তোমার সমাপ্তিতে আমার প্রাপ্তি ৩ পর্ব -০৭+৮

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (৭)

কাটাচামচ মিহির চোখের ভেতর না ঢুকলেও নিচের নরম স্থানে ঘা লেগেছে। দূরত্ব প্রায় এক সেন্টিমিটার। রক্ত জমে ফুলে ঢোল! নিচের দিকে তাকালে সাদা ব্যান্ডেজের প্রতিচ্ছায়া দেখা যায় শুধু। ইশাদ মিহিকে রেখে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলে ইমদাদ পথরোধ করে বলল,
” বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছে করে দিইনি। ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল! ”

ইমদাদের অসহায় মুখমণ্ডল ও কণ্ঠস্বর কোনোটাই ইশাদের শক্ত চোয়াল নরম করতে পারল না। উল্টো চোখে আগুন জ্বলে উঠল। শক্ত মুঠে কলার চেপে ধরে চাপা স্বরে শাসাল,
” তুই আবার আমার সামনে এসেছিস? আমি কিন্তু ভুলে যাব এটা হসপিটাল। ”

ইমদাদ ভয়ে জমে গেল। গলা শুকিয়ে খড়ায় পরিণত হলো। বুকের পাটা সংকুচিত করে বলল,
” আর এমন ভুল হবে না। মাফ করে দে। ”

ইশাদ কলার ছেড়ে ছিল। বিনাবাক্যে গরম চাহনি ফেলে হাঁটা ধরল নিজের চেম্বারের দিকে। ইমদাদ শুকিয়ে আসা কলিজা নিয়ে ইশাদের পিছু নিল। বিনা অনুমতিতে চেম্বারের ভেতর ঢুকে অনুরোধের গলায় বলল,
” বলছি তো আর ভুল হবে না। আমার চোখ, কান নষ্ট করে হলেও তোর বোনকে রক্ষা করব। ”
” তুই সত্যিই মিহিকে ভালোবাসিস? ”

ইশাদের হঠাৎ এমন প্রশ্নে ইমদাদ ঘাবড়ে গেল। ভয়ে জড়োসড়ো শরীরটা মেলে দাঁড়াল। চোখদুটো ইশাদের চোখে পড়তে নতুন ভয়ের জন্ম হলো। মিথ্যা ধরা পড়ার ভয়!

ইশাদের সন্দেহভরা চাহনিতে চেয়ে থাকতে পারল না ইমদাদ। মনিদুটো চঞ্চল হয়ে ঘুরতে লাগল পুরো চেম্বারজুড়ে।

ইশাদ এগিয়ে এসে অটল চাহনি ফেলে জিজ্ঞেস করল,
” মিহিকে ভালোবাসিস? উত্তর দে। ”

ইশাদের চোখে চোখ রাখার সাহস হলো না ইমদাদের। অন্যদিকে ঘুরে আমতা আমতা করে বলল,
” বাসি তো। না বাসলে বিয়ে করব কেন? তুই তো আমাকে চিনিসই, হুট-হাট বিয়ে করার ছেলে আমি নই। ”
” তাহলে ওর কষ্টে তোর চোখে ব্যথা নেই কেন? এখানে নিয়ে আসার পর থেকে আমার পিছ পিছ ঘুরছিস অথচ একবারও জিজ্ঞেস করলি না ও কেমন আছে। তাছাড়া যাকে ভালোবাসিস তাকে আঘাত করিস কিভাবে? ”
” যেভাবে তুই তোর ভালোবাসার মৃত্যু কামনা করিস। ”

ইশাদের অটল দৃষ্টি টলে গেল। ভ্রূজোড়া কুঁচকে যেতে ইমদাদ গোপনে শ্বাস ছাড়ল। কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে দ্রুত বলল,
” তুই যেমন রাগ থেকে তিহির মৃত্যু কামনা করেছিলি আমিও তেমন রাগ থেকেই করেছি। ইচ্ছাকৃত ছিল না। ”

ইশাদ কিছু একটা বলার জন্য প্রস্তুত হতে ইমদাদ প্রশ্ন করে বসল,
” কল করেছিলি? ”
” কাকে? ”
” কাকে আবার? তিহিকে। সে বাঁচবে না বলার পর তো দুটোদিন পার হয়ে গেল! যেতে পারিসনি বলে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করবি না? ”
” না। ”
” কেন? ”

ইশাদের দিক থেকে উত্তর শোনার ধৈর্য্য হলো না ইমদাদের। দারুন উৎসাহ নিয়ে বলল,
” থাক, ফোনে দেওয়া লাগবে না। একেবারে সামনে গিয়েই দিবি। ”
” মানে? ”

ইমদাদ পকেট থেকে নতুন দুটো টিকিট বের করে বলল,
” সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। সাড়ে এগারোটায় বাস আসবে। ”

ইমদাদ কথার মধ্যেই ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল,
” বেশি সময় নেই। চল বেরোই। ”

ইশাদ তাৎক্ষণিক কিছু বলল না। সন্দিহানে চেয়ে আছে ইমদাদের মুখে। সেকেন্ড কয়েক পর বলল,
” মিহিকে এ অবস্থায় একা রেখে যেতে তোর বিবেকে বাধছে না? এই, তুই আমার সাথে গেম খেলছিস না তো? সত্যি করে বল। ”

ঘুরেফিরে ইশাদ আবার সন্দেহ সাগরে পতিত হওয়ায় ইমদাদ হতাশ হলো। রেগেও গেল খুব। বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে মিহিকে দোষারোপ করতে থাকল। মনে মনে গালি-গালাজ করতে করতে বেফাঁসে বলে ফেলল, ‘ কাটাচামচটা চোখে না লেগে গলায় ঢুকে দম কেন আটকাল না? তাহলেই তো সব ঝামেলা মিটে যেত! ‘
” চুপ করে ভালবাসেনা আছিস কেন? ইমদাদ, সত্যি বল। ”

ইমদাদ বুদ্ধিশূন্য চোখে তাকাল ইশাদের দিকে। কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। সত্যি বললেও সমস্যা মিথ্যা বললেও! সে সময় ইশাদের ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে শাহিনা শাইখার নাম্বার ভেসে উঠতে তার বুদ্ধির বাতি জ্বলে উঠল। চটজলদি বলল,
” আরে, একা রেখে যাব কেন? আন্টি আছে না? তার কাছে রেখে যাব। ওর তো এখন খেয়ালের প্রয়োজন। আমি কি এত কিছু বুঝি? আন্টির কাছে ভালো থাকবে। তাছাড়া, আমরা তো সারাজীবনের জন্য যাচ্ছি না। যাব, তিহিকে নিয়ে চলে আসব। ”

ইমদাদের কথার প্রত্যুত্তর করল না ইশাদ। ফোন কানে চেপে তার দিকে সরু চোখে চেয়ে মায়ের সাথে কথা বলছে। কথা বলতে বলতেই মিহির কাছে গেল। তার কানে ফোন দিয়ে উল্টো ঘুরতে গিয়ে ইমদাদের সাথে ধাক্কা খেল। বিরক্ত নিয়ে বলল,
” কী সমস্যা? ”

ইমদাদ ইশাদকে খুশি করতে বলল,
” বউ সমস্যা। ড. সাহেব আমি কি কিছুক্ষণের জন্য বউয়ের সাথে সময় কাটাতে পারি? ”

ইমদাদের বলার ধরনে ইশাদ হেসে ফেলল। বুকে আদুরে ঘুষি দিয়ে বলল,
” জ্বি পারেন। তবে সাবধান, আবার যেন কোনো এক্সিডেন্ট না ঘটে তাহলে কিন্তু…”
” হবে না। যা, এখন। ”

ইশাদ চলে যেতে মিহি কল কেটে দিল। ইশাদের ফোনটা নিচে নামিয়ে রেখে অপরাধী সুরে বলল,
” আমি বুঝতে পারিনি আপনি রেগে যাবেন, সরি। ”

মিহির ব্যথায় ফুলে যাওয়া মুখটা দেখেও একটু মায়া হলো না ইমদাদের। সুযোগ নিয়ে বলল,
” এক শর্তে সরি গ্রহণ করব। ”

মিহির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শুকনো ঠোঁট টেনে আগ্রহ নিয়ে সুধাল,
” কী শর্ত? ”
” তুমি ইশাদকে বলবে, কয়েকদিন আন্টির সাথে থাকবে। ”

মিহি এক নিশ্বাসে রাজি হয়ে গেল। ইমদাদের একটা হাত ধরে বলল,
” আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। শুধু আপনি রাগ করবেন না, প্লিজ! ”

ইমদাদ ধীরে হাত সরিয়ে বলল,
” তাহলে আমি ইশাদকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”

_________
হাসপাতালের কাছেই একটি বিল্ডিংয়ে মাকে নিয়ে ভাড়া বাসায় উঠেছে ইশাদ। মিহির আবদারে তাকে নিয়ে আসল সেই বাসায়। রাতে খাওয়া শেষে মিহি আর ইশাদের মা শুলো এক রুমে। অন্য রুমে ইশাদ আর ইমদাদ। ইশাদ চোখ বুজা অবস্থায় ডান কাত হতে ইমদাদ বলল,
” সাড়ে এগারোটা বাজতে এখনও দশ মিনিট বাকি বুঝলি? বাসের তো নির্দিষ্ট সময় নেই। বলে এক সময় ছাড়ে আরেক সময়। ”

ইমদাদের কথায় কোনো সাড়া দিল না ইশাদ। চুপচাপ নিশ্বাস নিচ্ছে আর ছাড়ছে। ইমদাদ ঘাড় উঁচু করে ইশাদের দিকে তাকাল। একটু এগিয়ে বলল,
” আমরা যদি এখন বের হই তাহলেও….”

ইমদাদের কথার মাঝেই ইশাদ আচমকা ঘুরল। একটা কঠিন ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল। ভারী নিশ্বাস টেনে বলল,
” আজ সকালে নিউরোলজিস্টের সাথে কথা বলেছি। ”

ইমদাদ অবাক হয়ে বলল,
” নিউরোলজিস্ট? ”
” হ্যাঁ, তিহির জন্য। ওর অতিত জানার পর থেকেই আমার ভেতরের সব এলোমেলো হয়ে গেছে। ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। তাই নিউরোলজিস্ট এর শরণাপন্ন হই। ”
” কী বললেন উনি? ”

ইশাদ ইমদাদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অন্ধকারময় রুমে উদাস চোখে চেয়ে বলল,
” ওর শর্ট টাইম মেরোরি লস চলছে। যে কোনো সময় অতীতের সবকিছু মনে পড়ে যেতে পারে। এর মানে বুঝতে পারছিস? ”

ইমদাদ একজন ডাক্তার হওয়ার সুবাদে ভবিষ্যৎ বিপদ অনুধাবন করে শিউরে উঠল। আতঙ্কে ভেতরটা অস্থির হয়ে পড়ল। উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে গিয়েও লাগাম টেনে ধরে বলল,
” তোকে ভুলে যাবে এইতো? এতে ভয়ের কী আছে? আবার মনে করিয়ে দিবি। ”

ইশাদ উদাস থেকে ফিরল। চোখ বুঝে উল্টো ঘুরতে ঘুরতে বলল,
” অযৌক্তিক কথা বলিস না তো। ”

ইমদাদ ইশাদের উপর হেলে আসল। জোর দিয়ে বলল,
” মোটেও অযৌক্তিক নয়। যাকে ভালোবেসে মরে যেতে চায় তাকে এত সহজে ভুলে যাবে? আমরা দিলে তো? ”
” তোরা কী করবি? স্মৃতিশক্তি টেনে ধরে থাকবি? ”

এই মুহূর্তে ইশাদের এমন ব্যঙ্গটুকু হজম করতে কষ্ট হলো ইমদাদের। কষ্টুটুকু উপেক্ষা করে বলল,
” তিহি ভুলে যেতে পারে তুই তো আর ভুলছিস না। আবার প্রেমে ফেলবি। এবার তো একাই একাই করেছিলি। পরের বার আমরা সবাই মিলে করব। ”

ইশাদ ইমদাদের কথার পাত্তা দিল না। ইমদাদ দুইহাত দিয়ে ইশাদের মুখের দুদিকে চেপে ধরে উঁচু করে কঠিন গলায় বলল,
” তোর ভালোবাসায় বিশ্বাস নেই? জোর নেই? পাগল মেয়েটাকে আরেকবার পাগল করতে পারবি না? ”

ইশাদ অন্ধকারেও ইমদাদের অন্যরকম কণ্ঠস্বরে চমকে গেল। নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকলে ইমদাদ আবার বলল,
” তিহিকে ছাড়া তুই বাঁচতে পারবি? ”

ইশাদ সাথে সাথে উত্তর দিল না। অনেক্ষণ পর নিজেকে ছাড়িয়ে বালিশে মাথা রেখে বলল,
” তুই ভুলে যাচ্ছিস আমি ওর প্রথম ভালোবাসা নই। ওর হৃদয়জুড়ে আরেকজন মানুষের বসবাস। তার অবর্তমানে ভুলবশত আমি ঢুকে পড়েছি। সময় হলে আমাকে ঠিক বের করে দিবে। আর সে কাজটা তিহি করবে। ইমদাদ, ও যখন বলবে ‘ আমি তাজকে ভালোবাসি। ‘ তখন আমি সহ্য করব কীভাবে? ”
” আর যদি কখনও না বলে? ”
” মানে? ”
” এমনও তো হতে পারে তিহির কিছু মনে পড়লই না! হতে পারে না বল? ”

ইশাদ থমকে গেল। এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করতে চাইল তিহির কিছু মনে পড়বে না। পর মুহূর্তে ইনার মুখটা ভেসে উঠল। রুদ্ধশ্বাসে বলল,
” আমরা শুধু আমাদের কথাই ভাবছি। ইনার কথা ভাবছি না। ও এতদিন জানত তিহি আপু হয়। এখন জানে মা হয়। এতদিনে হয়ত বাবার সাথেও পরিচয় হয়ে গেছে। তারমধ্যে যদি….”
” আমি এত কিছু ভাবতে পারব না। আমি শুধু তোর খুশিটুকু ভাবতে চাই। ”

ইমদাদের এমন ত্যাড়া বক্তব্যে ইশাদ রেগে গেল। তাকে জোর করে রুম থেকে বের করে দরজা আটকে শুয়ে পড়ল। ইমদাদ দরজায় ঠকঠক করতে করতে বলল,
” আমাকে দাম দিচ্ছিস না তো পরে পস্তাবি। তাজ শালা কবে মরে ভূত হয়ে গেছে নাহলে অমন সুন্দরী বউ রেখে দূরে থাকে? আর তিহি? সেই বা কত দিন একা একা থাকবে? আজ তোকে চায়ছে, কাল ঠিকই অন্য কাউকে….”

ইমদাদ কথার মাঝেই ভারী ঘুষি টের পেল বুকে। পড়তে গিয়ে নিজেকে আটকাল। তন্মধ্যেই সেন্ডো গেঞ্জি টেনে ধরে ইশাদ বলল,
” তুই আমার হাতেই মরবি দেখিস। ”

ইমদাদ বুকে ঢলতে ঢলতে কুটিল হাসল। সদর দরজা পার হতে হতে বলল,
” অশ্লীল কাজ সবসময় খারাপ হয় না। ভালোও হয় তাই না, বন্ধু? ”

ইশাদ উত্তরে শাসাল,
” যদি বাস না পাই তোর কাঁধে চড়ে যাব। ”
#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (৮)

রুকমিনি মুখার্জি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন। স্নান সেরে পুজো করেন। আজও ব্যতিক্রম হলো না। স্নান শেষে পুজো ঘরে যাওয়ার আগে তিহির রুমে আসলেন। বিছানা খালি দেখে ভারী নিশ্বাস ছাড়লেন। হাতে করে আনা লাল টকটকে শাড়ি, সোনার গয়না আর সিঁদুরের কৌটা খাটের উপর রেখে বারান্দায় এগুলেন।

বারান্দার রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তিহি। চোখের চারপাশে কালচে ফোলাভাব। গাল বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রুর ধূসর রঙের দাগ। রসাশ্যান্য ঠোঁটদুটো থেকে থেকে কাঁপছে! তিহির এমন মুমূর্ষু অবস্থায় রুকমিনির ভেতরটা কেঁদে উঠল। ঠোঁট চেপে নিজের দুর্বলতাটুকু আটকে তিহির মাথায় আলতো হাত রাখলেন। আদুরে গলায় ডাকলেন,
” তিহিমা? ”

তিহি হালকা কেঁপে উঠল। আলস্যতায় চোখের পাতা মেললে রুকমিনি মুখার্জি বললেন,
” স্নান সেরে আয়। আমি পুজো দেব। ”

তিহি বোধ হয় কিছু শুনল না। অবুঝ চোখে তাকিয়ে থাকলে রুকমিনি মুখার্জি হাত সরিয়ে নিলেন। কণ্ঠে কাঠিন্যভাব এনে বললেন,
” এ বাড়ির বউ তুই। রীতি-রেওয়াজ শিখতে হবে। আমার অবর্তমানে পুজোঘরের দায়িত্ব তোর হবে। সংসারের কল্যাণ-অকল্যাণ জানতে হবে। তাই বলছি, আমি থাকতে থাকতে সব শিখে নে। ”

তিহি চোখ তুলে শাশুড়ির কথা শুনল ঠিকই কিন্তু তনুমনে কোনো রকম প্রভাব পড়ল না। তিনি থেমে যেতেই তিহির চোখ বুঝে আসছিল তখনই বললেন,
” আমার বিশ্বাস তাজ বেঁচে আছে। একদিন ঠিক আমার বুকে ফিরবে। আর সেই বিশ্বাস জোর পাবে তোর কপালে সিঁদুর উঠলে। অনেক স্বাধীনতা পেয়েছিস আর নয়। ”

তিহি এবারও চোখ মেলে শাশুড়ির কথা শুনছে। তিনি বের হয়ে যাওয়ার আগে হুকুম দেওয়ার মতো বললেন,
” বউমা, খাটের উপর শাড়ি আর গয়না রাখা আছে। স্নান করে পরবে। সিঁদুর পরবে মোটা করে, কেমন? ”

রুকমিনি শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসাতে তিহির ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠল। ভীষণ আহ্লাদে বলল,
” আমরা ঐ বাসায় কবে যাব, আম্মা? ”

রুকমিনি বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান ধরে বললেন,
” কোন বাসায়? ”
” ইশাদের বাসায়। ”

তিহি ইশাদের নাম উচ্চারণ করতে রুকমিনি মুখার্জির চোখ জ্বলে উঠল। চোয়াল শক্ত করে কঠিনস্বরে বললেন,
” তোমাকে না বলেছি ঐ নাম আর মুখে নিবে না? ”

মুহূর্তে অগ্নিমুর্তির রূপ ধরা শাশুড়িকে দেখে একটুও ভয় পেল না তিহি। তার ধমক উপেক্ষা করে নরম স্বরে বলল,
” আমার ধ্যান-ধারণায়, চিন্তা-কল্পনাজুড়ে তো শুধুই সে। নিশ্বাসে নিশ্বাসে তার নাম না জপলে আমি তো মরেই যাব, আম্মা। ”

রুকমিনি মুখার্জি কঠিন ধমক দিতে গিয়েও পারলেন না। আবার চুপচাপ মেনেও নিতে পারলেন না। ছুটে গেলেন ভেতরে। শাড়ির উপর রাখা সিঁদুরের কৌটা থেকে এক চিমটি সিঁদুর এনে তিহির সিঁথিতে পরিয়ে বললেন,
” তুই আমার ছেলের বউ। এ বাড়ির বউ। আমার বউমা। তোর স্বামীর নাম তাজ। সাত জনমের বন্ধন তোদের। ”

কথাটা বলেই রুকমিনি মুখার্জি ছুটে গেলেন পুজোঘরে। নিশ্বাস আটকে পার্থনা করলেন ভগবানের কাছে, ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে।

_______
তিহি সিঁদুর পরেই আবারও ঘুমিয়ে পড়ল। খাওয়া-দাওয়াই অবহেলায় শরীর এখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। হাঁটতে গেলে পা টলে! দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। বারান্দায় বসে বসে সময় কাটায়। চাহনি উদাস হয়ে আসতে ঘুমিয়ে পড়ে। সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়ে খেয়াল নেই। মাঝে মাঝে চাঁদ দেখতে পায়। মেঘে হারিয়ে গেলে সেও হারিয়ে যায় কোথাও একটা।

তিহির ঘুম ভাঙল পরিচিত কণ্ঠস্বরে। শরীরের ক্লান্তভাব হঠাৎই ছুটে গেল। মেঝেতে হাঁটু ভর দিয়ে মাথা তুলে তাকাল গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে। তার চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার জন্যই বুঝি ইশাদের মুখটা দেখা গেল বাড়ি ঢাকা সুউচ্চ দেয়ালের মাথায়। তিহি বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভালো করে তাকাতেই ইশাদের গলা পেল স্পষ্ট,
” দেয়াল টপকাব? দারোয়ান যদি চোর ভেবে পিটিয়ে দেয়? ”

উত্তরে ইমদাদ বলল,
” দিলে দিবে। ভালোবাসার জন্য এইটুকু মার সহ্য করতে পারবি না? ”

ইশাদ কিছু বলল না। দেয়ালের উচ্চতার মাপ পরীক্ষা করে বলল,
” আমরা আরেকটু অপেক্ষা করি। কেউ না কেউ তো বের হবেই। নাহলে গেইটে নক করব। ”

ইমদাদ ভারি বিরক্ত হলো বন্ধুর কথায়। ব্যঙ্গ করে বলল,
” তুমি ঢুকতে চাইলেই মালা দিয়ে বরণ করে নিবে তাই না? ”

ইশাদ কপাল কুঁচকে ফেললে ইমদাদ ওর কোমর চেপে ধরে উঁচু করল আচমকা। দেয়ালের মাথার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,
” ভুলে যেও না, তুমি এ বাড়ির বউকে চুরি করতে এসেছ। ”

ইশাদ দু-হাতে শক্ত করে দেয়াল চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল,
” আমরা কি সত্যি তিহিকে তুলে নিতে এসেছি? ”

ইমদাদ ইশাদকে ছেড়ে লাফিয়ে দেয়ালের অগ্রভাগ ছুঁলো দুই হাতে। প্রথমবারে শরীরের ভর ধরতে না পারলেও পরেরবার পারল। দেয়ালে উঠতে উঠতে বলল,
” জি, হ্যাঁ। ”

ইশাদ বিস্ময়ে ফেটে পড়ার আগেই তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিল ইমদাদ। নিজেও লাফিয়ে পড়ে বলল,
” ব্যথা পেয়েছিস? ”

ইশাদ উত্তর দিতে পারল না। তার আগেই তিহি চিৎকার করে উঠল,
” ইশাদ? ”

দুই বন্ধু ঘাড় বাঁকিয়ে উপরে তাকাল চকিতে। তিহি অস্থির হয়ে বলল,
” আমি জানতাম তুমি আসবে। আমাকে নিতে আসবে। দাঁড়াও আমি আসছি। এখনই আসছি। ”

এই মুহূর্তে তিহির এই সাহায্যটুকু একদমই অপ্রত্যাশিত ছিল। ইমদাদ ভেবেছিল ঘুমের ঘোরে কাঁধে নিয়ে পালাবে। কিন্তু এখন তো তার পরিকল্পনা ঘেটে গেল। সাথে তার বুদ্ধিপূর্ণ মস্তিষ্ক জানিয়ে দিল, সর্বনাশ হয়ে গেছে! ধরা খাওয়ার আগে লুকাতে হবে।

ইমদাদ লুকানোর জন্য জায়গা খুঁজতে লাগল। আশেপাশে ফুলের বাগান আর একটি কালো গাড়ি ছাড়া কিছু দেখতে পারছে না। কোনদিকে যাবে? ইমদাদ সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ইশাদকে তাড়া দিচ্ছিল। সে তখনও শূন্য বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে বিমোহিত হয়ে। ইমদাদ তার একহাত ধরে বাগানের দিকে টেনে এক কদম এগিয়েছে সবে তখনই দাড়োয়ান পথরোধ করল। সন্দেহ চোখে চেয়ে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল,
” আপনারা কে? ”

ততোক্ষণে ইশাদের সম্বিৎ ফিরেছে। ইমদাদ কিছু বলার আগেই সে জানাল,
” আমরা তাপান মুখার্জির পরিচিত। তিনি কি বাড়িতে আছেন? ”

দারোয়ানের সন্দেহভরা চোখদুটো একটু শীথিল হলো। কন্ঠস্বর ধীর করে বলল,
” আমার সাথে আসেন। ”

ইশাদ পিছু নিলে পেছন থেকে ইমদাদ হাত টান দিল। নিচুস্বরে বলল,
” কী করছিস? উনাদের সামনে পড়লে তিহিকে তুলব কী করে? ”

ইশাদ হাত ছাড়িয়ে নিল। ইমদাদকে উপেক্ষা করে সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কলিংবেল চাপতে হলো না তার আগেই অকস্মাৎ দরজা খুলে দাঁড়াল তিহি। ছটফট মনটা শান্ত করতে ইশাদের বুকে পড়বে সেই সময় পেছন থেকে হুংকার আসল,
” বউমা, ভেতরে যাও। ”

তিহি চমকে পেছনে তাকাল। তার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানায় ভয় জমল। ভীত স্বরেই বলল,
” ইশাদ আমাকে নিতে এসেছে, আম্মা। ”

রুকমিনি মুখার্জি পুনরায় ধমকে উঠলেন,
” তোমাকে ভেতরে যেতে বলেছি। ”

তিহি কেঁপে উঠলেও জায়গা থেকে নড়ল না। ছলছল চোখে আরেকবার অস্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
” আম্মা! ”

পরের কথাটুকু বলতে পারল না। নিজে এগিয়ে তিহিকে টেনে সিঁড়ির মুখে রেখে আসলেন। চোখের ইশারায় উপরে যাওয়ার আদেশ দিতে সে চুপচাপ চলে গেল।

এই মুহূর্তে ইশাদকে রুকমিনি মুখার্জির অপছন্দ হলেও বাইরে থেকে বিদায় করলেন না। কোনো রকম ঝামেলাও করলেন না। সাদরে ভেতরে বসতে দিলেন। নাস্তাপানির ব্যবস্থা করলেন নিজে দায়িত্ব নিয়ে। বেশ কয়েকপদের শুকনো খাবার ও পানীয় সামনে দিয়ে বললেন,
” আমরা অতিথিকে নারায়ণ মনে করি। খালি মুখে বিদায় করা পাপ। কিছু একটা মুখে দেও। ”

ইশাদ রুকমিনি মুখার্জিকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও ইমদাদ নিতে পারছে না। সে আশ্চর্যান্বিত চাহনিতে তার আগাগোড়া পরখ করছে। ইশাদদের বাড়িতে যাওয়া-আসা থাকায় বেশ কয়েকবার এই মহিলাকে দেখেছে। সে সুবাদে এনাকে চেনার কথা। কিন্তু এই চেনার মাঝেও কেমন অচেনাভাব। তার মনে হচ্ছে এই প্রথম এই মহিলাকে দেখছে। কেন? এই কেন এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করল আগে যাকে দেখেছিল তার সাজগোজ ছিল সাদামাটা। আর এখন যাকে দেখছে তার সাজগোজে আমিরত্ব। গায়ের দামি শাড়ি, গয়না ছাপিয়ে সিঁদুরে চোখ পড়তে এক পুজোর মন্ডপের কথা মনে পড়ল। সে সময় এক হিন্দু মেয়ের সাথে প্রেম চলছিল। তাকে খুশি করতে পুজা দেখতে গিয়েছিল। সেই পুজা মণ্ডপের এক মূর্তির সাথে এই মহিলার বিশাল মিল!

” কেন এসেছ? ”

রুকমিনি মুখার্জির হঠাৎ প্রশ্নে ইমদাদের ঘোর কাটল। একটু নড়েচড়ে বসতে রুকমিনি মুখার্জি আবার বললেন,
” তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি অন্যায় পথে পা বাড়াচ্ছ? ইশাদ, তোমার তো সব জানা। কিছুই লুকাইনি। ”

ইশাদ মাথা নিচু করে ফেলল। রুকমিনি মুখার্জি খানিকটা ব্যাকুল স্বরেই বললেন,
” তিহি আমার ছেলের বউ। ইনার মা। সব জেনেশুনেও…”
” আপনার কাছে প্রমাণ আছে? ”

ইশাদের আমচকা প্রশ্নে রুকমিনি মুখার্জি থমকে গেলেন। দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন,
” কিসের প্রমাণ? ”
” আপনি যা যা বলেছেন সব সত্য, এটা কি প্রমাণ করতে পারবেন? আচ্ছা, আপনি তো তাজ আর তিহির বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন না তাহলে কিভাবে জানলেন ওদের বিয়ে হয়েছে? তিহি বলেছে? এটা তো সম্ভব নয়। ম্যারেজ সার্টিফিকেট আছে আপনার কাছে? ”

ইশাদের একের পর এক প্রশ্নে থতমত খেলেন রুকমিনি মুখার্জি। ইশাদ মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। ঘাড় শক্ত করে শাণিত দৃষ্টি রেখে বললেন,
” কিসের উপর ভিত্তি করে দাবি করছেন তিহি আপনার ছেলের বউ? সিঁদুর দানে তো সম্ভব নয় কারণ, তিহি মুসলিম ঘরের সন্তান। তাহলে? ”

মুহূর্তে রুকমিনির আমিরত্ব সৌন্দর্যে অসহায়ত্ব ধরা পড়ল। চালচলনে অস্থিরতা ভাব। অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারছেন না। যেন ঠোঁটের আগায় এসে হারিয়ে যাচ্ছে। ইশাদ গোপনে খুশি হলো। চোখে-মুখে সাহসিকতা দৃষ্টান্ত! রুকমিনি মুখার্জিকে আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করল না। সোফা ছেড়ে সোজা চলে গেল সিঁড়ির ধারে। দৌড়ে উপরে উঠছে। সিঁড়ির সাথে লাগোয়া বারান্দার ডানদিকে পা রাখতে পেছন থেকে তিহি বলল,
” আমি এখানে। ”

ইশাদ থমকে গেল। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হৃদয়টা লাফিয়ে উঠল। মুগ্ধ চোখে দেখল তার তিহি লাল টকটকে শাড়ি পরে দাঁড়িয়েছে। সদ্য গোসল করে বের হওয়াই এতদিনের ক্লান্ত, অবসন্ন, দুর্বলতা বদনটা স্নিগ্ধ ও পবিত্র মনে হচ্ছে। সে ঘোরলাগা দৃষ্টি নিয়েই তিহির কাছ ঘেষে দাঁড়াল। এক গোছা ভেজা চুল কান থেকে সরিয়ে ফিসফিস করে সুধাল,
” তুমি এখনও বেঁচে আছ? আমি তো ভেবেছিলাম প্রাণ হারিয়ে ভূত-পেত্নী কিছু একটা হয়ে গেছ। ”

ইশাদের এমন মশকরায় তিহির রাগ হলো। ইশাদের মুখোমুখি হতে একটু ঘুরে দাঁড়াতে সোনার দুলটা তার ঠোঁটে বাড়ি খেল। ইশাদ চোখ বন্ধ করে নিলে তিহি রেগে বলল,
” আমি মরে গেলে তুমি খুশি? ”

ইশাদ চোখ মেলল। উত্তর দিল না। মুচকি হাসছে। তিহির এই হাসিটুকু পছন্দ হলো না। রাগ বেড়ে গেল। অভিমানে বলল,
” ঠিক আছে, মরেই দেখাচ্ছি। ”

তিহি সত্যি মরে যাবে এমনভাব ধরে হাঁটা ধরলে ইশাদ ওর হাত টেনে ধরল। ডান হাতের অনামিকা আঙুলে একটি আংটি পরিয়ে বলল,
” এখন একটু বেঁচে থাকো। আমি চলে যাওয়ার পর নাহয় মরে যেও। ”

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here