তোমার সমাপ্তিতে আমার প্রাপ্তি ৩ পর্ব -০৫+৬

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (৫)

” আমাকে নিয়ে যাও, ইশাদ। তোমাকে ছাড়া আমি মরে যাব। ”

ইশাদ তাৎক্ষণিক উত্তর দিল না। দুর্বলতা গ্রাস করল তনু ও মনে। চোখের পাতা জোড়া বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে তিহির ফুঁপানি শুনছে আপনমনে।

তিহি অনেক্ষণ চুপ থেকেও ইশাদের গলা না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। অধৈর্য্য হয়ে আকুল গলায় বলল,
” ইশাদ, আমি সত্যিই মরে যাব! ”

তিহি কথাটা শেষ করতে ইশাদ চট করে চোখ মেলল। কঠিন স্বরে বলল,
” তাহলে মরে যাও। ”

মুখায়ব কাঠিন্য রেখেই কল কেটে ফোন পকেটে পুড়ল। ইমদাদ দৌড়ে এলো নিজের ব্যথা ভুলে। অবিশ্বাস্য স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” কী বললি এটা! ইশাদ, তোর মাথা ঠিক আছে? ”

ইশাদ ক্রোধ চোখে তাকাল। ঘাড় শক্ত করে জবাব দিল,
” যার বেঁচে থাকা অন্য কারও উপর নির্ভর থাকে তার মরেই যাওয়া উচিত। ”

ইমদাদ দু-দিকে মাথা নেড়ে বলল,
” তুই ঠিক নেই। নিশ্চয় সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষিধের চোটে ভুল-ভাল বলছিস। খাবি চল। ”

ইশাদের কাঁধ জড়িয়ে নিতে নিতে মিহির দিকে তাকাল ইমদাদ। বলল,
” রান্না হয়েছে? ”
“হ্যাঁ। ”
” যাও, খাবার বাড়ো। আমরা আসছি। ”

মিহি ছুটে চলে গেলে। ইশাদ নিজের কাঁধ ছাড়িয়ে নিল। অন্য দিকে ঘুরে বলল,
” আমি খাব না। ”
” কেন? ”
” ক্ষিধে নেই। ”

ইশাদ রেলিংয়ের কাছে দাঁড়ালে পেছন থেকে ইমদাদ উঁচু স্বরে বলল,
” তুই বললেই হলো ক্ষিধে নেই? তোর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারা দিন না খাওয়া। আমার তো মনে হয় তিহি চলে যাওয়ার পর থেকে পেটে একটা দানাও পড়েনি। ”

এইটুকু বলে ইশাদের দিকে এগিয়ে গেল ইমদাদ। কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বলল,
” তিহি পাগল, তাই পাগলামি করছে। কিন্তু তুই তো সুস্থ। তোকে কি…”

কথাটা শেষ করতে পারল না ইমদাদ। তার আগেই ইশাদ চরকিবেগে ঘুরে দাঁড়াল। চোখের পাকানি দেখে ইমদাদ সাবধান হয়ে গেল। নিজের ভুল শুধরে বলল,
” তিহি কেন পাগল হবে? আমি পাগল। পাগলের চিকিৎসা করতে করতে আমিও পাগল হয়ে গেছি। আমার তুই ছাড়া কেউ নেই। তাই এখনও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বলছি কি তুই একটু সময় পেলে আমাকে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে…”

ইশাদ বিরক্তে কপাল কুঁচকে ফেলল। ইমদাদকে ফেলে ছাদ থেকে নেমে যাচ্ছে। ইমদাদ পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করছে, ‘ নিজে মেরে ফেললে দোষ নেই আর আমি একটু পাগল বলাতেই দোষ! ‘ বিড়বিড়ানিতে মনোযোগ দিতে গিয়ে খেয়াল করেনি ইশাদ মাঝ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে ধাক্কা লাগলে ইশাদ বলল,
” হয়েছে? ”

ইমদাদ নিজেকে সামলে বোকা কণ্ঠে বলল,
” কী? ”
” বিড়বিড় করা? ”
” তুই এটাও শুনেছিস? ”

ইশাদ উত্তরে সামান্য হাসল। ইমদাদকে একহাতে জড়িয়ে বলল,
” আমার রক্তের সম্পর্কে অনেকে থাকলেও আত্মার একজনই আছে। ”

ইশাদের কথার অর্থ ধরতে পেরে ইমদাদ কৃতজ্ঞতাপূর্ণ হাসল। বন্ধুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উচ্ছল স্বরে বলল,
” এবার চল পেটে কিছু চালান করি। ”

__________

দুপুরের খাবারে রুটি আর ডিম ভাজা দেখে তাজ্জব বনে গেল দুই বন্ধু। ইশাদ বিস্ময় আড়াল করতে পারলেও ইমদাদ পারল না। বলে ফেলল,
” মিহি, আমরা কি সকালের নাস্তা করছি? ”

মিহি সরলমনে বলল,
” না, দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। ”

ইমদাদ ভাজা ডিম উঁচু করতে টপটপ করে তেল বেয়ে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে বলল,
” আমি তো জানতাম, সকালের নাস্তায় রুটি আর ডিম থাকে। দুপুরের নাস্তায়ও যে থাকতে পারে বিয়ে না করলে জানতেই পারতাম না! ”

ইশাদকে কনুই দিয়ে গুতা দিয়ে বলল,
” তুই আগে থেকেই জানিস নাকি? না জানলে এখন জেনে রাখ। ”

ইশাদ কড়া চোখে তাকাল। ইমদাদের হাত থেকে ডিম নিজের প্লেটে নিয়ে বলল,
” আমার বোনের হাতে রান্না খাচ্ছিস তাই তোর ভাগ্য। শুকরিয়া কর। ”

ইমদাদ শুকরিয়া করতে পারল না। পেটের ভেতরে ক্ষুধার তীব্রতা টের পেল। গলার ভেতরটা তেতো হয়ে আসতে মজার ভাবটা কেটে গেল। ইশাদ না থাকলে হয়তো কয়েক প্রস্থ ধমকাধমকি করে ফেলত। ইশাদের ভয়ে নিজেকে সংযত রাখতে চেয়েও খুব একটা পারল না। বিরস গলায় জিজ্ঞেস করল,
” তুমি রাঁধতে পার না? ”

মুহূর্তে মিহির মুখের হাসি হারিয়ে গেল। মাথা নিচু করে বলল,
” একটু একটু পারি। ”

ইমদাদ জেরা শুরু করে দিল,
” কী কী পার শুনি? ”

মিহি একবার চোখ তুলে দেখল ইমদাদকে। তারপরেই নতজানু হয়ে বলল,
” রুটি, ভাত, ডাল, ভর্তা। ”
” কী কী ভর্তা? ”
” শুধু আলু ভর্তা। ”
” আর কিছু পার না? ”
” না। ”

ইমদাদ তপ্ত শ্বাস ফেলল। রাগটাকে ভেতরে রেখে বলল,
” তাহলে ভাত, ডাল, ভর্তাই করতে। রুটি করতে গেলে কেন? ”

ইমদাদের একের পর এক প্রশ্নে মিহি কুণ্ঠিত হচ্ছিল। দুর্বল স্বরে বলল,
” মা বলত, আমি রুটি ভালো বানাতে পারি তাই। ”
” ভালো বানাতে পার বলে দুপুরে রুটি খাওয়াবে? সময় জ্ঞান নেই নাকি? ”

মিহি হালকা কেঁপে উঠল। অসহায় চোখে তাকালে ইমদাদ বলল,
” তোমার মা তোমাকে রান্না শেখাইনি? মায়ের আঁচলের নিচে থেকে করেছটা কী? ”

ইমদাদের এমন কথায় মিহির কান্না পেয়ে গেল। ছলছল চোখে বলল,
” মা আমাকে কখনও রান্না শেখায়নি। এগুলো আমি দেখে দেখে শিখেছি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের বাসায় এসবই রান্না হত। অন্যকিছু হলে সেগুলোও শিখতে পারতাম।

মিহির কথায় ইমদাদের উপর কোনো প্রভাব না পড়লেও ইশাদের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সে এতক্ষণ চুপচাপ দুজনের কথপোকথন শুনে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক বুঝার চেষ্টা করছিল। মিহিকে ভেতরে রেখে বাইরে তালা দেওয়ার যুক্তিটা তার পছন্দ হয়নি। সন্দেহ দূর হওয়ার বদলে বেড়ে গিয়েছিল।

ইশাদ কিছু বলার জন্য উদ্যত হতে ইমদাদ তাড়াতাড়ি বলল,
” এখন থেকে আমাদের বাসায় অন্য কিছু রান্না হবে। তুমি সেগুলো দেখবে আর শিখবে, ঠিক আছে বউ? ”

মিহি ভেজা চোখে চকিতে তাকাল। ইমদাদ চোরা চোখে ইশাদকে দেখে বলল,
” প্রেম করার সময় দুজন দিন-রাত কথার পাহাড় বানালাম অথচ রান্না নিয়ে কিছু বললাম না। এটা কিছু হলো? কোনোভাবে যদি আঁচ করতে পারতাম তুমি রান্না পার না তাহলে বিয়ের আগেই রান্নার লোক রাখতাম। তাহলে এই ভর দুপুরে কষ্ট করে রুটি বানাতে হত না! ”

এতক্ষণে ইশাদ কথা বলল,
” বানিয়ে যখন ফেলেছেই ভালোবেসে খেয়ে ফেল। ”

ইমদাদ কৃত্রিম হাসল। ভেতরে বিরক্ত নিয়ে রুটি ছিঁড়ে মুখে ঢুকাল।

খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ধুতে হঠাৎ ইমদাদ বলল,
” তিহির ঠিকানাটা দে তো। বের হওয়ার আগে একটু খোঁজ নিয়ে দেখি কোন পথে গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। ”

ইশাদ প্রথমে অবাক হলেও পরমুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
” নেই। ”
” নেই মানে? রাখিসনি? ”
” না। ”
” কেন? ”

ইশাদ বসা থেকে উঠল। এক কদম হেঁটে বলল,
” তখন আমি ঠিকানা রাখা প্রয়োজন মনে করিনি। ”
” এখন তো প্রয়োজন হচ্ছে। ”

ইশাদ ইমদাদের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। শুকনো গলায় বলল,
” না, এখনও প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ, আমরা কোথাও যাচ্ছি না। ”

ইমদাদ অস্থির হয়ে গেল। অসহিষ্ণু স্বরে বলল,
” তুই কি চাচ্ছিস মেয়েটা সত্যি মরে যাক? ”

ইশাদ সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াল। অন্যরকম গলায় বলল,
” ব্যাপারটা এত সহজ না ইমদাদ। তিহি নিজের বাড়িতে নয়, শ্বশুরবাড়িতে আছে। তাছাড়া ওদের লাভ ম্যারেজ ছিল। ”

ইমদাদ তার কথায় গলে না গিয়ে প্রতিবাদ করল,
” কী ছিল না ছিল আমি বুঝি না। আমি শুধু বুঝি তিহি তোকে ভালোবাসে, তুই ওকে। আর আমি চাই এই ভালোবাসা পূর্ণতা পাক। তার জন্য আমার যা করতে হয় তাই করব। প্রয়োজন হলে তিহিকে তুলে…”

ইমদাদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ইশাদ বলল,
” আমি তাড়াহুড়ায় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। আমাকে ভাবতে দে। ”

ইমদাদ ইশাদকে ভাবার সময় দিল না। হেঁচকা টানে রুম থেকে বের করে বলল,
” গাড়িতে বসে বসে ভাবিস। এখন চুপচাপ আমাকে অনুসরণ কর। ”

__________

ইমদাদ একপ্রকার জোর করেই ইশাদকে নিয়ে বাস কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই তারা শেরপুর টাউনের উদ্দেশ্যে টিকিট কিনল। বাস সামনে এসে দাঁড়ালে ইশাদকে ঠেলে তুলল। পাশাপাশি বসে বলল,
” আমরা কবে কখন ফিরব বুঝতে পারছি না। আন্টিকে আগে থেকে বলে রাখলে ভালো হয়। তুই কল দিবি নাকি আমি? ”

ইশাদ ইমদাদকে উত্তর দেওয়ার বদলে ফোন বের করল। মায়ের নাম্বারে ডায়াল করে বাইরে তাকাল জানালা দিয়ে। একটু দূরে দৃষ্টি পড়তে আচমকা স্থির হয়ে গেল চোখের পাতা। গলা থেকে বেরিয়ে আসল একটি শব্দ, ‘ বাবা! ‘

সেই সময় ফোনের ওপাশ থেকে শাহিনা শাইখা বললেন,
” হ্যাঁ, বাবা বল। ”

ইশাদ জানালা দিয়ে গলা বের করে বাবাকে ভালো করে দেখে জিজ্ঞেস করল,
” আম্মু, আব্বু কোথায়? ”
” কোথায় আবার? বাসায়ই তো। ”
” বাসায় নেই, আম্মু। ”
” কী বলছিস? দুপুরে খেতে তো…”

মায়ের পুরো কথা শোনার ধৈর্য হলো না ইশাদের। দ্রুত প্রশ্ন করল,
” আব্বুর কি কোথাও যাওয়ার কথা ছিল? দূরে কোথাও? ”
” সেরকম কিছু তো আমাকে বলেনি। ”

ইশাদ আরও কিছু বলতে চাইল তার আগেই কথা হারিয়ে ফেলল। ফোন কানে বিস্ময় চোখে দেখল তার বাবা রুবিনাকে নিয়ে একটি বাসে উঠছেন।

দুজনে বাসের ভেতরে হারিয়ে গেলে ইশাদের বিস্ময় কাটল। সে তাৎক্ষণিক বাস থেকে নামার তোরজোর শুরু করল। ইমদাদের বাধা শুনল না। বাস থেকে নেমে বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, আজ একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে!
#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (৬)

ইশাদ বাসায় ঢুকলে টনু দৌড়ে এলো। জানাল, তার মা ছাদে পা পিছলে পড়ে গেছে। কোমরে ব্যথা পাওয়ায় হাঁটতে পারছে না। চিলেকোঠায় বসে আছে অনেক্ষণযাবৎ। কথাটা শোনার পর ইশাদ উদ্বিগ্নচিত্তে সিঁড়ি কাটল। মায়ের কাছে পৌঁছে বিনাবাক্যে কোলে তুলে নিলে, শাহিনা শাইখা দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন,
” আরে, কী করছিস? কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? ”

ইশাদ জরুরি গলায় বলল,
” ডাক্তারের কাছে। ”

ডাক্তারের কথা শুনে শাহিনা শাইখা ইশাদের গলা ছেড়ে দিলেন। নামার জন্য ছটফট করতে করতে বললেন,
” কোথাও যেতে হবে না। নামা আমাকে। ইশাদ, নামা বলছি। ”

মায়ের এমন বাচ্চাদের মতো হাত-পায়ের ছুটাছুটি সামলাতে কষ্ট হচ্ছে ইশাদের। বাধ্য হয়ে তাকে তার রুমে নিয়ে গেল। সাবধানে খাটে রেখে বলল,
” এমন করে কেউ? যদি হাত ছুটে যেত? একদম গড়িয়ে নিচে পড়তে, আম্মু! ”

ইশাদের অসহায় মুখটা দেখে শাহিনা শাইখা মৃদু হাসলেন। হাতদুটো টেনে বললেন,
” এত সহজ? এগুলো আমার ছেলের হাত। মাকে রক্ষা করায় সর্বদা প্রস্তুত। ”

ইশাদ মায়ের পাশে বসল। তার প্রশংসায় আনন্দিত না হয়ে রাগ নিয়ে বলল,
” তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছ কেন? ”
” কী মিথ্যা বলেছি? ”
” এই যে বাবা আছে। ”
” ছিল তো। তাকে নিচে দেখেই তো আমি উপরে গেলাম। ”

বাবার উপর বসে থাকা রাগটা আবার চড়ে উঠল। আচমকা মায়ের দিকে দুটি হাত মেলে সুধাল,
” তোমার কি এই দুটো হাতের উপর বিশ্বাস আছে, আম্মু? ”

শাহিনা শাইখা কপাল কুঁচকালেন। সরু চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। ভেতরে কী চলছে বুঝার চেষ্টা করলেন। না পেরে বললেন,
” থাকবে না কেন? ”
” আম্মু, প্রশ্ন নয় উত্তর দেও। ”

শাহিনা শাইখা ছেলের হাত টেনে তালুতে চুমু খেয়ে বললেন,
” হ্যাঁ, আছে। ”

ইশাদ খুশি হলো। ভীষণ শান্ত কিন্তু দৃঢ়স্বরে বলল,
” আমি তোমার দায়িত্ব চাই, এখন, এই মুহূর্তে। ”

প্রথমে বুঝতে পারলেন না শাহিনা শাইখা। পর মুহূ্র্তে আৎকে উঠলেন। ডান হাত দিয়ে বুকের মাঝে গভীর চাপ রেখে বিস্ফারিত চোখে বললেন,
” কী বলছিস, ইশাদ। অসম্ভব! ”

ইশাদ তার সেই অসম্ভব শব্দটাকে পরোয়া করল না। মায়ের বালিশের নিচ থেকে আলমারির চাবি নিল। তালা খুলতে খুলতে বলল,
” যদিও তোমাকে এক কাপড়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমি রাখি। কিন্তু দাদা-দাদির দেওয়া জিনিসগুলো তোমার সাথে নিয়ে যাব। কারণ, এগুলো তোমার। আর এ বাসা থেকে একবার বেরিয়ে গেলে আর কোনোদিন আসতে দিব না। তাই পরে চাইলেও নিতে পারবে না। ”

শাহিনা শাইখা বিছানার চাদর খামচে ধরে একস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন, অবিশ্বাস্য কিছু দেখছেন। ইশাদ কালো রঙের ব্যাগের চেইন লাগিয়ে বলল,
” আমি শুধু চাই না ঐ লোকটার কোনো জিনিস তুমি ব্যবহার করো। যার স্ত্রীর প্রতি নূন্যতম সম্মান, শ্রদ্ধা, সমাদর নেই তার নামের সকল বস্তু তুচ্ছ, মূল্যহীন। ”

ইশাদ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চিৎকার করে টনুকে ডাকল। রিকশা ভাড়া করে মূল দরজার সামনে আনার হুকুম দিল। সে ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে সোবহান শাইখ উপস্থিত হলেন দোরগোড়ায়। স্ত্রী ও ছেলের দিকে একপলক চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমরা কোথাও যাচ্ছ? ”

শাহিনা শাইখা উত্তর দিতে চাইলেও সুযোগ পেলেন না। ইশাদ অবজ্ঞায় বললেন,
” আপনাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না। ”

ছেলের কাছ থেকে এমন উত্তর অপ্রত্যাশিত ছিল। তিনি রুমের ভেতর ঢুকে বললেন,
” এভাবে কথা বলছ কেন? ”

ইশাদ বাবার দিকে সরাসরি চেয়ে শক্ত গলায় বলল,
” আপনার সাথে এভাবেই কথা বলা উচিত। ”

সোবহান শাইখ রেগে যাচ্ছেন বুঝতে পেরে শাহিনা শাইখা দ্রুত বললেন,
” ওর কী জানি হয়েছে। বলছে, আমাকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। ”

শাহিনা শাইখার কাতর কণ্ঠস্বরে খুব একটা বিচলিত হলেন না সোবহান শাইখ। ধীরস্বরে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ জানতে পারি? ”

ইশাদ বাবার দিকে এক নজর চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। বলল,
” হঠাৎ নয়, অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু মাকে বলার সাহস পাইনি। ”
” আজ সাহস পেয়েছ? ”
” হ্যাঁ। ”
” কিভাবে? ”

মুহূর্তে ইশাদের চোখে বাস স্ট্যান্ডের সেই দৃশ্য ভেসে উঠল। ঘৃণায় চোখ বুজে বলল,
” কয়েক ঘণ্টা আগে আপনার ঘটানো কাণ্ডে। ”

এই এতক্ষণে সোবহান শাইখের মুখমণ্ডলের ভাব পালটাতে লাগল। কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে আসল,
” মানে? কী করেছি আমি? ”

ইশাদ আর অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে পারল না। রাগে-ক্ষোভে মাথার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে যেন। চোয়াল কাঁপছে ক্রমাগত। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
” লজ্জা করছে না তোমার? নিজের কুকর্মের কথা ছেলের মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছ? ছি! ”

ছেলের এমন বিকৃত বদনে সোবহান শাইখ আর ঠিক থাকতে পারলেন না। শরীরজুড়ে কাঁপুনি উঠে গেছে। রাগে কাঁপছে সেও। কিন্তু চেঁচালেন না। ইশাদের কাঁধ ধরে নিজের দিকে টেনে বললেন,
” কথা প্যাঁচাবি না একদম। সরাসরি বল, কী করেছি আমি? ”

ইশাদও আর কথা ঘুরাল না। সরাসরি বলল,
” আমার অসুস্থ মাকে ফেলে তুমি রুবিনা আন্টিকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছ। টিকেট কেটে দুজনে বাসে উঠেছ। অথচ তোমার দায়িত্ব ছিল আম্মুকে নিয়ে হসপিটালে যাওয়া। তার ভালো-খারাপ দেখাশোনা করা। আব্বু, আর কত? আমার আম্মুকে এবার রেহাই দেও! ”

ইশাদের দুটো কথা ভারী অসহায় শোনায়। কাতরতায় ডুবে আছে যেন! তার সেই অনুরোধ চাপা পড়ল সোবহান শাইখের গলা ফাটা চিৎকারে। টনুকে ডেকে যাচ্ছেন বিরতিহীন। সে ঘোড়ার মতো ছুটে আসতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। সে অবস্থায় জিজ্ঞেস করল,
” মালিক ডাকতাছেন? ”

সোবহান শাইখ চোখ রাঙানোতে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমি যখন বাসা থেকে বের হয়েছি তখন ইশাদের মা কোথায় ছিল? ”

টনু তাৎক্ষণিক উত্তর দিল,
” ছাদে। ”
” সে যে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙেছে এ কথা আমাকে জানিয়েছে? ”

টনু দ্রুত মাথা দুপাশে নেড়ে বলল,
” না, উনি তো ছাদ থেকে নামতেই পারতাছিল না জানাইব ক্যামনে? আপনে যাওয়ার পর আমি ছাদে কাপড় মেলতে গিয়া দেখছি ম্যাডাম পইড়া আছে। ”
” তোর ম্যাডাম আমাকে ফোন করেছিল? ”
” না। ম্যাডামের কাছে ফোন আছিল না। ছোট স্যার যখন কল দিল তখন আমি ফোনের শব্দ শুইনা দিয়া আইছি। ”

সোবহান শাইখ জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে ইশাদের দিকে তাকাল। সে সন্তুষ্ট হলো না। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,
” আমার তো মনে হয় আপনাকে জানালেও ঘটনার কোনো পরিবর্তন ঘটত না। ছোটবেলা থেকে তো আপনাকে দেখে এসেছি। ”

সোবহান শাইখ কটমট চোখে তাকালেন। পর মুহূর্তে শান্ত চাহনি ঘুরিয়ে নিলেন স্ত্রীর দিকে। বললেন,
” তোমার ছেলের যদি মনে হয় তুমি এখান থেকে চলে গেলে ভালো থাকবে তাহলে যাও। আমি তোমাকে আটকাব না। কিন্তু ভুল বুঝে যাবে এটা মানব না। মিহির মাকে এ বাসায় তুমি এনেছিলে। সে যে এমনি এমনি আসার মেয়ে নয় আমি জানি, নিশ্চয় তুমি হাতে-পায়ে ধরেছিলে। রাজি না হওয়ায় ইশাদের সাথে মিহির বিয়ের কথা তুলেছিলে। আমি কি ঠিক বলছি? ”

শাহিনা শাইখা হতভম্ব চোখে মাথা উপরনিচ করলেন। সোবহান শাইখ আবার বললেন,
” তোমার এত কষ্ট বিফল হলো। মিহি বিয়ে করল ইমদাদকে। যেটা আমরা মেনে নিলেও রুবিনার পক্ষে মানা কতটা কষ্টের ছিল সেটা আমার থেকে তোমার ভালো জানার কথা। তবুও সে মুখ ফুটে একটা কথা বলেনি। সে চাইলে কিন্তু অনেক ঝামেলাই করতে পারত, করেনি। বরং বড় মনের পরিচয় দিয়ে চুপচাপ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। ”

শাহিনা শাইখা মাঝখানে প্রশ্ন করে বসলেন,
” উনি চলে যাচ্ছিলেন? ”

সোবহান শাইখ মাথা ধীরে উপরনিচ করে বললেন,
” হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমিও জানি না। অবশ্য জানার কথা না। কারণ, তার সাথে আমার আলাদা করে কখনই কথা হয়নি। দুপুরের খাবার পর আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম হাঁটতে। হঠাৎ রুবিনাকে বের হতে দেখি। হাতে ব্যাগ দেখে সন্দেহ হয়েছিল। পিছু নিতে দেখি সে সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই সিরাজগঞ্জ যাওয়ার উপায় জিজ্ঞেস করছে। আমার ভয় হলো, কোনো খারাপ লোকের খপ্পরে না পড়ে, সেই ভয়ে আমি তার সামনে যাই। রুবিনা রাজি না হওয়া সত্ত্বেও জোর করে তার সাথে চলি। ইচ্ছে হয়েছিল তাকে আটকাই। কিন্তু বলা হয়নি। কারণ, তাকে থেকে যাওয়ার মতো কোনো সম্পর্কই আমাদের মধ্যে ছিল না। একটা সম্পর্ক হতে গিয়েও হয়নি। আর কোনো সম্পর্ক হওয়ার পথও নেই। তাই চুপচাপ তাকে নিরাপদে বাসে উঠিয়ে দিয়ে এসেছি। ব্যস, এতটুকুই। এরমধ্যে তোমার ছেলে খারাপ কী দেখেছে আমি জানি না। তোমার যদি মনে হয় আমি ভুল করেছি তাহলে বলো। এখনই বলো। ”

শাহিনা শাইখা কিছু বললেন না। নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন। ইশাদের রাগটাও পড়ে গেল। সাথে বুঝে গেল, মাকে আর নেওয়া যাবে না। দোষ থাকা সত্ত্বেও যার প্রতি ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি, নির্দোষ অবস্থায় তাকে ফেলে চলে যাবে? এত ভাবনাতীত! ইশাদ কাঁধ থেকে ব্যাগ রেখে দিল। চেইন খুলে সবকিছু আগের জায়গায় গুছিয়ে রাখছে।

সোবহান শাইখ সগর্বে বের হতে গিয়েও থমকালেন। নাক উঁচু করে বললেন,
” তোমার আব্বুর ব্যবহার খারাপ হতে পারে, চরিত্র না। চরিত্র খারাপ হলে আজ আমাকে এখানে দেখতে পেতে না। আমাকে ধরে রাখার মতো কোনো মায়া, ক্ষমতা তোমার মায়ের নেই। রুবিনার সাথেও খারাপ সম্পর্ক তৈরি করার প্রয়োজন পড়ত না। তাকে বিয়ে করে নতুন সংসার করার মতো ক্ষমতা আমার ছিল। মিহির বাবার মরে যাওয়া পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হতো না। এক ডাকে সব ফেলে চলে আসত। ”

কথাটা শেষ করে নাক উঁচু অবস্থায় চলে যেতে নিলে শাহিনা শাইখা নীরবতা ভাঙলেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে ইশাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
” আমি পরনের কাপড়টাও নিয়ে যেতে চাই না, ইশাদ। কাছের একটা দোকান থেকে একটা শাড়ি নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি আসবি। এই আমি নিশ্বাস আটকে রাখলাম। এ বাড়ির একফোটা অক্সিজেনও আমার জন্য বিষ! ”

___________
ইমদাদ হাসপাতাল থেকে ফিরল সন্ধ্যার পর। অস্থির মনে পায়চারি করছে। চিন্তায় মাথা ধরে গেছে। কাল রাত থেকে ইশাদকে কল দিয়ে যাচ্ছে, ধরছে না। দুইবার তার চেম্বারে গিয়েছিল, পায়নি। বাসায় খোঁজ নিয়েছিল, সেখানেও নেই। মানুষটা হঠাৎ গায়েব হলো কী করে? এদিকে শেরপুরের এক পেশেন্টের আত্মীয় থেকে তিহির ঠিকানা পেয়েছে। তাপান মুখার্জি নাম শুনেই চিনে ফেলেছেন ভদ্রলোক। খুব টাকা নাকি লোকটার। ক্ষমতাশালী কোনো পদে না থাকলেও লোকজন সমীহ করেই চলে।

” আপনাকে চা দিব? ”

এই নিয়ে বেশ কয়েক বার ইমদাদের সামনে এসেছে মিহি। নানা রকম প্রশ্ন করেছে। ইমদাদ কানে তুলেনি। তার পুরোমন ফোনে। পরিচিত সকলকে কল দিয়ে যাচ্ছে। যদি কেউ ইশাদের খোঁজ দিতে পারে এ আশায়।

মিহি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার জিজ্ঞেস করল,
” অন্যকিছু খাবেন? আজ মিলা খালা নুডলস রান্না শিখিয়েছে। রান্না করব? ”

এ পর্যায়ে ইমদাদ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। কণ্ঠ থেকে প্রচণ্ড বিরক্ত ঝরে পড়ার পূর্বেই ফোন বেজে উঠল। ইশাদের বাবার কল। সালাম দিয়ে কথা শুরু করল। কয়েক সেকেন্ড পর কেটে দিতে ইমদাদের চিন্তা আকাশের মাপ নিল। সে তাৎক্ষণিক ইশাদের নাম্বারে কল দিল। কী ভাগ্য! কল রিসিভ হলো। সে উত্তেজিত হয়ে বলল,
” আরে ভাই, কল ধরছিস না কেন? কাল থেকে কম করে হলেও লক্ষবার কল দিয়েছি। তোর বাবার কলও নাকি ধরছিস না? সমস্যা কী? ”
” বাবা, কল দিয়েছিল তুই জানলি কিভাবে? ”
” একটু আগে কল করে বললেন। ”

মুহূর্তে রেগে গেল ইশাদ। রাগ নিয়ে বলল,
” এখনই তার নাম্বার ব্লকলিস্টে ফেলবি। ”

ইশাদকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ইমদাদ বলল,
” আচ্ছা। কথা শেষ করেই ফেলব। জরুরি কথা আছে। ”

ইশাদ মানল না। আগের রাগ নিয়েই বলল,
” না। আমি কেটে দিচ্ছি, ব্লকলিস্টে ফেলে আমাকে কল দে। ”

আদেশ করে ইশাদ কল কেটে দিল। সেই সময় মিহি বলল,
” ইশাদ ভাইয়া? তাকে বলুন আমি নুডলস রান্না করেছি। এসে যেন খেয়ে যায়। ”

কথাটা শেষ করতে পারল না ইমদাদ তার দিকে অগ্নিরূপে ঘুরল। মিহির হাতের গরম নুডলসের বাটিটা উল্টে দিয়ে বলল,
” একটু চুপ থাকতে পার না? দেখছ না, আমি চিন্তায় মরে যাচ্ছি? ”

ইমদাদের কথাটা মিহির কানে পৌঁছাল কি? তার আগেই চোখ চেপে ধরে বসে পড়ল। কাটা চামচের ঘাটা বুঝি চোখের ভেতরেই লেগেছে!

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here