চক্ষু কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে, এমনি করে তাকিয়ে আছে সবাই। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় সেই যুবকটির চাহনি, স্নিগ্ধ ও গভীর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে! আমি জ্ঞান শূন্য হয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম,
—” কোথায় ছিলেন এতো দিন?
সবাই বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। যুবক ছেলেটি আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন,
—” ভালোবাসো আমায়?
আমি স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো গলায় বললাম,
—” খুব বাসি।
যুবক ছেলেটি ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে তার চঞ্চল চোখ এদিক ওদিক চেয়ে বললেন,
—” চলো বিয়ে করবো!

এই তিনটি শব্দ আমাকে নাড়িয়ে তুলল‌। আমি এখনো নাবালিকা, বিয়ের বয়স হয়নি। তাই এই টুকু সময়ে বিয়ের ব্যাপারটা নিতে পারলাম না আমি। অস্ফুট স্বরে বললাম,
—” এখনি আমি বিয়ে করতে চাই না!
আমার কথায় তার কোন ভাবান্তর বোঝা গেল না। তবে বাঁকা হেসে মাথা দুলিয়ে, শেষ বারের মত বললেন,
—” আল্লাহ হাফেজ!
_________

নজরাত হতাশ গলায় বলল,
—” এখানেই সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল?
রাহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—” হুম। এর কিছুদিন পর জানতে পেরেছিলাম যুবকটি প্রবাশে চলে গিয়েছেন! সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু করে প্রতিষ্ঠিত হবেন। এটাই তার ইচ্ছে।

সবকিছু শুনে নজরাত থম মেরে বসে রইলো। প্রথম থেকে সবটা আবারো ভাবলো। ধীর, স্থির স্বরে বলল,
—” তোমার ভাইয়া গতকাল বাসায় ফিরেছিল? একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম আমি। কল করার সাহস হয়ে উঠেনি আমার।

সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে রাহা বলল,
—” আমাকে তুমি মাফ করে দাও ভাবীমণি?
নজরাত আশ্চার্যো চাহনিতে বলল,
—” কিন্তু কিসের জন্য?
—” তোমার সাথে এতো দিন অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি আমি। বিশ্বাস করো সবকিছু করেছি দুটো ভালোবাসার মানুষের জন্য। আমি চেয়েছিলাম আমার মতো যেন ভাইয়া কষ্ট না পায়। ভাইয়া যেন তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পেতে পারে সে জন্যই মিথ্যাও বলেছি।

এতটুকু বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে রাহা। নজরাত এর চোখেও পানি। নজরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
—” সব কিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি আমি। তাই এগুলো নিয়ে আফসোস করতে চাই না। তুমিও করো না। আল্লাহ তা’আলা যা ভালো মনে করেন তাই হবে।

রাহা বুঝতে পারলো নজরাত এর মতো মেয়ে হয় না। আজকাল এত্ত ভালো কেউ কি করে হয়?
_________

বিদায় এর সময় নজরাত বলে আমি যদি খুব ভুল না করি, তবে সেই যুবকটির নাম….

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।

(আসসালামু আলাইকুম।
আপনাদের মূল্যবান মতামত জানানোর অনুরোধ করছি। আপনাদের এই মতামত গুলো পড়তে আমার ভীষণ ভীষণ ভালো লাগে 🥰 ভুল ত্রুটি মার্জিত ভাষায় ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইল। “জাযাকিল্লাহু খাইরন”।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here