তোর নামেই এই শহর পর্ব -০৭

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকাঃসুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_০৭

১৭)
কোমড়ে আঁচল পেঁচিয়ে শক্ত করে গুঁজে লম্বা একটা বাঁশের কঞ্চি হাতে করে পুকুর পাড়ের লম্বা পেয়ারা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো হুরায়রা। একটা ঝুড়ি নিয়ে হুরায়রার পেছন পেছন হুমাশাও এসে দাঁড়ায় সেখানে। হুরায়রা বাঁশের কঞ্চি হাতে নিয়ে গাছের আগাটা একবার পরখ করে দেখলো। তারপর বলল,
“হ্যাঁরে হুমাশা তোর কি মনে হয় এই কঞ্চি দিয়ে পেয়ারা নাগালে আসবে?”
“আমার তো মনে হয় আসবে।”
“চল আগে চেষ্টা করে দেখি নাগাল পাওয়া যায় কিনা।”
হুরায়রা বাঁশের কঞ্চি তুলে পেয়ারা পাড়তে লেগে পড়লো। গাছ বড় হওয়ায় কঞ্চি পেয়ারা পর্যন্ত পৌঁছালো না। হুরায়রা বেশ খানিকটা সময় ধরে দুই পায়ের আংগুলে ভর দিয়ে সেগুলো পাড়ার চেষ্টা করলো অথচ কঞ্চিটা পেয়ারা অবধি কিছুতেই পৌঁছাচ্ছে না। হুমাশা কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো মাঝে মাঝে সে দুই একটা কথা বলে পেয়ারার অবস্থান বলে দিচ্ছে হুরায়রাকে।
বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরো যখন একটা পেয়ারারও সে নাগাল পেলো না তখন হাল ছেড়ে গাছের নিচে বসে পড়লো। নিচে বসে কয়েকটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে আবার পেয়ারা গাছের দিকে তাকায় সে।
“উফ কি উঁচু গাছরে বাবা। হাঁফিয়ে গেলাম একেবারে।”
“এই মেজদি এতোক্ষণ হলো একটা পেয়ারাও তো পাড়তে পারলে না তুমি, আমি হলে কতো আগে পেড়ে পেলতাম।”
“হ্যাঁ পুরো পানি পথের যুদ্ধ তুই এক দিনে জয় করে ফেলতিস, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক আমাকে পাড়তে দে।”
“এই মেজদি ইনান ভাইয়াকে কে ডেকে আনবো ও পেড়ে দিবে?”
“এই একদম না ওই শয়তানকে ডাকার কোনো দরকার নেই,পড়ে দেখবি ও নিজেই সব খেয়ে আমাদের জন্য গাছের পাতা রেখে যাবে।”
“এই মেজদি দেখ দেখ ওই যে ওইখানে দুটো পেয়ারা,বেশ বড় হয়েছে তো।”
“কোথায়?”
“ওই যে দেখ একেবারেই কাছে, এই কঞ্চিটা দিয়েই নাগাল পাবে।”

হুরায়রা আবারো সেগুলো পাড়ার চেষ্টা করলো কিন্তু দুর্ভাগ্য এইবারো পারলো না।
” মেজদি চল ইয়াদ ভাইয়াকে বলি।”
“এইইই তোর মাথায় কি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই নাকি?উনাকে বলবি তুই পেয়ারা পেড়ে দিতে?”

হুরায়রার কথা শেষ হওয়ার আগেই ইয়াদ সেখানে এসে উপস্থিত হলো। ইয়াদকে দেখেও না দেখার ভান করে নিজের কাজে মন দিলো হুরায়রা। ইয়াদ হুরায়রার এমন ব্যাবহার দেখে বাঁকা হাসলো তারপর হুরায়রা হাত থেকে বাঁশের কঞ্চিটা এক টানে প কেড়ে নিয়ে দুটো পেয়ারা ছিড়ে একটা হুমাশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্যটায় কামড় বসিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে গাছের মোটা শিকড়ের উপর গিয়ে বসলো। হুরায়রা ইয়াদের এহেন কর্মকাণ্ড দেখে চোখ বড় করে ডেব ডেব করে তাঁকিয়ে রইলো। ইয়াদ একবার তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে পেয়ারা খাওয়ায় মন দিয়ে বলল,
“তোকে না বলেছি এইভাবে তাঁকিয়ে থাকবি না চোখ বেড়িয়ে আসবে।”
সঙ্গে সঙ্গে হুরায়রা ঠোঁট ফুলিয়ে নিলো। ইয়াদ কিঞ্চিৎ ভ্রুকুচকে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
“এতে করে বিশেষ কোনো ফল হবে না, এই মুহুর্তে তোর রসগোল্লার মতো ঠোঁট দুটো আমাকে নেশা ধরাতে ব্যার্থ। তোর ওই পঁচা ঠোঁটের চেয়ে আমার এই পেয়ারা ডের ভালো।”
“আপনি কি কিছুই বুঝেন না?”
“না বুঝার কি আছে, এই তো বেশ বুঝতে পারছি তোর ওই যে সাপের মতো লম্বা জিভটা? সেটা লক লক করছে আমার হাতে পেয়ারা দেখে।”
“এই যে শুনুন আমার না আপনার পেয়ারার প্রতি কোনো লোভ নেই, আমি নিজেই পেয়ারা পেড়ে খেতে পারি।”
“তো খা না,কে মানা করেছে।”

হুরায়রা জিভ বের করে একটা ভেংচি কেঁটে আবার নিজের কাজে মন দিলো। ইয়াদ জায়গায় বসে পেয়ারায় কামড় দিতে দিতে নির্লিপ্তভাবে বলল,
“পেয়ারা খেতে এসেছি। তোর অনাবৃত পেট দেখতে নয়। ওইটা ঢেকে দে না হয় পেয়ারা খেতে অসুবিধা হচ্ছে।”

মুহুর্তেই হাতের কঞ্চি ফেলে দিলো হুরায়রা। দ্রুত নিজের দিকে চোখ বুলিয়ে নিতেই দেখলো কোমড়ে পেঁচিয়ে রাখা আঁচলটা খুলে পেটের দিক থেকে সরে এসেছে। লজ্জায় হুরায়রা কান গরম হয়ে উঠলো। গাল দুটো গোলাপ রাঙা হয়ে উঠেছে। ইয়াদ তার উন্মুক্ত পেটের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেছিলো? ইশ! ভেবেই হুরায়রা লজ্জাবতী লতার মতো নুইয়ে যেতে চাইলো।
“ছিঃ লোকটার এত টুকু লজ্জা নেই। কেউ কখনো কাউকে এভাবে লজ্জা দিতে পারে কেউ শুনেছে কোন দিন?”
বিড়বিড় করে বলল হুরায়রা।
“যেটা পড়ে সামলে রাখতে জানিস না সেটা পড়তে তোর এত আগ্রহ কেনো? অন্য কাউকে দেখানোর বুঝি খুব শখ তাই না?”
“ছিঃ কি অ/শ্লীল আপনি?”
“আর তুই কি?”
“আমি কি মানে?”
“মুখে খুব কথা ফুটেছ দেখছি,এর পর আমি ছাড়া যদি কারো সামনে তুই শাড়ি পড়েছিস তবে তোর অনাবৃত পেট আর অক্ষত থাকবে না সিগেরেটের আগুনে জ্বালিয়ে দিবো।”
বলেই ইয়াদ গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। ইয়াদের কথার অর্থ বুঝতে পেরে হুরায়রা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বলল,
“যার প্রতি আপনার মনে এতটুকু প্রেম নেই তার উপর অধিকারবোধ খাটানো টা একরকম বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। অধিকারবোধের গর্জনে ভালোবাসা যে তিলে তিলে গুমরে মরছে সে টুকু বুঝার বোধবুদ্ধি টুকুও কি আপনার নেই?”

(১৬)
জুমার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে ইয়াদ দেখলো তার থেকে কিছুটা দূরে একজন সুদর্শন যুবক বাহুতে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াদকে দেখেই সে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। সেদিকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে সে নিজের জুতা খুঁজতে আরম্ভ করলো। তাকে জুতা খুঁজতে দেখে যুবকটি কয়েক কদম এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। বলল,
“মি.ইয়াদ ইহতেসাম আমার মনে হয় না আপনি আপনার চটিজোড়া আর খুঁজে পাবেন না।”

ইয়াদ জবাবে কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার হলো তার সাথে এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রায় সময় নামায শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে নিজের জুতার জায়গায় অন্য একজোড়া ছেড়া জুতা পড়ে থাকতে দেখে সে।
“কি হলো মি.ইয়াদ?”
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনিও নিজের জুতা হারিয়েছেন মি.সামির?”
সামির নিজের পায়ের দিকে একবার তাঁকিয়ে মুখে মলিন হাসি ফুটিয়ে বললো,
“না ঠিক তা নয় আমি জুতা হারাই নি।”
“তবে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার আবশ্যকতাটা কি বুঝতে পাড়লাম না।”
“সব কিছুর আবশ্যকতা বুঝতে হয় না মি. ইয়াদ।আমি যতদূর জানি এটা আপনারই মুখের কথা।চলুন সামনে যাই।”

ইয়াদ কিছু না বলে হাঁটতে হাঁটতে সামনে আগায়।ইয়াদ ভাবতে পারে নি সামিরের সাথে তার এইভাবে এখানে দেখা হয়ে যাবে। উভয় খালি পায়ে পাশাপাশি হাঁটছে। এই মুহুর্তের তাদের দেখে কেউ বুঝবে না যে উভয়ে মধ্যে একটা তিক্ততার সম্পর্ক রয়েছে।

কিছুটা দূর এগিয়ে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায় সামির। সামিরকে দাঁড়াতে দেখে সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাঁকায় ইয়াদ।
“মি.ইয়াদ এখন আমি আপনাকে একটা জিনিস দেখাবো দেখবেন?”
“হোয়াই নট?”
“ওকে কাম।”
সামিরের পেছন পেছন একটা জীর্ণশীর্ণ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় ইয়াদ। একেবারে ছোট্ট একটা উঠোন পেরিয়ে আধভাঙা কুঁড়েঘর। ঘরের সামনে একজন বৃদ্ধ মহিলাকে কিছু জুতায় রঙ করতে দেখলো ইয়াদ। সামির ইয়াদকে দেখিয়ে বলল,
“সামনে যাওয়া যাক?”
ইয়াদ কোনো অভিব্যক্তি না করে একেবারে বৃদ্ধার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বৃদ্ধ মহিলাটি ইয়াদকে দেখতে না পেলেও বুঝতে পেরেছে তার সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটি হাতরে পাশে থাকা লাঠিটা উঠিয়ে তাতে ভর দিয়ে দাঁড়াল। বলল,

“কে গা আপনে?এহানে কি চান?”
ইয়াদ দেখতে পেলো বৃদ্ধা এতোক্ষণ যে জুতা জোড়া রঙ করছে সেগুলো তারই হারিয়ে যাওয়া জুতা।
“কি হইলো কথা কন না ক্যান?”
“দাদী আপনি যে জুতা জোড়া রঙ করছেন এই জুতা জোড়ার দাম কত?”
সামিরের কথা শুনে মুহুর্তেই বৃদ্ধার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। খুশিতে আত্নহারা হয়ে বললেন,,
“আপনেরা জুতা কিনবার আইছেন?”
“জ্বী দাদী আপনি যে জুতাজোড়া রঙ করছেন সেগুলো আমার চাই। দাম কত জুতার?”
“দুইশ আঁশি টাকা বাপজান।”

সামির ইয়াদের দিকে তাঁকাতেই ইয়াদ পকেট থেকে পাঁচশো টাকার বের করে বৃদ্ধাত হাতে দিলো। টাকা হাতে পেয়ে বৃদ্ধার চোখ খুশীতে চকচক করে উঠে। বৃদ্ধাকে দেখে বেশ মায়া হয় তার।
“বাপজান এইহানে কত ট্যাকা আছে কন তো?”
“পাঁচশো টাকা দাদী।”
“এত ট্যাকা তো ভাংতি নাই আমার কাছে ফেরত দিমু ক্যামনে এহন?”
নিরাশ হয়ে বললেন বৃদ্ধা।
“টাকা লাগবে না আপনি এটা রেখে দিন।”
বলে ইয়াদ জুতা জোড়া পড়ে নিলো।
সামির সেখান থেকে কয়েক জোড়া দেখে নিজের জুতাটা খুঁজে বের করে সেগুলো পড়ে নেয়।তারপর বৃদ্ধার হাতে কিছু টাকা দিয়ে সেখান থেকে উভয় বেড়িয়ে আসে।

“কি বুঝলেন মি.ইয়াদ? নিজের হারানো জুতা নিজেই আবার টাকা দিয়ে কিনে নিলেন।”
” ব্যাপারটা সত্যিই কত অদ্ভুত।”
“এই বার বুঝতে পেরেছেন মসজিদের জুতা চুরির আসল ব্যাপারটা আসলে কি?”
“তিন হাজার টাকার জুতা দুইশো আঁশি টাকায় বিক্রি করছেন। সত্যি এই পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত।তবে একটা ব্যাপার বুঝিনি উনি কি করে জানলেন আমার জুতায় কি রঙ করতে হবে উনি তো চোখে দেখেন না।”
“বৃদ্ধার একজন নাতী আছে সে ই জুতা চুরি করে।হয়তো সে বলেছে।”

“হবে হয় তো। মি.সামির আপনি তো বললেন আপনার জুতা হারায় নি তবে?”

প্রতি উত্তরে সামির শুধু কিঞ্চিৎ হাসলো। এই হাসির পিছনের উত্তর ইয়াদ খুব সহজেই বুঝে নিলো তাই আর কিছু না বলে চুপচাপ চলতে শুরু করলো।
আরো কিছুটা পথ এগিয়ে এসে সামির আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর নিজের মধ্যে একটা গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব এনে ইয়াদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“বাই দ্যা ওয়ে কনগ্রাচুলেশন মি.ইয়াদ আমাদের পেয়ে যাওয়া টেন্ডারশীপটা কেড়ে নেয়ার জন্য।”
“সেইম টু ইউ আমার বিরুদ্ধে সেমিনার ডেকে আপনার মুল্যবান বক্তব্য ব্যয় করার জন্য।”
ইয়াদের কথা শেষ হওয়ার পুর্বেই সামির একটা বাঁকা হাসি দিয়ে সেখান হতে প্রস্থান করলো। ইয়াদ ভাবলেশহীন ভাবে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে পরে বাড়ির পথ ধরলো।

পুকুর পাড়ের শিমুলগাছের ডালে বসে অনবরত কোকিল ডেকে চলেছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে হুরায়রাও কুহু কুহু করে যাচ্ছে। হুরায়রা যত কুহু কুহু করছে কোকিল আরো বেশি চেঁচিয়ে ডাক ছাড়ছে ব্যাপারটা বেশ লাগলো হুরায়রার।
“এই হুরমতি এইভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেনো?”

পিছন থেকে ইনানের মুখে হুরমতি নামটা শুনে রাগে কটমট করে উঠলো হুরায়রা। চট করে উঠে ইনানের পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো। বলল,
“অ/সভ্য ছেলে কোথাকার আর যদি আমায় হুরমতি ডাকিস তবে মেরে তোর মুখ ভেঙে দিবো মনে রাখিস।”
“দিন দিন তুই একটা গু/ন্ডি হচ্ছিস সেটা তুই জানিস?”
“এইইই একদম পাকামো করবি না বুঝলি এসছে আমার কোথাকার কোন মাস্টার মশাই।”
“তুই তো আচ্ছা ফাজিল হয়েছিস হুরায়রা, তুই জানিস আমি তোর তিনমাস পাঁচ দিনের বড়?আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবি?”
“এহহহ আসছে আমার বড় ভাই তাকে নাকি সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে যা ভাগ এখান থেকে।”
“ইয়াদ ভাই তোকে এমনি এমনি শাস্তি দেয় না তুই দিন কে দিন যা পাঁজী হচ্ছিস তোকে শায়েস্তা করার জন্য তিনিই ঠিক আছেন।”
“তোর তো দেখছি সাহস কম না তুই আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস?”
“হু দেখাচ্ছি আজ আসুক ভাইয়া আমি তাকে বলবো তুই ক্লাস টেস্ট পরীক্ষায় কেমন বাংলায় ফেইল মেরেছিস।”
ইনানের মুখে কথাটা শুনে ধপ করে নিচে বসে গেলো হুরায়রা। সে বাংলায় ফেইল করেছে এটা যদি ইয়াদ জানতে পারে তবে আর তাকে আস্ত রাখবে না ভেবেই গলা শুকিয়ে এলো। বুকের ভিতর ইতিমধ্যে হাতুড়ি পিটুনি শুরু হয়ে গেছে। ইনান যা বজ্জাত সে নিশ্চই ইয়াদকে বলে দিবে। ইনান হুরায়রার চাচাতো ভাই। মালিহার বড় ছেলে এবং হুমাশার বড় ভাই। হুরায়রা ইনান দুজনি পিঠাপিঠি। দুটিতে সব সময় ঝগড়া মারামারি লেগেই থাকে। একজন অন্যজনের পেছন না লাগলে হয়তো তাদের পেটের কোন খাবারই হজম হয় না।

হুরায়রাকে ধপ করে বসে পড়তে দেখে ইনান বলল,
“কিরে সব বাঁদরামি বন্ধ হয়ে গেলো?”
হুরায়রা মুখে জোর পূর্বক হাসি টেনে ইনানের কাছাকাছি এসে কাছুমাছু করে বলল,
“ভাই তুই না আমার সব চেয়ে ভালো ভাই, তুই আমার এই সর্বনাশ করিস না ভাই। উনাকে তুই কিচ্ছু বলবি না বল?”
“এসো বাছা পথে এসো। শুন তোকে আমি বাঁচাতে পারি কন্তু একটা শর্তে।”
“কি শর্ত বল।”
“যা বলবো করবি তো?”
“আরে শালা বল না কি করতে হবে?”
“ওই যে তোর একটা বান্ধবী আছে না লিরা? ওর সাথে আমার লাইনটা করিয়ে দে না বোন।”
“এই কি বললি রে তুই আরেক বার বল? শালা তুই তো দেখছি আমার চেয়ে বড় ডাকাত।”
“এই দেখ তুই কিন্তু বলেছিস আমি যা বলবো তাই করবি।”
“আমি কি বলেছি লিরার সাথে তোর লাইন করিয়ে দিবো? মেরে তোর পিঠের ছাল তুলে নিবো আমি বলে রাখলাম?”
“তুই তো দেখছি মহা বেইমান, এই যে দেখ তোকে একটা জিনিস দেখাই।”
বলেই ইনানা তার পকেট থেকে একটা খাতা বের করে হুরায়রার সামনে মেলে ধরলো। তারপর ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“এটা দেখেছিস? এটা এখান থেকে সোজা ইয়াদ ভাইয়ের ঘরে চালান হয়ে যাবে।”
“শয়তান ছেলে তোকে আমি দেখে নিবো বলে রাখলাম। আমার খাতা দে বলছি।”
“তার আগে তুই বল যে লিরার সাথে আমার ইয়েএএ।”
“যা যা করে দিবো আগে তুই খাতা টা দে।”
দাঁতে দাঁত চেপে ভ্রুকুটি করে বললো হুরায়রা।
“কিন্তু তোকে বিশ্বাস করবো কি করে তুই যে আমার কাজ টা করবি?”
“কাল আমি যখন কোচিং এ যাবো তখন তুই আমার সাথে যাস তাহলেই হবে এখন আমার খাতাটা দে।”
“নো নো খাতাটা আমি তোকে দিবো না, তুই যে বজ্জাত মেয়ে খাতাটা হাতে পেয়ে ঠিক নিজের রুপ বদল করে নিবি, তুই গিরগিটি থেকেও খারাপ।”

ইনানের কথায় গা একেবারে জ্বলে উঠলো হুরায়রার। ইচ্ছা করছে ইনানকে ধরে আরো কয়েকটা কিল পিঠে বসিয়ে দিতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেটা সে করতে পারবে না কারন এই মুহুর্তে তার প্রাণভ্রমর ইনানের হাতে। তাই সে জোর করে রাগটা দমিয়ে রেখে ইনানের কথা চুপচাপ মেনে নিলো।

ইনান চলে যাবাবার পর হুরায়রা গুটিগুটি পায়ে ছাদ থেকে নেমে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো।এই মুহূর্তে তার মনে একরাশ ভয় কাজ করছে।ইয়াদ যদি সত্যি সত্যি তার ফেইল করার খবরটা জানতে পারে তবে আর আস্ত রাখবে না।

(১৯)

বেশ কিছু বছর হয়েছে সামির নিজ গ্রামে পা রাখে নি। বলতে গেলে শৈশব কাঁটার পর পরই সে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছিলো তার পরিবারের সঙ্গে। গ্রামের স্মৃতি তার খুব একটা বেশি মনে না পড়লেও কিছু স্মৃতি এখনো তার মনের কোণঘেঁষে বিস্তর জায়গায় জুড়ে রয়েছে। সামিরের জীবনের বেশির ভাগ সময়ই বিদেশে কেঁটেছে। এইতো দুবছর হলো সে বাবার জোরাজুরিতে দেশে ফিরেছে। আর এসেই পারিবারিক বিজনেসে নিজেকে নিযুক্ত করে নিয়েছে। একজন সফল ব্যাবসায়ি হিসেবে বিদেশে তার বেশ সুখ্যাতিও রয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে সামির যেমন নিষ্ঠাবান তেমনি দয়ালু। তার মাঝে গাম্ভীর্য বা দাম্ভিকতার বিশেষ কোনো ছাপ নেই বললেই চলে।সবার সাথেই তার ধরতে গেলে মিত্রতার সম্পর্ক শুধু মাত্র একজন বিশেষ ব্যাক্তি বাদে।

দু বছরে সামির বেশ কয়েকবার গ্রামে এলেও গ্রামটাকে তেমন ঘুরে দেখা হয় নি। কাজের চাপ আর সময়ের সল্পতা কারনে সময় করে উঠতে পারে নি সে। আজ হাতে কিছুটা সময় নিয়ে বেড়িয়েছে সে। উদ্দেশ্য গ্রামের সুরু পথ ধরে যতটুকু যাওয়া যায়। সামনে বিস্তর মাঠ মাঝে সুরু কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দুই ধার ঘেঁষে সবুজ ঘাস মাঝে মাঝে দুই একটা নাম না জানা বনফুলের গাছ তার ছোট্ট ডাল পালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে আবার রঙ বেরঙ এর বাহারি ফুল ফুটেছে। প্রজাপতি তার রঙিন পাখা মেলে উড়ে এসে বসছে।

স্নিগ্ধ সকালে এমন ধুলোমাখা পথ ধরে খালি পায়ে হাঁটতে বেশ লাগছে তার। গ্রামের সবুজ শ্যামলিমার নির্মল প্রকৃতিতে প্রান ভরে নিশ্বাস নেয়ার মধ্যে যে একটা প্রশান্তি ছোঁয়া পাওয়া যায় সেটা হয়তো পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মুদিত নয়নে বুক ভরে লম্বা শ্বাস নিলো সামির। মুহুর্তে তার শরীর মন দুটোই ফুরফুরে হয়ে উঠলো।
গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে এইভাবে একা একা হেঁটে চলা অভিজ্ঞতা তার আগে কখনো হয় নি। তবে তার প্রথম অভিজ্ঞতা নেহাত মন্দ নয় বেশ উপভোগ করছে সে। গ্রামের সুরু মেঠো পথ ধরে হাঁটার মাঝে একরকম সুখ অনুভব করলো সে যা আগে কখনো করে নি। হঠাৎ করেই তার একটা গানের কয়েক লাইন মনে পড়ে গেলো আর সেটাই সে গুন গুন করে গাইতে শুরু করলো,
“গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ,
আমার মন ভুলায় রে,,,,।”

হাঁটতে হাঁটতে অনেক টা দূর এগিয়ে এসেছে সামির। রাস্তায় শেষ প্রান্তে একটা বড় আম গাছ সেখানে এসেই থামলো সে।এই পথ দিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলেই ইয়াদের মামার বাড়ির রাস্তা চোখে পড়ে।

চারপাশে হাল্কা কুয়াশা আর ফুরফুরে বাতাস বইছে। দূরে একটা শিমুলগাছ দেখা যাচ্ছে। তাতে একরাশ লাল টুকটুকে শিমুল ফুল ফুটে আছে। হাল্কা বাতাসে সেগুলো দোল খাচ্ছে আর তার কোনো একটা শাখে বসে কোকিল অনবরত ডেকে চলেছে। শুকনো পাতার উপর পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেলো সামির। এই মুহুর্তে তার মন অজান্তেই প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে। ধরনীর বুকে যে বসন্ত নেমেছে প্রকৃতি যেনো চারপাশে তারই প্রামান দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনি বসন্তের কোনো এক সকালে খালি পায়ে ফাগুন হাওয়া গায়ে মাখিয়ে হাঁটার স্বপ্ন দেখতো সামির। আজ সে স্বপ্নটা যেনো তার ই হাতে ধরা দিয়েছে।

বেশ খানিকটা পথা হেঁটে একটা বড় পুকুর পাড়ের কাছে এসে থামলো সামির। জায়গাটা বেশ শান্ত আর নিরিবিলি মুহুর্তেই তার মন প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। এখানে দু-দন্ড দাঁড়াবে বলে মনস্থির করলো সে। আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে বড় জারুল গাছটার নিচে এসে দাঁড়াতে তার চোখ একটা জায়গায় গিয়ে স্থির হয়ে গেলো। সামির সহসায় সেদিক থেকে চোখ ফেরাতে পারলো না। এই দৃশ্য কিছুটা সময়ের জন্য তাকে অসাড় করে তুলেছে। সামির দেখলো পুকুরের অপর পাশে শানবাঁধানো ঘাটের উপর পনেরো কি ষোলো বছরের রমনী পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে। পড়নে কলাপাতা রঙের শাড়ি। চুল গুলো পিঠ ছাড়িয়ে কোমরের নিচ পর্যন্ত নেমে এসেছে। মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে পুকুরের জলের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একমনে কিছু বলে চলেছে মেয়েটি। শীতল চাহনিযুক্ত ডাগর ডাগর আঁখিদুটি যেনো নিমিষেই তার হৃদয়ের গহীনে প্রচণ্ডরকমের একটা ঝড় বইয়ে দিলো।

পানির দিকে মুখ বাড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে চেয়ে মুখটা বাকিয়ে নিলো হুরায়রা। মনে মনে নিজের উপর খুব রেগে আছে সে। অবশ্য নিজের উপর রেগে থাকার বিশেষ কোন কারণ আছে কিনা সেটা তার অজানা। বেশ কিছুক্ষন ধরে পানিতে পা ডুবিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো হুরায়রা।অচিরেই আবার পানির দিকে ঝুঁকে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে গাল ফুলিয়ে ভিড়ভিড় করে বলল,

“এই মেয়ে তোর মাঝে কি নেই যে তুই ওই রাবণের মন জয় করতে পারছিস না? আচ্ছা ওই রাবণটা কি সত্যি কোনো মানুষ? না হয় একটা মেয়ে তার পিছন পিছন এত ঘুর ঘুর করে তাও সে বুঝে না যে মেয়েটি তাকে কতটা ভালোবাসে?আচ্ছা উনি কি অনুভুতিহীন কোনো মানব যার হৃদয়ে এতটুকুও মায়া নেই। বিধাতা কি উনাকে পাথর খণ্ড করে সৃষ্টি করেছে যার গায়ে হাজারো অনুভুতির আছড় কাঁটলেও তাতে এতটুকু দাগ পড়ে না?”

“এই হুর এইখানে বসে বসে কি ভিড়ভিড় করছিস?”

পিছন থেকে ইনানের গলার স্বর পেয়ে সচকিত হয়ে উঠলো হুরায়রা। হাজারো ভাবনার জগৎ বেরিয়ে নিজের মাঝে ফিরে এলো। ইনান তখন ঘাটে দাঁড়িয়ে হুরায়রা ঘাড় ফিরিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে তাঁকায় তার দিকে। ইনানকে দেখে তার কাল রাতের কথা মনে পড়ল। গতকাল ইনানের জন্যই সে ইয়াদের হাতে ধরা খেয়েছে। ইনান নিশ্চই তার সাথে বেইমানী করে ইয়াদকে এক্সাম এর খাতাটা দেখিয়েছিলো। হাতের কাছে পেলে এখনি সে দুই ঘা লাগিয়ে দিতো। কিন্তু না পারলো না ইনান তার কাছ থেকে গুনে গুনে সাতটা সিঁড়ি উপরে। চাইলেও সে গিয়ে ধরতে পারবে না তার আগেই ছুটে পালাবে সে। তাই নিজেকে শান্ত রেখে বলল হুরায়রা,

“এখানে কি চাই তোর? আমার সর্বনাশ করেও তোর শান্তি হলো না আবার এখানে চলে এসেছিস? “কোমড়ে দু হাত ঠেকিয়ে রক্তচক্ষু করে দাঁড়িয়ে ইনানের দিকে তাঁকালো।
“এই এইভাবে তাঁকাবি না বলে দিলাম,আমি কিছু করি নি।”
“ওহ তুই কিছু করিস নি তাই না? তবে উনি জানলো কি করে আর খাতা টাই বা পেলো কোথায়?”
“বিশ্বাস কর হুর আমি কিচ্ছু জানি না। ভাইয়া কখন এসে আমার ঘর থেকে সেটা নিয়ে গেছে আমি জানি না।”
“তুই কিচ্ছু জানিস না তাই না?”
“হ্যাঁ বিশ্বাস কর।”
“ঠিক আছে আজকে কোচিং এ গিয়ে আমি লিরাকে বলবো তুই ওকে কালা কুত্তি বলেছিস আর বলেছিস কালো গাই তার পর দেখ কেমন লাগে।”
“ওই বোন ওই তুই না আমার ভালো পিচ্চু বিলাই এমন টা করিস না মাফ চাই। আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
“তুই আমার যে সর্বনাশ করেছিস তার চেয়ে এটা কিছুই নয় যা ভাগ এখান থেকে।”
“দয়া কর হুর মাফ চাই।”
“এখান থেকে যাবি নাকি আমি সব ছোট মা আর চাচ্চুকে বলে দিবো।”
“যাচ্ছি যাচ্ছি।”
“যা ভাগ এখান থেকে।”
“হুরের বাচ্ছা তুই দেখে নিস আমি তোর,,,।”
“এই কি বললি রে?”
“না না কিছু বলি নি যাচ্ছি।”
“পাঁজি ছেলে তোর জন্য ই সব হয়েছে। আমি তো তোকে দেখে নিবো।”

ইনান চলে গেলে হুরায়রা আবার নিজের কাজে মন দিলো।দুহাতে আঁজলা ভরে পানি তুলে মুখ চোখে ছিটিয়ে নিলো।আরো একবার পানি তুলে মুখে ছিটিয়ে দিতেই মনে হলো কেউ যেনো তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। পানির উপর থেকে চোখ তুলে আশপাশ টা ভালো করে দেখলো সে, নাহ তেমন কাউকেই সে দেখতে পেলো না। হয়তো তার মনের ভুল ভেবে সে আরো কয়েক আঁজলা ভরে পানি তুলে মুখ হাত ধুয়ে নিলো।
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here