তোর নামেই এই শহর পর্ব -০৬

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকাঃসুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_০৬

(১৪)
রাতে খাবার টেবিলে বসতে গিয়ে এক নতুন বিপদে পড়লো হুরায়রা। সারাদিন পোড়া হাতটা সবার কাছ থেকে লুকিয়ে গেলেও এখন আর সেটা সম্ভব হলো না। বাবার চোখে শেষমেশ ধরা পড়ে গেলো।খাবার টেবিলের কাছে গিয়ে কাছুমাছু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ইয়াদ, জাফর আহমেদ এবং মিরাজ আহমেদ তিনজন আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হুরায়রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জাফর আহমেদ বললেন,
” তোর হাতে কি হয়েছে হুর?”

বাবার কথায় চমকে উঠে হুরায়রা। এতোক্ষণ সে যে ভয়টা পাচ্ছিলো ঠিক তাই হলো। কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। বাবাকে কি জবাব দিবে বুঝতে পারলো না হুরায়রা।নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো। জাফর আহমেদ মেয়ের জবাব না পেয়ে আরো একবার প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন।হুরায়রা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না এরই মাঝে রাহেলা বেগম এসে নতুন কান্ড বাঁধিয়ে দিলেন।তিনি একপ্রকার চিৎকার করে হুরায়রা হাত খপ করে চেপে ধরলেন। বললেন,
“ওলো ছেরি তুই হাত পুড়াইলি কেমনে?”

দাদির চিৎকারে কেঁপে উঠলো হুরায়রা। এক্ষুনি বৃদ্ধা চিৎকার চেঁচামেচি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলবেন। রাহেলা বেগমের চিৎকার শুনে হুমায়রা এবং মালিহা দুজনি রসুইঘর হতে ছুটে এলেন।শ্বাশুড়ির এমন চিৎকারে অর্থ বুঝতে না পেরে দুজনি উভয়ের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। বৃদ্ধা ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,
“এই যে তোমরা দুজন সারাদিন তো রুসুইঘরেই দিন কাঁটাইয়া দাও ঘরে যে তোমাগো দুইটা মাইয়া আছে সে খবর কি রাখো?”
“কি হয়েছে আম্মা?”
“কি হইছে তুমি আমারে জিগাও বড় বউ?”
রাহেলা বেগম খেঁকিয়ে উঠে হুরায়রার হাত টেনে নিয়ে হুমায়রার সামনে ধরলেন। বললেন,
“এই দেখো হাতের দিকে চাইয়া দেখো কত খানি পুড়ছে দেখো।”

হুমায়রা মেয়ের হাতের দিকে তাঁকিয়ে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর মালিহাকে ডেকে বললেন,
“ফ্রিজ থেকে কিছু বরফ নিয়ে আয় তো ছোট। তাড়াতাড়ি যা।”
মালিহা ছুটে গেলো বরফ আনতে। হুমায়রা মেয়ের হাত ধরে আরো কিছুক্ষণ দেখলেন। মায়ের গম্ভীর মুখ দেখে হুরায়রা কিছুটা ভীত চাহনিতে তাকালো। মায়ের গম্ভীর চেহারা পড়তে খুব একটা দেরি করলো না সে। মায়ের এই চাহনি তার খুব পরিচিত।

মালিহা বরফ নিয়ে এলে রাহেলা বেগম তাকে ইশারায় সেটা হুরায়রা হাতে লাগাতে বলেন। মালিহা হুরায়রা টেনে নিজের কাছে এনে বললেন,
” এদিকটায় এসে বস আমি বরফ লাগিয়ে দিচ্ছি।”
“ছোট মা আমার কিছু হয় নি বরফ লাগাতে হবে না।”
“ওই ছেরি আবার মুখে মুখে তর্ক করছ ক্যান, তুই আমাগোরে শিখাইতে হইবো যে কি হইছে নাকি হয় নাই? এখানে চুপ কইরা বইসা থাক। ছোট বউ তুমি হাতে বরফ লাগাও।”

“বড় বউ তাড়াতাড়ি গিয়া একটা ডিম লইয়া আসো হাতে ডিম ভাইঙা লাগাইলে হাতের জ্বালা কমবো।”

হুমায়রা শ্বাশুড়ির কথায় এক পাও নড়লেন না। শুধু এক নজর ইয়াদের দিকে তাঁকালেন। খাবার টেবিলে এসে এতবড় হইছই পড়ে গেলো হুরায়রাকে নিয়ে অথচ ইয়াদ কত শান্ত স্থির। ইয়াদকে এতটা স্থির দেখে হুমায়রা বুঝতে বাকি রইলো না হুরায়রার সাথে ঠিক ঘটেছিল। ইয়াদকে তিনি ছেলের মত স্নেহ করলেও হুরায়রা প্রতি তার এমন শাসন খুব একটা সোজা চোখে দেখেন না তিনি। আজকের ঘটনা পুরোপুরি না জানলেও আন্দাজ করতে পেরেছেন হুরায়রার হাত পুড়ে যাবার পেছনে ইয়াদেরই হাত ছিলো।

এই পুরো ঘটনায় হুরায়রা নির্বাক ছিলো। মালিহা হাতে বরফ লাগিয়ে উঠে গেলো। জাফর আহমেদ বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাস করার পরো হুরায়রা কোন জবাব করে নি শুধু অশহায় ভঙ্গিতে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ইয়াদ খুব স্বাভাবিক ভাবে নিচের দিকে তাঁকিয়ে খাবার শেষ করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। হুমায়রা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন এবার সরাসরি হুরায়রাকে জিজ্ঞাস করে বললেন,
“তোমাকে না কত দিন বলেছিলাম না বলে রসুইঘরে যাবি না তবে গেলি কেনো?”
মাকে তুমি করে বলতে শুনে হুরায়রার ভেতটা মুচড়ে উঠলো। হুমায়রা সচরাচর মেয়েকে তুমি করে বলেন না, যখন রেগে যান কিংবা রাগ করেন তখনি তুমি বলে সম্বোধন করে কথা বলেন। হুরায়রা কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলো না শুধু মায়ের দিকে একবার চোখ তুলে দেখলো। তার চোখ ফেঁটে যেনো কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইছে।
তবুও সে নিজেকে দমিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। এরই মাঝে ইয়াদ আবার ফিরে এলো।সাথে করে একটা মলম এনে নানীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“আজকাল তুমি খুব ডাইনী প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছো, এই নাও এটা তোমার নাতনীর হাতে লাগিয়ে দাও।”বলে ইয়াদ দুই পা বাড়িয়ে আবার থমকে দাঁড়লো। তারপর জাফর এবং মিরাজ আহমেদ কে উদ্দেশ্যে বলল,
“তোমার এই মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে এই বাড়ি থেকে বিদায় করো মামু আর সাথে তোমার এই মা টিকেও একটা বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করো তাহলে যদি এই বাড়িতে শান্তি ফিরে আসে।”
ইয়াদের কথায় জাফর আহমেদ মুচকি হাসলেন। তার অভিব্যক্তি কি তা বুঝা গেলো না। হুরায়রা তখন পাশেই ছিলো ইয়াদের কথার উপর সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“হ্যাঁ এই বাড়ি থেকে বিদায় হয়ে আপনার বাড়ির ফার্মানেন্ট সদস্য হয়ে যাবো দেখে নিবেন আপনি।”
ইয়াদ আড় চোখে হুরায়রাকে একবার অবলোকন করে পরে সেখান হতে প্রস্থান করলো।

রাতের নিস্তব্ধতা ক্রমশ বাড়ছে। দূরে কোথাও হতে পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। রাতজাগা কোনো পাখি হবে হয় তো। রাত গভীর হতে লাগলো চারপাশে নিস্তব্ধতা তোতই বাড়তে আরম্ভ করেছে। পরিশ্রান্ত মানুষগুলো যখন ঘুমে বিভোর তখন একজোড়া চোখ তখন অবিশ্রান্তভাবে সামনে থাকা ল্যাপটপ স্ক্রিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে আছে। স্ক্রিনে একজন অতি সুদর্শন একজন যুবককে সেমিনারে স্পিচ দিতে দেখা গেলো। বয়স প্রায় ছাব্বিশ কি সাতাশের এদিক ওদিক হবে। যুবকটি দেখতে যতটা সুদর্শন ঠিক ততোটাই প্রাণচঞ্চল। তার বলা প্রতিটা বাক্য শ্রোতাদর্শকদের মাঝে উন্মাদনা সৃষ্টি করছে।বাহা বাহ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠছে পুরো কক্ষটি। ল্যাপটপ স্ক্রিনের দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইয়াদের চোখ দুটো চকচক করে উঠে, কপালে একপাশের সুরু রগগুলো ফুলে শক্ত হয়ে উঠে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো সে। স্ক্রিনে যুবকটির দেয়া বক্তব্যগুলো কর্ণকুহরে যেতেই শরীরের র/ক্ত টকবক করে ফুটে শুরু করে। রাগে ইয়াদ বিছানায় পাশে থাকা ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো। বলল,
“হাউ ডেয়ার ইউ ম্যান? হাউ ইজ দিস পসিবল, হাউ ডেয়ার ইউ মি.সামির,হাউ? আমার কোম্পানির বিরুদ্ধে মোটিবেশনাল স্পিচ দেয়ার সাহস কি করে হয় তোমার?”
প্রচণ্ড আক্রোশে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। প্রচুর রাগ হচ্ছে তার। রাগে সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে। সামির নামক সুদর্শন যুবকটিকে সে প্রচণ্ড ঘৃণা করে। এতোক্ষণ যাবত সেমিনারে বলা সামিরের বেশির ভাগ কথাই ছিলো ইয়াদের বিরুদ্ধে। সেমিনারের একদল মানুষ তার পক্ষ হয়ে কথা বলেছে আর অন্যদল ইয়াদের। এহসান গ্রুপ এন্ড কোম্পানির ওনার সেলিম এহসানের একমাত্র ছেলে সামির এহসান গতকাল রাতে সিডনী থেকে বাংলাদেশে ফিরেছে। পনেরো দিনের সফরে সিডনী গিয়ে চারদিনের মাথায় দেশে ফিরে এসেছে সে। তার একমাত্র কারন ইয়াদ। প্রায় পেয়ে যাওয়া টেন্ডারশীপ হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার কারন জানতে পেরে রাতে রাতে দেশে ফিরেছে সামির। ফিরেই সে সেমিনার আয়োজন করে ইয়াদের বিরুদ্ধে নানান উ/ষ্কানি মুলক কথা বলে যাচ্ছে।

ঘড়িতে তখন বারোটা ছুঁইছুঁই। জানালার বাহিরে ছাতিমগাছের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ছাটিমের সুরু ডালের উপর প্রায় দুটো পাখি জড়াজড়ি করে বসে থাকতে দেখে ইয়াদ। আজও তেমন একটি দৃশ্য চোখে ধারণ করলো সে। নিশুতি রাত চারদিকে নীলাভ একটা আলো ছড়িয়ে আছে। কে বলেছে রাতের কোন নিজস্ব কোন রঙ নেই শুধু আধারই তার একমাত্র রঙ? এইতো ইয়াদ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রাতেরও একটা নিজস্ব রঙ আছে। সে পুরোপুরি আধারে ডেকে যায় নি। একটা নীলাভ রঙ চারপাশটাকে সাজিয়ে রেখেছে। ইয়াদ দেখলো ছাতিমডালে তখনো পাখি দুটি জড়াজড়ি হয়ে বসে আছে আছে। হয়তো গোপন কোন কথা বলছে একে অপরকে। কে জানে পাখি দুটোর কি নাম? আধারে তো আর ভালো করে তাদের দেখা যায় না শুধু অস্তিত্বটুকুই অনুভব করা যায়। হবে হয় তো নাম না জানা কোন রাতজাগা পাখি। ইয়াদের খুব ইচ্ছা হলো তাদের গোপন কথোপকথন গুলো শুনতে।

ইতিমধ্যে রাগটা কিছুটা প্রশমিত হয়ে এলো তার। তবে ভিতরে ভিতরে বেশ অস্তিরতা অনুভব করলো সে। অস্থিরতার কারনটা যে ঠিক কি সেটা খুঁজে পেলো না ইয়াদ। অজান্তেই অন্তঃকরণ হতে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। জানালা দিয়ে যতদূর দেখা যাচ্ছে সবই অধার ঘেরা নীলাভ আবরণ। চাঁদহীন আকাশের দিকে তাঁকিয়ে মুহুর্তেই মন খারাপ হয়ে এলো তার। মন খারাপের কারনটাও অজানা। মাঝে মাঝে মন খারাপের বিশেষ কোনো কারনের প্রয়োজন হয় না। মানুষ চাক আর না চাক কখনো সখনো সেটা খারাপ হবেই। প্রয়োজনে সে কাঁদাবে আবার প্রয়োজনে হাসাবেও।
আর মন? সে তো অবাধ্যতার আরেক রুপ। যার উপর পৃথিবীর কোনো নিয়ম কানুন কিংবা বাঁধা নিষেধ খাঁটে না। মন নামক বস্তুটাই বড় অদ্ভুত।ক্ষণে ক্ষণে রুপ বদলাতে তার জুড়ি মেলা ভার।কখনো এই ভালো তো কখনো মন্দ, কখনো আবার উত্তাল কখনো সে সুধীর।
এলোমেলো সব ভাবনাগুলো তাকে অস্থির করে তুলল। অচিরেই সে ব্যাকুল হয়ে উঠে। এই মুহুর্তে তার দু-দন্ড প্রশান্তির প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় পাবে সেই প্রশান্তি? মুহুর্তেই হুরায়রার মুখটা চোখে ভেসে এলো। একটা অন্যরকম অনুভূতি তার মনের কোণে ঢেউ খেলিয়ে চলে গেলো। আর কিছু ভাবলো না ইয়াদ ঘর থেকে বেড়িয়ে হুরায়রার ঘরের দিকে এগোলো।

পাশ ফিরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে হুরায়রা। সামনের কয়েকটা চুল এসে মুখের কাছটায় পড়েছে। দেখতে তাকে বড্ড মোহনীয় লাগছে। ড্রিম লাইটের মৃদু আলো তার সৌন্দর্য আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলেছে। ইয়াদ ধীরোস্থির ভাবে এসে মাটিতে হাটু গেড়ে হুরায়রার মাথার কাছে বসলো। হুরায়রার মায়াবী নির্মল চেহারার দিকে তাঁকিয়ে মুহুর্তেই একটা প্রশান্তি অনুভূব করলো সে। সারা দিনের সকল ক্লান্তি আর অবসাদ মুছে দুদণ্ড শান্তি দিলো হুরায়রার ঘুমন্ত মুখখানা। হৃদয়ের গহীনে থাকা উত্তাল সরোবর জোয়ার ভাটার উচাটন শেষে শান্ত উর্মিমালার দেখা পেলো। ইয়াদের মনের যত শ্রান্তি আর পরিশ্রান্তি সব যেনো নিমিষে মিলিয়ে গেলো হুরায়রার ঘুমন্ত মুখপানে দেখে।

হুরায়রার মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন একটা ঘোর লেগে এলো ইয়াদের। তার অবাধ্য মন বার বার চাইছে হুরায়রার ললাটে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতে। অথচ না ইয়াদ সেটা করতে পারলো না কারন? নাহ থাক ভেবেই সে মুচকি হেসে হুরায়রার পাশ থেকে উঠে আসে।
ঘর হতে বেড়িয়ে আসার পূর্বে আরেকবার হুরায়রার মুখের দিকে তাঁকিয়ে একটা প্রশান্তি ভরা শ্বাস নেয় ইয়াদ। সে জানে না তার ছোট্ট হুরের মাঝে এমন কি আছে শুধু জানে দিশাহারা জীবনে হুরই তার একটি মাত্র নাটোরের বনলতা সেন। যে তার তপ্ত হৃদয়ে দু-দন্ড শান্তি ঢেউ বয়ে আনে।
হুরায়রার মুখপানে তাঁকিয়ে ইয়াদ আনমনে উচ্চারণ করে বলল,

“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথিবীর পথে,
হিংহাল সমুদ্র হতে নিশীথের অন্ধকার মালয় সমুদ্রে,
অনেক ঘুরেছি আমি;বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে।
সেখানে ছিলাম আমি,আরো দূর অন্ধকার
বিদর্ভ নগরে।
আমি ক্লান্ত প্রান এক,চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়ে ছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্থীর কারুকার্য।
অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়ছে দিশা,
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভেতর,
তেমনি দেখিছি তারে অন্ধকারে।
বলেছে সে এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে চাওয়া নাটোরের বনলতা সেন।”
(জীবনানন্দ দাশ।)

(১৫)

এলার্মের উচ্চশব্দে ঘুম ভেঙে গেলো তিয়াশার। ঘুম ঘুম চোখে আড়মোড় ভাংতে ভাংতে ঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো সে। ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজে মাত্র। তার যতদূর মনে পড়ে গতকাল রাতে ঘুমানোর আগে সকাল আট টার জন্য এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিলো সে। তবে এত সকাল এলার্ম বাজার কারনটা কি সে তৎক্ষনাৎ বুঝে উঠতে না পারলেও পরোক্ষণে ঠিকই বুঝতে পারলো যে এটা নাবাদের কাজ। নাবাদের হুটহাট এমন বাঁদরামির জন্য তার প্রচণ্ড রাগ হতে লাগলো। বিছানা ছেড়ে অন্ধকার হাতরে জানাল পাশে গিয়ে দাঁড়ায় তিয়াশা। এখনো ভোরের আলো ঠিক করে ফুটেছে বলে তার মনে হলো না। জানালার কবাট খুলে পর্দা সরিয়ে নিতেই ফুরফুরে শীতল হাওয়া এসে তার গা ছুয়ে দিলো।বাহিরে ভোরের মৃদু আলো সাথে স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া প্রকৃতিকে যেনো নির্মল সজীবতায় ভরিয়ে রেখেছে। অজান্তেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।কিছুক্ষণ আগে নাবাদের উপর রাগ হলেও এখন সেটা আর হচ্ছে না। এমন একটা সুন্দর সকাল দেখে দিনের শুরু ভাবতেই তিয়াশার মন প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। দূরে কোথাও কাঁকা ডাকছে তিয়াশা সেটা কান পেতে শুনলো। ধীরেধীরে পূর্বাকাশ রক্তিম আভা ধারণ করেছে। তিয়াশার মনে হলো এমন একটা সময়কেই বোধহয় কাঁকডাকা ভোর বলে লোকে। গল্প উপন্যাসে কাঁকডাকা ভোরের কথা অনেক পড়েছে সে তবে বাস্তবিক জীবনে তার দেখা এই সময়টাকেই কাঁকডাকা ভোর বলে বোধগম্য হলো। গল্পে উপন্যাসে লেখক যেই কাঁকডাকা ভোরের রোমাঞ্চকর দৃশ্যের কথা বর্ণনা করেন বাস্তবিকভাবে সেটা তার চেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর। প্রকৃতির এক নিয়ম কোকিল মানেই সুমিষ্ট মধুর সুরেলা কন্ঠি আর কাক মানেই বেসুরালা। কোকিল মানেই সুরেলা কন্ঠি এটা একরকম সবারই অবগত কিন্তু ভোরবেলায় কাঁকের বেসুরো সুরও যে কতটা মধুর আর সুরেলা হতে পারে সেটা হয়তো মনুষ্যজাতির অজানা। তবে হ্যাঁ এটা ঠিক যে প্রকৃতিকে সেইভাবে অনুভব করা কিংবা দেখার দৃষ্টি হয়তো সকলের এক নয় তাইতো সবার কাছে প্রকৃতির রুপ রস আর গন্ধ একরকম নয়।

তিয়াশা বেশকিছু সময় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সকালের শুভ্রাতার পরশ গায়ে মাখিয়ে চোখ বুজে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বিছানায় ফিরে এলো।
ঘরের দুক্ষিণ পূর্বকোণ থেকে একটা সুমিষ্ট গন্ধ ভএসে তার নাকে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠে তিয়াশা। চাঁপা আর মধুমঞ্জুরি ফুলের সুবাসে পুরো ঘর মো মো করছে। সদ্য ফোটা ফুলের সৌরভ যেনো বাতাসের সাথে মিশে রয়েছে। এক অন্যরকম ভালোলাগার আবেশে জড়িয়ে যেতে লাগলো তিয়াশা, মুহুর্তেই আবার সচকিত হয়ে নড়েচড়ে বসলো। তার ঘরে এত সকাল চাঁপা আর মধুমঞ্জুরি ফুলের সুবাস আসার কথা নয় তবুও তার পুরো ঘর জুড়ে এই দুটো ফুলের মোহনীয় গন্ধ মো মো করছে। অনেকটা সন্দিহান হয়ে বালিশের পাশ হতে মোবাইল নিতে গিয়ে হাতে নরম কিছুর স্পর্শে চমকে উঠে তিয়াশা। অনেকটা ভয়ে ভয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে লাইট জ্বালতেই পুরো আশ্চর্যান্বিত হয়ে রইলো সে। চাঁপা আর মধুমঞ্জুরিতে ভরে আছে তার ঘর। ঘরের প্রতিটা কোণা খুব সুন্দর করে সেগুলো দিয়ে সাজানো।অনেকটা বিস্ময় আর হতবাক হয়ে চারদিকটা অবলোকন করতে লাগলো সে। হঠাৎ তার নজর পড়লো বালিশের কোণায়। এক গুচ্ছ পলাশ ফুল রাখা সেখানে। তিয়াশা রীতিমতো অবাকের সপ্তম আকাশে পৌঁছালো। গুটি গুটি পায়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায় সে। বিছানার কোণা হতে পলাশ ফুল হাতে নিয়ে সে আরো অবাক হলো।এগুলো শুধু পলাশ ফুল নয় বরং পলাশের গয়না।খোঁপার ফুল থেকে শুরু করে হাতের বালা পর্যন্ত সব কিছুই এখানে আছে। তিয়াশা এই মুহুর্তে কি করবে কি বলবে বুঝতে পারলো না। সকাল সকাল সে এত বড় একটা সারপ্রাইজ পাবে তা কল্পনাতীত।

বালিশের পাশে পলাশের গয়না ছাড়াও একটা চিরকুটে কুড়িয়ে পেলো সে। তাতে লিখা,
“আলমারি খুলে দেখো সেখানে একটা গোলাপি রঙের প্যাকেট রাখা আছে।”

তিয়াশা এইবার প্রচণ্ড আগ্রহভরে আলমারির দিকে ছুটে গেলো। আলমারি খুলতেই একটা গোলাপি প্যাকেট বেড়িয়ে এলো। তিয়াশা প্যাকেট হাতে করে বিছানায় ফিরে এসে সেটা খুলতেই একটা বাসন্তী রঙের সুতির শাড়ি বেড়িয়ে এলো যেটার আগা-গোড়ায় বাংলাতে প্রিন্ট করে শুভজন্মদিন সাথে রবীঠাকুরের “স্ফুলিঙ্গ”কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া কবিতার কয়েকটা লাইন,,,।
“জন্মদিন আসে বারে বারে,
মনের কারাবারে,,,
এ জীবন নিত্যই নূতন
প্রতি প্রাতে আলোকিত
পুলকিত
দিনের মতন,,,।

এটা দেখার পর তিয়াশার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছিলো না। এতটা অবাক সে আগে কখনো হয় নি। অজান্তেই খুশিতে তার চোখ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। তিয়াশা তো ভুলেই গিয়েছিলো যে আজ তার জন্মদিন। আর প্রতিবারের মতো এইবারো ইয়াদ তাকে এভাবে জন্মদিনের শুভেচ্ছা আর উপহার পাঠিয়ে সারপ্রাইজ দিবে না এমনটা যে হবে না সেটা সে ভুলেই বসেছিলো।

আজ ২৫শে ফাল্গুন তিয়াশার জন্মদিন। বরাবরের মতো এইবারো ইয়াদ এই দিনটাতে সবার আগে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তবে এইবার একটু ভিন্নভাবে। প্রতিবছর ভোরের আলো ফুটার সাথে সাথে ইয়াদ সশরীরে এসে তাকে এক গুচ্ছ পলাশ আর কাঠগোলাপ ধরিয়ে দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতো কিন্তু এইবার ইয়াদ এখানে নেই তাই বলে সবার আগে শুভেচ্ছা জানানোটা থেমে থাকে নি আজও সে সবার আগে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে।

“শুভ জন্মদিন আমার সোনা মামনি।”

দরজার কাছে মেহেরিমা মেহের আর ইশরাক এহসানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে তিয়াশার।

“একি বরাবরের মতো এইবারো ইয়াদ প্রথম শুভেচ্ছাটা জানিয়ে দিলো?”

“সেটা কি আর বলতে হয়? আমার ছেলে কি তোমার মত এত ঘুম কাতুরে যে নিজের একমাত্র ভাগ্নির জন্মদিনের দিনও পড়ে পড়ে ঘুমাবে তারপর বেলা করে উঠে তারপর শুভজন্মদিন কথাটা বলবে?”

“এই দেখো একদম বাজে কথা বলবে না বলে দিলাম ঘড়ির দিকে ভালো করে তাঁকিয়ে দেখো সবে পোনে সাতটা বাজে।ইয়াদ যে তারো আগে আমার প্রিন্সেসকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দিবে সেটা আমি কি করে বলবো বলো তো।”

“হ্যাঁ যেটা তুমি বাসায় বসে করতে পারো না সেটা আমার ছেলে গ্রামে বসে করে ফেলেছে তাও আবার এত সকালে হুহ।”

“হয়েছে হয়েছে তোমরা আবার এখন এটা নিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিও না প্লিজ?”

“আমি কোথায় ঝগড়া করলাম তোর মামি মা তো শুরু করেছে।”

“সেই যাই হোক দেখেছো বাবা বরাবরের মতো ভাইয়াই আগে ইউশ করেছে।তার মানে তুমি আর মা এইবারো ভাইয়ার কাছে হেরে গেলে।”
নাবাদের কথায় পিছন ফিরে তাঁকালো সবাই।নাবাদ এগিয়ে এসে তিয়াশার মাথায় চাটি মেরে বলল,

“শুভ জন্মদিন রাক্ষসী।”

“ধন্যবাদ নাবাদ।”

“এবার বলো ভাইয়ার করা এতসব সারপ্রাইজ কেমন হলো?”

“অসাধারণ রীতিমতো ভড়কে গিয়েছিলাম।”

এতোক্ষণ পর মেহেরিমা মেহের এবং ইশরাক ইহতেসাম উভয় লক্ষ্য করলেন তিয়াশার ঘর চাঁপা আর মধুমঞ্জুরিতে সাজানো।মেহেরিমা মেহের পুরোঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন তারপর অবাক অবাক হয়ে বললেন,

“ইয়াদ করেছে এত সব? বাহ ছেলেটা আমার বাড়ি নেই কিন্তু ঠিক ই সব আয়োজন করে রেখেছে।”

“কার ছেলে দেখতে হবে না?আমার ছেলে আমার।”

“এহ আমার ছেলে আমার ছেলে বলো না তুমি বাবা।ভাইয়ার সব প্লান অনুযায়ী কে কাজ করেছে আগে সেটা বলো?”

“হয়েছে নাবাদ ইয়াদের সব ক্রেডিট এখন নিজে নিতে এসো না।”

“উফ তিয়াশা তুমি সত্যিই খুব বোরিং।কোথায় আমায় থ্যাংকস দিবে যে ভাইয়ার প্লান মতো সব আমি করেছি তা না শুধু শুধু,,,।”

“হয়েছে হয়েছে এখন চুপ থাকো সবাই।আর তিয়াশা এই নে মা এটা আমার পক্ষ থেকে তোর জন্য উপহার।”

“কি এটা মামি মা?”

“খুলে নিজেই দেখে নিস।”

“কিন্তু মামি মা এত কিছুর কি দরকার ছিলো?”

“কোনো দরকারই ছিলো না হয়েছে?এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে নে আর চটজলদি তৈরি হয়ে নিচে চলে আয় তোর জন্য পায়েশ করছি।”

“সত্যি?”

“হুম তাড়াতাড়ি চলে আয়।”

“ঠিক আছে মামি মা তোমরা যাও আমি এক্ষুনি আসছি।”

মেহেরিমা মেহের এবং ইশরাক ইহতেসাম চলে গেলে নাবাদ এসে তিয়াশার বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়লো।

“জানো তো তিয়াশা এসব কিছু না ভাইয়ার পক্ষেই করা সম্ভব।”

“ইয়াদ যে আজো এইভাবে আমাকে সারপ্রাইজ দেবে ভাবি নি,আর সব থেকে বড় কথা হলো আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আজ আমার জন্মদিন।”

“হ্যাঁ সেটা তো ভুলবেই কারন মনে রাখার জন্য তো আমরা আছি তাই না।”

“তা ঠিক।তবে আমাদের পরিবারের এই ব্যাপারটা একটু ব্যাতিক্রম তাই না?”

“কোনটা?”

“এই যে জন্মদিনের ব্যাপারটা।এখনকার দিনে সবাই ইংরেজি মাস ধরেই জন্মদিন পালন করে।স্কুল, কলেজ,ভার্সিটি এমনকি চাকরী ক্ষেত্রেও বার্থডে টা ইংরেজি মাস ধরে হয় কিন্তু আমাদের পরিবার সম্পুর্ণ আলাদা একেবারে খাঁটি বাঙালী।আমাদের সবার জন্মদিন বাংলা মাস ধরেই পালন করা হয়।যদিও সার্টিফিকেটের ব্যাপারটা আলাদা।”

“হু আর সেটা একমাত্র দাদা জানের জন্যই সম্ভব হচ্ছে।আমার দাদাজান পৃথিবীর বেষ্ট দাদাজান।”

“তোমার দাদাজান তাই না আর আমার কি?”

“তোমার নানাজান হয়েছে?এখন চলো নিচে যাই নাহলে মা আবার শুরু করে দিবে।”

“হুম তুমি যাও আমি কিচ্ছুক্ষণ পর আসছি।”

নাবাদ চলে গেলে তিয়াশা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।শাড়িটাকে গায় জড়িয়ে নিজেকে ঘুরেফিরে বেশ কয়েকবার দেখে নিলো।তার চব্বিশ বছর জীবনে এটাই হয়তো ইয়াদের দেয়া সবচেয়ে মুল্যবান উপহার ছিলো।শাড়ির উপর হাত বুলিয়ে আয়নার দিকে আনমনে তাঁকিয়ে রইলো তিয়াশা।ইয়াদ কত সযত্নে তার জন্য এই শাড়িটা অর্ডার করে বানিয়েছে।শাড়ির মাঝে এমন কবিতার শব্দচয়ন আর জন্মদিন লিখে কারুকার্য করার আইডিয়াটা যে শুধু ইয়াদের মাথা থেকেই বের হতে পারে এই ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
চলবে,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here